Ticker

6/recent/ticker-posts

চার্লস ডারউইন ও বিবর্তনবাদ


ড. আমিনুল ইসলাম
দ্বি-শততম জন্মবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি
লন্ডন ১৮৫৯, ২৪ নভেম্বর। সে দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ডারউইনের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘প্রজাতির উতপত্তি' (Origin of Species)। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রথম সংস্করণের ১ হাজার ২৫০টি বই বিক্রি হয়ে যায়। প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় ওঠে এ বইটিক ঘিরে। কোনো বইকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। কিছুদিনের মধ্যে বইটি সমগ্র ইউরোপ তথা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে মানুষের চিন্তা জগতে তুমুল এক আলোড়ন এনে দেয়। বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পড়ে গেল এবং সবার মনে এ ধারণা জন্মাল যে, পৃথিবীতে একটি নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার অভ্যুদয় হয়েছে। কি গভীর অনুভূতির সঙ্গে লেখক তার আলোচ্য বিষয়কে বোঝাতে চেয়েছেন তা এ গ্রন্থে লক্ষ্য করা যায়। পড়তে গেলে বিস্ময় জাগে এটি বিজ্ঞানের বই, না গীতিময় কোন কাব্যগ্রন্থ! সত্যি বলতে লেখকের জীবনব্যাপী গবেষণা গবেষণামাত্র ছিল না ছিল না- তা ছিল এক অনাবিষ্কৃত পৃথিবী আবিষ্কার। ১২ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক চার্লস রবার্ট ডারউইনের দ্বি-শততম জন্মবর্ষ
বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিভিন্ন অঙ্গনে উনিশ শতকে যে সব তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়, বিবর্তনবাদ তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মতাত্ত্বিক দর্শন অনুসারে অনাদি অনন্তকাল থেকে বিরাজমান পরমেশ্বর এক আদেশবলে সৃষ্টি করেন এ জগৎ ও জীবকুল। যেমন, উপনিষদে আছে পরমেশ্বর চিন্তা করলেন ‘একেলা ন রমেত’ (আমি আর একা থাকব না), এক থেকে বহু সৃষ্টি করবো। ফলে তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। ইহুদি ও খিস্টীয় ধর্ম মতেও এ ধারণার সমর্থন রয়েছে। যেমন, স্রষ্টার ইচ্ছা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত জগৎসংসার। এ কাহিনী বিবৃত বাইবেলের আদি পর্বে। ওখানে বলা হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছায় শূন্য থেকে প্রথমে আলোর এবং তার পর ছ’দিন ধরে ক্রমান্বয়ে গ্রহ নক্ষত্র উদ্ভিদ প্রাণী এবং সর্বশেষে আদিমানব আদমের সৃষ্টি। আদমের অস্থিপঞ্জর থেকে সৃষ্টি করা হয় ঈভ বা হাওয়াকে। ছ’দিনে সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করে সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নেন। সেদিনের স্মরণেই খ্রিস্টানরা রবিবারে সাপ্তাহিক বিশ্রাম নেয়।
বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অনুপস্থিতিতে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাধান্যের ফলে মধ্যযুগে অবশ্য জগৎকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থির নিশ্চল বলে। কিন্তু আধুনিক যুগে বিবর্তনের ধারণা আবার নতুন করে বিস্তার লাভ করে। যেমন, ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০), লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) ও কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) প্রমুখ আধুনিক দার্শনিকদের চিন্তায় বিবর্তনের ধারণা কোন না কোনোভাবে উপস্থিত ছিল। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে প্রাণীকুল কীভাবে নিম্নতর পর্যায় থেকে ক্রমশ উচ্চতর পর্যায়ে বিবর্তিত হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে ফরাসী প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ল্যামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এসব মতের সূত্র ধরেই জীব ও জগতের বিবর্তন ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদ চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২)।
