Ticker

6/recent/ticker-posts

আমার ভারত: সারল্য ও মনীষার যুগলমূর্তি মার্টিন কেম্পশেন

আমার ভারত
সারল্য ও মনীষার যুগলমূর্তি
মার্টিন কেম্পশেন

ভারত যখন লােকসভা নির্বাচনের চরম তড়কা-বিকারের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তখন ভারত চেতনা নিয়ে একটা সংখ্যা তৈরির ভাবনা যথেষ্ট সময়ােপযােগী বলতে হবে।

আমাদের মনে এখন একটা শুদ্ধ সমীহের ভাব। যে-আমলাতন্ত্রের ঢিলেমি আর নড়বড়ে অবস্থার কথা শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা, তা এখন হিম্মত ধরেছে নব্বই কোটি মানুষকে ভােটকেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য। এখানে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা ঘটে না। এখানে ছাড়া আর কোথাও এ কাজ কোনও অংশে সফল হওয়ার নয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মনে হচ্ছে, আসলে নির্বাচন কমিশন বুঝি দেশটাকে চালাচ্ছে। চালাচ্ছে পরিকল্পিত ভাবনা আর অবিচল দৃঢ়তায়। এ যদি ভারতের সেরা উৎকর্ষ না হয়, তা হলে আর উৎকর্ষ কাকে বলে আর কোথায়ই-বা তার দর্শন মিলবে?

আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সবসময় ভারতের মানুষজন সবচেয়ে ভাল কাজ করে। কতবার দেখেছি, একটা পরিবার, একটা গােটা গ্রাম কিংবা শহরের কোনও পাড়া কীভাবে জেগে উঠেছে তাদের মধ্যে কারও প্রাণ বাঁচানাের জন্য। জেগে উঠেছে কোনও ছাত্রের গুরুভার কোনও প্রয়ােজনে সাহায্য জোগাতে বা কোনও বৃদ্ধ দুর্বল দম্পতিকে সাহায্য করতে। স্বগােষ্ঠী বা স্বদলের একজনের কোনও দায়মােচন করতে একদল মানুষ যে কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করতে পারে, তা দেখলে অনুপ্রাণিত হতে হয়। দেখে অনুপ্রেরণা জাগে, কারও মৃত্যুতে আশপাশের মানুষজন এসে যেভাবে সেই পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে জড়াে হয়। শুধু সেই এসে দাঁড়ানােটাই তাে শুশ্রুষার শামিল। এরকম পরিস্থিতিতে ঐক্যবােধ আর সংহতি-শক্তির বিস্ময়কর অভিব্যক্তি লক্ষ করেছি আমি।

উলটোদিকে আমাদের আটপৌরে প্রাত্যহিক জীবনের গল্পটা কিন্তু অন্যরকম। প্রকাশ্য জায়গায় যে-ধরনের রূঢ় আর কর্কশ গলাবাজি চলে, তা দেখে তাে আমার গায়ে সবসময় কাঁটা দেয়। যেমন কলকাতার রাস্তায়, দোকানে বা অফিসে। যেমন ট্যাক্সিচালক, রিকশাচালক, অটোচালক কিংবা বাসের কন্ডাক্টরদের সঙ্গে ব্যবহারে। আত্মপক্ষ সমর্থনে বন্ধুবান্ধবদের বলতে শুনি, ‘আমরা লােকের সঙ্গে এভাবেই কথাবার্তা বলি’। আমার কিন্তু মনে হয় তারা অকারণে অকথ্যকথন করে।

সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ব্যাপারটা কি এরকম যে, নিজেদের আচরণ নিয়ে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির অত আতুপুতুর দরকার হয় না উটকো মানুষজনের সঙ্গে ব্যবহারে, যাঁদের তাঁরা ধরেই নিয়েছেন নিম্নবর্গীয় হিসেবে? তাঁরা কি ভাবেন যে, এমন রুক্ষভাবে গলা চড়িয়ে না বললে তাঁরা যা চান তা হবে না? কোনও অচেনা মানুষের মুখােমুখি হলে কেন আমাদের সন্দেহ হবে, সে একটি পাক্কা চোর, আমাদের ঠকানাের ধান্দা করছে? অসততা কি এতটাই ছড়িয়েছে যে, অন্যের সঙ্গে স্বাভাবিক মার্জিত কথাবার্তায় নিজেদের নিরাপদ বােধ করি না আমরা?

জনাধিক্যের চাপ একটা কারণ, এটা সত্যি। আমাদের আচার-আচরণ নির্ভর করে এর ওপর। গুঁতােগুতি করে, এবং তা প্রায় নিষ্ঠুরভাবে, আমরা ট্রেনে উঠি। যদিও জানি যে, প্রত্যেকের বসার জায়গা মিলবে। দোকানে গিয়ে কিছু না ভেবে নিজের চাহিদার জিনিসটা আগে চাই, যারা আগে এসেছে তাদের টপকে। লাইন টপকানাের এই তাগিদ যেন দুর্নিবার। কেন এমন হয়? নিজেকে প্রশ্ন করেছি। সময়ের চাপে আমরা কি এতটাই থেঁতলে আছি যে, অন্যের ব্যাপারে নিজেদের বিবেচনাবােধ জলাঞ্জলি দিতে হয়?

