Ticker

6/recent/ticker-posts

খ্যাপাশিল্পী প্রখর দার্শনিক প্রবল বক্তা এবং একজন অসাধারণ সৃজনশীল শিল্পীর প্রতিকৃতি সেলিম আল দীন : ড. আফসার আহমদ

গত ১৪ জানুয়ারি ছিল সেলিম আল দীন প্রয়াণের প্রথমবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ভোরের কাগজের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে সেলিম আল দীনের শিল্প-দর্শন, জীবন ও কর্মের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন তারই ছাত্র ও সহকর্মী লেখক, গবেষক অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- হারুন রশীদ

ভোরের কাগজ : সেলিম আল দীন প্রায় এক বছর হলো আমাদের মাঝে নেই। তার একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে আপনি সেলিম আল দীনের এই অনুপস্থিতিতে তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে চান।

আফসার আহমদ : সেলিম আল দীন মারা গেছেন- এই ‘মারা যাওয়া’ শব্দটা না বলে আমি যদি বলি যে সেলিম আল দীন আমাদের সঙ্গে শারীরিকভাবে নেই তাহলে তার বয়স এক বছর হলো। কিন্তু আমরা তার সহকর্মী হিসেবে যারা আছি, আমার কাছে এই এক বছর সময়টা অনেক দীর্ঘ মনে হয়েছে। কারণ আমি প্রতিদিন বিভাগে তার অনুপস্থিতিটাকে স্মরণে রেখেছি এবং আমরা তাকে ভুলতে পারিনি। আমি ভুলতে চাইলেও সেলিম আল দীনকে আমার পক্ষে ভুলা সম্ভব নয়। ভুলা যায় না এ কারণে যে, সেলিম আল দীন আমার শিল্প চৈতন্য গঠনে যেমন ভূমিকা রেখেছেন এবং শিল্পবোধটাকে উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রেও তার অবদান রয়েছে। নাটকের গড়ন গঠনের ক্ষেত্রে আমার যে শিল্পবোধটা সেখানেও সেলিম আল দীনের ভূমিকা রয়েছে সেটা এখন আমি তীব্রভাবে অনুভব করছি। তার মূল্যায়নটা এখনো সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হবে না, কারণ এখন মাত্র এক বছর তাকে হারিয়েছি। যতোই দিন যাবে, তাকে মূল্যায়নের পরিধিটা ততোই বিস্তৃত হবে। সেলিম আল দীন ততোই নতুন করে আমাদের সামনে দেখা দেবেন। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার আছে, আজকে বাংলাদেশের শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কবিতা নাটক কথাসাহিত্যে অন্যরা যতো ক্ষয়ে যাচ্ছে সেলিম আল দীন ততো প্রবল হচ্ছেন কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে। এটা আমার মনে হয়েছে তার প্রয়াণের এক বছর পরে মূল্যায়ন করতে গিয়ে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের বিভাগের ক্ষেত্রে আমাদের মাথার ওপর যে ছাদটা সরে গেছে, সেলিম আল দীন থাকলে রোদ বৃষ্টি ঝড় এতোটা লাগতো না। আমি যে ছাতাটা ধরে আছি সেই ছাতাটা সেলিম আল দীনের মতো এতোটা বিস্তৃত নয়।

ভো. কা. : আপনি ছাত্রজীবনে সেলিম আল দীনকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন একই সঙ্গে সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছেন। তো শিক্ষক সেলিম আল দীনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

আ. আ. : সেলিম আল দীন আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি কখনোই সেলিম আল দীনকে আমার সহকর্মী হিসেবে ভাবিনি। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বাংলা বিভাগে ভর্তি হই তখন সেলিম আল দীনকে পাই তরুণ টগবগে প্রাণবন্ত একজন শিক্ষক হিসেবে। অনবরত তিনি শিল্পের নানা জায়গায় ছুটে চলেছেন। তখন তার শকুন্তলা পর্ব। আমি যতোই বড় হচ্ছি, আমার যতোই বয়স বাড়ছে সেলিম আল দীনও চোখের সামনে ততোই পরিণত হয়েছেন। তবে সেলিম আল দীনের নাটকের যে বিচিত্র বাঁক বাকান্তর তার সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকেই আমার পরিচয় ছিল। ছাত্র হিসেবে সেলিম আল দীনকে আমি দেখেছি। ক্লাসরুমে তিনি যতোটা শিক্ষক তারচেয়ে বেশি শিক্ষক তিনি ক্লাসের বাইরে। আমাদের যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তা ব্ল্যাকবোর্ড এবং ছাত্রছাত্রীকেন্দ্রিক। ব্ল্যাকবোর্ড এবং ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রাণের সংযোগ থাকে না। সেলিম আল দীন তার শিক্ষক জীবনের শুরুতেই এটা মানতেন না। কিন্তু সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো বা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল তাতে অনেকেই সেলিম আল দীনের এই তত্ত্বটাকে মানতো না। মনে করতো সেলিম আল দীন এগুলো ফাঁকি দেয়ার জন্য বলে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারি সেলিম আল দীনের যে শিক্ষাব্যবস্থা ক্লাসরুমের বাইরে নতুন কিছু শিক্ষা দেয়া, নতুন শিল্পতত্ত্ব এবং শিক্ষার সঙ্গে প্রাণের সংযোগ সাধন। একবার আমাদের এক ক্লাসে সেলিম আল দীন বললেন, শিল্প যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় অর্থাৎ ঝঁনষরসব-এ পৌঁছায় তখন শিল্পের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। শিল্পের ফর্মের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য থাকে না। আমি সেই সময় অনার্স ক্লাসের একজন ছাত্র হিসেবে শিল্পের এই ব্যাপারটা বুঝিনি। সেলিম আল দীন বললেন নৃত্যশিল্পীর নাচ, একটা শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের গোল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, শেক্সপিয়রের নাটক যখন শিল্পের চূড়ান্ত একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, তখন শিল্পের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। পরবর্তীকালে সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। এবং তিনি বললেন যে, নাটকের ফর্মের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য থাকবে না। সেই সেলিম আল দীন ক্লাসে যখন পড়াতেন তখন নিজেও তিনি জানতেন না তিনি আসলে কী ভাবছেন। সেলিম আল দীনের শিল্পবোধের সূচনাকালের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম, আমি দেখেছি সেলিম আল দীন শিল্পভাবনার অধিকাংশ স্ফুরণ ঘটিয়েছেন ক্লাসরুমে। এই গেলো আমার শিক্ষক হিসেবে সেলিম আল দীনকে দেখা। পরবর্তীকালে আমার সহকর্মী হিসেবে তাকে দেখেছি। পেছন ফিরে আরেকটা কথা বলি। আমার ছাত্র জীবন থেকে সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরেছি। আমাদের গ্রামে গেছি। আমার মনে আছে, আমি যখন কালিগঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে নৌকা নিয়ে যেতাম, তিনি তখন বলতেন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার জন্য। এবং তিনি এও বলতেন আমাদের দেশে নাটককে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার জন্য কোনো বিদ্যাপীঠ নেই, বিভাগ নেই। তো আমরা চেষ্টা করব এটা করতে পারি কি না। তখনো কিন্তু আমরা জানি না, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তখন আমি ছাত্র, তিনি শিক্ষক। তো এই মানুষটা যখন একদিন আমাকে বললেন, কবিতা লেখার দিকে মনোযোগ দিও না বেশি, কারণ কবিতা লিখে কোনো লাভ নেই। একজন ভালো নাট্যকার হও, একজন ভালো নাট্যকারের মধ্যে একজন ভালো কবির গুণ থাকে। ভালো কবির ভালো নাট্যকার না হলেও চলে। কিন্তু ভালো নাট্যকারের অবশ্যই একজন ভালো কবি হতে হবে। তুমি যদি নাটক লেখ তাহলে তোমার কাব্যিক প্রতিভাটাও এর মধ্যে বিকশিত হবে।

