Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন আহমেদ-এর আত্মজীবনী ফাউনটেনপেন

humayun_ahmed.jpg
হুমায়ূন আহমেদ-এর আত্মজীবনী
ফাউনটেনপেন

১ থেকে ৭
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা

এক মাস ধরে বইমেলা চলছে। আমি ঘরে বসে বিরহের বেলা কাটাচ্ছি। মেলায় যেতে না পারার বিরহ। সম্প্রতি ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় আমাকে কিছুটা সময় বারান্দায় বসে থাকতে হয়। বারান্দাটা এমন যে এখান থেকে দালানকোঠা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তবে একটা আমগাছ চোখে পড়ে। আমগাছে মুকুল এসেছে। বসন্তের নমুনা বলতে এটুকুই।
আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলেই পুত্র নিষাদ পাশে এসে বসে। সে এখন 'কেন?'_স্টেজে আছে। এই স্টেজের বাচ্চারা 'কেন?' 'কেন?' করতেই থাকে।
বাবা, বারান্দায় বসে আছ কেন?
আমগাছ দেখছি।
আমগাছ দেখছ কেন?
দেখতে ভালো লাগছে, তাই দেখছি।
ভালো লাগছে কেন?
জানি না।
জানো না কেন?
বাবা! যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এখন তোমাকে ধরে আমি একটা আছাড় দিব।
আছাড় দিবে কেন?
পুত্র কেন কেন করতে থাকুক, আমি মূল রচনায় ফিরে যাই। বইমেলা বিষয়ক রচনা। মেলায় নিজে যেতে না পারলেও টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকার কলামে মেলা দেখা হচ্ছে। ভালোমতোই হচ্ছে। মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখার মতো। অনেক খুঁটিনাটি চোখে পড়ছে। মেলায় উপস্থিত থাকলে চোখে পড়ত না।
কিছু লেখক এবং প্রকাশককে দেখলাম ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির। ঐতিহ্য বজায় রাখতেই হবে। মেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হতে হবে। অন্য কোথাও হওয়া যাবে না।
গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ হাঁটছে। বই হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। বাচ্চারা ভিড়ে অস্থির হয়ে কাঁদছে। কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে। বখাটে ছেলেরা থাকছে যদি সুযোগ বুঝে কোনো তরুণীর গায়ে হাত রাখা যায়। তসলিমা নাসরিন দেশে নেই। তরুণী লাঞ্ছিত হলেও লেখার কেউ নেই। লাঞ্ছিত হলেও ঐতিহ্য তো বজায় থাকবে।
টিভিতে বইমেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। যদি আগুন লাগে, যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে কি দমকলের গাড়ি পেঁৗছতে পারবে? ছোটাছুটি শুরু হলে বাচ্চারা কোথায় যাবে? কলকাতার অতি প্রশস্ত বইমেলাও একবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। সে সময় আমি কলকাতার বইমেলায়। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল আমার জানা আছে।
ঐতিহ্য-প্রেমিকদের বলছি, ঐতিহ্যও বদলায়। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা ধুতি পরতেন। ধুতি পরার ঐতিহ্য থেকে আমরা সরে এসেছি। আগের লেখকরা ঝর্না কলমে লিখতেন। এখন অনেকেই কম্পিউটারে লেখেন। ঝর্না কলম নামক ঐতিহ্যের মৃত্যু।
বাংলা একাডেমীর পাশেই বিশাল মাঠ পড়ে আছে। সেই মাঠ কারো চোখে পড়ছে না। আমরা আটকে আছি খুপরিতে। বাংলা একাডেমীর কর্তারা কেন মেলা পরিচালনা করছেন তাও বুঝতে পারছি না। মেলা পরিচালনা করবেন প্রকাশকরা। নীতি তাঁরা নির্ধারণ করবেন।
বইমেলায় হেঁটে বেড়ানো, নতুন প্রকাশিত বই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ থেকে বাংলা একাডেমী পাঠককে বঞ্চিত করছে। মেলা তাঁদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েই কাজটা করছে। প্রসঙ্গক্রমে অতীতের এক বইমেলার ঘটনা বলি, আমি একটা স্টলে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার কাছে চলে এলেন। তাঁর নাম, আচ্ছা থাক, নাম বললাম না। ডিজির চোখ-মুখ শক্ত। তিনি বললেন, আপনি মেলায় থাকতে পারবেন না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন পারব না?
তিনি বললেন, আপনার কারণে মেলায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটবে। আপনাকে এক্ষুনি উঠে যেতে হবে।
আমি বললাম, ব্যবস্থা করে দিন যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। লেখক হিসেবে আমার অধিকার আছে মেলায় আসার। বইমেলা শুধু পাঠক-প্রকাশকের মেলা নয়। লেখকদেরও মেলা।
আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আপনাকে মেলা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আমি বেশ মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। তারপর অবশ্য ঘটনা অনেকদূর গেল। অনেক প্রকাশক ঘোষণা করলেন তাঁরা মেলা করবেন না। সংসদে পর্যন্ত বিষয়টি উঠল। বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করলেন, আমার লেখা তাঁর কত পছন্দ ইত্যাদি।
আমি মেলায় যাওয়া এরপর থেকে বন্ধই করে দিলাম। এক দিন কিংবা দুদিন শুধু যাই। আমার অবস্থা চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার মন পড়ে থাকে মাটিতে। আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকি, আমার মন পড়ে থাকে বইমেলায়।
আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মাজহারুল ইসলাম, অন্যপ্রকাশের মালিক। তিনি হুমায়ূন আহমেদ টাইপ বাজারি লেখকদের বই ছেপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার স্টলের সামনে নাকি ভিড় লেগে থাকে। অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীরা মাছির মতো ভিড় করে বাজারি লেখকদের বই কিনতে চায়।
ভালো কথা, বাজারি লেখক বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাঁদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তাঁরা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা, তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমণের নমুনা, 'অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎসাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।...'
কালজয়ী এসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা_
কালজয়ী : কেমন আছেন?
আমি : জি ভালো।
কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ী : (গম্ভীর)
আমি : আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।

কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাঁদের টেলিফোন পেলে আতঙ্কিত বোধ করি। কেন আতঙ্কিত বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি_
উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে, কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।
হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।
কে শুইয়েছেন?
বদরুদ্দীন উমর।
কোথায় শোয়ালেন?
সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন, আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।
এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক বই হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম_ কোয়ান্টাম রসায়ন । সম্ভবত ওনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় (ঙষফ ঋড়ড়ষং' ঈষঁন) আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যেকোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়।
এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম_ 'এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।'
সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোচকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা নয়, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তাঁরাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে?
আচ্ছা শিক্ষা আপাতত থাকুক। মহান কালজয়ীরা বর্তমানের কুসাহিত্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির হতে থাকুন, আমি ফিরে যাই বইমেলায়। আপনারা কি জানেন, মেলায় প্রকাশিত চমৎকার সব প্রচ্ছদের বইগুলোর বেশির ভাগ লেখক প্রবাসী! তাঁরা বছরে একবার ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে দেশে আসেন। প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তি হয়। খরচ তাঁদের। প্রকাশকরা শুধু বই ছেপে দেবেন। প্রবাসী লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন খুব ঘটা করে হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের হাতে কাজকর্ম নেই বলেই হয়তো মোড়ক উন্মোচন নামক অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাকলেই পাওয়া যায়।
দুই বছর আগের কথা। এক প্রবাসী কবির বই বের হয়েছে, তিনি চাচ্ছেন আমি বইটির মোড়ক উন্মোচন করি। আমি বললাম, না। আমি একদিনের জন্য মেলায় যাই। সেদিনটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নষ্ট করব না।
ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত মন খারাপ করলেন। তাঁদের মন খারাপ দেখে আমার নিজের মন খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন বিকল্প প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আপনারা নুহাশ পল্লীতে চলে আসুন। নুহাশ পল্লীর দিঘিতে আমার একটা নৌকা আছে। আপনি নৌকায় বসে নিজের কবিতা আবৃত্তি করবেন। আমরা দিঘির ঘাটে বসে থাকব। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করে আপনাকে একটা কপি দেব। সেই ভিডিও আপনি বন্ধুবান্ধবদের দেখাবেন। এর জন্য আপনাকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। নুহাশ চলচ্চিত্র ভিডিও করে দেবে।
ভদ্রলোক আনন্দে অভিভূত হলেন।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান হলো। তিনি নৌকায় দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমাদের ব্যবস্থা দেখে তাঁর চোখে একটু পর পর পানি আসছে। তিনি চোখ মুছছেন। তাঁর স্ত্রীও আমার পাশে বসেই কবিতা শুনছিলেন। তিনি একপর্যায়ে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো, তাঁদের দুজনের জীবনে অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা আজকের অভিজ্ঞতা। তাঁরা সারা জীবন এই সুখস্মৃতি অন্তরে লালন করবেন। তাঁর স্বামীর একটা কবিতার বইও যদি কেউ না কেনে, তাতেও কিছুই আর যায় আসে না।
এই প্রবাসী কবির কথা থাকুক, অন্য আরেকজনের গল্প করি। তিনি কানাডাপ্রবাসী কবি। তাঁর নাম ইকবাল হাসান। প্রতিবছরই বইমেলায় তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই কবি আমাকে একবার ভালো বিপদে ফেলেছিলেন। বিপদের গল্পটি বলা যেতে পারে।
আমি গিয়েছি নিউইয়র্কে। বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছেন। আমি বইমেলার অতিথি। মেলা উপলক্ষে কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান এসেছেন। তিনি আমাকে ধরে বসলেন, একটা ইন্টারভিউ তাঁকে দিতেই হবে। আমার নিশ্চয়ই তখন শনির দশা চলছিল, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। ইন্টারভিউ পর্ব শুরু হওয়া মাত্র বুঝলাম_ঘটনা অন্য। ইকবাল হাসানের প্রশ্নের নমুনা শুনলে পাঠকও বলবেন, ঘটনা অন্য। প্রশ্নের নমুনা_
'অনেকেই এখন বলছেন আপনি উপন্যাস হিসেবে যা লেখেন তা আসলে অপন্যাস। আপনি কী বলেন?'
'আপনার হালকা লেখাগুলি কি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে লেখা হয়?'
'জীবনের গভীর বোধ আপনার লেখায় অনুপস্থিত কেন?'
'একই গল্প আপনি একটু এদিক ওদিক করে লেখেন। আপনার এই সীমাবদ্ধতার কারণ কী?
'আপনার বানানো নাটক-সিনেমা আপনার বইগুলির মতোই হালকা এবং অগভীর। এর কারণ কী?'
আমি হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তিনি যে উত্তর শুনতে চাইছেন তা-ই বললাম। বললাম, আমার লেখা সস্তা। টাকার জন্য লেখি_এইসব।
এবারের বইমেলায় (২০১০) ইকবাল হাসান এসেছেন। সমকাল পত্রিকায় কলাম লিখছেন। হঠাৎ সেখানে আমাকে নিয়ে এক লেখা। কি লেখা থাকবে জানি। ভদ্রভাবে গালাগালি। কবিরা সুন্দর কাব্যময় গদ্যে গালাগালি করতে পারেন। ইকবাল হাসানের লেখা পড়ে চমকালাম। ইকবাল হাসান উল্টাগীত ধরেছেন। রচনা পাঠ করে মনে হলো_হুমায়ূন আহমেদ একজন মহান লেখক। যাঁরা তার নিন্দামন্দ করেন, তাঁরাও সুযোগ পেলেই গোপনে তার বই পড়েন ইত্যাদি।
আমার খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু খুশি হওয়া গেল না। মনে হলো কবি নিশ্চয়ই অসুস্থ। সুস্থ ইকবাল হাসান এ ধরনের লেখা অবশ্যই লিখবেন না।
তিনি দুপুরে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, আমি তাঁর লেখা পড়েছি কি না।
আমি বললাম, পড়েছি। উল্টাগীত গাইছেন কেন?
কবি বললেন, আগে যখন আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছি, তখন আমি অপরিপক্ব ছিলাম।
আমি বললাম, এখন কি পেকেছেন?
কবি হতাশাগ্রস্ত গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, আমি এ দেশের একমাত্র কবি যে আপনার নুহাশ পল্লী নিয়ে কবিতা লিখেছে। আর কেউ কিন্তু লিখেনি। আপনি কেন এরকম করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন!
আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। তাঁর লেখা কবিতাটি পত্রস্থ করা হলো।

