Ticker

6/recent/ticker-posts

প্রাচীন সূর্য্যের গান - দীনেশচন্দ্র সেন

amarboi

প্রাচীন সূর্য্যের গান

সূৰ্য্যপূজা বহু প্রাচীন। ব্যবিলনের প্রসিদ্ধ ইতিহাস-লেখক বেরোসাস অনুমান করেন, অগ্নি-উপাসকগণের নেতা জরথুস্ত্র খৃষ্ট জন্মিবার ২২০০ বৎসর পূৰ্ব্বে আবির্ভূত হন (১)। ভবিষ্যপুরাণে উল্লিখিত আছে, জরথস্ত বা জরশস্ত্র অগ্নির উপাসক ছিলেন এবং তিনি অগ্নিসম্ভূত। এই জরথুস্ত্র বা জরশস্ত্র সূৰ্য্যোপাসকগণের বিদ্বেষী ছিলেন। এই জন্য মগ-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ইহার কলহ হয়। শ্রীকৃষ্ণের পু সাম্বের কুষ্ঠব্যাধি হওয়াতে তিনি সূৰ্য্যের সন্তোষ বিধানার্থ মগ-ব্রাহ্মণদিগকে মূলসাম্বপুরে (বৰ্ত্তমান মূলতানে) আনয়ন করেন। বরাহমিহির এবং রাজতরঙ্গিনী-লেখক কহ্লন কবির মতে এই সিদ্ধান্ত স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, কলিযুগের ৬৫৩ বৎসর অতীত হইলে কুরু-পাণ্ডবগণ আবির্ভূত হন। তাহা হইলে অনুমান খৃষ্ট জন্মিবার ২৩০০ বৎসর পূৰ্ব্বে ভারতবর্ষে শাকদ্বীপ-মগ-ব্রাহ্মণগণ আগমন করেন; সুতরাং তাঁহারা জরথস্ত্রের সামসময়িক ছিলেন। এক সময়ে এই সূৰ্য্যোপাসক ব্রাহ্মণদের সমস্ত আৰ্য্যাবর্ত্তে প্রবল প্রভাব হইয়াছিল। সম্ভবতঃ ইহারাই ভারতবর্ষে মূৰ্ত্তি-পূজার প্রবর্ত্তক। ইয়াং-চিয়াং মূলসাম্বপুরে সূৰ্য্যদেবতার বিশাল সুবর্ণবিগ্রহ দেখিয়া গিয়াছিলেন (২)। এখনও পূৰ্ব্ববঙ্গের অনেক স্থলে আচাৰ্য্য ব্রাহ্মণগণ মৃত্তিকানিৰ্ম্মিত দেববিগ্রহের চক্ষুদান না করিলে মূৰ্ত্তি শুদ্ধ হয় না। এবং বহু স্থানে এই আচাৰ্য্য ব্রাহ্মণগণই প্রতিমা নিৰ্ম্মাণ করিয়া থাকেন। এক কালে ইহাদের হাতেই মূৰ্ত্তি সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত ব্যাপারই ন্যস্ত ছিল।

সুতরাং দেখা যাইতেছে ভারতবর্ষে সূৰ্য্যপূজা বহু প্রাচীন। বেদে সূৰ্য্য অনেক স্থলে বিষ্ণু বলিয়া পরিচিত। এমন কি রামায়ণের সময়ও সূৰ্য্যের বিষ্ণু আখ্যা যায় নাই, এরূপ মনে হয়। রামের গুণ-বর্ণনোপলক্ষে বাল্মীকী আদিকাণ্ডে লিখিয়াছেন–“বিষ্ণুনা সদৃশো বীৰ্য্যে সোমব প্রিয়দর্শনঃ।” এই স্থলে বিষ্ণু অর্থ বেদানুযায়ী সূৰ্য্য হইলেই সঙ্গত হয়। বিষ্ণু বা সূৰ্য্যের আকাশ পৰ্য্যটন লইয়া এক সময় অনেক দেবপ্রসঙ্গ কল্পিত হইয়াছিল। সকলেই জানেন, হিন্দু-জ্যোতিৰ্ব্বিদ্‌গণ টোলেমির ন্যায় সূৰ্য্যের গতি কল্পনা করিয়া গ্ৰহাদির সংস্থান সিদ্ধান্ত করিতেন। আমরা নক্ষত্রগুলির মধ্যে অনুরাধা, বিশাখ, চিত্র ও রোহিণী প্রভৃতির নাম পাই;

(১) Haug’s Essays on Paris, p. 298.

