Ticker

6/recent/ticker-posts

একজন দুর্বল মানুষ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল (ছোটগল্প)

একজন দুর্বল মানুষ (ছোটগল্প)

বিকট একটা চিৎকার দিয়ে আমি উঠে বসলাম, বুকের ভেতর ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে, সারা শরীর ঘামে ভেজা, গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে আমি কোথায়—নিজের ঘরে বিছানার উপর বসে আছি জানার পরও আমার শরীর কাঁপতে থাকে। মাথার কাছে গ্লাসে পানি রাখা থাকে, হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিলাম। খানিকক্ষণ লাগল আমার ধাতস্থ হতে। আবছা অন্ধকার চারদিকে, ভোর হতে এখনো বেশ দেরি আছে। আমি বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে বসে নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে থাকি। ইশ—কী একটা স্বপ্ন!
এই একটা নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে—প্রায় প্রতি রাতেই একই ব্যাপার, ঘুরে ফিরে এই একই প্রশ্ন। আমি টেবিলের উপর হাত বিছিয়ে বসে আছি, আর একটা ন্যাংটা মানুষ—তার সারা শরীর লোম দিয়ে ঢাকা, একটা হাতুড়ি নিয়ে চিৎকার করে আমার হাতের আঙুলগুলো একটা একটা করে থেঁতলে দিচ্ছে, প্রচণ্ড আঘাতে আমার আঙুল থেকে নখ ছিটকে বের হয়ে আসছে আর আমি চেঁচাচ্ছি। কী ভয়ানক ব্যাপার! কেন আমি এরকম একটা জিনিস দেখছি? মিলিটারি আমাকে ধরে নিয়ে দুই মাস আটকে রেখেছিল সত্যি, কিন্তু আমার উপর সে রকম কোন অত্যাচার তো করেনি। দেশ স্বাধীন হবার পর গলায় ফুলের মালা দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে আনা হলো আমাদের। গলা কাঁপিয়ে আমি একটা ছোটখাটো বক্তৃতাও দিয়েছিলাম মনে আছে। কিন্তু এখন একি ব্যাপার? যত দিন যাচ্ছে ততই খারাপ হচ্ছে অবস্থা, আগে মাসে এক-দুই দিন দেখতাম স্বপ্নটা, তারপর সপ্তাহে এক-দুই দিন আজকাল প্রায় প্রতি রাতেই দেখি। এমন অবস্থা হয়েছে যে ইদানীং তো ঘুমোতে যেতেই ভয় করে।
বালিশের তলা থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম, মাত্র দুটি সিগারেট রয়েছে, রাতে নতুন একটা প্যাকেট খুলেছি এর মাঝেই সবশেষ। এত সিগারেট খেলে তো এমনিতেই যক্ষ্মা-টক্ষ্মা কিছু একটা হয়ে যাবে।
সিগারেটে দুটি টান দিয়ে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হলো। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, এটা নিয়ে মাথা গরম করে কী হবে? বেঁচে ফিরে এসেছি সেটাই বড় কথা, সেটা নিয়েই তো খুশি থাকা উচিত। কয়জন আর মিলিটারির হাত থেকে জ্যান্ত ফিরে এসেছে।
সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরে আমি বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম, আজ মনে হয় আর ঘুম আসবে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনটা ভাল হয়ে গেল, ভোরের প্রথম আলোতে সবকিছু এত সুন্দর দেখায় কেন? বাইরের এই হতশ্রী জায়গাটাও এখন কী মায়াময় লাগছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে পড়ল আজ এপ্রিলের চার তারিখ, আমার মায়ের মৃত্যু দিবস। প্রথম মৃত্যু দিবস। কী আশ্চর্য দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল?
আজকাল মারা যাওয়ার ব্যাপারটি কেমন জানি সহজ হয়ে গেছে। যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন মায়ের একবার অসুখ হয়েছিল, খারাপ রকমের নিমোনিয়া। কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম, মনে হতো যদি মরে যান তখন কী হবে? ভয়ের চোটে একবারে সত্যি সত্যি পেট নেমে গিয়েছিল আমার। মা যখন সত্যি সত্যি মারা গেলেন তখন কিন্তু ঠিক করে কেমন জানি সব কিছু বুঝতে পারলাম না, দুঃখ টুঃখ বেশি হলো না, মনে হলো এরকমই তো হবে। তখন অবিশ্যি একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম, মিলিটারির ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে দুদিন থেকে হাঁটছি, মার জ্বর, ভাল হাঁটতে পারেন না, ধরে ধরে কোনভাবে নিয়ে যাই। বিকেলের দিকে রাস্তার পাশে বসে বমি করলেন, সন্ধের দিকে বললেন, আমি আর পারি না, তোরা যা। শুনে দুঃখ নয়, হতাশা নয়, সবাই কেমন জানি মায়ের উপর রেগে উঠল। একবছর পর এখন সেই ঘটনা মনে পড়ে আমার এত লজ্জা লাগতে লাগল যে বলার নয়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের শূয়োরের বাচ্চা মিলিটারিরা কী রকম হৃদয়হীন অমানুষ করে দিয়েছিল!
