Ticker

6/recent/ticker-posts

স্বপ্নগ্রস্ত সুমন্ত আসলাম


স্বপ্নগ্রস্ত
সুমন্ত আসলাম

সানাউল্লা মুনসী স্বপ্ন দেখেন, সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে তিনি রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছেন। জনসমক্ষে, প্রকাশ্যে, খুব আনন্দ নিয়ে হাঁটছেন। ফ্যাশন টিভিতে দেখা ফ্যাশন শোর অলৌকিক মানবীদের মতো। তাঁর গায়ে কোনো কাপড় নেই, কাপড়ের একটা টুকরোও নেই। কেবল কোমরের কাছে তাবিজ লাগানোর তাগাটা ছাড়া। বহু বছর আগে লাগানো কালো সুতোটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চিকন হয়ে কোমরের দুপাশের হাড়ের সঙ্গে এমনভাবে ঝুলে আছে, যেন একটু সুযোগ পেলেই নিজেকে মুক্ত করে পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়বে সেটা।
স্বপ্নটা এটুকুই ঠিক ছিল। কিন্তু একটু পর খেয়াল করেন, কয়েক হাজার পিঁপড়া হেঁটে আসছে তাঁর দিকে। পিঁপড়াগুলো তাঁর শরীর বেড়ে উঠার চেষ্টা করছে। তিনি যত জোরে হাঁটছেন, পিঁপড়াগুলোও তত জোরে ধেয়ে আসছে। কোনোভাবেই তিনি পিঁপড়াদের খুব বেশি পেছনে ফেলে আসতে পারছেন না। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু না, নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না তিনি। কেমন করে যেন একটা পিঁপড়া তাঁর পা বেয়ে, দুপায়ের সংযোগস্থলে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর কৌশলগত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল। এবং সেখানে গিয়ে গোলানো ময়দার মতো নরম জায়গাটায় কুট করে একটা কামড় দিল। উহ্ করে একটা চিৎকার দিলেন তিনি। ঘুমটা ভেঙে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।
বিছানায় উঠে বসলেন মুনসী। সাধারণত এ ধরনের স্বপ্ন দেখে একটু হলেও দুশ্চিন্তা করার কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তা তো দূরের কথা, বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম প্রেমে পড়ার মতো পুলকিত মনে হলো তাঁকে, অন্য রকম একটা অনুভূতি দেখা গেল তাঁর মধ্যে, দিনশেষে পশ্চিম আকাশের গোলাপি আভাও দেখা গেল দুগালের মাঝখানে।
বেডসুইচ জ্বালালেন তিনি। বিছানায় টানানো মশারি জাপটে ধরে মশা বসে আছে ছয়টা। প্রত্যেকটার পেট ফুলে ঢোলের মতো হয়ে গেছে, কালো অবয়বটা লাল রং ধারণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছে চুলকানি পেল মুনসীর। একটু ফোলাও মনে হলো জায়গাটা। অন্যদিন হলে রাগে এতক্ষণ মশাগুলো দুহাতের তালুতে চটকিয়ে ফেলতেন, আজ তা করলেন না। স্বপ্নসংক্রান্ত ব্যাপারে মনটা ভালো আছে তাঁর, মন ভালো থাকলে কোনো প্রাণী হত্যা তো দূরের কথা, কাউকে বকা দিতেও ইচ্ছে করে না মুনসীর।
বিছানা থেকে পা নামিয়ে যে-ই না স্যান্ডেলে পা গলাবেন, ঠিক তখনই দেখতে পেলেন, একটা তেলাপোকা বসে আছে ডান পায়ের স্যান্ডেলটার ওপর। পা স্থির করে বসে আছে সে, কিন্তু তার শুঁড় দুটো অস্থিরভাবে নড়ছে। বরাবরের মতো এ অমেরুদণ্ডী প্রাণীটিকেও কিছু বলেন না তিনি। অথচ স্রষ্টার সৃষ্টির প্রাণিকুলের মধ্যে এ দুটো প্রাণীকেই তিনি দেখতে পারেন না, সবচেয়ে ঘৃণা করেন এবং চোখের সামনে পড়লেই মেরে ফেলেন।
আলতো করে স্যান্ডেলটা নাড়া দিয়ে প্রাণীটিকে সরিয়ে দিলেন তিনি। কিছুদূর গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল সে। কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়তে লাগল, যেন ভীষণ বিরক্ত সে এবং এভাবে অযাচিতভাবে তাড়িয়ে দেওয়া তার জন্য চরম লজ্জাজনক, অপমানজনকও।
সালাউল্লা মুনসী জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সীমাহীন শূন্যতার দিকে তাকিয়ে নিজের কথা ভাবতে লাগলেন, ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'ওহে মুনসী, তুমি কি এবার তোমার এই স্বপ্নটাও পূরণ করবে?'