আমি যখন বাংলা বিভাগের শিক্ষক হলাম, তখন তিনি খুব খুশি হলেন। বাংলা বিভাগে যোগদান করার পর আমি উপাচার্য আ ফ ম কামালউদ্দিনের ভাষণ লিখে দিতাম। একবার তার সিনেট বক্তৃতা লিখতে গেলে তিনি আমাদের বললেন, একটা কৌশল কর, বক্তৃতায় একটা বিভাগের কথা লিখে দে, তুই লিখলেই উনি পড়বেন। আমি তখন সেখানে ‘ড্রামাটিকস’ বলে একটা শব্দ ঢুকিয়ে দিলাম। সিনেটে সেটা পাস হয়ে গেলো। তারপর আমি সেলিম স্যার মিলে তাকে বললাম নাট্যতত্ত্ব নামে একটা বিভাগ খোলার জন্য। তখন তিনি সিন্ডিকেট থেকে একটি বিভাগ পাস করে দিলেন। পরবর্তীকালে নাম সংযোজন হলো, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। উপাচার্য কামাল উদ্দিন স্যারকে এ ব্যাপারে তাগাদা দেয়ার জন্য সহকর্মী হিসেবে সেলিম আল দীন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, আমি নিজেও একবার সিন্ডিকেট মেম্বার ছিলাম- তো আমরা সমস্ত প্রচেষ্টাকেই কাজে লাগিয়েছিলাম শুধু একটা বিভাগ খোলার জন্য। কখনোই সেলিম আল দীন শিল্প পথভ্রষ্ট হতে আমাদেরকে শিক্ষা দেননি। বলতেন যে, আমাদের যেখানে যতোটুকু ক্ষমতা থাকুক তা দিয়েই আমরা আমাদের শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। আমার সৌভাগ্য যে, সেলিম আল দীনকে আমি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম এবং পরবর্তী সময়ে সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছি। এবং তখন আমি দেখেছি যে, একটি কঠিন বিষয়কে কতোটা সহজভাবে বলা যেতে পারে এবং তার কাছে আরো শিখেছি শিল্প এবং শিক্ষকতা, এর মধ্যে যদি কমিটমেন্ট না থাকে তাহলে তা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এমন অনেকে আছে যারা শিক্ষকতাকে একটা চাকরি হিসেবে নেয়। শিক্ষকতাকে যদি চাকরি হিসেবে নেয়া হয়, তাহলে একটা আলু-পটলের ব্যবসা করা যায়। আলু-পটলের ব্যবসা এবং শিক্ষকতা এক নয়। যার জন্য এবং আমরা সেলিম আল দীনের কাছ থেকে এই শিক্ষা নিয়েছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার পেছনে এই দেশের মানুষের টেক্সের পয়সা থাকে, সুতরাং একজন শিক্ষক হিসেবে এই দেশের শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশকল্পে নিরন্ন মানুষের সঙ্গে থাকা উচিত। যার জন্য সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমরা যখন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হলাম, তখন কিন্তু আমরা এই নিরন্ন মানুষগুলোর শিল্পবোধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলাম। এবং এটা আমার একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিল। এটা সেলিম আল দীনের দূরদর্শিতার একটা কারণ আমরা বলব।

ভো. কা. : সেলিম আল দীনকে নাট্যাচার্য কিংবা আচার্য বলা হচ্ছে- কোন বিশেষ গুণটির জন্য তাকে এই অভিধায় অভিষিক্ত করা হচ্ছে- আপনি যদি একটু মূল্যায়ন করেন।

