Ticker

6/recent/ticker-posts

আপন ও পরবুদ্ধিজীবী - সলিমুল্লাহ খান

আপন ও পরবুদ্ধিজীবী

সলিমুল্লাহ খান


বাংলা ‘বু্‌দ্িধজীবী’ কথাটার চল সম্ভবত ইংরেজি ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ পদের তর্জমা আকারে শুরু হয়। ইংরেজিনবিশ বাংলার আগের বাংলায় একবচনে ‘বিদ্বান’ আর বহুবচনে ‘বিদ্বৎসমাজ’ লেখারই রেওয়াজ ছিল। ‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটা চালু হওয়ায় সমস্যা অতত দুই প্রত বেড়ে গেছে। বিদ্বান মাত্রই বু্‌দ্িধজীবী তবে বুদ্ধিজীবী মাত্রেই বিদ্বান নন। আর ‘বুদ্ধিজীবী’ পদটির সীমাহীনতাও আমাদের হাতের সমস্যার একমাত্র সীমা নয়।


১.

বুদ্ধিজীবী কি বস্তু? এ প্রশ্নের দক্ষিণে আরেক প্রশ্ন আছে, হয়তো আরও গাঢ় নীল সে প্রশ্ন: বুদ্ধিজীবী কে? সমাজে বুদ্ধিজীবী কি করেন? বুদ্ধিজীবীর ভেতরে কি আছে জানবার আগেভাগেই তাই জানা দরকার বুদ্ধিজীবীর বাইরে, মানে সমাজে কি আছে। ‘বাইরে’ কথাটা খাস করে বলা দরকার। কারণ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা যাই হোক, এ সংজ্ঞাকে আগে আলাদা করা চাই তার জুড়ি, তার অপর বা ‘অ-বুদ্ধিজীবী’ থেকে। তারপর আমরা দেখব সে সংজ্ঞার অসংজ্ঞা বা অজ্ঞান কি জিনিশ।


আমাদের যুগে ‘বুদ্ধিজীবীর বাইরে’ যে আছে সে কে? সে আর কেউ নয় শ্রমজীবী, শ্রমিক, খোদ মজুর। এই সংজ্ঞাটা তৈয়ের হয় যে যুগে বা মনে সে যুগে বা মনে বুদ্ধি মানেই ছিল ‘পরিশ্রমবিমুখতা’। শ্রম করত অন্যলোকে, বুদ্ধিজীবীর বাইরে, অপর কেউ। তাই বুদ্ধিজীবী পদের অর্থই তখন দাঁড়িয়েছিল ‘যে লোক পরিশ্রমী নয়, পরশ্রমী’। এ কথাটি বিশ্বাসের কথা, কল্পনার কথা, নিরেট সত্য নয়। বুুদ্ধিজীবীর মূলধন বিদ্যা। সে তো চিরকালই সাধনার ধন। বু্‌দ্িধজীবীর সংজ্ঞা বুদ্ধির ‘স্বভাব’ বা অন্দরমহল থেকে তৈয়ের হয় নাই। হয়েছে তার ‘পরভাব’ বা সদর থেকে। রাজার জ্যামিতি শেখার সহজ রাতা নাই। বাদশাহ সেকান্দর ও তদীয় গৃহশিক্ষক মহাত্মা আরতুর এই গল্প সেই সত্যেরই সাক্ষী। বুদ্ধিজীবীর অর্থই একদিন মনে হয়েছিল পরিশ্রমজীবী নয়, নেহায়েৎ পরশ্রমী। এর কারণ বুদ্ধিজীবীর ভেতরে ছিল না, ছিল বাইরে, সমাজগড়নের ভেতরমহলে। বুদ্ধিজীবীর বাইরে যে ছিল সে তো আর অন্য কেউ নয় শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, খোদ মজুর। বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার অজ্ঞানটা এখানেই প্রকাশ ছিল। আমরা তা চিনতাও করি নাই, তাই চিনতেও পারি নাই।