২. স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন সানাউল্লা মুনসী। স্বপ্ন দেখতে অনেকেই ভালোবাসে। কিন্তু অনেকের সঙ্গে মুনসীর পার্থক্য হচ্ছে_অনেকে স্বপ্ন দেখে ভুলে যায়, মুনসী ভোলেন না। মুনসী মনে করেন, আল্লাহ মানুষকে স্বপ্ন দেখান, সেই স্বপ্নটা পূরণ করার জন্য। স্বপ্ন তিনি এর আগে আরো অনেক দেখেছেন; কিন্তু সাড়ে তিন বছর আগে একটা স্বপ্ন দেখে তিনি আচমকা উপলব্ধি করেন, স্বপ্ন হচ্ছে সত্যি সত্যি পূরণ করার জিনিস। তারপর থেকেই স্বপ্ন দেখার পর সেই স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টা করেন তিনি।
সাড়ে তিন বছর আগে মুনসী স্বপ্ন দেখেন, রিকশাওয়ালা হয়ে গেছেন তিনি, লুঙ্গি আর ছেঁড়া ধরনের একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন আপনমনে। স্বপ্নটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে জেগে ওঠেন ঘুম থেকে। ভোরের স্বপ্ন ছিল সেটা। সকালের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রিকশার খোঁজে বের হন, কিন্তু রিকশা কোথায় পাওয়া যায়, কোথা থেকে ভাড়া নিতে হয়_একেবারে গোলকধাঁধায় পড়ে যাওয়ার অবস্থা। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর রিকশার একটা গ্যারেজ পান তিন। মালিককে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'একটা রিকশা দেওয়া যাবে?'
গ্যারেজের মালিক নেশা হিসেবে বিড়ি সিগারেট খায় না তবে গুল ব্যবহার করেন। এক চিমটি গুল নিয়ে বাম পাশের মাঢ়ির কাছে রেখে তিনি বললেন, 'কীয়ের রিকছা?'
'একটু চালানোর জন্য আর কি।'
'চালাইব কেডা?'
'কেন, আমি!'
'আপনে!' আরেক চিমটি গুল মাঢ়ির কাছে রেখে গ্যারেজ মালিক বললেন, 'ছখ কইর‌্যা চালাইবেন, না অন্য কিছুর লাইগ্যা।'
'শখ বা অন্য কিছু না, সত্যি সত্যি একজন রিকশাওয়ালা হতে চাই আমি। সানাউল্লা মুনসী খুব স্পষ্ট স্বরে বললেন, 'মাত্র এক দিনের জন্য।'
'মাত্র এক দিনের জন্য! কারণডা কওয়া যাইব?'
'না। এটা একান্তই ব্যক্তিগত।'
'ব্যক্তিগত অইলে থাউক। কিন্তু এত চকচকা চেহারা নিয়া তো রিকছাওয়ালা হওন যাইব না।' গ্যারেজ মালিক মুনসীর আপাদমস্তক দেখে বললেন, 'আপনার পিন্দনের পোছাক-আছাকও তো মাছছাল্লা নয়া মনে অয়, ওগুলাও তো চকচক করতাছে।'
'রিকশাওয়ালা হতে হলে আমাকে কী করতে হবে?'