(২) Journal Asiatique (Paris), 1881, Tome X, p. 70.

বিষ্ণু বা সূর্য্যের সঙ্গে ইহাদের সংশ্ৰব কল্পনা করিয়া পরবর্ত্তী কৃষ্ণলীলা বিরচিত হওয়া আশ্চর্য্য নহে। বহুসংখ্যক নক্ষত্রবিশিষ্ট সূর্য্য বা বিষ্ণুদেবতাকে পরবর্ত্তী সময়ে ষোলশত-গোপিনীবিহারী শ্ৰীকৃষ্ণরূপে পরিণত করা হইয়াছিল কিনা, তাহা ভাবিবার বিষয়। এক সময়ে যখন সূৰ্য্যই প্রধান দেবতা ছিলেন, তখন তাঁহার নানা গ্রহমণ্ডলে গতিবিধির কল্পনা-প্রসঙ্গে বিচিত্র উপাখ্যান-মালা দেশময় প্রচলিত ছিল; ভাগবতের কৃষ্ণলীলাতে সেই সূর্য্যোপাখ্যানগুলি নব-কলেবরযুক্ত হইয়াছে কিনা, বলিতে পারি না; কিন্তু ইহা একটি অনুসন্ধানের বিষয় বটে। আমরা অনেকগুলি বাঙ্গালা সূৰ্য্যমঙ্গলের সন্ধান পাইয়াছি। তন্মধ্যে ১৬৮৯ খৃষ্টাব্দে রচিত রামজীবন বিদ্যাভূষণের সূৰ্য্যমঙ্গলখানি অতি বিরাট্‌ গ্রন্থ। ইহাতে সূৰ্য্যোপাসক আচাৰ্য্যগণের হস্তে বৌদ্ধ হাড়িদের নির্য্যাতন বর্ণিত হইয়াছে। এই উপলক্ষে সূর্য্যোপাসকগণের সঙ্গে বৌদ্ধদের কোন প্রাচীন কলহের ঐতিহাসিক তত্ত্ব সূচিত হইয়াছে কিনা, তাহা জানি না। আমরা সূৰ্য্যমঙ্গলগুলি হইতে কোন অংশ উদ্ধৃত করিলাম না, যেহেতু তাহাদের বিশেষত্ব কিছুই নাই। কিন্তু প্রাচীন কালের একটী সূৰ্য্য সম্বন্ধীয় ছড়া আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে হইতেছে। এই ছড়ায় দেখা যায় যে, প্রাচীন সূৰ্য্য-বন্দনায় যে সকল উপাখ্যান প্রচলিত ছিল, কালে সেই সকল উপাখ্যান পরবর্ত্তী শিব ও কৃষ্ণের উপাসনায় আরোপ করা হইয়াছে। ‘গৌরী’ শিবের স্ত্রীরূপেই বঙ্গীয় কাব্য-সমূহে উল্লিখিত। কিন্তু এখানে দেখা যাইতেছে প্রথমতঃ ‘গৌরী’ নাম সূর্য্যের স্ত্রীর প্রতি প্রযুক্ত হইত। শ্রীকৃষ্ণের নৌকা-বিহার সম্বন্ধীয় ব্রজলীলার যে সকল পদ আছে, তাহার আদি-কথা সূর্য্যের নৌকা-যাত্রায় সূচিত। পরবর্ত্তী কালে যে সকল উপাখ্যান লইয়া শিব এবং শ্ৰীকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ পুষ্ট হইয়াছে এই ছড়ায় তাহার উপাদান সূর্য্যে আরোপিত হইয়াছে। এখানে ষোলশত গোপিনী লইয়া শিব-ঠাকুরের সঙ্গে সূৰ্য্য পূজা গ্রহণ করিতে মথুরায় যাত্রা করিতেছেন, এবং নৌকার কর্ণধার বিশাই, বা বিশ্বকর্ম্মা, শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় নৌকাকে অৰ্দ্ধমগ্ন করিয়া কৌতুক করিতেছেন। এ সময়ে ঘরে ঘরে “সূৰ্য্য-মঙ্গল” গীত হইত, তাহার কথাও এই ছড়ায় পাওয়া যায়।

