Ticker

6/recent/ticker-posts

আ মরি বাংলা ভাষা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আজকাল খুব আশ্চর্যের সঙ্গেই একটা বিষয় লক্ষ করি, বেশ কিছু বাঙালি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির এই আত্মসন্মান বোধের অভাব আজকাল খুবই চোখে পড়ে। আসলে ব্যাপারটা এই যে, বাংলা নিয়ে আমাদের হীনমন্যতা। আমরা সব জায়গায় বাংলা বলি না, আমাদের ছেলেমেয়ে বাংলা না শিখলে আমরা গর্ববোধ করি। এটা হচ্ছে আত্মসম্মান বোধের অভাব। কেন না, মানুষের চরিত্র তৈরি হয় তার ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে। তাই ভাষা একটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নেয়। যারা এটা ভুলে যায়, তারা জীবনে খুব বেশি উন্নতি করে বলে আমি মনে করি না। কিছু কিছু জাগতিক বিষয় তাদের কজায় আসতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব একটা সুখী তারা হয় না। আমি এরকম অনেক উদাহরণ জানি।
বিদেশে আমি দেখেছি। কিছু কিছু লোক যারা প্রাণপণ চেষ্টা করে মাতৃভাষা ভুলে গেছে, বাঙালিদের সঙ্গেই মিশতে চায় না, বাংলা গান শোনে না, তারা ওদেশে গিয়ে সাহেব হবে। সাহেব তারা জীবনে হতে পারবে না; গায়ের রং কোনওদিন পালটাতে পারবে না, পালটানো যায় না। আর যতই সাজ পোশাক করুক, সাহেবরা তাদের নেটিভ বা কালো লোকই বলবে। আমরা যাদের খুব ফরসা বলি তারাও ওদেশে কালো। কেন তারা কালো হয়ে থাকল জানি না।
এই যারা এই জায়গা থেকে বিচ্যুত হতে হতে ওদেশের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায়, এক প্রজন্মে এটা সম্ভব হয় না। আমি কিছু কিছু লোককে দেখেছি যাদের সবই আছে। বিদেশে বাড়ি আছে, দু-তিনখানা গাড়ি আছে, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে আছে। সুন্দরী শিক্ষিত স্ত্রী আছে কিন্তু অদ্ভুত একটা অসুখী ছাপ তাদের মনে, তারা ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। এটার কারণটা যারা মনোচিকিৎসক তারা বলেছেন, মাতৃসংস্কৃতি থেকে বিচ্ছেদের জন্য এটা হচ্ছে। সবই আছে কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। একটা অদ্ভুত ছটফটে ভাব, একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। তারা কেউ প্রচুর মদ খাওয়া শুরু করে, কেউ কেউ জুয়া খেলে, কেউ কেউ ব্যভিচার করে। অর্থাৎ কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এটা প্রথম জীবনে যে অন্যায়, তার আঘাতটা পায় শেষে। যারা মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাদের খুব একটা লাভ হয় না। জাগতিক সুখ পাচ্ছে কিন্তু আসলে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় কথা এই, আমরা কোনও অদ্ভুত কারণে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনও পূর্বে তাকাই না। আমাদের পূর্বের দেশগুলো কী করে, সে সম্বন্ধে আমরা খুবই কম জানি। আজকের চিন বা কোরিয়া বা মালয়েশিয়া— এদের ভাষা নিয়ে গর্ব দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। এমনকী জাপান, যদিও কারিগরি বিষয়ে এত উন্নতি করেছে যে দেশ, সেই দেশের বহুলোকই একবর্ণ ইংরেজি জানে না, ইংরেজি না জেনেও চ্যালেঞ্জ করে তারা সবকিছুতেই উন্নত হয়েছে। চিনেও তাই, চিনে বেশির ভাগ লোকই ইংরেজি জানে না, একটা শব্দও বোঝে না। তারা শিক্ষিতলোক, তারা সমস্ত কিছুই পারে, কাজেই এটা সম্ভব।