আমাদের ব্যবহারের ধরন আর কাজের এই তীব্র বৈপরীত্য আমার বিরক্তি উত্তরােত্তর বাড়িয়ে তােলে। এটা বাড়ে ঘটনাটা কেমন জায়গায় ঘটছে তার উপর নির্ভর করে, এবং তা ব্যক্তিগত পরিসরে নাকি কোনও প্রকাশ্য স্থানে। অন্যদিকে, নির্বাচনের সময় উঠে আসে একটা নিখুঁত চিত্র। গােটা পৃথিবীর কাছে আদর্শ হিসেবে দেশের তুলে ধরা উচিত, ভারতে গণতন্ত্র কেমন সুষ্ঠুভাবে চলছে। ফলে, শুরুতে যা বলেছি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কার্যকর করায় ভারতের সাধ আর সামর্থ্যের বস্তুত এক বিস্ময়কর ছবি উপহার দেয় এই নির্বাচন।

এর বিপরীতে আমরা লক্ষ করি রাজনৈতিক নেতাদের পরস্পর-বিরােধী পক্ষের দিকে কাদা ছােড়াছুড়ি। পরস্পরের প্রতি কুবাক্য প্রয়ােগ। সাধারণ সামাজিক আবহ বিষিয়ে ওঠে তাতে। সে এক নারকীয় দৃশ্য। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, নির্বাচনের পর যখন নতুন সরকার গঠিত হবে, এই সব নেতা বিরােধীদের সঙ্গে ফলপ্রসূ উপায়ে কাজ করবেন কীভাবে? সংসদে উপস্থিত সমস্ত দল একযােগে কাজ করবে, সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবি তাে এটাই। পরস্পরের প্রতি প্রাথমিক শ্রদ্ধাবােধ ছাড়া তা কী করে সম্ভব?

আমাদের ভুললে চলবে না, নির্বাচন হচ্ছে সেই সময়, যখন গােটা পৃথিবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভারতের দিকে। এর কোনও যুক্তি নেই, তবুও বছরের অধিকাংশ সময় বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রগতির প্রসঙ্গে সেভাবে আলােচিত হয় না। বহু বৈচিত্রে ভরপুর এই ভারতভূমি, বড়ই জটিল। সবদিক দিয়ে তা এতটা বিশাল যে, তার ধারণা করা সহজ নয়। বহির্বিশ্বের জনমানসে কিন্তু তার সম্পর্কে টিকে আছে কিছু বস্তাপচা ক্লিশে ধারণা। যেমন যােগ আর হিমালয়। যেমন রাজারাজড়া আর মহাত্মা গাঁধী। বর্তমানে ভারত যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেটা সম্পর্কে কোনও রুচিশীল ধারণা তৈরি করতে গেলে এসব আর যথেষ্ট নয়। তাই জার্মানি-সহ অধিকাংশ বাইরের দেশ ভারতের সঙ্গে তাদের আলাপ আলােচনা সীমাবদ্ধ রাখে অর্থনৈতিক আর বাণিজ্যিক বিষয়ে।

কিন্তু এখন, এই নির্বাচনের সময়, সবার নজর ঘােরে ভারতের দিকে। সম্ভবত বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্র ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'। তাতে গত এপ্রিল ও এই মে মাসে ভারত এবং তার নির্বাচন নিয়ে আমি একটার পর একটা লেখা পড়ে চলেছি। সুইটজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত জার্মান ভাষার সেরা দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে জয়ুর্চের জাইটুং' (Neue Zurcher Zeitung')। সেখানে লাইন দিয়ে বেরােচ্ছে ভারত সম্পর্কিত বিভিন্ন নিবন্ধ। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলােতেও এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি পত্রপত্রিকায় ভারতের কী ধরনের ভাবমূর্তির প্রকাশ দেখতে চাই আমরা? ক্রুদ্ধভাবে গলাফাটানাে এইসব রাজনৈতিক নেতার ছবি বিশ্ববাসীর মনে পাকাপােক্ত হয়ে থাক, তাই কি চাই আমরা?

ভারতের মানুষ তুলােধনা করে তাদের দেশের দারিদ্র নিয়ে আহা-উহু করার পশ্চিমি প্রবণতাকে। সে হক তাদের একশাে ভাগ আছে। দারিদ্র আর রােজগার যে একটা গুরুতর সমস্যা, তা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু দৈনন্দিন দারিদ্রই একমাত্র সত্য নয়। বহু কিছুর সমন্বয়ে গড়া বহুস্তরীয় এক জটিল মূর্তিই ভারতের বাস্তব অবস্থার সঠিক প্রতিচ্ছবি। আর অপুষ্টি আক্রান্ত শিশুদের ছবির বদলে আমরা কি চাই যে, গলাফাটানাে, মুষ্টি আস্ফালনকারী এই সব নেতা আর ভাষ্যকারের ছবি বহির্ভারতের মানুষের মন জুড়ে থাকুক?