নুহাশ পল্লী

নিঃশ্বাস ফেলবে কোথায়? নেবে শ্বাস?
শরীরকে দেবে অক্সিজেন? এখন বাতাসে
শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড_শুষে নেবে তেমন বৃক্ষ কোথায়?
যেদিকে তাকাবে তুমি শুধু দূষিত বাতাস। 'বড় হয়ে
দেখবে, পৃথিবী সুন্দর কতো'_মধ্যবয়সে এসে দেখি,
এসব আশ্বাসবাণী শুধু শূন্যে ঝরে পড়ে। হাওয়া নেই
শহরে ও গ্রামে। সবকিছু গিলে খাচ্ছে বিষাক্ত আকাশ।

যদিও স্বপ্ন দ্যাখায় প্রভাতের রোদ আর রাতের নক্ষত্র
তবু ভাবি : মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো, আর কবে
আমাদের গ্রামগুলো নুহাশ পল্লীর মতো স্বয়ম্ভর হবে?
[আকাশপরী, ইকবাল হাসান, পৃষ্ঠা-১৫, দি রয়েল পাবলিশার্স, ঢাকা]

পাদটীকা
পোকারা আমাদের ওপর রাগ করে কামড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় বলেই কামড়ায়। সমালোচকদের বেলায়ও কথাটা সত্য। তারা আমাদের রক্ত চায়, আমাদের কষ্ট চায় না।
ফ্রেডারিখ নীট্শে