এতক্ষণ যা লিখলাম তা জগদ্বিখ্যাত এয়ুরূপ মহাদেশি বুদ্ধিজীবী মহাত্মা আতনিয়ো গ্রামসির (১৮৯০-১৯৩৭) কথার অনুবাদ মাত্র। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখছি। এই লেখার শেষ নাগাদ আমরা দেখব গ্রামসি পর্যত নিজের কথায় শেষ পর্যত নিজে স্থির থাকতে পারছেন না। খোদ শ্রমিকই যদি বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন তো বুদ্ধিজীবী-শ্রমজীবীর পুরাতন ভেদভিত্তিক জ্ঞানটা কি আর টিকতে পারে? বুদ্ধিজীবীর মানে তখন কি দাঁড়াবে? বুদ্ধিজীবীও এখন অধুনাতন যুগে পুঁজির রাজ্যে বেতনভোগী শ্রমিক। ওদিকে গ্রামসি বলছেন এই পরকালে আধুনিক ধনতন্ত্রে খোদ শ্রমিকও কিছু না কিছু বুদ্ধিজীবী হতে বাধ্য। বাধ্য উৎপাদন ব্যবহারের ভেতরের প্রয়োজনেই। কৃষকসমাজের অনেক লোক বুদ্ধিজীবী হয়, হয়ে উপরের শ্রেণীতে ওঠে, শহরে যায়। ততদিনে তারা আর কৃষক সমাজের বুদ্ধিজীবী থাকেন না। উপরের সমাজের পালিত সতান হয়ে ওঠেন। চাষি চায় তার ছেলে বুদ্ধিজীবী হোক, আলেম হোক, পাদরি হোক। ছেলে চাষি হোক তা চায় না চাষি মা-বাপ। গ্রামসি বলেন যে শ্রেণী নিজ সমাজে গৃহথ বুদ্ধিজীবী লালন বা পালন করতে পারে না সে শ্রেণী অপূর্ব নয়। এই হিসাবেই গ্রামসি বলেন এয়ুরোপ মহাদেশে সামতবাদ পর্বেও কৃষকশ্রেণী অপূর্বশ্রেণী নয়।


কিন্তু বর্তমান যুগের শ্রমিকশ্রেণী নিজেই নিজের বুদ্ধিজীবী লালন করতে পারে। সেই কারণেই এই শ্রেণী ‘অপূর্ব’ বা আমূল নতুন। বুদ্ধিজীবী মানে যদি ‘অশ্রমিক’ না হয় তাহলে বাকি থাকে কি? এই বাকি জিনিসটা কোন ‘জিনিস’ই নয়। এর নাম ‘সত্য’। সত্য কোন ‘বস্তু’ বা ‘চিজ’ হতে পারে না। কি তা হলে সত্য? এর উত্তর দেওয়ার জায়গা এখানে নাই। তবে নিশান আকারে বলে রাখি শ্রমজীবী-বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে মানুষ মাত্রেই আর এক ‘বড় পর’ বা পরমের অধীন। সে পরম কারণ তার কোন অপর বা পরম নাই। মানুষের ভাষা এই পরমের সবচেয়ে সহজপাচ্য উদাহরণ। পরমের সাথে অধমের সম্পর্কের মধ্যেই আছে সে সত্যের ইশারা। নিজের ভেতরের পরকে যে শনাক্ত করতে’ পেরেছে সত্যের দেখা সে-ই পেয়েছে।


আধুনিক যুগের শ্রমিক শুদ্ধ নিজের মজুরি বৃদ্ধিতেই জীবনের মোক্ষ দেখবে না। সমাজের সকলের মোক্ষই তার আপন মোক্ষের অপূর্ব শর্ত। এখানেই সে বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিজীবীতে আর মানুষে এই অর্থে ভেদ সামান্য। যে সত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, পরমের সঙ্গে প্রাণ যার বাঁধা একমাত্র সে অধমই বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীই মাত্র নি:সংকোচে প্রাণ দান করে। কোন কোন পাখি পত্রিকান্তরে প্রকাশ দলে দলে আত্মহত্যা করে। এই পাখিদেও নি:সন্দেহে বুদ্ধিজীবী উপাধি দেওয়া যায়।


২.