মা মারা গেলেন এপ্রিলের চার তারিখ, রোববার। তারিখটা বের করেছিলাম পরে, তখন দিন তারিখের কথা মনে ছিল না। একটা অচেনা গ্রামে অপরিচিত একজন মানুষের বাড়ির বারান্দায় শুয়ে আমার মা, যিনি সেই যুগে বাংলায় এমএ পাস করেছিলেন চুপচাপ মারা গেলেন। মোটামুটি যান্ত্রিক দক্ষতায় তাকে একটা পুকুর পাড়ে কবর দেয়া হয়েছিল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমার পুরো ঘটনাটি মনে পড়ে গেল, আর কেন জানি বেশ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। আঁখু মে লোহু ছবিতে এরকম একটা সিনেমার নায়ক ঠিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
আজকে ভাল একটা কিছু করতে হবে মায়ের জন্য। মোটামুটি দুর্বল চরিত্রের মানুষ আমি, ভাল কিংবা খারাপ কোনকিছুই করতে পারি না। তবুও আমার এমএ পাসের মায়ের জন্য—যিনি আকারে ছোটখাটো এবং কোমল স্বভাবের ছিলেন, যাকে দাফন করে আমরা প্রচণ্ড খিদে নিয়ে গুড় দিয়ে পেট ভরে রুটি খেয়েছিলাম—তাঁর জন্য আমার কিছু একটা করার ইচ্ছে হলো। বেঁচে থাকলে কী করলে মা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন? আজ সেটাই করব আমি।
মা ধার্মিক মহিলা ছিলেন। মার্চ মাসের গোড়ার দিকে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো তখন মা বঙ্গবন্ধুর নামে খতমে ইউনুস পড়া শুরু করলেন, তার ধারণা হলো বঙ্গবন্ধুর উপর অনেক বড় বিপদ। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার পড়বেন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জুয়ালেমিন, যার অর্থ মনে হয় ‘হে খোদা এই জালিমের হাত থেকে তুমি রক্ষা করো’। কে জানে আমার মায়ের দোয়ার জোরেই বঙ্গবন্ধু বেঁচে ফিরে এসেছে কি না। আমার মায়ের জন্যে কেউ খতমে ইউনুস পড়েনি, তাই মা আর বাঁচতে পারলেন না। জালিমের হাত থেকে পালাতে গিয়ে একজনের বারান্দায় শুয়ে মারা পড়লেন।
মায়ের জন্যে কী একটা খতমে ইউনুস পড়ব? নাহ! যে মারা গেছে তাকে জালিমদের হাত থেকে রক্ষা করে কী হবে? তাহলে কী নামাজ পড়া শুরু করব? মা সবসময় বলতেন, নামাজ পড়, নামাজ পড় অন্তত জুমার নামাজটা পড়। আর কী একবার নামাজ পড়ে দেখব? মা বেঁচে থাকলে তো খুবই খুশি হতেন, অজু করে কি বসে যাব ফজরের নামাজে? আইডিয়াটা খারাপ না, শুধু একটা সমস্যা, আত্তাহিয়াতু ভুলে গেছি। সেই কবে ছেলেবেলায় শিখেছিলাম, এতদিন পরে কি মনে থাকে? তবু বার কয়েক চেষ্টা করে দেখলাম পুরোটা মনে করতে পারলাম না।
নাহ্‌ অন্য একটা কিছু করতে হবে।
সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলে কেমন হয়? বুকের ভেতরে হঠাৎ আমার আবেগের মতো একটা জিনিসের সৃষ্টি হলো। মা দু চোখে দেখতে পারতেন না সিগারেট, ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে যখন চেষ্টা চরিত্র করে সিগারেট খাওয়া শিখে ফেললাম মা যে কী বিরক্ত হয়েছিলেন তা আর বলার নয়, কিন্তু বলতেও পারতেন না, আবার না বলেও থাকতে পারতেন না। সেই সময়ের কথা মনে করে আজ মায়ের মৃত্যু দিবসে আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। বালিশের তলা থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে গভীর আবেগের সাথে বললাম, মা তোমার কথা মনে করে আজ থেকে আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলাম। এই দেখো—বলে আমি অবশিষ্ট সিগারেটটিকে ছিঁড়ে দুই টুকরো করে ফেলে বললাম, আজ থেকে সিগারেট খাই তো গু খাই।
মায়ের মৃত্যুদিবসে এরকম একটা প্রতিজ্ঞা করে আমার ভেতরে একটা গভীর ভাবের সৃষ্টি হলো, সেই ভাবটা টাটকা টাটকা থাকতেই সাত সকালে গোসল করে ফেললাম। নাশতা করা পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারলাম হঠাৎ সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়াটা ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। গত দুই বছর থেকে আমি সকালে চায়ের সাথে একটা করে সিগারেট খেয়ে আসছি, শরীর প্রাত্যহিক নিকোটিনের এই ডোজে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আমার নিজের মায়ের পুণ্য স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যত ইচ্ছেই থাকুক আমার বুক একটু সিগারেটের ধোঁয়ার জন্যে প্রায় খেপে গেল। আমি নেহায়েতই দুর্বল চরিত্রের মানুষ, কাজেই একটু পরেই সকালে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে রাখা সিগারেটটা খুঁজে বের করে ধরাতে বাধ্য হলাম। মা তুমি আমাকে মাপ করে দিও, আজ আমি তোমার জন্যে অন্য একটা কিছু করব।
সকাল সাড়ে আটটায় একটা ক্লাস আছে। এত সকালে ক্লাসে আমি কখনো যাই না, শামীমের সাথে ঠিক করা আছে, সে আমার হয়ে প্রক্‌সি দিয়ে দেয়। আজ যখন এত ভোরে উঠে গেছি, ক্লাসটাতে হাজির হলে কেমন হয়? ব্যাপারটি চিন্তা করে আহ্লাদিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু আমার ভেতরে আবার আবেগের মতো সেই জিনিসটার জন্ম নিল। মায়ের মৃত্যুদিবসে আজ আমি সৎভাবে থাকব, কেউ আমার ক্লাসে প্রক্‌সি দেবে না, আমি কারো ক্লাসে প্রক্‌সি দেব না, সারাদিন মিথ্যা কথা বলব না, মেয়েদের শরীরের দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকব না, গর্দান মোটা আজিজের ঘাড় ভেঙ্গে চা সিগারেট খাব না, ফাইফ ফিফটি ফাইভের লোভে আরশাদের মোটা মোটা রসিকথায় হেসে গড়িয়ে পড়ব না।
ব্যাপারটা সিগারেট ছেড়ে দেবার মতো এত কঠিন হবার কথা নয়, তা ছাড়া সারা জীবনের জন্যে তো প্রতিজ্ঞা করছি না, করছি শুধু একদিনের জন্য। আমার ভাল মানুষ মায়ের কথা মনে করে একদিন একটা খাঁটি মানুষের মতো থাকার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী? আমি, জাফর ইকবাল, উনিশশ বাহাত্তুর সালের চৌঠা এপ্রিল সকাল সাতটা আটচল্লিশ মিনিটে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে একটা খাঁটি মানুষের মতো থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
অভ্যাসের অভাবে সকাল সাড়ে আটটার ক্লাসে নয়টা বাজার আগেই গভীর ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করে আমার চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম, সকালে এত বড় একটা প্রতিজ্ঞা করে ক্লাসে ঘুমিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাস শেষ হতে মনে হলো এক যুগ লেগে গেল। ক্লাস থেকে বের হতেই শফিক আমার কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, ইকবাল, এদিকে আয়, তোর সাথে কথা আছে।
শফিক একটা রাজনৈতিক চরিত্র। ময়লা শার্ট, মোটা গলা এবং ভারী চশমা নিয়ে সে সহজ-সরল বিষয়কে ঘোরালো করে তার ভেতর থেকে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বের করে ফেলে। ক্লাসের বেশির ভাগ মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে ফেলায় শফিকের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা আর ছেলেদের মাঝে বেশি সুবিধা করতে পারছে না। মিলিটারি আমাকে ধরে প্রায় দুই মাস আটকে রেখেছিল বলে আমার প্রতি শফিকের একটা শ্রদ্ধা মেশানো বিশ্বাস রয়েছে এবং প্রয়োজনে সে আমার সাথে কথা বলে থাকে। আজও গলা নামিয়ে বলল, ইকবাল, ব্যাপার বেশি সুবিধের না।
কেন কী হয়েছে।
খোরশেদ শালা বিট্রে করেছে।
তাই নাকি।
হ্যাঁ। এরপর আমাকে শফিকের মুখ থেকে খোরশেদ নামে আরো একজন রাজনৈতিক চরিত্রের কার্যকলাপের বিশদ বর্ণনা শুনতে হলো।
আমি আমার মুখে বিষয়টির উপযোগী গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম, হুঁ। কেস সিরিয়াস। এখন কী করা যায়? শফিক গলা নামিয়ে বলল, তোকে ঐ শালা এখনো নিউট্রাল লোক মনে করে। তুই যদি শালাকে একটু বুজিয়ে সুঝিয়ে বলিস। এরপর শফিক আমাকে বলে দিল খোরশেদ নামক ছেলেটিকে, যাকে শফিক শ্যালক বলে সম্বোধন করছে, তাকে কী কী বানানো কথা বলতে হবে।
বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমি আগেও বিভিন্ন জায়গায় নানারকম বানানো কথা বলেছি, আমার বিবেক কখনো সেকারণে আমাকে যন্ত্রণা দেয়নি। তাছাড়া শফিককে হাতে রাখাটা খারাপ নয়, তার অনেক বিশ্বস্ত চামচা রয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি বলে দেব।
বলেই আমার মনে পড়ল আজ আমার খাঁটি মানুষের মতো থাকার কথা, আজ সকল রকম মিথ্যাচার বন্ধ। সাথে সাথে আমি মুখটি গম্ভীর করে বললাম, শফিক—
কী? দোস্ত, আজ হবে না। আজ আমি কারো সাথে মিথ্যে কথা বলতে পারব না।
কী করতে পারবি না?
