Ticker

6/recent/ticker-posts

বন্ধ করো না পাখা রফিকুর রশীদ

amarboi.com
বন্ধ করো না পাখা
রফিকুর রশীদ

সহসা দরজার কবাট খোলার মতো প্রশ্ন করে মারিয়া,
পরকীয়া শব্দের ব্যুৎপত্তি মনে পড়ে স্যার?

প্রশ্ন শুনে আমার পিলে চমকে ওঠার দশা। সোজাসুজি তাকাতেও পারি না, ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি সংকোচে। টিচার্স কমনরুমে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে বেশ ক'জন সহকর্মী। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মোজাম্মেল সাহেবও আছেন উত্তর কোণায়, ভাঁজভাঙা খবরের কাগজের আড়ালে কোনদিকে তার কুতকুতে দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন ঠিক আছে! মুখ খুললেই নর্দমার কাদাপ্যাঁকের মতো দুর্গন্ধ বেরোয়, কথা বলতে শুরু করলে তার মুখে বাধে না কিছুই। এই পরিবেশে মারিয়ার এটা কী ধরনের প্রশ্ন হলো! পরকীয়া শব্দের ব্যুৎপত্তি জানা কি এতই জরুরি!
মারিয়া সুলতানার এই এক দোষ_ কারও কানকথা কিংবা বৈরী পরিবেশনকে সে মোটেই পাত্তা দিতে চায় না। এটা তার গুণও বটে, চরিত্রের দৃঢ়তা। কত না স্পষ্টভাবে সে বলতে পারে_ 'ওসব পাত্তা দিতে নেই স্যার। পাত্তা দিয়েছেন কি ভূতের মতো লাফিয়ে উঠবে ঘাড়ে, ঠ্যাং দোলাবে ধেই ধেই। হুঁ।' কথা শুনে মনে হয় জীবনের অভিজ্ঞতা বুঝি ওর বয়সকেও অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। হাতের চক-ডাস্টার, অ্যাটেন্ডেন্স খাতা নির্দিষ্ট ড্রয়ারে রেখে এসে মারিয়া আমার পাশের চেয়ারটিতে ধপাশ করে বসে পড়ে। চশমাটা নামিয়ে রাখে টেবিলে। সোনালি ফ্রেমের রিমলেস গ্গ্নাস। নাকের ডগায় এই চশমা চড়ানো তার বেশিদিনের নয়। মারিয়ার চশমাবিহীন নিরাভরণ মুখটুকুই আমার বেশি ভালো লাগে, মনে হয় কেমন যেন চড়ূই চড়ূই স্বভাব; কিন্তু ওই চশমা তার চেহারায় এনে দিয়েছে ভারিক্কি ছাপ। মারিয়ার নাকি মুখোশ পরার মতো অনুভূতি হয়। আমি মনে করিয়ে দিই_ শিক্ষকতার মুখোশ তো পরেই আছো সারাক্ষণ! 'শিক্ষকতার মুখোশ' শব্দযুগলের ব্যাপারে তার প্রবল আপত্তি। প্রতিবাদ জানায় তীব্রভাবে। মারিয়া এই রকমই। আজ তার মাথায় ঢুকেছে পরকীয়া। টেবিলের সঙ্গে বুক লাগিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে সে বলে,
শব্দ তো শব্দই। ফুলের মতো। থোকা থোকা, আবার একা একাও। গেঁথে দিলেই হয় কথার মালা।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি মারিয়ার কথা। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। আমাদের কলেজে সে ইতিহাস পড়ায়। কিন্তু তার অধিক আগ্রহ সাহিত্যে। নিজস্ব পড়াশোনার প্রাঙ্গণে ইতিহাস অপেক্ষা সাহিত্যের সীমানায় অধিক বিস্তৃত। সেই সুবাদেই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পাঠরুচি কিংবা কথা বলার ভঙ্গি নিয়ে প্রশংসা করলে গালে টোল ফেলে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। অবলীলায় বলে, এসব