Ticker

6/recent/ticker-posts

ড. হুমায়ুন আজাদের অপ্রকাশিত রচনা চোমস্কীয় বিপ্লব

ড. হুমায়ুন আজাদের অপ্রকাশিত রচনা চোমস্কীয় বিপ্লব

ড. হুমায়ুন আজাদ। ভাষা বিজ্ঞানী, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ। বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় এক মানুষ। মুক্তির মিছিলে তিনি ছিলেন, থাকবেন। সম্প্রতি তার সহধর্মিনী লতিফা কোহিনূর তার একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। বিষয় বাংলা ভাষারীতি, ভাষা বিজ্ঞান। পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবে আগামী প্রকাশনী। এখানে সেই রচনার কিছু অংশ বিশেষ...

উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
* চোমস্কীয় রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের বিপ্লবাত্মকতার স্বরূপ জানতে পারবেন;
* চোমস্কীয় রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের লক্ষ্য বর্ণনা করতে পারবেন।

ভাষাবিজ্ঞানের সমগ্র ইতিহাসে চোমস্কীয় ভাষিক তত্ত্ব সবচেয়ে অভিনব ও বৈপ্লবিক; এবং একে অভিহিত করা হয় ‘চোমস্কীয় বিপ্লব’ (Chomskyan Revolution) নামে। চোমস্কি সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের ছদ্মবৈজ্ঞানিকতা দূর ক’রে ভাষাবিজ্ঞানকে ক’রে তুলেছেন বিশুদ্ধভাবে বিজ্ঞানসম্মত। সংকীর্ণ উপাত্ত বর্ণনার বিমর্ষতা থেকে তিনি উদ্ধার করেন ভাষাবিজ্ঞানকে, এবং ভাষা ও মানুষ সম্পর্কে সৃষ্টি করেন নতুন ও গভীর বোধ। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের আচরণবাদী (Behaviorist) দৃষ্টিতে মানুষ পরিণত হয়েছিলো কুকুর ও গিনিপিগের মতো উদ্দীপক (Stimulus) ও সাড়া (Response) নিয়ন্ত্রিত প্রাণীতে; চোমস্কি দেখান মানুষ প্রকৃতিতে ভিন্ন, কেননা মানুষ সৃষ্টিশীল। তিনি দেখান যে আচরণবাদীরা অনুকরণ করেছেন বিজ্ঞানের বহিরঙ্গের; তাই তাঁরা ভাষা ও মানুষ সম্পর্কে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেন নি।
চোমস্কি মানুষ ও ভাষার আন্তর সূত্র ও শৃঙ্খলা আবিষ্কারে উৎসাহী। ‘ভাষাপ্রয়োগ’ (Performance) তাঁর কাছে মানুষের ‘ভাষাবোধ’ (Competence)-এর বিচূর্ণ প্রকাশ মাত্র; তাই ভাষাপ্রয়োগ নয়, বরং ভাষাবোধের সূত্র বের করাই ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি পর্যবেক্ষণসম্ভব (Observable) উপাত্তের সাহায্যে আবিষ্কার করতে চান ওই উপাত্তের সংগোপন সূত্র। বিজ্ঞানে যখন কোনো গৃহীত ‘মডেল’ (Model) বা ‘প্যারাডাইম’ (Paradigm) বা ‘তত্ত্ব’ (Theory নতুন উপাত্ত ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়, তখন দরকার হয় নতুন তত্ত্বের। চোমস্কি তাঁর সময়ে প্রচলিত সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের মডেলের সামনে উপস্থিত করেন এমন উপাত্ত, যা ব্যাখ্যার শক্তি ছিলো না সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের। তাই তিনি ওই মডেল বা তত্ত্ব ত্যাগ ক’রে প্রস্তাব করেন নতুন মডেল বা তত্ত্ব। ১৯৫৭র আগে সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করতেন ভাষাবস্তুরাশি শনাক্ত ও শ্রেণীকরণ করাই ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য। চোমস্কি দেখান যে এ-লক্ষ্য থেকে মূল্যবান ফল পাওয়া যায় না। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রণালিপদ্ধতিগুলো ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের ওপর প্রয়োগ ক’রে মোটামুটি সাফল্য অর্জন করা যায়, কেননা ধ্বনি ও রূপ সসীম; কিন্তু বাক্যের ওপর ওগুলো প্রয়োগ ক’রে নিষ্ফল হ’তে হয়, কেননা ভাষায় বাক্য সংখ্যাহীন। প্রতিটি ভাষায় সম্ভাব্য নতুন বাক্যের কোনো সীমা নেই। সাংগঠনিক প্রণালিপদ্ধতি প্রয়োগ ক’রে ভাষার অসংখ্য বাক্য বর্ণনা সম্ভব নয়। সাংগঠনিকদের কাছে ভাষা সৃষ্টিশীল নয়, আর চোমস্কির তত্ত্বে ভাষা সৃষ্টিশীল।