ফাউনটেনপেন

ধর্মকর্ম

(বাংলা ভাষার অতি বিচিত্র বিষয় হলো শব্দের দ্বৈততা_গল্পগুজব, ফলমূল, হাসিঠাট্টা, খেলাধুলা। ধর্ম শব্দটি বেশিরভাগ সময়ই কর্মের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সম্ভবত কর্মকে আমরা ধর্মের সমার্থক ভাবি।)
আমি এসেছি অতি কঠিন গোঁড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি 'মৌলবিবাড়ি' নামে এখনো পরিচিত।
ছোটবেলায় দেখেছি দাদার বাড়ির মূল অংশে বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দার আড়ালে থাকতেন মহিলারা। তাদের কণ্ঠস্বর পুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় তারা ফিসফিস করে কথা বলতেন। হাতে চুড়ি পরতেন না। চুড়ির রিনঝিন শব্দও পরপুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ। দাদাজান বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন হাততালির মাধ্যমে। এক হাততালির অর্থ-পানি খাবেন। দুই হাততালি-পান তামাক ইত্যাদি।
একবার বড় ঈদ উপলক্ষে দাদার বাড়িতে গিয়েছি। আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। দাদাজান ডেকে পাঠালেন। বললেন, কলেমা তৈয়ব পড়।
আমি বললাম, জানি না তো।
দাদাজানের মুখ গম্ভীর হলো। দাদিজান আবার তাৎক্ষণিক শাস্তির পক্ষে। তিনি বললেন, পুলারে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, কলেমা জানে না।
দাদাজান বিরক্তমুখে বললেন, সে ছোট মানুষ। শাস্তি তার প্রাপ্য না। শাস্তি তার বাবা-মা'র প্রাপ্য।
বাবা-মা'র শাস্তি হয়েছিল কি না আমি জানি না। দাদা-দাদির কাছ থেকে মুক্তি পাচ্ছি এতেই আমি খুশি। ছুটে বের হতে যাচ্ছি, দাদাজান আটকালেন। কঠিন এক নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশে আমি সব জায়গায় যেতে পারব, একটা বিশেষ বাড়িতে যেতে পারব না। এই বিশেষ বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। গাছপালায় ঢাকা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে টলটলা পানির দিঘি। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওই বাড়িতে কেন যাব না?
দাদিজান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পুলা বেশি কথা কয়। এরে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, মুখে মুখে কথা।
দাদাজান শাস্তির দিকে গেলেন না। শীতল গলায় বললেন, ওই বাড়িতে ধর্মের নামে বেদাত হয়। ওই বাড়ি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ। দিনের বেলা যাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর না।
আমি ছোটচাচাকে ধরলাম যেন ওই বাড়িতে যেতে পারি। ছোটচাচা বললেন নিয়ে যাবেন। ওই বাড়ির বিষয়ে ছোটচাচার কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো_ওই বাড়ি মুসলমান বাড়ি। তবে তারা অন্যরকম মুসলমান। সন্ধ্যার পর পুরুষ মানুষরা নাচে।
ঘটনা কী জানার জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সারাটা দিন ছটফটানির ভেতর দিয়ে গেল। সন্ধ্যা মিলাবার পর ছোটচাচার সঙ্গে ওই বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হলাম। বাড়ির প্রধান শান্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ আমাকে কোলে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ফয়জুরের ছেলে আসছে। ফয়জুরের বড় পুলা আসছে। এরে কিছু খাইতে দাও।
সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় সত্যি সত্যি পুরুষদের নাচ শুরু হলো। ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচের সঙ্গে সবাই মিলে একসঙ্গে বলছে 'আল্লাহু আল্লাহু'। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভেতর মত্ততা দেখা দিল। একজন অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চক্রাকারে ঘুরে নাচতেই থাকল। ছোটচাচা গলা নামিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, একটা মাত্র পড়েছে। আরও পড়ব। ধুপধাপ কইরা পড়ব। দেখ মজা।
ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে আরো একজন পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে_এরা কি কোনোভাবে সুফিবাদের সঙ্গে যুক্ত? ড্যান্সিং দরবেশ? এদের পোশাক সে রকম না, লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। কিন্তু নৃত্যের ভঙ্গি এবং জিগির তো একই রকম। ড্যান্সিং দরবেশদের মধ্যে একসময় আবেশ তৈরি হয়। তারাও মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এখানেও তো তাই হচ্ছে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুফিবাদ আসবেইবা কীভাবে? কে এনেছে? কেন এনেছে? যখন কলেজে পড়ি (১৯৬৬) তখন কিছু খোঁজখবর বের করার চেষ্টা করেছি। এই বিশেষ ধরনের আরাধনা কে প্রথম শুরু করেন? এইসব। উত্তর পাইনি। তাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তার নমুনা দিচ্ছি।
প্রশ্ন: নাচতে নাচতে আপনি দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন কী হয়?
উত্তর: ভাবে চইলা যাই।
প্রশ্ন: কী রকম ভাব?
উত্তর: অন্য দুনিয়ার ভাব।
প্রশ্ন: পরিষ্কার করে বলুন।
উত্তর: বলতে পারব না। ভাবের বিষয়।
প্রশ্ন: চোখের সামনে কিছু দেখেন?
উত্তর: ভাব দেখি। উনারে দেখি।
প্রশ্ন: উনারে দেখেন মানে কী? উনি কে?
উত্তর: উনি ভাব।
সুফিবাদের উৎস হিসেবে ধরা হয় নবীজি (দ.)-এর সঙ্গে জিব্রাইল আলায়েস সালামের সরাসরি সাক্ষাতের হাদিস থেকে। একদিন নবীজি (দ.) বসে ছিলেন। মানুষের রূপ ধরে জিব্রাইল আলায়েস সালাম তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একটি হলো-নিবেদন (Submission, ইসলাম), আরেকটি হলো বিশ্বাস (Faith, ঈমান), আর তৃতীয়টি হলো সুন্দর কর্মসাধন (Doing the beautiful, Bnmvb)।
প্রথম দুটি ইসলাম এবং ঈমান, ধর্মের পাঁচস্তম্ভের মধ্যে আছে। তৃতীয়টি নেই। এই তৃতীয়টি থেকেই সুফিবাদের শুরু।
সুফিবাদ বিষয়ে আমার জ্ঞান শুধু যে ভাসাভাসা তা নয়, ভাসাভাসার চেয়েও ভাসাভাসা। দোষ আমার না। দোষ সুফিবাদের দুর্বোধ্যতা এবং জটিলতার। সুফি সাধকদের রচনা পাঠ করেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। পশ্চিমাদের লেখা সুফিবাদের বইগুলো জটিলতা বৃদ্ধি করেছে, কমাতে পারেনি।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সুফিবাদ বলছে_'I was a Hidden Treasure, so I loved to be known. Hence I created the creatures that I might be known.' [আমি ছিলাম লুকানো রত্ন। নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা হলো। আমি সৃষ্টি করলাম যাতে প্রকাশিত হই।]
সুফিবাদের একটি ধারণা হলো_সৃষ্টিকর্তা মানুষকে করুণা করেন এবং ভালোবাসেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারবে কিন্তু করুণা করতে পারবে না। ভালোবাসা দু'দিকেই চলাচল করতে সক্ষম, করুণার গতি শুধুই একমুখী।
একইভাবে মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে। পশুপাখি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে না।
জবধষরঃু বা বাস্তবতা নিয়ে সুফিদের অনেক বিশুদ্ধ চিন্তা আছে। তাদের চিন্তার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার কিছু মিল আছে। সুফিরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বাস্তব।
সুফিরা বলেন, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে আমরা দেখি, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমেই আমরা শুনি।
সুফিদের আরাধনার মূল বিষয়টি আমার পছন্দের। তাঁরা প্রার্থনা করেন-'Show me the things as they are.' [বস্তুগুলো যে-রকম আমাকে সে-রকম দেখাও।] তাঁদের প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বস্তুগুলো যে-রকম দেখছি আসলে সে-রকম না। জবধষরঃু-র সমস্যা চলে আসছে।
মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে আল্লাহপাকের সাক্ষাতের ঘটনার সুফি ব্যাখ্যা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পাঠকদের সঙ্গে সুফি ব্যাখ্যা ভাগাভাগি করতে চাচ্ছি।
তুর পর্বতের সামনে এই সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে। তুর পর্বত কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মূসা (আ.) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুফি ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ বাস্তব আর সবই অবাস্তব। কাজেই বাস্তব আল্লাহর উপস্থিতিতে অবাস্তব পাহাড় মিলিয়ে গেল।
আমি কি ধর্মকর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল করার চেষ্টা চালাচ্ছি? মনে হয় তাই। সহজিয়া ধারায় চলে আসা যাক। সুফিদের কথা বাদ। নিজের কথা বলি।
ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। পাঠকদের হজরত শাহ মখদুম সম্পর্কে একটি অন্যরকম তথ্য দিই। তাঁর জীবনী লেখা হয় ফারসি ভাষাতে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের আদেশে এই জীবনী ফারসি থেকে বাংলা তরজমা করা হয়। এই বাংলা তরজমা আদি বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য ছিল। বইটি একসময় বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন প্রকাশ করেছিল। আমার কাছে একটি কপি ছিল। বিটিভির নওয়াজেশ আলী খান পড়তে নিয়ে ফেরত দেননি। বইটির দ্বিতীয় কপি জোগাড় করতে পারিনি। (ফাউনটেনপেন লেখায় যাঁরা আমার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে ফেরত দেননি তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কাজেই সাবধান। আমার আরেকটি প্রিয় গ্রন্থ মিসরের গভর্নরকে লেখা হজরত আলীর চিঠি কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান পাঁচ বছর আগে নিয়েছেন। এখনো ফেরত দেননি।)
পূর্বকথায় ফিরে যাই। আমি যে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মাজারে যাই তা কিন্তু না। যে-কোনো ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ নিয়েই পাবনা শহরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে একদিন উপস্থিত হলাম। ইনি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দুর ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি বইতেই থাকবে র:স্থা যা অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীর্ষেন্দুর জবানিতে_একসময় তিনি জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আত্দহননের কথা চিন্তা করছিলেন। তখন অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। অনুকূল ঠাকুর হাত দিয়ে শীর্ষেন্দুকে স্পর্শ করা মাত্র কিছু একটা ঘটে গেল। শীর্ষেন্দু জীবনের প্রতি মমতা ফিরে পেলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুও এরপর থেকেই।
অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতরা আমাকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন। দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। আশ্রমের প্রধান অনুকূল ঠাকুরের বিশাল এক তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুগ্ধ গলায় বললেন, ঠাকুরের রহস্যটা একটু দেখুন স্যার। আপনি যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনে হবে ঠাকুর আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তরে দাঁড়ান কিংবা পুবে দাঁড়ান, ঠাকুরের দৃষ্টি আপনার দিকে।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, সরাসরি ক্যামেরা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি একটি ছবি তোলেন সেই ছবিতেও একই ব্যাপার হবে। সবকিছুতে মহিমা আরোপ না করাই ভালো। সেবায়েত আমার কথায় মন খারাপ করলেও বিষয়টি স্বীকার করলেন।
অনেক বছর আগে নেপালে হনুমানজির মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরের একজন সেবায়েতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানুষটা বুদ্ধিমান। আমি তাঁকে কাছে ডেকে বললাম, ভাই, মন্দিরের কাছে কিছু কুকুর দেখতে পাচ্ছি। ওরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে পারবে, আর আমি মানুষ হয়ে যেতে পারব না। এটা কি ঠিক?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাইনি। কেন জানি হঠাৎ করে মন উঠে গেল।
আমাদের অতি পবিত্র স্থান মক্কা শরীফে অমুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমাদের নবীজি (দ.)-এর জীবদ্দশায় অনেক অমুসলমান সেখানে বাস করতেন। কাবার কাছে যেতেন। তাদের ওপর কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল বলে আমি বইপত্রে পড়িনি। ধর্ম আমাদের উদার করবে। অনুদার করবে কেন?

পাদটীকা:
প্রশ্ন: মুসলমান মাত্রই বেতের নামাজের কথা জানেন। তিন রাকাতের নামাজ। বেতের শব্দের অর্থ বেজোড়। এক একটি বেজোড় সংখ্যা। এক রাকাতের নামাজ কি পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ যায়।
(আমি মনগড়া কথা বলছি না। জেনেশুনেই বলছি।)
ফাউনটেনপেন
ছাইঞ্চ মিয়া

স্যার, আমার নাম 'ছাইঞ্চ' মিয়া।
কী নাম বলেছ?
ছাইঞ্চ মিয়া।
গ্রামের মানুষদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখার প্রবণতা আছে। তবে সেসব নাম সহজ হয়। উচ্চারণে অসুবিধা হয় না। 'ছাইঞ্চ' যথেষ্ট জটিল। আমি বললাম, এই নামের অর্থ কী?
লেহা-পড়া। এই নামের অর্থ লেহা-পড়া।
আমি বললাম, সায়েন্স থেকে ছাইন্স? বিজ্ঞান?
জায়গামতো ধরছেন স্যার। এইটাও আমার নাম।
ঘটনা যা জানলাম তা হলো ছাইন্স মিয়ার আসল নাম ছাত্তার। সে আট-নয় বছর বয়সে নীলগঞ্জ স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক আজিজ মাস্টারের বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে যোগ দেয়। আজিজ মাস্টার ছাত্তারের নানান বিষয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল দেখে তাকে আদর করে ডাকতেন সায়েন্স। সেখান থেকে ছাইঞ্চ মিয়া।
এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্ত সবল। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ। গ্রামের মানুষদের সহজে টাক পড়ে না। এর মাথায় চুলের বংশও নেই। ছাইঞ্চ মিয়া কাজকর্ম কিছু করে না। স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমায়। ছাত্রদের হোস্টেলে রান্নাবান্নার বিনিময়ে খাবার পায়। মাছ মারায় তার বিশেষ পারদর্শিতা আছে। কৈ জাল দিয়ে কৈ মাছ ধরার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে নাকি কিছুদিন পরপর মাছ মারার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে।
ছাইঞ্চ মিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন নিয়া আসছি স্যার। অনেকরে জিজ্ঞাস করেছি কেউ বলতে পারে নাই। আজিজ স্যারে বাঁইচা থাকলে উনি পারতেন। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ খোদার আলমে নাই বললেই চলে।
আমি বললাম, অনেকেই যখন পারে নাই তখন আমারও না পারার কথা।
প্রশ্নটা কী?
জগতের সব ফল গোল। বেদানা, আপেল, বরই, আঙুর, আম, কাঁঠাল, ডাব, শরিফা। কিন্তু কলা ফলটা লম্বা। এর কারণ কী?
আমি একটু থতমত খেলাম। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, বুঝতাছি আপনে পারতেছেন না। আমি নিজে নিজে একটা উত্তর বাইর করেছি। স্যার বলব?
বলো।
আল্লাপাক গোল পছন্দ করেন এইজন্যে সব ফল গোল। কলা আল্লাপাক পছন্দ করেন না বিধায় কলা লম্বা। কলা খাওয়া এই কারণে ঠিক না। আমি সব ফল খাই, কলা খাই না।
আমি কিছু বললাম না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, যে ফল যত গোল সেটা তত 'উবগার', আমি হিসাবে এইটা পাই। স্যার ঠিক আছে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতটুকু জানো?
বাংলা লেখতে-পড়তে পারি। নয় ঘর পর্যন্ত নামতা জানি। আজিজ স্যার শিখায়েছেন। ৯ একে ৯, ৯ দুকুনে ১৮, তিন নং ২৭ ...
ছাইঞ্চ মিয়া নয়ের ঘরের নামতা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। মাছ মারতে যাবে। তার কাছে শুনলাম সে কৈ মাছ ধরার একটা পদ্ধতি বের করেছে। এ পদ্ধতিতে শুধু ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা পড়ে, ডিম ছাড়া কৈ কখনো না।