গোটা দুই ডিম ভেজে খায় নাই কিংবা ছেঁড়া কোর্তা রিপু করে গায়ে দেয় নাই এমন মানুষ দুনিয়ায় চারজন পাওয়া যাবে কি না সন্দেহের বিষয়। তাই বলে লোকে তাদের ‘বাবুর্চি’ কি ‘দরজি’ নামে ডাকে না। ঘোড়ার ঘাস কাটতেও সে রকম কিছু না কিছু বুদ্ধিশুদ্ধির ডাক পড়ে। তাই বলে মানুষ বুদ্ধিজীবী বা ইন্টেলেকচুয়াল বলতে ঘোড়ার ঘাসকাটা বোঝে না। জগদ্বিখ্যাত আতনিয়ো গ্রামসি (১৮৯০-১৯৩৭) বলতেন, ‘বুদ্ধিজীবী সকলেই, তবে ব্যবহারবিচারে পেশার হিসাবে কেউ কেউ মা্‌ত্র।’ বুদ্ধিজীবী সকলেই, কারণ সকলেই ভাষার জীব, পদের অধীন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর পেশা সকলেই গ্রহণ করেন না্‌ বুদ্ধিজীবী মানে ভাষা ব্যবহারের, পদের দাস বুদ্ধিজীবী নয়, পেশাবিচারের, ‘পদবীর’, ‘পদ বীর’ বুদ্ধিজীবী। ইংরেজির ন্যায় বাংলায়ও ‘বুদ্ধিজীবী’ এখন আর বিশেষণ মা্‌ত্র নয়, বিশেষ্য পদ হয়ে আছে।


‘বু্‌দ্িধজীবী’ নিয়ে সমস্যা আছে আরও একপ্রত। এ সমস্যা উঁচুনিচুর। বুদ্ধিজীবীসমাজেও শ্রেণীভেদ, না কথাটি ঠিক বললাম না, জাতিবর্ণভেদ আছে। ১৯৭১ সালের জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে বাংলাদেশের অগুণতি মানুষ পরান দিয়েছেন, তাদের আমরা শহিদ বলি। শহিদের একদলকে আমরা শহিদ বুদ্ধিজীবী বলি। আমাদের গ্রামের শহিদ চাষি সিপাহি হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ও আয়ুর্বেদজ্ঞ কবিরাজকে আমরা শুদ্ধ ‘শহিদ’ বলি কিন্তু ঢাকা শহরের কি জেলা সদরের শহিদ ডাক্তার অধ্যাপক সাংবাদিক আর এডভোকেট পেলে বলি ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী’। শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের ছেলেমেয়েরা যে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন সে প্রতিষ্ঠানেও কথা হয় কার বাবা বিশ্ববিদ্যালযে পড়াতেন আর কার কার বাবা মফস্বলে কলেজ শিক্ষক ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কি বুদ্ধিজীবী?


বাংলায় এখন আমরা বুদ্ধিজীবী বলতে উচ্চবর্ণের বিদ্বান বা বিদ্বজ্জন বুঝি। বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব বলতে সম্ভবত এই উঁচুতরের কথাই বোঝান হয়। জন্মসুত্রে মার্কিনদেশের ফিলিতিনি অধ্যাপক মহাত্মা এডোয়ার্ড সায়িদ বলতেন ক্ষমতাবানের মুখের ওপর অকপটে সত্য উচ্চারণ করাই বুদ্ধিজীবীর দায়। বুদ্ধিজীবী বলতে সায়িদও যে উঁচুতরই বোঝাচ্ছিলেন সে কথা কি পরিষ্কার নয়? এই বুঝেরও সমস্যা আছে। বুদ্ধিজীবীসমাজ কি চিরকালই একরকম থাকে? না, তারও ইতিহাস, মানে রূপাতর, আছে? থাকলে সে রূপাতরের হিসাব কি ভাবে মিলবে? হিসাবে গোল বাধলে অনেকে গোলে হরিবোল দেয়। আমরা দেখব সায়িদের কথায়ও সত্য আছে। তবে অন্য অর্থে। সায়িদেও বুদ্ধিজীবী সত্য বলবেন, কিন্তু সত্য কি বস্তু তিনি কিভাবে জানবেন।