কিন্তু আধুনিক জীববিজ্ঞান এই আকস্মিক সৃষ্টিবাদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে এবং এর স্থলে প্রবর্তন করে বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের বাড়ষঁঃরড়হ) ধারণা। এ মতে, জগৎ ও জীবনে প্রতিনিয়ত যে সব ঘটনা ঘটে সেগুলোর কোনোটিই সম্পূর্ণ নতুন নয়; প্রতিটি ঘটনাই তার পূর্ববর্তী ঘটনা ক্রমবিকাশের ফল। জগতের অগণ্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তথা সব জৈব ও অজৈব সত্তা এক সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে ক্রমবিকশিত হয়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। এ জগৎ এক অবিরাম পরিবর্তন প্রবাহ বা স্রোতধারাস্বরূপ, আর এ গতিময় ধারায় নিয়ত বদল হচ্ছে জগৎ জীবন সমাজসহ ত্রিভুবনের সবকিছু। আমরা আজ যে পৃথিবীতে বসবাস করছি লক্ষ কোটি বছর আগে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যেমন, তখন সূর্যের তাপ ছিল আজকের চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রখর এবং পৃথিবীও ছিল অনেক বেশি উত্তপ্ত-এতই উত্তপ্ত যে তখন প্রাণীকুলের বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব। নক্ষত্রের তাপমাত্রা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় কালক্রমে পরিবেশ ক্রমশ অনুকূল হয়ে ওঠে এবং আর্বিভাব ঘটে রকমারি রাসায়নিক পদার্থের। এ প্রক্রিয়ায়ই উপযুক্ত আবহাওয়া, বায়ু ও পানির আবির্ভাবের ফলে ক্রমশ উদ্ভব ঘটে উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রাণীর।
শুরুতে মূল পদার্থিক ও রাসায়নিক উপাদানগুলো ছিল সরল কিন্তু এলোমেলো অবস্থায়। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে এগুলো সুশৃঙ্খল জটিল রূপ ধারণ করতে থাকে। বিবর্তন মানে সরল থেকে যৌগিক, বিশৃঙ্খল থেকে সুশৃঙ্খল এবং অনুন্নত থেকে উন্নত অবস্থায় ক্রমিক বিকাশ বা উত্তরণ। এ বিবর্তন ধারার বিভিন্ন স্তর পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ধারাবাহিক অনবচ্ছিন্ন। জগতের সবকিছুই প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল। এখানকার কোনোকিছুই সম্পূর্ণ নতুন নয়, সবই পূর্ববর্তী বস্তু ও ঘটনার ক্রমবিকাশের ফল। বিবর্তনবাদের এ বক্তব্য ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করে উনিশ শতকে। তখন থেকে সৃষ্টিবাদের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে।
মানুষসহ বিভিন্ন জীবজন্তু কীভাবে বিবর্তিত হয় তার এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চার্লস ডারউইন। বিবর্তনবাদে ডারউইনের অবদান প্রধানত জীবজগৎকে কেন্দ্র করে। শৈশব থেকেই উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। পরবর্তীকালে তিন পড়াশোনাও করেন। এ বিষয়েই। ছাত্রজীবন শেষ করে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন একদিন তার পছন্দ করা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করার এক বিরাট সুযোগ আসে। এইচএমএস বিগল নামক একটি জাহাজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কাজে বিশ্বপরিক্রমায় বের হয় এবং ডারউইন তাতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী হিসাবে একটি চাকরি পান। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ঐ জাহাজে করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জৈব উপাত্ত নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন। প্রায় পঁচিশ বছর অবধি এসব উপাত্তের ওপর গবেষণা করার পর ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রজাতির উৎপত্তি (ঙৎরমরহ ড়ভ ঝঢ়বপরপং) নামক গ্রন্থে তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। মানুষ ও জগতের বিভিন্ন জীবজন্তু কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার এক চমৎকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর এ যুগান্তকারী গ্রন্থে। এ ছাড়াও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে মানুষের আগমন (উবংপহঃ ড়ভ সবহ) নামক তাঁর অপর একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
