Ticker

6/recent/ticker-posts

অ্যানিমেল ফার্ম - জর্জ অরওয়েল

অ্যানিমেল ফার্ম - জর্জ অরওয়েল অ্যানিমেল ফার্ম - জর্জ অরওয়েল

লেখক পরিচিতি
জর্জ অরওয়েলের প্রকৃত নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালে ভারতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা চাকরি করতেন ভারতের সিভিল সার্ভিসে। ১৯০৭ সালে সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে যান তারা। ১৯১৭ সালে ইটনে পড়াশোনা করার সময় সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে জর্জ অরওয়েলের। এ সময় বিভিন্ন কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পুলিশ বিভাগের হয়ে বার্মায় কাজ করেন অরওয়েল। চাকরির এই অভিজ্ঞতা তাকে প্রথম উপন্যাস লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বার্মিজ ডেজ"। পরবর্তীতে ক’টা বছর দারিদ্র্যের কষ্ট পোহাতে হয় অরওয়েলকে। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে দুটো বছর প্যারিসে কাটান তিনি। এ সময় জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হয় তাকে। কখনো গৃহশিক্ষক ছিলেন, কখনো স্কুলে পড়াতেন, কখনো বা বইয়ের দোকানে বই বিক্রি করতেন। কাজের ফঁাকে ফঁাকে লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন। বিভিন্ন সাময়িকীতে তখন তার বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয় জর্জ অরওয়েলের ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’ ।
১৯৩৬ সালে ভিক্টর গোলাঙ্কজের কাজ নিয়ে তিনি পরিদর্শন করতে যান ল্যাঙ্কাশায়ার এবং ইয়োর্কশায়ারের বেকারত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। এই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে লেখেন “দ্য রোড টু উইগান পায়্যার’। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে জর্জের নিজ চোখে দেখা দারিদ্র্যের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে।
১৯৩৬ সালের শেষ দিকে অরওয়েল স্পেন চলে যান প্রজাতন্ত্রের সমর্থনে যুদ্ধ করতে এবং আহত হন। গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’ বইটি। ১৯৩৮ সালে একটি স্যানাটোরিয়ামে কিছুদিন থাকতে হয় তাকে। এরপর থেকে কখনো পুরোপুরি সুস্থ হন নি তিনি। মরক্কো মাস ছয়েক ছিলেন অরওয়েল। এ সময় লেখেন ‘কামিং আপ ফর এয়ার’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হোম গার্ড এবং বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিসে কাজ করেন তিনি। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত উল্লিখিত কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পরে সাহিত্যসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন “ট্রিবিউন” পত্রিকায়। এ সময় রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখতেন তিনি। একই সঙ্গে অবজারভার’ এবং ‘ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ’ পত্রিকায়ও লিখেছেন। তার রূপকধৰ্মী চমৎকার রাজনৈতিক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৯৫ সালে এই বইটি ডাব্লিউ. এইচ. স্মিথ এবং পেঙ্গুইন বুকস থেকে শতাব্দীর সেরা বই'এর পুরস্কার অর্জন করে। মূলত ‘অ্যানিমেল ফার্ম এবং ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ (১৯৪৯ সালে প্রকাশিত)—এই দুটি বইয়ের জন্যই জর্জ অরওয়েল বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন এই খ্যাতিমান লেখক।

পেঙ্গুইন সংস্করণের ভূমিকা
“অ্যানিমেল ফার্ম" ইংল্যান্ডে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট। এর এক বছর পর বইটি প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। “অ্যানিমেল ফার্ম প্রকাশিত হওয়ার আগে ব্রিটেন এবং আমেরিকায় জর্জ অরওয়েলের নয়টি বইয়ের (ইনসাইড দ্য হোয়েল এবং দ্য লায়ন অ্যান্ড দ্য ইউনিকর্মসহ) প্রকাশিত কপির সংখ্যা ছিল ১,৯৫,৫০০। এর মধ্যে ‘দ্য রোড টু উইগান পায়্যার’-এর সংখ্যা ছিল ৪৭,০৭৯ এবং পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন এবং বার্মিজ ডেজ’ বই দুটি মিলিয়ে কপির সংখ্যা ছিল ১,১৫,০০০। পেঙ্গুইন থেকে এই বই দুটি প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাগজসঙ্কটের কারণে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর সীমিতসংখ্যক কপি প্রকাশিত হয় ব্রিটেনে। তবে ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে যখন জর্জ অরওয়েল মৃত্যুবরণ করেন, সে সময় বইটির প্রকাশিত কপির সংখ্যা পৌছে গিয়ে ২৫,৫০০-তে। সে সময় আমেরিকায় ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ প্রকাশিত হয় ৫,৯০,০০০ কপি। প্রকাশিত কপির এই বিশাল পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে বিপুল সাফল্য এনে দেয় ‘অ্যানিমেল ফার্ম"-কে। ব্যাপক প্রচার এবং ব্যবসায়িক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিতও হয় সে সময় ।
অরওয়েলের জীবদ্দশাতেই, জীবনের শেষ কটি বছরে ইউরোপের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয় ‘অ্যানিমেল ফার্ম। বিশেষ করে পারসিয়ান, তেলুগু, আইসল্যান্ডিক এবং ইউক্রেনিক ভাষায় বইটির ভাষান্তর ছিল উল্লেখযোগ্য সাফল্য ।
কিন্তু বইটি ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পেছনে মূল কারণটি কী?