বিজ্ঞানের শুরুটা কোথায়?
জ্ঞানীরা বলেন, শুরু হলো কৌতূহলে। মানুষ কৌতূহলী হওয়ার কারণেই বিজ্ঞান। গাছের অনুভূতি আছে, কৌতূহল নেই বলেই বিজ্ঞানে গাছের অবদান নেই।
আমি জ্ঞানী না বলেই হয়তো জ্ঞানীদের কথা নিতে পারছি না। আমার মতে, বিজ্ঞানের শুরু খাদ্য অনুসন্ধানে। খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে_এই ব্যাকুলতা থেকেই বিজ্ঞান। আর গাছের কৌতূহল নেই তাইবা আমরা ধরে নেব কেন? আমার মনে হয়, গাছ তার নিজের মতো করেই কৌতূহলী। আমরা তার কৌতূহল ধরতে পারছি না।
নুহাশ পল্লীতে আমার দিন কাটে গাছপালার সঙ্গে। তাদের জগৎ বোঝার সাধ্যও আমার নেই। সেই চেষ্টাও বড় ধরনের বোকামি ছাড়া কিছু না। তারপরও গাছপালার বনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি_গাছদের কি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? তারা কি ভাবতে পারে? কল্পনা করতে পারে?
বিশাল বৃক্ষকে 'বনসাই' বানানোর প্রবণতা আজকাল দেখতে পাচ্ছি। টবে বটগাছ, ঝুড়ি নেমে গেছে_এইসব। বনসাই বৃক্ষ যতবার দেখি ততবারই মন খারাপ হয়। একটা বিশাল বৃক্ষকে পঙ্গু বানিয়ে রাখার মানে কী? গত বৃক্ষমেলা থেকে অনেক দাম দিয়ে আমি দুটো বনসাই গাছ কিনলাম। একটা বট আরেকটা তেঁতুল। এই দুই বামুন বৃক্ষকে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে এসে বললাম, আজ তোদের বনসাই অবস্থা থেকে মুক্তি দেব। তোরা সাধারণ বৃক্ষের মতো বড় হবি এবং অবশ্যই বলবি_একজন মানুষ আমাদের কষ্ট বুঝতে পেরে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তোরা বলবি_মানুষের জয় হোক।
বনসাই গাছ দুটি পুঁতে দিলাম। এক বছরের আগেই তারা স্বাস্থ্যে, সৌন্দর্যে, প্রাণে ঝলমল করে উঠল। তারা এখন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে। আমার নানাবিধ পাগলামির একটি হচ্ছে, এই দুটি গাছের সঙ্গে কথা বলা। কথা বলার নমুনা (বটগাছের সঙ্গে)_
এই তোর অবস্থা কিরে? ঝুড়ি এর মধ্যেই নামিয়ে ফেলেছিস? ঝুড়ি নামানোর মতো অবস্থা তো হয়নি। ঘটনা কী? মালী তোকে ঠিকঠাক যত্ন করছে?
গাছের সঙ্গে তুই তুই করে কেন কথা বলি? জানি না।
গাছের কথা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকুক। আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব, এখন বিজ্ঞান-কথা। একটা কুকুর দিয়ে শুরু করা যাক। সে ভরপেট খেয়ে উঠোনে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে খাদ্যের সন্ধানে সে যাবে না। এর অর্থ এই না সে তার চারপাশের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শামুক তা-ই করত। খাওয়া শেষ হলেই খোলসের ভেতর ঢুকে খোলসের মুখ বন্ধ করে দিত। কুকুর তা করছে না। সে বিশ্রাম নিতে নিতেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ কান খাড়া করে দূরের কোনো শব্দ শুনছে। সে তথ্য সংগ্রহ করছে। এই তথ্যের কিছুটা সে তার মস্তিষ্কে জমা করে রাখবে। অনেকটাই ফেলে দেবে। যে প্রাণী যত উন্নত তার তথ্য সংগ্রহ এবং জমা রাখার পদ্ধতিও তত উন্নত। সৌরজগতের সবচেয়ে উন্নত প্রাণী মানুষের তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা বিস্ময়কর। এই তথ্য সংগ্রহের প্রায় সবটাই হলো কৌতূহলের কারণে।
পেনডোরার বাক্সের ঘটনা তো সবার জানা। গল্পটা এ রকম_পেনডোরাকে একটা বাক্স দিয়ে বলা হলো, খবরদার এই বাক্স তুমি খুলবে না। কৌতূহলের কারণে পেনডোরা সেই বাক্স খুলল, বাক্স থেকে বের হলো দুঃখ, কষ্ট, জরা, দুর্ভিক্ষ, ভয়ঙ্কর সব জিনিস। সেই থেকেই এসব পৃথিবীতে আছে। পেনডোরা কৌতূহলী না হলে আজ আমরা সুখে থাকতাম। পেনডোরার গল্পের সঙ্গে আদম-হাওয়ার গল্পের মিল আছে। কৌতূহলের কারণেই হাওয়া গন্ধম ফল খেলেন, নিজের স্বামীকে খাইয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত হলেন। পৃথিবীর গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট, জরা-মৃত্যু তাদের স্পর্শ করল।
মানুষ তথ্য সংগ্রহ করে, তথ্যগুলো সাজায়, তাদের ভেতরের মিল-অমিল বের করে। মিল-অমিলের পেছনে কী তা বের করার চেষ্টা করে এটাই বিজ্ঞান।
উদাহরণ দেই।

তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কাঠ ভাসে, তুলা ভাসে, পাখির পালক ভাসে, পিতল ডুবে যায়, পাথর ডুবে যায় ...

তথ্যের বিচার
লোহা, পিতল, পাথর পানিতে ডুবে যায়।
কাঠ, তুলা, পাখির পালক ভাসে।

বিজ্ঞান
পানির চেয়ে ভারী বস্তু ডুবে যাবে, পানির চেয়ে হালকা বস্তু ভেসে থাকবে।
জ্ঞান কিন্তু এইখানেই থেমে থাকবে না। আরও এগুবে। নতুন তথ্য যুক্ত হবে যেমন_

নতুন তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কিন্তু লোহার তৈরি নৌকা ভাসে।
কেন?
পিতল নদীতে ডুবে যায়, কিন্তু পিতলের কলসি পানিতে ভাসে। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হলো। একদিন আর্কিমিডিস স্নানঘরের চৌবাচ্চায় নগ্ন হয়ে স্নান করতে নামলেন। নেমেই উত্তর পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঊঁৎবশধ! কথিত আছে তিনি নগ্ন অবস্থায় রাজপথে নেমে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ঊঁৎবশধ! ঊঁৎবশধ! পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি।

লেখক হিসেবে আমাকে মাঝে মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। যেমন, আপনার কি মৃত্যুভীতি আছে?
উত্তরে আমি বলি, আমার মৃত্যুভীতি নেই, তবে মৃত্যুর বিষয়ে প্রবল বিদ্বেষ আছে। আমি মোটামুটি এক হাজার বছর বেঁচে তারপর মরতে চাই।
কেন?
কচ্ছপের মতো তুচ্ছ একটি প্রাণী তিনশ, সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে আর মানুষের মতো এত ক্ষমতাধর প্রাণী সত্তর-আশি বছরেই শেষ। এর কোনো অর্থ আছে?
এক হাজার বছর বাঁচতে চান কেন?
বিজ্ঞানের মহান আবিষ্কারগুলো দেখে মরতে চাই। পেনডোরার বাক্স থেকে যেসব ভয়ঙ্কর জিনিস বের হয়েছিল বিজ্ঞান সব ক'টাকে আবার বাক্সে ঢোকাবে। সেই বাক্স বিজ্ঞান ধ্বংস করে দেবে। এই দৃশ্য দেখার আমার শখ।
বিজ্ঞান কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে। যেমন আমরা কে? পৃথিবীতে কেন জন্ম নিয়েছি? আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি?
সৃষ্টির মূল রহস্য বিজ্ঞানই ভেদ করবে। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ বিজ্ঞান করবে। ফিলসফি না।
বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আমার আস্থা এবং ভরসা সীমাহীন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার যাত্রা অনংঃৎধপঃ-এর দিকে। কোয়ান্টাম থিওরি, স্ট্রিং থিওরি সবকিছু আমার মতো সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা চলে যাচ্ছে ফিলসফির দিকে। সুফিরা যেমন বলেন, সবই মায়া; বিজ্ঞানও বলা শুরু করেছে, সবই মায়া।
কবি রিল্কে (জধরহবৎ গধৎরধ জরষশব) তার ঞযব ঞবহঃয ঊষবমু-তে বলেছেন_
... যড় িধষরবহ, ধষধং ধৎব ঃযব ংঃৎববঃং
ড়ভ ঃযব পরঃু ড়ভ মৎরবভ.
এখানে মৎরবভ-এর বদলে ংপরবহপব লিখে দিলে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হবে_
... যড় িধষরবহ, ধষধং ধৎব ঃযব ংঃৎববঃং
ড়ভ ঃযব পরঃু ড়ভ ংপরবহপব.
আমি একপর্যায়ে গাছপালার কাছে ফিরে আসব বলেছিলাম, এখন ফিরলাম।
গাছপালা খাদ্যের সন্ধানে যেতে পারে না। তাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ে। এখান থেকেই সে খাবার তৈরি করে। সে খাদ্যচিন্তা থেকে মুক্ত। মুক্ত বলেই সে তার চিন্তা অন্যদিকে নিতে পারে। তার অনুভূতি আছে। তার সেই অনুভূতির নিয়ন্ত্রকও থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণটা কোথায়?
আমার ভাবতে ভালো লাগে বৃক্ষরাজি অনেক রহস্যই জানে। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব রহস্য মানুষকে জানাতে পারছে না। মানুষও তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে গাছের কাছ থেকে কিছু জানতে পারছে না। একদিন সীমাবদ্ধতা দূর হবে। বৃক্ষরাজি কথা বলা শুরু করবে। কী অদ্ভুত কাণ্ডই না তখন ঘটবে!
গাছপালা বিষয়ে নবীজী (দ.)-এর একটি চমৎকার হাদিস আছে। তিনি বলছেন, মনে করো তোমার হাতে গাছের একটি চারা আছে। যে-কোনোভাবেই হোক তুমি জেনে ফেলেছ পরদিন রোজ কেয়ামত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরেও গাছের চারাটি তুমি মাটিতে লাগিয়ো।

