Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূনের হৃদয়ের উষ্ণতা নিয়ে বেঁচে আছি - আলমগীর রহমান

হুমায়ূনের হৃদয়ের উষ্ণতা নিয়ে বেঁচে আছি - আলমগীর রহমান
কোনো কিছুই ভালো লাগে না। যে ছিল আমাদের জীবনীশক্তি, সে আজ আর নেই। ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাঁর অভাবে বন্ধুদেরও আগের মতো দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। মনে হয়, জীবনকে কেবল টেনে নিয়ে যাচ্ছি। ভালোবাসার সে সম্পর্কের স্মৃতিই বয়ে বেড়াচ্ছি। ১৯৭৮ সালের কথা। চাকরি করতাম বিচিত্রায়। শাহাদত চৌধুরীর রুমে আড্ডা জমত। অনেকে আড্ডা দিতে আসতেন সম্পাদকের রুমে। মাঝে মাঝে আসতেন হুমায়ূন। একবার সংবাদপত্রগুলোতে নানা দাবিদাওয়া নিয়ে শুরু হলো তুমুল আন্দোলন। বন্ধ হয়ে গেল সংবাদপত্রের প্রকাশ। অফিসে আসি ঠিকই, কাজকর্ম নেই। অলস সময় কাটে। এক আড্ডায় সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির আর মুনতাসীর মামুন বুদ্ধি দিলেন, 'আলমগীর, আপনি তো বসে আছেন। পেপারব্যাকে বই বের করেন না কেন? তবে অন্যদের মতো নয়। প্রকাশ করবেন মৌলিক রচনা। সাহিত্যমূল্য আছে এমন বই পাঠকদের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারলে একটা নতুন ধারা শুরু হবে। পারিবারিকভাবে তো আপনাদের প্রকাশনা সংস্থা আছে।' আমাদের প্রকাশনীর নাম বাংলাদেশ বুক করপোরেশন। খুব মনে ধরে গেল সে আইডিয়া। সেবা প্রকাশনী তো পেপারব্যাকে বই বের করে জমজমাট ব্যবসা করছে।
২.
মুনতাসীর মামুনের ইস্পাহানি রোডের বাসায় জমায়েত হয়েছি। আমি, শাহরিয়ার কবির, ইমদাদুল হক মিলন, রেজওয়ান সিদ্দিকী আর হুমায়ূন। শুরুতেই হুমায়ূনকে পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা হলো। পেপারব্যাকে উপন্যাস লেখার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ১৯৮৫ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হলো 'দেবী'। 'মিসির আলী' সিরিজের প্রথম বই। সে লেখার জন্য অগ্রিম সম্মানী পেয়েছিলেন মাত্র এক হাজার টাকা। টাকার দিকে অবশ্য ফিরেও তাকাননি। নতুন কিছু করছেন, তাতেই তাঁর আনন্দ।
৩.
'স্মিথসোনিয়ান' নামে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে যাচ্ছি একদিন। দেখছি স্প্রেডশিটে ডিজনির কার্টুন রবিনহুডের রঙিন ছবি। শাহাদত চৌধুরীর রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন হুমায়ূন। আমার টেবিল অতিক্রম করার সময় ম্যাগাজিনের খোলা পাতাটার ওপর চোখ পড়তেই আটকে গেলেন। বিজ্ঞাপনটা দেখলেন, 'ওটা রেখে দেবেন। ছোটদের জন্য কয়েকটা গল্প লিখে দেব। সে গল্পগুলো নিয়ে যে বই হবে সেটার প্রচ্ছদ হবে এই ছবি দিয়ে।' এভাবেই জন্ম নিল 'তোমাদের জন্য রূপকথা', ছোটদের জন্য চিরপ্রিয় একটি বই।
৪.