এই সূর্য্যের গান অতি প্রাচীন। ইহার ভাষা অনেকটা পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু আমরা এই ছড়ার যে অংশটুকু পাইয়াছি, তাহা পৌরাণিক যুগের পূৰ্ব্বের কল্পনা বলিয়া মনে হয়। পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে, সূৰ্য্যের উপাসনা শিব এবং বিষ্ণু পুজার হইতে প্রাচীনতর।

এই আদিম গ্রাম্য-রচনায় কবিত্বের অভাব নাই। ভগবান্‌কে অন্তরঙ্গ করিয়া তাহাঁকে নিজেদের মত না করিয়া লইতে পারিলে হিন্দু-গৃহস্থ কখনই সন্তুষ্ট হন না। এখানে বালক-সূর্য্যকে লইয়া যে সকল আদর করা হইয়াছে, তাহা যশোদার গোপালের পূর্ব-কল্পনা। সূৰ্য্যের বিবাহেচ্ছার অভিব্যক্তি গ্রাম্য কবির রসিকতায় সুন্দর ও উজ্জ্বল হইয়াছে। গৌরীর শ্বশুর-বাড়ী যাইবার প্রাক্কালে পিতৃ-গৃহের যে করুণ ক্ৰন্দন, তাহার মৰ্ম্মস্পর্শী সুর গ্রাম্য কথায় আমাদের প্রাণের তন্ত্রী স্পর্শ করে। গৌরী বিলাপের সুরে মাঝিকে ধীরে ধীরে নৌকা বাহিতে বলিতেছেন; মাতা-পিতা এবং ভ্রাতা-ভগিনীর যে ক্ৰন্দনের স্বর তিনি শুনিতেছিলেন, তাহা আরও কিছুকাল শুনিয়া দুঃখমিশ্র সান্ত্বনা পাইবার আশায় মাঝিকে বলিতেছেন–

“ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা ঢলকে ওঠে পানী।

ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি-ভাই মায়ের কাঁদন শুনি॥” ইত্যাদি।

স্বামীর সঙ্গে তাঁহার নৌকায় যে আলাপ হইয়াছিল, সহজ কথায় তাহাতে হিন্দু-গাৰ্হস্থ্যধৰ্ম্মের সার কথা বলা হইয়াছে,–তাহা পল্লী-বালিকা ও তাহার পতির পবিত্র দাম্পত্য গাৰ্হস্থ্যধৰ্ম্মের উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতেছে। হিন্দু-স্ত্রী শুধু স্বামীর জন্য নহেন, তিনি স্বামীর পরিবারবর্গের সঙ্গে একান্তরূপে মিশিয়া সুগৃহিণী-পদে বাচ্য হন, সহজ কথায় সূর্য্য গৌরীকে তাহাই বুঝাইয়াছেন।

বরিশালের ফুল্লশ্রী-গ্রামে প্রাপ্ত সূর্য্যের গান
সূর্য্যের রূপ-বর্ণনা ও উদয়-দৃশ্য


