Ticker

6/recent/ticker-posts

সমরেশদা - মিহির সেনগুপ্ত

amarboi.com

সমরেশ বসু (১১ ডিসেম্বর ১৯২৪-১২ মার্চ ১৯৮৮)। ছবি : নাসির আলী মামুন

সমরেশদা - মিহির সেনগুপ্ত

সমরেশদার কিছু খুচরো স্মৃতি
মিহির সেনগুপ্ত
তোমার মধ্যে একটা লেখার প্রবণতা আছে বলে মনে হয় আমার। তাই আগেভাগেই বলে রাখছি। নইলে কী লিখতে কী লিখবে, আমার কথা লিখতে গেলে অনেকেরই হাত চুলবুল করে তো! যত সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য চুট্কুলা আর মুখরোচক কেচ্ছাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। দুশ্চরিত্র, মদ্যপ বলে খ্যাতি আছে তো আমার!
_তার জন্য তুমি নিজেও কম দায়ী নও। তোমার লেখাগুলোই দুশ্চরিত্র হিসেবে তোমায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এত প্রেমের কাহিনী, তার কিছু কি আর 'ঘটনা' নয়? মানুষ হয়তো এমন ভাবে।
_তোর কথাটা কী? তুই তো আমার সব লেখা পড়েছিস বলছিস। মিশছিসও অনেক দিন থেকে। কালকূটের সঙ্গে বাস্তব ভ্রমণও তোর কম নয়।
_আমার মনে হয়, তোমার মধ্যে সেঙ্ ফ্যান্টাসির একটা মস্ত বড় ব্যাপার আছে।
_তা আছে। তবে সেটা কোন লেখকের মধ্যে নেই? ব্যাপারটা যখন কালকূট হিসেবে লিখি, তখন প্রেমের একটা মহিমান্বিত রূপ প্রকাশ করার প্রচেষ্টা থাকে। কালকূট কখনো উপভোগে মত্ত হয় না, ভোগে স্নিগ্ধ থাকে। সমরেশ বসুর ব্যাপারটা আলাদা, সে ব্যাটার বাস্তবের প্রতি নিষ্ঠ থাকার দায় আছে।
_দায়টা কার কাছে?
_প্রথমত, নিজের কাছে কনফেশনের প্রশ্নে, দ্বিতীয়ত, পাঠকদের কাছে আর্ট এবং ভণ্ডামিমুক্ত থাকার স্বার্থে।
_কনফেশন কেন? কোনো কাজের জন্য কি পাপবোধে ভোগো?
_পাপবোধে যারা ভোগে না, তারা ক্রিমিনাল, অন্তত সাইকোলজিক্যালি।
কথাগুলো মোটামুটি এ রকমভাবেই হয়েছিল রূপনারায়ণের কুলের এক সেচ বিভাগের বাংলোর বারান্দায় বসে এক বর্ষণমুখর সকালে। অনেকে মিলে গিয়েছিলাম। আগের রাতে যথেচ্ছ ইলিশ মাছ, খিচুড়ি এবং 'রস'-এর কল্যাণে বাকি সবাই তখনো ঘুমে বিভোর। সমরেশদা আর্লি রাইজার। অভ্যাসটা আমারও। প্রাতঃকৃত্য সেরে দুজনে নিরুপদ্রবে হালকা কথাবার্তা কইছিলাম। জায়গাটির নাম 'দেনার'।
প্রকৃতি এখানে অকৃপণ। বাংলোর আশপাশে বিরাট এলাকা নিয়ে পাঁচিলঘেরা বাগান। বিশাল বিশাল গাছ, বেশ সযত্ন পরিচর্যায় প্রতিপালিত। সামনে রূপনারায়ণ তার বিরাট বিস্তার নিয়ে বিরাজমান। সার্থকনামা নদ। জীব জগতে নাকি পুরুষ প্রাণী স্ত্রী প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতর। এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও। নদী এবং নদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই নিয়মটি অন্তত খাটে না। আমার কাছে নদ বলতে অজয়, দামোদর ইত্যাদি। তাদের কখনোই আমার দর্শনধারী বলে মনে হয়নি। কিন্তু রূপনারায়ণ তা নয়। তার মধ্যে যেমন একটা ম্যাচো ভাব, তেমনই কাণ্ড স্বভাব। এ ছাড়া নদীই আমার কাছে আকর্ষণের। তার প্রেমিকাসত্তাটি আমাকে বড় মজায়।