আ. আ. : আমি একটা লেখায় বলেছি একজন লেখক কখন, কেন আচার্য হন। আমরা সেলিম আল দীনকে শুধ নাট্যাচার্য বলছি না- আমরা বলছি আচার্য। এটার জন্য একটা ভূমিকার প্রয়োজন আছে- সেটা হলো যে মানুষ কখন আচার্য হন- যখন সেই মানুষটি সমস্ত শিল্পের কাছে, সমাজের কাছে, মানুষের কাছে, তার নিজের কাছে একটা প্রবল দায়বদ্ধতার মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমরা যদি এভাবে বলি যে, সেলিম আল দীন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, অন্য পাঁচজন, দশজন শিক্ষকের মতো তিনি কিন্তু ক্লাসরুম এবং ঘর এই পর্যন্ত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, গুটিকয়েক গবেষণামূলক প্রবন্ধ তার মধ্যেও কিন্তু নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। অনেক নাট্যকার আছে কিন্তু সেলিম আল দীন আমাদের হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতিটাকে পাল্টে দিলেন। আড়াই হাজার বছর ধরে নাটকের পারস্পরিক সংলাপের যে রীতিটা ছিল এই সংলাপ বিনিময়ের ক্লিশে রীতিটাকে তিনি পরিহার করলেন। আড়াই হাজার বছরের সংলাপরীতি তিনি বদলে দিলেন ফর্মের ক্ষেত্রে। সেলিম আল দীন পাশ্চাত্যের যে ক্লাইমেক্স রীতি ছিল, সেই ক্লাইমেক্স ফল করলে নাটক শেষ হয়ে যাবে, সেলিম আল দীন দেখলেন যে, বাংলা বর্ণনাত্মক রীতির মধ্যে কোনো ক্লাইমেক্স থাকে না। কখনো ক্লাইমেক্স হয় আর নতুন করে ক্লাইমেক্স পড়ে যায় আবার নতুন করে তৈরি হয়। আমরা ‘প্রাচ্য’ নাটকে দেখব- এখানে শোক যখন তীব্র হয় তখন সাপের সৌন্দর্যের বর্ণনা আসে। ‘কীত্তন খোলা’ নাটকে সোনাই যখন ইদু কন্ট্রাকটরকে খুন করে ছুটে পালিয়ে যায় তখন পথে রুস্তমের সঙ্গে দেখা হয়, তখন সে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাও, দর্শক রুদ্ধশ্বাসে আছে যে তাকে ধরে ফেলতে পারে; খুনিকে ধরে ফেলতে পারে। যে যখন জিজ্ঞেস করে কোথায় যাও, তখন বলে কোথাও না। সে বলে যে তুমি যদি পালাতেই চাও তবে আমার গ্রামের বাড়িতে যাও। সামনে একটা নদী পাবে, নদীর পরে বটগাছ পাবে, বটগাছের পরে একটা স্কুল পাবে। বর্ণনার মধ্য দিয়ে খুনের তীব্রতাটা কেটে যায়। তাহলে পাশ্চাত্য নাটকের ধরন থেকে সেলিম আল দীন কিন্তু মুক্তি দিলেন তার নাটককে। আধুনিক বিশ্বনাটকের সমান্তরালে তিনি বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী নাট্যরীতিকে প্রতিষ্ঠা করলেন। আচার্য হওয়ার জন্য মানুষের আর কতোটা লাগে। সেলিম আল দীন নাটকের ক্ষেত্রে আচার্য, তিনি নতুন শিল্পরীতি নির্মাণ করলেন, নতুন শিল্পরীতির তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেলিম আল দীন বললেন, শিল্পের শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে বা শিল্পের পদ্ধতিগত দিক থেকে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়। শ্রী চৈতন্যের সময়- গীতায় একটা কথা আছে ‘এক হুম বহু শ্যাম’- ঈশ্বর বলেন আমি এক ছিলাম বহু হলাম? ভোরের ঘাসের শিশির বিন্দুতে ঈশ্বর, শিশুর হাসির মধ্যে ঈশ্বর, পাতার মধ্যে ঈশ্বর, বোধের মধ্যে ঈশ্বর, বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে ঈশ্বর। তাহলে এক ইশ্বর এরকম বহুভাবে ছড়িয়ে গেলেন। আবার সেই ইশ্বর এক হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রা কাব্যে একটি কবিতা আছে ‘একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে’, অর্থাৎ সমস্ত কিছু একক হয়ে আসে। তাহলে একক যখন ভেঙে যায়, আবার ভাঙাটা যখন একক হয়ে আসে তখনই কিন্তু দ্বৈতাদ্বৈতবাদী চিন্তাটা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ যে মুহূর্তে রাধা কৃষ্ণের ভাবে ভাবিত হয়, কৃষ্ণের দিকে ছুটে চলে তখন রাধার পরিচয়টা রাধা থাকে না, সৃষ্টি হিসেবে থাকে। তখন কৃষ্ণ আর কৃষ্ণ থাকে না, সে তখন স্রষ্টা হয়ে যায়। ছোট সৃষ্টি সব সময় বড় সৃষ্টির দিকে ছুটে চলে। সেলিম আল দীন এই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পটা প্রতিষ্ঠিত করলেন, তিনি দেখালেন, একটি চরিত্র যখন মঞ্চে অভিনয় করে বহু চরিত্রের অভিনয় করেন। বাংলা ঐতিহ্যবাহী নাটকে একজন গায়েন বহুচরিত্রে অভিনয় করেন, একজন মানুষ এতো এতো চরিত্রে অভিনয় করেন কিন্তু তিনি বেশ বদল করেন না, তিনি দেশও বদল করেন না, ভাষা বদল করেন না, তিনি এমন একটি দৃশ্যমানতা তৈরি করেন যাতে বোঝা যায় এই মানুষটি যে কথাগুলো বলছেন- এই মানুষটি সেই চরিত্র। এইভাবে সেলিম আল দীন তার দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বটাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন যে নাটকের ফর্মের ক্ষেত্রে আলাদা কোনো বিভাজন থাকবে না। সেখানে দেখা যায় নাটক, কবিতা, উপন্যাস, গল্প একই বিষয়।’ ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’ গবেষণার জন্যও তাকে আচার্য বলা যায়। আমরা জানতাম ১৭৯৫ সালে লেবেদফ নামে একজন রশ ভদ্রলোক বাংলা নাটকের যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু সেলিম আল দীন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে দেখালেন যে, মধ্যযুগের হাজার বছরের যে নাটকগুলো ছিল তা একেবারেই বাংলা নাটক, ট্র্যাডিশনাল বাংলা নাটক, আধুনিককালের ফর্মের সঙ্গে তা একেবারেই আলাদা। তিনি প্রমাণ করলেন মধ্যযুগ একটা স্বর্ণসম্ভারের যুগ এবং সেখানে বাংলা নাটক ছিল। সেখানে গাজীর গান ছিল, পাঁচালি ছিল, পয়ার ছিল- অসাধারণ উপাখ্যান আমাদের জনচিত্তকে প্রভাবিত করেছে। এগুলো তিনি তার থিসিসে প্রমাণ করলেন। গবেষণা সৃজনধর্মীয় হয় না সাধারণত, সেলিম আল দীন এই কারণে আচার্য যে, তিনি আমাদের চিন্তার ভুবনকে বিস্তৃত করেছিলেন। বাংলা আধুনিক গান খুব ক্লিশে, আমি তুমির মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু সেলিম আল দীন আধুনিক গানকে নতুন রূপ দিলেন, তিনি আধুনিক গানে একটা গদ্যভঙ্গি আনয়ন করলেন। আধুনিক গানকে কবিতায় নিয়ে আসলেন। আধুনিক গানের সুরের ক্ষেত্রেও তিনি একটা রীতি তৈরি করলেন। সেলিম আল দীনের গানগুলোর মধ্যে একেবারে ক্লাসিক্যাল রীতির মধ্যেও তিনি ভেঙে দিলেন নতুন করে। ফলে সেলিম আল দীন অনবরত ভাঙন গড়নের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে শিল্পের বিচিত্র পথে পরিভ্রমণ করছেন। অতএব সেলিম আল দীন অবশ্যই আচার্য।

ভো. কা. : আমরা জানি যে, আপনি নৃগোষ্ঠী নাট্যের ওপর অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এবং সেলিম আল দীনকে বলা হয় ‘নিউ এথনিক’ থিয়েটারের প্রবক্তা। এই বিষয়টা সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাই।

আ.আ. : এই এথনিক বিষয়টা সেলিম স্যার ও আমাদের যৌথ একটা কাজ ছিল। আমাদের ডিপার্টমেন্টে থিয়েটার স্টাডিজ নামে একটা পত্রিকা বের করার ক্ষেত্রে সেলিম স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রত্যেকটা ইস্যু হবে বিষয়ভিত্তিক।