সূৰ্য্য ওঠে কোন্ কোন্ বর্ণ।

সূৰ্য্য ওঠে আগুন-বৰ্ণ॥

সূৰ্য্য ওঠে কোন্ কোন্ বর্ণ।

সূৰ্য্য ওঠে রক্ত-বৰ্ণ॥

সূৰ্য্য ওঠে কোন্ কোন্ বর্ণ।

সূৰ্য্য ওঠে তাম্বুল-বর্ণ॥

ওঠ সূৰ্য্য উদয় দিয়া (১)।

বাওনের (২) ঘরের কোণ ছুইয়া॥

বাওনের মাইয়া (৩) বড় বেয়ান।

সূৰ্য্যাইর পৈতা জোগায় বেয়ান বেয়ান (৪)॥



(১) পূৰ্ব্বদিক্ হইতে।

(২) ব্রাহ্মণের।

(৩) মেয়ে = কন্যা।

(৪) প্রত্যহ প্রাতে।

ওঠ সূর্য্য উদয় দিয়া।

কাঁসারীর ঘরের কোণ ছঁুইয়া॥

কাঁসারীর মাইয়া বড় সেয়ান।

পূজার সাজ (১) জোগায় বেয়ান বেয়ান॥

ওঠ সূর্য্য উদয় দিয়া।

মালীর ঘরের কোণ ছঁুইয়া॥

মালীর মাইয়া বড় সেয়ান।

পুষ্প জোগায় বেয়ান বেয়ান॥

ওঠ সূৰ্য্য উদয় দিয়া।

মুনির ঘরের কোণ ছঁুইয়া॥

মুনির মাইয়া বড় সেয়ান।

সন্ধ্যা-পূজা (২) জোগায় বেয়ান বেয়ান॥

ওঠ সূৰ্য্য উদয় দিয়া।

তেলীর ঘরের কোণ ছঁুইয়া॥

তেলীর মাইয়া বড় রাগী।

খাড়া রাগে (৩) ঢালে পানী॥

ঢাল ঢাল মুখ-পাথ্‌লানী (৪)।

তা দিয়া সূৰ্য্যাইর মুখ-পাখ্‌লানী॥
সূর্য্যের নিদ্রা-ভঙ্গ

উত্তর আলা (৫) কদম গাছটী দক্ষিণ আলা বাওরে।

গা তোল গা তোল সূৰ্য্যাই ডাকে তোমার মাওরে॥

শিয়রে চন্ননের (৬) বাটী বুকে ছিটা পড়েরে।

গা তোল গা তোল সূৰ্য্যাই ডাকে তোমার মাওরে॥

কাঁস বাজে করতাল বাজে তবু সূৰ্য্যাইর ঘুম নাহি ভাঙ্গেরে।

গা তোল গা তোল সূৰ্য্যাই ডাকে তোমার মাওরে॥



(১) সজ্জা = উপকরণ।

(২) সন্ধ্যা-পূজার উপকরণ।

(৩) উচ্চস্থান হইতে সোজাসুজি ভাবে।

(৪) পাখ্‌লানী = ধোওয়া; এস্থলে ধোওয়ার জল।

(৫) দিকের।

(৬) চন্দনের।
সূর্য্যের স্নান

সোণার বাটী আগর (১) চন্নন রূপার বাটী তৈলরে।

স্নান কর ছাওয়াল (২) সূৰ্য্যাইরে॥

দুগ্ধের পুষ্কর্ণী সূৰ্য্যাই নুইঞা দাও ডুবরে।

স্নান কর ছাওয়াল সূৰ্য্যাইরে॥

কাগে (৩) নিল তৈলের বাটী গামছা নিল সোতেরে (৪)