এখানে প্রকৃতির বিস্তারটি প্রকৃতই উদার। সমরেশদা তাঁর লেখালেখিতে প্রকৃতিকে মানুষের পরিমণ্ডল ব্যতিরেকে ব্যবহার বিশেষ করেন না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু তাঁর স্বভাবে প্রকৃতি-প্রিয়তা বড় ব্যাপক। মানুষটি প্রকৃতিকে আকণ্ঠ-আস্বাদে ভোগ করেন। ব্যাপার আরো সত্য মনে হয়েছিল, যখন অনেকক্ষণ কথাবার্তা কইবার পর, দুজনেই গাছেদের বিপুল বর্ষণের মধ্যে প্রায় নৃত্যরত দেখছিলাম এবং মৌন ভঙ্গ করে বলেছিলাম_একটা গান গাও। সমরেশদা কিছুকাল নাকি দস্তুরমতো না হলেও শিখেছিলেন। আমার অনুরোধটা পরিবেশের সমর্থন পেয়েছিল। প্রথমেই তিনি শোনালেন 'আজি বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি।' গলা অসাধারণ নয়, তবে সুরে আছে এবং তাঁর আবেগ পরিবেশ ও গানের বাণীর সঙ্গে একাকার হয়ে অনবদ্য লেগেছিল। আমি ভুলভাল সুরে অজস্র গান গাইতে পারতাম। সমরেশদাকে আগে শুনিয়েওছিলাম। সেদিনও গেয়েছিলাম তাঁর নির্দেশে। অতুলপ্রসাদী টপ্পা_'তাহারে ভুলিবি বল কেমনে?' পরিবেশ মজিয়েছিল দুজনকেই। সুরের শুদ্ধাশুদ্ধি কাউকেই বিব্রত করেনি। মনে বড় আনন্দ ছিল দুজনেরই।
সেদিন রাতের পান-ভোজনের পর দলের সবাই ঘুমোলে সমরেশদা বলেছিলেন, ইলিশ মাছ ধরা দেখেছো কখনো রাতের বেলায়? জেলেদের ডিঙিতে চেপে? বলেছিলাম, ছোটবেলায় দুই-একবার, দেশের বাড়িতে।
_দেশ কোথায় ছিল?
_বরিশালে।
_চলো আজ রূপনারায়ণের মাঝিদের সঙ্গে দেখি। বলা যায় না, হয়তো বরিশালের কোনো জেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েও যেতে পারে। উদ্বাস্তু হয়ে কতই তো এসেছে এ পারে।
সেদিন এক চমৎকার অভিজ্ঞতা এবং সম্পর্কের উষ্ণতায় রাতটা কেটেছিল। এই ঘটনার কাহিনীটা আমি একটা ছোট পত্রিকায় ভিন্নভাবে লিখেছিলাম। এখন বিস্তারিতে আবার লিখছি। আগের লেখাটা হয়তো দু-চারজন পড়ে থাকলেও থাকতে পারেন। বরং একটা বড় লেখার মধ্যে কাহিনীটা ধরা থাকুক_এমন ভাবছি এখন।
সমরেশদার সঙ্গে সেদিন আগেভাগে কথাবার্তা হয়েই ছিল। রাতে সঙ্গের সাথিরা সারা দিনের হুল্লোড় এবং মদ্যপ্রভাবে রাত ১১টার মধ্যেই ঘুমে কাদা। সমরেশদার নিয়মিত পানাভ্যাস ছিল, সুতরাং ছন্দপতন ঘটাতেন না। আমার তখন সবে মদ্য-প্রাশন ঘটেছে। সুতরাং মনে ভয় এবং পাপবোধ দুটোই। ব্যাপারটা বিত্তাং বলার হেতু এই যে বরাবর একটা রটনা শুনে এসেছি যে সমরেশদার নাকি মাত্রাজ্ঞান নেই, সময়-অসময়ের ঠিক নেই, কাছা-কোঁচার পর্যন্ত সাব্যস্ততা থাকে না, তিনি নাকি এমনই দরের একজন পানাসক্ত ব্যক্তি। আমি অবশ্য আমার সুদীর্ঘ সাহচর্যে কোনো দিন তাঁর এমন অবস্থা দেখিনি। তাঁর প্রথম যৌবনকালে কী করেছেন, সেটা অবশ্য জানা নেই। তখন আমার বয়সটা তাঁর সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত ছিল না।
অতএব, আমাদের দেহমন ফুরফুরে থাকলেও ইন্দ্রিয় তথা প্রতঙ্গ-নিচয় যথা-স্বাভাবিকই ছিল। আমার মধ্যে একটা ভিন্ন উন্মাদনা কাজ করছিল। জানতাম, 'গঙ্গা' উপন্যাসটি লেখার আগে তিনি দীর্ঘদিন জেলেদের সঙ্গে তাদের কঠিন জীবনের সঙ্গী হয়ে শুধু ক্ষেত্রকর্ম করেছিলেন। উপন্যাসটির বাস্তবতা সেই বিষয়ে ব্যাপক সাক্ষ্য দেয়। লোকজীবনের কত মহৎ উপন্যাস রচনা করার জন্যই যে তিনি এ রকম কঠোর বাস্তবতার মধ্য দিয়ে গেছেন!
