Ticker

6/recent/ticker-posts

শওকত ভাইকে মনে পড়ে

আবুল হাসানাত
বৃদ্ধ বয়সে মনে হয় পুরনো কথা মনে পড়া স্বাভাবিক- যাকে স্মৃতিচারণ বলে। শওকত ভাইকে মনে পড়ে এজন্য যে, তিনি আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে আছেন এবং থাকবেন। তার সাহিত্যের বিপুল ভা-ার ছাড়াও অকৃত্রিম একটি ভালো মানুষ যিনি সারাজীবন সাহিত্যসাধনা করেছেন ও মানুষকে ভালোবেসেছেন। তাকে সাহিত্য পাঠকের মনে থাকবে জননীর জন্য। এমন অনবদ্য গ্রাম-কথা সহজলভ্য নয়। গ্রামীণ জীবনের একটি অসাধারণ চিত্র। হাসান আজিজুল হকই প্রথম এই তাৎপর্যম-িত উপন্যাসটির স্বরূপ উন্মোচন করেন তার অনবদ্য ভাষারীতি ও রচনারীতির মাধ্যমে। যদিও ‘ক্রীতদাসের হাসি’ তার বহুল পঠিত ও পাঠকনন্দিত উপন্যাস। তবুও আমরা মনে করি ‘জননী’ই তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
আমরা যেমন জড়িয়ে আছি বাংলা একাডেমীর সঙ্গে, শওকত ভাইও যেমনি- কতোবার যে কাজে-অকাজে আমাদের কাছে এসেছেন, আড্ডা দিয়েছেন আর তার শেষ জীবনে দু’লাইন পদ্য উপহার দিয়েছেন যা সংগ্রহ করে রাখলে একটি কাজের কাজ হতো। শেষ বয়সে তার পারিবারিক জীবনের কথা যদিও আমাদের ব্যথিত করে তবুও তা তার প্রাণোচ্ছল জীবনের ছন্দ-নৃত্যকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। হাসি-খুশি থাকা, ভালো থাকা তার জীবনের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল।
আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ১৯৫৪ সালে চাটগাঁয়ে। আমি তখন গোগ্রাসে সাহিত্য গিলছি। তার নাটক সম্পর্কে কিছু লিখে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে যেতে লিখেছিলেন। যাওয়াটা হলো আলাউদ্দিন আল আজাদের কল্যাণে। তিনি সাহিত্য সংসদের সম্মেলনে রাজশাহী থেকে প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আর একজন ছিলেন এনামুল হক। তিনি অবশ্য যাননি। আমি ঠিক করলাম আগে চট্টগ্রাম যাবো তারপর যাবো ঢাকা। চট্টগ্রামে গেলাম শেখ-ই-চাটগামস প্লেসের নুরুন নাহার ও আইনুন নাহারের কাছে। পত্রমিতালি। তারপর গেলাম শওকত ভাইয়ের কাছে। কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়ে আমার পিলে চমকে উঠলো বিরাট এক কুকুরের তর্জনে-গর্জনে। শওকত ভাই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। আলাপের শুরুতেই বললেন, প্রচুর পানি খাবে, অর্থনীতির বই পড়বে আর বিকেলে হাঁটাহাঁটি করবে। তারপর আমি কী করছি ইত্যাদির খোঁজখবর নিয়ে বললেন, পড়বে, এই দেখ আমি ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ পড়ছি- ছয়বারের বার। অসাধারণ। শওকত ভাই একাই ছিলেন- ছেলেমেয়ে-স্ত্রী কলকাতায় গিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এলে এবং আমি বাংলা একাডেমীতে চাকরি পেলে বুলবন ওসমান আমাদের বন্ধু হয়ে যায় এবং সেই সুবাদে শওকত ভাইয়ের বাড়িও যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় চলে যান এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ দিনগুলোও পাক-সেনাদের অকল্পনীয় অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লেখেন- অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা তার এসব উপন্যাসে ফুটে ওঠেনি। তিনি কেন রগরগা ঘটনানির্ভর উপন্যাস লিখলেন, বোঝা গেল না। শওকত ভাইয়ের নাটক রচনায় হাত ছিল- পরবর্তী পর্যায়ে নাটক রচনা ছেড়ে দিয়ে তিনি ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। একটি আশ্চর্য সুন্দর ছোটদের রচনাও লিখেছিলেন যা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা একাডেমী ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় আড্ডাস্থল ছিল দৈনিক বাংলা। হাসান ভাই- হাসান হাফিজুর রহমান- যার মুকুটমণি ছিলেন। এখানে প্রায় আসতেন শওকত ভাই এবং দু’পঙ্‌ক্তির পদ্য উপহার দিতেন। একদিন দেখি হাসান ভাই রেগে গেলেন এবং বললেন, এসব আপনার কপালে সেঁটে দেন, ঘুরে বেড়ান তারপর। যা হোক, শওকত ভাইকে গোমড়ামুখে দেখিনি- সদা হাস্যময়। এই হাসিহাসি মুখ করে চিনি স্যারের বাসায় আসতেন, শরীফ স্যারের। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হতো তার। তাদের আলোচনা খুব উচ্চমার্গের ছিল। একদিন স্যার বললেন, ওসমান সাহেব আর আসেন না। কেন স্যার, আমি জিজ্ঞাসা করি। আমি নাস্তিক বলে। পরে জীবন সায়াহ্নে আবার তাদের সম্পর্ক ভালো হয়।




