Ticker

6/recent/ticker-posts

আমার নগ্নিকারা - মুর্তজা বশীর

amarboi

আমার নগ্নিকারা
মুর্তজা বশীর

চিত্রশিল্পী হব, এ রকম কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। ছোটবেলা থেকে ভেবেছি, লেখক হব। নাইন-টেনে পড়ি যখন, বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছিলাম। বাড়িতে চুরি হলে, সেগুলো চুরি হয়ে গেল। পরিতোষ সেনের অসংখ্য চিঠি’, ‘বরকতের রক্তভেজা রুমাল, ‘জেলের খাতা’ সবকিছু রেখেছিলাম একটা বাক্সে। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বানে ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ ও মাদ্রাজের তেলেঙ্গানায় ৭ জুন মুক্ত এলাকা পালনের প্রচারকালে গ্রেপ্তার হই। জেলে থাকার সময় খাতায় এঁকেছিলাম নানা ড্রয়িং ও লিখেছিলাম কবিতা। কিছু প্রতিকৃতিও ছিল—কৃষকনেতা বারী মিয়া, খেতমজুর নেতা মনু মিয়া, আবদুল্লাহ আল-মুতী ও আলী আকসাদের।

চিত্রকলায় মানুষের শরীর একটি বড় বিষয়। নারী না পুরুষ, সেটা বিবেচ্য নয়। পুরুষ শিল্পীদের কাছে নারীর শরীর বেশি গুরুত্ব পাবে, এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। শিল্পকলায় পুরুষ শিল্পীদের প্রাধান্য রয়েছে, তাই নারীদের ন্যুডই আমরা বেশি দেখি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যেমন মাইকেলেঞ্জেলোর কথা ধরুন। তিনি নগ্ন নারীদের চেয়ে নগ্ন পুরুষদের নিয়েই বেশি কাজ করেছেন।

এখন এই যে ন্যুড পেইন্টিং, আমাদের দেশে বর্তমানে যা রয়েছে, সেটা একসময় ছিল না। আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন দেশে ন্যুড মডেলের প্রচলন ছিল না। নগ্নিকা নারী প্রথম দিনদুপুরের আলোতে দেখলাম ইতালিতে, ১৯৫৬ সালে। আমার বাবা ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের জুলাই পর্যন্ত নিজের অর্থ ব্যয় করে আমাকে পড়িয়েছেন। বাবার টাকা শেষ হয়ে এলে আমি লন্ডনে চলে গেলাম। আমার ইচ্ছে ছিল আমি লন্ডনেই থেকে যাব। দেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না।

ইতালির ফ্লোরেন্সে একাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রথম যখন মডেল এল, তখন সে কাপড়চোপড় পরা। তখনো বুঝিনি, সে নগ্ন হয়ে পোজ দিয়ে বসবে। ছেলেমেয়েরা ইজেল নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা আস্তে আস্তে কাপড় খুলতে লাগল। আমি খুব বিব্রত হয়েছিলাম। চোখের সামনে একটা সাদা মেয়ে। আমরা তো কালো। সবারই সাদার প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। নিজের ছেলে কালো, সেটা কোনো কথা নয়, কিন্তু বাপ-মা চায় বউ যেন ফরসা হয়। আমি আমার এক বন্ধুর কথা বলব, তার নাম বলব না, সে খুব বিখ্যাত মানুষ। সে আমাকে বলত, বশীর, আমার জন্য মেয়ে দেখ। আমি মেয়েদের ছবি দেখাতাম। ওর পছন্দ হতো না। আমি একদিন খুব রেগে গেলাম, বললাম, তুমি নিজের চেহারা দেখেছ আয়নায়?' আমরা দেখতে যেমনই হই না কেন, আমাদের দরকার হলো ধবধবে ফরসা মেয়ে।

যাহোক, ইতালির ফ্লোরেন্সের একাডেমি অব ফাইন আর্টসে পড়ছি। শিখছি। ন্যুড মডেলকে প্রথম দেখে আমি খুবই বিব্রত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। এর আগে জলজ্যান্ত নগ্নিকা নারী দেখিনি। তবে হ্যাঁ, চিত্রশিল্পের অ্যালবামে দেখেছি। আমার যখন বয়স ১৪-১৫ তখন। আমার পিতা ১৯২৮ সালে সরবােন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট শেষ করার পর প্যারিসে ভারতীয় ছাত্রসংগঠন তাঁকে বিদায় উপলক্ষে লুভ মিউজিয়ামের দুই খণ্ড চিত্রাবলির অ্যালবাম উপহার দিয়েছিল। তিনি তার লাইব্রেরিতে মেহগনি কাঠের একটা ছোট আলমারিতে বহু মূল্যবান বইসহ এই অ্যালবাম দুটি তালা দিয়ে রাখতেন। কখনো ভুলে খােলা রাখলে আমি অ্যালবাম দুটি দেখতাম, যা ছিল আমার কাছে নিষিদ্ধ ফলের মতো। বইয়ে ইনগ্রেম দাভিদ, রেমব্রান্ট, রুবেন্স, ফ্রাঁসােয়া বুশের প্রমুখের বস্ত্রহীন চিত্রকর্মের প্রতি কৈশোরের স্বাভাবিক একটা কৌতুহল ছিল। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টে ভর্তির জন্য বাবা আমাকে টাকা তো দিলেনই সঙ্গে দিলেন অ্যালবাম দুটিও। আমি তখন ১৭ বছর বয়সে পা দিয়েছি। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এই ছবিগুলোর বিবস্ত্র রমণীরা অন্য ছেলেদের কাছে হবে ন্যাকেড, আমার কাছে ন্যুড।