আমরা কি বাংলায় পারি না? এটা আমরা কি কোনও ভারতীয় ভাষায় পারি না, আমরা কি এতই খারাপ, আমাদের ভাষা কি এতই দুর্বল ? তা তো নয়। ভাষাতাত্বিকরা বলেন, বাংলা ভাষায় এত ঐশ্বর্য, শুধু সংস্কৃত নয়, আমাদের দরজা খোলা, সব ভাষা থেকে এখানে শব্দ গ্রহণ করি। আর করি বলে বাংলা ভাষার সম্পদ অত্যন্ত বেশি, যে-কোনও ভাবই আমরা বাংলায় প্রকাশ করতে পারি। সেই ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব থাকবে না! একমাত্র চিনে ও জাপানে ইংরেজি শেখা আরম্ভ হয়েছে, তার কারণ, কম্পিউটার নামক যন্ত্রটি। ভিন্ন ভাষায় কম্পিউটার হবে না। কারণ, তাতে তার জটিলতা বেড়ে যাবে। কেবল কম্পিউটার নামক যন্ত্রটির ভাষা ইংরেজিতে হবে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিন, জাপান ও রাশিয়াতেও মানুষ ইংরেজি শিখছে কম্পিউটারে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু তার জন্য তারা নিজের ভাষা তো ছাড়ছে না। আজকে দুজন চিনার যখন দেখা হয়, তারা একবর্ণ ইংরেজি বলে না, চিনা ভাষায়ই কথা বলে। কাজেই অন্য একটি ভাষা শিখতে গেলে বা অন্য একটা ভাষাকে প্রয়োজনীয় মনে করলে যে মাতৃভাষাকে ত্যাগ করতে হবে এটা অতি মূর্খতা। এটা বারবার বলে লাভ নেই। যখন প্রয়োজন একটাই, প্রয়োজন হচ্ছে এই যে, আমাদের কিছুদিন ধরে একটা আলস্য উদাসীনতা এসেছিল। বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতি আস্তে আস্তে যে পিছনে সরে যাচ্ছে এটা খেয়াল করিনি, এখন এটা আমাদের আটকাতে হবে, ছেলেমেয়েদের সেদিকে ফেরাতে হবে।
এখন আমাদের দেখতে হবে উদাসীনতার ফলে এই ভাষা থেকে, এই সংস্কৃতি থেকে যেন একেবারে বিচ্যুত হয়ে না যাই। উদাসীনতার কারণটা ছিল, অনেকে বুঝতে পারেননি ভাষা নিয়ে আবার কী করার আছে। এই তো ভাষা ঠিকই আছে, এই তো আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। ছেলেমেয়েরা শিখছে না ওতে কী এসে যায়। বাংলা সিনেমার জায়গায় হিন্দি সিনেমা, তাতেই বা কী ক্ষতি। বাংলা গানের জায়গায় হিন্দি গান, ইংরেজি গান তাতেই বা কী ক্ষতি। এই ক্ষতির ফলে আস্তে আস্তে বাংলা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। ভাষাকে সবসময় পরিবর্ধনের চেষ্টা করতে হয়। তার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করতে হয়। আসলে, চোখ একটু অন্যদিকে ফেরালেই ভাষা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। নদীর মতন, অনেক নদী পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভাষাও তাই। এককালে বহু ভাষা ছিল, সেখানকার মানুষদের অসচেতনতার ফলে সেইসব ভাষা হারিয়ে গেছে।
আমরা কি বাংলা ভাষাকে সেভাবে হারাতে দেব? পৃথিবী বাংলাভাষাকে শুধু বাংলাদেশের ভাষা বলেই জানবে, আমাদের ভাষা বলে কেউ জানবে না? এটা নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত।
দুই দশকেরও বেশি সময়ে পশ্চিমবাংলার দৃশ্যপটে, মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে গেছে অনেক। বিস্ফোরণ ঘটেছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। প্রমোদ উপকরণে নানান উৎপাত ঢুকে পড়েছে। এমনকী মানুষের শয়নকক্ষেও। বাংলা ভাষা যেমন মর্যাদা হারিয়েছে তেমনি বাংলার সংস্কৃতিও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে আজ এক বিশেষ সংস্কৃতির অবরোধে। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু কিছু সঙ্গীতধারা একেবারে লুপ্ত হবার পথে। অনেকদিন আমরা ওই ব্যাপারে উদাসীন থেকেছি, আমাদের পরবতী প্রজন্ম মাতৃভাষা বিমুখ হয়ে পড়েছে, তা দেখেও না দেখার ভান করেছি আমরা। এই বাংলায়, বাঙালির অধিকারচু্যত হবার উপক্রম হলে আমরা প্রতিকারের কথা চিন্তা করিনি। এই কৈব্যে আমরা হারাতে বসেছিলাম বাংলার যা কিছু গর্বের সম্পদ।