অনেক দূরে গুটি গুটি ভাসমান ডিবড়ির আলো দেখা যাচ্ছিল। ওগুলো আসলে ইলিশ ধরা নৌকোর ডিবড়ির আলো। নৌকোগুলো অন্ধকারে ঠাহর হয় না, শুধু আলোগুলোকে মনে হয় যেন তারা জলের মধ্যে ভাসছে। একটা আলো খানিক কাছাকাছি এলে সমরেশদা মুখের দুই পাশে হাত দুটো চোঙার মতো করে একটা তীব্র আওয়াজ করলেন। এ আওয়াজ জেলেরা বোঝে। নৌকো থেকে তাই একই তীব্রতায় প্রতি-আওয়াজ এল একটা। সমরেশদা বললেন, হবে হে, আমাদের মাছ ধরা দেখা হবে। বললাম, কী করে বুঝলে?
_না হলে আওয়াজটা অন্য সুরে দিয়ে, নৌকো মাঝের দিকে চালিয়ে দিত। আওয়াজটা শিখেছিলাম সেই 'গঙ্গা'র সময়ে। ব্যাপারটায় খানিক মন্ত্রগুপ্তি আছে। না শিখলে, না জানলে, এমনি হবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি লম্বাটে নৌকোর ছুঁচলো মুখ জলের প্রান্তে এসে লাগল। আকাশে তখন বর্ষা রাতের মেটে জোছনা। সারা দিন বৃষ্টি গেছে, খুব তাড়াতাড়ি আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু জলের কিনারে পেঁৗছাতে অন্তত শ-তিনেক কিলোমিটার কাদা পেরিয়ে যেতে হবে। সমরেশদা বললেন, পারবে? ব্যাপারটা কিন্তু সহজ না। বললাম, আমার কথা ছাড়ো। আমার জিলায় সন্তানরা মাতৃগর্ভ থেকে সরাসরি কাদায় পড়ে। তুমি যখন গঙ্গামাটির কাদায় জীবন দর্শন করছিলে, সেটা ছিল তোমার ভাবের দশায় কাদাঘাটা, আমি তখন কোমর অবধি পাঁকে ডুবিয়ে চ্যাং, পাঁকাল, বান মাছ ধরার নামে জীবনের দুঃখ হাতড়াতে শুরু করেছি। বয়স তখন ১০ কি ১১! আমায় কাদা চিনিয়ো না।
_আরে আমিও বাঙাল বাচ্চা মূলত।
_সে তো ঢাকাই বাঙাল। বরিশালে যদি কোনো কালে একটা বর্ষা কাটাতে, না হয় কথা ছিল।
আমি পূর্ব বাংলার সব চাইতে নদী, বিল, বাঁওড়ের জিলার ছেলে ছিলাম। ১০-১২ বছর বয়স থেকে মাছ ধরা দেখতে এবং মাছ ধরতে খাল, বিল, নদী, বাঁওড়ে জেলেদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে ভোররাতে বাড়ি এসে বাবার বিদ্যাসাগরী চটি বা কাষ্ঠ খড়মের আস্বাদ! কত করেছি তার কি শেষ আছে? অবশ্য সেই মাছের ভাগ যা পেতাম, তা বাবা খেতেন না, এমনো নয়। সুতরাং সমরেশদাকে একেবারে তুবড়িতে যেন উড়িয়ে দিলাম।
মাঝি আওয়াজ দিতে, কাপড় গুটিয়ে চটি হাতে দুজনে থপাস্ থপ, থপাস্ থপ্ চলছি তো চলছি। দুজনেরই কাঁধে ঝোলা। সমরেশদারটা একটু যেন ভারী।
সে রাতের নৌকোভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হয়েছিল, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। মনে উত্তেজনাটা ছিল একজন বিখ্যাত এবং বিতর্কিত লেখকের সানি্নধ্যে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করার। প্রকৃতির ব্যাপারটা তো ছিলই। তাঁর সঙ্গে কাছে-দূরে কম জায়গায় ঘুরিনি। কিন্তু রূপনারায়ণের এই বেড়ানোটার মতো বেড়ানো আর ঘটেনি। বর্ষকালের রাত ছিল সেদিন। শুক্লপক্ষ হলেও জোছনার প্রাবল্য ছিল না মোটেই। বৃষ্টি হচ্ছিল না বটে, তবে আকাশে মেঘের আনাগোনা যথেষ্টই ছিল। ফলে কখনো মেঘ, কখনো চাঁদের আলো_একটু ভিন্ন প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করছিল।
নৌকোয় উঠে কী কায়দায় বসে পায়ের কাদা সাফ করতে হয়, দেখলাম সেসব কায়দাকানুন তাঁর রপ্তে দিব্য আছে। নৌকোয় জুত করে বসে, থলে থেকে একটি বেশ বড় মাপের পেটমোটা বোতল বের করে জেলেদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ তার হাতে দিয়ে বললেন, জল, পাত্র_এসব আছে তো?