তত দিনে হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক, অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বিটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে তাঁর লেখা তুমুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'এইসব দিনরাত্রি'। অনেকেই তাঁর বাসায় যান। আড্ডা হয়। আমিও তাঁদের একজন। মানুষটার প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা আমাকে পেয়ে বসল। অফিস করে সোজা চলে যেতাম। শহীদুল্লাহ হলের টানা বারান্দায় চলত আমাদের আড্ডা। প্রায়ই আসতেন ওবায়দুল ইসলাম, ইমদাদুল হক মিলন, ময়মনসিংহ থেকে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, টিঅ্যান্ডটির মনির ভাই এবং আরো অনেকে। কিছুদিন পর ছেড়ে দিলেন শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টার। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে এলেন এলিফ্যান্ট রোডে।
৫.
সারাক্ষণ লেখাপড়া করেন। অবিশ্বাস্য তাঁর মেধা। বই যা আছে বুকশেলফে, তার চেয়ে বেশি তাঁর মগজে। এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন না। পছন্দ করতেন মানিকের লেখা। বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তির জীবনবোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে ডাকতেন 'কুসুম'। সেও মানিকেরই চরিত্র। প্রিয় কবি ছিলেন জীবনানন্দ। তাঁর বহু বইয়ের নাম ছিল জীবনানন্দের কবিতার লাইন দিয়ে। সাম্প্রতিক ইংরেজি সাহিত্যের বইও পড়তেন দেদার। জন স্টেইনবেক, অ্যাডগার অ্যালেন পোসহ অনেকেই ছিলেন প্রিয়। পড়তে ভালোবাসতেন ধর্মগ্রন্থও।
৬.
নানা ধরনের পাগলামি ছিল মানুষটার ভেতরে। একসময় মনে হলো, জায়গা কিনবেন সেন্ট মার্টিনে। পাশ্চাত্যের অনেক লেখকেরই ঘরবাড়ি থাকে দ্বীপে। তেমন একটা বাড়ি বানানোর ইচ্ছে হলো তাঁরও। যে সময়ের কথা- সেন্ট মার্টিনে যাওয়াটাই ছিল দুষ্কর। বছরে মাত্র তিন মাস ইঞ্জিন নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যায়। অন্য সময় যোগাযোগ বন্ধ। এসব প্রতিকূলতা অবশ্য মোটেও দমাতে পারেনি হুমায়ূনকে। সেই প্রবালদ্বীপে বানালেন নিজের বাড়ি 'সমুদ্র বিলাস'। কিছুদিন পর আরেকটা শখ পেয়ে বসল তাঁকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে গানের অনুষ্ঠান করা হবে। সেটি তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো হুমায়ূনকে। অনুষ্ঠানের নাম দিলেন 'জলসাঘর'। বিখ্যাত লোকজ গানগুলো চিত্রায়িত করলেন, এ অনুষ্ঠানেরই শুটিংয়ের জন্য আসাদুজ্জামান নূরের বাগানবাড়িতে। সাভারের সেই বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়, একেবারেই গ্রামীণ, নিরিবিলি পরিবেশ। দেখে তো হুমায়ূনের মাথা খারাপ। এমন একটা জায়গা খুঁজতে লাগলেন তন্নতন্ন করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নুহাশপল্লীর জন্ম। প্রথমে ছিল জঙ্গল আর চষাক্ষেত। আস্তে আস্তে সেটাকে নিজের মতো করে সাজালেন। পুকুর কাটলেন, দেশের বৃহত্তম ঔষধি গাছের বাগান করলেন। আমাদের স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে লাগালেন ৭১টি আমগাছ। অবসরে সবাই মিলে চলে যেতাম। দেশ-বিদেশ থেকে লেখক-শিল্পীরা আসতেন। সেও এক উৎসবের ব্যাপার। আড্ডা দিতাম আর চলত গান।
৭.
মানুষটার রক্তের মধ্যেই গান মিশে আছে। একবার ঠিক করলেন, হাছন রাজার গান নিয়ে সিডি বের করবেন। অ্যালবামের শিল্পী নির্বাচন করা হলো সেলিম চৌধুরীকে। সেলিম তত দিনে আইজাবো নাটকে 'আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম' গান দিয়ে রীতিমতো বিখ্যাত। আমি আর স্থপতি আবু করিম মিলে বিনিয়োগ করলাম। কিন্তু প্রিন্ট করা হবে কিভাবে? বাংলাদেশে তো এমনটা কোনো দিন হয়নি। সেলিম সিলেটের মানুষ। লন্ডনে যোগাযোগ আছে। সে সিডি প্রিন্ট করিয়ে আনল। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ১৩টি গানের এই অ্যালবামটিই বাংলাদেশের প্রথম অডিও সিডি। লোকজ গানের এই অ্যালবামটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে হাছন রাজার গান সেলিম চৌধুরীর ক্যারিয়ারে আরো কয়েকটি তারকা এঁটে দিল। এর পর থেকে হাছন রাজার গান মানেই সেলিম চৌধুরী- এটাই রীতি হয়ে দাঁড়াল।
৮.