পাদটীকা
দর্শন হলো একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভুল শাস্ত্র।
_দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি
ফাউনটেনপেন

পড়াশোনা
বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার_পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।
আমরা যেভাবে পড়ি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। 'বৃদ্ধ বোকা সংঘের' আসরে যে কথা বলে তার কথা শুনতেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে কথা বলে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না।
একটা বয়স পার হলে মানুষ 'কথা বলা রোগ'-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু হয়। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তার পর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো কথাই নেই।
প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন, শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও, স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরত। এই স্নান থেকেই এসেছে 'স্নাতক' শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।
পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন স্নান করেনি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষ দিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।
আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।
ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গুরুর কথা শুনত। নবীজি (সা.)-কে আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়_'পড়ো! তোমার প্রভুর নামে...'
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।
আমার আত্দীয়স্বজনরা মাঝেমধ্যে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাঁদের ধারণা, আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলো নাকি 'অতি উত্তম'। তাঁদের কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তাঁরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে 'অতি উত্তম' কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা।
লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন_এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। তাঁরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারো সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহাবিরক্ত হতেন।
উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধু তাঁর মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ডমাস্টার আইজাক এসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।
আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম, সেটা ব্যাখ্যা করি। হঠাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন_
'হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করে সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।...'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় 'অন্যদিন' পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে)। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?
মাজহার বলল, স্যার, ভয়েস রেকর্ডার।
ভয়েস রেকর্ডার কেন?
এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না।
শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, স্যরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্দজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তার চেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে।
নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে...
তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই জোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে...
যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাঁচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটেই সময় কাটাই।
সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি_তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম 'ঙহব ঃযড়ঁংধহফ ড়হব ভরষস ঃযধঃ ুড়ঁ সঁংঃ ংবব নবভড়ৎব ুড়ঁ ফরব.' [এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে।] বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দিই।
বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি আধঃবৎ, ঞরসব ঃৎধাবষষবৎ'ং রিভব.
বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলো মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটি বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।
পৃথিবীর সব লেখকের দোষগুলো আমার মধ্যে আছে। একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প-উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না। বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই।
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দুটি স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়। এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ' বাংলায় 'পাঠবস্তু'। দুই মাস আগে মিসরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ'-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।
সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি_
১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশন। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশন কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয়নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।
অসনধংংধফড়ৎ ডরঃযড়ঁঃ ঈৎবফবহঃরধষং
ঝবৎমবর ঝহবমড়া (জধফঁমধ চঁনষরংযবৎং)
২. ঞযব ঞৎধাবষং ড়ভ গধৎপড়ঢ়ড়ষড়
এ বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।
সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) এক দল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।
এই বাংলাদেশেই আরেক দল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।
তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নিজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়েনি।
৩. ঞযব ঊহফ ড়ভ ঃরসব
এটি বিজ্ঞানের বই। 'সময়' কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।
৪. ঞযব উবসড়হ ঐধহঁহঃবফ ডড়ৎষফ
ঈধৎষ ঝধমধহ.
কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তাঁর লেখা ঈড়ংসড়ং বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটিই হারিয়েছে!
৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবুরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব 'বাদশাহ নামদার'। হুমায়ুন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি।
কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?
আছে। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি_তা জানানো।
আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটেছি একটা বিষয় জানার জন্যে_বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোশাকের কথা আছে, সংগীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।
লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।
অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা।
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখা_১. পথের পাঁচালী
২. দৃষ্টি প্রদীপ
৩. আরণ্যক
৪. ইছামতী
৫. দেবযান
ফাউনটেনপেন
৫.
হাসপাতাল

ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একটি কেবিন।
কবি শামসুর রাহমান শুয়ে আছেন। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল, গায়ে হাসপাতালের পোশাক নেই। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে শুয়ে আছেন। গেঞ্জি গলা পর্যন্ত ওঠানো বলে কবির বুক যে হাপরের মতো ওঠানামা করছে, তা দেখা যাচ্ছে। কবি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ নেই।
হাসপাতালের ওই কেবিনে আমার সঙ্গে আছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। আরো কেউ কেউ হয়তো ছিলেন, তাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কবির রোগযন্ত্রণা দেখছি, হঠাৎ সৈয়দ শামসুল হক নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, 'কবি, আপনাকে বাঁচতেই হবে। আমি আমার থেকে খানিকটা আপনাকে দিলাম।'
ঘোষণায় নাটকীয়তা ছিল, আবেগ ছিল; যুক্তি ছিল না। একজন তাঁর আয়ুর খানিকটা অন্যকে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের সব মানুষ এক মিনিট করে আয়ু কবিকে দান করলে কবি বেঁচে থাকতেন তিন শ বছর।
তবে মোগল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে নিজের আয়ু দান করেছিলেন। ঘটনাটা এ রকম_হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসকদের সব চিকিৎসা ব্যর্থ। এ সময় সুফি দরবেশ মীর আবুল কাশেম সম্রাটকে বললেন, আপনি আপনার জীবনের একটি অতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা করতে পারেন। এটা হবে শেষ চেষ্টা।
সম্রাট বাবর বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নিজ জীবন। এর বিনিময়ে আমি পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
মীর আবুল কাশেম আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! নিজের জীবন না, আপনি বরং বহুমূল্যবান কোহিনূর হীরা দান করে দিন।
সম্রাট বললেন, আমার পুত্রের জীবন কি সামান্য হীরকখণ্ডের তুল্যমূল্য?
আমি আমার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
সম্রাট তিনবার পুত্রের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনা করলেন। তিনবার বললেন, পুত্র, তোমার সমস্ত ব্যাধি আমি নিজ দেহে তুলে নিলাম। পরম করুণাময়, আমার প্রার্থনা কবুল কর।
হুমায়ুন অবচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় এসে পানি খেতে চাইলেন আর বাবর হলেন অসুস্থ।
আমার নিজের জীবনেও এ রকম একটা ঘটনা আছে। আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন। তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা করব। জায়নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, এই প্রার্থনা কবুল হবে।
শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারিনি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
নুহাশ পল্লীর ঔষধি উদ্যানে একটি স্মৃতিফলক আছে_ 'রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান'। তার নিচে লেখা_ 'আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি'।
আমার শিশুপুত্র তিন দিনের আয়ু নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিল। সে এই সৌন্দর্যের কিছুই দেখেনি। আমি প্রায়ই নিজেকে এর জন্য দায়ী করি।
থাকুক পুরনো কথা, হাসপাতালের অন্য গল্প করি।
গল্প-১
স্থান : হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর।
আমার বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি হয়েছি হাসপাতালে। নানান যন্ত্রপাতি এবং মনিটর শরীরে লাগানো। আমার বড় ছেলে নুহাশ আমাকে দেখতে এসেছে। নুহাশের বয়স পাঁচ। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। মনিটরে ঢেউয়ের মতো রেখা দেখা যাচ্ছে।
নুহাশ বলল, বাবা, এখানে কী হচ্ছে, আমি জানি।
কী হচ্ছে?
এই যে ঢেউয়ের মতো রেখাগুলো দেখছ, একসময় রেখা সমান হয়ে স্ট্রেইট লাইন হবে। তখন তুমি মারা যাবে।
আমি বললাম, ও!
নুহাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে মনিটর দেখছে। কখন স্ট্রেইট লাইন হবে, কখন তার বাবা মারা যাবে, এই প্রতীক্ষা।
গল্প-২
স্থান : বেলিভিউ হাসপাতাল, নিউইয়র্ক।
আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনি কেটে একটা সুই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি, মৃত্যু হলে দায়-দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার।
অপারেশন হবে ভোর ন'টায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?
হ্যাঁ।
কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্য তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?
তার মানে কী?
এই হাসপাতালে রোগীদের জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনার জন্য আলাদা ফি আছে। তুমি ফির ডলার জমা দিলেই প্রার্থনার ব্যবস্থা হবে।
হাসপাতাল হলো চিকিৎসার জায়গা। প্রার্থনার জায়গা_ এটা জানতাম না।
কাউন্সিলর বললেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তাদের আরোগ্যের হার বেশি। এ জন্যই প্রার্থনা বিভাগ খোলা হয়েছে।
আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই।
তোমার অপারেশনটি জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্য সুপারিশ করতে পারি। একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন।
ডিসকাউন্টের প্রার্থনায়ও আমার বিশ্বাস নেই।
তুমি কি নাস্তিক?
আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী না।
ভোর ন'টায় এনজিওগ্রাম শুরু হলো। ডাক্তার একজন অল্পবয়সী তরুণী। আমেরিকান না, ভারতীয় তরুণী। সে কিছু একটা গণ্ডগোল করল। ধমনি ফেটে রক্ত ছিটকে বের হয়ে আমার সামনের মনিটরে পড়ল। ডাক্তারের চোখেমুখেও পড়ল। আমি ইংরেজিতে জানতে চাইলাম, কোনো সমস্যা কি হয়েছে?
তরুণী বলল, ঝঃধু পধষস. অর্থাৎ শান্ত থাকো। আমাকে শান্ত থাকতে বলে সে যথেষ্টই অশান্ত হয়ে পড়ল। একটা পর্যায়ে তাকে সাহায্য করার জন্য অন্য ডাক্তার চেয়ে পাঠাল। আমি মনে মনে বললাম, ডিসকাউন্টের প্রার্থনা নেওয়াই মনে হয় উচিত ছিল।
গল্প-৩
স্থান : মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল, সিঙ্গাপুর।
মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চতুর্থবারের মতো আমার এনজিওগ্রাম করা হয়েছে। রাতটা হাসপাতালের কেবিনে কাটাতে হবে। পরদিন ছুটি। খরচ কমানোর জন্য সিঙ্গেল কেবিন না নিয়ে ডাবল কেবিন নিয়েছি। আমার পাশে আরেকজন অতি বৃদ্ধ চায়নিজ রোগী। দু'জনের মাঝখানে পর্দা আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি বৃদ্ধ রোগীকে দেখতে পাচ্ছি।
রোগীর অবস্থা শোচনীয়। তাঁর মুখে বেলুনের মতো কী যেন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বেলুন ফুলছে এবং সংকুচিত হচ্ছে। অনেকটা ব্যাঙের গলার ফুলকার মতো। রোগী ঘড়ঘড় শব্দ করছে। ভয়ঙ্কর রকম আহত জন্তু হয়তো বা এ রকম শব্দ করে।
রোগীকে দেখার জন্য একের পর এক তাঁর আত্দীয়-স্বজন আসছে। কিছুক্ষণ কেঁদে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অনেককে দেখলাম রোগীর বালিশের নিচে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে আসছে। বাবা-মা বাচ্চাদের উঁচু করে রোগীকে দেখাচ্ছে। অনেকটা শেষ দেখার মতো। কুমিরের বাচ্চার মতো দেখানো শেষ হওয়া মাত্র বাচ্চাগুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার দিকে। এরা শুরু করে কিচিরমিচির। কেউ কেউ চেষ্টা করে আমার বিছানায় উঠতে।
একসময় মধ্য বয়স্ক এক মহিলা এসে বিনয়ে নিচু হয়ে আমাকে জানাল, তার দাদা মারা যাচ্ছেন বলে সবাই দেখতে আসছে। আমাকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে তাদের লজ্জার সীমা নেই। আমি যেন ক্ষমা করে দেই।
রাত ১০টায় নার্স আমার জন্য ওষুধ নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই বৃদ্ধের কী হয়েছে?
নার্স বলল, বার্ধক্য ব্যাধি।
অবস্থা কি খারাপ?
যথেষ্টই খারাপ। ঘটনা রাতেই ঘটবে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেউ রাতে মারা গেলে তার ডেডবডি কি তোমরা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাও, না পরে নাও?
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হয়।
আমি বললাম, আমি মৃত মানুষ পাশে নিয়ে কখনো শুয়ে থাকিনি। আমাকে কি অন্য একটা কেবিনে দেওয়া যাবে?
নার্স বলল, অবশ্যই যাবে। তুমি ওষুধ খাও, আমি ব্যবস্থা করছি।
আমি ওষুধ খেলাম। নিশ্চয়ই কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। আমি আমার নিজের কেবিনেই আছি। পর্দার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোনো শব্দও নেই। সুনসান নীরবতা। ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটে গেছে।
আমি অতি কষ্টে বিছানা থেকে নামলাম। উঁকি দিলাম পাশের বিছানায়। বৃদ্ধ হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধের মুখ হাসি হাসি। সে চামচ দিয়ে স্যুপ খাচ্ছে।
আমাকে দেখে বলল, গুড মর্নিং।
আমি বললাম, গুড মর্নিং।
বৃদ্ধ হাত ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকল। বিড়বিড় করে চায়নিজ ভাষায় কী যেন বলল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বালিশের নিচে হাত দিয়ে ১০০ সিঙ্গাপুর ডলারের একটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, টেক টেক টেক। মনে হয়, জীবন ফিরে পেয়ে সে মহা আনন্দিত। এই আনন্দের খানিকটা ভাগ আমাকে দিতে চায়। (পাঠকদের কী ধারণা_আমি কি বৃদ্ধের উপহার নিয়েছি, নাকি নেইনি? কুইজ।)