দ্বিতীয় থেকেই সংখ্যা সিদ্ধান্ত হলো, আমরা প্রত্যেকেই নৃগোষ্ঠীর কাছে চলে যাবো। এর আগেই আমি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ট্যুর করেছি এবং কিছু কিছু কাজও করেছিলাম। এবং আমি ডিপার্টমেন্টে একটা প্রডাকশনও করেছিলাম, ‘আলংনাবাহ’ নামে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে। পরবর্তীকালে সেলিম আল দীন, ‘একটি মারমা রূপকথা’ লিখলেন, যেটা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ নাটকের মোড়টাকে পাল্টে দিলো। তখন আমি মারমাদের কাছ থেকে ‘মনরি মাংসু’ নামে একটি গল্প এনে দিই তাকে। গল্পটা পড়েই সেলিম স্যার এই নাটকটা তৈরি করলেন। ‘উপজাতীয়’ শব্দটাকে সেলিম আল দীন সর্বাবস্থায় পরিহার করলেন এবং তার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা বলতে শুরু করলাম ‘নৃগোষ্ঠী নাট্য’। এবং পরবর্তীকালে নিউ এথনিক থিয়েটার অর্থাৎ নব্য নৃগোষ্ঠী নাট্য নামে পরিচিতি পেল তা। এই নব্য নৃগোষ্ঠী নাট্য টার্মটি সেলিম আল দীনের দেয়া। আমরা দুজনেই এই কাজটি করেছিলাম। নৃগোষ্ঠী নাট্যের যে কাজটি আমি শুরু করেছিলাম তার শিল্পসম্মত রূপ দেন সেলিম আল দীন। আমি শুরু করেছিলাম গবেষণার প্রথম দিকটা এবং গবেষণা করতে করতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলাম। তিনি মধ্যযুগের বাংলা নাট্যে গেলেন। আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা একটা ত্রয়ী কাজ করব। আমাদের বিভাগের প্রফেসর লুৎফর রহমান নন্দনতত্ত্বের ওপর একটা কাজ করলেন। নন্দনতত্ত্ব, মধ্যযুগের বাংলা নাট্য এবং আমাদের দেশের নিউ এথনিক থিয়েটার এটা নিয়ে একটা ত্রয়ী গবেষণা রীতি তৈরি হবে যাতে আমাদের দেশের শিল্পসাহিত্যে পরানুগ্রহীতা থেকে সরে আসবে। এথনিক গল্পগুলো আমাদের মেইন স্ট্রিমে চলে আসলে আমাদের বাংলা সাহিত্য বাংলা নাটক আরো বেশি উজ্জ্বল হবে। নিউ এথনিক থিয়েটারকে সেলিম আল দীন যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন সেই সংজ্ঞাটাকে আমি আমার থিসিসে আরো একটু ডেভেলপ করেছিলাম।

ভো. কা. : পশ্চিমবঙ্গের নন্দনতাত্ত্বিক গবেষক ও শিল্প সমালোচক অরুণ সেন সেলিম আল দীনকে রবীন্দ্র-উত্তরকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলেছেন। সেলিম আল দীনের নাটকের কালপর্ব উল্লেখপূর্বক তাকে মূল্যায়নের এই সূত্রটা একটু ব্যাখ্যা করবেন কী।

আ.আ.: বাংলাদেশে সেলিম আল দীনের ওপর অ্যাকাডেমিক্যালি আমি প্রথম কাজ করি। আমি ‘কীত্তন খোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’; ‘হাতহদাই’কে বলেছিলাম মঞ্চের ট্রিলজি। এটা কোনো কাহিনীর ট্রিলজি না, একটা ফর্মের ট্রিলজি। গল্পে কাহিনীর মিল না থাকলেও কো-রিলেশন আছে। কীত্তন খোলার সিক্যুয়েন্স ওভার হয় বেল বাজিয়ে, কেরামত মঙ্গলে আমরা একটি বৃত্ত দেখতে পাই, এবং হাতহদাইয়ে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা দিয়ে দৃশ্যান্তর ঘটে। যেহেতু সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের কাহিনী হাতহদাই ফলে নাটকের এই দৃশ্যান্তর করতে গিয়ে তিনি- জোয়ার-ভাটাকে নিয়ে এসেছেন। এটা ইউনিক, আর কেউ কখনো করেনি। কীত্তন খোলার ক্ষেত্রে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি এবং বেল বাজানোর ব্যাপার লক্ষ্য করি। কেরামত মঙ্গলে দান্তের ডিভাইন কমেডির বৃত্ত থেকে ধারণা তিনি নিয়েছিলেন। ফলে নরক বৃত্ত ইত্যাদি নানা খণ্ডে খণ্ডে তিনি ভাগ করেছিলেন। অরুণ সেন, সেলিম আল দীনকে নিয়ে যে লেখাটা তিনি লিখলেন, বললেন রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, রবীন্দ্র-পরবর্তী হলে রবীন্দ্রনাথকে ধরতে হবে। কেউ কেউ বলেন যে, নাটকের শাখায় রবীন্দ্রনাথের অবাধ এবং অগাধ বিচরণ ছিল না। যারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে নাটক রচনা করেছেন তারাই কিন্তু বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের নাটকের বিভিন্ন শাখায় অবাধ বিচরণ ছিল না। কিন্তু আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথ, যাত্রা, পালা, লালনের গান অর্থাৎ এই ট্র্যাডিশনাল ফর্মের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলেন। যার জন্য তার নাটকগুলো কিন্তু সঙ্গীতবহুল। আমাদের যে কোনো পালাগানের পারফরমেন্সগুলোও একেবারে সঙ্গীতবহুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করলেন, যেমন দাদা ঠাকুর, বাউল, খ্যাপা বাউল। তার চোখের সামনে ছিল বাংলাদেশের হাজার বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১ম অংক, দ্বিতীয় অংক এরকম অংক বিভাজন করেননি। তিনি এই দৃশ্যের বিষয়টা ভেঙে দিয়েছেন। এই অনুসরণটা আর কেউ করেননি। সেলিম আল দীন বাংলা নাটক রচনা করতে গিয়ে এই অংকের বন্ধনটা একেবারে ভেঙে দিলেন। তিনি নাটককে কাঠামোর মধ্যে রাখতে চাইলেন না। যার জন্য এটাকে আমরা বলি মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি। সংস্কৃত নাটকের নিয়ম অনুযায়ী মহাকাব্য সাধারণত নয় স্বর্গের কাব্যকে বলা হয়ে থাকে। সংস্কৃত নাটকে সাত অংকের নাটকও আছে। সংস্কৃতে সেগুলোকে মহানাটক বলে। সেলিম আল দীনের ক্ষেত্রে নয়টা স্বর্গ আমরা লক্ষ্য করি। আমরা এটাকে মহানাটক বলতে পারি, মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির নাটক বলতে পারি। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে যতো নাটক রচিত হয়েছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ওয়েস্টকে ধ্রুব ধরে। সেলিম আল দীন পশ্চিমের শিল্পাদর্শকে বিবেচনায় রেখে প্রাচ্যদেশীয় মনমানসিকতায় নাটক রচনা করেছিলেন। যার জন্য আমরা বলব যে, সেলিম আল দীন একটা নতুন শিল্পরীতির ব্যাখ্যা দিলেন যেটা রবীন্দ্র পরবর্তীকালে আর কেউ দেননি। যার জন্য সেলিম আল দীন রবীন্দ্র-পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শুধু নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, শিল্পতাত্ত্বিক, শিল্পের বিনির্মাণ ও কাঠামোগত দিক থেকে সেলিম আল দীন রবীন্দ্র- পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার।

* ভো. কা. : ব্যক্তি সেলিম আল দীনকে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