হুমায়ূন তখন থাকেন ধানমণ্ডির ১০/এ-এর বাড়িতে। বিশাল হলরুম, ঝাড়বাতি জ্বলছে। বিরাট দেয়ালজুড়ে তাঁর বিশাল সংগ্রহশালা। মেঝে কাঠ দিয়ে মোড়া। একদিন গিয়ে দেখি, বসে আছেন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক। শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ন দৃষ্টি। মাথার হালকা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। কে ইনি? জানা গেল, তিনি ভাটি অঞ্চলের বিখ্যাত শাহ আবদুল করিম, যাঁর গান ও গীতি সবাইকে মুগ্ধ করে। গায়ক সেলিম চৌধুরী ও ছাত্র তুহিনকে (এখন লন্ডনপ্রবাসী, হুমায়ূনের নাটক 'আজ রবিবার'-এর গ্রামের নওজোয়ান/হিন্দু-মুসলমান গানের গায়ক) পাঠিয়ে খুঁজে বের করে এনেছেন। বাউল সাধককে তুলে ধরলেন দেশের মানুষের কাছে; বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে।
৯.
হাছন রাজার গানের অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে পরিচয় হয় বারী সিদ্দিকীর সঙ্গে। অ্যালবামের বাঁশি বাজিয়েছেন তিনি। বাঁশি বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে গানও শোনাতেন। অবশ্যই হুমায়ূনের প্রিয় লোকজ গান। গান শুনতে শুনতে হুমায়ূনের মাথায় খেলে গেল এঁকে কাজে লাগাতে হবে। এবং তা-ই করলেন 'শ্রাবণ মেঘের দিন' চলচ্চিত্রে। বারী সিদ্দিকী গাইলেন বিখ্যাত কয়েকটি গান- 'শুয়া চান পাখি, আমি ডাকি তুমি ঘুমাইছ নাকি', 'আষাঢ় মাসের ভাসান পানি রে পূবালী বাতাসে' ইত্যাদি।
১০.
ভালোবাসতেন ম্যাজিক। নিজেও ম্যাজিকের চর্চা করতেন। জাদুতে হাতের খেলায় (পামিং) ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তাঁকে 'ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ান'-এর পূর্ণ সদস্যপদও দেওয়া হয়েছিল। জাদুকর জুয়েল আইচ ছিলেন ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। নতুন কোনো ম্যাজিক পেলেই দৌড়ে চলে আসতেন হুমায়ূনের কাছে। দুই জাদুকর একে অপরের ম্যাজিক দেখতেন। আমরা মুগ্ধ দর্শক।
১১.
এক্সপেরিমেন্ট করতেন সব সময়। লেখালেখি নিয়েও সেটা চলত। সেভাবেই শুভ্র, মিসির আলী, হিমুর মতো চরিত্রের জন্ম। নানাভাবে দেখেছেন মধ্যবিত্তের জীবন। 'নন্দিত নরকে' থেকে যে জীবন সোনার কলমে লিখে যাওয়া শুরু করেছেন, কোনো দিনও বাঙালি পাঠক সে জীবনের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারেনি। শেষ দিকে বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।
লেখালেখি করতেন ভোরে। সবাই ঘুমিয়ে আছে। এক কাপ চা খেয়ে লিখতে বসে যেতেন। টানা লিখতেন। একসঙ্গে কয়েকটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন।
দেখা যেত একই সঙ্গে হয়তো মিসির আলির এক চ্যাপ্টার লিখলেন তো একটু পরেই বসে পড়লেন হিমু বা নতুন কোনো উপন্যাস নিয়ে। মাঝে মাঝে ফোন করতেন নানা তথ্যের জন্য। যত দূর পারি আমরা জোগাড় করে দিতাম। কদাচ বিকেলে লিখতেন। রাত ৮টার পর বন্ধুবান্ধবরা আড্ডা দিতে ভিড় করতাম তাঁর ফ্ল্যাটে।
১২.