'চেহারা তো আর বদলানো যাইব না। একটা পুরাতন ধরনের লুঙ্গি আর ছেঁড়া-ফাটা একটা গেঞ্জি অইলে বালো অয়।'
বাসায় ফিরে এলেন মুনসী। পুরাতন একটা লুঙ্গি এবং একটা গেঞ্জি কাপড়-চোপড়ের মধ্য থেকে খুঁজে বের করলেন। তারপর আবার গ্যারেজে গিয়ে রিকশা ভাড়া নিলেন একটা। কিন্তু রিকশা চালানো যে এত কঠিন, জানা ছিল না তাঁর। রিকশার হ্যান্ডেল সব সময় একদিকে কাত হয়ে যায়। ব্যালেন্স রাখা খুবই মুশকিল।
দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর কোনো রকম রিকশা চালানো শিখলেন তিনি। তারপর একটা ভাড়াও পেলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পথে একটা ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, কলজেটা আর বুকের ভেতর থাকতে চাচ্ছে না, জিভটাও বের হতে চাচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। তাদের সঙ্গে চোখ দুটোও ঠিকরে বের হতে চাচ্ছে একটু পর পরই। খুব কষ্ট করে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যেতেই হ্যান্ডেলটা বাঁকা হয়ে যায় রিকশার। পাশে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল সেটা। চালক এবং আরোহী দুজনই পড়ে গেলেন মাটিতে। কিন্তু আরোহী ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন মুনসীর গালে। দুই চোখ বেয়ে পানি নেমে এল মুনসীর। মাস তিনেক আগে ছোট একটা কারণে এভাবে একটা রিকশাওয়ালার গালে থাপ্পড় মেরেছিলেন তিনি, তাঁর চোখ বেয়েও পানি ঝরেছিল এভাবে।
রিকশাওয়ালা হওয়ার স্বপ্ন দেখার পর মুনসী আবার স্বপ্ন দেখেন। দেখেন, ফকির হয়ে গেছেন তিনি। ভিক্ষা করার জন্য ভাঙা একটা থালা দরকার, টিনের থালা। নিদেনপক্ষে রং ওঠে যাওয়া পুরাতন হলেও চলে। আজকাল বাসায় কেউ টিনের থালা ব্যবহার করে না। তা ছাড়া পুরাতন কোনো থালাও রাখা হয় না বাসায়। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে এক ফকিরের কাছ থেকে ভাঙা একটা থালা ভাড়া নিলেন মুনসী। ফার্মগেটের কাছে একটা রাস্তায় ভিক্ষাও করতে বসলেন। আধঘণ্টার মধ্যে বেশ কয়েকটা এক টাকার নোট পড়ল থালায়, একজন অবশ্য পাঁচ টাকার কয়েনও দিয়েছে। হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামে তাঁর সামনে। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন পুলিশ এসে দুহাত চেপে ধরে তাঁর, টেনে গাড়িতে তোলে তাঁকে। কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট নাকি আসবে আজ ঢাকায়। ঢাকাকে তাই ভ্রাম্যমাণ ফকিরমুক্ত করার জন্য সব ফকিরকে ধরে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিন দিন পর ছেড়ে দেওয়া হবে তাদের। তিন দিন পর বাসায় ফিরে আসেন মুনসী। তত দিনে বাসায় হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে গেছে। দেশের এমন কোনো হাসপাতাল, থানা নেই যে খোঁজ নেওয়া হয়নি তাঁর। রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, পেপারেও দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে যত আত্মীয়স্বজন ছিল ফোনের পর ফোন করে খোঁজ নিয়েছে সবাই। ফকির সাজা এবং পুলিশ কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল অবশেষে। তাতে প্রথম ক্ষতিটা হলো মুনসীরই, দ্বিতীয়টাও তাঁর। খুব চমৎকার একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কদিন পর বিয়ে। ভেঙে গিয়েছিল বিয়েটা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, সবাই মিলে জোর করে তাঁকে দেশের বিশিষ্ট মানসিক চিকিৎসক ডাক্তার শহীদ কামালের কাছে নিয়ে গেলেন।
এবারও চোখ ফেটে পানি এসে গেল মুনসীর। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলল তাঁকে। বেশ কয়েক দিন আগে একটা ফকির বাসার গেটের সামনে এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করত। ভিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত চিৎকার করতেই থাকত। কদিন আগে তাঁর পুলিশ বন্ধুকে ব্যাপারটা বলার পর ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওই বুড়ো ফকিরটাকে।
ডাক্তার কামাল বললেন, 'সমস্যা কী আপনার?'
মুনসী কিছুটা রাগত স্বরে বললেন, 'কোনো সমস্যা নেই আমার।'
'সমস্যা নেই আপনার? তাহলে একবার রিকশা চালাচ্ছেন আপনি, একবার ভিক্ষা করছেন_ব্যাপারটা কী?'