_আইজ্ঞা। তাঁর উত্তর। আমি 'আইজ্ঞা' শুনে বুঝলাম তিনি পূর্ব বাংলার।
নৌকোয় তিনজন জেলে। তাদের একজন কিশোর প্রায়। সমরেশদা বললেন, তোর খেয়ে কাজ নেই। এখনো গোঁফ গজায়নি। বড় দুজন কিশোরটির হাতে 'খুঁট' ধরিয়ে চারটি নারকেলের মালা বের করে বললেন, এতে চইলব্যে, বাবু? এ ছাড়া তো পাত্তর নাই আইজ্ঞা। সমরেশদা বললেন, খুউব চলবে। কিন্তু 'বাবু' ডাকটা চলবে না। আমার নাম এই। খুব অস্বস্তি লাগলে সঙ্গে একটা 'দা' যোগ করতে পারো। এবার তোমাদের নামগুলো বলে ফেলো তো কত্তা।
_মোরে কত্তা কলেন! মুই কি কত্তা ডাকের যুগ্যি?
সময়টা ছিল আশির দশকের গোড়ার দিকের। তখনো নিম্ন বর্গের তথা অবহেলিত জাতের মানুষদের সামাজিক সম্মান তেমন প্রশংসনীয় স্তরে ওঠেনি। নিজেদের আত্মসম্মান বিষয়ে তাদের নিজেদেরই অবস্থান ছিল নড়বড়ে, যা এখনো যে পুরোটা গেছে এমন নয়। সমরেশদা মানুষের সম্মান বিষয়ে খুব সতর্ক-সচেতন মানুষ ছিলেন। ফাঁকা বুলি দিয়ে 'আমার-তোমার মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই' গোছের বাণী দিয়ে, লোকদেখানো উদারতার মধ্যে তাঁকে কখনো দেখিনি। যখন যে সমাজের মানুষের সঙ্গে মিশতেন, তাদের রীতি-কানুনটা রপ্ত করে নিতেন খুব দ্রুত। তারা যাতে সহজ সেই সহজতায় চলে যেতে পারত অক্লেশে। তিনি তাদের বরং বলতেন, দেখো, আমাদের-তোমাদের মধ্যে তফাত আছেই। সেটা যাতে আমরা উভয় তরফ থেকে আস্তে আস্তে কমিয়ে শেষ করতে পারি, সেই চেষ্টাটাই করা উচিত। এর জন্য হয়তো সময় লাগবে, তবে এ পাপ ঘুচবেই একদিন।
আমি অবাক হচ্ছিলাম নৌকোর জেলেরা সমরেশদা আর আমাকে অত সমাদরে নিল কেন এবং কোনো প্রশ্ন না তুলেই? আমরা কারা, কোত্থেকে এসেছি, আমাদের উদ্দেশ্য কী_কিছুই তো তারা জানতে চাইল না! সমরেশদা নৌকোর গলুইয়ে বসে পা ধুতে শুরু করার আগে একবার বলেছিলেন, আমরা একটু তাদের সঙ্গে ভেসে ভেসে মাছ ধরা দেখতে চাই। ব্যস, তারা অমনি রাজি হয়ে গেল? শুধু বলল, সে আর এমন কী কথা? তবে এ বড় কষ্টের ব্যাপার। আপনারা শহর-নগরের বাবু মানুষ, কাদাপ্যাকে পা ডুবোয়ে আলেন, না বলব না। তবি বড় কষ্টডা হবেনে আপনাদের।
এইমাত্র কথা। বয়স্ক লোকটি বাবা, অন্য দুজন তার দুই ছেলে। সমরেশদা নাম জিজ্ঞেস করলে বয়স্ক লোকটি জানালেন তাঁর নাম গাঙ্গুরী দাস, বড় ছেলে বলা বা বলরাম দাস এবং কিশোরটি ছোট ছেলে, নাম সুবল দাস। গাঙ্গুরী নামটি বেশ। পুরো নামটা হলো গাঙ্গুরীপদ দাস। গঙ্গাপদ নামটি শোনা যায়, কিন্তু গাঙ্গুরী নামটা একেবারেই অভিনব। সমরেশদাকে বললাম, তুমি যদি এ রকম একটা পটভূমিকা নিয়ে লেখায় এই নামটা ব্যবহার করতে, ভাবতাম তুমি ব্যাপারটা বানিয়ে ইচ্ছাপূরণ করেছো। কিন্তু সঙ্গে থেকে তো জানলাম, এসব ব্যাপারস্যাপার বাস্তবেও কত কাকতালীয় হয়। সমরেশদা বললেন, বাস্তবের মজাটাই তো ওখানে। সে সব সময়ই কল্পনাকে ডিঙিয়ে যায়। তবে সাহিত্যে বাস্তবের ব্যবহারটা গল্পের মোড়কে না করতে পারলে 'গাঙ্গুরী'কে উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র করা যায় না। কিন্তু এসব আলোচনা এখানে করলে আমাদের এই রাতটা নীরস হয়ে যাবে। তা ছাড়া ব্যাপারটা উপস্থিত যাদের সঙ্গে আমরা আছি, তাদের জন্য সম্মানজনকও নয়।