স্নান কর ছাওয়াল সূৰ্য্যাইরে॥

এক ডুবে উঠেরে সূৰ্য্যাই যেন ধুত্‌রার ফুলরে।

স্নান কর ছাওয়াল সূৰ্য্যাইরে॥
সূর্য্যের ধুতি-গামছা

স্নান কল্লা ছাওয়াল সূৰ্য্যাই ধুতি-গামছা কোথা পাইলারে।

স্বর্গে আছে তাঁতীর ছাওয়াল সূৰ্য্যাইর ধুতি-গামছা জোগায় সেওরে॥

স্নান কল্লা ছাওয়াল সূৰ্য্যাই তুমি সন্ধ্যা (৫) পাইলা কোথায়রে।

স্বর্গে আছে মুনির ছেলে সূৰ্য্যাইর সন্ধ্যা জোগায় সেওরে॥

স্নান কল্লা ছাওয়াল সূর্য্যাইরে॥
সূর্য্যের পূজা

পূজা লওরে সূৰ্য্যাই পূজা লও॥ ধ্রু॥

মণে মণে চাউল হৈলে পূজায় বইতে (৬) পারি।

ছড়াভরা কলা হৈলে পূজায় বইতে পারি॥

সেরভরা ধুপ হৈলে পূজায় বইতে পারি।

সাজিভরা পুষ্প হৈলে পূজায় বইতে পারি॥

ডান ধারে ফুলের সাজি বাঁও (৭) ধারে রচনা (৮)।

পুরৈত (৯) ঠাকুর করে পূজা করিয়া কামনা॥

কলা কাডি (১০) কুচি কুচি নবিদ্য বাড়ি সারি (১১)।

রচনা বসাইতে আইলা ব্রাহ্মণেরি নারী॥



(১) অগুরু।

(২) ছেলে = বালক।   (৩) কাক।

(৪) সোতে = স্রোতে।

(৫) সন্ধ্যা-পদ্ধতি।

(৬) বসিতে।

(৭) বাম।

(৮) দেবোদ্দেশে প্রদত্ত হাঁড়িপূর্ণ চিড়া খই প্রভৃতি দ্ৰব্য-সম্ভার।

(৯) পুরোহিত।

(১০) কাটি।

(১১) সারি সারি নৈবেদ্য রচনা করি।

ঘটের আড়ে (১) বইয়া সূৰ্য্যাই নুইঞা নুইঞা চায়

শ্বেত ধূপের গন্ধে সূৰ্য্যাই পূজা খাইতে বয় (২)॥

পূজা খাইয়া ছাওয়াল সূৰ্য্যাই জলপান কল্লা কি।

হাল্যা (৩) বাড়ীর দুগ্ধ-দধি গোয়াল-বাড়ীর ঘি॥

পূজা খাইয়া ছাওয়াল সূৰ্য্যাই চতুর্দ্দিকে চায়।

জলপান কল্লা ছাওয়াল সূৰ্য্যাই মুখশুদ্ধ কল্লা কি।

বারৈ বাড়ীর পাণ সুপারি গাছের হরতকী॥
সূৰ্য্যের যাত্রা ও পার

আরে ও পাটনী মোরে পার কররে॥ ধ্রু॥

সূৰ্য্যাই ঠাকুর যাত্রা করে সুংখে (৪) সোণার ঘটি।

চারিদিকে লোক-লস্কর মধ্যে নাচে হরি॥

শিবাই ঠাকুর যাত্রা করে দুই কাণে ধুতুরা।

ষোল শত গোপিনী লয়ে চলিছে মথুরা॥

গাঙ্গের কূলে গিয়া সূৰ্য্যাই ডাকে ঘন ঘন।

কৈ গেলা পাটনী বিশাই খেওয়ার কড়ি গণ॥

শ্ৰীফল গাছের নৌকাখানি মধ্যে জোড়-গুড়া (৫)।

সূৰ্য্যাই ঠাকুর বৈছেন (৬) যেন পৰ্ব্বতেরি চূড়া॥

চন্নন গাছের নৌকাখানি আগা পাছা টান।

সূৰ্য্যাই ঠাকুর বৈছেন যেন পূর্ণিমারি চাঁদ॥

মধ্য গাঙ্গে নিয়ারে বিশাই নাও (৭) করিল কাইত্‌।

বুঝিলাম বুঝিলাম বিশাই দুপুা ডাকাত (৮)॥

নৌকা হইতে সূৰ্য্যাই ঠাকুর কূলে দিল পারা (৯)।

আচম্বিতে পাইল বিশাই সুবর্ণের ভরা॥

পার হইয়া সূৰ্য্যাই ঠাকুর চারিদিকে চায়।

যে দিক শোনে সূৰ্য্যাই-মঙ্গল (১০) সেই দিক চলা যায়॥



(১)  আড়ালে।  (২) বসে।  (৩) যাহারা হাল চাষ করে = কৃষক। বরিশাল অঞ্চলে কৃষকশ্রেণীই প্রধানতঃ দুগ্ধ-দধি-বিক্রেতা।

