Ticker

6/recent/ticker-posts

চল অচিনপুরে - আসজাদুল কিবরিয়া


amarboi.com


চল অচিনপুরে
আসজাদুল কিবরিয়া

দর্শনশাস্ত্র মানে কঠিন ও দুরূহ বিষয়। কাজেই দর্শনবিষয়ক কোনো বই পড়া থেকে দূরে থাকা স্বস্তিদায়ক মনে হতো। আর তাই অঞ্জন মাহফুজের অন্তর তীর্থে: মরমী বিশ্বের মৌনভাব বইটি হাতে পাওয়ার পর অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। বইটি যে আমার পড়া হবে না, তা তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিলাম। বড়জোর উল্টে-পাল্টে একনজর দেখে বইয়ের তাকে সাজিয়ে রাখাই হবে সার।
তবে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে মনে হলো, কয়েক পাতা পড়েই ফেলি না কেন! প্রথম থেকে শুরু না করে মাঝখান থেকে একটা প্রবন্ধ বেছে নিলাম। নাম ‘চল রে মন এক অচিনপুরে’।
তিব্বতের রহস্যময় ‘শাম্বালা’র ওপর লেখা। শাংরিলার নাম যতটা পরিচিত, শাম্বালা হয়তো ততটা নয়। জেমস হিলটনের লস্ট হরাইজন গ্রন্থের মাধ্যমে তিব্বতের শাংরিলা সম্পর্কে পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রথম বড় আলোড়ন তৈরি হয়। তিব্বতের বৌদ্ধচর্চা ও বৌদ্ধ মরমিভাবের রহস্যঘেরা আবরণ আজ অনেকটা উন্মোচিত হলেও বেশির ভাগটাই বুঝি রয়ে গেছে অধরা। আর তাই শাম্বালা ঘিরে চিন্তা-গবেষণাও হয়েছে অনেক। কিন্তু এই অমর রহস্যপুরীর রহস্য তাতে উন্মোচিত হয়নি। তুষারাবৃত পাহাড়ঘেরা চিরসবুজ ও শান্ত অথচ গোপন এক স্থান এই শাম্বালার কথা তিব্বতের ঐতিহ্য ও কিংবদন্তিতে প্রথিত। ‘তিব্বতিরা মনে করেন, শাম্বালা নামের এই দেশটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পুব-প্রান্তে এবং জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। তিব্বতি বিভিন্ন গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাইরের বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা, যান্ত্রিক জগতে অধ্যাত্ম মূল্যবোধ ও মরমী বা গূঢ়বিদ্যা ধীরে ধীরে যখন হারিয়ে যেতে বসেছে, শাম্বালাতেই সেসব বিষয় গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষিত করা হয়েছে অনাগতকালের জন্য।’ (পৃ-১১৩)।
শাম্বালা সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিতজনের ধারণা ও পর্যালোচনার সার কথাগুলো সুবিন্যস্ত আকারে তুলে ধরে এবং সেগুলো প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ করে অঞ্জন মাহফুজ পাঠককে নিয়ে যান এক অচিনপুরের মোহজালে। পড়তে পড়তে নিজের মনের গহিন থেকে কেমন যেন একটা আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি হয়। এবং বারবারই প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি শাম্বালা আছে? উত্তরটা মেলে এভাবে, ‘শাম্বালা আর কিছু নয়, আমাদের অচেতনে থাকা সেই মরমী মনকে এমনই এক অমরনগরী তথা ভুবনের দিকে টেনে নিয়ে যায়।...মনে হয় না, শাম্বালা শুধু স্বপ্নময় এক ধর্মীয় ফ্যান্টাসি, বরং এর চাইতে বেশি কিছু। নিশ্চয়ই মানুষের অন্তর্গূঢ় চেতনার একধরনের বাস্তবতা কাজ করেছে। কারণ সত্য রয়েছে সর্বত্র। যদিও তা ফ্যান্টাসি বা মিথ্যা কপোলকল্পনার আবরণে চাপা পড়তে পারে।’ (পৃ-১২২)