বইটি বিভিন্ন ধরনের পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিল প্রচ্ছদ-পাতার বৈচিত্র্য। অরওয়েল তার বইটিকে ‘আ ফেইরি স্টোরি’ বলে উল্লেখ করেন। সেকার অ্যান্ড ওয়ারবার্গ এবং পেঙ্গুইন বুকস থেকে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর যত সংস্করণ বেরিয়েছে, প্রতিটাতেই লেখকের এই কথাটি দেখা গেছে। কিন্তু আমেরিকানরা 'আ ফেইরি ক্টোরি’ বাদ দেয় বই থেকে।
অরওয়েলের জীবদ্দশায় ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর যত অনুবাদ বেরোয়, সেগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র তেলুগু ভাষায় অনূদিত বইয়ে আ ফেইরি ষ্টোরি’ কথাটি থেকে যায়। অন্যান্য ভাষার বইয়ে সাব-টাইটেল ছিল—“আ স্যাটায়ার’, ‘আ কন্টেম্পোরারি স্যাটায়ার’, কিংবা ‘অ্যাডভেঞ্চার' অথবা নিছক টেল’ ।
সাব-টাইটেলের বৈচিত্র্য ছাড়াও বইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাহিনীবিন্যাসে দু দুবার পরিবর্তন। একবার পরিবর্তন করা হয় প্রথম সংস্করণের সময়। কিছু ভুলক্রটি শুধরে নেওয়ার জন্য। আরেকবার পরিবর্তন করা হয় কাহিনী-বিন্যাস ঠিক হয় নি ভেবে।
১৯৪৫ সালের মার্চে প্যারিসে কাজ করছিলেন অরওয়েল, “অবজারভার' এবং ম্যানচেষ্টার ইভনিং নিউজ’-এর জন্য যুদ্ধের খবরাখবর পাঠাতেন। সে সময় জোসেফ জাপৃস্কির সাথে দেখা হয় তার, যিনি সোভিয়েত বেসামরিক বন্দীশিবির থেকে বহুকষ্টে উদ্ধার পেয়েছিলেন। বন্দীশিবিরের নির্মম অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এবং সোভিয়েত শাসনতন্ত্রের ঘোর বিরোধী হওয়ার পরেও জাপৃস্কি অরয়েলকে বলেন, “অ্যানিমেল ফার্মে মূলত স্ট্যালিনের মহানুভবতাই ফুটে উঠেছে... ।’
জার্মানরা যখন রাশিয়া দখলের প্রস্তুতি নেয়, তখন অসীম দৃঢ়তার সাথে মস্কো অবস্থান করেন ষ্ট্যালিন। তার বিপুল সাহসের কারণেই রুশরা জার্মানদের ঠেকিয়ে দেওয়ার শক্তি অর্জন করে। নেপোলিয়নের মাঝে স্ট্যালিনের প্রতিচ্ছবি আবিস্কার করেন জাপৃস্কি। যদিও নেপোলিয়নের মাঝে স্ট্যালিনের অত্যাচারী ভাবটা প্রবল, তবেকিছু কিছু ক্ষেত্রে স্ট্যালিনের চারিত্রিক দৃঢ়তা নেপোলিয়নের মাঝে ফুটিয়ে তোলার কথা ভাবেন অরওয়েল। বইটির অষ্টম অধ্যায়ের কিছু অংশ পরিবর্তনের জন্য প্রকাশককে চিঠি লেখেন তিনি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে যখন উইন্ডমিলের পতন হয়, তখন নেপোলিয়নসহ সব পশু আতঙ্কে নিজেদের গুটিয়ে নেয় মাটিতে শুয়ে । অরওয়েল এখানে নেপোলিয়নকে অটল রেখে দেন আগের লেখা শুধরে। এখানে নেপোলিয়নের মাঝে স্ট্যালিনের প্রকৃত ভূমিকাটিই ফুটে উঠেছে জার্মানদের আক্রমণের মুখে।