এই হচ্ছে সমরেশদার সাধারণের সঙ্গে মেলামেলার বিবেচনা। অন্য অনেক ক্ষেত্রেই সমরেশদা অনাবশ্যকভাবে সাহিত্যিক আলোচনা টাল খাইয়ে দিতেন। সেদিন নৌকোর মানুষদের এই মানুষটির স্বরূপ বুঝতে কিছুমাত্র সময় লাগেনি। এসব কথার স্মৃতিচারণা করছি এ কারণে যে আমার নিজের বরাবরের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল সমরেশ বসু কিভাবে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় চরিত্রগুলোকে, মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে নির্বাচন করতেন, তার রহস্য জানা। তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য তো তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অবশ্য জানতাম যে একসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং বস্তি এলাকায় থাকতেন, শ্রমিকদের মধ্যে। তা ছাড়া মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে সাধারণবর্গের মানুষদের সঙ্গে মেশার একটা সহজাত প্রবণতা তাঁর ছিল, যা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর কঠোর জীবনসংগ্রাম তথা শিল্পীসত্তা থেকে।
জেলেদের মাছ ধরা সেদিন মাথায় উঠেছিল। সমরেশদা জেলেদের জীবনেরই নানা গল্প করছিলেন। গাঙ্গুরী দাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কত্তা, কাত্তিক, নরেন, শীতল_এদের সঙ্গে পরিচয় ছিল কোনো কালে? ওরা একসময় গঙ্গায় মাছ ধরত। অনেক দিন হয়ে গেল, জানি না কে আছে, কে নেই বা কেমন আছে। গাঙ্গুরী বলেছিলেন, তা আর চিনিনে, তারা যে আমাদের আপ্তজন। আমরা হলেম গে জলের মানুষ। বাড়ি যেখানেই হোক, দেখা কখনো না কখনো তো হবেই। এই ধরেন, এক খ্যাপ্ মারতি যদি রায়মঙ্গলে গিয়ে পড়ি, সেখানে দেশ গাঁয়ের দুই-চারজনের সঙ্গে দেখা হবেই।
_ওপারের কোথাকার লোক তোমরা?
সাতক্ষীরের শ্যামনগর। একাত্তরের যুদ্ধে এদিকে আসতি হলো। কাত্তিক, লরেন, শেতল ওরা হল্য গিয়ে আপনার হাসনাবাদ বসিরহাটের দিকের লোক। তবে আসল কথা কী জানেন, জেলেগার বাড়িঘর যেখানেই হোক, আসল ঘর মোহনায়। ঘুরেফিরে সেখানে সবার সাথি দেখা হবেই।
_'মোহনায় আসল ঘর! বাহ, কথাটি তোমার বেশ, কত্তা।' সমরেশদা কথাটি উচ্চারণ করে বেশ কিছুক্ষণের জন্য মৌনী হয়ে গেলেন।
গাঙ্গুরী সমরেশদার হাতে একটি হুঁকো ধরিয়ে দিয়ে ছেলের সঙ্গে পানে ব্যস্ত। সুবল খুঁট ধরে আছে। একটাও মাছ পড়েনি, কিন্তু সে নিয়ে কারোরই কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি বোকার মতো চুপচাপ বসে ছিলাম। গাঙ্গুরী আমার অবস্থাটা বুঝে একটা নারকেল মালার পাত্র 'রস' পূর্ণ করে দিতে চাইলে আপত্তি জানালাম। আমার দৌড় এক-আধ চুমুক পর্যন্ত। সে কোটা সন্ধ্যাবেলায়ই শেষ হয়ে গেছে।
সমরেশদার যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। তাঁর এ রকম ভাবের ঘোরের সময় আমরা যারা সঙ্গে থাকি, তারা সাধারণত বিরক্ত করি না। তত দিনে বুঝে গেছি, ভ্রমণে বেরোলে এই মুহূর্তগুলো তাঁর প্রকৃত সম্ভোগের সময়। তাঁর কথায়, 'ভ্রমণ-বিষাদের ক্ষণ'। কারণ সময় ছুটে চলেছে। এই মুহূর্তটা আর ফিরবে না। সুতরাং 'সর্বপ্রকারে তাকে উপভোগ করে নাও, তার নির্যাস স্মৃতিতে গেঁথে রাখো।' লেখক মানুষ তো, পরে কাজে লাগাবেন। কিন্তু সেদিন এই মগ্ন উপভোগের সুযোগ তাঁকে দিলাম না। ধ্যান ভাঙিয়ে বললাম, কী ব্যাপার তে'পর রাত্তিরে মাঝগাঙে এনে ছেড়ে দিয়ে, নিজে যে ধ্যানী অমোঘ সিদ্ধি হয়ে বসলে? কী রকম লোক হে তুমি? বললেন, ধ্যানী অমোঘ সিদ্ধি! বেশ কথাটি বললে কিন্তু। আসলে সর্বভ্রমণে, সর্বস্থানে, সব সময় কথা-গল্প চলে না। এমন একটা বা প্রায় অনুরূপ পরিবেশেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন_'আমি মানব একাকী ভ্রমি, বিস্ময়ে প্রমি বিস্ময়ে।' আমি সেই 'বিস্ময়ের' খুদ-কুঁড়োটুকু চেটেপুটে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এই প্রগাঢ় স্তব্ধতা, এই বিস্তীর্ণ বারিধি, মাথার ওপরে অনন্ত আকাশ, সর্ব চরাচরে এই অসামান্য মৌন, এর মধ্যে কি কথা মানায়? এই উপভোগের মালিক, সর্বজীব জগতের মধ্যে একমাত্র আমি, মানুষ। কী অভিনব সৌভাগ্যের একমাত্র অধিকারী এবং তা শুধু একবারেরই জন্য।
বললাম, 'আবার যদি ইচ্ছা কর, আবার আসি ফিরে।' বললেন, সে কী হয় আর? কী জানি? সমরেশদা, আগেই বলেছি খুব সুকণ্ঠ না হলেও সুরে ছিলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে, গভীর হৃদয়াবর্তের মুহূর্তে নিজের থেকেই গেয়ে উঠতেন। অনুভূত। উপলব্ধ বিস্ময়কে, আনন্দ বা বিষাদকে প্রকাশ করার উপযুক্ত গানের কলিটি ঠিক সময়ে এসে যেত তাঁর কণ্ঠে এবং তা যেন প্রায় ঋকমন্ত্রের অমোঘ উচ্চারণের মতো ধ্বনিতে। তা যে সব সময়ই রবিঠাকুরের গানের বাণীই হতো, এমন নয়। লোকায়ত কোনো গীত বা গাথার একটি বাণীকেই হয়তো মূলাধারে রেখে। বাকিটা নিজেই বানিয়ে নিতেন। গোটা গানটি হয়তো মনে নেই। কোথায় কোন বাউল, ফকির, মাইজভাণ্ডারীর আখড়া বা মাজার থেকে শোনা একটি মনমতন কলি তখন হয়ে উঠত একটি ভিন্ন গান। সুর থাকত লোকায়তই, নইলে যাদের সঙ্গে বিহার তারা মজবে কেন? সে রকমই অবস্থায় এখন দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন_
এমন মানব জনম আর পাবে না_
যদি পেয়ে গেছ মজে গেছ
তারে ভোগ করে নাও ষোল আনা।
দিন বৃথায় যেতে দিও না হে_
শুধু কালের সাথে তালে তালে
যাও হে এই মধুর ভ্রমণে
পিছন থাকুক পিছে পড়ে, পিছে ফিরে থেকো না হে
পিছন পানে চেও না।
মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। গাঙ্গুরী বলে উঠলেন, 'বলিহারি যাই, বলিহারি যাইগো সাধু! আমার ক্যান্ য্যানো ডুবি মরতি ইচ্ছে হচ্ছে।' সমরেশদা বললেন, মোরো না। ডুবে যাও শুধু। ডুবে দেখো কী পাও। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? সমরেশদা ভাবের ঘোরেই বললেন, তারপর আর কী? 'পিছন থাকুক পিছে পড়ে, পিছে ফিরে চেও না।' এইমাত্র যেটুকু দেখলে, পর মুহূর্তেই তা গতস্য শোচনা। সৎকারের পর থেকেই শোক বিবৃতির বিধান, দাহকার্য শেষ হলে যে পেছন ফিরে তাকানো নিষেধ, তার কারণও এটাই। লোকাচারে বলা হয়, তাহলে নাকি ভীষণ দৃশ্য চোখে পড়বে। কথাটা কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। তাই খাস কথা হচ্ছে, 'পিছে ফিরে চেও না', শুধু সামনে চলো।
_গানটা তুমি এখনই বাজালে?
প্রথম কলিটা প্রচলিত দেহতত্ত্বের গান, বাকি কথাগুলো ভুলে গেছি বলে বানিয়ে নিলাম আর কী।
রাত শেষের যামের দিকে হেলেছে। গাঙ্গুরীর দেহমনে এখন নেশা প্রবল, তবে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার মানুষ, বেসামাল নয়। ছেলেও তা-ই। নেশাভাং এদের করতেই হয়। নইলে এই অমানুষিক শ্রমের নিরন্তরতা বহন করতে পারবে কেন? গাঙ্গুরী সমরেশদার গান শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কত্তা কী দেহতত্ত্বে আছেন? সমরেশদা বলেছিলেন, আর কোনো তত্ত্ব যে জানিনে ভাই। তবে দেহতত্ত্বটাও কি জানি? ঠিক বলতে পারব না।
_তা জানলি তো সব তত্ত্বই জানা হয়ি যায়। কেউ জানতি পেরেছে, এমন জানেন?
_একজন জেনেছেন বলে বিশ্বাস।
_তিনি কেডা?