পাদটীকা-১
এবার ইউরোপের অতি উন্নত একটি দেশের অদ্ভুত চিকিৎসার গল্প। দেশটির নাম সুইডেন। সেই দেশে বাঙালি এক মহিলা দাঁতের সমস্যা নিয়ে গেছেন। দাঁতের ডাক্তার পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, দাঁতের গোড়ায় ভয়ঙ্কর এক জীবাণু পাওয়া গেছে। এই জীবাণু হার্টে চলে যাওয়া মানে হার্ট ফেলিউর। তিনি ব্যবস্থা দিলেন, রোগীর সব দাঁত জরুরি ব্যবস্থায় তুলে ফেলতে হবে। মহিলা শুরু করলেন কান্না। মহিলার মেয়ে একজন ডাক্তার। সে মাকে বলল, মা, তোমার চিকিৎসা হচ্ছে সুইডেনে, এত ভালো চিকিৎসা কোথাও হবে না। দাঁত ফেলতে বলছে ফেলে দাও।
বেচারির সব সুস্থ দাঁত টেনে তুলে ফেলে দেওয়া হলো। তাঁকে ভর্তি করা হলো ভয়ঙ্কর জীবাণুর চিকিৎসা যে হাসপাতালে হয়, সেখানে। ডাক্তাররা ভয়ঙ্কর জীবাণুর সন্ধানে লেগে গেলেন। একসময় ঘোষণা করলেন, এই জীবাণুর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ভুল হয়েছে। ভুলের কারণেই সব দাঁত ফেলা হয়েছে। তারা দুঃখিত।
ভদ্র মহিলা হচ্ছেন নির্বাসিতা লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মা। তসলিমা নাসরিন মাকে চিকিৎসা করাতে সুইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

পাদটীকা-২
আমি কখনোই মনে করি না, মানুষ এমন কোনো অপরাধ করতে পারে, যার শাস্তি তার কাছ থেকে দেশ কেড়ে নেওয়া। মানুষ মানুষকে ত্যাগ করে; দেশ কখনো তার সন্তানকে ত্যাগ করে না। যাঁরা তসলিমা নাসরিনের রচনা পছন্দ করেন না, তাঁরা পড়বেন না। তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তাঁর বিভ্রান্তি নিয়ে। আমরা কেন তাঁকে দেশছাড়া করব? কেন বাংলাদেশের একটা মেয়ে ভবঘুরের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশ ঘুরবে? ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধাপরাধীরা তো ঠিকই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তো তাদেরকে দেশান্তরী করি না।
হুমায়ূন আহমেদের
ফাউনটেনপেন
চ্যালেঞ্জার
৬.