৫৬ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্রাস্তের বছর? মোতাবেক ১৮৯৪ সালে? অরবিন্দ ঘোষের বয়স হয়েছিল ২২ বছর। অরবিন্দ লিখলেন, ‘তিনি মানে বঙ্কিম বানিয়ে দিয়েছেন একাধারে এক ভাষা এক সাহিত্য আর এক জাতি।’ বঙ্কিম আর অরবিন্দ দুইজনই বুদ্ধিজীবী লোক। এই ছিল তাদের সত্য। কী জাতি বানিয়েছিলেন তিনি? ঊনি বানিয়েছিলেন সেই জাতি যারা বলতে পারে ‘ইংরেজ মিত্ররাজা।’ আনন্দমঠ মহাকাব্যের শেষকথা বা মূলমন্ত্র এই নয় কি? অস্বীকার করার জো কোথায়? বুদ্ধিজীবীর জোর সাধারণ জোরজবরদচ্চি নয়। বুদ্ধিজীবীর সহজ উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


৩.

বুদ্ধিজীবী নিয়ে সহজকথা বলা শুদ্ধ মার্কিন মূল্লুকে কেন, এই সাম্রাজ্যের সব প্রদেশেই, গরিবের দেশ এই বাংলাদেশেও নিতাত সহজ নয়। সহজকথা মানে সত্যকথা। আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি।


এই গরিবের জীবন তেমন লম্বা নয়। এই খাট ছোট মফস্বল জীবনে বুদ্ধিজীবীর দেখা বেশি পাই নাই। যে দুই চারিজনের সাক্ষাৎ জুটেছে তার মধ্যে রাখঢাক না করে বলা দরকার পায়ের নখ থেকে মাথার খুলি পর্যত বুদ্ধিজীবী দেখেছি একজন মাত্র। নাম আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)। বুদ্ধিজীবী কথাটার তাৎপর্য বিচার তিনি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসীম ক্ষমার সীমার ভেতর ভালমন্দ সকলি মিলায়ে আমি বলতে বাধ্য তিনিও সত্য ঠাহর করতে পারেন নাই বুদ্ধিজীবী ঠিক কি বস্তু, কী চিজ। সেই দুঃখেই হয়তো আজকার এই প্রচারপত্র দাঁড় করাচ্ছি।


১৯৭১ সালে আগরতলা হয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন আহমদ ছফা। সেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদের আশ্রয়ে ঘুমানোর সুবিধা তিনি পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সনের ২৮শে জুলাই নাগাদ ছফার ধুরন্ধর, জিন্দাবিপ্লবী প্রবন্ধসংগ্রহ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ নামে ছাপা হয়। ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ ওরফে মুক্তধারা প্রকাশ করেছিলেন এই বই। লেখকের বয়স তখন টেনেটুনে ২৭-২৮ বছর। ঘটনাচক্রে ৩০ গ্রীষ্ম পর একই তারিখে ২০০১ সনের ২৮শে জুলাই মহান আহমদ ছফা ঢাকা শহরে এতেকাল করেন। ১৯৭১ সালের আগরতলা কলকাতায় আমাদের এই লেখকের অভিজ্ঞতাই ‘অলাতচক্র’ নামে বাংলা কথাসাহিত্যের এক অসামান্য দলিল হয়ে উঠেছে। এই সাহিত্যে কলকাতায় আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলানবিশ এক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আচারব্যবহার অবলম্বন করে ১৯৭১ সালের জাতীয় যুদ্ধ পরিচালনা নীতির আমূল বিচার ও সমালোচনা হাজির করেন আহমদ ছফা। পাকিতান পালিয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে শামিল তরুণ সেনানায়ক আবু তাহের ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত সমরনীতির যে সমালোচনা সেদিন হাজির করেন তার সঙ্গে আহমদ ছফার নীতিবিচারের ভাব দেখা যায় গলায় গলায়।


১৯৭২ সালে দেশে ফিরতে না ফিরতেই গরিব মহাত্মা আহমদ ছফা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে একগুচ্ছ প্রচারপত্র প্রথমে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ করেন। পরে ইশতেহার আকারেও আলাদা প্রচারিত হয় এই পত্রমালা। বইয়ের প্রথম বাক্যেই ছফা লিখেছেন: ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না আর এখন যা বলছেন শুনলে সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইটির পূর্বাভাস লিখেছিলেন খানদানি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, এককালের বিখ্যাত অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমর। আহমদ ছফার এই প্রচারকাণ্ড, জানালেন উমর সাহেব, বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে তাঁদেরই একজনের, জনৈক জ্ঞাতিভাইয়ের, নালিশ বৈ নয়।


বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী (ছফার রেওয়াজে বলতে ‘বুদ্ধিজীবীরা’) বুদ্ধিলব্ধ সত্যে মোটেও আস্থাবান নন, ওরা বেচারা। খালি জীবিকার পেছনে, খালি সুবিধার সন্ধানে ছোটাই ওঁদের নিয়তি। সারানুবাদে আহমদ ছফার অভিযোগের যোগফল দাঁড়ায় এই। ছফা বললেন বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী ভাবের গান লিখেছেন, পাকিস্তান গাছের গন্দম খেয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই একই বুদ্ধিজীবীরাই আবার জয়বাংলার, মানে অধুনাবিস্মৃত চার খাম্বার জয়ধ্বনি আওড়াচ্ছেন, এক কথায় তলারটাও কুড়াচ্ছেন। আহমদ ছফারটিত এইসব ঘটনা যদি মোটের ওপরও ঘটিত সত্য হয় তবে প্রশ্ন জাগে ‘এখান থিকা বাইরে যাইবা কোন পথে?’ ভাই আহমদ ছফাও সে কয়েকটা কথা পুরাপুরি আমল করেন নাই। যদি করতেন তো তিনি আবারও সেই একই বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকাবেন কেন? নিশিদিন ভরসা রাখার জায়গা তিনিও পান নাই, সত্য বলতে আমিও পাই নাই। এখানে তার দুয়েকটা তওবা তওবা কথা বলতে চাই। তবে আমি মনে হয় শুদ্ধ সমস্যার চেহারাটা দেখতে পেয়েছি।


বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজ এখন আর আহমদ ছফার মতন ‘বাংলার রেনেসাঁস’ ‘বাংলার রেনেসাঁস’ বলে চিৎকার আর করেন না, তাঁরা এখন ওনাসিস হতে চান। ‘বাংলার বুদ্ধিজীবীসমাজ আজ যা ভাবে তা ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবীসমাজ তা ভাবেন কাল।’ এই ধরণের সংষ্কারেও এখন আর বেশি লোকে ভোগে না। তবু বুদ্ধিজীবীসমাজ এক জাতীয় স্বয়ম্ভূ এমন কথা আজও অনেকেই ভেবে থাকেন। আহমদ ছফাও ভাবতেন।


৪.

তবে এহেন সংস্কার একা আহমদ ছফার নয়। অনেকের সংস্কার বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী বুঝি কোন এক আলাদা শ্রেণীর মানুষ। এই বুঝ কি ঠিক বুঝ? কথাটা পরিষ্কার করে বলেছেন আতনিয়ো গ্রামসি। গ্রামসি বলেন ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণী’ একটা কথার কথা মাত্র, আলাদা শ্রেণী নয়। প্রত্যেক অপূর্ব সমাজশ্রেণীই নিজ নিজ বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী গড়ে । কিছু সে মৌরসি নেয় পূর্বগামী অপূর্ব শ্রেণী থেকে আর কিছু জন্মায় তার নিজেরই ঔরসে। এয়ুরোপের ইতিহাসনিঙড়ানো উদাহরণ অনেক দিয়েছেন গ্রামসি। এখানে তার নমুনা মাত্র উল্লেখ করছি।


