Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন আহমেদ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

Humayun Ahmed by Zafar Iqbal
হুমায়ূন আহমেদ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল


আমি তখন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। বাবা কুমিল্লার ডিএসপি, ঠাকুরপাড়ায় বিশাল দোতলা বাসা। বাসার সামনে মাঠ, পাশে পুকুর। হোস্টেলে থাকতে থাকতে যদি মন কেমন কেমন করে, তাহলে বিআরটিসির বাসে করে কুমিল্লায় বাসায় চলে আসি। এক-দুই দিন থেকে আবার ফিরে যাই।
সেরকমভাবে আমি হুট করে কুমিল্লা এসেছি, আমি একা নই, আমার সঙ্গে আমার কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে। আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বাসায় এসে দেখি সেও আছে। বাসায় অনেক মানুষ থাকলে যা হয় তাই হলো, সারা দিন গল্পগুজবে কেটে গেল। আমাদের বাসায় গল্পগুজব হলে ঘুরেফিরে সেটা ভূতের গল্পে গিয়ে জায়গা নেয়। আমার বাবার এসব ব্যাপারে খুব কৌতূহল, তাই বাসাভর্তি ভূত-প্রেত, জ্যোতিষচর্চা এসবের বই। আমরা সব ভাইবোন জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হাত দেখেছি, প্ল্যানচেট করে চক্রে বসে ভূত নামিয়েছি। কাজেই এবারও গল্পগুজব ভূতের গল্পে আটকা পড়ে গেল। তখন আমার কলেজের বন্ধুরা বড় ভাই হুমায়ূন ভাইকে ধরে বসল, তাদের ভূত এনে দেখাতে হবে। হুমায়ূন আহমেদ রাজি হলো—ঠিক হলো রাত ১২টায় চক্রে বসা হবে।
সময় কাটানোর জন্য আমি আর আমার বন্ধুবান্ধব সেকেন্ড শো সিনেমা দেখতে গিয়েছি। আমরা যে খুব সিনেমার পোকা তা নয়, কিন্তু বড় ভাইয়ের উৎসাহে গিয়েছি, ভালো ছবি নাকি দেখাচ্ছে।
রাতে বাসায় ফেরার পর ভূত নামানোর জন্য আমরা চক্রে বসেছি। দোতলা বাসার নিচের তলায় কেউ থাকে না, সেখানে একটা বড় ঘর পরিষ্কার করা হয়েছে। মেঝেতে পরিষ্কার চাদর বিছানো হয়েছে, আমরা সবাই হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গোল হয়ে বসেছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ ঘরের চারকোনায় চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল, মোমবাতির মৃদু আলোতে একটা ভৌতিক পরিবেশ চলে এসেছে। আমরা কেউ জোরে কথা বলছি না। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ফিসফিস করে নিয়মকানুন বলে দিল, ‘তোমরা কেউ ভয় পাবে না। প্রেতাত্মা যদি চলে আসে, আমাদের কারও ওপর সেটা ভর করবে। তার সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলবে।’
আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, ‘এসেছে কি না কেমন করে বুঝব?’
‘অনেকভাবে বোঝা যায়। হয়তো মোমবাতিগুলো নিভে যাবে। হয়তো ঘরে একটা তীব্র গন্ধ পাবে, ঘরটা শীতল হয়ে যাবে। হয়তো কেউ একজন থরথর করে কাঁপতে থাকবে।’
তার থমথমে গলার স্বর শুনেই আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। 
হুমায়ূন আহমেদ বলল, ‘তোমরা সবাই এখন পরকাল নিয়ে চিন্তা করো, মৃত কোনো মানুষের আত্মাকে আহ্বান করো।’
আমরা গোল হয়ে বসে অন্যের হাত ধরে মৃত মানুষের আত্মাকে আহ্বান করতে থাকি, ঘরের ভেতরে আমাদের নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকে, মোমবাতিগুলো হঠাৎ করে নিভু নিভু হয়ে যায় আর একসঙ্গে সব মোমবাতি নিভে গেল। 
বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ ফিসফিস করে বলল, ‘এসেছে! কেউ একজন এসেছে! কিছু একটা এসেছে। কেউ ভয় পাবে না।’
তখন ভয়ে হাত-পা আমাদের শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আর কী আশ্চর্য, ঠিক তখন শুনতে পেলাম বাসার পাশে যে গাছ, সেই গাছের ডাল নড়তে শুরু করেছে, জানালার মাঝে গাছের ডালগুলো জীবন্ত প্রাণীর মতো হুটোপুটি খাচ্ছে। আমরা ভয় পেয়ে আর্তচিৎকার করে উঠি, ‘কী হচ্ছে? কিসের শব্দ?’
হুমায়ূন আহমেদ বলল, ‘চলো। বাইরে গিয়ে দেখি।’
আমাদের কারও বাইরে যাওয়ার সাহস নেই, তার পরেও হুমায়ূন আহমেদের পিছু পিছু বাইরে এলাম। আবছা অন্ধকার, কোথাও বাতাস নেই, তার মাঝে শুধু একটা গাছের ডাল জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে, হুটোপুটি খাচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে আমরা একজন আরেকজনকে ধরে কাঁপছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বলল, ‘ভয় পাবে না। কেউ ভয় পাবে না—হক ভাইকে ডেকে তুলে আনি।’
হক ভাইয়ের পুরো নাম আবদুল হক, বাবার অফিসের অর্ডারলি, বাসার সামনে ছোট একটা আলাদা টিনের ঘরে থাকেন। ধর্মভীরু মানুষ, কারও সাতেপাঁচে নেই। আমাদেরও মনে হলো, এই আতঙ্কময় মুহূর্তে তাঁকে ডেকে আনলে মন্দ হয় না, আমরা তাঁর ঘরের কাছে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। হক ভাই দরজা খুলে গুলির মতো বের হয়ে এলেন, গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে এলেন। আমরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে হক ভাই, কী হয়েছে?’
হক ভাই কথা বলতে পারেন না, ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন, অনেক কষ্ট করে বললেন, ‘আ আ আমার ঘরে...’
‘আপনার ঘরে কী?’
‘আমার ঘরে একটা মানুষ। ঘরের ছাদের সমান লম্বা। নিচু হয়ে তাকিয়ে আছে। হায় আল্লাহ!’
ঠিক তখন হঠাৎ করে গাছের ডাল ভয়ংকরভাবে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, তারপর হঠাৎ চারদিক নীরব হয়ে গেল। হুমায়ূন আহমেদ কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় একটা খারাপ প্রেতাত্মা চলে এসেছে, আমরা আর কিছু না করে এখানেই শেষ করে দিই।’
আমরা মাথা নাড়লাম, ‘হ্যাঁ। আর কিছু করার দরকার নেই।’
‘যার যার মতো গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওপরে গেলাম, গরমের দিন। ফ্যান চালিয়ে ভাইবোনেরা মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি গুটিসুটি মেরে তাদের দুই দিকে ঠেলে একটু জায়গা করে শুয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের কাউকে চেনা যায় না। ভয়ে আতঙ্কে একেকজনের উদ্ভ্রান্ত চেহারা, উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ।
আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। আমার অন্য বন্ধুদের কথা জানি না, কিন্তু আমি পাকাপাকিভাবে ভীতু হয়ে গেলাম। রাতে ঘুমাতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় মাথার কাছে ছাদের সমান লম্বা একটা মানুষ তীব্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে।
যারা ভূতের গল্প শুনতে পছন্দ করে, তাদের জন্য বলছি, গল্পের বাকি অংশটুকু পড়ার প্রয়োজন নেই। এখন পর্যন্ত যেটুকু বলা হয়েছে, তার প্রতিটি অক্ষর সত্যি—অবিশ্বাস্য হতে পারে, কিন্তু সত্যি। 

