Ticker

6/recent/ticker-posts

নিউ ইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসা - পূরবী বসু

Humayun Ahmedনিউ ইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসা - পূরবী বসু

Download/Read

নিউ ইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসা
পূরবী বসু
জনপ্রিয়তা এবং সৃষ্টির বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে বিচার করলে হুমায়ূন আহমেদ সমগ্র বাংলা সাহিত্যে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গকারী লেখক। এই যুগস্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের অকালপ্রয়াণে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ তাই স্তব্ধ-শোকাহত।
আগে তেমন জানাশোনা না থাকলেও আমেরিকায় তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালে হুমায়ূন ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘটনাচক্রেই আমাদের পরিবারের যথেষ্ট সখ্য গড়ে উঠেছিল। আর এই বন্ধুতার প্রায় সবটাই তাঁর চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমার এ ব্যাপারে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা এবং তাঁর চিকিৎসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত দুই হাসপাতালের দুজন সিনিয়র ডাক্তারের (মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিংয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান ও হুমায়ূনের ক্যান্সার চিকিৎসক ডা. স্টিভেন ভিচ এবং বেলভ্যু হাসপাতাল তথা নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক সার্জন জর্জ মিলার) সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে আমার বহুবার সরাসরি যোগাযোগ বা আলোচনার (মৌখিক ও লিখিতভাবে) ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা লিখছি, কিছু তথ্য পরিবেশন করছি। আজ হুমায়ূন নেই। ওঁর বেঁচে থাকাকালে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ওঁকে নিয়ে কিছু লিখিনি কোথাও। শুধু এ কারণে যে নিজেকে অযথা গৌরবান্বীয় করা হয়ে যেতে পারে তাতে। আজ লিখতে বসেও বারবার মনে হচ্ছে, এসব কথা নিয়ে লেখার হয়তো কোনো মানেই হয় না। আর আমি কখনো এ ব্যাপারে লিখব ভাবিওনি কোনো দিন। আসলে এসবের কোনো কিছুরই দরকার হতো না, হুমায়ূন যদি আজ বেঁচে থাকতেন। তাহলে বাংলাদেশে বা যুক্তরাষ্ট্রে আজ ওঁকে এবং ওঁর প্রিয়জনদের নিয়ে অনর্থক এমন বিতণ্ডা বা বিতর্কের সূচনা করার স্পর্ধাও কেউ দেখানোর সুযোগ পেত না। আজ বিভিন্ন স্থানে হুমায়ূনের অসংখ্য ভক্ত তাঁর জন্য শোক করতে গিয়ে বা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে অনর্থক এবং অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে হুমায়ূনের কিছু প্রিয়জনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছেন, কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে তাঁর চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছে। আমি যেহেতু হুমায়ূনের আমেরিকায় ক্যান্সার চিকিৎসার সঙ্গে কিয়ৎ পরিমাণে জড়িত ছিলাম, এটা আমি স্পষ্ট করেই বলতে পারি, আমার জানা মতে হুমায়ূনের চিকিৎসায় কখনো কোনো অবহেলা, কোনো গাফিলতি হয়নি। সে প্রশ্নই আসে না_কোনোভাবেই। হুমায়ূনের ক্যান্সার সার্জারি টিমের প্রধান ডাক্তারকে (ডা. জর্জ মিলার) বারবার বহুভাবে আমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি, হুমায়ূনের পরিবার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে এমন কিছু করার ছিল কি না, যা করা হয়নি, যা আমরা করতে পারিনি, করিনি অথবা সময়মতো করা হয়নি। কিংবা এমন কিছু করা হয়েছিল কি না, যা করা ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে, অথবা যার জন্য কোনো ক্ষতি হয়েছে? জবাবে জর্জ মিলার প্রতিবার পরিষ্কার করে জোর দিয়ে বলেছেন, লিখেছেন (এমনকি মাত্র দুই দিন আগেও আমার লিখিত প্রশ্নের জবাবে টেক্সট মেসেজ করে জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁর জন্য যা করা সম্ভব ছিল তার সবই করা হয়েছে। কোনো কিছু করণীয় থেকে বিরত থাকা হয়নি)। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, হুমায়ূন ও তাঁর স্ত্রী শাওন উভয়েই ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ক্যান্সার ও তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে আমাকে সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা করার অনুমতি ও অধিকার দিয়েছিলেন বলেই সেটা করতে পেরেছি; তা না হলে এ দেশে ডাক্তার বা হাসপাতালের তরফ থেকে রোগীর পরিবারের বাইরের কাউকে রোগীর শারীরিক অবস্থা বা চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিধান লঙ্ঘনের আশঙ্কায় সবাই বড় সতর্ক এ দেশে। আমাকে এই বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত এই কারণে যে আমি নিজে ডাক্তার না হলেও বায়োমেডিক্যাল বিজ্ঞানে, বিশেষ করে ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। এর ফলে ডাক্তারি শাস্ত্র সম্পর্কে আমার সামান্য কিছু ধারণা জন্মেছে। আর পেশাগত কারণেই স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু টেকনিক্যাল শব্দের সঙ্গেও পরিচিতি রয়েছে আমার। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় যে কারণে হয়তো এত অনায়াসে আমাকে এই দায়িত্ব তাঁরা দিতে পেরেছিলেন, সেটা হলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনা ও বিচক্ষণতার ওপর হুমায়ূন ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনের এক রকম আস্থা জন্মেছিল।
গত বছর (২০১১ সালে) সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সিঙ্গাপুরে রুটিন চেক-আপ করাতে গিয়ে আকস্মিকভাবেই ধরা পড়ে, হুমায়ূনের কোলনে (বৃহদন্ত্রে) ক্যান্সার। আর তাও চতুর্থ স্টেজে। সাধারণত রোগীর শরীরে ক্যান্সারের অবস্থা নির্ণয়ে এই স্টেজগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়। কতকগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে ক্যান্সারের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি অনুসারে সাধারণত এই স্টেজগুলোকে ১ থেকে ৪ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়। প্রাথমিক বা স্টেজ ১-এ ক্যান্সার মূল জায়গায় অর্থাৎ যেখানে প্রথম বাসা বেঁধেছিল, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং শরীরের আর কোথাও ছড়ায় না। তখন উপযুক্ত বা যথাযথ চিকিৎসা করলে নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। অবশ্য সেটাও নির্ভর করে কী ধরনের ক্যান্সার, কোথায় এর অবস্থিতি, ক্যান্সার ছাড়া শরীরে অন্যান্য অসুস্থতা বা জটিলতার উপস্থিতি (যেমন_ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) রয়েছে কি না, রোগীর বয়স কত ইত্যাদি। সফলতার সঙ্গে ক্যান্সার চিকিৎসার সম্ভাবনা যেমন প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি এটাও সত্য যে এখনো এমন অনেক ক্যান্সারই রয়েছে, যাদের উপস্থিতি স্টেজ ১-এ ধরা পড়লেও অনেক সময় করার কিছুই থাকে না। স্টেজ ৪ ক্যান্সার মানে সবচেয়ে পরিণত বা Advanced Stage-এর ক্যান্সার। স্টেজ ৪-এ কর্কট কোষগুলো মূল জায়গা ছাড়াও অন্যত্র, মানে শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কোলন ক্যান্সারে চার নম্বর স্টেজ থেকে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা খুবই কম (৭ শতাংশের মতো)। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরাই দুঃসংবাদটি দিয়েছিলেন হুমায়ূনকে। জানিয়েছিলেন কোলন থেকে তাঁর ক্যান্সার লিভারের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় সম্ভাব্য করণীয় কী কী হতে পারে তারও বিবরণ দিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা। তবে কোনো কিছুই খুব আশাপ্রদ বলে মনে হয়নি তাঁদের। সম্ভাব্য চিকিৎসার মধ্যে ছিল কেমোথেরাপি, অথবা কিছু কেমোথেরাপি আর সার্জারি। কিন্তু অসুখের নামটা শুনেই হুমায়ূন মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জায়গায় যাবেন এবং সেটা সিঙ্গাপুর নয়, আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি সপরিবারে। স্ত্রী শাওন ইন্টারনেট ও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, নিউ ইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারই এই বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত হাসপাতাল। সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আমেরিকায় স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এত নামকরা ও পুরনো প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো রোগীর ভিড় ও চাহিদা একটু বেশি এখানে। তাই চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে এখানে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করতে হয়। সে যা-ই হোক, হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকাশক ও প্রতিবেশী আলমগীর রহমানের (আলমগীর আমাদেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্তত চার দশক ধরে) কাছে কাকতালীয়ভাবে সংবাদটা জানতে পেরে আমি হুমায়ূনের জন্য তাঁর নিউ ইয়র্কে পৌঁছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্লোন ক্যাটারিংয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য একটা অ্যাপয়নমেন্টের ব্যবস্থা করি। এ ব্যাপারে আমার সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রিভলিন আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন। এ ছাড়া আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রায় এক যুগ ধরে আমি স্লোন ক্যাটারিংয়ে গবেষণার কাজ করেছি বলে সেখানে এক-আধটু জানাশোনা তখনো অবশিষ্ট ছিল। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ রাতে সপরিবারে হুমায়ূন নিউ ইয়র্কে পৌঁছেন আর সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ সকাল ৮টায় তাঁর অ্যাপয়নমেন্ট ঠিক করা হয় স্লোন ক্যাটারিংয়ে। সেদিন সব কাগজপত্র, প্লেট দেখে, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার স্থির করেন, প্রথম কিস্তিতে ছয়টি কেমো নিতে হবে। হুমায়ূনের ক্যান্সারের তখন যে অবস্থা (স্টেজ ৪), তাতে তখন আর সার্জারি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কাগজে এই সার্জারি না করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক সংবাদ ভেবে লিখে ফেলে, 'অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। অপারেশন ছাড়াই হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে উঠবেন।' ডাক্তার স্টিভেন ভিচ বললেন, প্রথম ছয়টি কেমো দিয়ে দেওয়ার পর সিটি স্ক্যানসহ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবার করে পরবর্তী সময়ে কর্মপদ্ধতি স্থির করা হবে। মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিংয়ের আন্তর্জাতিক শাখার প্রধান ডা. স্টিভেন ভিচ নিজেই হলেন হুমায়ূনের ডাক্তার। বললেন, আপাতত যে ছয়টি কেমো দেওয়া হবে তার প্রতিটির ভেতর তিনটি করে ক্যান্সারের ওষুধ থাকবে। লক্ষ করলাম, স্লোন ক্যাটারিং গত ২৫ বছরে অনেক বদলে গেছে। বড়ও (আকৃতিতে) হয়েছে অনেকটাই। তবে হাসপাতালের বহিরাঙ্গের এই পরিবর্তনের ঝিলিক চিকিৎসায় কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, ঠিক বলতে পারব না; কিন্তু চিকিৎসার অর্থায়নের ব্যাপারে সেটা স্পষ্ট। বিশেষ করে এখনকার নিয়মে যাঁরা বিদেশি এবং যাঁরা স্বাস্থ্য বীমাবিহীন বিদেশি, তাঁদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সবটা অর্থই আগে থেকে ক্যাশিয়ারের কাছে জমা দিতে হবে, তার পরই চিকিৎসা শুরু হবে। এটা করা হয়েছে কারণ অনেক বিদেশি রোগী নাকি ধারে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করেই নিজ দেশে ফিরে গেছেন। কোনো দিন তাঁদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁরা জানান, নতুন পলিসি অনুযায়ী হুমায়ূনের কেমোথেরাপির প্রথম কোর্সের (ছয়টি কেমোর) যাবতীয় অর্থ আগাম পরিশোধ করলে তবেই চিকিৎসা শুরু হবে। সে তো একসঙ্গে বিস্তর টাকার ব্যাপার। অত টাকার ব্যবস্থা রাতারাতি করা প্রায় অসম্ভব। অথচ চিকিৎসা আর দেরি না করে এক্ষুনি শুরু করা দরকার। এ অবস্থায় ডা. ভিচসহ আরো দু-তিনজনের সঙ্গে কথা বলে কিস্তিতে টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই।
স্লোনে কেমো দেওয়ার ধরনটি ছিল এ রকম_কেমো নেওয়ার দিন সকালে হাসপাতালে গেলে প্রথমে রোগীর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হবে এটা দেখতে যে কেমো নেওয়ার জন্য তাঁর স্বাস্থ্য উপযুক্ত কি না। তাঁর হিমোগ্লোবিন, লাল, সাদা ও অন্যান্য (প্লেটিলেট) রক্তকণার পরিমাণ, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কি না দেখা হবে। এরপর ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করবেন, কথা বলবেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। ইতিমধ্যে ফার্মেসিতে তাঁর ইন্ট্রাভেনাস কেমো দেওয়ার জন্য ককটেইল তৈরি হতে থাকবে। অর্থাৎ ক্যান্সার কোষগুলো মেরে ফেলার জন্য যে তিনটি কড়া ওষুধ শরীরে যাবে, তা শরীরের ভালো জীবকোষগুলোকেও যাতে ধ্বংস বা ক্ষতি না করে সে জন্য ওই ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন, মিনারেল, স্টেরয়েড ছাড়াও বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো হয়, যার জন্য কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইদানীং আগেকার দিনের তুলনায় অনেক কম হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে সেই ওষুধ-ককটেইল শরীরে দেওয়ার পর বাকি ওষুধটা একটি বোতলের মতো ধাতব পাত্রে ভরে রোগীর পেটের ওপর একটা ব্যাগে বেঁধে দেওয়া হয়। একটা সরু নল দিয়ে সেই বোতল থেকে ওষুধ এসে রোগীর বুকের চামড়ার ভেতরে semi-permanent-ভাবে বসানো medi-port-এর ভেতর দিয়ে দুই দিন ধরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করবে। কিন্তু তার জন্য দুই দিন ধরে হাসপাতালবাসের প্রয়োজন নেই। ঘরে গিয়ে দুই দিন পরে এসে খালি ক্যানিস্টারটা খুলিয়ে আসতে হয় কেবল। এভাবে দুই সপ্তাহ পর পর তিন দিন ধরে কেমো চলতে থাকে; কিন্তু কেবল প্রথম দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আউটপেশেন্ট বিভাগে থাকতে হয়। বাকি কেমো চলে বাড়িতেই।
ডা. ভিচ ও স্লোন ক্যাটারিংয়ের অন্য সমাজকর্মীদের সঙ্গে এই চিকিৎসার খরচের ব্যয়ের ব্যাপারে কথা বলে কিছু করে উঠতে পারিনি। ২৫ বছর আগে অন্য এক বাঙালি ক্যান্সার রোগীর বিনা খরচে চিকিৎসার যে ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজকের পরিবর্তিত পলিসির স্লোন ক্যাটারিংয়ের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেলাম না। এই নামিদামি হাসপাতালটি এবং এর বেশির ভাগ কর্মচারীকে এখন কেমন প্রাণহীন ও রোবটের মতো মনে হয়েছে আমার। অত্যন্ত বেশি ব্যবসায়ী মনোভাব গড়ে উঠেছে এখানে_ওটাই বর্তমানে এখানকার সংস্কৃতি। আন্তর্জাতিক ভবনে প্রতিটি আন্তর্জাতিক রোগীর জন্য রয়েছে একজন করে বিশেষ সমন্বয়কারী। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে পড়লেন এমন একজন মধ্যপ্রাচ্যের নারী, যাঁর আগাগোড়া ব্যবহারে এটিই ফুটে উঠছিল যে 'বাবু যত বলে, মোসাহেব দলে বলে তার শতগুণ'। আমার যুক্তি ছিল, যেহেতু হাসপাতাল যা বিল করে কোনো ইনস্যুরেন্স কম্পানিই এর পুরোটা কখনো দেয় না। তারা তাদের হিসাবমতো একটা ন্যায্য ও নির্দিষ্ট মূল্য স্থির করে দেয় প্রতিটি চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজের জন্য। প্রতিটি ইনস্যুরেন্স কম্পানিই যেহেতু ভিন্ন ও স্বাধীন, তাদের সবার ন্যায্য মূল্যও এক নয়। আর কোনো বিশেষ হাসপাতাল যদি একটি বিশেষ ইনস্যুরেন্স গ্রহণ করে থাকে (সব হাসপাতাল সব ইনস্যুরেন্স নেয় না), তাহলে সেই হাসপাতাল ওই ইনস্যুরেন্স কম্পানি নির্ধারিত ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য। তারপর পলিসি অনুযায়ী যদি ইনস্যুরেন্স কম্পানি ৮০ শতাংশ দেয়, রোগীকে দিতে হয় বাকি ২০ শতাংশ। আর মূল বিল থেকে বাকি অংশটা হাসপাতাল write off করে দেয়। আমার যুক্তি ছিল, ইনস্যুরেন্স থাকলে যদি তারা চিকিৎসার জন্য আংশিক মূল্য নিয়ে বাকিটা ছেড়ে দিতে পারে, তাহলে যে ব্যক্তির ইনস্যুরেন্স নেই, যে ক্যান্সার চিকিৎসার মতো বিশাল খরচ নিজে বহন করছে, তার জন্য কোনো প্রকার ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা থাকবে না কেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এই নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিংয়ে (যার শত বছর পূর্তি উপলক্ষে, মনে আছে, ১৯৮৪ সালে স্লোন ক্যাটারিংয়ের মূল ভবনে এসে ইউএস পোস্টাল সার্ভিস বিভাগ দুটি নতুন ডাকটিকিট চালু করেছিল আনুষ্ঠানিকভাবে) এ ব্যাপারে কিছু করতে সক্ষম হলাম না। স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলো ছাড়াও সরকারি কিছু ইনস্যুরেন্স রয়েছে, যেমন গরিবদের জন্য মেডিকেইড এবং অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধদের জন্য মেডিকেয়ার। ইতিমধ্যে সব দেখেশুনে পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম, কোলন ক্যান্সারের জন্য যে কেমো হুমায়ূন নিচ্ছেন এখানে, এর সঙ্গে এ দেশের অন্য হাসপাতালের কোলন ক্যান্সারের কেমোর কোনো বস্তুগত বা গুণগত পার্থক্য নেই। ডা. ভিচ প্রথম থেকেই হুমায়ূনকে খুব পছন্দ করেন এবং হুমায়ূনও ভিচ বলতে অজ্ঞান। ডা. ভিচ আমাদের বারবার বলেছেন, এখন যে চিকিৎসা চলছে তা একেবারে মামুলি বা স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপি, যা বেশ কিছু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে অন্তত এই বিশেষ চিকিৎসাটির ক্ষেত্রে স্লোন ক্যাটারিংয়ের মতো প্রাইভেট ও খরচসাপেক্ষ হাসপাতালে এসে নিজের বিত্তের এক বিশাল অংশ খুইয়ে রুটিন চিকিৎসা নেওয়ার মানে হয় না। তিনি বলেছিলেন, শুধু এখানকার সিটি হাসপাতালে কেন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, এমনকি হয়তো বাংলাদেশে বসেও একই চিকিৎসা পেতে পারেন হুমায়ূন। ইতিমধ্যে শাওন খোঁজখবর নিয়ে দেখেন, সিটি হাসপাতালগুলোতে ফোর্থ স্টেজ কোলন ক্যান্সারের জন্য একই ওষুধ দেওয়া হয়। নিউ ইয়র্কের কোনো সিটি হাসপাতালে কর্মরত এক বাঙালি ডাক্তার দম্পতি শাওনকে সে কথা বলেছেন; তবু আমাদের দ্বিধা কাটে না। হুমায়ূন রাজি হলেও শাওনের মনে ভয়, যদি চিকিৎসার মান একই না হয়! ওদিকে শাওনের মা এখান থেকে এবং শাওনের বাবা ঢাকা থেকে ক্রমাগত বলছেন স্লোন ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যদি চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দিতে হয়, সেটা যেন চিন্তায়ও না রাখে তারা। প্রয়োজনে শাওনের বাবা দেশ থেকে টাকা পাঠাতে চাইলেন। যা হোক, সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্য আমি ডেনভার, কলোরাডোতেও খোঁজ করি। কোলন ক্যান্সারের স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপির ওষুধগুলোর নাম, মাত্রা ও খরচ সম্পর্কে খোঁজ নিই। নিউ ইয়র্কের সিটি হাসপাতালের মতো না হলেও স্লোনের চেয়ে অনেক কম খরচ এখানেও। আমি তখন ডা. ভিচকে গিয়ে দুটো কথা বলি। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন হুমায়ূনের অত্যন্ত প্রিয়জন, তাঁর সুহৃদ, ঢাকায় তাঁর পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী, হুমায়ূনের বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ব্যবসা, বাড়িঘর, পরিবার_সব ছেড়ে দীর্ঘদিন তিনি এখানে পড়ে আছেন কেবল হুমায়ূনের চিকিৎসার তদারক করতে। তা ছাড়া মাজহারকে হুমায়ূন খুবই স্নেহ করেন_অনেক ব্যাপারে তাঁর ওপর নির্ভর করেন। ঢাকায় বাড়িতে বিশেষ ধরনের বড় মাছ এলে মাজহারের জন্য অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতেন হুমায়ূন একসঙ্গে বসে খাবেন বলে। গত নয়-দশ মাসে আমরা অন্তত চারবার গেছি নিউ ইয়র্কে (জ্যোতি আরো অনেক বেশিবার) বেশ কিছু সময়ের জন্য। আসলে আমরা একসময় ওখানেই স্থায়ীভাবে থাকতাম। বর্তমানে, মানে দুই বছর হলো, আমরা ডেনভার, কলোরাডোতে থাকি, তবে প্রায়ই আসি নিউ ইয়র্কে। যখন যাই, নিজের বাড়ির নিচতলায়ই থাকি। ওপরে ভাড়ায় থাকে আমাদের বন্ধু তাজুল ইমাম ও স্বপ্না। গত ১০ মাসে যতবার নিউ ইয়র্কে গেছি, একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি হুমায়ূনের বাসায় বেশ কয়েক রাতসহ। সেই বাড়িতে রয়েছেন হুমায়ূন, শাওন, কখনো শাওনের এমপি মা, কখনো ছোট বোন সেঁজুতি, নিষাদ, নিনিত, মাজহার, ঘরের কাজে সাহায্যকারী খালা, যে এই বাড়িতেই থাকে এবং একবার পেয়েছিলাম মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণাকে তাঁদের দুই ছেলেসহ। সেই গৃহে আমাদের অবস্থানের সময় আমি দেখেছি, অন্যের জন্য কী সাংঘাতিক করতে পারেন এই মাজহার! খাবারের ব্যাপারে হুমায়ূন খুবই খুঁতখুঁতে। এক খাবার দুই বেলা খাবেন না, বাসি কিছু তো নয়ই। এর ওপর কেমোথেরাপি নিলে এমনিতেই খাদ্যে রুচি চলে যায়। প্রতি সকালে উঠে মাজহার হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করেন, স্যার, আজকে দুপুরে কী খাবেন? হুমায়ূন যা বলেন, সেটা কিনতে তখনই বাজারে ছোটেন মাজহার। শুধু তা-ই নয়, অনেক দিনই নিজের হাতে রান্না করেন মাজহার, যেমন করে রাঁধলে হুমায়ূন পছন্দ করেন ঠিক সেভাবেই রাঁধেন। প্রায় বিকেলেই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপ বানিয়ে আনেন তাজা তরিতরকারি দিয়ে হুমায়ূনের জন্য। কখনো ফল কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে আসেন প্লেটে। বাড়ির এই অনাত্মীয় লোকটিকে বরাবর দেখেছি সম্পূর্ণ পরিবারটিকে আগলে রাখতে। কে বলবে তাঁকে দেখে তিনি ঢাকায় এত বড় ব্যবসায়ী! তাঁর স্ত্রী-পুত্রদ্বয় যখন এসেছিল বেড়াতে, হাসপাতাল, রান্না, বাজার করেও স্ত্রী ও বাচ্চাদের নিয়ে দ্রষ্টব্য স্থানে ঘোরাফেরা করা, শপিং করা, পাবলিক লন্ড্রামেটে কাপড় ধোয়া-শুকানো_সবই করতেন মাজহার। আমার মনে হয়, পরিবারের কোনো দুর্যোগ বা বিপদ এলে সব সময়ই দেখা যায় বাড়ির ভেতরের বা বাইরের একজন কাউকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামনে এগিয়ে আসতে। সব কিছুর দিকে লক্ষ রেখেও তিনি এই বিশেষ আপৎকালীন সময়টাকে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করেন। হুমায়ূন পরিবারে, তাঁর অসুস্থতার সময়, নিউ ইয়র্কে, সেই কাজটি অত্যন্ত দরদ দিয়ে করেছেন মাজহার_মাজহারুল ইসলাম। শুধু বাড়ির লোক নয়, বাড়িতে বেড়াতে গেছি আমরা যারা, তাদের প্রত্যেকের প্রতিও তাঁর নজর ও কর্তব্যের শেষ নেই। আসলে যারা করে, সবার জন্যই করে; যারা করে না, কারো জন্যই করে না। দীর্ঘ জীবনে এমনটি কতবার দেখেছি।
যে কথা বলছিলাম, সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্য, নিজেরা নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য আমরা আবার ডা. ভিচের সঙ্গে বসি একদিন। তিনি আমাদের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে সিটি হাসপাতালে একই চিকিৎসা চলবে হুমায়ূনের। তিনি কথা দেন, সিটি হাসপাতালের জন্য একটি ফাইল তৈরি করে দেবেন তিনি। সেখানে তাঁর চলতি চিকিৎসার বিষয়ে সব কিছু লিখে দেবেন, মানে এখানে কিভাবে কোন ওষুধ কত ডোজে কত দ্রুততার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি সব কিছু পূর্ণ সম্প্রসারিত রূপে। আমি তখন তাঁকে অনুরোধ করলাম, এটা কি আদৌ সম্ভব যে তিনি তাঁর ওষুধের ককটেইলের একটা রেসিপি দিয়ে দেবেন আমাদের কাছে বা সিটি হাসপাতালে, যেখানে রন্ধন পদ্ধতির মতো করে লেখা থাকবে প্রতিটি adjuvant দ্রব্যের নাম, পরিমাণ, মেশানোর পদ্ধতি, কতক্ষণ ধরে মেশানো হয়, সব কিছু, পরম্পরাসহ। ডা. ভিচ রাজি হলেন, সেটাও নিজের হাতে লিখে দেবেন তিনি। এরপর তাঁর সঙ্গে কথা হলো, তাঁর পরামর্শমতো, তাঁর তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চলবে কিন্তু খরচ কমানোর জন্য কেমোটা নেওয়া হবে সিটি হাসপাতালে। এ ছাড়া কিছুদিন পর পর রোগীর অবস্থা নিরূপণে যে স্ক্রিনিং চলবে, জানার জন্য কতটা উন্নতি হলো, কতটা ছোট বা শুকিয়ে এলো টিউমারের আকৃতি, টিউমার মার্কারের পরিমাণ কতখানি কমল বা কমল না, অন্য কোথাও ছড়াল কি না ক্যান্সার ইত্যাদি। আমরা ডা. ভিচকে তাঁর সব কিছু জানাব, দেখাব কাগজপত্র প্লেট। তিনি রাজি হলেন। সেই থেকে আমি হুমায়ূনের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছি। ডা. ভিচের সঙ্গে আমার ই-মেইলে শেষ দুটি যোগাযোগ হয়েছে ১৭ আর ১৯ জুলাই। ১৯ জুলাই হুমায়ূন মারা গেছেন। ডা. ভিচের দুটি ই-মেইলের কপি দেওয়া হলো নিচে, একটি হুমায়ূন মারা যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে, অন্যটি মারা যাওয়ার ঠিক পরে। ডা. ভিচ সব সময় ই-মেইল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতে উত্তর দেন, কোনো সেক্রেটারির মাধ্যমে নয়।
(১)
I am so sorry to hear this terrible news. It seems from your description that this is a post-operative complication and the chance of survival in his current condition is extremely low. I would not think the fall should have been a factor in this situation and would have happened regardless. It would seem the doctors are trying everything possible to save his life but realistically I would prepare for the worst.
Please pass on my sympathy to his family and friends.
Dr. Veach

(২)
It is very hard for everyone, I am sure, after all of the difficulty, sacrifice, and pain, to believe that he is gone. Surely no one can doubt that you and he did everything possible. It is beyond all of our capacity to understand why it happened to him. Please accept my most sincere condolence and sympathy. With warm regards, Dr. Veach.
ইতিমধ্যে স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে পাঁচটি কেমো নেওয়া হয়ে গেছে। এরপর হুমায়ূনের সিটি হাসপাতালে (বেলভ্যু হাসপাতালে) তাঁর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন নিউ ইয়র্কের মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা। স্লোন ক্যাটারিংয়ের একেকটা কেমোতে যেখানে সাড়ে ১৭ হাজার ডলার লাগত, সেখানে প্রায় বিনা পয়সায় তাঁর একই কেমো চলতে থাকে বেলভ্যুতে। বরং বেলভ্যুতে Avastine নামে আরো একটি নতুন ওষুধ যোগ করা হলো, যেটা মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিংয়ে দেওয়া হতো না। Avastine সাধারণত এই পর্যায়ের বেশির ভাগ কোলন ক্যান্সার রোগীকে দেওয়া হয় অন্য তিনটি (Oxaliplatin, Levo covenin, 5 FLU) ওষুধের সঙ্গে, যে তিনটি স্লোন ক্যাটারিংয়ে দেওয়া হচ্ছিল। Avastine কেন এত দিন দেওয়া হয়নি বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজিস্টের প্রশ্নের উত্তরে ডা. ভিচের বক্তব্য ছিল, দুই কারণে সেটা করা হয়নি_যখন হুমায়ূন প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন এখানে, তাঁর কোলনের টিউমারের যা অবস্থা ছিল, আকৃতি ও রক্তক্ষরণের পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনি ইচ্ছা করেই Avastine দেননি, কেননা তাতে বি্লডিং বেশি হতে পারে। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, তিনি ভেবে দেখেছেন Avistine (যা প্রধানত টিউমার কোষের মধ্যে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ করে টিউমারকে বড় হতে বাধা দেয়) তার ককটেইলে যোগ করলে ফলাফল উনিশ-বিশের বেশি কিছু হতো না। সে ক্ষেত্রে পকেট থেকে এত খরচের পর আরেকটি খুব দামি ওষুধ যোগ করে খরচ বাড়ানোর ব্যাপারে বিবেকের কাছে সায় পাননি তিনি। বেলভ্যুর অল্পবয়সী অত্যন্ত সতর্ক নারী ডাক্তারটি তখন এই প্রৌঢ় অভিজ্ঞ ডা. ভিচকে জিজ্ঞেস করলেন, পাঁচটি কেমোর পর যেহেতু তাঁর টিউমারের অবস্থা অনেক ভালো, রক্তক্ষরণও আর নেই, টিউমার মার্কারের পরিমাণও কমে এসেছে, সে ক্ষেত্রে এখন Avastine যোগ করলে কেমন হয়? ডা. ভিচ তাঁকে Avastine যোগ করার পরামর্শ দিলেন। এভাবে হুমায়ূন আহমেদের স্লোন ক্যাটারিংয়ের চিকিৎসাই বেলভ্যু হাসপাতালে (সিটির অধীনে হলেও বেলভ্যু হাসপাতাল গুণগত দিক দিয়ে খুবই নামকরা। শুধু সিটির অধীনে নয়, বেলভ্যু হাসপাতাল খ্যাতনামা নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত) হতে থাকে। পার্থক্য শুধু বেলভ্যুতে ঘরে কেমো নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এখানে কেমো নেওয়ার প্রথম দিন আউটপেশেন্ট হিসেবে এবং পরের দুই দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেমো নিতে হয়। এটা একদিক দিয়ে ভালো, কেননা কেমো নেওয়ার সময়ও সর্বক্ষণ চিকিৎসকদের নজরের ভেতর থাকেন হুমায়ূন। বেলভ্যু হাসপাতালে কর্মরত দু-একজন বাঙালি স্বাস্থ্যকর্মী হুমায়ূনকে রোগী হিসেবে পেয়ে মহা আনন্দিত এবং তাঁদের একজন রনি সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের প্রিয় লেখকের জন্য। যেমন কেমো নেওয়াকালে semi-private room-এর বদলে private room-এর ব্যবস্থা করেন তাঁরা, যাতে ইচ্ছা করলে শাওন এসে থাকতে পারেন রাতে। মাঝখানে কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দু-দুবার সাদা রক্তকণা অথবা প্লেটিলেটের পরিমাণ অনেকটা কমে যায় হুমায়ূনের। এই রকমটি ঘটা খুবই স্বাভাবিক কেমোথেরাপির রোগীদের। এ রকম একবার হয়েছিল স্লোনে চিকিৎসার সময়ও। তখন নির্ধারিত কেমোর দিন পেছাতে হয়। প্রয়োজনে রক্তকণার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য bone-marrow কে চাঙ্গা করতে এ রকম ইনজেকশন দেওয়া হয়। তাতে হুমায়ূনের বেশ কয়েক দিন ধরে হাত-পায়ে খুব ব্যথা, সামান্য জ্বর ও বিভিন্ন রকম শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য হতো।