প্রজাতির উৎপত্তি গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বক্তব্য নিয়ে ইংল্যান্ডে এক ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়। এ বিতর্ক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে ডারউইনের মতবাদের মূলমর্ম জানা দরকার। ডারউইনের মতে, পৃথিবীর জীবজন্তু বর্তমানে যে যে অবস্থায় আছে, শুরুতে সে অবস্থায় ছিল না। এক আদিম অপরিপক্ক অবস্থা তেকে ক্রমিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বর্তমানের অপেক্ষাকৃত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রকৃতি এক বিরামহীন সংগ্রামে নিয়োজিত। যারা সর্বাধিক যোগ্য তারাই এ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকে। যারা দুর্বল এবং যারা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম, তাদের বিলুুপ্তি অনিবার্য। জীবনসংগ্রামে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সর্বাধিক যোগ্যদের টিকে থাকার মাধ্যমে জীবকোষের অভ্যন্তরে আকস্মিক পরিবর্তন বা প্রকরণের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। তাঁর মতে, প্রথম থেকেই প্রতিটি প্রজাতিকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রামের সময় প্রাণীদেহে অনেক পরিবর্তন সংঘঠিত হয়। প্রজাতির পক্ষে এসব পরিবর্তনের কিছু কিছু উপযোগী, আর কিছু-কিছু অনুপযোগী। উপযোগী পরিবর্তন প্রজাতিকে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলতে সাহায্য করে এবং অনুপযোগী পরিবর্তন প্রজাতিকে পরিবেশের সঙ্গে চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। অনুপযোগী পরিবর্তনসমূহ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সংশ্লিষ্ট প্রজাতি বেঁচে থাকার সংগ্রাম জয়ী হয়।
বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু পৃথিবীর খাদ্যের পরিমাণ সীমিত। ফলে খাদ্যের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জয়ী হয় তারাই যারা সর্বাধিক উপযুক্ত। সর্বাধিক উপযুক্ত তারাই যারা পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমানে যেসব প্রজাতি বেঁচে আছে, তারা এক দীর্ঘ পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আজ যে তারা বেঁচে আছে, তার অর্থ এই যে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে তারা নিজেদের সবার্ধিক উপযুক্ত বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এ মতবাদের মূল অর্থ এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার। যে বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে, মানবজাতিও তার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মধ্যেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম অব্যাহত এবং মানুষের বেলায়ও শক্তিশালীরাই সংগ্রাম জয়ী হয়। এবং এ বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় মানুষের দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে থাকে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে। ডারউইন এই নিশ্চিন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, মানুষ এক বানর ও মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষণীয়, তার মূলেও রয়েছে সর্বজনীন বিবর্তননীতির প্রভাব। বেঁচে থাকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধিতে এমন অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যার ফলে সে পবিেশের প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে জয়ী হতে পেরেছে।
কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে সরিয়ে এবং সৌরজগতের এটি গ্রহে পরিণত করে মানুষকে যেমন সব রকমের জ্যোতির্বিদ্যাকে কেন্দ্র্রিয়তা ও গুরুত্ব থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদেও তেমনি অপরাপর যেকোনো প্রাণীর ন্যায় মানুষও এক আদি সরল অবস্থা থেকে উদ্ভূত এবং অন্যান্য প্রজাতির ন্যায় মানুষও ক্রমিক বিবর্তনের মধ্যমে তার নিজস্ব চেষ্টায় বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, ডারউইনের বিবর্তনবাদী মত খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বেও বিরোধী। ডারউইনের মতে, জগতে মানুষের কোনো বিশেষ সুুবিধাজনক অবস্থান নেই, এবং জাগতিক ব্যাপারে বিধাতার হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে না। এ মতের প্রভাব বাইবেল বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে অনেকেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শুরু করে এবং এভাবে ধর্মীয় ব্যাপারাদি নিয়ে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। ডারউইনেরও প্রায় তিনশো বছর আগে কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও প্রমুখ বিজ্ঞানী নতুন ধর্মবিরুদ্ধ মত প্রচার করে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ মত নিয়ে তুমুল মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর তীব্র নিন্দা করে।