মিথ্যা কথা বলতে পারব না।
শফিক প্রথমে ভাবল এটি কোন এক ধরনের রসিকথা, তাই সে টেনে টেনে খানিকক্ষণ হাসল, কিন্তু আমি তবু মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম দেখে সে খানিকক্ষণ আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর আর একটি কথাও না বলে চলে গেল। ব্যাপারটি ভাল হলো না। ময়লা শার্ট, মোটা গলা এবং ভারী চশমার শফিককে চটানো ঠিক নয়, তার সাথে সব মাস্তানদের খাতির। আমি নিজে দেখেছি তার এক বিশ্বস্ত চামচা শার্টের নিচে একটা জং ধরা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ক্যান্টিনে আজিজকে পাওয়া গেল। তার দু’পাশে দুজন বসে আছে, সব সময় তার সাথে কেউ না কেউ বসে থাকে। আজিজ মালদার পার্টি, আমাদের ক্লাসে যে দুজন ছেলে গাড়ি হাঁকিয়ে আসে তার একজন হচ্ছে আজিজ, তার বাবার বিস্কুটের ফ্যাক্টরি রয়েছে, কাজেই তার ঘাড় ভেঙ্গে খাওয়া নতুন কোন ব্যাপার নয়। আজিজের বুকে আড়াআড়িভাবে বসানো আছে একটা মস্ত হৃদয়, এই হৃদয়ের কোন অবসর নেই। সব সময়েই সেটা কোন না কোন মেয়ের জন্যে নিবেদিত, যদিও সেই মেয়েটি কখনোই তার খবর পায় না। আজিজের সুবিশাল হৃদয় তৈরি করতে গিয়ে যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে টান পড়েছে তার একটি হচ্ছে মস্তিষ্ক। আমার ধারণা তার খুলি খুলে দেখলে সেখানে কাঁটালের বিচির মতো ছোট একটা মস্তিষ্ক পাওয়া যাবে। তার কাছে বসে গল্প-গুজব করা কোন সুখকর ব্যাপার নয়। কিন্তু আমাকে হাত নেড়ে ডাকায় তার কাছে গিয়ে বসতে হলো। আজিজের সাথে বসে আছে ফখরুল আর সুমন। সুমন ছেলেটির চেহারা ভাল বলেই কি না জানি না মেয়েরা তাকে খুব লাই দেয়। এই শালা মেয়েদের সাথে অবলীলায় তুই তুই করে কথা বলে এবং মেয়েরাও তাকে বলে ‘দেব একটা থাপ্পড়’ বা ‘দেব একটা চড়’। শুনে সেও দেখি হি হি করে হাসে। সুমন ব্যাটা বজ্জাত কম না, সেদিন দেখি কয়জন মেয়ে সিঁড়ির উপরে বসে আছে। এই শালা ঠেলেঠুলে তাদের মাঝখানে জায়গা করে বসে পড়ল। কি যেন একটা মজার ব্যাপার আর মেয়েদের কী খিল খিল হাসি! শুনেই আমার গা জ্বলে যায়। মেয়েসংক্রান্ত ব্যাপারে উপদেশের প্রয়োজন হলে আজিজ সব সময়ই এই অভিজ্ঞ মানুষটির শরণাপন্ন হয়, কে জানে আজকেও তাই হচ্ছে কি না।
সুমন আমার দিকে চোখ টিপে বলল, দোস্ত, অবস্থা খুব সিরিয়াস।
আমি বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
আজিজের সাথে ফোরটি থ্রির লদকা লদকি।
আজিজ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, যা শালা বাজে কথা বলিস না।
রোল নাম্বার পোরটি থ্রি ক্লাসের সুন্দরী মেয়েগুলোর একজন, অনেকেই লদকা লদকির জন্যে ঘুরোঘুরি করছে এদের মাঝে আজিজের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে তার কোন সম্ভাবনা নেই। বিড়াল যে রকম ইঁদুরের বাচ্চাকে নিয়ে খেলে সুমন আর ফখরুলও এই গর্দভকে নিয়ে সেভাবে খেলছে। আমি বসতেই সুমন গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো কথা বলতে শুরু করল, কথার বিষয়বস্তু হলো লাইব্রেরিতে বই নিতে রোল নাম্বার ফোরটি থ্রির সাথে আজিজের কী কী কথা হয়েছে এবং সেটার প্রকৃত অর্থ কী। অন্যদিন হলে আমিও এটাতে যোগ দিয়ে প্রমাণ করে ছেড়ে দিতাম যে পুরো ব্যাপারটি আজিজের প্রতি রোল নাম্বার ফোরটি থ্রির গোপন অনুরাগের একটি বহিঃপ্রকাশ। এখন আজিজের কী করা উচিত সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শুরু করে দেয়া হতো। আজ অন্য ব্যাপার, ঠিক করে রেখেছি যে খাঁটি মানুষের মতো থাকব। কাজেই এই ছেলেমানুষী এবং সম্ভবত হৃদয়হীন ব্যাপারে যোগ দেয়া গেল না। সুমন আরেকবার ব্যাপারটির অন্য একটি দৃষ্টি থেকে বিশ্লেষণ শুরু করতেই আমি মেঘ স্বরে বললাম, সুমন।
সুমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে হাতের আধ খাওয়া ফাইভ ফিফটি ফাইভটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, এটা নিশ্চিতভাবে আজিজের প্যাকেট থেকে নেয়া। আমি অভ্যাসবশত প্রায় নিয়েই নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেল, আজ আর কোন রকম দীনতা নয়। তাছাড়া শালা সুমনের ঠোঁটে বিশ্রী রকমের একটা ঘা দেখা যাচ্ছে। কে জানে সেটা ছোঁয়াচে কি না। হাত নেড়ে ফিফটি ফাইভকে উপেক্ষা করে আজিজকে বললাম, আজিজ তোর মাথায় কী ঘিলু বলে কিছু নেই।
‘কানাকে কানা বলিতে হয় না’, ‘খোঁড়াকে খোঁড়া বলিতে হয় না’, সেরকম মনে হয় ‘বোকাকেও বোকা বলিতে হয় না’, কারণ আমার প্রশ্ন শুনে আজিজ একেবারে ঘ্যাঁক করে ক্ষেপে উঠল, চোখ লাল করে বলল, কী বললি? কী বললি তুই?