আমরা যখন প্রথম দিন বস্ত্রহীন রমণীর ছবি আঁকছিলাম, তখন আমি ছাড়া অন্য শিক্ষার্থীদের কিন্তু কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। তাদের কেউ সিগারেট খাচ্ছে, কাজ করছে। আমি কিন্তু বেরিয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরে এলাম। তখনো গা শিরশির করছে। ভাবলাম, এভাবে যদি আমি তার স্তন, জঙ্ঘা, যোনি দেখি, তাহলে তো আমি উত্তেজিত হয়ে যাব। পরে কিন্তু বুঝতে পারলাম, গা সওয়া হয়ে গেলে তখন স্তনকে মনে হতো আপেল দেখছি। যখন আঁকতে হয়, তখন ভালো করে দেখতে হয়। পোট্রেট করার সময় তো বারবার চেহারাটা দেখতে হয়। কয়েক দিন পরই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। স্তনে রং লাগাচ্ছি, আমার কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। যোনিদ্বারে যখন কাজ করছি, তখন মনেই হয়নি এটা স্ত্রী-অঙ্গ। মডেল আবার কাজের ফাঁকে অবসরে এসে আমাদের কাজ দেখত। কাজের ক্ষেত্রে এটা আসলে কোনো ব্যাপারই নয়। ও দেশে মডেলদের সম্মান দেওয়া হয়।

আমার কিছু ড্রয়িং আছে, যেগুলো খুব কম দেখেছে মানুষ। ন্যুড ড্রয়িং করার সময় আমার মনে ইউরোপ বা আমাদের দেশের কোনো শিল্পীকে অনুসরণ করিনি। সামনে মডেল ছিল, তাঁকেই একেছি। আমার পদ্ধতি ছিল, প্রথমবার মডেলকে দেখে দেখে পেনসিল দিয়ে ঘষে ঘষে আঁকা। ভুল হলে রাবার দিয়ে ঘষে আবার নতুন করে আঁকা। এভাবেই একটা ড্রয়িং শেষ করা। দ্বিতীয়বার মডেল সামনে থাকে, কিন্তু একটু তাড়াতাড়িই আঁকা হয়ে যায়। কারণ, আমার তো ততক্ষণে সে মুখস্থ হয়ে গেছে। তৃতীয়বার আঁকার সময় আর মডেলের দিকে তাকাই না। মানে ঝাপসা ঝাপসা দেখি, তখন ড্রয়িংয়ের মানের ওপর জোর দেওয়ার জন্য আমি একাগ্র থাকি। এটা হলো আমার নুড ড্রয়িং করার পদ্ধতি।

আমি নারী মডেলদের নিয়েই মূলত কাজ করেছি, ছেলে মডেল ইতালিতে কম। আমি বুঝি ফ্লোরেন্সে একজনকেই পেয়েছিলাম।

এগুলো করার সময় ভারতবর্ষীয় বা ইউরোপের কোনো শিল্পীর আঁকা আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেনি। রুবেন্স বা মোদিলিয়ানির কথাও মনে হয়নি। আমি এঁকেছি নিজের মতো করে। আমি কিন্তু জীবনে কখনো পিকাসাের ড্রয়িং কপি করিনি। কিন্তু ফ্লোরেন্সের একাডেমিতে আমার শিক্ষক বলতেন, আমি নাকি পিকাসােকে কপি করছি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমি কপি করিনি, আমাদের উৎস এক। ইট্রুসকান তামার আয়নাতে ড্রয়িং দেখে কপি করেছি। পিকাসাের ড্রয়িংও গ্রিক ভাস ও এমফোরা আঁকা ছবিগুলো থেকে অনুপ্রাণিত।

কেন নগ্নিকা আঁকতে হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। এ ব্যাপারে একটা গল্প বলি। একবার বিচিত্রায় কামরুল হাসানের ওপর একটা লেখা বেরিয়েছিল, সেখানে কামরুল হাসান রমণীদের প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। পাহাড়-পর্বতউপত্যকা ইত্যাদির সঙ্গে নারীদেহের সাদৃশ্যের কথা বলেছিলেন। শাহাদত (শাহাদত চৌধুরী, বিচিত্রা সম্পাদক) আমাকে বলল, আপনি রমণীর ওপর লেখেন। আমি লিখলাম। ওরা ছাপল বাংলাদেশের রমণী। আমি বলেছিলাম পুরুষেরা মেয়েদের ছবি বা নগ্নিকা নারী কেন আঁকে। আমি বলেছিলাম, এটা জৈবিক কারণ আছে। পুরুষের চোখে নিজের প্যান্টশার্ট হ্যাঙ্গারে ঝােলানো দেখতে ভালো লাগে না। সেখানে কুঁচানো শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ দেখতে ভালো লাগে।

পুরুষ যে সুন্দর নয়, তা না। ডেভিড অনেক সুন্দর। অ্যাপোলো অনেক সুন্দর। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পী নগ্নিকা নারী একেঁছে আমার মতে একটা জৈবিক চাহিদা থেকে। কারণ, সৌন্দর্য তো পুরুষেরও কম নয়। আমার মনে হয়, অবচেতন মনে এটা একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে এ রকম। আমি ভুলও হতে পারি।

আমাদের দেশে তখনো তো ন্যুড হয়নি। ন্যুড এখন ইনস্টিটিউটে মুক্তভাবে করে কি না, আমি জানি না। তবে প্রাইভেটলি হয়, ফিমেল মডেল হয়।

কোনো মডেল দেখে আমার কাম আসেনি। তবে বিব্রত হয়েছি। লজ্জা পেয়েছি। প্রথমে শারীরিক উত্তেজনা হয়েছে, পরে সেটা আর ছিল না।

প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা ২০১৯
দোকানে পাওয়া যাচ্ছে আজই সংগ্রহ করুন।

বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!