এই অধ্যায়টি পড়ার পর গোটা বইটি পড়ার বিষয়ে আগ্রহ বেড়ে গেল। তবে সুবিধা হলো, প্রতিটি অধ্যায়ই স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ। তাই শুরু থেকেই যে পড়ে আসতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সে জন্যই যখন যেটা ইচ্ছা, সে প্রবন্ধটি বেছে নিচ্ছি। না। এটি গোগ্রাসে গিলে ফেলার মতো বই নয়। সময় নিয়ে অল্প কয়েক পাতা করে না পড়লে কোনো আনন্দ পাওয়া যায় না। বিষয়গুলো সম্পর্কে কোনো ধারণাও পাওয়া যায় না। তাই পুরো বইটা শেষ করতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে।
বইটি মূলত ২২টি প্রবন্ধের একটি সংকলন। বেশির ভাগই মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়েছে। কোনোটিতে তিব্বতি পুনর্জন্মবাদ বা মৃত্যুর গোপন তথ্য নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আছে চীনের তাওবাদ এবং সুফিবাদ নিয়ে আলোচনা। প্রাণীর রহস্যবাদ নিয়ে আছে দুটি প্রবন্ধ—‘চিচি যে এক ভগবতী’ ও ‘হুলোর দুনিয়া’।
বস্তুত মরমিবাদ বা মিসটিসিজমের পরিধি অনেক বিস্তৃত ও অত্যন্ত গভীর। যুগে যুগে কালে কালে মরমিবাদে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন চিন্তাধারা ও অনুশীলন। সুতরাং, মরমিবাদের ওপর আলোকপাত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মরমিবাদ-বিষয়ক জ্ঞান দীর্ঘদিনের নিরন্তর ও সুনিষ্ঠ চর্চা ছাড়া যথাযথভাবে আয়ত্ত হয় না। বইটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, অঞ্জন মাহফুজের সেই চর্চায় তেমন কোনো ঘাটতি নেই।
আর এই চর্চার ফলে মরমি বিশ্বের সঙ্গে তার নিজের নিবিড় যোগাযোগের অনুভূতি প্রকাশে তিনি পিছপা হননি। এই অনুভূতিগুলোও পাঠকের মনকে দোলা দেবে, বিমূর্ত চিন্তায় মগ্ন হতে উদ্বুদ্ধ করবে। ‘আপনাতে আপনি হওয়া’ প্রবন্ধের শেষ ভাগ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিলেই তা বোঝা যায়। লেখা হয়েছে, ‘কোনো মানুষের অস্তিত্ব যখন এক জগৎস্তর থেকে অপর স্তরে সট্ করে অনুপ্রবেশ করে বসে তখনই সে নিজেকে খুইয়ে ফেলে, আত্ম-অস্তিত্বকে হারায়-যেন জড় থেকে অজড়ের পানে ফুস করে হারিয়ে গেল, কিংবা বস্তু থেকে ভাবের পানে। এমন অবস্থায় পুরো ঘটনাটিকে আবার নিজের সঙ্গে নিজের পুনর্মিলন হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। এ যেন নিজেকে নিজেরই প্রতিবিম্বের সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে ফেলার দশা, আত্ম-প্রতিবিম্বের সঙ্গে একেবারে বা একাত্ম হয়ে একেবারে জমে যাওয়া, আপন অস্তি-নাস্তির (অস্তিত্বের জড় বা অজড়তে) মধ্যে অদ্বৈত বা ঐক্য গড়া।’ (পৃ-২৬)।
বইটি পড়তে পড়তে এটাও মনে হচ্ছে, অঞ্জন মাহফুজ কাজটি করেছেন দুঃসাহসিক বটে। এর দুটো কারণ। প্রথমত, মরমিবাদের বিষয় কখনো কখনো সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপাত সাংঘর্ষিক হয়ে পড়তে পারে। আর তাই ঔৎসুক্য ও মুক্তমন নিয়ে ‘অন্তর তীর্থে’ প্রবেশ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিষয়ের জটিলতা ও গভীরতা তুলে ধরতে গিয়ে ভাষাগত সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। মাহফুজ এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন বলে আমার ধারণা। সর্বোপরি লেখক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিজের মতামত তুলে ধরলেও তাকে শেষ কথা হিসেবে ভেবে নিতে অনুপ্রাণিত করেননি। বরং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেওয়ার স্পষ্ট আভাস আছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।