আ.আ.: সেলিম আল দীন আমার শিক্ষক ছিলেন। তার সঙ্গে আমার আর একটি সম্পর্ক ছিল। আমার ছাত্রজীবনে সেলিম আল দীন আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। শিক্ষকতার কালেও গিয়েছেন। আমার মাকে উনি মা বলতেন। একটি কথা কিন্তু বলে রাখা ভালো, সেলিম আল দীন ভালোবাসা এবং স্নেহের কাঙাল ছিলেন। যার জন্য প্রায়শই তিনি ছেলেমেয়েদের বাবা বলতেন। এবং তাকে কেউ বাবা বললে খুশি হতেন। আমি তাকে নানা বলতাম। সুতরাং একান্তে আমরা যখন আলাপ করতাম তখন কিন্তু নানা নাতির একটা সম্পর্ক ছিল। এটা একেবারে ঘরোয়া। এই মানুষটি খেতে ভালোবাসতেন। মাছ খেতেন মাংস খেতেন। মাছের জন্য তিনি পাগল ছিলেন। একবার ইসলামপুর বাজারে মাছ পছন্দ হলো তার, কিন্তু দেখলেন, পকেটে টাকা নেই, তখন মাছের খাড়ি এবং জেলেকে গাড়িতে তুলে বাড়িতে নিয়ে এলেন। এরকম তার ভোজনপ্রীতি ছিল। কিন্তু শেষ জীবনে খেতে পারতেন না। তখন আমি তাকে বলতাম আপনার খাওয়ার কোটা কমে গেছে। যখন বারডেমে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি তার পাশে, আমাকে বললেন যে, আমার বুকটা তুমি মালিশ কর, তখন বলছেন, সিগারেট খেয়ে জীবনটা শেষ করে দিলাম, তুই সিগারেট খাসনা ভালো আছিস। বুঝলাম তার খুব কষ্টে হচ্ছে। আমি বললাম সিগারেট তেমন কোনো ক্ষতি করে না। ল্যাব এইডে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে গেলেন, আমরা কিন্তু জানতাম না যে এটা তার শেষ যাওয়া হবে। তার সাথে তার জীবনের এতো ঘনিষ্ঠ সময় কেটেছে আমি জানি না অন্য কারো সঙ্গে কেটেছে কিনা। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার সঙ্গে আমি এতো ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে, সেই ঘনিষ্ঠতা একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে শিক্ষক সেলিম আল দীন যেমন তীব্র তেমনি ব্যক্তি সেলিম আল দীন আমার কাছে প্রভাবকের মতো কাজ করে। প্রায়ই তাকে স্বপ্ন দেখি। ক্লান্তির বশে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে কিন্তু আমি যখন স্বপ্ন দেখি, দেখি সেই আমার ছাত্রজীবনের সেলিম আল দীন। চকচকে সেলিম আল দীন। এক বসন্তে সেলিম আল দীন একটি শিমুল গাছে কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন তোমাকে বাপ্তিষ্প করাব। যিশুখ্রিস্টের মতো বাপ্তিষ্প করতে হবে। আমি বললাম বাপ্তিষ্প কী? ভালো ছাত্রদের শিল্পসাহিত্য বা সাধারণ মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপরতা কাজ করে। ফলে এই স্বার্থপরতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তোমাকে বাপ্তিষ্প করাব। তারপর তিনি আমাকে বললেন এই শিমুল গাছে তোমাকে উঠতে হবে। দেখলাম যে শিমুল গাছে অনেক কাঁটা, উঠা সম্ভব নয়। বললাম, না উঠতে পারব না। বললেন বাপ্তিষ্পে না বলে কোনো কথা নেই, তোমাকে বাপ্তিষ্প করতে হবে। উঠতে হবে তোমাকে। তো আমি চেষ্টা করলাম, হাতটা একটু ছিলে গেলো, উনি পরে নামতে বললেন। বললেন, তোমার হাফ বাপ্তিষ্প হয়েছে। কারণ তুমি শুরুতে ভয় করেছিলে। আর তুমি যদি উঠতে চাইতে তাহলে আমি তোমাকে উঠতে দিতাম না। আমার প্রতি তোমার আস্থা ছিল না। তোমার ধারণা ছিল যে, এই কাঁটার মধ্য দিয়ে আমি তোমাকে উঠাব। সেলিম আল দীনের নানা রকম বাপ্তিষ্প পদ্ধতি ছিল। সেলিম আল দীনের প্লানচেটের একটা ঘটনা বলি। আমার তুলা রাশি। সবার বিশ্বাস যে তুলা রাশি দিয়ে প্লানচেট করানো যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা প্লানচেট আছে- ‘আত্মা’। আমি তখন বাংলা বিভাগে নতুন যোগদান করেছি, বর্তমানে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।

তিনি এবং সেলিম স্যার একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে আমাকে বললেন যে, আত্মা আনতে হবে। কার আত্মা আনবো। ডিএল রায়ের পুত্র, দিলীপ কুমার রায়ের এক শিষ্য ছিলেন উমা। অসাধারণ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তিনি। মাত্র আঠারো বছরে মারা যান। সেলিম স্যার তাকে খুব পছন্দ করতেন। দিলীপ কুমারের গান শুনতেন। বললেন, আমরা তার আত্মাটা আনব। আমাকে আত্মা আনার জন্য নিয়োজিত করলেন। এভাবে নানারকম আদি দৈবিক সংস্কারও তার মধ্যে ছিল। কোনো জায়গায় রওনা হওয়ার সময় কোনো বাধা পড়লে সেটাও তিনি মানতেন। তিনি প্রাচ্যদেশীয় রীতিটা সম্পূর্ণভাবে মানতেন যে, গুরুজনদের সম্মান করতে হয় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা এমন হবে যে, একেবারে প্রাচ্যদেশীয় গুরু শিষ্যের মধ্যে যে রকম সম্পর্ক থাকে। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা সঠিকভাবে হবে। আরেকটা মজার স্মৃতি আছে। আমরা একবার গ্রাম থিয়েটারের কাজে টাঙ্গাইলে সালাম সাকলাইনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে হুমায়ুন ফরিদী ছিলেন, সেলিম স্যার, আমি আরো অনেকে ছিলেন। ভযাবহ শীতের রাত। সেই শীতের রাতে যে ঘরে আমাদের ঘুমাতে দেওয়া হলো সেই ঘরটিতে ছিল পাটখড়ির বেড়া। শোয়ার জন্য নাড়া বিছিয়ে দিয়েছে, বেশ ওম আছে। সেলিম স্যার যেহেতু আমাদের শিক্ষক, সুতরাং তার জন্য একটা লেপের ব্যবস্থা হলো। উনি বললেন যে, তুই আমার কাছে ঘুমাবি। আমি দেখলাম যে যেহেতু লেপ আছে বেশ ভালোই শীত নিবারণ হবে। কিন্তু রাতে দেখলাম যে অর্ধেক লেপ তিনি তার শরীরের নিচে বিছিয়ে বাকি অর্ধেক গায়ে দিলেন। আমাকে বললেন যে, তুই কোনায় ঘুমা। আমি দেখলাম যে নিচ দিয়ে তীব্র বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। এই বাতাস ব্যারিয়ারটা হলো আমার শরীর। আমি বললাম যে, আমি এখানে বাতাসের ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমাবো আর আপনি লেপে ঘুমাবেন এটা হয় না। তিনি বললেন, কেন, তুমি মহাভারতে ‘অরনি কথা’ পড়নি। অরনি কীভাবে গুরুর জমি পাহারা দেয়ার জন্য নিজের শরীর দিয়ে পানির প্রবাহকে প্রতিহত করেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বললেন যে, তুমি কি কখনো আমার ছাত্র ছিলে না। আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তুমি ওখানেই ঘুমাবে। ওখানের হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডার মধ্যে শুয়ে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। শেষ রাতে দেখলাম যে নিজের মাথার বালিশটা আমার মাথার নিচে এবং লেপটা আমার গায়ের ওপর। যখন ঘুম ভাঙে তখন মনে হলো আমি যদি এখন জাগি তাহলে তার এই আনন্দটা মাটি হয়ে যেতে পারে। আমি অনেক পরে জাগলাম। তাকে জাগালাম। এবং আমি বললাম, চলেন আমরা জেগে থাকি, আমরা ঘুমাবো না। তো সারারাত আমরা লেপ গায়ে দিয়ে গল্প করলাম। কারো প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি দেখাতে পেরে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। আমার মনে আছে আমার চাকরির শুরু, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছি। আমার রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গিয়েছিল। আমাকে নিয়ে তিনি বাজারে গেলেন। বললেন, তুমি লেকচারার হয়েছ, তোমার টাকা নেই, পয়সা নেই, তুমি খাবা কী? চলো তোমাকে বাজার করে দিই। কচি মুরগি কিনে দিই। তেষট্টি টাকা দিয়ে তিনি কচি মুরগি কিনে দিলেন। যে টাকা তিনি কখনো নেননি। সারাটা জীবন এমন কি মৃত্যুর ২০-২২ দিন আগেও তিনি বললেন, তোমার কাছে আমি তেষট্টি টাকা পাই, তোমাকে আমি মুরগি কিনে দিয়েছিলাম। রক্ত হয় না বলে। এমনকি ক্লাসেও তিনি ছাত্রদের বলতেন তোমাদের শিক্ষককে আমি মুরগি কিনে দিয়েছিলাম। এ রকম শিশুসুলভ তার অনেক বিষয় ছিল। আমি যদি বলি একজন খ্যাপা শিল্পী, একজন প্রখর দার্শনিক, প্রবল বক্তা এবং একজন অসাধারণ গুণী শিল্পীর প্রতিকৃতি সেলিম আল দীন। শিশু সুলভ একটা আকুতি ছিল তার। এবং আমার ধারণা একটা বিপুল অভিমান নিয়ে সেলিম আল দীন আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন।