চোমস্কির তত্ত্বে বাক্যই ভাষার মূল বস্তু; তাই রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের দায়িত্ব হচ্ছে ভাষার ‘সমস্ত শুদ্ধ’, এবং শুধুই শুদ্ধ’ বাক্য সৃষ্টি করা। রূপান্তর ব্যাকরণ আসে একটি সুষ্ঠু শক্তিমান ভাষিক তত্ত্ব নিয়ে। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান প্রণালিপদ্ধতির যান্ত্রিক প্রয়োগের সাহায্যে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলো সত্য, কিন্তু রূপান্তর ব্যাকরণ বিশ্বাস ক’রে যে শুধু প্রণালিপদ্ধতি দিয়ে নয়, মনে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতেও উদ্ভাসিত হ’তে পারে সত্য; তবে তা প্রকাশ করতে হবে বস্তুনিষ্ঠভাবে। ভাষার একটি শক্তিমান তত্ত্বের সাথে চোমস্কি যুক্ত করেন নানা প্রণালিপদ্ধতি, যার সাহায্যে ভাষার মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলো গাণিতিক যথাযথতার সাথে প্রকাশ করা সম্ভব। তিনি মনে করেন যে পৃথিবীর সব ভাষার সূত্রই কমবেশি সন্নিকট, আর ভাষাসংগঠনের নীতিমালা যেনো জৈবিকভাবে স্থির-করা।
চোমস্কির সিন্ট্যাক্টিক স্ট্রাকচারস-এ (১৯৫৭) প্রস্তাবিত হয় চোমস্কীয় বিপ্লবের মূল তত্ত্বগুলো; পরে তিনি ‘A Transformational Approach to Syntax’ (1958), ‘A Review of B F Skinner’s Verbal Behavior’ (1959), Current Issues in Linguistic Theory (1964), Aspects on the Theory of Syntax (1965) এবং আরো নানা রচনায় তাঁর তত্ত্বকে বিস্তৃত করেন ও সুষ্ঠুতা দেন। সিন্ট্যাক্টিক স্ট্রাকচারস আজ আর ভাষা বর্ণনায় ব্যবহৃত হয় না, তবে এ- বইয়ের মৌল তত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৭র পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চোমস্কীয় বিপ্লব; এবং আমেরিকার তরুণ ভাষাবিজ্ঞানীরা সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান ছেড়ে হয়ে ওঠেন রূপান্তরবাদী ও সৃষ্টিশীল। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য ছিলো ভাষাবস্তু শনাক্তকরণ ও শ্রেণীকরণ : উপাত্ত বর্ণনা ছিলো সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো সীমাবদ্ধ ও উপাত্তের ওপর। চোমস্কি এর থেকে অনেক দূরে স’রে যান। চোমস্কির কাছে ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘সৃষ্টিশীলতা’। তাঁর মতে, ভাষিক তত্ত্বের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভাষার সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করা। কোনো ভাষীই তার ভাষার সমস্ত বাক্য মুখস্থ ক’রে রাখে না, এটা সম্ভব নয়; কেননা প্রত্যেক ভাষায় বাক্য অসংখ্য। ভাষাভাষীদের আছে সে-শক্তি যার সাহায্যে তারা অভিনব বাক্য সৃষ্টি করতে ও বুঝতে পারে। চোমস্কির কাছে কোনো ভাষার ব্যাকরণ হচ্ছে ওই ভাষার তত্ত্ব। কোনো তত্ত্ব গ’ড়ে ওঠে কিছুসংখ্যক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি ক’রে। ওই তত্ত্ব দৃশ্যমান উপাত্ত নির্ভর ক’রে রচনা করতে পারে সাধারণ সূত্র, যা ভবিষ্যদ্বাণী (Prediction) করতে পারে অদৃশ্য উপাত্ত সম্পর্কে। ব্যাকরণের সূত্রগুলো উপাত্তের বাক্যগুলোর সাংগঠনিক সম্পর্ক নির্দেশ করে, এবং নির্দেশ করে উপাত্তের বাইরের অসংখ্য বাক্যের সম্পর্ক। তাই ভাষিক তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে ভাষার জন্যে ঠিক তত্ত্ব বা ব্যাকরণ রচনা।