তবে ডারউইনের সময় থেকে বিজ্ঞানীরা যেসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন তাতে বিবর্তনবাদী অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা আজ সাধারণভাবে এ মতকে সত্য বলে গ্রহণও করেছেন। কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিদ্যা যেমন এর ঘোষণার পঁচাত্তর বছর পরে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল, ঠিক তেমনি আজকের দিনের মানুষও ডারউইনের মতকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। তবে একথা ঠিক যে, কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মত আর ডারউইনের জৈব বিবর্তনবাদ, এ দুয়ের কোনোটিই আজও সব মহলে সমানভাবে গৃহীত ও আদৃত নয়। তাই দেখা যায়, বিবর্তনের গোটা ধারণাটিকেই আজও কেউ কেউ সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
বিবর্তনবাদ আজ একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। আর এর পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণও রয়েছে প্রচুর। এ মত জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ যুক্তিপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সৌরমন্ডল ও নক্ষত্রপুঞ্জের বর্তমান অবস্থা লক্ষ-কোটি বছরের ক্রমবিবর্তনের ফল। সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের শক্ত হওয়ার এবং পৃথিবীর একটা নিরেট অবস্থা ধারণের এবং পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ও লোকালয় গড়ে ওঠার জন্য সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। মাটির বিভিন্ন স্তর পরীক্ষা করে ভূবিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আমাদের এই ধরিত্রী একটি আদিম তরল অগ্নিময় অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কঠিন অবস্থা ধারনা করেছে।
মাটির নিচের বিভিন্ন ভূস্তরে কিছু অধুনালুপ্ত প্রাচীন জীবের শিলীভূত নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, বর্তমান প্রাণীকুল সেসব প্রাচীন প্রাণীরই বিবর্তিত রূপ। আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভাষাও অনুরূপ। বর্তমানে আমরা যেসব জীবজন্তু দেখছি তাদের উৎপত্তি আদিকালের জীবজন্তু থেকে। সেদিনের জীবজন্তু ছিল ভিন্নতর আকার ও অবয়বের, এবং তারা বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। মানুষের বেলায়ও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমানে আমরা মানবজাতির যে অবস্থা দেখছি তা হঠাৎ করে এই রূপ ধারণ করেনি। এখন আমরা মানুষের যেরকম দেহ ও মন প্রত্যক্ষ করছি, আদিযুগের মানুষের দেহ ও মন তেমনটি ছিল না। কোনো জীবজন্তুই সবসময় একরকম থাকে না। জীবজগতের বিভিন্ন জাতি-প্রজাতি যেমন চিরকাল এক অবস্থায় থাকে না, তেমনি সমাজ ও সামাজিক অনুশাসনও পূর্বাপর একরকম থাকে না। সমাজবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের যেসব সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, মূল্যমান ও মূল্যবোধ সেগুলোও এক ক্রমিক পরিবর্তনধারা বা ক্রমবিকাশের ফল।
বিবর্তনের মূল প্রকল্পটিতেও ডারউইনের সময় থেকে ক্রমশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জীবনসংগ্রাম ও যোগ্যতমের টিকে থাকার মাধ্যমে বিবর্তনকে সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কি না এবং বিবর্তন ব্যাখ্যায় অন্য কেনো নতুন কিছু অবতারণার প্রয়োজন আছে কি না, এ নিয়ে আজও প্রশ্ন উঠেছে। বিবর্তনের নিরবচ্ছিন্নতা সম্বন্ধেও কেউ-কেউ যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, বিবর্তন-প্রক্রিয়া সুসংবদ্ধ ও ক্রমিক অগ্রগতির নির্দেশক নয়, বরং এর মধ্যে প্রায়শই এমন কিছু আকস্মিক পরিবর্তন দেখা যায় যেগুলো বিবর্তনের ক্রমিক ও ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্যকে বিঘ্নিত করে।
