Ticker

6/recent/ticker-posts

Sunil Gangopadhaya - Bijone Nijer Shonge Dekha যারা চেতনার ওপারে


Sunil Gangopadhaya - Bijone Nijer Shonge Dekha

বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা

যারা চেতনার ওপারে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

উন্মাদদের ভাষা ভারি সাঙ্কেতিক হয়। হঠাৎ শুনলে মনে হয়, মহৎ সাহিত্যের উদ্ধৃতি। ওরা বাস্তব নিরপেক্ষ, চোখে যা দেখে-তাকে অবিশ্বাস এবং অবহেলা করতে পারে। ছেঁড়া কাপড়ে কেউ সেজে থাকে সম্রাট, বাতাসকে প্রতিদ্বন্দী ভেবে যুদ্ধ করে, কেউবা যেন সমস্ত পৃথিবীকে অনবরত দয়া করে চলেছে।
উন্মাদেরা এমন কিছু আকর্ষণীয় নয়। ওদের মুখে গম্ভীর কথা শুনলেও হাসি পায়, করুণ ব্যবহার দেখলেও দয়া হয় না। কারণ ওরা বোধহীন। একটি উন্মাদের শরীরটা মানুষের মতো, কিন্তু ভিতরের মানুষটি নেই। এমনকি একটি পশুরও যেটুকু আত্মচেতনা থাকে-বদ্ধ উন্মাদেরা তার থেকেও বঞ্চিত হয়। একদিন একটি অপ্রকৃতিস্থ বিশালকায় পুরুষকে একখন্ড পাথর ঠুকে ঠুকে নিজের কপাল থেকে রক্ত বার করে হো-হো করে হাসতে দেখে বুঝেছিলাম ঐ লোকটির শরীর আর ওর নিজের নেই। আর, শরীরের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হলে মানুষ্যজন্মের কিইবা বাকি থাকে।
মৃত্যুর অভিজ্ঞতা কোনো মানুষের নেই, কারণ পুনর্জীবন পাওয়া যায় না। কপালে বুলেট বিঁধিয়ে কিংবা পায়ের শিরা কেটে কিংবা আধ ডজন ঘুমের ওষুধ খেয়ে একবার মৃত্যুকে-যত কষ্টই হোক, চেখে দেখতুম-যদি আবার জেগে উঠে এই ভুবনমনোমোহিনীকে দেখতে পারার নিশ্চয়তা পেতুম। অনেক মানুষকে সাময়িকভাবে জ্ঞান হারিয়ে পুনরায় সেই দুর্লভ জ্ঞান ফিরে পেতে দেখেছি। তাদের কি সেই অচেতন জীবনের কথা মনে থাকে ! জানি না।
তবে বদ্ধ উন্মাদদশা থেকে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেলে দেখেছি সেই মানুষটি হঠাৎ বড় দুঃখী হয়ে পড়ে। হয়তো এই জীবনের স্বাদ এতই তীব্র যে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো চেতনা ফিরে এলে সমস্ত অস্তিত্বকে ঝলসে দেয়। নচেৎ বদ্ধ-উন্মাদদশায় পাগলেরা বেশ সুখেই থাকে মনে হয়, অন্তত সুস্থ মানুষের চেয়ে যে তারা উঁচু একথা তাদের ব্যবহার বেশ স্পষ্ট। পাগলেরা কথা বলে, চিৎকার করে, পা ফেলে দুম্ দুম্ করে, মুখভঙ্গি করে ভয়ংকর। বেদনাচ্ছন্ন, দুঃখী পাগল খুব কম দেখা যায়। দুঃখ চতুর্গুণ প্রবল হয়ে ফিরে আসে তখনই যখন অকস্মাৎ চেতনা ফিরে আসে।