তো আপনার কাছ থেকেই পাওয়া। আমি অভিভূত হই, খানিক বিব্রতও হই। আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না, অথচ মারিয়ার জোর দাবি_ সে আমার ছাত্রী ছিল। শিক্ষকতা জীবনে শুরুতে আমি যে কলেজের শিক্ষক ছিলাম, সেখান থেকেই নাকি তার ইন্টারমিডিয়েট। সেই ব্যাচের দু'চারজন ছাত্রছাত্রীর চেহারা এখনও ভাসাভাসা মনে আছে। বিশেষ করে শান্তা নামে সায়েন্সের একটি মেয়ের মুখ আজও বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। 'দুঃসময়' আবৃত্তি করে পুরস্কার পেয়েছিল। তার কণ্ঠের 'এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা'_ আমি যেন এখনও দিব্যি শুনতে পাই। মারিয়ার দাবি_ শান্তা তারই সহপাঠী বান্ধবী, স্বামীর সঙ্গে কানাডায় থাকে; আজও তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। নাহ্, আমি কিছুতেই শান্তার পাশে মারিয়ার মুখ মনে করতে পারি না। কৌতূহলে শুধাই,
তুমিও কি সায়েন্স পড়তে?
খিলখিল করে হেসে জবাব দেয়,
জি স্যার। রোল নম্বর আনলাকি থার্টিন্স।
রোল নম্বর বলে আবারও হাসতে থাকে। আমি জিগ্যেস করি,
এত হাসির কী হলো?
হাসতে হাসতেই সে ব্যাখ্যা দেয়,
তের দু'গুণে ছাবি্বশ। মানে ডাবল আনলাকি। অথচ আপনি সেই টুয়েন্টি সিক্সকে ঠিকই মনে রেখেছেন। এতদিনে বুঝলাম_ নাম্বার থার্টিন যথার্থই আনলাকি।
আমি সবিস্ময়ে মারিয়ার দিকে তাকাই,
তার মানে তুমি বলছ_ শান্তার রোল ছিল টুয়েন্টি সিক্স?
জি। এতক্ষণে মনে পড়ছে সব!
হঠাৎ দেখি মারিয়ার চোখ ছলছল করছে। কিন্তু কেন, সেটাই আমি বুঝতে পারি না। ভয়ানক বিব্রতবোধ করি। দশ বছর পূর্বে সে আমার ছাত্রী থাকলেও তো বর্তমানে সে আমার সহকর্মী। কী কথায় কোন কথা উঠে এলো যে তাকে এভাবে চোখের জল ফেলতে হচ্ছে! আঁচলে চোখ মুছতে হচ্ছে! আমি নিরুপায় হয়ে বলে উঠি_ এসব কী হচ্ছে মারিয়া? তোমার কেন মন খারাপ?
না, মারিয়া সেদিন আর কোনো কথাই বলে না।
মারিয়া সুলতানার প্রকৃতিটাই ওই রকম। মনের আকাশে মেঘ জমলে ঘন-ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে জমাট বাঁধবে, তারপর কখনও এক পশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে তবেই রক্ষা। মুড অফ হলে সেদিন কে আর কথা বলায় তাকে! এমনিতে সারাদিন সারাবেলা কথার খই ফোটে তার মুখে। মনটা তখন শরৎ আকাশ, মুঠো মুঠো রোদ ছড়ানো কিংবা নির্মেঘ চাদরে জোছনা ঝরানো অমল ধবল। তখন পেয়ে বসে কথার কাকলিতে। শব্দ নিয়েই কত রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তার। কী চমৎকার করে বলে সে,
শব্দের গায়ে রঙ চড়িয়েছে কে বলুন তো! শব্দের গায়ে গন্ধ মাখিয়েছে কে? প্রশ্ন করার পর এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে দেয় কাশফুলের মতো। আমি তখন ওই হাসির গায়েও বর্ণগন্ধ খুঁজে পাই। অভিভূত হয়ে কান খাড়া করে থাকি। মারিয়া নিজে থেকেই জবাব দেয়_ এসব হচ্ছে কবিদের কাজ। শব্দকে পবিত্র করা, কলুষিত করা, এ সবের মানে হয়?