কিছু বলিনি, জিজ্ঞেস করেছি। তোর মাথায় কি ঘিলু বলে কিছু আছে?
মুখ কালো করে আজিজ বলল, কেন কী হয়েছে?
এই শালারা তোর সাথে রং-তামাশা করে ইয়ারকি মারে আর তুই ভাবিস দুনিয়া জাহানের সব মেয়ের সাথে তোর প্রেম? প্রেম এত সোজা? তাও তোর মতো গর্দভের সাথে? শালা গরু কোথাকার।
আজিজ একবারে ফ্যাকাসে মেরে গেল। সুমন আর ফখরুল আমার কাছ থেকে এরকম একটা জিনিস আশা করেনি, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অপ্রস্তুতের মতো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল, কারণ আমি দেখতে পেলাম শফিকের সাথে তার দলের একজন বড় চাঁই এবং কয়েকজন চামচা আমাদের দিকে আসছে, তার মাঝে একজন হচ্ছে শফিকের বিশেষ বিশ্বস্ত যে কোমরে একটা জং ধরা রিভলবার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেরেছে!
দলের বড় চাঁইয়ের সাইজ বেশ ছোট। উঁচু জুতা এবং কোকড়া চুলকে ঝাউগাছের মতো উপরে তুলে দিয়েও সর্বোচ্চ উচ্চতা মনে হয় চার ফিট তিন থেকে এক আঙুল বেশি হবে না। চাঁইটা আমাদের কাছে এসে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হাসল।
উত্তরে আমি আমার শুকনো ঠোঁটকে জিব দিয়ে ভিজিয়ে মধুরভাবে হাসার চেষ্টা করলাম। চাঁই আমার পাশে এসে বসল এবং সাথে সাথে আজিজ এবং তার সাথে ফখরুল আর সুমন চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল, এই ক্ষুদ্রাকৃতির চরিত্রটি এই এলাকায় বাটু গুণ্ডা নামে পরিচিত।
বাটু গুণ্ডা আমার ঊরুতে একটা থাবা দিয়ে বলল, কী?
এটি ঠিক প্রশ্ন হতে পারে না, তাই আমি উত্তর না দিয়ে আবার একটু হাসার মতো ভান করলাম।
কী শুনি?
এটা একটি প্রশ্ন, উত্তর দেয়া প্রয়োজন। মুখে অবিচলিত ভাব ধরে রাখার জন্যে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে একটা সিগারেট ধরালাম, লম্বা একটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী শুনেন?
তুমি নাকি ভোল পাল্টাচ্ছ? শার্ট খুলে নাকি পেটিকোট?
ইঙ্গিতটি স্পষ্ট, শফিকের দল ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছি কি না জিজ্ঞেস করছে। আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখে একটা বাঁকা হাসি টেনে এনে বাম হাতের বুড়া আঙুলি দিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সাথে শফিককে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার শোনার যন্ত্র কি একটাই, না আরো আছে?
ঠিক বুঝতে পারলাম না কেন বাটু গুণ্ডা এটাকে খুব উঁচু দরের রসিকথা হিসেবে ধরে নিল। সে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ করে দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। বেশির ভাগ মানুষকে হাসলে ভাল দেখায়, এর বেলায় সেটি সত্যি নয়। এর মাড়ি কৃষ্ণবর্ণ এবং হাসার সময় হায়েনার মতো মাড়ি বের হয়ে আসে। আমি কখনো হায়েনা দেখিনি, কিন্তু আমি নিশ্চিত হায়েনা দেখতে অনেকটা এরকম। বাটু গুণ্ডা যেভাবে হঠাৎ হাসি শুরু করেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাচু ভাই কেমন আছেন?
আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে সে আমার বাবার কথা বলছে। আমার বাবার ডাক নাম কাচু, এখন শুধু আমাদের গ্রামের বাড়ির কিছু বয়স্ক লোকেরা তাকে কাচু নামে ডাকে। আমি শুনেছিলাম এই বাটু গুণ্ডা আমাদের গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে এসেছে। এর আগে কখনো সে সেই সম্পর্কটা ব্যবহার করেনি, আজ করল। আমি বললাম, ভাল আছেন।
বাটু গুণ্ডা একটি ছোট কিন্তু দর্শনীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভাল আর কিভাবে থাকবেন। ভাবীকে ছাড়া—ওফ! সে গভীর একটা দুঃখের ভান করে মাথা নাড়তে থাকে।
আমি টের পেতে থাকি যে আমার মেজাজ আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
কয়দিন আগে দেখা হয়েছিল কাচু ভাইয়ের সাথে, ইশ, চেনা যায় না দেখে। বাটু গুণ্ডা মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, মানুষের মন ভেঙে গেলে আর কিছুই ঠিক থাকে না। কী চেহারা ছিল কাচু ভাই এর। আর এখন।
বাবা ভালই আছেন।
বাটু গুণ্ডা আমার কথায় একটু অসন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো। একটু রেগে বলল, এরকম অবস্থায় মানুষ ভাল থাকে কেমন করে?
আমার কী হলো জানি না এক গাল হেসে বললাম, বাবা আবার বিয়ে করেছেন।
বাটু গুণ্ডা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, ঠিক বুঝতে পারছিল না আমি ঠাট্টা করছি কি না। আমতা আমতা করে বলল, কাচু ভাই? কাচু ভাই?
হ্যাঁ। বিয়ে করেছেন।
কা-কাকে?
একটা মেয়েকে। আমাদের আত্মীয় হয়, মেয়ের বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, তাই বাবা পরিবারটিকে একটু উপকার করার চেষ্টা করছেন। আমি এবারে দাঁত বের বরে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করলাম।
উপস্থিত অন্যদের এই প্রথমবার একটু কৌতূহলী হতে দেখা গেল। একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবার বয়স কত?
পঞ্চাশ।
মেয়ের?