১৯৪৬ সালের শেষ দিকে, বিবিসির থার্ড প্রোগ্রামের জন্যে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-কে প্রচার-উপযোগী করে সাজান অরওয়েল । ২ ডিসেম্বর আমেরিকার পলিটিক্স পত্রিকার সম্পাদক ডুইট ম্যাকডোনাল্ড বলেন তার মতে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর আবেদন রয়েছে শুধুমাত্র রাশিয়ায়, এবং এ বইয়ে বিপ্লবের দর্শন নিয়ে বড় ধরনের কোনো মতামত প্রকাশ করেন নি অরওয়েল। উল্লেখ্য যে, ম্যাকডোনাল্ড অরওয়েলের একজন বন্ধুও ছিলেন। তার মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে অরওয়েল বলেন, ‘অ্যানিমেল ফার্ম যদিও প্রথমত রুশ বিপ্লবের ওপর একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনা, কিন্তু এর আবেদন ব্যাপক। এ ধরনের বিপ্লবের নাম দিয়েছেন তিনি—“হিংস্র ষড়যন্ত্রমূলক বিপ্লব।’ ক্ষমতালোভীরা অন্ধের মতো ছোটে এই বিপ্লবের পেছনে, এবং পরিণতিতে শুধু কর্তৃত্ব বদল হয়, সত্যিকারের সাম্য আসে না।
অরওয়েল বলেছেন, “এ ধরনের বিপ্লবের ক্ষেত্রে পরিণতিটা কী হওয়া উচিত, তার পরিষ্কার ইঙ্গিত রয়েছে উপন্যাসে। এই বিপ্লবে আমূল পরিবর্তন আসবে তখনি, যখন জনতা সচেতন থাকবে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে এবং সতর্ক থাকবে-কখন কোন অনিয়মের ফলে উৎখাত করতে হবে নেতাদের। এ কাহিনীর নাটকীয় বাকটা আসে তখন, যখন আপেল আর দুধ নিজেদের জন্য রেখে দেয় শূকরেরা।’ ১৯২১ সালে এরকম অধিকারবঞ্চিত হওয়ার প্রতিবাদে সোভিয়েত শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধর্মঘট শুরু হয় লেলিনগ্রাদে। আর এই ধর্মঘটের সমর্থনে নাবিক বিদ্রোহ দেখা দেয় ক্রোনস্তাদৃত-এ ।
তবে উপন্যাসের এই নাটকীয় বাঁকটা পাঠকের কাছে কতটুকু পরিস্কার হয়েছে, এ নিয়ে সংশয় ছিল অরওয়েলের। এজন্য রেডিওতে প্রচার-উপযোগী করার সময় সংলাপে কিছু পরিবর্তন আনেন তিনি। যেমন—
ক্লোভার : আপেলগুলো যে এরা নিয়ে গেল, এটা কি ঠিক হল? কি বল তোমরা?
মলি : কি, আপেল সব ওদের জন্যে রেখে দেবে নাকি?
মুরিয়েল : আমরা কি কিছুই পাব না?