(৪)  সম্মুখে।  (৫) যে কাষ্ঠ কড়িকাঠের ন্যায় আড়াআড়ি ভাবে নৌকার উপর সংলগ্ন থাকে তাহাকে ‘গুড়া’ বলে। নৌকা শক্ত করিবার জন্য কোন কোন স্থলে দুইটা গুড়া একত্র করিয়া দেওয়ার নিয়ম আছে বলিয়া এস্থলে ‘জোড়-গুড়া’র কথা উল্লিখিত হইয়াছে।

(৬) বসিয়াছেন।

(৭) নৌকা।

(৮) যে লোক দিনে-দুপুরেও ডাকাতি করিতে পারে।

(৯) পদক্ষেপ করিল।

(১০) সূৰ্য্যের উদ্দেশে মঙ্গল-গীতি।

সূৰ্য্যাই আইল শিবাই আইল পড়্যা গেল সাড়া।

কেহ বাজায় ঢোল ডাগর কেহ বাজায় কারা॥

মুই যদি জানিতাম সূৰ্য্যাই আস্‌বেন আমার বাড়ী।

চন্ননের ছড়া-ঝাইর দিতাম সকল বাড়ী॥

সূৰ্য্যাই আইল শিবাই আইল পড়্যা গেল সাড়া।

সায়বানা (১) টানাইয়া তারা রৈল কদমতলা॥
সূর্য্যের বিবাহেচ্ছা

ওপার দুইটী বাওনের কন্যা মেল্যা দিছে সাড়ি।

তাহা দেখ্যা সূৰ্য্যাই ঠাকুর ফেরেন বাড়ী বাড়ী।।

ওগো সূৰ্য্যাইর মা।

তোমার সূৰ্য্যাই ডাঙ্গর (২) হৈছে বিয়া করাও না॥

ওপার দুইটী বাওনের কন্যা মেল্যা দিছে কেশ।

তাহা দেখ্যা সূৰ্য্যাই ঠাকুর ফেরেন নানা দেশ॥

ওগো সূৰ্য্যাইর মা।

তোমার সূৰ্য্যাই ডাঙ্গর হৈছে বিয়া করাও না॥

ওপার দুইটী বাওনের কন্যা মল খাড়ুয়া (৩) পায়।

তাহা দেখ্যা সূৰ্য্যাই ঠাকুর বিয়া করতে চায়॥

ওগো সূৰ্য্যাইর মা।

তোমার সূৰ্য্যাই ডাঙ্গর হৈছে বিয়া করাও না॥
ঘটকের আগমন

ঘটক চলিল ও চলিলরে ঘটক-চূড়ামণি॥ ধ্রু॥

কোথা ত্থিকা (৪) আইছরে ঘটক কি নাম তোমার।

স্বর্গে ত্থিকা আইছিরে আমি মঞ্চে (৫) দিয়া পাও॥

সূৰ্য্যাইরও যে বিয়া রে হইবে রাঙ্গা শুক্কুরবার (৬)॥

কি দেখিলা কি ওরে শোন্‌লা ঘটক রে মশায়।

হাত দেখ্‌লাম পাও দেখ্‌লাম দেখ্‌লাম দীঘল চুল।

প্রদীপের রোস্‌নাইতে দেখ্‌লাম বধূর চন্দ্রমুখ॥



(১) সামিয়ানা।

(২) ডাগর = বয়স্ক।

(৩) পায়ের এক প্রকার বক্রাকৃতি অলঙ্কার।

(৪) হইতে।

(৫) মর্ত্ত্যে।

(৬) শুক্রবার।
সূর্য্য ও গৌরীর বিবাহ-সজ্জা ক্রয়

সুন্দর বাণিয়ার ছাওয়াল নগর দিয়া যায়।

সূৰ্য্যাই-গৌরার বিয়ার চন্নন কেনে গৌরার মায়॥