'কোনো ব্যাপারট্যাপার নেই। আমার যখন যেটা ইচ্ছে করে, সেটাই করি আমি।' ধীরে ধীরে আরো রেগে যাচ্ছেন মুনসী।
'আর কী কী ইচ্ছে করে আপনার।'
'অনেক ইচ্ছে করে। এ মুহূর্তে ড্রেনের তিন গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছে করছে একসঙ্গে।'
ডাক্তার কামাল আরো কয়েকটা প্রশ্ন করলেন মুনসীকে। তারপর কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন তাঁকে। মুনসীর বড় মামা সবচেয়ে কড়া মানুষ। তাঁকে দেখে সবাই যমের মতো ভয় পায়। মুনসীকে ডাক্তারের কাছে তিনি নিয়ে এসেছেন। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন ভাগিনাকে।
মামার বাসায় মুনসীর কোনো কাজ নেই। খাবার খাও, ওষুধ খাও আর ঘুমাও। কাউকে না বলে বের হওয়া যাবে না বাসা থেকে। মামার ভয়ে মুনসী বেরও হন না। এরই মধ্যে সুযোগ পেয়ে একটা গ্লাস নিয়ে বাসার বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। বাসার সামনের ড্রেন থেকে তিন গ্লাস পানি খেয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলেন দ্রুত। পরের দিন থেকেই পেটে আর কিছু রাখতে পারেন না মুনসী। যা খান তাই তরল হয়ে বের হয়ে আসে পেট থেকে। মামা ফোন করলেন ডাক্তার কামালকে, 'স্যার, আপনি যে ওষুধগুলো আমার ভাগিনাকে দিয়েছেন, তার কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?'
'না তো!' চেয়ারে হেলান দিয়েছিলেন ডাক্তার কামাল। সোজা হলেন তিনি, 'কেন, কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি আপনার ভাগিনার?'
বিস্তারিত খুলে বললেন মামা। ডাক্তার কামাল আবার চেম্বারে আনতে বললেন তাঁকে। মুনসীকে দেখে ডাক্তার বললেন, 'ড্রেনের তিন গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছে করেছিল আপনার, আপনি তাই খেয়েছেন। না?'
মুনসী কিছু বললেন না। তাদের কাজের বুয়াটার দুই বছরের একটা বাচ্চা আছে। একদিন পানির ফিল্টার থেকে বাচ্চাকে পানি খাওয়াচ্ছিল বুয়া। রাগ করে তিনি বলেছিলেন, ফিল্টার থেকে খাওয়াতে হবে কেন, সরাসরি ট্যাপের পানি খাওয়ালে কী হয়? বুয়া তার বাচ্চাকে তাই খাইয়েছিল। পরের দিন থেকে বাচ্চাটা ডায়রিয়ায় মরতে বসেছিল।
ডাক্তার কামাল ওষুধ পাল্টে নতুন ওষুধ দিলেন। গত বিশ দিন ধরে সেগুলোই খাচ্ছেন মুনসী।
বেশ শীত পড়েছে। আজ রাতে রাস্তায় বের হয়ে মুনসী দেখেন, ফুটপাতে অনেক মানুষ বসে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বসে আছে কেন তারা? তারা বলল, তাদের তেমন কোনো শীতের কাপড় নেই। ঘুমালে শীত আরো বেশি লাগে বলে তারা ঘুমাচ্ছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল মুনসীর। প্রচণ্ড শীতে তারা ঘুমাতে পারছে না, কোনো শীতের কাপড় নেই তাদের। অথচ তাঁর তিনটা মোটা উলের সোয়েটার, দুইটা চামড়ার জ্যাকেট, ফুল হাতের মোটা গেঞ্জি ছয়-সাতটা। কম্বল, লেপ যেটা ভালো লাগে সেটাই গায়ে দিতে পারেন যখন-তখন! অপরাধবোধে বিষণ্ন হয়ে যান তিনি।
বাসায় ফিরে ঘুমাতে যান মুনসী। অপরাধবোধটা রয়েই গেছে এবং সেই বোধ নিয়ে ঘুমানোর পরই ন্যাংটো হওয়ার স্বপ্নটা দেখলেন তিনি। যারা এত কাপড় ঘরে রেখে বিলাসিতা করে, তাদের অন্তত একদিন স্রেফ একদিন গায়ে কোনো কাপড় না রেখে পরিপূর্ণ ন্যাংটো হয়ে কনকনে শীতের রাতে কিংবা দিনে উদাম দেহে ঘোরা উচিত। এটা তাদের জন্য একটা শাস্তি, অন্যের ব্যথা অনুধাবন করার একটা প্রক্রিয়া।
