Ticker

6/recent/ticker-posts

আটলানটিক সিটি হুমায়ূন আহমেদের খুবই পছন্দের একটি জায়গা

humayun ahmedআটলা›টিক সিটি হুমায়ূন আহমেদের খুবই পছ›দের একটি জায়গা। মূলত দুই কারণে এই সিটি তার পছন্দ। আটলা›টিক সাগরের পাড়ঘেঁষে পর্যটকদের হাঁটাহাঁটির জন্য তিন-চার কিলোমিটার বোট ওয়াক। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসার জন্য লম্বা লোহার চেয়ারের ব্যবস্থা। আর রাস্তার দুই পাশে নানা ধরনের গিফট শপ ও বিভিন্ন দেশের খাবারের দোকান। এখানে সাগরের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, গিফট শপ অথবা নাই›টি নাইন সেন্টসের দোকান থেকে নিষাদ-নিনিতের জন্য একগাদা খেলনা কেনা তার পছ›দের বিষয়। দ্বিতীয়ত ক্যাসিনোতে কিছু সময় কাটানো। ক্যাসিনো তার পছ›দের জায়গা।
আমেরিকা বেড়াতে এলে একবার আটলা›টিক সিটি যাবেন না তা তো হয় না। তবে এবার প্েরক্ষাপট ভিন্ন। সিঙ্গাপুরে রুটিন চেকআপ করতে গিয়ে চতুর্থ স্তরের ক্যান্সার শনাক্তের পর চিকিৎসার জন্য এবার তার যুক্তরাষ্ট্ের আসা। ১৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়কর্ েপৌঁছেছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ১৯ সেপ্টেম্বর নানা চেকআপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হল তার প্রথম কেমোথেরাপি। কাজেই বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্ের এলেই আটলা›টিক সিটিতে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এখনও ঠাঁই নিতে পারেনি।
সিঙ্গাপুর থেকে শহীদ হোসেন খোকন নিউইয়র্ক আসছেন ২৬ সেপ্টেম্বর শুধু হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে। থাকবেন দশ দিন। খোকন সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন বহু বছর ধরে। পেশায় ব্যবসায়ী। সাহিত্যচর্চা করেন অনেক দিন ধরেই। একাধিক গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়েছে তার। হুমায়ূন আহমেদের অন্ধভক্ত।
২০০২ সালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ ও তার মা আয়েশা ফয়েজের বাইপাস অপারেশনের সময় অনেক সহযোগিতা করেছিলেন খোকন। আমি সেই চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। খোকনের আন্তরিকতা সে সময় আমায় মুগ্ধ করে। এবার সিঙ্গাপুরে চেকআপের সময়ও খোকন সবসময় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ছিলেন। নুহাশ পল্লীর দুটি বড় স্কালপচার তিনি সিঙ্গাপুর থেকে এনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের জš§দিনের উপহার হিসেবে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যে কোনো মানুষ সিঙ্গাপুর গেলেই খোকন তাদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
হুমায়ূন আহমেদ, শাওন ভাবি ও আমাকে ডেকে বললেন, খোকন আমেরিকা আসছে। এটা তার প্রথম আমেরিকা আসা। এতদূর থেকে শুধু আমাকে দেখতে আসছে। আমি ওকে নিয়ে আটলা›টিক সিটি বেড়াতে যেতে চাই। তোমরা হোটেল বুক কর এবং কীভাবে যাব সে ব্যবস্থা কর।
হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় শাওন ভাবি প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছার কারণে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলেন হোটেল বুক করতে।