কী এক উৎসব উপলক্ষে আমরা অর্থাৎ ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা একটা হোটেলের বড় ঘরে জড়ো হয়েছি। সেখানে মধ্যবয়স্ক অচেনা এক ব্যক্তি ঢুকল। আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আড্ডায় কখনো অপরিচিতজনদের আসতে দেওয়া হয় না। এ কে? এখানে কী চায়?
পরিচয়ে জানলাম_তার একটা প্রেস আছে। সেই প্রেসে মাজহারদের 'অন্যপ্রকাশ'-এর বইয়ের কভার মাঝেমধ্যে ছাপা হয়। সে মাজহারের কাছে এসেছে, তার কিছু টাকা দরকার।
বেচারা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, আপনি বসুন।
সে সংকুচিত ভঙ্গিতে বসল।
আড্ডা জমে উঠল। আমি তার কথা ভুলেই গেছি। নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছি। হঠাৎ সে বলল, এখন আপনি যে যুক্তিটা দিলেন তাতে ভুল আছে।
আমি বললাম, কী ভুল?
সে আমার যুক্তির ভুল ব্যাখ্যা করল। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম, আপনার কী নাম?
স্যার, আমার নাম সাদেক।
আপনি এত পেছনে কেন? কাছে এগিয়ে আসুন। সাদেক কাছে এগিয়ে এল। এই আসরেই তার নতুন নাম করা হলো 'চ্যালেঞ্জার'।
তার নামকরণে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। নামকরণ করেছিলেন অবসর প্রকাশনার মালিক আলমগীর রহমান। সাদেক আলমগীর রহমানের দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে চ্যালেঞ্জ জিতে নেন বলেই নাম চ্যালেঞ্জার। চ্যালেঞ্জার কী বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তা বলতে চাইছি না। কোনো এক বিশেষ তরল পদার্থ গলাধঃকরণবিষয়ক চ্যালেঞ্জ। ধরা যাক পেপসি। আলমগীর আট বোতল পেপসি খেয়ে বমি শুরু করল। চ্যালেঞ্জার নয় বোতল খেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল, যেন কিছুই হয়নি।
তাকে আমি প্রথম যে নাটকে নিলাম তার নাম 'হাবলঙের বাজার'। নাটকের কাহিনী হচ্ছে_গরমের সময় ডাক্তার এজাজের মাথা এলোমেলো হয়। তার বিয়ের দিন মাথা খুব এলোমেলো হলো। ঠিক করা হলো, মাথা কামিয়ে সেখানে এলাজ দেওয়া হবে। শর্ট নেওয়ার আগে আগে দেখা গেল নাপিত আনা হয়নি।
কিভাবে নাটক বানানো হয় তা দেখার জন্য চ্যালেঞ্জার তার স্ত্রীকে নিয়ে গেছে। দুজনই আগ্রহ নিয়ে নাটক বানানো দেখছে। আমি চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললাম_তুমি তো সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও। এসো নাপিতের ভূমিকায় অভিনয় করো।
চ্যালেঞ্জার বলল, স্যার আপনি যা বলবেন তা-ই করব। মাটি খেতে বললে মাটি খাব। নাটক পারব না।
আমি বললাম, তুমি পারবে। নাও ক্ষুর হাতে নাও।
চ্যালেঞ্জার ছোট্ট একটা ভূমিকায় অভিনয় করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, তার ভেতর সহজাত অভিনয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।
তাকে এক ঘণ্টার একটি নাটকে প্রধান চিরত্র করতে বললাম, নাটকের নাম 'খোয়াবনগর'। সেখানে আমার মেজো মেয়ে শীলা অভিনয় করেছিল। নাটকের শেষে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! চ্যালেঞ্জার নামের এই নতুন অভিনেতার অভিনয় তোমার কেমন লাগল?
শীলা বলল, আসাদুজ্জামান নূর চাচাকে আমার এ দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে হয়। আমি আজ যাঁর সঙ্গে অভিনয় করলাম, তিনি নূর চাচার চেয়ে কোনো অংশে কম না।
বাবা! তোমার কী মনে হয় সুপারস্টার হিসেবে তার পরিচয় হবে?
শীলা বলল, অবশ্যই।
'উড়ে যায় বকপক্ষী'তে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে সে নিজেকে সুপারস্টার প্রমাণিত করল।
আমি কোনো অবিচুয়ারি লিখছি না। চ্যালেঞ্জার এখনো জীবিত। আজ দুপুরে সে তার স্ত্রীকে ইশারায় বলল, সে আমাকে দেখতে চায়।
তার স্ত্রী তাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার কথা বলার ক্ষমতা নেই। যে কথা বলতে পারছে না, তার সঙ্গে কথা বলে তার যন্ত্রণা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।
চ্যালেঞ্জার সম্পর্কে দুটি ছোটগল্প বলতে ইচ্ছা করছে।
গল্প-১
আমি আমার মেয়ে বিপাশা এবং পুত্র নূহাশকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছি। তখন আমি মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একা বাস করি। আমার এই দুই পুত্র-কন্যা হঠাৎই ঠিক করল, বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। কাজেই তাদের নিয়ে এসেছি সমুদ্রের কাছে। উঠেছি হোটেল সায়মনে। খুব ভোরবেলা দরজায় নক হচ্ছে। দরজা খুললাম, অবকা হয়ে দেখি, এক কাপ গরম চা এবং খবরের কাগজ হাতে চ্যালেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সারা রাত গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে।
গল্প-২
দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি। শীলার মায়ের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে ওল্ড ফুলস ক্লাবের সব সদস্য আমাকে ত্যাগ করেছে। কেউ ফ্ল্যাটে আসে না। হঠাৎ কারো সঙ্গে দেখা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অদ্ভুত ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমার সেই দুঃসময়ের কাল বেশ দীর্ঘ ছিল। তখন প্রতিদিন দুপুরে এবং রাতে চ্যালেঞ্জার এসে বসে থাকত। সে আমার সঙ্গে খাবে। তার একটাই যুক্তি, 'স্যার, আপনি একা খেতে পছন্দ করেন না। আমি কখনোই আপনাকে একা খেতে দেব না।' এক সময় ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা আসতে শুরু করল। চ্যালেঞ্জার দূরে সরে গেল।
চ্যালেঞ্জারের নিজের একটা গল্প বলি। সে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তার সৎমায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছোট ছোট ভাইবোন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। তার নিজের ভাষ্যমতে, 'স্যার, কতদিন গিয়েছে কোনো খাওয়া নাই। গ্লাসভর্তি চা নিজে খেয়েছি। ভাইবোনদের খাইয়েছি।' বড় ভাইয়ের দায়িত্ব সে পুরোপুরি পালন করেছিল, সব ভাইবোনকে পড়াশোনা করিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। তার চেয়েও অদ্ভুত কথা সে তার সৎমাকে নিজের কাছে এনে যতটুকু আদর-যত্ন করা যায় করেছে। মৃত্যুর সময় এই মহিলা তার সৎ ছেলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
চ্যালেঞ্জার এখন জম্বী। তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। ব্রেইন ক্যানসার নামক কালান্তক ব্যাধি তার কাছ থেকে সব কিছু নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সাহায্যের হাত গাঢ় মমতায় তার দিকে বাড়িয়েছে বলেই সে এখনো বেঁচে আছে।
সাহায্যের নামে কেউ কেউ প্রতারণাও করেছেন। চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরার সামনে বড় বড় ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের নাম প্রচারিত হয়েছে_এই পর্যন্তই।
এ প্রসঙ্গে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁকে আমি একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জনাব আসাদুজ্জামান নূরের হাত দিয়ে পাঠাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা ব্যক্তিগত পত্রটি সংযুক্ত হলো।

৫ আগস্ট, ২০০৯
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
দেশরত্ন শেখ হাসিনা
শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আমার বিনীত সালাম গ্রহণ করুন।
আপনি প্রচুর বইপত্র পড়েন_এই তথ্য আমার জানা আছে। নাটক-সিনেমা দেখার সুযোগ পান কি না জানি না। সুযোগ পেলে চ্যালেঞ্জার নামের একজন শক্তিমান অভিনেতার অভিনয় আপনার দেখার কথা। অতি অল্প সময়ে সে অভিনয় দিয়ে দেশবাসীর হৃদয় হরণ করেছে।
বর্তমানে সে মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার তার পরিবার আর নিতে পারছে না।
আমি তার হয়ে আপনার কোমল মানবিক সত্তার কাছে আবেদন করছি। আপনার মঙ্গলময় হাত কী এই শক্তিমান অসহায় অভিনেতার দিকে প্রসারিত করা যায়?

বিনীত
হুমায়ূন আহমেদ
ফাউনটেনপেন

জি্বন এবং পক্ষীকথা

নুহাশ পল্লীর মাঠে বসে আছি। সময় সকাল ১০টা। আমার সঙ্গে আছেন সিলেটের হ্যারল্ড রশীদ। তিনি একজন সংগীত পরিচালক, চিত্রকর এবং শখের জ্যোতির্বিদ। তিনি আমাকে বৃহস্পতির চাঁদ এবং শনিগ্রহের বলয় দেখাতে এসেছেন। নিজের টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন। রাতে টেলিস্কোপ সেট হবে।
আমরা রাতের জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার জায়গাটা সুন্দর। বেদি দেওয়া জাপানি বটগাছের নিচে বসেছি। আমাদের ঘিরে আছে ছয়টা চেরিগাছ। দুইটাতে ফুল ফুটেছে। নীল রঙের স্নিগ্ধ ফুল। চারদিকে নানান ধরনের পাখি ডাকছে। পাখির বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। সব পাখি চিনিও না। তাদের কিচিরমিচিরে ভোরবেলা জেগে উঠতে হয়। কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এদের ওপর খানিকটা রাগও করি। দুইটা কাঠঠোকরা পাখি আমাকে ভোরবেলায় অস্থির করে তোলে। এরা কাঠের ইলেকট্রিক পোলে গর্ত করে বাসা বানিয়েছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এরা বাসা থেকে বের হয়। আমি যে ঘরে ঘুমাই তার কাঁচের জানালায় ঠোকর দেয়। মনে হয় জানালা ফুটো করতে চায় কিংবা আয়নায় নিজেকে দেখতে চায়। আরেকটি সম্ভাবনা আছে_হয়তো এদের ঠোঁট কুট কুট করে। প্রচণ্ড শক্তিতে গ্লাসে ধাক্কা দিলে ঠোঁটে আরাম হয়।
পাখি দুইটির বজ্জাতির গল্প হ্যারল্ড রশীদের সঙ্গে করলাম। তিনি বললেন_আচ্ছা, আপনার নুহাশ পল্লীতে এত পাখি, আপনি কি কখনো এখানে মৃত পাখি দেখেছেন?
আমি বললাম_পাখির বাসা থেকে পড়ে মরে গেছে এমন দেখেছি।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি?
আমি বললাম_না।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি যে কোথাও দেখা যায় না এই বিষয়টা আমি জানি। অনেক বছর আগে ঞরসব বা জবধফবৎং উরমবংঃ পত্রিকায় একটা লেখা পড়েছিলাম_'ডযবৎব ঃযব ফবধফ নরৎফং মড়?' সেখানেও মৃত পাখির বিষয়টাকে রহস্য বলা হয়েছে।
হ্যারল্ড রশীদ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন_মৃত পাখিদের জি্বন খেয়ে ফেলে, তাই আমরা মৃত পাখি দেখি না।
_বলেন কি!
জি্বনের খাবার হলো হাড়। পাখির হাড় তারা খেয়ে ফেলে।
হ্যারল্ড রশীদের কথা গসপেল মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে সাদাত সেলিম সাহেবকে টেলিফোন করলাম। উনি একজন পক্ষীবিশারদ। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। টেলিফোনে সহজে তাঁকে পাওয়া যায় না। আমার ভাগ্য ভালো, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। আমি বললাম_বিশাল নুহাশ পল্লীকে পক্ষীর অভয়াশ্রম বলা যায়। আমি কেন এখানে মৃত পাখি দেখি না?
সাদাত সেলিম যে জবাব দিলেন তা হ্যারল্ড রশীদের জবাবের চেয়েও অদ্ভুত। তিনি বললেন, পাখিদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এরা কখন মারা যাবে তা বুঝতে পারে। বুঝতে পারামাত্র দলবল ছেড়ে গহীন অরণ্যের দিকে যাত্রা করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গহীন অরণ্যে তাদের মৃত্যু হয় বলেই আমরা লোকালয়ে মৃত পাখি দেখি না।
পক্ষী বিষয়ে সাদাত সেলিমের চেয়েও অনেক অদ্ভুত কথা একজন বলে গেছেন, তাঁর নাম বাবর। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাবর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'বাবরনামা'য় লিখেছেন, তাঁর সংগ্রহে একটি তোতা পাখি ছিল। তোতা পাখি কথা বলত, যা শুনত তা-ই বলত। তবে এই পাখির রক্ষক একদিন সম্রাটকে বলল, পাখিটা যে সব কথা শুনে শুনে বলে তা নয়, সে নিজ থেকেও কথা বলতে পারে। একদিন পাখিটা বলল, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকনাটা খুলে দাও।
আরেক দিনের কথা, সম্রাট দলবল নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। সঙ্গে তোতা পাখিও আছে। পথে এক জায়গায় তোতা পাখির রক্ষক ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই চলে গেছে। তখন পাখিটা বলল, সবাই চলে গেছে, আমরা বসে আছি কেন? আমরা কেন যাচ্ছি না?
সম্রাট বাবর তাঁর জীবনীতে গালগল্প ফাঁদবেন বলে মনে হয় না। তিনি সেই সময়কার হিন্দুস্তানের নিখুঁত বর্ণনা তাঁর গ্রন্থে দিয়ে গেছেন। পাখির যে রক্ষক সম্রাটকে এই কথা বলেছে তার নাম আবুল কাসিম জালায়ের। সম্রাট লিখেছেন_এ আমর অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
নানান ধরনের পাখি সম্পর্কে বাবর লিখে গেছেন। তার কয়েকটা উদাহরণ_