ভালো কিছু দেখলেই প্রশংসা করতেন খুব। কোনো দিন কারো উপকার করতে কার্পণ্য করেননি। সেটা নিয়ে গর্বও ছিল না। বলতেন, 'ডান হাতে এমনভাবে উপকার করবে, যাতে বাঁ হাতও টের না পায়।' আগে লেমিনেশন মেশিন ভারত থেকে আনতে হতো। এক মেকানিককে দিয়ে সেটা অনেক কষ্টে দেশেই তৈরি করলাম। বহুজনকে ডেকে সে কথা বলেছেন। হুমায়ূনের সুবাদে অনেক বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। শিল্পী শাহাবুদ্দিন দেশে এলেই দাওয়াত করতেন। হুমায়ূনের সঙ্গে আমরাও যেতাম।
১৩.
সুখাদ্যের প্রতি খুব দুর্বলতা ছিল। ধানমণ্ডির ১০/এ-এর ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে ৮-১০ জন খেতে বসতাম। তবে দখিন হাওয়ার বাসা তো এত বড় ছিল না। ডাইনিং টেবিলটাও ছিল ছোট। আমরা তাঁর ড্রইংরুমের মেঝেটাকেই ডাইনিং টেবিল বানিয়ে ফেলতাম। মেঝেতে বসেই আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া। কখনো কখনো আড্ডার সদস্য ২০-২৫ জন ছাড়িয়ে যেত।
প্রতিদিন নতুন নতুন খাবার খেতে ভালোবাসতেন। নিজে ছিলেন স্বল্পাহারি, এক চামচ-দু চামচ খেতেন। তবে সেটা ভালো হওয়া চাই। মাঝেমধ্যে নিজের হাতে রেঁধে বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন করতেন। খাবার নিয়েও নানা গল্প আছে। একবার সবাই মিলে বগুড়া গিয়েছিলাম। খাবার খেয়ে খুব মেজাজ খারাপ করলেন। ফেরার সময় বললেন, 'কোকটাই সবচেয়ে ভালো রান্না হয়েছে।' ঈশ্বরদীতে বেড়াতে গিয়েও খাবার ভালো লাগেনি। সেটা বলতেও ছাড়েননি, 'চিংড়ি মাছ যে এত খারাপ রান্না হয়, জানতাম না।'
আমার 'ইলিশ রান্না' বইটার আইডিয়াটাও তাঁর। জন্ম নিয়েছিল আড্ডা থেকেই। বইয়ের কাজ শুরুর পর দেখি, বাজারে ইলিশ নেই। মনেই ছিল না, দুয়েক মাসের বেশি বড় ইলিশ থাকে না। বইটা বের করতে তিন বছর লেগে গেল। হুমায়ূন তো অধৈর্য। ভূমিকা লিখে বসে আছেন। অথচ বইয়ের দেখা নেই।
১৪.
ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন। আমার মতো ঘরকুনোর মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ঘোরাঘুরির নেশা। সে শুরুটাও নাটকীয় ঘটনা। 'নক্ষত্রের রাত' নাটকের শুটিং শেষ। নিজের খরচে সবাইকে নেপালে নিয়ে গেলেন। বিরাট সে দঙ্গল। জাহিদ হাসান, দিলারা জামানসহ অনেকেই আছেন। বন্ধু হিসেবে আমিও। সবাই মিলে পোখরা, নাগরকোট গেলাম। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন যে প্রায়ই হিমালয় যেতেন, নেপাল যাওয়ার পর বুঝলাম। এক নেপালেই আমরা ১২-১৪ বার গিয়েছি। কথায় আছে- পাহাড় মানুষ টানে। নেপালের পাহাড়-প্রকৃতির মধ্যে এমন ব্যাপকতা-বিশালত্ব আছে, মানুষ নামের এই ক্ষুদ্র প্রাণীরা যেন তার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ভালোবাসে। সেবার সবাই মিলে রেপটিং করলাম কৌশলা নদীতে। রাবারের নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ালাম খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে নদীতে পড়ে গেল। সেও খুব মজার অভিজ্ঞতা।
১৫.