কুড়ি বাইশ। একেবারে থৈ থৈ যৌবন। বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, দেখলে মুখে পানি এসে যায়।
বাটু গুণ্ডা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের কথা শুনে আমি নিজেও একটু অবাক হয়ে গেলাম, এই প্রথমবার বুঝতে পারলাম বাবা নামক চরিত্রটির উপর আমি কী পরিমাণ ক্ষেপে আছি।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছে সূক্ষ্মভাবে। একদিন সকালে দেখলাম বাবা গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন, জন্মের পর থেকে দেখে আসছি তার নবাব সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফ, হঠাৎ করে সেটা কামিয়ে ফেলায় তাকে একটা মেয়ে মানুষের মতো দেখাতে লাগল। গোঁফ কামানোর রহস্যটা তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু কয়দিন পর যখন তার কাস্টমসের এক বন্ধু তাকে এক বোতল বিলিতি কলপ দিয়ে গেল তখন সেটা পরিষ্কার হলো। পাকা চুল কলপ দিয়ে কালো করা যত সোজা পাকা গোঁফকে কালো করা তত সোজা নয়। একটা দুইটা হলে টেনে তুলে ফেলা যায়, কিন্তু অর্ধেক পেকে গেলে কামিয়ে ফেলা ছাড়া গতি নেই। বিলিতি কলপের কী কেরামতি, রাতারাতি না হয়ে আস্তে আস্তে করে চুল কালো হতে শুরু করল, মাসখানেক পরে দেখি বাবাকে আর চেনা যায় না, বয়স চোখ বুজে কুড়ি বছর কমিয়ে ফেলেছেন!
এরপর বাবা যে খেল দেখালেন তার কোন তুলনা নেই। একদিন বললেন, ঘর বাড়ি অনেকদিন থেকে চুনকাম করা হয়নি, তাই ঘর চুনকাম করা হবে। দেওয়াল থেকে সব ছবি নামিয়ে ঘর চুনকাম করা হলো, তারপর আবার সব ছবি টাঙানো হলো—দুটি ছবি ছাড়া। মায়ের একটা বড় ছবি আর বাবার আর মায়ের বিয়ের ছবি। খবরের কাগজে মুড়িয়ে অনেকদিন সে দুটি স্টোর রুমে ফেলে রাখা হয়েছিল, পুরোপুরি গায়েব হবার আগেই আমি মায়ের ছবিটা আমার ঘরে সরিয়ে এনেছি।
আমার ভবিষ্যৎ মা কয়েকবার তার ভাইদের সাথে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন, বাবা ছোক ছোক করে তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ান আর তিনি একেবারে কাঠ হয়ে বসে থাকেন। অপদার্থ ভাইগুলো জোর করে এই কমবয়সী কপাল খারাপ মেয়েটিকে বাবার মতো একজন বুড়োর গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে।
বাবার খবরটি দেবার পর বাটু গুণ্ডার উচ্ছ্বাসে একটু ভাটা পড়ে গেল। খানিকক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়ে বলল, আমি উঠি। একটু থেমে যোগ করল, তাহলে সেটাই ঠিক থাকল।
কী বলতে চাইছে পরিষ্কার বুঝতে পেরেও আমি না বোঝার ভান করলাম, কী ঠিক থাকল?
শফিক তোমাকে যেটা বলেছে।
আমি মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না।
কবে থেকে পীর হয়ে গেলে?
আজ থেকে।
বাটু গুণ্ডার মুখ লাল হয়ে ওঠে। এই ধরনের চরিত্রগুলো রেগে গেলে বিপদ, এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, লোকজনের সামনে একটা কিছু অপমান করে ফেলতে পারে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সাথের দুই চামচা একটু এগিয়ে আসছিল, বাটু গুণ্ডা তাদের থামিয়ে বলল, এতদিন কোন ঝামেলা টের পাও নাই, কারণ সবাইকে বলেছি তুমি আমাদের দিকে আছ। যদি না থাক ক্ষতি নাই, কিন্তু যদি বিট্রে করো, বলে রাখলাম বড় ঝামেলা হবে।
বাটু গুণ্ডা, তার পিছনে শফিক এবং সবার পিছনে দুই চামচা হেঁটে হেঁটে বের হয়ে গেল। ক্যান্টিনের সবাই মাথা ঘুরিয়ে প্রথমে তাদের এবং তারপর আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, মা, তোমার মৃত্যুবার্ষিকীতে সত্যি কথা বলার প্রতিজ্ঞা করে দেখো কী রকম ঝামেলায় ফেঁসে যাচ্ছি।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে ক্যান্টিনে বসে রইলাম, সত্যি কথা বলতে কী পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার বেশ ভালই লাগল, কে জানে আমার চরিত্রটা হয়তো যতটা দুর্বল ভেবেছিলাম ততটা দুর্বল নয়, বাটু গুণ্ডার মুখের উপর ওরকম কথা কয়জন বলতে পারে?
আজ পর পর বেশ কয়েকটা ক্লাস, কোনটা ফাঁকি না দিয়ে একটার পর আরেকটা চালিয়ে গেলাম। অন্যদিনের মতো ফোরটি থ্রির শরীরের দিকে না তাকিয়ে স্যারেরা কী বলছেন বোঝার চেষ্টা করলাম। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে মস্তিষ্ক কাজ করতে চায় না, পড়াশুনা করি না, ক্লাস বহুদূর এগিয়ে গেছে সেটাও আরেকটা সমস্যা। অনার্সের আগে তিন মাস দরজা বন্ধ করে পড়ে পড়ে সব সামাল দিতে হবে, এখন দিতে পারলে হয়!
তিনটার দিকে সব ক্লাস শেষ করে আমরা কয়জন বারান্দায় বসে আড্ডা মারছিলাম। রসালো বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, কার ঘর থেকে কার জানালার ভেতর দিয়ে শোয়ার ঘরে কী দেখা যায় এসব। আমি জোর করে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি, আজকের দিনটাতে অন্তত একটা দৃঢ় চরিত্র দেখাতে হবে। ঠিক এরকম সময়ে সামনে লাল রঙের ভারী সুন্দর একটি গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামল একটা মেয়ে, দেখতে একেবারে যাকে বলে আগুনের মতো সুন্দরী। কয়েক পুরুষ ধরে বড়লোক হলেই মনে হয় মানুষের ভেতর ফিল্টার করে করে এরকম সৌন্দর্য এসে জমা হয়। আমাদের ভেতর একটা চাপ উচ্ছ্বাসের বিদ্যুৎ বয়ে গেল। এতগুলো ছেলে মেয়েটার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, তবু মেয়েটিকে খুব একটা বিব্রত হতে দেখা গেল না, বেশ সপ্রতিভভাবে হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছে এসে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ফিজিক্‌স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র?
সুমন বলল, হ্যাঁ, আমরা সবাই কপাল পোড়া।
মেয়েটি একটু ভদ্রতার হাসি হেসে বলল, থার্ড ইয়ারের কী কেউ আছেন?