লুজা
মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত এর গায়ে কয়েক রকমের রং। গলায় কবুতরের গলার মতো চকচকে রং আছে। এ পাখি পর্বতের চূড়ায় বাস করে।

ফিং
বিশাল পাখি। এদের এক একটি ডানা লম্বায় মানুষ সমান। এর মাথা ও গলায় কোনো লোম নেই। এর গলায় থলের মতো একটা কিছু ঝোলে। এর পিঠ কালো, বুক সাদা। এ পাখি মাঝেমধ্যেই কাবুলে দেখা যায়। একবার আমাকে একটা ফিং পাখি ধরে এনে দিল। পাখিটা পোষ মানল।

কোকিল
দৈর্ঘ্যে কাকের সমান, কিন্তু দেহ কাকের চেয়ে সরু। গান গায়। হিন্দুস্তানের বুলবুল। আমরা যেমন বুলবুল ভালোবাসি হিন্দুস্তানের লোকেরা তেমনি কোকিল ভালোবাসে। ঘন গাছের বাগানে থাকে।
অদ্ভুত আরেক পাখির কথা আমি দাদাজানের কাছে শুনেছি। তিনি এই পাখির নাম বলেছেন 'মউত পাখি'। যখন কোনো বাড়িতে কারো মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন এই পাখি নাকি নিশিরাতে বাড়ির চালে এসে বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে থাকে। আমার সবচেয়ে ছোট ফুফুর মৃত্যুর দুই রাত আগে নাকি এমন একটা পাখি দাদাজানের বাড়ির টিনের চালে এসে বসে ডাকতে শুরু করে। আমার এই ফুফুর নাম মাহমুদা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। আমার মা সব সময় বলেন, এমন রূপবতী কিশোরী তিনি তাঁর জীবনে দেখেননি।
পক্ষীবিশারদ সাদাত সেলিমের মতে, পাখি নিজের মৃত্যুর অগ্রিম খবর পায়। এই ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের মৃত্যুর খবরও তাদের কাছে থাকার কথা।
পক্ষী প্রসঙ্গে এখানেই ইতি। এখন চলে যাই অন্য প্রসঙ্গে। অমাবস্যার রাত। আকাশভর্তি তারা। হ্যারল্ড রশীদ তাঁর টেলিস্কোপ তারাদের দিকে তাক করেছেন।
আমরা প্রথম দেখলাম লুব্ধক নক্ষত্র। আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। ইংরেজি নাম সিরিয়াস। অতি প্রাচীন এক সভ্যতার নাম মায়া সভ্যতা। মায়ারা বলত তারা এসেছে লুব্ধক নক্ষত্রের পাশের একটি নক্ষত্র থেকে। লুব্ধক নক্ষত্রের পাশে কোনো নক্ষত্র এত দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এখন জ্যোতির্বিদরা একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন।
লুব্ধকের পরে আমরা দেখলাম একটা সুপার নোভা। তারপর দেখা হলো সপ্ত ভগিনী তারা গুচ্ছ (ঝবাবহ ংরংঃবৎং)। বৃহস্পতি ডুবে গিয়েছিল বলে বৃহস্পতি বা তার চাঁদ দেখা গেল না। শনিগ্রহের অবস্থান বের করতে হয় বৃহস্পতি গ্রহ থেকে। যেহেতু বৃহস্পতি নেই আমরা শনি দেখতে পারলাম না, তবে ঘড়ৎঃয ংঃধৎ খুব খুঁটিয়ে দেখলাম।
নর্থ স্টারের বাংলা নাম ধ্রুব তারা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে_'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুব তারা।' সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। আকাশের সব তারা পশ্চিম দিকে ওঠে পূর্ব দিকে অস্ত যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম নর্থ স্টার বা ধ্রুব তারা। এই তারা আকাশে স্থির হয়ে থাকে। নাবিকরা এই তারা দেখে দিক ঠিক করেন। আমাদের দেশের নৌকার মাঝিরাও এই তারা খুব ভালো করে চেনে।
তারা দেখা চলছে, হঠাৎ আমাদের আসরে চকচকে কালো রঙের এক কুকুর উপস্থিত হলো। হ্যারল্ড রশীদ বললেন, হুমায়ূন ভাই, এই কুকুরটা জি্বন।
আমি বললাম, আপনার সমস্যা কী বলুন তো। সকালে বলেছেন মরা পাখি সব জি্বন খেয়ে ফেলে। এখন বলছেন, কালো কুকুর জি্বন।
হ্যারল্ড রশীদ বললেন, আমি বই পড়ে বলছি।
_কী বই?
বইয়ের নাম 'জি্বন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস'।
কে লিখেছেন? প্রকাশক কে?
এসব মনে নেই।
বইটা কি আছে আপনার কাছে?
না।
আমি ঢাকায় ফিরে এসেই নুহাশ চলচ্চিত্রের এক কর্মকর্তাকে বাংলাবাজারে পাঠালাম, সে যেভাবেই হোক 'জি্বন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস' গ্রন্থ জোগাড় করবে।
দুপুরবেলা সে জানাল, পাঁচটা ইতিহাস সে পেয়েছে। সব কিনবে কি না।
আমি বললাম, সব কিনবে।
সে বিকেলে পাঁচটা বই নিয়ে উপস্থিত হলো। আমি দেখলাম প্রতিটি বই হলো চীন জাতির ইতিহাস। সে চীনের ইতিহাসের সব বই কিনে নিয়ে চলে এসেছে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত 'জি্বন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাস' বইটি পাওয়া গেছে। মূল বই আরবি ভাষায়। লেখক আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়তী (রহ.), অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান। আরেকটি বই পাওয়া গেছে 'জি্বন ও শয়তানের ইতিকথা'। এটিও আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়তী (রহ.)-এর লেখা। বই দুইটি পড়ে জি্বন জাতি সম্পর্কে যা জেনেছি তার সারমর্ম_

জি্বন শব্দের অর্থ
গুপ্ত, অদৃশ্য, লুকানো, আবৃত।

জি্বন জাতির শ্রেণী বিভাগ
ক. সাধারণ জি্বন।
খ. আমির : মানুষের সঙ্গে থাকে।
গ. আরওয়াহ : মানুষের সামনে আসে।
ঘ. শয়তান।
ঙ. ইফরীব্ব (শয়তানের চেয়েও বিপজ্জনক। এদের দেখা পেলে আযান দিতে হবে)।

জি্বন কিসের তৈরি?
পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে, "আমি আদমের আগে, জি্বনকে সৃষ্টি করেছি 'লু'-র আগুন দিয়ে।" (সুরাহ আল হিজর, আয়াত ২৭)
হজরত ইবনে আব্বাস (র.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন 'লু'-র আগুনের অর্থ খুবই সুন্দর আগুন। হজরত উমার বিন দীনার (র.) বলেছেন, জি্বন জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্যের আগুন থেকে।

জি্বনদের প্রকারভেদ
তিন শ্রেণীর জি্বন আছে।
১. এরা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। খাদ্য গ্রহণ করে না, নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয় না। সন্তান উৎপাদন করে না।
২. এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে, খাদ্য গ্রহণ করে। বিয়ে করে। সন্তান উৎপাদন করে।
৩. সাদা রঙের সাপ এবং সম্পূর্ণ কালো কুকুরও জি্বন।

জি্বনদের খাদ্য
নবীজি (স.) বলেছেন, তোমাদের খাদ্য এমন সব হাড় যার প্রতি আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, তাই জি্বনের খাদ্য। (তিরমিযী)
(আমরা শুনি জি্বনরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। তার কোনো উল্লেখ পাইনি।)

জি্বনদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে
এই নিয়ে আলেমদের মতভেদ আছে। একদল বলেছেন জি্বন যেহেতু সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির কাজেই তাদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে অবৈধ।
আলেমদের আরেক দল বলছেন, পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ শয়তানকে বলেছেন, 'তুই মানুষের সম্পদে ও সন্তানে শীরক হয়ে যা।' (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৪)
সন্তানে শারীক হতে হলে বিবাহ বাঞ্ছনীয়। কাজেই জি্বনের সঙ্গে মানুষের বিয়ে হতে পারে।
মানুষ এবং জি্বনের যৌনক্রিয়ায় যেসব সন্তান জন্মায় তারাই হিজড়া। {হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)} এদের আরবি নাম খুন্নাস।

পাদটীকা
নিউজিল্যান্ডের এক বাড়িতে দুইটা ভূত ধরে বোতলবন্দি করা হয়েছে। একটি অল্প বয়সী দুষ্টু ভূত। অন্যটি শান্ত-ভদ্র ভূত। দুইটি ভূতই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়েছে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট

Post a Comment

0 Comments