একটুখানি থামে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চকিতে কী যেন জরিপ করে নেয়। তারপর সহসা সে ফিরে যায় পুরনো প্রসঙ্গে, এই ধরুন, পরকীয়া শব্দটির কথা। কী দোষ এ শব্দের? কেউ কেউ এই শব্দের গায়ে মিঠেকড়া গন্ধ খুঁজে পায়, মিঠে আবার কড়া; তবে কী কাঠমলি্লকার মতো? না, তার চেয়েও তীব্র; তবে কটু। চেতনা নাশ করে দেয়।
কোনোমতে আমি উচ্চারণ করি,
কী সর্বনাশ!
মারিয়া চমকে ওঠে,
আপনিও তাই বলেন? টানা এক দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার কণ্ঠে, হঠাৎ সে উচ্চারণ করে_ হায় জীবনানন্দ!
আমি বলি, এর মধ্যে জীবনানন্দকে টানা কেন?
'না ভাবছি, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!'
'তোমার কথার জাদুকরী প্যাঁচ আমি বুঝি না মারিয়া। ছিলে বেশ পরকীয়ায়, হুট করে চলে এলে বেদনায়; মানে হয়?'
'হয় হয়। শব্দ দুটিতে কেমন গলায় গলায় ভাব, দেখতে পান না স্যার?'
'নাহ্! আমার চোখে তো পড়ে না।'
'চোখে পড়ে ঠিকই, মুখে বলেন না।'
'এ তুমি কী বলছ?'
'ঠিকই বলছি। আপনার কাছেই তো প্রথম জেনেছি বেদনার রঙ নীল।'
'আমার কাছে জেনেছ। কবে?'
'সেই কবে। আমার আজও মনে আছে_' 'কত দশা বিরহিণীর_ এই দুই তিন দশটি।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার পূর্ববাংলা কবিতার চরণ_ এখানে ত্রস্ত আকুলতায় চিরকাল অভিসার...।'
'সেই প্রথম বিরহিণী রাধার সঙ্গে পরিচয়, বেদনার নীলরঙ চিনতে শেখা। কী আশ্চর্য! তুমি বাংলায় অনার্স পড়নি কেন বলো তো!'
'শুনলে হাসবেন_ সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়েও ইতিহাসে চান্স পেলাম, অথচ বাংলা বিভাগের দরজাই খুলতে পারিনি।'
'তাই নাকি! সে কারণেই বুঝি সাহিত্যের প্রতি তোমার এত টান! '
'মানুষ যা চেয়েও পায় না, তার প্রতি আকর্ষণ তো থাকবেই চিরকাল।'
এতক্ষণে এসে আমি মর্মরিত হাহাকার শুনতে পাই, কাছেই কোথাও যেন বা বেজে ওঠে শূন্যতার করতালি। আজ বলে শুধু নয়, এর আগেও অনেকদিন আমাদের আলাপচারিতা ঘন হয়ে জমে ওঠার মুহূর্তে এসে মারিয়া এ রকমই দীর্ঘশ্বাসের উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। তখন সবকিছু নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, বর্ণহীন হয়ে পড়ে। আজ আমি ইচ্ছে করেই একটু আঘাত দিতে চাই, সোজাসুজি জানতে চাই,
'তুমি কী পাওনি বলো তো শুনি, কী নেই তোমার?
সে হিসেব তো মেলাইনি আজও!'
'এ তোমার বেদনা-বিলাসিতা মারিয়া।'
'তা বলতে পারেন। তবে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আমাকে ভীষণ নিঃসঙ্গ করে দেয় প্রবলভাবে দগ্ধায়। তখন নিজেই বুঝি না_ কী জানি পরাণ কী যে চায়...।'
'কিন্তু তোমার এই হাহাকার, এই না পাওয়ার আর্তি যে অন্যকেও সংক্রমিত করতে পারে, এটা কখনও ভেবেছ?'
'না তো! এই অনুভূতি কি আদৌ সংক্রমণযোগ্য?'
এইখানে এসে আমি ব্রেক কষি, সোজাসুজি জবান না দিয়ে বলি,