সুমন একগাল হেসে বলল, আপনার কপাল খুবই ভাল, সবাই আমরা থার্ড ইয়ারের।
আপনারা কী জাফর ইকবাল নামে কাউকে চেনেন?
সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল, ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, এরকম সুন্দরী একটা মেয়ে আমাকে খোঁজ করতে পারে।
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমি জাফর ইকবাল।
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু মনে হলো একটু যেন হতাশ হলো। শালার চেহারাটা এরকম যে যেই দেখে কেমন জানি সন্দেহের চোখে দেখে। মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, আপনার সাথে একটা কথা বলতে পারি?
আমি উত্তেজনায় প্রায় দাঁড়িয়ে গেলাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শিওর।
মেয়েটি একটু এগিয়ে গেল। আমি উপস্থিত সবার ঈর্ষার পাত্র হয়ে পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম, সুমন সবাইকে শুনিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এমন একটা বেহায়া ছেলে।
আমার নাম রুখসানা। রুখসানা হাসান।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমি শুনেছি যুদ্ধের সময় আপনাকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ দু’মাস আমি ক্যান্টনমেন্টে আটক ছিলাম। মুখে আমি ক্যান্টনমেন্টে আটকা থাকার দুঃসহ জীবনের উপযোগী একটি ভাব আনার চেষ্টা করতে থাকি।
যখন ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন তখন কি আপনি শওকত নামে কাউকে দেখেছিলেন?
শওকত?
হ্যাঁ, আমার ছোট ভাই। মিলিটারিরা অক্টোবর মাসে ধরেছিল। দেখেছিলেন?
হায় খোদা! এ শওকতের বোন? আমার চোখের সামনে হঠাৎ দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। শওকতের হাতটি চেপে ধরে রেখেছে একজন আর আরেকজন একটা হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড আঘাতে তার আঙুল থেঁতলে দিচ্ছে, হাতের নখ ছিটকে ছিটকে বের হয়ে আসছে আর চিৎকার করছে শওকত। চিৎকার—চিৎকার—চিৎকার!
অক্টোবর মাসে ধরেছিল ডেমরার কাছে, পাওয়ার স্টেশনে একটা অপারেশান করতে যাচ্ছিল, আপনার মতোনই লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা, কালো ফ্রেমের চশমা। দেখেছিলেন তাকে? দেখেছিলেন?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। কী বলি এখন?
দেখেছিলেন তাকে? খুব আমাদের জানার ইচ্ছে তার জীবনের শেষ সময়টা কিভাবে কেটেছিল। জানেন আপনি?
হায় খোদা কী বলি এখন মেয়েটাকে? কী বলি?
জানেন তার কথা?
আমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লাম, জানি।
মেয়েটি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, একটি কথাও না বলে। তারপর খুব আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি কি আমাদের বাসায় যাবেন একবার? আমার মায়ের সাথে একটু কথা বলবেন? খুব তার জানার ইচ্ছে কী হয়েছিল।
আমি আমার শুকনো ঠোঁট দুটি জিব দিয়ে ভিজিয়ে বললাম, যাব।
গাড়িতে ওঠার সময় শুনলাম সুমন উচ্চ স্বরে একটি হিন্দি গান গাইতে শুরু করেছে বাংলায় যেটার অর্থ, প্রথমবার দেখেই তোমাকে আমার হৃদয় সঁপে দিয়েছি। এখন হৃদয় ছাড়া এই দীর্ঘ রজনী কেমন করে কাটাব? আমি না শোনার ভান করলাম। মেয়েটিকে দেখে বোঝা গেল না সে সুমনের গান শুনেছে কি না, সুন্দরী মেয়েদের এসব নিশ্চয়ই গা সওয়াও, কখন শুনতে হয় কখন না শুনতে হয় ওদের নিশ্চয় অনেক ভাল করে জানা। শালা সুমন, ফিরে এসে আমি যদি তোর দাঁত খুলে না নিই।
মেয়েটির চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম যে এরা কয়েক পুরুষ ধরে বড়লোক, বাসাটি দেখে বুঝলাম আমার ধারণা সত্যি। এরকম বাসায় এলসোসিয়ান কুকুর থাকে, বাইরের কেউ এলেই সেই কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করে। এসব বাসায় অনাহূতভাবে কখনো আসতে হয় না, তাতে ভারী বিড়ম্বনা হয়। আজ অবিশ্যি আমার কোন ভয় নেই। এই বাসার মেয়ের সাথে এক গাড়িতে এসেছি, পিছনের সিটে প্রায় গায়ের সাথে পা লাগিয়ে। তাছাড়া মনে হচ্ছে এ বাসায় কোন কুকুর নেই, গাড়ি থেকে নেমে সোজা বসার ঘরে চলে এলাম। কোন কুকুর তো ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো না।
বসার ঘরটি মনে হয় খুব সুন্দর করে সাজানো। আমার রুচিজ্ঞান খুব সুবিধের নয়, গলায় কাগজের ফুল দেয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলেই আমি কাত হয়ে যাই, সে তুলনায় এই বাসাতো একেবারে আর্ট মিউজিয়াম। দেয়ালে বড় বড় সুর্বোধ্য তেলরঙের ছবি, এক কোনায় আধা ন্যাংটা মেয়ের মূর্তি। কালো পাথরের টেবিল ল্যাম্প, মখমলের সোফা! কী নেই এই ঘরটাতে, কোথাও বড় করে একটা শওকতের ছবি থাকবে ভেবেছিলাম, সেটা নেই। কেন কে জানে। বড়লোক বন্ধু-বান্ধবের বাসায় গেলে বাসার কাজের লোক দিয়ে অনেকবার ভেতরে খবর আদান-প্রদান করাতে হয়, দেখা করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এখানে এসেও নিজের অজান্তেই তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলাম, কিন্তু মেয়েটি প্রায সাথে সাথেই একটা গ্লাসে ঠাণ্ডা একটু সরবত নিয়ে ঢুকল। তার পিছনে একজন মহিলা, ঠিক যেরকম হবে ভেবেছিলাম সেরকম। দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি এই মেয়ের মা, মনে হয় বড় বোন, কপালের উপর ইন্দিরা গান্ধীর মতো এক গোছা পাকা চুল ছাড়া চেহারায় বয়সের কোন ছাপ নেই।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, সালাম টালাম কিছু একটা দেব কি না চিন্তা করছিলাম। ভদ্রমহিলা তার সুযোগ দিলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, রুখসানা তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসেনি তো বাবা?