অনেক দিন পর বাসার সবার সঙ্গে কথা হচ্ছে, আমি কী একটা প্রসঙ্গে সহজ-সরল হক ভাইকে নিয়ে একটা কথা বলেছি। আমার মা মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, ‘হক ভাইকে বেশি সহজ-সরল মনে হচ্ছে? অ্যাকটিং দেখে তো সেটা বলিসনি!’
‘অ্যাকটিং!’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কিসের অ্যাকটিং?’
তখন সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে। সেই ভয়ংকর ভৌতিক রাতটি ছিল হুমায়ূন আহমেদের নেতৃত্বে বাসার সবার সম্মিলিত একটা ষড়যন্ত্রের ঘটনা। আমাদের জোর করে সেকেন্ড শো সিনেমা দেখতে পাঠিয়ে বাসায় ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাছের ডালের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দোতলায় ভাইবোনেরা সেটা ধরে টেনে গাছ নড়িয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় হক ভাই অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘মোমবাতি? মোমবাতি কেমন করে নিভে গেল?’
হুমায়ূন আহমেদ হাসল, ‘খুবই সোজা। মোমবাতির সুতাটা কেটে রাখা হয়েছে। ঠিক সময়মতো নিভে গেছে।’
আমি হতবাক হয়ে হুমায়ূন আহমেদ আর তার বিশাল ষড়যন্ত্রীর দল আমার বাবা-মা ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। 
হুমায়ূন আহমেদের এ রকম গল্প একটি-দুটি নয়, শত শত! জীবনটা একঘেয়ে হলে সেটা মেনে নিতে হবে কে বলেছে? জীবনটাকে চোখের পলকে রঙিন করা যায়, চমকপ্রদ করা যায়—তার মতো সেটা কে পারত?
কেউ না।

Chrome Extension for Amarboi, Add it Now You can follow us on Twitter or join our Facebook fanpage or even follow our Google+ Page to keep yourself updated on all the latest from Bangla Literature.
Download Bangla books in pdf form amarboi.com and also read it online. 'bangla-boi, boimela, humayun ahmed, bangla boi, ebook, bangla-ebook, bangla-pdf, bangla book, bangla pdf, zafar iqbal, boi, bengali books download'

Post a Comment

2 Comments

himu said…
pritibite keo karo moto noy..........
কাহিনীটা ভালই!