যাইহোক, জগৎ ও জীবনকুলের বিবর্তনাবাদী ব্যাখ্যা ধর্ম ও বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানের বেলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে, নীতিবিদ্যার চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণায় বিবর্তনবাদের প্রভাব যুগান্তকারী। এ মতে, অতীতের নীতিবিদরা যেসব স্থির ও অপরিবর্তনীয় বিধি-নিয়মের কথা বলেছিলেন সেগুলো আসলে তেমন নয়। যেমন, কান্টের দৃষ্টিতে যেসব নৈতিক নিয়মছিল অপরিবর্তনীয় ও প্রাকসিদ্ধ বিবর্তনবাদের প্রভাবে সেগুলোকে দেখা হয় স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে। বিবর্তনবাদের প্রভাবে অনপেক্ষ নৈতিক বিশ্বাসের স্থলে আপেক্ষিকতা ক্রমবর্ধমানা গুরুত্ব লাভ করতে পারে। জীবনসংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সবচেয়ে উপযুক্তদের বেঁচে থাকার ডারউইনীয় ধারণা শিক্ষিত মহলে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। তখন এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, মানুষসহ সব জীবজন্তুই প্রাকৃতিক কার্যকারণ নিয়মের আওতাধীন, এবং এ নিয়মেই তারা কোনো চেতন সত্তা কিংবা ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়াই ক্রমবিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এ মতে, মানুষের আচরণের শুভাশুভ বিচারের মানদণ্ড খুঁজতে হবে প্রকৃতিজগতেই, কোনো অজানা অচেনা অতিপ্রাকৃত সত্তায় নয়। নৈতিক মূল্যবোধকেও বিচার করতে হবে প্রচলিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই।
জগতের এই নতুন বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা একদিকে কর্মের ক্ষেত্রে, অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বেলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে অর্থনীতির পাঠ ও গবেষণায় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির বিকাশের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, এবং আঠারো শতকের অর্থনীতিবিদেরা যেসব স্থির ও অপরিবর্তনীয় নিয়মের কথা বলেছিলেন সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এক কথায় অর্থনীতিকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে এনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের আওতাভুক্ত করা হয়। নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রের অনুরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কান্টের দৃষ্টিতে যেসব নিয়ম ছিল অপরিবর্তনীয়, বিবর্তনবাদের প্রভাবে তাদের দেখা হয় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসাবে। অনপেক্ষ নৈতিক বিশ্বাসের স্থলে আপেক্ষিকতার ক্রমবর্ধমান গুরুত্বলাভ করে।
বিবর্তনবাদ ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও গবেষণাকে উৎসাহিত করে। ইতিহাসকে মনে করা হয় সেসব মানুষের মনের চাবিকাঠি হিসাবে যারা বস্তু ও ঘটনাকে দেখেন তাদের উৎপত্তি ও বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে। উনিশ শতকের ইতিহাসবিদরা যখন পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেন এবং মানুষ ও তার প্রতিষ্ঠানাদির বিবেচনায় ডারউইনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুকরণ করলেন, তখনই সম্পূর্ণ হলো অতিপ্রাকৃতের অক্টোপাস থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া। সমাজবিজ্ঞানের পাঠ ও অধ্যয়নেও বিবর্তনবাদ সৃষ্টি করে এক নতুন প্রেরণা। প্রাণীদেহের গতিপ্রকৃতি যেমন তাদের পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মানুষকেও তেমনি দেখা হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির অংশ হিসাবে। সমাজবিজ্ঞানীরা ক্রমশ উপলব্ধি করলেন যে, এসব প্রতিষ্ঠান এক অবিরাম পরিবর্তনধারার অধীন। এরা স্থির হয়ে নেই; সুতরাং সমাজবিজ্ঞানে অনপেক্ষ নিয়মের কোনো স্থান নেই। আমরা শুধু সমাজের বর্ণনা ও শ্রেণীবিভাগ করতে পারি, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই পূর্ণাঙ্গতার দাবি করতে পারি না।

Post a Comment

0 Comments