১৯৭৩ সালে যখন আমি ভারতে এলাম, তখন বিশেষভাবে আমার মন কেড়েছিল এ দেশের তরুণদের সরলতা। নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে তিনবছর ছিলাম। সেই সময় দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটা গ্রাম দেখেছি। পরে চেন্নাইয়ে (তখন মাদ্রাজ) গেলাম, তখন দক্ষিণ ভারতে বিস্তর ঘােরাঘুরি করেছি। সেই দিনগুলােয় অনেক ছাত্র আর চাকরিজীবী যুবকের মুখােমুখি হয়েছি। তাদের দিলখােলা ভাব, তাদের আগ্রহ আর বিনম্র ও সংবেদী ব্যবহারে আমি অন্য এক মানবলােকে পৌঁছে গেছি। সে যখন যেমন বাস্তব, তেমনই অকপট আর মানবিক।

পরে যখন শান্তিনিকেতনে আস্তানা নিলাম, তখন বিভিন্ন সাঁওতাল গ্রামের তরুণদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। তাদের সারল্য আর স্পষ্টবাদী, মনখােলা ও বিশ্বস্ত ব্যবহার আবারও বিমুগ্ধ করল আমাকে। মনে যা আছে তা তারা খােলাখুলি বলে। তাতে তাদের লাভ না ক্ষতি হবে, তার অঙ্ক কষে না। এ ধরনের কথাবার্তায় মনে বাতাস লাগে। শিক্ষিত সাঁওতালদের সঙ্গে কাজ শুরু করে বিস্মিত হয়ে দেখলাম, স্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতালদের সহিষ্ণুতার অনুশীলন কতখানি উঁচু মাত্রার।

‘ভারতবর্ষ বেঁচে আছে তার গ্রামগুলােতে’— মহাত্মা গাঁধীর এই উক্তি সুবিদিত। শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতাল গ্রামবাসীদের সঙ্গে যখন আমি কাজে জড়িয়ে গেলাম, উপলব্ধি করতে শুরু করলাম ভারতবর্ষের অন্তরে প্রবেশ করেছি। আরও বাড়িয়ে বললে বিশ্বের অন্তরে। এই গ্রামগুলােতে যা সমস্যা আর সামাজিক ও মানসিক জটিলতা হিসেবে প্রকাশ পেতে দেখলাম, বুঝতে পারলাম বিশ্ব জনগােষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তা মার্কামারা আর প্রাসঙ্গিক। ঐতিহ্য আর আধুনিক মূলস্রোতের মধ্যে টানাপােড়েন, টানাপােড়েন প্রথাগত জ্ঞান আর অধীত জ্ঞানের মধ্যে, টানাপােড়েন। ঘন-বদ্ধ পারিবারিক ও সামাজিক জীবন আর স্বাধীন মূল্যবােধকামী জীবনের মধ্যে ভারতের পল্লিজনের সঙ্গে দৈনন্দিন আলাপচারিতায় এই সব কিছুর প্রতিফলন লক্ষ করলাম আমার চারপাশে।

শান্তিনিকেতনে যখন থাকতে শুরু করলাম, তখন পরিচয় পেলাম বহু সূক্ষ্ম মননশীল মানুষের। ভারত যে কী ভূমিকা নিতে পারে, কোন ভূমিকা তার নেওয়া উচিত, এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে তাঁদের। ভারতের জনগণের নিহিত শক্তির কথা তাঁরা জানেন। তাদের সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশােনা করেন। তাঁরা সমানভাবে পরিচিত ইউরােপ আমেরিকার বিদগ্ধ জীবনধারার সঙ্গে। এঁদের অনেকে কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই আর মুম্বইয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের সদাজাগ্রত মনীষার বিস্তার এতখানি, জার্মানিতে যা আমি খুব কম দেখেছি। জার্মানির শ্রেষ্ঠ, বিদ্বান মানুষটিরও পর্যন্ত দক্ষতা সীমাবদ্ধ থাকে পাশ্চাত্য বিদ্যার পরিসরে। বুঝতে পারছি, এই শক্তিমান ভারতীয় মনস্বীগণকে বিশ্ব-জনমতে নেতৃত্ব দিতে হবে। দিতে হবে তাঁদের মননবােধের ব্যাপ্ত বিশালতার জন্য।

আমার দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ মানে তাই গ্রাম-ভারতের নিখাদ সারল্য আর বিদগ্ধজনের সূক্ষ্মতম মননে অর্জিত বিশ্বজনীন সজ্ঞা। এই দু’য়ের সমন্বয় ভবিষ্যৎ ভারতের পথনির্দেশ করবে।

অনুবাদ: জয়কৃষ্ণ কয়াল
দেশ পত্রিকা ১৭ই মে ২০১৯

বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!