Ticker

6/recent/ticker-posts

সমর সেনঃ কবির জীবন ও কবিতায় জীবন - বৃন্দাবন কর্মকার

সমর সেনঃ কবির জীবন ও কবিতায় জীবন - বৃন্দাবন কর্মকার
সমর সেনঃ কবির জীবন ও কবিতায় জীবন - বৃন্দাবন কর্মকার

“জানি, এরা নয় বৈশ্য সভ্যতার জারজ সস্তান
গলিত ধনতন্ত্রের চতুর বিভীষণ,
তাই সক্রিয় আশা মৃত্যুহীন জাগে অনেকের মনে;
অপরের শস্যালোভী পরজীবী পঙ্গপাল
পিষ্ট হবে হাতুড়িতে, ছিন্ন হবে কাস্তেতে।”

বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরেই কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন সমর সেন। আমার যৌবনে বুদ্ধদেব জানিয়েছেন, ‘এক গ্রীষ্মের সকালে আমার ঘরে একটি ক্ষীণাঙ্গ ছেলে-প্রায় বালক, সবে পা দিয়েছে যৌবনে – গায়ের রং হলদে-ঘেঁষা ফর্সা, ঠোঁটে গোঁফের ছায়া, চোখে চশমা, গালে একটি ব্রণের ওপর এক ফোঁটা চুন লাগানো। কিছুমাত্র ভূমিকা না করে বলল, আমি আপনার ‘শাপভ্রষ্ট’ কবিতার একটি ইংরেজি করেছি। – আপনি দেখবেন?’ এভাবেই দুজনের মধ্যে পরিচয়ের সূত্রপাত, যা পরবর্তীকালে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। অন্যদিকে সমর সেনও এই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন – ‘১৯৩৪-এ গ্রীষ্মকালে দারুণ মর্মবেদনা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য একবার সাহস করে গেলাম বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে, ভবানীপুরে। ‘বন্দীর বন্দনা’র কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কবিতা লিখি কিনা। কয়েকটা লেখা দিনকয়েক পরে দেখাতে, বললেন নিয়মিত ছন্দের চেষ্টা ছেড়ে গদ্যছন্দে যেতে।’ পরবর্তীকালে সমকালীন অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে-কে লিখে জানিয়েছিলেন ‘গদ্য কবিতা কেন, কোনো কবিতা সম্পর্কেই এখন আর উৎসাহ নেই।’
ইংরেজী সাহিত্যের দুর্ধর্ষ ছাত্র সমর সেন তার কাব্যজীবনের শুরুতেই পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা আর বুদ্ধদেব বসুর নির্ভরযোগ্য প্রশ্রয়। রবীন্দ্রনাথ সমর সেনের কবিতায় দেখেছেন-‘গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ।’
আধুনিক বাংলা কবিতার কোনো কোনো গবেষক-সমালোচক তাদের কাব্যালোচনার পরিধিতে কবি সমর সেনকে উপেক্ষা করলেও যুদ্ধোত্তর বাংলা কাব্যসংসারে কবি সমর সেনের প্রতিভাকে অস্বীকার করার উপায় ও অবসর নেই। কারণ তার মননঋদ্ধ কবিতাগুলিতে সেই সময়কার যুগযন্ত্রণা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতেই তিনি কবি হিসাবে অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া, আধুনিকতার যুগলক্ষণগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি, যেমন নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার অভিঘাত, জীবনে ক্লাস্তি ও নৈরাশ্যবোধ, অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্ব, আত্মবিরোধ ও শিকড়হীনতার যন্ত্রণা, শরীরী সন্তাপের দ্বিধাহীন প্রকাশ, ছন্দে গদ্যরীতির ব্যবহার, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক মনোভঙ্গি প্রভৃতি একদিকে যেমন কবি সমর সেনের কবিতার অঙ্গরাগ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি অন্যদিকে প্রাণরস সিঞ্চন করেছিল-তার নগরজীবনের প্লানিময় অভিজ্ঞতা, যুগোচিত একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা, বিষাদ-বিষন্নতা, শ্রেণীবৈষম্য, যুদ্ধোত্তর সমাজ-পরিবেশে হা-অন্নের ছবি; সর্বোপরি তার সুগভীর সমাজচেতনা ও তীব্র মানবতাবোধ। তাই কবি সমর সেনকে উপেক্ষা করে সমকালীন কাব্যালোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
১৯৩৫/৩৬ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ধারাবাহিক কাব্যচর্চায় ছেদ টেনে তিনি কাব্যজগৎ থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছিলেন এবং সংবাদপত্রের জগতে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। এর বছর দশেক বাদে আরো কয়েকটি কবিতা লিখলেও সেই ধারাবাহিকতা আর ছিল না। তার কবিতার বইয়ের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তার ক্ষীণকায় কবিতার বইগুলির নাম—‘কয়েকটি কবিতা’, ‘গ্রহণ’, ‘নানাকথা’, ‘খোলাচিঠি’ ও ‘তিনপুরুষ’। তবু আধুনিক বাংলা কবিতায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
বহুল তথ্য, উদাহরণ ও পাদটীকা সহযোগে সাতটি অধ্যায়ে সমর সেনের জীবনকথা ও কাব্য ভাবনার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন বৃন্দাবন কর্মকার। সমর সেনকে বুঝতে বইটি অবশ্য পাঠ্য।

"সমর সেনঃ কবির জীবন ও কবিতায় জীবন - বৃন্দাবন কর্মকার"