সব ভাষা ও সংস্কৃতিই পরিচর্যা দাবি করে, আমরা তা বিস্মৃত হয়েছিলাম। কিন্তু কোনও এক সময় এই সব কিছু পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ না নিলে, আমরা জাতির ইতিহাসে আত্মসম্মানহীন, অপদার্থ হিসাবে গণ্য হব না কি? সুখের বিষয়, বেশ কিছু ছোটপত্রিকা, এমনকী পশ্চিমবাংলার সরকারও এ সমস্যার গুরুত্ব বুঝে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে চলেছে। আসলে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবাহমানতার দায় আমাদেরই, যা বিভিন্ন কর্মধারায় বহন করতে হবে।
এগিয়ে আসছে অবশ্যই ছোটপত্রিকাগুলো। বইমেলা, লিটন ম্যাগাজিন মেলা জেলায় জেলায় মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করছে মাতৃভাষার মাহাত্ম্য। ছোটপত্রিকাই তো প্রাণ, তারাই তো পারে সুসংগঠিতভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার কাজে যথার্থ উদ্যোগী হতে। এই তো ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি’ নিষ্ঠা ভরে করে যাচ্ছে সে কাজ। ছোট পত্র-পত্রিকার সম্পাদক, কবি, লেখক ও সাহিত্যকর্মীদের সম্মিলিত চেষ্টা আর ভালোবাসাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মরা গাঙে আবার জোয়ার আনতে পারে। মাতৃঋণ পরিশোধের এর চেয়ে বড় আর কী-ই বা উপায় হতে পারে।
আমরা স্বপ্ন দেখি।
অনুপাতে কম হলেও ভাষার (ও সাহিত্যের) ওপর একটা অবক্ষয়ের চাপ পশ্চিমবাংলায়ও ক্রমে ক্রমে দেখা দেবে মনে হয়। এখনই দেখা দিচ্ছে। বাংলা একদিন কোটি কোটি লোকের ভাষা ছিল, বাংলার বাইরে নানা দিকে তার পরিব্যাপ্তি ছিল, মর্যাদা ছিল; কয়েক বছর আগেও দেশের পরিধি প্রায় তিনগুণ বড় ছিল। মননের ও কাজের নানা দিকে বাঙালির ভারতীয় খ্যাতি ছিল। সব কিছুই এত বেশি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, বিপর্যয় এত বেশি, টাকাকড়ির কুশৃঙ্খলা এত কঠিন যে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করবার সময় খুব সম্ভব দেশের নেই আজকাল। ভাষা লোকের মুখে ভেঙে গড়ে সাহিত্যিকদের হাতেই বিশেষভাবে অগ্রসর হয়। বাংলার লোকদের অনেকেই আজ উৎখাত। এবং প্রায় সব বাঙালিই আজ টাকা ও অন্নের সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছে, বেকার, আধ-বেকার, আধপেটা খাওয়া লোক প্রায় ঘরে ঘরে আজ। চাকরি নেই, ঘর নেই, ভাত নেই—এরকম দুঃখ-কষ্ট বাঙালি শীগগির বোধ করেনি। এই সমস্যাই আজ সব চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে; বাংলার লোকের হাড়মাংস চিত্তের থেকে মুখের ভাষা-উপভাষার নতুন নতুন বিকাশের পথ আজ আশা করা কঠিন। যে বাংলা একদিন ভাত-কাপড়ে ঘরে তৃপ্তি পেয়ে গল্প রূপকথা বচন ছড়া ইত্যাদি তৈরি করেছিল বাংলার সে হৃদয় নেই এখন, সেসব লোক নেই, সে প্রবাদ, ছড়া লেখালেখন নতুন যুগে কোনও যুক্তিঘন ক্রমবিকাশ লাভ করল না, মরেই গেল—মানুষই মরে যাচ্ছে বলে। বাংলার সাধারণ জনতাপট আজ এরকম। এদের সাহিত্য আজ নিস্তব্ধ। সাহিত্যিকদের সাহিত্য বেচে আছে অবশ্য; তারই থেকে সাধারণজনও কিছুটা তৃপ্তি সংগ্রহ করে নিজেদের রুচি বৃদ্ধি অনুসারে। বাংলাদেশে এখনও বড়, মাঝারি অনেক সাহিত্যিক আছেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা সকলেই প্রায় প্রবীণ, প্রৌঢ় । সাহিত্যে তেমন কোনও নতুন বড় সুচনার লক্ষণ শীগগির দেখা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। —জীবনানন্দ দাশ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ
Comments/Join our Facebook Group