আমি একটু হাসার ভঙ্গি করে বললাম, না না কী যে বলেন।
তুমি এসেছ খুব ভাল হয়েছে, না হয় আমি নিজেই যেতাম।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ভদ্রমহিলা আরো কিছুক্ষণ হালকা কথাবার্তা বলে আসল বক্তব্যে চলে এলেন। শান্ত গলায় বললেন, রুখসানা বলেছে তুমি নাকি শওকতকে ক্যান্টনমেন্টে দেখেছিলে।
আমি মাথা নাড়লাম।
আমি ওর জীবনের শেষ সময়টার কথা তোমার কাছে শুনতে চাই।
আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই কি বলব মনে মনে ঠিক করে নিয়ে প্রায় মুখস্থ বলার মতো করে বললাম, আমাকে আর শওকতকে যারা ধরে নিয়েছিল তারা ছিল মোটামুটি অমানুষ, তারা আমাদের কী করেছে সেটা শুনতে আপনার ভাল লাগবে না।
ভদ্রমহিলা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, আমি তবু শুনতে চাই।
বিশ্বাস করেন শুনে আপনার আরো কষ্ট হবে।
হোক। আমি তবু শুনতে চাই।
কেন?
ভদ্রমহিলা থেমে থেমে প্রত্যেকটা শব্দে জোর দিয়ে বললেন, কারণ শওকত আমার ছেলে, তাকে আমি এইটুকু থেকে আস্তে আস্তে বড় করেছি। তার কাছে দেশ কেমন করে আমার থেকে বড় হয় সেটা আমি বুঝতে পারি না। আমি বুঝতে চাই।
কিন্তু আপনি তো বুঝতে পারবেন না।
ভদ্রমহিলা অসহিষ্ণুর মতো বললেন, না বুঝলে নাই, কিন্তু আমি তবু শুনতে চাই।
ঠিক আছে।
তুমি কোন কিছু গোপন করবে না, সব বলবে।
ঠিক আছে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কথা বলতে শুরু করলাম।
প্রথমে বললাম তাকে কিভাবে ধরে নিয়ে এলো তার কথা, চোখ কেমন করে কাল কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল, হাত দুটি কেমন করে শরীরের পিছন দিকে বাঁধা ছিল সেইসব। হাত খুলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ভেতরে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়ার পর শওকত কী কী করল আমি সেগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না সে ভয় পেয়েছে, সম্ভবত তখনো সে একটা ঘোরের মাঝে ছিল। আমাদের কয়েকজন তার সাথে কথা বলতে চাইলে সে বেশি উৎসাহ দেখায়নি। ডান হাতে কোন রকমের আঘাত লেগেছিল, ঠিক কতটা গুরুতর বোঝা যাচ্ছিল না। ঘণ্টাখানেক আমাদের কয়েকজনকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। প্রায় প্রতিদিনই নেয়, ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন করে, প্রয়োজনে একটু মারপিট করে। আজ সেখানে একজন মিলিটারি অফিসার বসে ছিল, সে শওকতকে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। জিজ্ঞেস করল তার অন্য মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা কোথায়? আমি এইটুকু বলে থামলাম।
ভদ্রমহিলা সাথে সাথে বললেন, তারপর কী হলো?
আমি একটু মাথা নিচু করলাম। এখন আমি কেমন করে বলি যে শওকত যখন বলল সে জানে না, সাথে সাথে ঠাণ্ডা মাথায় তার উপর অত্যাচার শুরু হলো। কেমন করে বলি যে একজন শওকতের হাত দুটি টেবিলের উপর চেপে ধরল আর একজন একটা হাতুড়ি নিয়ে একটা একটা আঙুল থেঁতলে দিতে শুরু করল? আমি কেমন করে বলি যে প্রচণ্ড আঘাতে হাতের নখ উড়ে যেতে শুরু করল? শওকত গরুর মতো চিৎকার করতে লাগল—হায় খোদা, এসব আমি এখন কেমন করে বলি?
ভদ্রমহিলার চোখ দুটি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল, ভাঙ্গা গলায় বললেন, বলো।
রুখসানা একটু এগিয়ে এসে তার মায়ের হাত দুটি ধরল অনেকটা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে।
আমি আমার শুকনো ঠোঁট দুটি জিব দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিলাম, হায় খোদা, আমাকে তুমি এ কী বিপদে ফেলেছ?
বলো কী হলো তারপর। ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভেঙ্গে গেল হঠাৎ।
আপনি কেন শুনতে চাইছেন? আমি বলছি আপনার শুনতে ভাল লাগবে না।
তবু বলো। তবু আমি শুনতে চাই।
আমি এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করলাম, মা তোমার মৃত্যুদিবসে মিথ্যা কথা বলব না প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর পারলাম না। আমাকে তুমি মাফ করে দিও। আমি এদের সত্যি কথা বলতে পারব না, তোমার মতো আরেকজন মায়ের হৃৎপিণ্ড হাত দিয়ে টেনে আমি ছিঁড়তে পারব না।
বলো।
বলছি। আমি কল্পনা করে নিলাম শওকত সুদর্শন অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অফিসারটি জিজ্ঞেস করছে তোমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা কই? শওকত উত্তরে কিছু একটা বলবে, কী বলবে? একটু ভেবে আবার শুরু করলাম আমি, বললাম, অফিসারটি শওকতকে জিজ্ঞেস করেছে উর্দুতে। বাংলাদেশের এমন কোন মানুষ নেই যে অল্প বিস্তর উর্দু জানে না, সবাই জানে, আমিও জানি, অন্তত কথা বোঝার মতো জানি। শওকত নিশ্চয়ই জানে, কিন্তু সে বলল, আমি উর্দু বুঝি না। বল ইংরেজিতে। কী সাহস! মিলিটারি অফিসারটি প্রথম কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না, তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, এবারেও উর্দুতে। শওকত আবার বলল, আমি উর্দু জানি না। তখন পাশে দাঁড়ানো লোকটি এসে ওকে মারল, প্রচণ্ড জোরে, এত জোরে যে শওকত ঘুরে পড়ে গেল নিচে।
ভদ্রমহিলা মখমলের সোফা তার নখ দিয়ে আকড়ে ধরলেন, মুখ রক্তশূন্য, রুখসানা মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, তার অপূর্ব সুন্দর মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন। মিথ্যা বলতে হয় সত্যির খুব কাছাকাছি করে, না হয় সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কতবার কত জায়গায় মিথ্যা বলেছি আমি, আমার মতো মিথ্যা কে বলতে পারে? আমি আবার শুরু করলাম, শওকত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, দেখলাম তার ঠোঁট কেটে গেছে। হাত দিয়ে ঠোঁট মুছে সে উঠে দাঁড়াল, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে, অফিসারটির দিকে তাকিয়ে যেটা বলল আমি নিজের কানে না শুনলে সেটা কখনো বিশ্বাস করতাম না। সে বলল, যে হাত দিয়ে তোমরা আমাকে মারছ, আমি বলে রাখলাম শুনে রাখ, একদিন সেই হাত জোড় করে তোমরা আমাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা করবে।
ভদ্রমহিলা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, তাই বলল? তাই বলল শওকত?