জীবনের শেষের দিকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। প্রায় সভা-সমিতিতে যেতেন। বক্তৃতাও দিতেন। আমরা অনেকে তা পছন্দ করতাম না। আমরা বলতাম, তার মেয়ের কাছে যেতে, কয়েক মাস বেড়িয়ে আসতে। ভালো লাগবে। লেখারও সুযোগ আসবে, উপকরণও পাবেন। শওকত ভাই রাজি হতেন না।
’৭৩-৭৪ সালে বাংলা একাডেমীতে বেশকিছু অফিসারের পদোন্নতি দেয়া হয়। একটি নির্বাচন কমিটির সদস্য ছিলেন শওকত ভাই। হবীবুল্লাহ (প্রেস ম্যানেজার উপপরিচালক, বাংলা একাডেমী) আমাকে এসে দেখলো, ওসমান সাহেবের সঙ্গে আপনার তো ভালো পরিচয়, আমার কথা বলেন না। আমি এ জাতীয় উমেদারি করি না। কিন্তু এক্ষেত্রে বললাম শওকত ভাইকে। তিনি হবীবুল্লাহর পক্ষে বলেছিলেন, ফলে তার পদোন্নতি হয়েছিল। অফিসার থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছিল।
তবুও আমার মনে হয় শওকত ভাই মানুষ অপেক্ষা একজন লেখক হিসেবে অনেক বড়। মানুষ হিসেবে সজ্জন, সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল তো বটেই। লেখক হিসেবে একাধারে তিনি গল্পলেখক, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। বাস্তবের রূঢ়তা ও সমাজবাস্তবতার রূপায়ণে তিনি দক্ষ শিল্পী। তার গদ্য যদিও কিঞ্চিৎ রূঢ়, তবুও বলবো তার বিষয়বস্তুর ভাবপ্রকাশে তা সার্থক। ‘ক্রীতদাসের হাসি’র আরম্ভটি লক্ষ্য করুন- কী কঠিন, রূঢ় ও অমসৃণ। অবশ্য এটাই তার বৈশিষ্ট্য। শওকত ভাইকে বলেছিলাম ভারত বিভাগ নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে, বিশেষ করে ১৯৪৬-৪৭-এর অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো মনে রেখে। গরল বয়ে যাচ্ছে ভারতবর্ষজুড়ে। কলকাতা-নোয়াখালী-বিহারে রক্ত ঝরছে। তারপর পাঞ্জাবে শিখ-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। নেহরু-জিন্নাহ-মাউন্টব্যাটন ও গান্ধীর বিশ্বাসঘাতকতা। অখ- ভারত স্বাধীনতা পেল না- জন্ম নিল পাকিস্তান। লাখ লাখ মানুষ চলে আসছে তা পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে; পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাঞ্জাবে। আবার পশ্চিম বাংলা থেকে মুসলমান দলে দলে চলে আসছে পূর্ব বাংলায় এবং পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাচ্ছে লাখ লাখ হিন্দু। শওকত ভাই মাথা নেড়েছিলেন। কিন্তু উপন্যাসটি তার পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি- হয়তো সমানভাবে কিংবা প্রয়োজনীয় অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য। লিখলে ভালো হতো। কারণ ’৪৬-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিভূতিভূষণ ‘অশনি সংকেত’, ‘তারাশঙ্কর মন্বন্তর’, সরোজ রায় চৌধুরী ‘কালো ঘোড়া’ ও প্রবোধ স্যানাল ‘অঙ্গার’ লিখেছিলেন।
শওকত ওসমানের রচনা নতুন প্রজন্ম পড়ে কি না জানি না। মনে হয় তেমনভাবে তিনি পঠিত নন। তারা হয়তো হুমায়ুন পড়ে। আবার এটাও ভাবী আছে নিশ্চয় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শওকত ওসমানের উপন্যাসগুলো পড়েন। আর গবেষকদের পক্ষে বাংলাদেশের উপন্যাস আলোচনার ক্ষেত্রে তার ‘জননী’র উল্লেখ অবশ্যই করতে হবে।
মৃত্যুর পর আমরা ক’জনকে বা মনে রাখি। হয়তো ব্যক্তিগত চেনাজানাই মনে রাখার একমাত্র পন্থা। তাই হোক। তবুও শওকত ভাইকে যে মনে রাখছি। তার দিক থেকে নয়, আমাদের দিক থেকে এটাই লাভ।