ভো. কা. : সেলিম আল দীনের ভক্ত শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা যথেষ্ট। এবং একজন বড় মাপের লেখক হওয়া সত্ত্বেও তার লেখার পাঠক সামান্যই আছে। এর কারণ কী? ব্যাপকভাবে পাঠক মহলে সেলিম আল দীনকে নিয়ে আসতে হলে কী করণীয় আছে বলে মনে করেন।

আ.আ. : সময় থেকে শত বছর এগিয়ে থাকা নাট্যকার সেলিম আল দীন। নিজের জাতি, সংস্কৃতি, শিল্পকে চেনার প্রবণতা আরো তীব্র হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। সেলিম আল দীন কিন্তু সেই সময়টাকে দেখেছিলেন। সুতরাং সেলিম আল দীন যে নাটকগুলো লিখেছিলেন, সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন বলেই সমকালের পাঠকরা তাকে অনুধাবন করতে পারেনি। তারা মনে করছে সেলিম আল দীনের নাটক কঠিন, দুরূহ। তার নাটক দুর্বোধ্য। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর তার নাটক পাঠ করতে গিয়ে পাঠক বুঝতে পেরেছে তার নাটক দুরূহ কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। সেলিম আল যে বিষয়ে লিখতেন তা সম্পূর্ণভাবে জেনে লিখতেন। জানার ক্ষেত্রটাকে তিনি প্রস্তুত করতেন দেশের ভূগোলের মধ্যে। দেশ যাদের অধ্যয়নের বিষয়, তারাই কেবল সেলিম আল দীনের নাটককে গভীরভাবে বুঝতে পারে। দেশের সঙ্গে, দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সেলিম আল দীনের নাটকের সংযোগটাই কিন্তু দুরূহতা। সেলিম আল দীনকে বুঝার জন্য সময়ের প্রয়োজন, সেলিম আল দীনকে বুঝার জন্য পাঠ করা প্রয়োজন। সেলিম আল দীনকে ঝুঝতে হলে এই দেশটাকে অবশ্যই জানতে হবে ভালোবাসতে হবে।

ভো.কা. : সেলিম আল দীনের নাটকের চরিত্র, তার কল্পিত চরিত্র এবং শিল্পচিন্তা বিষয়ে মূল্যায়ন করবেন কী?

আ. আ. সেলিম আল দীনের নাটকের চরিত্রগুলো আমাদের সমাজ বাস্তবতা, দীর্ঘকালের সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেলিম আল দীন প্রায় নাটকেই পূর্বসুরিদের স্মরণ করেন। যেমন ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকে আলাওল, হোমারের ইলিয়াড কাব্যকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, মধুসূদন দত্তকে, শাহনামার কবি ফেরদৌসীকে বন্দনা করেছেন শুরুতে। তিনি বলেছেন, দীর্ঘকালের শিল্প চর্চায় যে সব নাম যুক্ত হয়েছে সেখানে একজন দীনহীন সেলিম আল দীনের নাম যুক্ত হলো। সেলিম আল দীনের কাহিনী এবং লেখার মধ্যে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ছিল। ইস্টকে আগে আমরা জানতাম ওয়েস্টকে দিয়ে। আমরা ইতিহাসকে দেখতাম ওদের শেখানো পথে। যখন উল্টো করে আমরা দেখলাম- যখন আমাদের দেশে চর্যাপদ লেখা হচ্ছে তখন ওয়েস্টের কোনো খবর নেই। আমাদের দেশে চণ্ডীদাস বলছেন- ‘শুনহে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।’ তখনো চণ্ডীদাসের আবির্ভাব ঘটেনি- রূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ যখন লিখলেন তখন ওয়েস্টে শিল্পসাহিত্য দেখি না। দেখি একটা অরাজকতা চলছে। আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। গ্রীক ট্র্যাজেডি শেক্সপিয়রের ট্যাজেডি কে তিনি দেখলেন ভিন্ন চোখে। আমাদের দেশের নিরন্ন কৃষকের যে মেয়েটি মারা গেছে সেটা কি ট্র্যাজেডি নয়। ট্র্যাজেডি হতে হলে পিতাকে হত্যা করতে হবে, মাকে বিয়ে করতে হবে কেন। নিরন্ন কৃষকের যে ঘাম, তার কাচির ডগায় পড়ে সেখানে যে সূর্যের আলো পড়ে ঝলমলিয়ে ওঠে সেটা কি ট্র্যাজেডি হতে পারে না। ট্রাজেডির তত্ত্বগুলোকে সেলিম আল দীন নিজের মতো করে দেখেছেন। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে দেবতা, শেক্সপিয়রের মানুষ আর আমাদের দেশের চন্দ্রাবতী তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার শোক কি ট্র্যাজেডি হতে পারে না। মহুয়ার হাতে ছুরি তুলে দিলো নদের চাঁদকে হত্যা করতে। মহুয়া নদের চাঁদকে হত্যা করতে পারলো না কিন্তু নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারলেন। প্রাচ্য দেশীয় আটপৌরে ছিল সেলিম আল দীনের শিল্প চৈতন্য। ওয়েস্টের মানবিকতার মধ্যে একটা ক্লিশে আবহ আছে। তার শিল্প বিশ্বাসে একটা প্রাচ্যদেশীয় আধ্যাত্মিকতা ছিল।