_তাঁর নাম রবিঠাকুর। তিনি গেয়েছেন 'এই কি তোমার প্রেম ওগো হৃদয় হরণ। এই যে আলো পাতায় নাচে সোনার বরণ।'
_সবটা বুজতি পারলাম না, তবি আলো যে পাতার সাথি রসে মইজে আছে সেটা দেহতত্ত্ব বটে।
গাঙ্গুরী দাসের কথাটা শুনে সমরেশদা হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর কাছে পেঁৗছে কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, তোমার বাড়ি আমায় নিয়ে যাবে কত্তা? না হলে যে এবারের তিথি দরশনের চলাটা পূর্ণ হবে না। তুমিই খাঁটি 'দেহতত্ত্ব'টা বুঝেছ। ওই বুঝটা বুঝতে আমাদের ঢের যুগ কাটে। তুমি ধন্য কত্তা।
মদে কি নেশা হয়? নেশা হয় কথায়, আড্ডায়। সমরেশদার সঙ্গে নানা ঘাট-আঘাটায় গিয়ে সেটা বুঝেছি। বুঝেছি কথার মতো কথা আস্বাদ করতে হলে কথার জাল ফেলতে হয় আসরে। কথার রসিক যাঁরা, তাঁরা ঠিক সেই জালে সময়মতো ধরা দেবেনই। কারণ কথার নেশা বড় জব্বর নেশা। গাঙ্গুরী অনেকক্ষণ ধরেই পান করে চলছিলেন বটে, কিন্তু তা তাঁকে যতটা না নেশার্ত করেছিল গান এবং কথা তাঁকে নেশার্ত করেছিল বেশি। সমরেশদার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। তাঁর কথা শুনে, গাঙ্গুরী যেন আবার তাঁর খোলসের মধ্যে ঢুকে গেলেন, সে খোলস উচ্চ-নিচের ভেদাভেদের ফলে তথাকথিত নিচের তলার মানুষের সন্দেহের খোলস, যেটা সব সময়ই যেন তাকে ঘিরে রাখতে চায়। পাছে উঁচুতলার মানুষ তাকে মিথ্যা সম্মান দেখিয়ে করুণা করে। অবশ্য এ সতর্কতা শুধু গাঙ্গুরীর মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শ্রমজীবীর। ব্যাপারটা ব্যাপক নিচের তলার মানুষের যদি থাকত, তবে এ দেশে সমাজ বিপ্লবের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হতো।
গাঙ্গুরী বললেন, তখন থেইকে আপনি আমাক 'কত্তা' কতিছেন। আবার এখন আমার বাড়ি যাতি চাচ্ছেন, আর কী সব ভালো ভালো কথা কয়েলেনও। মোরা মুক্যুসুক্যু, জাইলে কৈবত্ত মানুষ। সাঁইদার, মহাজনের লাত্থিকুত্থি, চাপরডা খাইয়ে বাইচে আছি। মোগোরে অত খাতির-সোম্মান কত্তি আছে?
সমরেশদা এসব কথা শুনছিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, বুঝলি, আমার ভ্রমণ হলো এটা। এই যে মানুষটিকে পেলাম, খানিক বুঝলাম, আবার অনেকটা না-বোঝা রয়ে গেল, একে রাখলাম আমার থলেতে। আমার ভ্রমণ শুধু প্রকৃতির খন্দর-কন্দরে নয়, মানুষের গহনে। মানুষ ছাড়া প্রকৃতিকে আমি আস্বাদ করতে পারি না। শুধু নদী, পাহাড়, বনবাদাড়, অরণ্য-সাগর ঢুঁড়ে হন্যে হলেই আমার বেড়ানো হয় না। মানুষকে সেসবের মধ্যে আমার চাই। উদ্দেশ্যের, রসগ্রহণের তফাত থাকে, আমারটা এ রকমই। এ ভ্রমণ আমি ঘরে বসেও করতে পারি। আমি জন্মসূত্রেই তীর্থঙ্কর। মানুষকেও তাই মনে করি। সবাই জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে প্রব্রজক জীবন যাপন করে। কিন্তু কেউ-ই কি পথের হদিস জানে? তিনি গেয়েছেন_'না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি আমি।' জন্ম থেকে মৃত্যু_সবটাই প্রব্রজনা। তাহলে কত্তা, এবার নাবিয়ে দাও, রাত শেষ। আর এটা রাখো, মাছ ধরার তো তেইশ মেরে দিলাম। তবে এটাকে দয়াধম্ম মনে কোরো না, এটা তোমার সময়ের যৎকিঞ্চিৎ দাম। সমরেশদা দুটো ১০০ টাকার নোট তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
সমরেশদার বিষয়ে সব কাহিনীই ভ্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও অন্য নিত্যনৈমিত্তিক কাহিনীও ঢের আছে, যা উল্লেখযোগ্য। অবশ্য এসব খুঁটিনাটি বিবৃত করে আমি এটা প্রমাণ করতে চাইছি না যে আমি তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলাম। আমার মতো অজস্র অনুরাগী তাঁর ছিল, বরং সেদিক দিয়ে বিচার করলে, আমি তেমন ঘনিষ্ঠজন তাঁর ছিলাম না। কথাগুলো এ কারণে লিখছি যে আমার ওপর তাঁর একটা প্রভাব আছে, যদিও লেখালেখির গুণগত দিক দিয়ে বিচার করলে সেই প্রভাবটা বোঝা যাবে না। কারণ যতই তাঁর লেখা পড়ে থাকি, যতই মানুষটিকে চিনেছি বলে দাবি করি না কেন, ওই সৃজনশীলতা বা রচনাশৈলীর অন্ধ অনুকরণ করাও আমার এই অর্ধশিক্ষিত ভোঁতা মগজে সম্ভব হবে না।