আমাদের পাশের বাড়ির রকে একটি মেয়ে কদিন ধরে এসে রয়েছে। কোথা থেকে হঠাৎ এলো কে জানে। আর যেতে চায়না। যায়গা নোংরা করে। মেয়েটা ফর্সা, বয়সে তিরিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, শরীর প্রায় ভেঙে গেছে। খুব সম্ভবত পূর্ববঙ্গের নির্যাতিত। খবরের কাগজে এবং গল্পে যাদের কথা পড়েছি তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। মেয়েটি বদ্ধ উন্মাদ। কথাবার্তা সম্পূর্ণ উল্টোপাল্টা, মাঝে মাঝে দু-এক লাইন রামায়ণ মহাভারত বলে-তাতে মনে হয় কিছুটা হয়তো লেখাপড়া জানত। কোনো স্মৃতি নেই, কোন কথার মধ্যেই কোনো সঙ্গতি নেই। যেমনঃ ‘মা একটু সুপারি দেবেন, খাম পোস্টকার্ড বানাব। বিড়ালটা ঘুর ঘুর করে ক্যান – ওর মায় তো মাদারীপুরে উকিল হইছে’। 
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, পাগলী তোর নামকি? ও উত্তর দেয় , ‘আমার নাম? আমার নাম সুজি। চিনি কম দিছে। তাই মিষ্টি না’। 
এই সব কথা শুনে সকলে হাসাহাসি করে। রোদ্দুরে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, এঁটোকাঁটা খায়, কুকুর বিড়ালের সঙ্গে মারামারি করে। রাত্তির বেলায় একটুও ঘুমোয় না। এলোমেলো চিৎকার করে। ওর প্রতি কারও দয়া করারাও উপায় নেই। রাত্তিরে বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট পায় বলে এক ভদ্রলোক তাঁর সদর দরজার মধ্যে থাকতে দিয়েছিলেন – কিন্তু মাঝরাত্তিরে সে এমন চিৎকার করতে আরম্ভ করল যে বাধ্য হয়ে তিনি তাকে বের করে দিলেন। আমি ওকে দেখে এক নজরেই বুঝে নিয়েছিলুম যে ওর আর কোনো আশা নেই, মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা ছাড়া।
একদিন প্রবল বর্ষণমন্দ্রিত মধ্যরাতে আমি সেই উন্মাদ মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলুম। মেয়েটা হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে আর বলছে, ‘কতদিন কিছু খাইনাই, পড়ার কাপড় নেই …. উঃ, পারি না, কোথায় যাব আমি …. আর পারি না।’ জানালা দিয়ে দেখলুম মেয়েটা হাঁটুতে মুখ ঢেকে যে- কোন উপন্যাসের নায়িকার মতো রোদন করছে। একবার মুখ তুলল সে – তার বৃষ্টিধৌতমুখ দেখলুম, অশ্রুময় চোখ দেখলুম – সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে কি মেয়েটা পাগলিনীর ছদ্মবেশে আছে-না তার জ্ঞান ফিরে এসেছে!
পরদিন সকালে তাকে আবার দেখলুম রুটির টুকরো নিয়ে কুকুরের সঙ্গে লড়াই করতে। চোখের দৃষ্টি কুকুরটার চেয়েও ভয়ানক উগ্র। আমার ইচ্ছে হলো, কাল রাত্রের কথা ওর মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করি।
তারপরেই মনে হলো, সেটা বোধ হয় নিষ্ঠুরতা হয়ে যাবে। সে কি আমার কথা বুঝবে? তার ভাষা আর আমার ভাষা তো সম্পূর্ণ আলাদা।

Post a Comment

3 Comments

Abs Rumon said…
vai, ami uponnasher 1st 3ta part pathalam font soho. Boita ajkei prokash korle khushi hotam, jai hok rongmohol a banar lekha shesh.amarboi.comer user barbe asha kora jai.
Abs Rumon said…
ami info@amarboi.com a lekha pathieci.
Riton Khan said…
please check this link
http://www.amarboi.com/2011/05/blog-post_26.html