কেমো নেওয়া, রক্ত পরীক্ষা করা ও স্ক্রিনিংয়ের জন্য হাসপাতালে খুব ঘন ঘনই যেতে হতো হুমায়ূনকে। বেলভ্যু হাসপাতাল ম্যানহাটানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছে। আর হুমায়ূনের ভাড়া করা বাসা জ্যামাইকা, কুইন্সে। প্রথম দিকে বিশ্বজিতের স্ত্রী রুমা সাহাই প্রধানত নিয়ে যেত হুমায়ূনকে হাসপাতালে। পরের দিকে জ্যোতি (জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত) নিউ ইয়র্ক থাকাকালে প্রায়ই নিয়ে যেত হুমায়ূনকে। এ বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত লাগোর্ডিয়া কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ানোর জন্য জ্যোতি নিউ ইয়র্কেই ছিল। তখন অনেক ঘন ঘন তার দেখা হতো হুমায়ূনের সঙ্গে। জ্যোতির সঙ্গ খুব উপভোগ করতেন হুমায়ূন। অপেক্ষা করে বসে থাকতেন যেদিন সে আসবে। রুমা ও জ্যোতি ছাড়াও কখনো কখনো হুমায়ূনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন হুমায়ূনের বাল্যবন্ধু ফানসু মণ্ডল, নুরুদ্দীন সাহেব ও রুবেল। আটটি কেমো শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো স্ক্রিনিং হলো। আমরা ফলাফল নিয়ে স্লোন ক্যাটারিংয়ে ডা. ভিচের কাছে গেলাম। শাওন, মাজহার, জ্যোতি ও আমি গেলাম সেখানে। মনে মনে আশা ছিল। কেননা আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে হুমায়ূনের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো হয়েছে, তাঁর ওজন বেড়েছে, আগের তুলনায় খাবারও খাচ্ছেন নিয়মিত। এত দিনে লিভারের টিউমারগুলো যথেষ্ট হয়তো সংকুচিত হয়েছে। হয়তো তিনি এখন অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত হবেন। এর পরও মনে সন্দেহ ছিল বলে আমরা রোগীকে সঙ্গে নিয়ে যাইনি। হুমায়ূন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ। সেসব ব্যাপারে একেবারে ছেলেমানুষের মতো ভয় ছিল, কোনো কিছু নেতিবাচক শুনলেই না বলে বসেন, 'তাহলে আমি চললাম দেশে।' ডা. ভিচ দেখেশুনে বললেন (পরে তাঁদের সার্জারি বিভাগের সঙ্গেও কথা বলে একই মন্তব্য করেছিলেন), হুমায়ূনের অনেক উন্নতি হলেও লিভারের টিউমার এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি, যখন Local Embolization করা যাবে। স্লোন ক্যাটারিং এই একটা নতুন টেকনিক শুরু করেছে, বলেছিলেন ডা. রিভলিন (আমার সাবেক বিভাগীয় প্রধান) ও ডা. ভিচ, তাঁদের জন্য যাঁদের টিউমার প্রাইমারি জায়গা থেকে শুরু করে এখন ছড়িয়ে গেছে লিভারে (metastatis)। এই পদ্ধতি এখন অন্য কয়েকটি জায়গাতেও করে। পদ্ধতি অনুযায়ী লিভারের যেখানে যেখানে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সেখানে গিয়ে ওই বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে স্থায়ীভাবে একধরনের বিশেষ টেকনিকে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় কেমো দিতে হয় না। ফলে পুরো লিভার বা পুরো শরীরের জীবকোষগুলো মাত্রাতিরিক্ত কেমোর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আর সম্ভাবনা থাকে না।
এরপর বেলভ্যুতে আরো চারটি কেমো দেওয়া হলো। ১২টি কেমোর ধাক্কা সামলানো কম কঠিন কাজ নয়। হুমায়ূন মনের জোরে এক রকম সহজভাবেই তা পার করে দিলেন। এদিকে শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শাওনের মা এবং কখনো কখনো তাঁর ছোট বোন এসে তাঁকে সাহায্য করেন, মনে জোর দেন। দুটি অতি শিশুসন্তান নিয়ে নিউ ইয়র্কের মতো বৃহৎ শহরে তা নইলে তাঁদের খুব অসুবিধা হতো। ১২টি কেমো দেওয়ার পর নতুন করে আবার স্ক্রিনিং হওয়ার পর বেলভ্যুতে-নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল কলেজের সার্জন ডা. মিলারের সঙ্গে হুমায়ূন ও তাঁর পরিবারের দীর্ঘ মিটিং হয়। আমি তখন ডেনভারে। প্রতিদিনই টেলিফোনে খবর পাই হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার। সার্জারির ব্যাপারে অনকোলজি বিভাগ থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিলে প্রাথমিক কথা হওয়ার পরে আবার দ্বিতীয় দফায় বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ১২ জুন ভোরে হুমায়ূনের সার্জারি হবে_কোলন ও লিভারে দুই জায়গাতে একই সঙ্গে। কোলনে হবে প্রথাগত সার্জারি। অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের যে অংশে ক্যান্সার রয়েছে, সেই অংশটুকু কেটে ফেলে দিয়ে আবার সুস্থ বৃহদান্ত্রের দুই মাথা যোগ করে সেলাই করে দেওয়া হবে। আর লিভারে প্রথম Local embolization technique ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। যদি সেটা সম্ভবপর না হয় অথবা কোনো জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে লিভার থেকে প্রথাগতভাবে মানে পুরনো স্টাইলে টিউমার কেটে ফেলে দেওয়া হবে লিভারের লোব থেকে। দুটির জন্যই সম্মতিপত্র রেখে দিলেন তাঁরা। সংবাদটি শুনে আমরা সবাই খুশি। সার্জারিই একমাত্র আশা, যদি হুমায়ূনকে নিরাময় করে তোলা যায়। কেননা দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমোথেরাপি আর আগের মতো কাজ করছিল না। সত্যি বলতে গেলে আটটি ও ১২টি কেমোর ভেতর লিভারে খুব যে দৃশ্যনীয় উন্নতি ঘটেছে, তা নয়। ১২ জুন হুমায়ূনের সার্জারি হবে, বেলভ্যু থেকেই সুসংবাদটি দিল আমায় শাওন। আমি তখন ডেনভারে। আর তাঁরা বেলভ্যুতে। তাঁরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই আমি ১১ জুন সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে পৌঁছার একটি প্লেনের টিকিট কেটে ফেলি। জ্যোতিও তখন নিউ ইয়র্কেই থাকবে। তাঁর সার্জারির জন্য আমার এত দূরে আসার খবরটা শুনে হুমায়ূন খুবই খুশি হন। সে কথা ফোনে জানায় আমাকে।
আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করি। ১১ তারিখ রাতে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে জ্যোতি ও মাজহার হুমায়ূনের জ্যামাইকার বাসায় নিয়ে আসে। হুমায়ূনকে সে রাতে খুব হাসিখুশি ও চিন্তামুক্ত লাগছিল। আসন্ন সার্জারির জন্য দুশ্চিন্তার কোনো চিহ্ন নেই। পরদিন সকাল ৬টায় সার্জারি। সাড়ে ৫টায় পৌঁছাতে হবে। হুমায়ূনের ইচ্ছা জ্যোতির সঙ্গে যাবেন হাসপাতালে। যথারীতি ভোর সাড়ে ৪টায় জ্যোতি আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে সাড়ে ৫টার আগেই আমরা বেলভ্যুতে পৌঁছি। আমাদের গাড়িতে হুমায়ূন, শাওন, জ্যোতি ও আমি। মাজহারের বন্ধু রুবেলের গাড়িতে রুবেল, মাজহার ও ফানসু। সাড়ে ৫টার আগেই হাসপাতালে পৌঁছে যাই। সার্জারি বিভাগে এসে কাগজপত্র জমা দেন হুমায়ূন। ৬টার আগেই আমাদের ওয়েটিং রুমে রেখে হুমায়ূনকে নিয়ে গেলেন নার্স। বললেন, অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আবার দেখতে পাবে তাকে। ওয়েটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করি। ভোর ৬টার দিকে কয়েকজন রোগীকে স্ট্রেচারে করে নার্স নিয়ে গেলেন সার্জারিতে আমাদের সামনে দিয়ে। কিন্তু হুমায়ূন কোথায়? একটু পর দেখি গাউন পরা হুমায়ূন স্ট্রেচারে করে নয়, হেঁটে দিব্যি নার্সের সঙ্গে হাসিমুখে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেলেন অপারেশন থিয়েটারের দিকে। এরপর গেল আরো কয়েকটি স্ট্রেচার, সবশেষে হুমায়ূনের মতো দু-একজন হেঁটে যাওয়া রোগী।
অপেক্ষার মুহূর্তগুলো বড় দীর্ঘ। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে চলে প্রতীক্ষা। ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমরা_শাওন, আমি, জ্যোতি, মাজহার, বিশ্বজিৎ, বগুড়ায় হুমায়ূনের স্কুলের সহপাঠী বন্ধু ফানসু আর মাজহারের পুরনো বন্ধু রুবেল। অপেক্ষা করছে আরো কিছু অপরিচিত মানুষ, আমাদেরই মতো তাদের প্রিয়জনদের জন্য। আমাদের সবার দৃষ্টি টিভি মনিটরের দিকে। হুমায়ূনের জন্য আমাদের একটা নম্বর দেওয়া হয়েছে, আমরা বসে বসে দেখছি মনিটরে এখন কোথায় কী পর্যায়ে আছেন তিনি। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য একটি ভিন্ন রং। হুমায়ূনের সার্জারির রং আর পাল্টায় না। সার্জারি হচ্ছে তো হচ্ছেই। সাড়ে ছয় ঘণ্টা পরে দেখা গেল তাঁর সার্জারি শেষ। রিকোভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁকে। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বা করমর্দন করে নিজেদের আনন্দ ও তৃপ্তি প্রকাশ করি। আমি বিশ্বজিতের কাছে গিয়ে তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। তার ব্যবস্থার জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। আরো কিছুক্ষণ পরে রিকোভারি রুমে জ্ঞান ফিরল হুমায়ূনের। ততক্ষণে হুমায়ূনের সার্জিক্যাল টিম এসে আমাদের বলে গেল অপারেশন সফল হয়েছে। Local embolization-ই লেগেছে। লিভার কাটার দরকার হয়নি। কোলনের সার্জারিও ভালোভাবে হয়েছে। সার্জন বললেন, 'যত দূর আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাঁর শরীরে এখন আর কোনো ক্যান্সার নেই।' যদি কোনো টিউমার ইতিমধ্যে অন্য কোথাও তৈরি হতে শুরু করে থাকে, যা এখনো চোখে দেখা যায় না, অথবা আবার পরে যদি নতুন করে কোনো টিউমার হয়, সেটার কথা অবশ্য বলা যাবে না এই মুহূর্তে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যেহেতু স্টেজ ফোরে হুমায়ূনের ক্যান্সারের অবস্থান। আমরা ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাই। ডা. মিলার আসেননি ওয়েটিং রুমে অন্য সার্জনদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, ডা. মিলার সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অপারেশন রুমে। মঙ্গলবার সারা দিন ধরে সার্জারি চলে এই হাসপাতালে। পরের সার্জারি নিয়ে নিশ্চয় ব্যস্ত আছেন মিলার। আমরা তখন একে একে গিয়ে রিকোভারি রুমে হুমায়ূনকে দেখে এলাম। যদিও সবার আগেই গেছে শাওন, তবু আমরা যারা তাঁকে দেখতে যাচ্ছি, সবাইকে শুধু তাঁর 'কুসুম'-এর কথা জিজ্ঞেস করছেন হুমায়ূন। কুসুমকে কাছে, চোখের সামনে সব সময়ের জন্য চান হুমায়ূন। গত সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে ওই রুমটায় বসে আছি আমরা কোথাও যাইনি কেউ এক মুহূর্তের জন্যও। এখন সবাইকে খেতে হবে। হুমায়ূনের কেবল পিপাসা পাচ্ছে তখন। পানি এখন দেওয়া যাবে না, মুখে বরফের দু-একটা ছোট টুকরা দেওয়া হলো। এ সময় তাঁকে দেখতে ঘরে ঢুকলেন নিউ ইয়র্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক সৈয়দ মুহাম্মদ উল্লাহ্। এলো বেলভ্যু হাসপাতালে কর্মরত সেই বাঙালি ছেলেটি। আমার কানে তখন শুধু ঝংকার তুলছে 'ক্যান্সার-ফ্রি' শব্দ দুটি। হুমায়ূন ক্যান্সার-ফ্রি। আঃ, কী মনোরম ওই দুটি শব্দ।
পাঁচ দিন সার্জিক্যাল বিভাগের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) থাকার পর ১৭ তারিখে রাতে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হলো হুমায়ূনকে। সাধারণত প্রাইভেট রুমই দেওয়া হয় তাঁকে; কিন্তু সেদিন কোনো খালি রুম না থাকায় তাঁকে semi-private রুমে থাকতে হলো। এর মানে আরেকজন রোগী ছিল সেই ঘরে। সেদিন সকাল থেকেই হুমায়ূনকে আইসিইউ থেকে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে, টের পেয়েছিলাম আমরা সবাই। ডাক্তার রিলিজপত্র লিখে দিয়েছেন অতি ভোরে; কিন্তু রুম খালি না পাওয়ায় এই অবেলায় মানে রাত্রিতে তাঁকে নেওয়া হলো ওয়ার্ডে। ১৯ তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মাজহারের ফোনে, বললেন, হুমায়ূনকে রিলিজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। তিনি ঘরে আসার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁর হাসপাতালের রুমে। আমরা তখন আমাদের বাড়িতে রকল্যান্ড কাউন্টিতে, শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি, এটা বলেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হই। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ফানসু মণ্ডলের গাড়িতে করে হুমায়ূন ও শাওন বাড়ি চলে যান। বুঝলাম, হুমায়ূন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। নিষাদ আর নিনিতকে দেখেন না আজ এক সপ্তাহ। তাঁকে দোষ দিই কী করে? হাসপাতালে তখনো মাজহার ও বিশ্বজিৎ। বিশ্বজিতের বেশ খানিকটা সময় লাগল হুমায়ূনের বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো হাসপাতালের একাধিক ফার্মেসি থেকে তুলতে। অপেক্ষা শেষে ওকে আর মাজহারকে নিয়ে আমরা হুমায়ূনের বাড়ির দিকে কুইন্সে যেতে থাকি। পথে বিশ্বজিৎ মুক্তধারায় নেমে যায়। এরপর আমরা তিনজন হুমায়ূনের বাসায় আসি। হুমায়ূনের জন্য একটা শোবার ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল ওপরে। আমরা হুমায়ূনের শোবার ঘরের জন্য আমাদের বাসা থেকে একটি ছোট টিভি নিয়ে এসেছিলাম। ইনফেকশনের ভয়ে সাফছুতোর করে ওটাকে রীতিমতো লাইসল দিয়ে চান করালাম বীজাণুমুক্ত করার জন্য। হুমায়ূনের ঘর থেকে আগেই সব জিনিসপত্র বের করে ফেলা হয়েছিল। এই বাড়িটি যেহেতু দোতলা, হুমায়ূনকে কেউ ঝামেলা বা বিরক্ত করতে পারবে না। কেননা বাইরের ঘরটি নিচ তলায়। আমরা নিজেরাও কেবল হুমায়ূনের ঘরের বাইরে দূর থেকে তাঁকে দেখে এলাম একবার।
হুমায়ূনের খোঁজ নেই প্রতিদিন। শুনি পেটে অনেক ব্যথা ও অস্বস্তি। সেটা প্রত্যাশিত, ডাক্তার বলেছিলেন। আর সে তো হবেই। এত বড় দু-দুটি সার্জারি। ২১ তারিখ বিকেলে মাজহার আমাদের রকল্যান্ডের বাড়িতে ফোন করে জানায়, হুমায়ূনের কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পেটে ব্যথা। আমি বললাম, তাকে ডাক্তারের সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলতে। তিনি যা করতে বলবেন, যেখানে নিয়ে যেতে বললেন, তা-ই করো। এরপর খুব ভোরে মাজহারের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। বলল, হুমায়ূনের পেটের ব্যথা বেড়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে খুব। আমরা এ মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে বেরোলেও আরো দুই ঘণ্টা লাগবে পাক্কা এই বাড়ি থেকে রওনা হয়ে হুমায়ূনের বাড়ি যেতে। ফলে আর কাউকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যেতে বললাম। আমরাও আসছি। মাজহার ইতিমধ্যেই ফান্সুকে ডেকেছে। আমরাও তাতে সায় দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা রওনা হলাম কুইন্সের দিকে। যেতে যেতেই খবর পেলাম, ফান্সুর গাড়িতে এক ব্লক যেতে না যেতেই হুমায়ূনের এত বেশি খারাপ লাগা শুরু হয় যে সে আর বসে থাকতে পারছিল না। ফলে তারা ৯১১ কল করলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সকে তারা বেলভিউতে নিয়ে যেতে বললেও অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিকটবর্তী জামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে এসেছে। আমরা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তাদের কাছেই ছুটে চলি। মাজহার জানে না, হয়তো ফান্সুও নয় (আর জানলেই বা কী হতো? ও রকম ইমার্জেন্সিতে ৯১১-কে তো ডাকতেই হবে) যে ৯১১ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে ওরা সব সময়ই সবচেয়ে কাছের হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসবে। রোগীর পছন্দমতো বা চাহিদামতো হাসপাতালে নয়। জামাইকা হাসপাতাল কুইন্সে_অনেক কাছে হুমায়ূনের বাসা থেকে। আমরা যখন জামাইকা হাসপাতালে পৌঁছি, দেখি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে হুমায়ূন শুয়ে আছে। তার হার্টবিট ১৩০-১৩৫। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। ওদিকে মাজহার ও বিশ্বজিৎ বেলভিউর সঙ্গে যোগাযোগ করে হুমায়ূনকে সেখাবে নেওয়ার ও ভর্তির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে। এ ব্যাপরে বেলভিউ স্বাস্থ্যকর্মী বাংলাদেশের সেই তরুণ রনি এবং ভারতীয় নারী সার্জন জ্যোতি খুব সাহায্য করেন। কিন্তু এক অদ্ভুত ব্যুরোক্রেটিক জটিলতায় পড়া গেল। যদিও বেলভিউ হুমায়ূনের জন্য ICU-তে রুম রেডি করে ভর্তির সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, তারা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারবে না। কোনো খালি অ্যাম্বুলেন্স নেই। এদিকে জামাইকা হাসপাতাল বলে, তারা রোগী আনতে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে, রোগীকে চলে যাওয়ার জন্য নয়। অবশ্য সময় নষ্ট হয়নি। কেননা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে করতে হুমায়ূনের পেটের CT scan করা ও তার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেল। ওখানকার সার্জন বললেন, যদিও স্ক্যানে সুনির্দিষ্ট কোনো লিক দেখা যাচ্ছে না অন্ত্রে, কিন্তু পেটে (abdominal cavity-তে) যথেষ্ট গ্যাস ও তরল পদার্থ জমা হয়েছে। আমি জানতে চাইলাম তারা স্ক্যান থেকে বলতে পারে কি না ওই তরল পদার্থ রক্ত কি না। ডাক্তার (সার্জন) জোর দিয়েই বললেন, না ওটা রক্ত নয়, তরল পদার্থ। এর মাত্র কিছুক্ষণ আগেই জানতে পারলাম, গতকাল হুমায়ূন তার শোবার ঘরের একটি প্লাস্টিক চেয়ারে বসে ছিল। হঠাৎ করে ওই চেয়ারটির চারটি পা-ই বেঁকে গিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে থাকে। আর মুচড়ে যাওয়া পায়ের (কলাপ্স করা) চেয়ারে উপবিষ্ট হুমায়ূন ধীরে ধীরে মেঝের দিকে বসে পড়তে শুরু করে। সামনেই ছিল শাওন। সে অবস্থায় তাকে দুই বাহু ধরে তুলে খাটে নিয়ে বসানো হয়। সেই সার্জন ডাক্তার ঘটনাটির আদ্যোপান্ত খুঁটিনাটি শুনে বললেন, 'তার এখনকার এ অবস্থার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনো যোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।' ডাক্তার আমাদের বোঝান, পেটে (abdominal cavity-তে) যথেষ্ট গ্যাস ও তরল পদার্থ থাকায় তার পেট ফুলে উঠেছে। যথেষ্ট অক্সিজেনের জন্য এমন ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। দ্রুত হার্ট রেট ও রেস্পিরেটরি রেট বোঝাচ্ছে যে আরো অক্সিজেনের প্রয়োজন তার, আর সেটাই মেটাবার চেষ্টা করছে হৃদপিণ্ড। হুমায়ূনের নাক দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল তখন।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যখন একটা জটিলতা চলছে, জ্যোতির খেয়াল হলো, প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ডেকে কেন নিয়ে যাই না আমরা! তাই তো! ওটা সেই মুহূর্তে কারো মনে আসেনি। তখন নিজেরা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেই হুমায়ূনকে নিয়ে আসা হলো বেলভিউতে। হুমায়ূনের ভর্তির সব ব্যবস্থা ও রুম তৈরিই ছিল সেখানে। তাই কোনো দেরি হয়নি কোথাও। বেলভিউতে। এখানে আসার পর পরই ডাক্তাররা আসতে শুরু করলেন। অনেক ছোটাছুটি চলে নার্স-ডাক্তারদের মধ্যে। বেশ কয়েক শিশি রক্ত নেওয়া হয় হুমায়ূনের কাছ থেকে ল্যাবে পাঠাবে বলে। অন্যান্য ভাইটাল সাইন পরীক্ষা করা হলো। অন্য হাসপাতালে বসানো সব টিউব, নল, ক্যাথেটার খুলে ফেলে দিয়ে নতুন সব লাগানো হলো। একদল ডাক্তার CT scan রিপোর্ট পড়তে একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। সার্জারি বিভাগ থেকে ডাক্তার শাহ্ বলে এক অল্প বয়সী ভারতীয় চেহারার ডাক্তার হুমায়ূনের মেডিক্যাল ইতিহাস নিতে শুরু করলেন। ডাক্তার শাহ্কে আমি গতকালের প্লাস্টিক চেয়ার কলাপ্স করে হুমায়ূনের মেঝের দিকে ঝুলে পড়ার কথা বললাম। ডাক্তার শাহ্ আমার কথা তেমন গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, 'ওটা তেমন কিছু নয়। ওটার জন্য আমরা চিন্তিত নই। ওর জন্য কিছু হয়েছে মনে হয় না। আমি CT scan দেখে এসেছি।' আমরা হাসপাতাল রুমে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। পেটে ভীষণ খিদে। কিন্তু এত রাতে কোথাও থামতেও ইচ্ছা করে না। সারা দিনে জ্যোতি খেয়েছে একখানি অম্লেট সেই সকালে জামাইকা হাসপাতালের কাছে, আর আমি বিকেলে রাস্তার ভেন্ডর থেকে কিনে খেয়েছি একটা হট ডগ। আমরা তখন সবে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ পার হয়ে নিউ জার্সিতে ঢুকেছি। মাজহার ফোন করল। হুমায়ূনকে এক ঘণ্টার মধ্যে emergency surgery করবে বলে নিয়ে যাবে। সেখানে পেট থেকে গ্যাস ও পানি বের করবে, সেই সঙ্গে অন্ত্রের দিকটাও ঠিক করা হবে। তা নইলে তার জীবন সংশয় হতে পারে। যেখান থেকে গ্যাস ও তরল পদার্থ বেরোতে শুরু করেছে, সেটা মানে অন্ত্রের সেই লিকটা মেরামত করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। আমরা আবার হাসপাতালে ফিরে যাব কি না জিজ্ঞেস করলে মাজহার বলে, এসে তো কিছু লাভ হবে না, তার আগেই অপারেশনে নিয়ে যাবে হুমায়ূনকে। সে রাতে প্রায় সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মাজহারের সঙ্গে কথা হয়। ভালোমতো সার্জারি হয়েছে মাজহারের ফোনে সেটা শোনার পরে জ্যোতি শুতে যায়। আমরা পরের দিন সকালে আবার হাসপাতালের দিকে যাত্রা করি। যদিও কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এবং এস্পিরিন বন্ধ করার আগেই সার্জারি করা হয়েছে, যখন তার হার্টবিট ও ব্লাড প্রেসারও খুব স্বাভাবিক ছিল না, ডাক্তাররা তার জ্ঞান ফিরে আসার ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। বলেছিলেন, হুমায়ূনের অজ্ঞান অবস্থা ভাঙতে সময় লাগতে পারে। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি, বেলা তখন ১১টাও বাজেনি, হুমায়ূন পরিপূর্ণ জাগা। সে শুয়ে আছে ICU-এর সার্জারি ইউনিটে অন্য একটি রুমে। গতকাল রাতের সার্জারির চার্জে ছিলেন ডাক্তার মুর। ছোট ছোট করে অনেক কথা হলো হুমায়ূনের সঙ্গে সেদিন। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কথা হুমায়ূন যেটা জিজ্ঞেস করে আমায় 'আমার কি কোলেস্টমি করেছে?'