এয়ুরোপের ইতিহাসের যে পর্ব সামতবাদ নামে পরিচিত সে পর্বের অপূর্ব শ্রেণী একদিকে জমিদার অন্যদিকে চাষী। হজরত ঈসার উম্মতসংঘের সদস্য বুদ্ধিজীবীরাই গ্রামসির দেখা এয়ুরূপী জমিদারশ্রেণীর মৌরসি বা ‘পোষা’ বা ‘পালিত’ বুদ্ধিজীবীর পরম উদাহরণ। ‘পালিত’ কথাটি আমি গ্রামসিরই আঁকশি ব্যবহার করে বাংলার বিখ্যাত হিন্দু বুদ্ধিজীবী ভূদেব মুখোপাধ্যায় থেকে পাড়লাম। ভূদেববাবু ভারতবর্ষের মুসলমানদের বলেছিলেন ভারতমাতার ‘পালিত’ সতান। গ্রামসি যাদের ‘ট্র্যাডিশনাল’ বুদ্ধিজীবী বলেন তারাও অন্য কারও ‘পালিত’। আমরা তাঁদের ‘ভাড়াটিয়া’ও বলতে পারতাম। সমাজে বিপ্লব ঘটে। বিপ্লব মানে ওলট পালট, এক শ্রেণীর জায়গায় অন্য শ্রেণী ক্ষমতাসীন হয়। সম্পর্কের রূপবদল হলে ক্ষমতাসীন নতুন বা উত্তর শ্রেণী উত্তরাধিকারস্বরূপ পুরানা ক্ষমতাসীন বা পূবের অপূর্র্ব শ্রেণীর আপন সতানতুল্য বুদ্ধিজীবীদের কাজে নিয়োগ করে। তারা ‘পালিত’ সন্তান সন্দ্‌েহ কি!


আহমদ ছফা যে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নালিশ খাড়া করেছিলেন তাঁরা একসময় পাকিতানপন্থী ছিলেন, পরে বাঙ্গালি হয়েছেন, ছফার ভাষায় ‘তাও ঠেলায় পড়ে’। মহাত্মা ছফা একটা কথা মাত্র ভুলে গিয়েছিলেন। বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে একদা জনপ্রিয় পাকিতান আন্দোলনও একটা আপন সমাজজাত বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী খাড়া করতে সক্ষম হয়। তাদেরই ছোট একটি অংশ বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, অনেকে আর বাংলাদেশে বসবাসও করে নাই। মোহাম্মদ মোহর আলী কিংবা সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়নের নাম এই প্রসংেগ নেওয়ায় আশা করি অন্যায় হয় না। কিন্তু সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবুল ফজল, কবি শামসুর রাহমান কিম্বা বেগম সুফিয়া কামালের বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীতে রূপাতর ছফার অকল্পনীয় হবে কেন?


ক্ষমতাসীন নতুন বা অপূর্ব শাসকশ্রেণীর আপন সতানবৎ বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর নাম গ্রামসি রাখেন ‘ঔরসি বুদ্ধিজীবী’ বা কোলের সতান বা আপনজন। আমরা বলতে পারতাম ‘গৃহস্থ’ বুদ্ধিজীবী’। ইংরেজি তর্জমাকাররা এঁদেরই নাম রেখেছেন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’। সমাজ পরিবর্তনকামী প্রত্যেক অপূর্ব শাসক শ্রেণীর আপন বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী থাকবেই। এই আপন বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর তাঁবেদার হবেন ‘পালিত’ বা ‘ভাড়াটিয়া’ বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী। যদি না হয় তো বিপ্লব ফল প্রসব করবে না। বাংলাদেশে যে সমাজবিপ্লব আহমদ ছফা প্রার্থনা করেছিলেন তা ফল প্রসব করে নাই। কেন কওে নাই তার একটা উত্তর তো এখানেই মিলছে। তাই আমাদের খোঁজ করতে হয় ‘গৃহথ’ বুদ্ধিজীবীর। আহমদ ছফার অনেক নালিশের জন্ম এই মনোমালিন্যের ভেতর। তিনি মালিকের ভাড়াখাটা বুদ্ধিজীবীদের বিরূদ্ধে অনুযোগ করছিলেন তারা কেন শ্রমিকের বুদ্ধিজীবী হবেন না। দীর্ঘদিবস দীর্ঘরজনী পরের অধীনে বসবাস করতে করতে মানুষ পরম সত্য ভুলতে বসে। পরাধীনতার নানা বিকারের মধ্যে এই বিকারও পড়ে।


৫.