প্রতিটি ব্যাকরণকে কিছু ‘যোগ্যতার সূত্র’ (Condition of Adequacy) পূরণ করতে হয়। চোমস্কি এমন একটি শর্তের নাম দিয়েছেন ‘যোগ্যতার বহিঃশর্ত’ (External Condition of Adequacy)। ‘যোগ্যতার বহিঃশর্ত’ বলতে বোঝানো হয় যে ব্যাকরণের সৃষ্ট সমস্ত বাক্যকে ওই ভাষাভাষীদের কাছে শুদ্ধ বলে গণ্য হ’তে হবে। আরেকটি শর্ত হচ্ছে ‘সাধারণত্ব শর্ত (Condition of Generality))। এ-শর্ত অনুসারে ব্যাকরণে ব্যবহৃত ক্যাটাগরিগুলো গৃহীত হ’তে হবে একটি নির্বিশেষ ভাষিক তত্ত্ব থেকে, যা প্রয়োগ করা সম্ভব সব ভাষায়।
প্রশ্ন হচ্ছে নির্বিশেষ ভাষিক তত্ত্ব ও বিশেষ ভাষার ব্যাকরণের মধ্যে কী সম্পর্ক? কোনো নির্বিশেষ ভাষিক তত্ত্ব থেকে বিশেষ ভাষার ব্যাকরণের উদ্ভবকে চোমস্কি ভাগ করেছেন নিম্নলিখিত তিনটি প্রণালিতে:
আবিষ্কারপ্রণালি (Discovery Proceduer) : ভাষিক তত্ত্বটি এত শক্তিমান যে এটি উপাত্ত সরবরাহের সাথে সাথে নির্দেশ করবে উপাত্তের ব্যাকরণ রচনার কৌশল। এ-তত্ত্ব দেবে ব্যাকরণ ‘আবিষ্কারপ্রণালি’।
সিদ্ধান্তপ্রণালি (Decision Procedure) : ভাষিক তত্ত্বটি এমন প্রণালি দেবে, যার সাহায্যে উপাত্তের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাকরণটি যান্ত্রিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এ-তত্ত্ব দেবে ‘সিদ্ধান্তপ্রণালি’।
মূল্যায়নপ্রণালি (Evalution Procedure) : ভাষিক তত্ত্বটি এমন প্রণালি দেবে, যার সাহায্যে কোনটি উৎকৃষ্ট আর কোনটি উৎকৃষ্ট নয়, তা নির্ণয় করা যাবে। এ-তত্ত্ব দেবে ব্যাকরণ ‘মূল্যায়নপ্রণালি’।
কোনো তত্ত্বের কাছে আবিষ্কারপ্রণালি আশা করা হচ্ছে দুরাশা; এর চেয়ে বাস্তব প্রত্যাশা হচ্ছে সিদ্ধান্তপ্রণালি চাওয়া, এবং সবচেয়ে বাস্তব প্রত্যাশা হচ্ছে মূল্যায়নপ্রণালি চাওয়া। চোমস্কির মতে কোনো ভাষিক তত্ত্বের কাছে মূল্যায়নপ্রণালির থেকে শক্তিমান কোনো প্রণালি কামনা করা যায় না। কোনো একটি ভাষিক তত্ত্ব যা করতে পারে, তা হচ্ছে মূল্যায়নপ্রণালি রচনা, অর্থাৎ প্রতিযোগী ব্যাকরণগুলোর মধ্যে তুলনা করে কোনটি ভালো, কোনটি ভালো নয় সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে। অন্যান্য বিজ্ঞানেও এমনই ঘটে। সেখানেও এমন উপায় নেই, যার সাহায্যে পাওয়া যেতে পারে উপাত্তের শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব; বা নির্ণয় করা সম্ভব নয় প্রতিযোগীর তত্ত্বগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোনটি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকেও তাঁর উপাত্তের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা ব’লে মনে করা হয় না, শুধু মনে করা হয় যে আপেক্ষিক তত্ত্ব নিউটনীয় তত্ত্বের থেকে উৎকৃষ্ট। কোনো বিজ্ঞানেই মূল্যায়নপ্রণালির থেকে শক্তিমান কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। ব্রুমফিল্ডীয় ভাষাবিজ্ঞান চেয়েছিলো আবিষ্কারপ্রণালি; প্রণালিপদ্ধতির সাহায্যে যান্ত্রিকভাবে ভাষার ব্যাকরণ আবিষ্কার। চোমঙ্কি এতো উচ্চাভিলাষী নন, কেননা এটা চাওয়া যেতে পারে না। অনেকে মনে করতে পারেন যে আবিষ্কারপ্রণালি ছেড়ে মূল্যায়নপ্রণালি গ্রহণ ক’রে চোমস্কি সীমাবদ্ধ করেছেন ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্যকে। কিন্তু আসলে তিনি ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্যকে প্রসারিত করেছেন। তিনি সীমাবদ্ধ উপাত্ত বর্ণনা ছেড়ে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন ভাষার সংখ্যাহীন বাক্য, এবং দিতে চেয়েছেন সেগুলোর সাংগঠনিক বর্ণনা (Structural Description)। ভাষার সৃষ্টিশীলতা ও ভাষাভাষীদের সৃষ্টিশীলতার আন্তর সূত্র উদঘাটন রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের লক্ষ্য। তিনি ভাষার সৃষ্টিশীলতার সূত্র উদঘাটন করতে চেয়ে মহান ক’রে তুলেছেন ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্যকে।
রচনাটি অবিকৃতভাবে প্রকাশিত হলো

Post a Comment

0 Comments