বিছানার এক ধারে শোয়ানো কিছুটা বাদামি তরল পদার্থ দিয়ে ভরা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আমি বলি 'হ্যাঁ'। আমি জানি 'গু-এর ব্যাগ' বাইরে থেকে বয়ে বেড়াতে তার কী ভীষণ অস্বস্তি_কী ভয়ানক আপত্তি তার। তাই প্রথম সার্জারির সময় কোলেস্টমি হবে না শুনে সে কী খুশি হুমায়ূন। আমরা গতকাল রাতেই খবর পেয়েছি এবার শুধু কোলেস্টমি নয়, পেট থেকে তরল পদার্থ বের করে নিয়ে আসার জন্য টিউবও লাগানো হবে ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।
আমি জীবাণুনাশক ক্রিম দুই হাতে ভালো করে মেখে হুমায়ূনের হাতের ও পায়ের আঙুল একটি করে টিপে দিতে শুরু করি। কেমোথেরাপির জন্য নিউরোপ্যাথি হওয়ার জন্য হাত-পা ব্যথা করে ওর, টিপে দিলে আরাম পায়। কয়েক দিন আগেও আমাকে সঙ্কোচ করত, টিপে দিতে দিত না। কেবল শাওন ও মাজহার করত এটা। কয়েক দিন আগে একদিন আচ্ছা করে বকা দিলাম হুমায়ূনকে, শাওনের সামনেই।
'এত সেকেলে কেন হুমায়ূন? আমি আপনার হাত বা পা টিপে দিলে ক্ষতি কী হবে? তা ছাড়া আমি তো অফিশিয়ালিই আপনার বোন এখন। তাই না?' আর আপত্তি করেনি হুমায়ূন। হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
জীবনের শেষ বিকেলে অকস্মাৎ পাওয়া আমার ভাইটির আঙুল টিপে দিতে থাকি আমি। এই বাক্যটা লিখতে গিয়ে ওর সেই হাতের উষ্ণতা এখনো যেন টের পাচ্ছি। একটা আঙুল শেষ না হতেই আরেকটা বাড়িয়ে দেয়।
হুমায়ূনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরো একটি তথ্যও আমি মাত্র কয়েক মাস আগেই জানতে পেরেছি। আমার মতো হুমায়ূনেরও দু'ট জন্ম সাল, দুই বছরের ব্যবধানে। আর আশ্চর্য, ঠিক সেই বিশেষ দুটি বছরেই। যদিও পরে আমি জানতে পেরেছিলাম ওই দুটোর একটিও আমার সঠিক জন্ম তারিখ নয়। আসল তারিখ এই দুটোর মাঝামাঝি। তবে আমরা যে সমবয়সী সে সম্বন্ধেও কোনো ধারণা ছিল না আমার। হুমায়ূনের প্রকৃত জন্মদিন আর আমার কন্যা জয়ীষার জন্মদিনও আবার এক_১৩ নভেম্বর।
সেদিন হুমায়ূনকে ক্লান্ত দেখালেও কেমন প্রশান্ত লাগছিল। দুপুরে তাকে semi-solid খাবার দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই মুখে দিতে চায় না সে। আমি জোর করে চামচে করে কয়েকবার কমলা-জেলো খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। তিন-চার চামচ খাবার পরই বলে, আর খাব না।
জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগল?
অতি স্বাভাবিকভাবে হুমায়ূন বলল, 'গুয়ের মতো।'
আমি হেসে বলি, 'আপনি কি কখনো গু খেয়ে দেখেছেন কেমন খেতে?'
হুমায়ূন হাসে।
আমি ওর আঙুল টিপে দিই।
একুশ বছর ধরে নিউ ইয়র্কের মুক্তধারার বইমেলার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত রয়েছি। অথচ এবার মেলায় নিউ ইয়র্কে হওয়া সত্ত্বেও তিন দিনের ভেতর মাত্র একদিন_মানে প্রথম দিন রাতে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য আমি গিয়েছিলাম সেখানে। তাও আমার শিক্ষক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, এবারের বইমেলার প্রধান অতিথি শামসুজ্জামান খানের ফোন পেয়ে। জ্যোতিকে একা দেখে তিনি আমার কথা জানতে চেয়েছিলেন। আমি আসতে নাও পারি শুনে তিনি ফোন করেছিলেন। স্যারের কথায় শুক্রবার রাতে, মানে ২৯ জুন, বইমেলায় গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। সেই রাতে ও আগের রাতে আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু দম্পতি বাচ্চু ও লিজি রহমানের নতুন বাসায় ছিলাম জামাইকায়। লিজি আমরা বইমেলায় আসব জেনে ডেনভারে ফোন করে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাদের বাসায় অন্তত কয়েক দিন থাকতে। লিজির বর বাচ্চু আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা দুজনই মুন্সীগঞ্জের। প্রোগ্রাম অনুযায়ী এবার মেলার দ্বিতীয় দিনে হুমায়ূনকে সম্মাননা দেওয়ার কথা ছিল বইমেলার পক্ষ থেকে। মেলার পক্ষ থেকে হুমায়ূনকে অনেক আগেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'কার হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করতে চান আপনি?'
উত্তরে হুমায়ূন নাকি বলেছিল, 'পূরবীর হাত থেকে।'
কিন্তু সেই ৩০ জুন, বইমেলার দ্বিতীয় দিনে, মেলায় নয়, আমি ছিলাম হুমায়ূনের পাশে বেলভিউতে। কিন্তু Show must go on অতএব, বইমেলার মঞ্চে সেই নির্দিষ্ট সম্মাননা পর্বে জ্যোতি মঞ্চে গিয়ে বলেছিল, হুমায়ূনকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য পূরবীর হাতে সম্মাননা সনদখানি সে পৌঁছে দেবে।
১ জুলাই রবিবার। কেউ জাগার আগে খুব ভোরে আমি ও শাওন হাসপাতালে আসি। বাংলাদেশ মিশন থেকে কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার জন্য চাইলে গাড়িতে রাইড পাওয়া যাচ্ছিল (অবশ্য যদি সেই মুহূর্তে খালি গাড়ি থাকে মিশনে, তবেই)। বাংলাদেশ সরকারের অনারারি সিনিয়র পরামর্শক হিসেবে হুমায়ূন নিয়োগ পাওয়ার পরে এটিই হয়তো প্রথম কোনো সুবিধা নেওয়া। মিশনের গাড়িতে হুমায়ূনের বাসা থেকে হাসপাতালে আসি আমরা। এত সকালে যাতে ডাক্তাররা রাউন্ডে বেরোবার আগেই আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারি। লম্বা করিডরের অন্য প্রান্ত থেকে হঠাৎ দেখি হুমায়ূনের ঘরের সামনে কে একজন দাঁড়িয়ে কাচের দেয়াল দিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে। হাসপাতালের কোনো কর্মী এটা করবে না। আমরা দ্রুত কাছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন। এত ভোরে এভাবে এসে হুমায়ূনকে দেখছেন তিনি, এতে একটু বিস্মিত হয়েছি বৈকি? হঠাৎ মনে পড়ে, গতকাল বিকেলে শহরে একটা গুজব উঠেছিল, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। বইমেলায় উত্তেজনা ও হৈচৈ শুরু হওয়ার আগেই আসল সত্য জেনে গেছে সবাই। ঠিক এভাবে আরেকবার গুজব দিয়ে বইমেলা পণ্ড করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন ঢাকায় আহত হুমায়ুন আজাদের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিল কেউ।
২ জুলাই। সোমবার। রাউন্ডে আসা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ভোর হতে না হতেই আবারও হাসপাতালে চলে এসেছি আমি ও শাওন। সকাল সাড়ে ৬টা তখন। আরো কিছুক্ষণ পরে Critical Care Unit-এর প্রধানের সঙ্গে নতুন শিক্ষা বছরের নয়-দশজন ইন্টার্ন-রেসিডেন্ট এসে উপস্থিত। তাঁরা ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রুমে গিয়ে রোগী দেখে তাদের অবস্থা নিয়ে রুমের বাইরে এসে হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আলোচনা করেন। আগের দিন হুমায়ূনকে বলা হয়েছিল, আজ সকালে তার মুখ থেকে পাইপটা খুলে দেবে, ওই পাইপের জন্য সে কথা বলতে পারে না। প্রচণ্ড অস্বস্তি। আজ ভোরেও যখন আমরা ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, শাওনকে কাগজে লিখে জিজ্ঞেস করেছে হুমায়ূন কবে খুলবে তার মুখের নল। শাওন বলেছে, কিছুক্ষণ পর। হুমায়ূন আবার লিখে জানতে চায় 'কয় ঘণ্টা পর?' কিন্তু সে বা আমরা কেউ তখনো জানি না যে গতকাল আবার বমি করেছিল হুমায়ূন এবং কিছুটা বমি আগের বারের মতো ফুসফুসে ঢুকে গেলে ফুসফুসের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছে এখন। হুমায়ূন এখন ১০০% সাপোর্ট নিচ্ছে ভেন্টিলেটরের। ভ্রান্যমাণ ডাক্তারের দল অবশেষে হুমায়ূনের রুমে ঢোকেন। ইউনিট-প্রধান হুমায়ূনের কাছে এসে বলেন, 'আমি জানি তুমি খুব অপেক্ষা করে আছো তোমার মুখের পাইপটা খোলার জন্য। কিন্তু, আজ নয়, কাল নয়, পরশুও নয়। তোমাকে আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে।' বড় বড় চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে থাকে হুমায়ূন। ডাক্তার বলতে থাকেন তার বমির কথা। সেটা যে কতখানি ক্ষতি করেছে তার ফুসফুসের। বাইরে এসে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বমি ঢুকে গেলে যদি এতই ক্ষতি হয় ফুসফুসের_এমন কিছু কেন আপনারা করেন না, যাতে বমি ভেতরে শ্বাসনালিতে চলে যেতে না পারে। কারণ এ ধরনের সার্জিক্যাল রোগীদের জন্য বমি করাটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তা ছাড়া শোয়া অবস্থায় বমি করলে কিছুটা তো ভেতরে চলেই যেতে পারে শ্বাসনালিতে।' ডাক্তার আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন সে জন্যই মুখের টিউবের পেছনে একটা বেলুনের মতো থাকে, যাতে বমি ভেতরে না গিয়ে বাইরে ফিরে আসে। কিন্তু সেটা ১০০% বমি তো সব সময় আটকাতে পারে না। গলাকে আর যা-ই হোক, একেবারে সিল তো করে দেওয়া যায় না। তাই না? তবে আজ আরেকটা বেলুনের মতো জিনিস বসানো হয়েছে মুখের ধারে, দেখো। যাতে এমন আর না হয়। ডাক্তাররা তখন হুমায়ূনের রুমের বদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ূনের অসুস্থতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। শুনতে পাই ARDS শব্দটা বহুবার ব্যবহৃত হতে। Acute Respiratory Distress Syndrome বা ARDS. অনেক ইনার্ন ও রসিডেন্টই হুমায়ূনের ARDS হয়েছে বলে সন্দেহ করেন। শাওন ও আমি পরে ইন্টারনেটে ARDS সম্পর্কে পড়ে দেখেছি, যদিও এটা বিশেষ কোনো অসুখ নয়, এটি অনেক মারাত্মক উপসর্গের সমাহার। খুবই জটিল ও সিরিয়াস মেডিক্যাল সমস্যা ARDS Syndrome-এর ভয়াবহতার কথা জানতে পেরে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। রাতে আবার একা একা ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পাই অন্য আরো কারণের মধ্যে বমি ফুসফুসে চলে যাওয়া সত্যি একটা বড় কারণ ARDS-এর। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খাওয়ার (নিউ ইয়র্কে এসে সিগারেট বন্ধ করেছে হুমায়ূন) কারণে ওর ফুসফুসের ধারণক্ষমতা খুব ভালো ছিল না। তার ওপর ফুসফুসে এখন তো সংক্রমণও রয়েছে। এক্স-রেতে দেখা গেছে, ফুসফুসের বাইরের পর্দায় জল জমেছে। তাই সব মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে এত কষ্ট। হার্ট রেট-ও সে কারণেই বেশি।
এর কয়েক দিন আগে হুমায়ূন যেদিন বমি করে, আমি ও শাওন কাছেই ছিলাম। ছিল নার্স, সে ডেকে এনেছিল আরো কয়েকজনকে। কিন্তু তবু নাকি কিছুটা বমি চলে গিয়েছিল ফুসফুসে। বমি করার ঠিক আগে বিছানায় বসা শাওনকে হাতের আঙুল দিয়ে মুখের কাছে কী দেখাচ্ছিল হুমায়ূন। আমাকে একদিন এ রকম দেখানোতে আমি একগাদা চৌকো গজের টুকরো মুখের কাছে ধরেছিলাম। হুমায়ূন একটু থুথু ফেলে মুখটা পরিষ্কার করেছিল। আমি শাওনের হাতে একগাদা গজ কাপড় তুলে দিলে ও সেগুলো ওর মুখের কাছে ধরতে না ধরতেই সে গলগল করে বমি করে দেয়। শাওন প্রথমে ভেবেছিল হুমায়ূন কিছু লেখার কথা ভাবছে, তাই কাগজ-কলম নিয়ে আসছিল সে। হুমায়ূন যখন বমি করে দেয়, তখন শাওনের বাঁ হাতে কাগজ-কলম, ডান হাতে গজ-ক্লথ। সে কাছে গিয়ে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করার আগেই ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে নার্স ছুটে আসে। শাওনকে সরিয়ে দিয়ে আরো সাহায্যের জন্য ডাক দিয়ে নার্স নিজেই হুমায়ূনের মাথাটি সোজা করে ধরে তার মুখ, নল পরিষ্কার করতে শুরু করে। অন্য এক নার্স, নার্সেস এইডের সঙ্গে স্বয়ং ডাক্তারও ছুটে আসেন ঘরে। সবাই মিলে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করতে শুরু করেন তাঁরা। তাঁদের এত ছোটাছুটি কর্মব্যস্ততা দেখে মনে হয়েছিল আমার, সাধারণ বমি করা এটা নয়।
ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে থাকতে আমরা পালা করে মাঝে মাঝে হুমায়ূনকে দেখে যাই। সেদিন সকাল বেলায় ডাক্তার যেহেতু বলে গেছেন আগামী দু-তিন দিনের ভেতর টিউব খোলা হবে না মুখ থেকে, আমরা জানতাম সে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়বে। আমি কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে তাকে দেখে ফিরে যাব ভেবে তার ঘরের সামনে আসতে থমকে দাঁড়াই। দেয়ালের ওপারে ঘরের ভেতর খাটে শুয়ে ছিল হুমায়ূন। হঠাৎ আমি দেখি হুমায়ূন তার দুই হাত দিয়ে তার শরীর থেকে তার সকল নল, তার-টার সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমরা যখন এখান থেকে যাই, সে ঘুমুচ্ছিল। দুদিন আগে ঠিক একই কাজ করেছিল সে। শাওন সেই গভীর রাতে তারই ঘরে ছিল তখন। চেয়ারে বসে বসে ঘুমুবার চেষ্টা করছিল। হুমায়ূনের সেই আকস্মিক কাণ্ড দেখে তাকে থামাতে চেষ্টা করতে করতে সে চিৎকার করতে থাকে। ডাক্তার-নার্স ছুটে এসে সকলে মিলে হুমায়ূনকে শান্ত করেন। তারপর ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। শাওন আর বাকি রাত ঘুমুতে পারেনি।
আজ সকালেই ডাক্তার বলে গেলেন হুমায়ূন ১০০% সাপোর্ট পাচ্ছে ভেন্টিলেটর থেকে। এ অবস্থায় টিউব খুলে ফেললে কী হবে ভাবা যায় না। আমি ডাক্তার-নার্সদের ডাকতে থাকি। নার্সেস স্টশেনে কেউ নেই, অন্য রোগীর কাছে হয়তো। লাল আলো জ্বলতে শুরু করেছে ঘরে। সেই সঙ্গে নার্সেস স্টেশনে। হুমায়ূনের ঘরের দরোজার বাইরে ট্রেতে রাখা একটা গাউন গায়ে দিয়ে ঘরে ঢুকি। তখনো তাকিয়ে তাকিয়ে সব কিছু খোলার চেষ্টা করছে। আমি হুমায়ূনের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অনুনয় করতে থাকি, হুমায়ূন, ভাইরে, প্লিজ ওগুলো খুলবেন না হুমায়ূন, এটা করে না। থামুন। প্লিজ। এগুলো খুললে খুব খারাপ হবে। থামুন। আর আশ্চর্য। ৯০ ডিগ্রি কোনাকুনি করে রাখা শূন্যে তার হাত দুটো নিশ্চল হয়ে যায়। আমি ছুটে বাইরে আসি, নার্সকে তখন দেখতে পাই না। করিডরের উল্টো পাশের কাচের ঘরের ভেতর বসে ডাক্তাররা মিটিং করছেন। আমি সোজা সেই ঘরে ঢুকে পড়ি। বলি, কী ঘটছিল এক মিনিট আগে ওপাশের রুমে। ডাক্তাররা সকলে তখন মিটিং ফেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। তাঁদের ঘরের দরজা থেকেই তাঁরা এবং আমি সকলেই দেখতে পাই হুমায়ূন আমার কথা না রেখে আবার সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। ডাক্তাররা কয়েজন হুমায়ূনের রুমের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে থামালেন। পরে লক্ষ করি, হুমায়ূনের দুই হাতের নিচে লম্বা কাঠের পাত দিয়ে প্লাস্টারের মতো করে বেঁধে দিয়েছেন তাঁরা, যাতে সে হাত দিয়ে নাক বা মুখের টিউব খুলে ফেলতে না পারে। অন্য অনেক রোগীর মতো ওর হাত দুটো খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখার কথা তারা চিন্তা করেননি। কেননা তাতে হুমায়ূন আরো উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে, এটা তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন।
আমরা কাল ফিরে যাব ডেনভারে। কাল মানে জুলাইয়ের ৩ তারিখে। এসেছিলাম জুনের ১১ তারিখে। অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে এসেছিলাম এবার। পরের দিনের সার্জারি যদি সফল হয়, কে জানে, হয়তো হুমায়ূন এ যাত্রায় মরণব্যাধিকে জয় করে সুস্থ হয়ে উঠবে। পরে ভবিষ্যতে কী হবে আমরা কেউ তা জানি না। কিন্তু সেই মুহূর্তে একমাত্র সার্জারির সফলতাই তাকে ক্যান্সার মুক্ত করতে পারে। কেননা কেমোথেরাপিতে আর নতুন করে কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না।
অথচ কাল হুমায়ূনের এমন শারীরিক অবস্থায় ওকে হাসপাতালে রেখে আমরা ফিরে যাচ্ছি, যেটা করতে খুবই অস্বস্তি বোধ করছি, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। আমরা ৩ তারিখে চলে আসব সেই সময়সূচি পেয়েই আটলান্টা থেকে আমাদের বন্ধু খালেদ হায়দার ও তার স্ত্রী শেলী প্লেনের টিকিট কেটেছে আমাদের বাড়িতে ডেনভারে ৪ জুলাই বেড়াতে আসবে বলে। গত বৃহস্পতিবার ২৮ তারিখে আমরা যখন রকল্যান্ড কাউন্টি থেকে শহরে এসেছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম এক বা বড়জোর দুই রাত্রি থাকব শহরে। ওষুধ ছাড়া মাত্র দুই প্রস্থ কাপড় এনেছিলাম সঙ্গে। ফলে একবার ঘরে যাওয়া একান্ত দরকার, ফিরে যাওয়ার গোছগাছ করার জন্যও। আজ সোমবার, এখনো ঘরে যাওয়া হয়নি। গতকাল দুপুরে মাজহার একটি জরুরি কথা বলেছে, যেটা আমার খুব মনে ধরেছে। মাজহার বলল, যাওয়ার আগে আমি যদি একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে যেতাম! একটা বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই আমরা কথা বলছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল হুমায়ূনের একটার পর একটা জরুরি অবস্থা হওয়ায় ICU টিম (Critical care unit) প্রতিটি জরুরি অবস্থাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। যখন যেটা দরকার সেটাই যেন সামাল দিচ্ছে। কিন্তু তাদের long term plan কী বুঝতে পারছি না। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, এই জরুরি অবস্থাটা আগে Stable হোক তো! তাই মাজহার বলল, 'পূরবীদি, আপনি চলে যাওয়ার আগে একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমাদের সবার দুশ্চিন্তার কথা, আমাদের আশঙ্কার কথা বলুন। তা ছাড়া আবার যে স্যারকে এখানে ভর্তি করানো হয়েছে, সার্জারি করা হয়েছে সেই ব্যাপারেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার, যদিও সেই সার্জিক্যাল টিমে তিনি ছিলেন না। আপনি যাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তার মিলারের সঙ্গে একবার কথা বলে যান।' এটা যে কত বড় সুপরামর্শ ছিল তা বলার নয়। কিন্তু আমার যে একবার বাড়িতে যাওয়া একান্তই দরকার ছিল!
জ্যোতি বলে, তেমন দরকার হলে আমি যেমন করে পারি সব গুছিয়ে নিয়ে আসবো। তুমি বরং ডাক্তারের সঙ্গে কথা বল। হাসপাতালেই থাকো।
মাজহার তখন বলল, আমি বরং যাই জ্যোতিদার সঙ্গে। আপনাদের বাসায়। আপনি এখানে থেকে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলুন।
সেই পরিকল্পনা অনুসারে গতকাল রাতে ডিউটিরত ডাক্তারকে বিশেষভাবে আমরা বলে গিয়েছিলাম আজ ডাক্তার মিলারের সঙ্গে আমাদের দেখা করা চাই-ই চাই। ডাক্তার সেটা হুমায়ূনের ফাইলে বড় করে লিখে রাখেন। শাওন আমাকে দেখিয়ে বলেন, হুমায়ূনের বোন। পরশু ভোরে ফিরে যাবে ডেনভার। ফলে কাল দেখা করতেই হবে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে।
পরদিন দুপুরের পরে ডাক্তার মিলার সত্যি এলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। এদিকে জ্যোতির একা সব গুছিয়ে আনা কষ্টকর হবে বলে, আর আমাকে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য জ্যোতির সঙ্গে সারা দিনের জন্য মাজহার চলে যায় রকল্যান্ডে আমাদের বাসায়। ডাক্তার মিলার যে খুব বড় একজন ডাক্তার এবং সকলেই যে তাঁকে খুব সমীহ করে, তার নজির পেলাম, তিনি যখন হুমায়ূনকে দেখার পরে আমাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমরা তখন ওয়েটিং রুমে। দেখলাম, চারদিকে কেমন ছোটাছুটি সন্ত্রস্ত ভাব। একে অপরকে বলছে, ডাক্তার মিলার এসেছেন ফ্লোরে। এমন অবস্থায় এক নার্স এসে সেই ফ্লোরের কনফারেন্স রুমের দরোজা খুলে দিল আমাদের নিশ্চিন্তে এবং একান্তে বসে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। আমরা, মানে আমি, শাওন, ফান্সু ও ডাক্তার মিলার কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম। প্রথমে পরিচয়পর্বের শুরুতেই শাওন আমাকে হুমায়ূনের বড় বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিল। জানাল, আগামী কাল-ই আমি চলে যাচ্ছি। তবে প্রয়োজন হলে আমিই সাধারণত ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে কথা বলি এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জানাই। প্রথমে ডাক্তার বর্ণনা করলেন হুমায়ূনের কী শারীরিক অবস্থা ছিল, যখন সে প্রথম আমেরিকায় আসে। চিকিৎসার পরে কতখানি উন্নতি হয়েছিল। তারপরে সার্জারি কিরকম সফল হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কোলনের সার্জারির জায়গা থেকে 'লিক (Leak)' করতে শুরু করেছিল। ফলে ইমার্জেন্সি সার্জারি সেটি ঠিক করা হয়েছে। পেটের ভেতরের সব গ্যাস, পানি বের করে ফেলা হয়েছে। তাঁকে তিনটি ব্রড স্পেকট্রাম এন্টিবায়োটিক এবং ফ্লাজিন দেওয়া হচ্ছে। তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে, যা সম্ভবত পেটের সংক্রমণ থেকে এসেছে। তাঁর ওপর বমি ঢুকে যাওয়ার জন্য ফুসফুসে Infiltration হয়েছে এবং ফুসফুসের বাইরের দেয়ালে পানি জমে যাওয়ায় তাঁর ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। সেসব কিছুর ওপরে আছে তাঁর ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা, করোনারি বাইপাস সার্জারির পরেও হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচলে কিছু সমস্যা, দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য তাঁর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। এ ধরনের সব অতিরিক্ত জটিলতা ও risk factor মিলিয়ে তাঁর অবস্থা একটু ক্রিটিক্যাল করে তুলেছে। তবে ডাক্তার মিলার খুব-ই আশাবাদী, তিনি ভালো হয়ে যাবেন। তবে সময় লাগবে। শাওনকে দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, আমাদের রোগীর বয়স যদি তোমার মতো হতো, যদি অন্য কোনো অসুখ না থাকত, আরো নিশ্চিন্তভাবে আরো জোর দিয়ে আমি বলতে পারতাম। কিন্তু সব কিছু জেনেও বলছি, তিনি ভালো হয়ে যাবেন, এটাই আমার বিশ্বাস। তখন শাওন হুমায়ূনের তার-টিউব খুলে ফেলার প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল একজন নার্সকে শুধু হুমায়ূনের জন্য dedicated করে দেওয়া যায় কি না। ডাক্তার বললেন, ICU-তে প্রতি দুজন রোগীর জন্য একজন নার্স। এর বেশি আর সম্ভব নয়। তবে তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে বাকি সময় রোগীর দরজার বাইরে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন, শুধু রোগীর কাজ-কারবার লক্ষ করার জন্য। শাওন ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে জানাল, তাঁর দুটি ছোট ছোট বাচ্চা আছে বলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রতি রাতে সে এখানে থাকতে পারে না। ডাক্তার জানতে চাইলেন, তাদের বয়স কত? ফান্সু বললেন, এক ও পাঁচ বছর। শুনেই ডাক্তার মিলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করলেন, একটু পরে আমরা সবাই দেখি, ডাক্তারের চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। মুখ তুলে যখন তাকালেন, তাঁর সমস্ত মুখমণ্ডল ও চোখ লাল। টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে শুরু করেন ডাক্তার মিলার। তিনি তাঁর আচরণে অপ্রস্তুত দেখেই বোঝা যায়। আমি আজ পর্যন্ত কোনো ডাক্তারকে কারো সামনে কাঁদতে দেখিনি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিশ্চয়ই বাচ্চা আছে।
ঘাড় নেড়ে শুধু সম্মতি জানান ডাক্তার। প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলেন, ওকে বাঁচাতেই হবে।'
আমি খুব বিনীতিভাবে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি তখন, প্রথমবারে হুমায়ূনকে কোলেস্টমি কেন করা হলো না।
ডাক্তার মিলার উত্তরে বলেন, I wish I had a crystal ball. But i did not have one. তিনি বললেন, 'আজকাল অধিকাংশ কোলন সার্জারির জন্য কোলেস্টমি করা হয় না। ডাক্তার বলেন, সে ধরনের সার্জারির পরে ৫ শতাংশেরও কম মানুষের লিক বা ওই জাতীয় জটিলতা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ৫ শতাংশের মধ্যে হুমায়ূন পড়ে গেছেন।'
ডাক্তার মিলার তাঁর একখানা কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। কার্ডের ওপর কলম বের করে নিজের হাতে তিনি তাঁর মোবাইল নম্বরটা লিখে দিলেন। বললেন ২৪/৭ যখন ইচ্ছা আমাকে ফোন করতে পার। শাওন, ফান্সুর দিকে তাকিয়ে বলল, 'তোমরাও'।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ICU থেকে বের করার পর এত তাড়াতাড়ি কেন ছেড়ে দেওয়া হলো তাঁকে? আরো দুটো দিন রাখলে কী ক্ষতি হতো?