সুন্দর মালিয়ার ছাওয়াল নগর দিয়া যায়।

সূৰ্য্যাই-গৌরার বিয়ার মুকুট কেনে গৌরার মায়॥

সুন্দর তাঁতিয়ার ছাওয়াল নগর দিয়া যায়।

সূৰ্য্যাই-গৌরার বিয়ার কাপড় কেনে গৌরার মায়॥

গৌরাইর বিয়া তোরা দেখ্যা যা বেড়িয়া ঘুরিয়া॥ ধ্রু॥

আসিতে শিখাইল মায়।

গৌরাই প্রণাম কর্ বা জামাইর পায়॥
সূর্য্যের বিবাহ

আম ফলে থোকা থোকা, তিতৈল (১) ফলে বেকা বেকা (২)।

ছাওয়াল সূৰ্য্যাই বিয়া করেন মা’র ঝোলা টাকা টাকা॥

খাডো খাডো নাইরকোল গাছটী পির (৩) ছাইয়া ফলে।

ছাওয়াল সূৰ্য্যাই বিয়া করেন ঘৃতের প্রদীপ জলে॥

খাডো খাডো কলা গাছটী বাইয়া পড়ে মৌ।

ছাওয়াল সূৰ্য্যাই বিয়া করেন বড় সুন্দর বৌ॥

সখী চল্‌ গিয়া মোরা দেখি।

ছাওয়াল সূৰ্য্যাই বিয়া করেন নামে চন্দ্রমুখী॥

ছাওয়াল সূৰ্য্যাইর ঘরের ছাঁইচে (৪) রামকলার পাত।

তাহাতে রাঁধিয়া দিমু দারা-কূটার (৫) ভাত॥

সখী চল্‌ গিয়া মোরা দেখি।

ছাওয়াল সূৰ্য্যাই বিয়া করেন নামে চন্দ্রমুখী॥
সূর্য্যের শ্বশুর-বাড়ী যাত্রার উদ্যোগ ও শ্বশুর-গৃহে আচরণ সম্বন্ধে তাহার প্রতি উপদেশ

আনন্দের আর সীমা নাইগো আনন্দ॥ ধ্রু॥

সূৰ্য্যাই যাবেন শ্বশুর-বাড়ী সঙ্গে যাইবেন কে।

সঙ্গে যাইবে সূৰ্য্যাইর বাপে সাজ্‌তে লাগ্‌ষে (৬) সে॥



(১) তেঁতুল। (২) বাঁকা = বক্ৰ।

(৩) খাডো = খাট = ক্ষুদ্র। নাইরকোল = নারিকেল। পির = কান্দী।

(৪)  ছাঁচনাতলায়।

(৫) ‘দারা-কুটার ভাত’ খাওয়া বিবাহ-সময়ের একটা স্ত্রী-আচার। তিনখানা দারা অর্থাৎ কাঠের উপর হাঁড়ি রাখিয়া কূটা অর্থাৎ খড় দ্বারা এই অন্ন ঘৃতপক্ক করিতে হয় বলিয়া ইহার এইরূপ নামকরণ হইয়াছে।

(৬) লাগিয়াছে = আরম্ভ করিয়াছে।

মামায় ভাইগ্‌নায় হাল বায় বামে ঠেল্যা যাইও। (১)

শালীরা যে পাণ দিবে কাপড়ে মুছ্যা খাইও॥

শাশুড়ী রেঁধেছে দারা ঝালে আর ঝোলে।

শালা-বৌ পশেন (২) দারা সুবর্ণেরি থালে॥
গৌরীর শ্বশুর-বাড়ী গমন

আজ যা গৌরী কাঁদ্যা-কাট্যা।

কাইল আইস্‌ গৌরী হাস্যা-রস্যা॥

গৌরীর মায় কাঁদে-কাটে।

হাজার টাকা গাইডে বাঁধে॥ (৩)