কার্ল মার্কসের নিকটতম আত্মীয় দার্শনিক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস কোন এক জায়গায় বলেছিলেন ‘চিতা করার মতো দার্শনিক আর লড়াই করার মতন শ্রমিক যখন আমাদের সঙ্গে তখন আমাদের জয়যাত্রা ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কে রাখে!’ এই কথার ভেতরে একটা ফাঁকও আছে। এই ফাঁকটাই পরে উন্নীত হয় ফাঁকির মর্যাদায়। এই নীতি মূলধন করেই জার্মান সমাজতন্ত্রী দলের নেতা কার্ল কাউটস্কি প্রভৃতি দার্শনিকের ব্যবহার দাঁড়িয়েছিল। সে দলের বুদ্ধিজীবীর বেশির ভাগই এসেছিলেন পুরানা শাসকশ্রেণীর আপন বা ‘গৃহথ’ বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী থেকে। তারা তো শ্রমিক হন নাই আর শ্রমিকদের বুদ্ধিজীবী করে গড়ে নেবেন সে সুযোগও পান নাই।


রূশ সমাজতন্ত্রী দলের নেতা বুদ্ধিজীবীশ্রেষ্ঠ লেনিন শ্রমিকশ্রেণীর দলে একদিকে বুদ্ধিজীবী আর অন্যদিকে মজুর এই পুরানা ভাগাভাগিটা বিলোপের পথ প্রতাব করলেন। তিনি বললেন শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক দল মানে শ্রমিকশ্রেণীর নতুন বুদ্ধিজীবী। ইংরেজিতে একেই বলে ‘ভ্যানগার্ড’ বা সামনের কাতার। ধনিক শ্রেণীর পালিত বুদ্ধিজীবীরা এখানে আসবেন বটে তবে পুরানা বুদ্ধিজীবীর জামাটা খুলে আসবেন। আগের গো ধরে থাকবেন না। আলাদা বসবাস করবেন না্‌।


লেনিনের এই বিচারের সঙ্গে আঠারো আনা একমত আতনিয়ো গ্রামসি। তবে একটা নতুন কথাও তিনি যোগ করেছেন। সে কথাটি অপূর্ব। তিনি বললেন শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে যেমন সামনের কাতার নতুন বুদ্ধিজীবী বা নতুন ক্ষাত্রশক্তি (মহাত্মা মাকিয়াভেল্লির ‘প্রিন্স’ মানেও একালের বিপ্লবী পার্টি? এ বাক্যটিও গ্রামসির) তেমনি সমাজের মধ্যেও শ্রমিকশ্রেণীকে নতুন নেতা হয়ে উঠতে হবে। নেতা হতে হলে বুদ্ধিজীবী হওয়া বিনে গতি নাই। খোদ শ্রমিক শ্রেণীরই কর্তব্য দাঁড়ায় সমাজের প্রথম কাতার বা বুদ্ধিজীবী হওয়া। সত্যের দেখা না পাওয়া অবধি এই জাতীয় নেতা হওয়ার যোগ্যতা বা ‘এগেমনিয়া’ তার আয়ত্তে আসছে না।


পুরানা শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী দিয়ে?কি ‘পালিত’, কি ‘গৃহথ’? শ্রমিকশ্রেণীর কাজ হবে কতখানি? গ্রামসি বলেন সে উত্তর নির্ভর করে শ্রমিকশ্রেণীর আপন বা গৃহত বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী কতখানি পাকা তার ওপর। একদিন বুদ্ধিজীবী মানে ছিল যাদুকর, যাদুর চেরাগধরা আলায়ুদ্দিন। চেরাগের এক ঘষায় সত্য? মানে দৌলত? এসে ঘর ভরে দেবে। আর এক যুগে বুদ্ধিজীবী মানে ধর্মবাদক, অবতার বা পয়গাম্বর। মানুষ সত্য ভাবে না, অবতার ভাবে।


১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন অধ্যায়ে মৌলানা আবুল খালাম আজাদ লিখেছেন ভারতবর্ষের বিতর মানুষ ভাবতেন কোন না কোন মন্ত্রের জোরে কিংবা সামান্য মানুষ জানেন না এমন কোন অজ্ঞান পথে দেশের স্বাধীনতা এনে দেবেন গান্ধিজি। দুঃখের মধ্যে অনেকে আরও ধরে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার খাতে সে জন্য কারো আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলার দরকার নাই। যা করবার গান্ধি মহারাজ করবেন। বর্তমান যুগে বুদ্ধিজীবী মানে ‘বৈজ্ঞানিক’, ‘বিজ্ঞানী’ বা ‘বিশেষজ্ঞ’। সত্য কি তা বৈজ্ঞানিক জানেন। আর আমাদের চিতা করার সময়ও বা কোথায়? খোদ গান্ধিজির রাজনীতি ধর্মাশ্রয়ী বলে অনেক নিন্দামন্দ হয়েছে। ধর্মবাদ্যও এক প্রকার যাদুবিদ্যা ওরফে মোজেজা (ওরফে মুসার লাঠি) আশ্রয়ী বলে গালিগালাজ কম হয় নাই।