ডাক্তার বললেন, এটা স্টান্ডার্ড প্রোসেডিউর। জটিলতা না থাকলে এক সপ্তাহের বেশি রোগীকে সাধারণত রাখা হয় না।
ডাক্তার মিলারের হস্তক্ষেপের ফলে সেদিন থেকে সব কিছু দ্রুত নড়তে শুরু করল। যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফুসফুসের পানি বের করে আনা হবে বলছিলেন তাঁরা কয়েকদিন ধরে, তা আজ ডাক্তার মিলারের সহকর্মীরা পঁয়তালি্লশ মিনিটের মধ্যেই করে ফেললেন। প্রায় ৬৫০ মি.লি. পানি বের করলেন তাঁরা শুধু একটি ফুসফুস থেকে, হুমায়ূনের রুমের ভেতরেই, তার খাটে শায়িত অবস্থায়ই। যাঁরা কাজটি করলেন, তাঁদের একজন কালো নারী ডাক্তার, আরেকজন স্ক্রাচে ভর করা অল্পবয়সী সাদা লোক। শেষোক্ত সার্জন ঠাট্টা করে বলেন, '৬৫০ সিসি মানে এক ক্যান কোকাকোলা বের করে এনেছি। ওঁরা মন্তব্য করেন, অনেক আরাম পাবে এখন। এ ছাড়া ফুসফুসের ভেতর থেকে আপনাআপনি পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটি ড্রেইন টিউব বসিয়ে দিয়েছেন তাঁরা ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।
পরের দিন ভোরে আমরা চলে আসি ডেনভার। সেই দিন-ই আমরা চলে আসার কয়েক ঘণ্টা পরে জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন এলেন নিউ ইয়র্কে হুমায়ূনকে দেখতে, তাঁর শুশ্রূষা করতে। খুব অল্পের জন্য ওঁদের সঙ্গে দেখা হলো না। অনেক বছর আগে ওঁরা যখন নিউ জার্সিতে থাকতেন, তখন থেকে জানি তাঁদের। সেদিন দেশ থেকে আরো এসেছিল শাওনের কনিষ্ঠ সহোদর, সেঁজুতি, যাকে গত ডিসেম্বরে দেখেছি, হুমায়ূনদের সঙ্গে ডেনভারে, আমাদের বাড়িতে, যখন বেড়াতে এসেছিল ওরা।
এরপর প্রতিদিন (শনি-রবিবারসহ) ভোর ছয়টায় উঠে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলা হয় বা টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদান হয়। আর হুমায়ূনের ব্যাপারে ডাক্তারের বক্তব্য আমি তৎক্ষণাৎ নিউ ইয়র্কে তাঁর স্বজনদের ফোন করে অথবা টেক্সট মেসেজে পাঠিয়ে দিই। এরপর একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। হুমায়ূনের ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা তো ছিল-ই, তাঁর বাইপাস সার্জারিও পুরোটা করা সম্ভব হয়নি সিঙ্গাপুরে রক্তনালির অবস্থা খুব ভালো না থাকায়। দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খাওয়ার ফলে ফুসফুসের ধারণক্ষমতাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তার ওপর স্টেজ ফোর ক্যান্সার ও ক্যান্সারের জন্য বারোটি কেমো নেওয়া। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা একেবারেই কমে গিয়েছিল তাঁর। ফলে অতি সহজেই সংক্রামক রোগে আক্তান্ত হন তিনি। একটার পর একটা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তাঁর অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়টায়। আগে তাঁকে ইন্ট্রাভেনাস খাবার দেওয়া হতো। পরে পাইপ দিয়ে পাকস্থলীতে সরাসরি খাওয়ানো শুরু হয়। এর ভেতর হুমায়ূনের আরো একটি অস্ত্রোপচার হয়। সেটা হয়, কেননা দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর পেটের মাঝখান দিয়ে যে কাটা হয়েছিল সেটা ঠিকমতো জোড়া লাগছিল না। জোড়া লাগার পরিবর্তে দুই ধারেই স্কার টিস্যু হয়ে ফাঁক হয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিল কাটা জায়গাটা। ফলে আরেকটি অপারেশন করে স্কার টিস্যুগুলো পরিষ্কার করে চামড়ার নিচে ম্যাশ বসিয়ে দিয়ে দুদিক জোড়া লাগিয়ে দেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছিল। হুমায়ূনের ডায়েবেটিস শরীরে ঘা শুকানোর জন্য অনুকূল ছিল না। তাঁর শরীরে ইনফেকশনের একপর্যায়ে কিডনিও কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ডায়ালাইসিস দিতে হয় তাঁকে। আরো পরে ট্রাকিওটমিও করা হয়, যদি তাতে একটু আরাম পায় রোগী। সাদা রক্ত কণার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার হয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে একটু কমে, আবার একদিন খুব বাড়ে, পরের দিন একটু কমে। অবশেষে রক্তেও সংক্রমণ বিস্তার করলে সেপসিসের লক্ষণ দেখা দেয়। একটি সময় আসে, যখন ব্লাড প্রেসার কিছুতেই ওপরে তুলে রাখা যাচ্ছিল না। ইয়সেলাইনের সঙ্গে এপিনেফ্রিন, ভেসোপ্রেসিনের সম্ভবপর সর্বোচ্চ পরিমাণ দিয়েও নয়। ব্লাড প্রেসার ওঠাতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছিল। অক্সিজেন সাচুরেশনের জন্য ভেন্টিলেটরের সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়। এভাবে হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য আঠার শ' মেইল দূরে বসে দিনে কয়েকবার করে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে আমার কথা হতো, কয়েকবার টেক্সট মেসেজেরও আদান-প্রদান ঘটত।
অবশেষে এলো ১৯ জুলাই। খুব ভোরে ডাক্তার মিলার নিজেই মেসেজ পাঠালেন আমাকে সেদিন, আমি ফোন করার আগেই। হুমায়ূনের অবস্থা ভালো নয়, ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে হুমায়ূনের স্বজনদের খবরটা দিলাম। পরে আস্তে আস্তে হাসপাতাল থেকে একে একে ফোন পেতে শুরু করলাম, শাওনের, মাজহারের, ইয়াসমিনের, ডাক্তার মিলারের। একসময় ডাক্তার মিলার লিখলেন, 'হুমায়ূনের অবস্থা খুব খারাপ। তাঁর স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনরা খাটের চারপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ভীষণ দুঃখিত।' আমি লিখলাম, 'এই কি তাহলে শেষ?' উত্তরে ডাক্তার মিলার লিখলেন, May be, but we are still trying. হুমায়ূন মারা যাওয়ার পরে অন্যদের মধ্যে জাফর ইকবাল ফোন করে আমাকে সংবাদটা দেয় ভয়েস মেইলে। আমি তার আগেই সব টেলিফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম। বলার মতো কোনো কথা ছিল না আমার, শোনার মতো ধৈর্যও নয়।
এর পরে সেদিনই আরো কয়েকটি মেসেজ আমাকে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার মিলার। নিচে দুটোর উল্লেখ করলাম :
My deepest condolence. I am terribly sorry. He had so much more to live for. I hope, u and the rest of the family will be able to take comfort in the great life that he lived which will inspire everyone forever. 2:44, Thur, July 19, 2012
I feel awful that he won't be able to see his young children grow but I am sure his wife and u will keep his influence on them. 2:46 PM. July 19, 2012
হুমায়ূনের মৃত্যুর কারণ কী ছিল জানতে চাইলে এককথায় বলা শক্ত। সম্ভবত ARDS, sepsis, সেপ্টিক শক। এগুলো শুরু হয়েছিল, যা থেকে সেগুলো হলো : বৃহদান্ত্রে লিক, পেটের ভেতর সংক্রমণ, এবসেস, ফুসফুসের শ্লথ কার্যকারিতা, ফুসফুসে পানি জমা, পেটে -ফুসফুসে-রক্তে সংক্রমণ এবং সবশেষে অক্সিজেনের মাত্রা ও রক্তচাপ বজায় রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর প্রচণ্ড ধকল এবং অবশেষে হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়া। তবে প্লাস্টিকের চেয়ারের পা কলাপ্স করা বা দুমড়ে যাওয়ার সঙ্গে এসবের যে কোনো সংযোগ নেই, তা একাধিক ডাক্তার বারবার করে বলেছেন, ডাক্তার মিলার, ডাক্তার শাহ, ডাক্তার ভিচ ও জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে কর্তব্যরত ২২ জুনের সেই সার্জন (নামটা ভুলে গিয়েছি) যিনি হুমায়ূনের CT scan পড়ে আমাদের রিপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি, হুমায়ূনের সঙ্গে আমাদের আগে তেমন জানাশোনা ছিল না। যদিও, আশ্চর্য, আমরা ধানমণ্ডির একই রাস্তার ওপরে একেবারে মুখোমুখি দুটি দালানে বাস করেছি অন্তত দুই বছর। নব্বুই-এর দশকের শেষ দিকে। গত নভেম্বরে ওর জন্মদিনে প্রকাশিত হুমায়ূনের লেখা 'রং পেন্সিল' বইটি জ্যোতিকে আর আমাকে উৎসর্গ করতে গিয়ে হুমায়ূন লিখেছিল, 'এঁদের সঙ্গে আগে কেন পরিচয় হলো না।' সব শেষ হয়ে গেলে আজ মনে হয়, পরিচয় যদি হয়েছিলই, কেন এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হলো তাঁকে?