গরু : আমার মনে হয়, আপেলগুলো ওরা সমানভাবেই ভাগ করে দেবে।
কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বাক্যগুলো কেটে দেন বিবিসির প্রযোজক রেনার হেপেনস্টল। অরওয়েল পরে আর সংশোধন করেন নি “অ্যানিমেল ফার্ম”। ফলে উল্লিখিত সংলাপগুলো বইয়ে স্থান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ অরওয়েল তার এক ঘনিষ্ঠজনকে বলেছেন, এই সংলাপগুলোই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর ‘কী প্যাসেজ’ ।

পিটার ডেভিসন
আলবেনি, লন্ডন

অ্যানিমেল ফার্ম : মূলকথা
‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর জন্য প্রকাশক খুঁজতে গিয়ে বড় বিপাকে পড়ে যান অরওয়েল। এ বইয়ের জন্য তার হন্যে হয়ে প্রকাশক খুঁজে বেড়ানোর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। প্রকাশকরাও মূলত রাজনৈতিক কারণেই বইটি প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিলেন। বইটি ছিল সে সময়কার সোভিয়েত সরকারের শাসনপদ্ধতির ওপর মর্মভেদী আক্রমণ। এজন্যই এগিয়ে আসতে চান নি কোনো প্রকাশক। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন মিত্রদেশ ছিল ব্রিটেনের। অরয়েল অ্যানিমেল মার্ম লেখেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে হিটলার শাসিত জার্মানির নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে রাশিয়া। সেই সূত্রে রাশিয়া ছিল ব্রিটেনের মিত্র। আর তাই প্রকাশকরা চান নি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো লেখা প্রকাশ হোক ।
‘অ্যানিমেল ফার্ম যেমন ভালো একটা গল্প, তার আক্রমণটাও তেমনি জোরালো। যে বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে কাহিনী গড়ে উঠেছে, ব্যঙ্গবিদ্রুপের পরিপূর্ণ প্রভাব পড়েছে তাতে, এবং হয়তোবা গল্পের অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন : অরওয়েল যেমন বলেছেন, ‘এটা হচ্ছে আমার প্রথম বই, যেখানে আমি সম্পূর্ণ সচেতন থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং শৈল্পিক উদ্দেশ্য এক করে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ এবং আমরা নিদ্বিধায় বলতে পারি, এই এক করার চেষ্টাটা তার সফল হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, একদম শুরুতে কিছু পাঠক এই বইটিকে নিছক একটি জীবজন্তুর গল্প হিসেবে ধরে নিয়েছিল।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে বইটি রুশ বিপ্লব এবং এর পরিণতিকে সরাসরি ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূর। বইটিতে উন্মোচিত হয়েছে তৎকালীন সোভিয়েত শাসনতন্ত্রের গুপ্তরহস্য। রুশ বা নাৎসি স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠী ছাড়াও পশ্চিম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন সমাদৃত হয় নি এ বই। বইটি আসলে রাজনীতিতে এ ধরনের আক্রমণ করে বসে : বইটি দেখায়—যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা এবং লোক দেখানো ভালো কাজের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, যা পরিণতিতে ডেকে আনে সর্বনাশ।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে একধরনের হতাশাও ফুটিয়ে তুলেছে বইটি। ঘটনা সেভাবে হাস্যরস এবং ক্রীড়াকৌতুকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে, উপসংহারে এসে সেই আমেজটা আর থাকে নি। মানুষ এবং তার কর্মকাণ্ড বিষয়ক গভীর হতাশার মাঝে কোমলতা ফুটিয়ে তুলতে পারে নি প্রবহমান আবহ। বইটির কাহিনী বিন্যাসে সরাসরি সহজভাবে ফুটে উঠেছে চিরাচরিত একটি রূপকথার আদল, যেখানে স্বচ্ছন্দে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের দুঃখজনক বিপর্যয়, সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও শেষতক কলুষিত অশুভশক্তির জন্য কাঙিক্ষত ফল লাভে ব্যর্থ হওয়া। গল্পের শুরুতে ক্রীতদাস থাকে পশুরা, ওরা