একেবারেই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বাসায় থাকলে লুঙ্গি, শার্ট। গরমে খালি গায়ে পায়চারি করতেন। তবে সুন্দর পোশাকের প্রতি আগ্রহ ছিল। তরুণ বয়সের ছবি দেখলেই সেটা বোঝা যাবে। তবে মানুষটা রাগলে অসম্ভব রেগে যেতেন। হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। তাঁর ঘনিষ্ঠ, কিন্তু রাগের শিকার হননি এমন কেউ নেই। আমি, মাজহার, করিম- সবাই এটার শিকার হয়েছি। তবে রাগ ধরে রাখতে পারতেন না। রাতের রাগ রাতেই শেষ হয়ে যেত। সকালে ফোন করে বলতেন, 'এই আসছ না কেন তোমরা?' হুমায়ূন ছিলেন নেশার মতো। ওঁর চরিত্রের মধ্যে এমন একটা ক্যারিশমা ছিল, যারা মেশার পর কোনো কারণে দূরে চলে যেত, সব সময় কেন হুমায়ূনের সঙ্গে নেই এই স্মৃতিটা দংশন করত।
১৬.
হৈচৈ খুব পছন্দ করতেন। এত এত বিষয় নিয়ে কথা বলতেন, শোনাটাই ছিল অপার আনন্দের। বহু পুরনো বন্ধুরাও মাঝে মাঝে চলে আসতেন। স্কুলবেলার বন্ধু সেহেরি, ওষুধ কম্পানির বড় কর্তা দেলওয়ার হোসেন খান হঠাৎ বাসায় এসে হাজির হতেন। অথচ বছরের পর বছর তাঁদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারপর প্রতিদিনই আসা-যাওয়া। ধুমছে আড্ডা-ঘোরাঘুরি। তবে অবাক ব্যাপার কিছুদিনের মধ্যে একজন একজন করে মারা যেতে লাগলেন। এটা নিছক কাকতালীয় ঘটনা না নিয়তি? ঠাট্টা করে নিজেও বলতেন, 'ওরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে মরার জন্য।' মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করতেও ছাড়তেন না। 'আজ রোববার' নাটকে একটা দৃশ্য ছিল একটা মানুষ কফিনে ঢুকে শুয়ে থাকে। বসনিয়ার যুদ্ধে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশের এক কর্নেল নিহত হন। তাঁর মরদেহ বহনকারী কফিনটি কাঁটাবন বাজার থেকে নাটকের প্রপস হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। শুটিংয়ের সময় দেখা গেল, এই কফিনে ঢুকতে কেউ রাজি হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কফিনে শুতে রাজি হলেন অভিনেতা সুজা খন্দকার। নাটক শুটিং হলো। ঠিকঠাক চলল সব। নাটকও হলো শেষ। কদিন পরে খবর পেলাম, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন সুজা খন্দকার।
১৭.
'নয় নম্বর বিপদ সংকেত' নাটকে একটা দৃশ্য আছে একটা মানুষ খাটিয়ায় শুয়ে আছে। মরার ভান করছে। এমন করে মৃত্যু নিয়ে পরিহাস করেছেন হুমায়ূন। ২০১২ সালের জুন মাসে চিকিৎসা বিরতিতে ঢাকা এসে সবার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। মায়ের বাড়ি গেলেন, নুহাশপল্লীতে গেলেন। আমায় ডেকে বললেন, 'আমরা তো কখনো কোলাকুলি করি নাই। আসেন আমরা কোলাকুলি করি।' আমায় দিয়ে গেলেন হৃদয়ের শেষ উষ্ণতা, শরীরের গন্ধ, ভালোবাসা। সেটা নিয়েই বেঁচে আছি।
অনুলিখন : ওমর শাহেদ

Post a Comment

0 Comments