কিন্তু মুনসীর নতুন স্বপ্নের ব্যাপারটা কেমন করে টের পেয়ে যায় সবাই। মামাকে জানানো হয় সেটা। মামা আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। অন্য রকম একটা ওষুধ দেন এবার ডাক্তার কামাল। সেই ওষুধের কার্যকারিতায় স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায় সানাউল্লা মুনসীর। মরার মতো সে এখন ঘুমায়। কখনোসখনো এপাশ-ওপাশ হন দু-একবার, তারপর ভোর হয়ে যায়, বেলা বয়ে যায়, দিন কেটে যায়, রাত চলে আসে। আবার ঘুম, স্বপ্নহীন ঘুম, আবার ভোর, দিন, রাত...।
মুনসী একদিন টের পান, তিনি এবার সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্ন না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন : প্রতিদিন যে কমবেশি ভুল কাজ করছেন, অন্যায় করছেন, তার প্রায়শ্চিত্ত না করতে পারার অনুশোচনায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন।
রাতে এখন আর ঘুমান না সানাউল্লা মুনসী। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশের তারা গোনার চেষ্টা করেন, হাত বাড়িয়ে চাঁদ ছোঁয়ার চেষ্টা করেন কিংবা অন্ধকারের মাঝে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু কী খোঁজেন মুনসী, তা তিনি নিজেই জানেন না। কখনো কখনো ছাদে গিয়ে হাত উঁচিয়ে আকাশ ধরতে চান তিনি, মেঘের কাঁধে ভর করে চলে যেতে চান দূর অজানার দেশে।
চুপিচুপি একা একাই একদিন ডাক্তার কামালের চেম্বারে চলে যান সানাউল্লা মুনসী। রুমের সামনের হলুদ, নীল, কমলা রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারগুলোর একটাতে বসে থাকেন চুপচাপ। ডাক্তারের রুমে রোগীর যাওয়া দেখেন, বের হওয়া দেখেন, আশা আর আশাহত মুখগুলো দেখেন। একসময় সব রোগী চলে যায়, ঠিক তখনই মুনসী মনে করেন, এবার তাঁর একটু যাওয়া দরকার। ধীরে ধীরে একসময় তিনিও যান। ডাক্তার কামাল বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মুনসীকে দেখেই মুখটা হাসি-হাসি করে বললেন, 'আ রে, মুনসী যে! কখন এলেন?'
'এসেছি অনেকক্ষণ।'
'বসুন। মুনসী বসতেই ডাক্তার কামাল বললেন, 'তা কোনো সমস্যা?'
'জি।'
'কী সমস্যা বলুন।'
'আমি সত্যি সত্যি স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছি।'
'তাতে সমস্যা কী?'
'যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তারা সেটা দেখা ভুলে গেলে তারা আর তখন মানুষ থাকে না। মৃত মানুষ হয়ে যায়। মৃত মানুষের কোনো বোধ থাকে না, অনুশোচনা থাকে না, প্রায়শ্চিত্ত থাকে না, আশা থাকে না, স্বপ্ন থাকে না। এসব না থাকার কষ্টে খসে পড়া টিকটিকির লেজের মতো তাদের আত্মা তড়পায়, দুঃসহ একটা আতঙ্কে বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। তখন কেবল নিজে নয়, সবকিছু মনে হয় মৃত, গাছপালা, আকাশ, মেঘ, চাঁদ-তারা সব মৃত। মনে হয় মৃত পৃথিবী!' মুনসী উঠে দাঁড়ায়, 'কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি। দেখেছি, আমি একটা মানুষকে খুন করছি, যে আমার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছে তাকে খুন করছি।' ঝট করে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলেন মুনসী। বাটনে টিপ দিতেই খাটাস করে লম্বা হয়ে গেল ছুরিটা। 'আমি আবার স্বপ্ন দেখতে চাই, ডাক্তার কামাল।'
চেম্বারে ঢোকার পর এই প্রথম মুনসী হাসলেন। লাল চোখে ডাক্তার কামাল দেখলেন, সেই হাসি-হাসি মুখ নিয়েই তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন সানাউল্লা মুনসী, যাঁর ডান হাতে চকচকে একটা লম্বা ছুরি!

প্রথম প্রকাশিত কালের কন্ঠ।

Post a Comment

0 Comments