সবশেষে বলতে পারি সেলিম আল দীনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই রীতিটা বহমান থাকবে কিনা। বড় শিল্পী কোনো সৃষ্টিকে অনুকরণ করেন না। সেলিম আল দীনও করেননি। তিনি যে পথে হেঁটেছেন সেখানেও অনেক শাখাপথ তৈরি করেছেন। ব্রেখট বলেন, একটি চরিত্র সব সময় সেই চরিত্রের মতো করে কথা বলবে না। স্তানিস্লাভস্কি বলেন, অবশ্য চরিত্র সেই চরিত্রের মতোই কথা বলবে। ব্রেখট বলেন, বারবার চরিত্রের মধ্যে ঢুকবে, বেরিয়ে যাবে। আমাদের পালাগানেও এই রীতিটাও আছে। অভিনয়ের মাঝখানে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলে অনেক তো হলো এবার একটু পান খেয়ে নিই। তাতে করে দর্শকদের সঙ্গে পারফর্মারের একটা সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ফলে এলিয়েনেশন তত্ত্বতা ব্রেখটের নতুন না, আমাদের এই ভূখণ্ডেই ছিল। গায়েন পদ্ধতির রীতিনীতির মধ্যে এই এলিয়েনেশন তত্ত্বটা ছিল। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির চিত্রময়তাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা নাটকের ক্ষেত্রে আরো ডাইমেনশন নিয়ে আসতে পারি। তাহলে আমরা দেখবো যে, সেলিম আল দীনের কীর্তির মধ্যেও আলাদা পথ খুঁজে নেয়া যায়। সেলিম আল দীন বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর কখনো তার মৃত্যু ঘটায় না যখন পর্যন্ত না তার কাজ শেষ হয়। সেলিম আল দীন তার কাজ, তার ভাবনায় স্ফুরণ ঘটাতে পেরেছেন। চৈতন্যের সময় চৈতন্য পরিকর বলে একটা চক্র ছিল। আমার ধারণা ‘সেলিম আল দীন পরিকর’ বলে একালে একটা বলয় হতে পারে। যারা তার স্বপ্নকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিতে পারবেন। তার তত্ত্ব ও দর্শনকে এভাবে আরো ব্যাখ্যা করা যাবে। তখন মনে হবে সেলিম আল দীন সত্যিকার অর্থে আচার্য ছিলেন।

ভো. কা. : ব্যক্তি সেলিম আল দীনকে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

আ.আ.: সেলিম আল দীন আমার শিক্ষক ছিলেন। তার সঙ্গে আমার আর একটি সম্পর্ক ছিল। আমার ছাত্রজীবনে সেলিম আল দীন আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। শিক্ষকতার কালেও গিয়েছেন। আমার মাকে উনি মা বলতেন। একটি কথা কিন্তু বলে রাখা ভালো, সেলিম আল দীন ভালোবাসা এবং স্নেহের কাঙাল ছিলেন। যার জন্য প্রায়শই তিনি ছেলেমেয়েদের বাবা বলতেন। এবং তাকে কেউ বাবা বললে খুশি হতেন। আমি তাকে নানা বলতাম। সুতরাং একান্তে আমরা যখন আলাপ করতাম তখন কিন্তু নানা নাতির একটা সম্পর্ক ছিল। এটা একেবারে ঘরোয়া। এই মানুষটি খেতে ভালোবাসতেন। মাছ খেতেন মাংস খেতেন। মাছের জন্য তিনি পাগল ছিলেন। একবার ইসলামপুর বাজারে মাছ পছন্দ হলো তার, কিন্তু দেখলেন, পকেটে টাকা নেই, তখন মাছের খাড়ি এবং জেলেকে গাড়িতে তুলে বাড়িতে নিয়ে এলেন। এরকম তার ভোজনপ্রীতি ছিল। কিন্তু শেষ জীবনে খেতে পারতেন না। তখন আমি তাকে বলতাম আপনার খাওয়ার কোটা কমে গেছে। যখন বারডেমে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি তার পাশে, আমাকে বললেন যে, আমার বুকটা তুমি মালিশ কর, তখন বলছেন, সিগারেট খেয়ে জীবনটা শেষ করে দিলাম, তুই সিগারেট খাসনা ভালো আছিস। বুঝলাম তার খুব কষ্টে হচ্ছে। আমি বললাম সিগারেট তেমন কোনো ক্ষতি করে না। ল্যাব এইডে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে গেলেন, আমরা কিন্তু জানতাম না যে এটা তার শেষ যাওয়া হবে। তার সাথে তার জীবনের এতো ঘনিষ্ঠ সময় কেটেছে আমি জানি না অন্য কারো সঙ্গে কেটেছে কিনা। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার সঙ্গে আমি এতো ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে, সেই ঘনিষ্ঠতা একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে শিক্ষক সেলিম আল দীন যেমন তীব্র তেমনি ব্যক্তি সেলিম আল দীন আমার কাছে প্রভাবকের মতো কাজ করে। প্রায়ই তাকে স্বপ্ন দেখি। ক্লান্তির বশে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে কিন্তু আমি যখন স্বপ্ন দেখি, দেখি সেই আমার ছাত্রজীবনের সেলিম আল দীন। চকচকে সেলিম আল দীন। এক বসন্তে সেলিম আল দীন একটি শিমুল গাছে কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন তোমাকে বাপ্তিষ্প করাব। যিশুখ্রিস্টের মতো বাপ্তিষ্প করতে হবে। আমি বললাম বাপ্তিষ্প কী? ভালো ছাত্রদের শিল্পসাহিত্য বা সাধারণ মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপরতা কাজ করে। ফলে এই স্বার্থপরতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তোমাকে বাপ্তিষ্প করাব। তারপর তিনি আমাকে বললেন এই শিমুল গাছে তোমাকে উঠতে হবে। দেখলাম যে শিমুল গাছে অনেক কাঁটা, উঠা সম্ভব নয়। বললাম, না উঠতে পারব না। বললেন বাপ্তিষ্পে না বলে কোনো কথা নেই, তোমাকে বাপ্তিষ্প করতে হবে। উঠতে হবে তোমাকে। তো আমি চেষ্টা করলাম, হাতটা একটু ছিলে গেলো, উনি পরে নামতে বললেন। বললেন, তোমার হাফ বাপ্তিষ্প হয়েছে। কারণ তুমি শুরুতে ভয় করেছিলে। আর তুমি যদি উঠতে চাইতে তাহলে আমি তোমাকে উঠতে দিতাম না। আমার প্রতি তোমার আস্থা ছিল না। তোমার ধারণা ছিল যে, এই কাঁটার মধ্য দিয়ে আমি তোমাকে উঠাব। সেলিম আল দীনের নানা রকম বাপ্তিষ্প পদ্ধতি ছিল। সেলিম আল দীনের প্লানচেটের একটা ঘটনা বলি। আমার তুলা রাশি। সবার বিশ্বাস যে তুলা রাশি দিয়ে প্লানচেট করানো যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা প্লানচেট আছে- ‘আত্মা’। আমি তখন বাংলা বিভাগে নতুন যোগদান করেছি, বর্তমানে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।