চেষ্টা করে নগ্ন, নিষ্পাপ এবং মুক্ত থাকার মতো একটা পরিবেশে ফিরে যেতে, কিন্তু ঘুরেফিরে আবার সেই ক্রীতদাসই হয়ে যায় সবাই—তখন ওদের অবস্থা আগের চেয়েও করুণ। পশুদের প্রতীকী ব্যঞ্জনার ভেতর দিয়ে মানব সমাজের এই অন্ধকার চিত্র এত উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে গল্পে, কৌতুকরস কোনোভাবেই ক্ষুন্ন করে নি মূল ভাবার্থকে, অরওয়েলও বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি তার সচেতন লক্ষ্য থেকে। তার কাছে কৌতুক মানে ‘মানুষের বাগাড়ম্বর থামিয়ে দেওয়া । এবং এজন্যই মানুষকে তিনি উপস্থাপন করেছেন পশুর আদলে। তিনি বলেছেন, “আমাদের ব্যঙ্গচিত্র পশুদের মাঝে রয়েছে বলেই ওরা এত হাস্যকর। অরওয়েলের মতে, যে কোনো ধরনের রঙ্গকৌতুক, এমনকি নিখাদ ফ্যান্টাসিরও মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে দুম করে ভূতলে নামিয়ে আনা। অরওয়েল আরেকটি সুন্দর কথা বলেছেন, মানুষের মর্যাদাহানি করো না, তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দাও ইতোমধ্যে তার মর্যাদাহানি ঘটেছে।’
সুইফট তার জগদ্বিখ্যাত বই ‘গালিভার্স ট্রাভেলস-এ ঘোড়াকে আদর্শের প্রতিভূ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, কারণ ঘোড়াকে সবাই উপকারী প্রাণী হিসেবে জানে। অরয়েল তার গল্পের জন্য শুকূরদের নিয়েছেন সম্ভবত নীতিগত দিক বিবেচনা করে। মানুষের কাছে শূকরের মর্যাদা পশুদের ভেতর একদম নিচে। সুইফটের ঘোড়ার মতো অরয়েলের ঘোড়াগুলোও এসেছে নির্দোষ এবং দায়িত্বশীল ক্রীতদাস হিসেবে। অদ্ভুত কারণে শূকরদের মানুষ যেমন ঘৃণা করে, তেমনি একই কারণে মানুষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পছন্দ করে না নিজেদেরকেও। এজন্যই ‘অ্যানিমেল ফার্মা-এ শূকরেরা এসেছে মন্দ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে। শারীরিক এবং নৈতিকভাবে মানুষের পাপপঙ্কের দুর্গন্ধ থেকে অরওয়েলের সভয়ে পিছিয়ে আসাটাই মূলত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এ বইটিতে।

জর্জ অরওয়েলের প্রধান সাহিত্যকর্ম
রচনা
১. ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন (১৯৩৩) : বিশ্বের বড় দুটি শহর প্যারিস এবং লন্ডনে বসবাসের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এ বইটি লিখেছেন অরওয়েল। ফরাসি এবং ইংরেজ সমাজের নিম্ন শ্রেণীর নিম্নতম মানুষের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা স্থান পেয়েছে এ লেখায়। এই মানুষগুলোর ভেতর কেউ সমাজচ্যুত, কেউ ভবঘুরে, কেউ জঘন্য অপরাধী এবং কেউ পতিতা।
২. দ্য রোড টু উইগান পাইয়্যার (১৯৩৭) : শিল্প শহর উইগানসহ ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জায়গা ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা থেকে এ বই লিখেছেন অরওয়েল। এসব জায়গার পরিবেশ-পরিস্থিতি বড়ই হতাশ করেছে তাকে। একটা চালচিত্র ফুটে উঠেছে এ লেখার মাঝে।
৩. হোপেজ টু ক্যাটালোনিয়া (১৯৩৮) : স্পেনের গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এ বইটি লিখেছেন অরওয়েল। এই যুদ্ধে স্বল্পকালের জন্য অংশও নেন তিনি।
উপন্যাস
১. বার্মিজ ডেজ (১৯৩৪) : একসময় একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে বাৰ্মায় ক’বছর কাজ করেন অরওয়েল । সেই অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে এই উপন্যাসটি। ফ্লোরি নামে এক হতাশ তরুণ এই উপন্যাসের নায়ক, যে বার্মার এক কাঠ-ব্যবসায়ী ।
২. আ ক্ল্যারজিম্যান্স ডটার (১৯৩৫) : ডরোথি নামে এক যাজকের চিরকুমারী মেয়েকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাসের কাহিনী। একবার এক যৌন নির্যাতনে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে সে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে । শেষে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসে নিজের বাড়ি, আবার তুলে নেয় বাবার দেখাশোনার ভার।