২৭ সেপ্টেম্বর খোকন এসে পৌঁছালেন জ্যামাইকার বাসায়। আমি সোহেলকে নিয়ে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম তাকে আনতে। হুমায়ূন আহমেদ খুবই খুশি হলেন খোকনকে দেখে। খোকন যখন জানতে পারলেন আটলা›টিক সিটি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ, তিনি চমকে উঠলেন। স্যারের এরকম শারীরিক অবস্থায় তিনি বেড়াতে যাবেন? তাও আবার তাকে উদ্দেশ করে এই ভ্রমণ। খোকন ভেবেছিলেন প্রথম কেমো নেয়ার পর হুমায়ূন আহমেদকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু ঘটনা সে রকম নয়। ডাক্তারও বলেছেন, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে। হাসি-খুশি আন›দে থাকতে। সব শোনার পর খোকন যথেষ্ট খুশি হলেন এবং দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন এই ভেবে যে, স্যারের শরীর খুব বেশি খারাপ না। কেমো তাকে মোটেও দুর্বল করতে পারেনি। মানসিকভাবেও তিনি বেশ ভালো আছেন।
২৮ সেপ্টেম্বর দুপুর একটায় আমরা বাসা থেকে বের হলাম দুটো গাড়িতে। লোকসংখ্যা বেশি। হুমায়ূন আহমেদ, শাওন ভাবি, নিষাদ, নিনিত, ভাবির মা তহুরা আলী, খোকন ও আমি। দুপুর দু’টায় আমাদের বাস। ম্যানহাটন থেকে বাসগুলো ছাড়ে। চ্যানেল আইয়ের খোকন ও আমার স্ত্রী স্বর্ণার ফুফাতো ভাই সাবŸির আমাদের গ্ের-হর্ন বাসে তুলে দিতে রওনা হয়েছে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। আমরা বাস টামর্নিালে পৌঁছালাম ঠিক ২.০৫ মিনিটে। দৌড়ে গেলাম ডিপারচার গেটে। ততক্ষণে বাসের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা হতাশ। এতগুলো টিকিট বুঝি নষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্েযই জানলাম প্রতি ঘণ্টায় একটি করে বাস আটলা›টিক সিটির উদ্দেশে রওনা হয়। যে কোনো বাসে উঠে বসলেই হল। শুধু যে তারিখের জন্য টিকিট ইস্যু করা ওই তারিখের মধ্েয ভ্রমণ করতে হবে। আমরা পরের বাসে রওনা হলাম।
আটলা›টিক সিটিতে আমাদের দুই রাত থাকার কথা। ইন্টারনেটে শো-বোর্ট নামে একটা হোটেল বুক করা হয়েছে। হোটেলের পেছন দিয়ে একটু হাঁটলেই বোট ওয়াক, অর্থাৎ আটলা›টিক সাগরপাড়ের হাঁটার রাস্তা। মাত্র তিন মাস আগে হুমায়ূন আহমেদ এখানে এসেছিলেন বেড়াতে। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র। এই হোটেলেই দু’রাত কাটিয়েছেন তারা। সে সময় তারা এক মাসের জন্য আমেরিকা এসেছিলেন। ভিসা জটিলতার কারণে আমি তখন সঙ্গে আসতে পারিনি। হোটেলটা হুমায়ূন আহমেদ খুব পছন্দ করেছিলেন। সে কারণে এই হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হোটেল থেকে বের হলেই বাচ্চাদের প­ে-জোন।
শো-বোটর্ েতিনটা রুম ভাড়া নেয়া হয়েছে। এক রুমে হুমায়ূন আহমেদ সপরিবার। দ্বিতীয় রুমে শাশুড়ি তহুরা আলী একা। তৃতীয় রুমে আমি ও সিঙ্গাপুর থেকে আগত আমাদের বন্ধু খোকন।
আটলা›টিক সিটি যাওয়ার পথে মনে হল- হুমায়ূন আহমেদ তো একনাগাড়ে দুই রাত তিন দিন ভাত না খেয়ে থাকতে পারবেন না। তা ছাড়া এই মুহূতর্ েতার বাইরের খাবার বেশি না খাওয়াই ভালো। মনে পড়ল নাসিম ভাইয়ের কথা। এর আগেরবার তার বাড়িতে অনেক খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। ঢাকায় নাসিম ভাইয়ের বন্ধু খোকনকে ফোন করে তার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করলাম। হুমায়ূন আহমেদের চার খোকনের আরেক খোকন। দীর্ঘদিন নিউইয়কর্ েবসবাসের পর এখন ঢাকায় স্থায়ী হয়েছেন। ফোনে একবারেই নাসিম ভাইকে পেয়ে গেলাম।