তিনি এবং সেলিম স্যার একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে আমাকে বললেন যে, আত্মা আনতে হবে। কার আত্মা আনবো। ডিএল রায়ের পুত্র, দিলীপ কুমার রায়ের এক শিষ্য ছিলেন উমা। অসাধারণ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তিনি। মাত্র আঠারো বছরে মারা যান। সেলিম স্যার তাকে খুব পছন্দ করতেন। দিলীপ কুমারের গান শুনতেন। বললেন, আমরা তার আত্মাটা আনব। আমাকে আত্মা আনার জন্য নিয়োজিত করলেন। এভাবে নানারকম আদি দৈবিক সংস্কারও তার মধ্যে ছিল। কোনো জায়গায় রওনা হওয়ার সময় কোনো বাধা পড়লে সেটাও তিনি মানতেন। তিনি প্রাচ্যদেশীয় রীতিটা সম্পূর্ণভাবে মানতেন যে, গুরুজনদের সম্মান করতে হয় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা এমন হবে যে, একেবারে প্রাচ্যদেশীয় গুরু শিষ্যের মধ্যে যে রকম সম্পর্ক থাকে। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা সঠিকভাবে হবে। আরেকটা মজার স্মৃতি আছে। আমরা একবার গ্রাম থিয়েটারের কাজে টাঙ্গাইলে সালাম সাকলাইনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে হুমায়ুন ফরিদী ছিলেন, সেলিম স্যার, আমি আরো অনেকে ছিলেন। ভযাবহ শীতের রাত। সেই শীতের রাতে যে ঘরে আমাদের ঘুমাতে দেওয়া হলো সেই ঘরটিতে ছিল পাটখড়ির বেড়া। শোয়ার জন্য নাড়া বিছিয়ে দিয়েছে, বেশ ওম আছে। সেলিম স্যার যেহেতু আমাদের শিক্ষক, সুতরাং তার জন্য একটা লেপের ব্যবস্থা হলো। উনি বললেন যে, তুই আমার কাছে ঘুমাবি। আমি দেখলাম যে যেহেতু লেপ আছে বেশ ভালোই শীত নিবারণ হবে। কিন্তু রাতে দেখলাম যে অর্ধেক লেপ তিনি তার শরীরের নিচে বিছিয়ে বাকি অর্ধেক গায়ে দিলেন। আমাকে বললেন যে, তুই কোনায় ঘুমা। আমি দেখলাম যে নিচ দিয়ে তীব্র বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। এই বাতাস ব্যারিয়ারটা হলো আমার শরীর। আমি বললাম যে, আমি এখানে বাতাসের ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমাবো আর আপনি লেপে ঘুমাবেন এটা হয় না। তিনি বললেন, কেন, তুমি মহাভারতে ‘অরনি কথা’ পড়নি। অরনি কীভাবে গুরুর জমি পাহারা দেয়ার জন্য নিজের শরীর দিয়ে পানির প্রবাহকে প্রতিহত করেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বললেন যে, তুমি কি কখনো আমার ছাত্র ছিলে না। আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তুমি ওখানেই ঘুমাবে। ওখানের হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডার মধ্যে শুয়ে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। শেষ রাতে দেখলাম যে নিজের মাথার বালিশটা আমার মাথার নিচে এবং লেপটা আমার গায়ের ওপর। যখন ঘুম ভাঙে তখন মনে হলো আমি যদি এখন জাগি তাহলে তার এই আনন্দটা মাটি হয়ে যেতে পারে। আমি অনেক পরে জাগলাম। তাকে জাগালাম। এবং আমি বললাম, চলেন আমরা জেগে থাকি, আমরা ঘুমাবো না। তো সারারাত আমরা লেপ গায়ে দিয়ে গল্প করলাম। কারো প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি দেখাতে পেরে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। আমার মনে আছে আমার চাকরির শুরু, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছি। আমার রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গিয়েছিল। আমাকে নিয়ে তিনি বাজারে গেলেন। বললেন, তুমি লেকচারার হয়েছ, তোমার টাকা নেই, পয়সা নেই, তুমি খাবা কী? চলো তোমাকে বাজার করে দিই। কচি মুরগি কিনে দিই। তেষট্টি টাকা দিয়ে তিনি কচি মুরগি কিনে দিলেন। যে টাকা তিনি কখনো নেননি। সারাটা জীবন এমন কি মৃত্যুর ২০-২২ দিন আগেও তিনি বললেন, তোমার কাছে আমি তেষট্টি টাকা পাই, তোমাকে আমি মুরগি কিনে দিয়েছিলাম। রক্ত হয় না বলে। এমনকি ক্লাসেও তিনি ছাত্রদের বলতেন তোমাদের শিক্ষককে আমি মুরগি কিনে দিয়েছিলাম। এ রকম শিশুসুলভ তার অনেক বিষয় ছিল। আমি যদি বলি একজন খ্যাপা শিল্পী, একজন প্রখর দার্শনিক, প্রবল বক্তা এবং একজন অসাধারণ গুণী শিল্পীর প্রতিকৃতি সেলিম আল দীন। শিশু সুলভ একটা আকুতি ছিল তার। এবং আমার ধারণা একটা বিপুল অভিমান নিয়ে সেলিম আল দীন আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন।

ভো. কা. : সেলিম আল দীনের ভক্ত শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা যথেষ্ট। এবং একজন বড় মাপের লেখক হওয়া সত্ত্বেও তার লেখার পাঠক সামান্যই আছে। এর কারণ কী? ব্যাপকভাবে পাঠক মহলে সেলিম আল দীনকে নিয়ে আসতে হলে কী করণীয় আছে বলে মনে করেন।

আ.আ. : সময় থেকে শত বছর এগিয়ে থাকা নাট্যকার সেলিম আল দীন। নিজের জাতি, সংস্কৃতি, শিল্পকে চেনার প্রবণতা আরো তীব্র হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। সেলিম আল দীন কিন্তু সেই সময়টাকে দেখেছিলেন। সুতরাং সেলিম আল দীন যে নাটকগুলো লিখেছিলেন, সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন বলেই সমকালের পাঠকরা তাকে অনুধাবন করতে পারেনি। তারা মনে করছে সেলিম আল দীনের নাটক কঠিন, দুরূহ। তার নাটক দুর্বোধ্য। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর তার নাটক পাঠ করতে গিয়ে পাঠক বুঝতে পেরেছে তার নাটক দুরূহ কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। সেলিম আল যে বিষয়ে লিখতেন তা সম্পূর্ণভাবে জেনে লিখতেন। জানার ক্ষেত্রটাকে তিনি প্রস্তুত করতেন দেশের ভূগোলের মধ্যে। দেশ যাদের অধ্যয়নের বিষয়, তারাই কেবল সেলিম আল দীনের নাটককে গভীরভাবে বুঝতে পারে। দেশের সঙ্গে, দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সেলিম আল দীনের নাটকের সংযোগটাই কিন্তু দুরূহতা। সেলিম আল দীনকে বুঝার জন্য সময়ের প্রয়োজন, সেলিম আল দীনকে বুঝার জন্য পাঠ করা প্রয়োজন। সেলিম আল দীনকে ঝুঝতে হলে এই দেশটাকে অবশ্যই জানতে হবে ভালোবাসতে হবে।


Post a Comment

0 Comments