ও গৌরী না গিয়া।

পান্তা ভাত খা গিয়া॥

পান্তা ভাত শলা শলা।

পুডি মাছ চলা চলা (৪)॥

আম গাছে থাকলো কোকিলা চন্নন গাছে বাসা।

আলো আমার গৌরা নিতেলো কোকিলা মনে কর আশা॥

কোন খান দিয়া আইলরে অতিথ আমি বাইর বাড়ী দিলাম বাসা।

সে না আতিথের মনে গৌরা নেবার আশা॥

আট বার বছরের গৌরী তের নয়রে পড়ে।

ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাছা মায়ের অঞ্চল ধরে।

টাকা নয়রে কড়ি নয়রে কোটরে রাখিব।

পরের লগ্যা হৈছে গৌরা পরেরে সে দিব॥

অৰ্দ্ধেক গাঙ্গে (৫) ঝড় বৃষ্টি অৰ্দ্ধেক গাঙ্গে কূয়া।

মধ্য গাঙ্গে বাদ্য বাজে গৌরা লবার লইঞা॥

আড়শী কাঁদে পড়শী কাঁদে কাঁদে রইয়া রইয়া।

গৌরীর জনকে কাঁদে গামছ মুড়ি দিয়া॥

গৌরীর যে ভাই কাঁদে খেলার সাজি লইয়া।

গৌরীর যে মায়ে কাঁদে শানে পাছার (৬) খাইয়া॥



(১)  হাল বায় = হলকর্ষণ করে। মাতুল ও ভাগিনেয়ের একত্র হল-কর্ষণ বামে দেখিলে যাত্রা শুভ হয়।

(২) পরিবেশন করেন।

(৩) গাইডে = গাঁটে। তৎকালে কন্যা-পণ লওয়ার প্রথা ছিল।

(৪)  পুডি = পুঁটি। চলা = রাঁধিবার কাঠ; এস্থলে (ভাজা পুঁটি মাছ) কাঠের ন্যায় দৃঢ়।

(৫) নদীতে।

(৬) আছার।

মাও ধন বাপ ধন তোমরা নি রাখ্‌বা মোরে।

সভার মধ্যে লইছি টাকা কেমনে রাখ্‌ব তোরে॥

উত্তর আটের (১) রামকলা কাট্যা আন পাত।

তাহাতে খাইবে গৌরী নাইওরেরি (২) ভাত॥

ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা ঢলকে ওঠে পানী।

ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি-ভাই মায়ের কাঁদন শুনি॥

ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা ঢলকে ওঠে পানী।

ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি ভাই ভাইয়ের কাঁদন শুনি॥

ভাঙ্গা নাও মাদারের বৈঠা ঢলকে ওঠে পানী।

ধীরে ধীরে বাওরে মাঝি-ভাই বুইনের (৩) কাঁদন শুনি॥
গৌরীর অভাব-মোচনে সূর্য্যের সঙ্কল্প

(উত্তর-প্রত্যুত্তর)

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি কাপড়ে দুঃখ পামু।

নগরে নগরে আমি তাঁতিয়া বসামু॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি শঙ্খের দুঃখ পামু।

নগরে নগরে আমি শাঁখারী বসামু॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি সিন্দূরে দুঃখ পামু।

নগরে নগরে আমি বাণিয়া বসামু॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি তেলের দুঃখ পামু।

নগরে নগরে আমি তেলিয়া বসামু॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি চাউলের দুঃখ পামু।

নগরে নগরে আমি হালিয়া (৪) বসামু॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি মা বলিমু কারে।

আমার যে মা আছে মা বলিবা তারে॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি বাপ বলিমু কারে।

আমার যে বাপ আছে বাপ বলিবা তারে॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি ভাই বলিমু কারে।

আমার যে ভাই আছে ভাই বলিবা তারে॥

তোমার দেশে যামুরে সূৰ্য্যাই আমি বুইন বলিমু কারে।

আমার যে বুইন আছে বুইন বলিবা তারে॥



(১) হাটের।

(২) স্ত্রীলোকের কুটুম্বগৃহে যাওয়াকে ‘নাইওর’ বলে।

(৩) বহিন = ভগিনী।

(৪) চাষা = কৃষক।

Post a Comment

0 Comments