হ্যাঁ, আমরা ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম তার সাহস দেখে। পাশে দাঁড়ানো মিলিটারিটা বুকের কাপড় ধরে টেনে আনল তার কাছে, তারপর হাত তুলল মারার জন্যে, ঠিক যখন মারবে অফিসারটি তাকে থামাল। থামিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ছেলে, তোমার ভয় করে না?
শওকত বলল, করে।
অফিসারটি বলল, তোমাকে দেখে তো মনে হয় না, তুমি ভয় পেয়েছ।
শওকত তখন একটু হাসল, কী আশ্চর্য ব্যাপার, এরকম অবস্থায় কোনদিন কোন মানুষ হাসতে পারে? হেসে বলল, পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই যে মৃত্যুকে ভয় পায় না। তুমি যদি মানুষ হতে তাহলে তুমিও বুঝতে আমি কত ভয় পেয়েছি। কিন্তু তোমরা তো মানুষ নও, তোমরা পশু তাই তোমরা বুঝতে পার না। তোমার সামনে আমি আমার ভয় দেখাব না। কিছুতেই না।
আমরা ভেবেছিলাম শওকতের কথা শুনে অফিসারটি রেগে ফেটে পড়বে, কিন্তু সে রাগল না। ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল।
তারপর? তারপর কী হলো?
আমি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল শওকতের চেহারা, প্রচণ্ড মার খেয়ে সারা মুখ রক্তে প্রায় মাখামাখি, বাম চোখটা ফুলে প্রায় বুজে আছে, আঙুল সব কয়টি থেঁতলে দিয়েছে, তাকানো যায় না সেদিকে। তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা কোথায় বলতে পারছে না দেখে এবারে এক বালতি পানি নিয়ে এসেছে একজন। অফিসারটি ইঙ্গিত দিতেই একজন তার মাথার পিছনে চুলের ঝুটি ধরে তার মাথা বালতির পানিতে ডুবিয়ে ধরল, ছটফট করছে শওকত, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না আর জোর করে ধরে রেখেছে দুজন।
অফিসারটি সময় নিয়ে আস্তে আস্তে একটা সিগারেট ধরাল, তারপর সেটাতে একটা লম্বা টান দিল। কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে শওকত। আমি আর দেখতে পারছি না। চোখ বন্ধ করে বলছি, খোদা একটু দয়া কর, একটু দয়া কর, মেরে ফেল ছেলেটিকে, মেরে ফেল আর কষ্ট দিও না। ঠিক তখন অফিসারটি ইঙ্গিত করল তাকে তুলে ধরতে। মাথা টেনে তুলল পানি থেকে, খোদা আমার কথা শুনেনি, এখনো বেঁচে আছে শওকত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল বুভুক্ষের মতো; একবার, দুইবার, তৃতীয়বার নেবার আগেই আবার তার মাতা চেপে ধরল পানিতে! হায় খোদা আবার কেন আমার মনে করিয়ে দিলে সেই সব? কতবার তাকে এভাবে পানিতে চেপে ধরে রেখেছিল? কতবার? মানুষ হয়ে কেমন করে মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারে? কেমন করে?
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, কাঁপা গলায় বললেন, বল তারপর।
আমি জোর করে সরিয়ে দিলাম দৃশ্যটি। চোখের সামনে এসে দাঁড়াল শওকত, কী দৃপ্ত চেহারা তার! সামনে অফিসারটিকে লাগছে একজন ভেঙে পড়া অপরাধী মানুষের মতো। আবার বলতে শুরু করলাম আমি, অফিসারটি তখন শওকতকে বলল, আমি তোমার সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি ছেলে। আমার নিজের উপর থাকলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিতাম। এই পৃথিবী সাহসী মানুষের জন্য, কাপুরুষের জন্যে নয়। কিন্তু আমার উপর আদেশ আছে তোমাকে মেরে ফেলার। তার আগে যেভাবে সম্ভব তোমার মুখ থেকে কয়টা কথা বের করতে হবে। যেভাবে সম্ভব। তোমরা যুদ্ধবন্দি নও, জেনেভা কনভেনশন তোমাদের বেলায় খাটে না। যেভাবে খুশি আমরা তোমাদের উপর অত্যাচার করতে পারি, কিন্তু আমি তোমার উপরে কোন অত্যাচার করব না, তোমাকে আমি সম্মান নিয়ে মরতে দেব। তুমি কী প্রস্তুত আছ মরার জন্যে?
ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল শওকতের মুখ, মৃত্যুর মুখোমুখি কি কোন মানুষ এত সহজে দাঁড়াতে পারে? আমি দেখলাম খুব চেষ্টা করে ধীরে ধীরে সে নিজেকে শান্ত করল, তারপর বলল, আমি প্রস্তুত। তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, তাকিয়ে বলল, আমার নাম শওকত হাসান, যদি আপনাদের কেউ বেঁচে থাকেন খোঁজ করে আমার মায়ের সাথে দেখা করবেন। প্লিজ, দেখা করে বলবেন—
আমি থেমে গেলাম। কোন কথা না বলে মা আর মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে দুজনের। সুন্দর একটা কথা বলতে হবে এখন। কী বলা যায়? এক মুহূর্তে ভেবে বললাম, খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিল ইংরেজিতে, কথাটা বাংলায় অনেকটা এরকম, জীবনকে তার দৈর্ঘ্য দিয়ে বিচার করো না, বিচার করো সেটা কত তীব্র ছিল সেটা দিয়ে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে সত্যিই বুঝি দৈর্ঘ্য নয় তীব্রতাই হচ্ছে জীবনের সবকিছু। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা নয়, প্রচণ্ড উত্তাপে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে জীবন, শত্রুর মার খাওয়া নয়, অস্ত্র হাতে তার হৃৎপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হচ্ছে জীবন। মনে হতে থাকে পিশাচের দল যে শওকতকে টেনে-হিঁচড়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়েছিল সে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত পঙ্গু নয়, সে ছিল জীবনের ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। মনে হতে থাকে আমি যা বলেছি সব সত্যি, শওকত নামের উনিশ বছরের একটা ছেলে সত্যি সত্যি মৃত্যুর মুখোমুখি এসেও প্রচণ্ড অহংকারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, কী অসহ্য দীপ্তি ছিল তার চোখে, কী ভয়ংকর পৌরুষত্ব তার মুখে, কী আশ্চর্য সৌন্দর্য তার চেহারায়—আমার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল, ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করলাম আটকাতে, পারলাম না। একুশ বৎসরের ধাড়ি একটা মানুষের চোখ দিয়ে পানি বের হওয়ার থেকে অশালীন আর কিছু হতে পারে না। জেনেও আমি কিছু করতে পারলাম না, বসে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম ওদের সামনে।
এত দুর্বল আমি কেমন করে হলাম? মা, তুমি কেমন করে আমার মতো এমন একটা দুর্বল ছেলের জন্ম দিলে?
কেমন করে দিলে?