আমার এই বৃত্তান্ত আলেখ্যটা আমার নিজের কিছু হয়ে ওঠা-না হয়ে ওঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্মৃতিকাহিনী। সুতরাং সেই সূত্রে আমি যাঁদের সংস্পর্শে এসে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত বা প্রভাবান্বিত হয়েছি, কমবেশি সবার কথাই আমার বলতে হবে। আসলে এটাই তো আমার হওয়া-না হওয়ার বৃত্তান্ত। সেখানে অবশ্যই সমরেশদার মতো যাঁরা, তাঁদের বৃত্তান্ত বলাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তিনি যে বিশেষভাবে আমাকে মানুষের কাছে পেঁৗছানোর পথের হদিস দিয়েছেন, যেমন গাঙ্গুরীপদ দাসের কথা বললাম।
আমার একসময়ের, প্রায় প্রত্যহের, কাজ ছিল দুপুর আড়াইটে-তিনটের সময় সমরেশদার ১২ নম্বর সার্কাস রেঞ্জের বাসায় হানা দেওয়া। আমি ব্যাংকের যে শাখায় তখন কাজ করি, তার ম্যানেজার ছিলেন সমরেশদার খুবই ঘনিষ্ঠ এবং গুণগ্রাহী। বাড়ি হাওড়া বাজেশিবপুরে। নাম অম্বরনাথ, অম্বরনাথ ব্যানার্জি। আমি জীবনে নিজে ভবঘুরেপনা কম করিনি, কম ভ্রমণপাগল, ভবঘুরেও দেখিনি। কিন্তু অম্বরদার মতো এ রকম একজন পাঁড় ভ্রমণবিলাসী এবং আড্ডাবাজ মানুষ আরেকটি দেখিনি। বস্তুত, তাঁরই পেছন ধরে সমরেশদা এবং শক্তিদা, অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো সারস্বত ব্যক্তিত্বের দরবারে আমার গতায়াত। এঁরা দুজনেই অম্বরদার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। অম্বরদার নেতৃত্বে ব্যাংকের এবং তার বাইরের বিভিন্ন বয়সীদের একটি বেড়ানো পার্টি ছিল আমাদের। সে বেড়ানো এমন কিছু হিলি্ল-দিলি্ল বেড়ানো নয়, কাছেপিঠেরই বেশি। ডুমুরদহও সেই লিস্টে একটি পর্যটনকেন্দ্র বিশেষ। খুব দূরের মধ্যে উড়িষ্যার শিম্লিপাল অরণ্যের বড়হি, পানি ইত্যাদি স্থানের বাংলোকে কেন্দ্র করে বেড়ানো বা উত্তর বাংলার গরুমারা এবং অন্যান্য টি গার্ডেনের কেন্দ্রগুলোতে ঘোরা। জায়গা যেমনই হোক, একটা ভালো বাংলো এবং তার কাছেপিঠে একটা নদী, জঙ্গল এলাকা অথবা পাহাড় থাকাটা আবশ্যিক শর্ত ছিল। আর এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খবরাখবর, আলোচনা ইত্যাদি করার জন্যই ১২ নম্বর সার্কাস রেঞ্জে সময়-অসময়ে অম্বরদা আমাকে পাঠাতেন। ব্যাপারটা দুদিক দিয়ে আমার কাছে লাভজনক ছিল। এক, আমার অত্যন্ত অপছন্দের কাজ অফিস কর্তব্য পালন থেকে অব্যাহতি; দুই, সমরেশদার নিয়মিত সাহচর্য।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
আপনাদের সহযোগীতা আমাদের একান্ত কাম্য। তাই যদি বইটি ভালো লেগে থাকে তাহলে দুচার লাইন লিখে আপনার অভিমতগুলো জানিয়ে রাখুন আমাদের কমেন্টস বক্সগুলোতে। বন্ধু-বান্ধবদের বলুন এই সাইটটির কথা। আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমরা আরও অনেক বই নিয়ে আপনাদের সামনে আসতে পারবো। ধন্যবাদ।
Download Bangla books in pdf form mediafire.com and also read it online. Read it from iPad, iPhone. Samoresh Basu - Mihir Sengupta, bangla ebooks, free download , mediafire , humayun ahmed , zafar iqbal , sunil gangopadhaya , suchitra , bengali ebooks, free bangla books online, ebooks bangla, bangla pdf, bangla books, boi, bangla boi, amarboi.
নতুন বই ইমেইলে পেতে হলে

Post a Comment

0 Comments