থাক এসব কথা। বেদনার রঙ নিয়ে কথা বলছিলে, সে-ই বরং ভালো। বলো, শুনি।
এক চিলতে বিষণ্ন হাসি ছড়িয়ে মারিয়া বলে,
'নীলরঙ গাঢ় থেকে আরও আরও প্রগাঢ় হলে এখন কালো হয়ে যায়, জানেন তো? আর কালো রূপ রঙ নিয়ে বাংলা ভাষায় কত কিছু যে সৃষ্টি হয়েছে তার তো ইয়ত্তাই নেই।'
'তা ঠিক। এক শ্রীকৃষ্ণের কারণেই কত যে পদ লেখা হয়েছে, গাওয়া হয়েছে!'
মারিয়া সহসা বেশ উষ্ণ হয়ে ওঠে, দুম করে প্রশ্ন করে বসে,
তবে কি এই জন্য পরকীয়ার রঙ হয়েছে কৃষ্ণকালো?
আমি চমকে উঠি, বলে কী মেয়েটা! পরকীয়ারও রঙ খুঁজে আবিষ্কার করেছে?
'কে বলল তোমাকে_ ওই রঙ কৃষ্ণকালো?'
'শুধু কি কৃষ্ণকালো! শুনেছি সে নাকি ভ্রমরকালো। রঙ নির্বাচনেও কেমন রোমান্টিকতা দেখেছেন!'
'কাক কালো কোকিল কালো, কিংবা মেঘ কালো আঁধার কালো_ এসব তাহলে তুচ্ছ?'
'ঠিক ধরেছেন। 'ভ্রমরকালো' শব্দের ব্যঞ্জনাই আলাদা।'
সহসা আমি হা হা করে হেসে উঠি উচ্চস্বরে।
ধীরে ধীরে কখন আমাদের টিচার্স কমনরুম ফাঁকা হয়ে গেছে। বেলা গড়িয়ে পড়েছে অপরাহ্নের গায়ে। পড়ন্ত বেলায় আমার হাসি খটখট করে বেজে ওঠে কর্কশ শব্দে। কী আশ্চর্য, সেটা মারিয়ার কানেও ধরা পড়ে! সে আমার হাতের ওপরে আলতোভাবে তার হাত ছুঁয়ে জিগ্যেস করে,
'স্যার, আপনি কি কাঁদছেন?'
আমার অন্তরে-বাইরে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে যায়। নিজেকেই প্রশ্ন করি_ কেন, আমি এভাবে কাঁদব কেন? আমার অন্তরে কেন গুমরে উঠবে হাহাকার? কী নেই আমার? স্ত্রী-পুত্র, ঘর-সংসার_ সব মিলিয়ে আমি এক মধ্যবয়সী গৃহী মানুষ। হ্যাঁ, আমার কন্যা তৃষ্ণা অবিবাহিতই রয়ে গেছে বটে, তাই বলে কি আমি এই মারিয়ার মধ্যে কখনও সেই কন্যার ছবি খুঁজেছি? বুকের ভেতরে কে এক সন্ন্যাসী মাথা ঝাঁকিয়ে না না করে ওঠে। তাহলে মারিয়া আমার কে_ সাবেক ছাত্রী? সহকর্মী? কত সহজেই সে বলতে পারে, শুকনো হাসি দিয়ে আপনি ভেতরের অশ্রুপাত কেন ঢাকতে চাইছেন?
আমার মগজের কোষে চিনচিন করে রাগ চড়ে যায়, চাঁদি দপদপ করে_ আমার ভেতরে যা-ই ঘটুক, কেন আমি তার কৈফিয়ৎ দিতে যাব? কার কাছে জবাবদিহির দায় আমার? বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে আমি প্রস্তাব রাখি,
'চলো উঠি মারিয়া, বেলা অনেক গড়িয়েছে।'
মারিয়া তখন শব্দ শব্দ খেলার মধ্যে নিজেকে আড়াল করে। সে বলে_ 'মানুষ কতভাবে যে শব্দের ওপরে নির্যাতন করে স্যার! কী এমন বেলা গড়িয়েছে আপনার।'
মারিয়ার এ প্রশ্নে আমি ম্রিয়মাণ হই, জবাব দিতে পারি না কিছুই।

আপনাদের সহযোগীতা না পেলে এই সাইট সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই যদি বইটি ভালো লেগে থাকে তাহলে দুচার লাইন লিখে আপনার অভিব্যাক্তিগুলো জানিয়ে রাখুন আমাদের কমেন্টস বক্সগুলোতে। আর শুধু মাত্র তাহলে আমরা আরও অনেক বই নিয়ে আপনাদের সামনে আসতে পারবো। ধন্যবাদ।

নতুন বই ইমেইলে পেতে হলে

Click on +1 button before download =>

Post a Comment

0 Comments