৩. কীপ দ্য অ্যাসপিডিষ্ট্রা ফ্লাইং (১৯৩৬) : দরিদ্র ভদ্র পরিবারের ছেলে গর্ডন কনস্টকের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। শৈশবে স্কুলে পড়তে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ধনী ছেলেদের মাঝে অরওয়েল যে হীনমন্যতাবোধ করেছেন, এই গর্ডনও তেমনি ভোগান্তি পোহিয়েছে। আসলে বার্মিজ ডেজ’-এর মতো এই বইটিও অরওয়েলের একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।
৪. কামিং আপ ফর এয়ার (১৯৩৯) : শহরতলির মাঝবয়েসী বীমা প্রতিনিধি জর্জ বোলিংয়ের কাহিনী বিধৃত হয়েছে এ উপন্যাসে। নানাভাবে আহত অভিজ্ঞতা থেকে অরওয়েল পেয়েছেন উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। রাজধানী লন্ডনের জীবনযাত্রা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হত তার কাছে, এই অভিজ্ঞতা তার ভেতর এনে দিয়েছিল প্রচণ্ড এক ঘৃণা। তার ওপর আসন্ন যুদ্ধ বুকের ভেতর জাগিয়েছিল বিশাল এক ভয়। এর সাথে যোগ হয়েছে কল্পিত নিরাপত্তার জন্য শৈশবের আকুল আকাঙ্ক্ষা। সব মিলিয়ে অরওয়েলের বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে জর্জ বোলিং চরিত্রটির মাঝে ।
৫. অ্যানিমেল ফার্ম (১৯৪৫) : জীবজন্তুর কল্পকাহিনীর আড়ালে রয়েছে এ উপন্যাসটির রূপকধৰ্মী তাৎপর্য। ষ্ট্যালিনের অধীনে রাশিয়ায় সে সময়ের বামপন্থী শাসনতন্ত্রকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে এই উপাখ্যান। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে যে রুশ বিপ্লব ঘটে, পরবর্তীতে ষ্ট্যালিনের শাসনামলে এই বিপ্লবের আদর্শ পুরোটাই নস্যাৎ হয়ে যায়। বলতে গেলে, স্ট্যালিন বিশ্বাসঘাতকতা করেন রুশ বিপ্লবের নীতি এবং আদর্শের সাথে। স্ট্যালিনের সেই অসঙ্গতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকেই অনুপুঙ্খভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এই উপন্যাসটিতে।
৬. নাইনটিন এইটি-ফোর (১৯৪৯); সর্বগ্রাসী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে এ উপন্যাসে। অরওয়েল যখন এই বইটি লেখেন, সেই সময়কালে দাড়িয়ে দুঃস্বপ্নময় ভবিষ্যতের দৃশ্য দেখেছেন তিনি। উপন্যাসের নায়ক উইনষ্টোন স্মিথের ভয়ঙ্কর কিছু অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে এ কাহিনীতে।
প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধ ইত্যাদি প্রচুর প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্র লিখে গেছেন জর্জ অরওয়েল। বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের সংখ্যাও অনেক। তার এই টুকরো লেখাগুলো বিশাল আকারের চার খণ্ড ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে, যে সিরিজটির নাম দেওয়া হয়েছে-‘দ্য কালেক্টেড এসেজ, জার্নালিজম, অ্যান্ড লেটারস অভ জর্জ অরওয়েল’ ।
ভলিউম ১. অ্যান এজ লাইক দিস : সময়কাল ১৯২০-১৯৪০।
ভলিউম ২, মাই কান্ট্রি রাইট অর লেফট : সময়কাল ১৯৪০–১৯৪৩।
ভলিউম ৩. অ্যাজ আই প্লীজ : সময়কাল ১৯৪৩–১৯৪৫ ৷
ভলিউম ৪. ইন ফ্রন্ট অভ ইয়ের নোজ ; সময়কাল ১৯৪৫ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। .
দ্রষ্টব্য : অরওয়েল তার আত্মজীবনী লিখে যান ‘সাচ, সাচ ওয়্যার দ্য জয়েস’ নামে। মূলত স্কুল জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোই স্থান পেয়েছে এতে । অরওয়েলের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় এই আত্মজীবনীমূলক বইটি। ১৯৪৭ সালে লেখা এ বইয়ে অরওয়েল স্মৃতিচারণ করেছেন সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুলের দুঃখময় সেই দিনগুলোর কথা, যে স্কুলে এগার বছর বয়স থেকে সতের বছর পর্যন্ত ছ’ছটি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

Download and Comments/Join our Facebook Group