হুমায়ূন আহমেদসহ আমরা তার শহরে আসছি শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। কেন তাকে আগে জানাইনি, আগে জানালে তিনি গাড়ি নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে আমাদের নিয়ে আসতেন ইত্যাদি। আমাকে আর কোনো কিছুই বলতে হল না। বাস থেকে নামতেই দেখি নাসিম ভাই গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। এরপর থেকে দুই রাত তিন দিন আমরা সবাই নাসিম ভাইয়ের মেহমান হয়ে গেলাম। সকালে নাসিম ভাই-ভাবি হুমায়ূন আহমেদের পছ›দের নাশতা নিয়ে হোটেলে হাজির। সব রুম থেকে সবাইকে ডেকে ডেকে নাশতা খাওয়ানো যেন একটা উৎসবে পরিণত হল। কাজ-কর্ম বন্ধ করে নাসিম-দম্পতি হুমায়ূন আহমেদের সেবায় নিয়োজিত। রাতে তাদের বাড়িতে গিয়ে আমরা খেয়ে আসি। টেবিলভতর্ িহুমায়ূন আহমেদের পছ›দের সব খাবার। পরদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আমরা সবাই বোট ওয়াকে সময় কাটালাম। বাচ্চাদের প­ে-জোন শীতের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলে নিষাদের মন খারাপ। আমার কাছে মনে হল নিষাদের চেয়ে হুমায়ূন আহমেদের মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। মন ভালো করার জন্য নাই›টি নাইন সে›টের দোকান থেকে এক ব্যাগভতর্ িখেলনা কেনা হল নিষাদের জন্য।
এক রাতে নিষাদকে তার নানির রুমে রেখে কিছু সময়ের জন্য আমরা নিচে ক্যাসিনোতে গিয়েছিলাম। নানির সঙ্গে ইচ্ছামতো আনন্দ করেছে সাড়ে চার বছর বয়সী নিষাদ হুমায়ূন। পরদিন দুপুরে চেকআউট করার সময় ১২০ ইউএস ডলার জমা দিতে হল কাউন্টারে। কারণ খেলতে গিয়ে নিষাদ পরপর দুইবার বড়দের পে-চ্যানেলে চাপ দেয়ায় এই বিল দিতে হয়েছে। পে-চ্যানেল চালু করলেই পয়সা দিতে হবে। যতক্ষণই দেখা হোক না কেন একই ডলার পে করতে হবে।
দুপুরে আমরা বোট ওয়াকে একটা চাইনিজ রেস্টুরে›টে খেয়েছিলাম। বাদবাকি সব খাবারই ছিল নাসিম ভাই ও তার স্ত্রীর আয়োজনে। আমার এক জীবনে যে কয়জন ভালো মানুষ দেখেছি তাদের মধ্েয এই দম্পতি অন্যতম। অসাধারণ ভালো মানুষ তারা।
আমেরিকায় প্রায় নয় মাসের চিকিৎসাকালে আরও একবার আটলা›টিক সিটি ঘুরতে গিয়েছিলাম আমরা। সেবার স্বর্ণা ও আমাদের দুই পুত্র অমিয়, অন্বয় সঙ্গে ছিল। মূলত ওদের জন্যই তখন আটলা›টিক সিটিতে যাওয়া। উদ্েযাগটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। চারটা শিশু একসঙ্গে থাকায় আনন্দ হইচই অনেক বেশি হয়েছিল। শিশুদের আন›দে মুগ্ধ হুমায়ূন আহমেদ। শীতকাল হওয়ায় শিশুদের জন্য ইনডোর প­ে-জোন খুঁজে পাওয়া গেল বোট ওয়াকে। চার শিশু প­ে-জোন থেকে কোনোভাবেই বের হবে না। হুমায়ূন আহমেদ তাদের সংস্পশর্ েকিছু সময়ের জন্য যেন শিশু হয়ে গেলেন। নিজেও শিশুদের সঙ্গে নানা খেলায় অংশ নিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ২০০১-এ প্রথম আমেরিকা ভ্রমণে দু’দফা আটলা›টিক সিটিতে এসেছিলাম। এরপর ২০০৫ সালে একবার একসঙ্গে এসেছিলাম আমেরিকা। সেবারও আটলা›টিক সিটিতে দুটি রাত খুব আন›দে কেটেছিল আমাদের।
বন্ধু ও প্িরয়জনদের আনন্দ দিতে যে মানুষটি অসম্ভব পছন্দ করতেন, সবসময় যার ভাবনা ছিল অন্যদের সঙ্গে কীভাবে আনন্দ শেয়ার করা যায়, তিনি আজ অদেখা ভুবনের বাসিন্দা। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চল”চিত্রের মাধ্যমে আন›দে ভাসিয়েছেন তিনি কোটি মানুষকে। আর কাছের মানুষদের দিয়েছেন দুর্লভ আনন্দদায়ক সঙ্গ। তার প্িরয় জায়গা আটলা›টিক সিটির জৌলুস আর আকর্ষণ হয়তো আরও বাড়বে দিনে দিনে, কিন্তু আমরা যারা তার সঙ্গী হয়ে এসেছি বারবার এই শহরে, তাদের কাছে কি সেই ঔজ্জ্বল্য ধরা দেবে কখনও?

Post a Comment

0 Comments