আগের যুগের কি যাদু, কি ধর্মবাদ্য আর একালের বিজ্ঞান কোনটাই সত্য আবিষ্কার করতে পারে না। অতত আজও পারে নাই। কিন্তু কেন পারে না সে জিজ্ঞাসা খুব বেশি কেউ আজ তর্ক করে সারতে পারেন নাই। গুজব আছে আমাদের জমানা বিজ্ঞানের জমানা। বিজ্ঞানে আমাদের বিশ্বাস অগাধ। একদা আমরা যাদু কিম্বা ধর্মে যেভাবে ঈমান এনেছিলাম আজ বিজ্ঞানেও আমাদের তেমন আস্থা আমদানি করেছি। আমাদের ঈমানদার বিজ্ঞানী বন্ধুদেও, বেশি নয়, একখানা সওয়াল করুন: কেন বিজ্ঞান? তারা জওয়াব করবেন ‘বিজ্ঞানে কাজ হয়, দাদা, কাজ হয়।’ যাদুতে কাজ হয়, হয় ধর্মবিশ্বাসেও। আজিকালি যাদুবিজ্ঞান আর ধর্মবিজ্ঞানের বেশ চাহিদা ধরেছে। বাজিকর আর পয়গম্বরের জমানা আর নাই। কিন্তুু বিজ্ঞানী আর বুদ্ধিজীবীর জমানা দুয়ারে দাঁড়ায়ে। এ বিজ্ঞান আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? পজিটিভিজম বা বিজ্ঞানবাদ বুর্জোয়া সমাজের বিকার। আপসোস, আমরা অনেকে না বুঝে এই বিকারের আরেক নাম রেখেছি কঠিন গান্ধার, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ। বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে নতুন ধর্মতত্ত্ব। বিগ ব্যাং।


কিন্তু সত্যের চিরস্থায়ী কোন বন্দোবত কায়েম হয় নাই। সত্যকে প্রতিদিন নতুন করে, আপনার করে পেতে হয়। আতনিয়ো গ্রামসির লেখায় আছে বর্তমান যুগের বুদ্ধিজীবীরা মূলত বিজ্ঞানীই। আধুনিক পুঁজির যুগের পরেও যদি কোন মানবযুগ কল্পনা করার থাকে তবে সে যুগেও বুদ্ধিজীবীর পথ হবে এই বিজ্ঞানী ও কারিগরদের পথই। কিন্তু আমার সন্দেহ গ্রামসিও পুরাপুরি দূর করতে পারেন নাই। বস্তু কি জিনিশ তার উত্তর না দিলে বিজ্ঞান কি বস্তু তা আমরা বুঝব কি করে? যে বিজ্ঞান যাদু নয়, ধর্মকল্পনা নয়, সে বিজ্ঞান তো আজকের ইহবিজ্ঞানও নয়। বুদ্ধিজীবীর কাজই হয়তো এই। এই অশান্তির বীজ বপন করা।


সত্য বা অসত্য কারিগরি বা কৌশলের মামলা নয়। কাজের মানুষ (ওমো ফবের) আর রসের মানুষ (ওমো সপিয়েন) আলাদা মানুষ নয়। কাজের মধ্যে রস আর রসের মধ্যেই কাজ। সমাজ গড়ার স্বার্থে মানুষ যে সত্যকে চাপা দিয়েছে যে সত্যের সঙ্গে দেখা হয় নাই দোয়েলের, ফড়িঙ্গের সে সত্যের আবিষ্কার, সে সত্যের দেখা পাওয়াই বুদ্ধিজীবীর দায়।


Post a Comment

0 Comments