Ticker

6/recent/ticker-posts

ফাউন্টেনপেন - হুমায়ূন আহমেদ


Everyone who works in the domain of fiction is a bit crazy. The problem is to render this craziness interesting _Francois Truffaut


humayun ahmed'সুনীল সাগর' বাক্যটা সুন্দর। 'স'-এর অনুপ্রাস আছে। বাক্যের দু'টা শব্দই তিন অক্ষরের বলে প্রচ্ছন্ন ছন্দের দোলা আছে। বাক্যটি সাগরের গুণ প্রকাশ করছে। 'সুনিলিত সাগরিত' বাক্যটায় কী বোঝাচ্ছে? সম্পূর্ণ অর্থহীন একটা বাক্য না? বছর ত্রিশ আগে আমরা ঠিক করলাম, একটা পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করব। দেয়াল পত্রিকার নাম হবে 'সুনীল সাগর'।
আমি সেই নাম পাল্টে নাম দিলাম 'সুনিলিত সাগরিত'।
সম্পূর্ণ অর্থহীন নাম।
আমি প্রধান সম্পাদক। জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব ছিল পত্রিকার অঙ্গসজ্জার দায়িত্বে। পনের দিন পরপর ঢাউস এক কাগজে সবার লেখা ছাপা হতো। কেউ বাদ যেত না। 'সুনিলিত সাগরিত' পত্রিকাটি আমাদের পারিবারিক ধারাবাহিক ইতিহাস। আমার নিজের লেখালেখির ইতিহাস। আমার দুই ভাইয়ের লেখালেখিরও ইতিহাস। দুই বোন সুফিয়া ও শিখুও ভালো লিখত। তারা কেন জানি এই পারিবারিক পত্রিকার বাইরে নিজেদের প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকল।
দেয়াল পত্রিকার প্রকাশনা অতি সঙ্গত কারণেই ছিল অনিয়মিত। একটা পর্যায়ে প্রকাশনা হয়ে দাঁড়াল পারিবারিক বিশেষ বিশেষ ঘটনানির্ভর। পরিবারের একজন সদস্যের বিয়ে হচ্ছে, সেই উপলক্ষে প্রকাশনা। কেউ প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যাচ্ছে বা কারো প্রথম সন্তানের জন্ম হচ্ছে, সেই উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা। 'সুনিলিত সাগরিত'র সর্বশেষ সংখ্যাটি বের হয় আমার বড় মেয়ে নোভা আহমেদের বিয়ে উপলক্ষে। পরিবারের বাইরের কারও লেখাই এখানে প্রকাশের নিয়ম নেই। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নোভাকে আশীর্বাদ জানিয়ে যে চারটি লাইন লিখেছিলেন তা পত্রিকায় ঢোকানো। তা সম্ভব হয়নি। সংসার ছেড়ে বাইরে চলে আসার কারণে পত্রিকাটির ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি নিজে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটিও প্রকাশ হবে কি-না তা নিয়েই শঙ্কিত ছিলাম।
আমি আমার বড় মেয়ের বিয়েতে বিশেষ কোনো উপহার দিতে চেয়েছিলাম। শাড়ি, গয়না, ফ্রিজ, টিভির বাইরে কিছু। কী দেওয়া যায় কী দেওয়া যায়? নোভার অতি প্রিয় লেখকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নোভার বিয়ের আসরে তার প্রিয় লেখককে উপস্থিত করলে কেমন হয়? এই উপহারটি হয়তো তার পছন্দ হবে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ জানালাম। তাঁদের বললাম, মেয়ের বিয়েতে gift হিসেবে তাঁদের প্রয়োজন। আমাকে অবাক করে দিয়ে দু'জনেই চলে এলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বিয়ের আসর বিডিআর-এর দরবার হলে উপস্থিত হলেন। নোভা তার বরকে নিয়ে স্টেজে বসে ছিল। বিয়ের এবং উৎসবের উত্তেজনায় সে খানিকটা দিশেহারা। আমি বললাম, মা, তোমার বিয়ের গিফট দেখে যাও। নোভা তার অতি প্রিয় লেখককে বিয়ের আসরে উপস্থিত দেখে চমকে উঠল।
পাঠক কি ধরতে পেরেছেন মানুষকে চমকে দেওয়ার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে আছে? সৃষ্টিশীল সমস্ত কর্মকাণ্ডে 'চমক' একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমরা কখন চমকাই? সচরাচর যা ঘটে না তা ঘটতে দেখলে চমকাই।
একজন Fiction writer চমকের ব্যাপারটি কিন্তু তাঁর মাথায় রাখেন, কেউ অবচেতনভাবে এই কাজটি করেন, আবার কেউ সচেতনভাবেই করেন। যেমন জর্জ বার্নার্ড শ। লেখালেখির সময় সচেতন এবং অবচেতনভাবে অনেক কিছু করতে হয় বলেই এই কর্মটি অতীব জটিল।
Writing is a dog’s life, but the only life worth living.
-Gustave Flauvert. .
লেখকের জীবন হলো কুকুরের জীবন, কিন্তু এই একমাত্র অর্থবহ জীবন। অধ্যাপনা ছেড়ে আমি একসময় কুকুরের জীবন বেছে নেব তা কখনো ভাবিনি। এক দুপুরের কথা। বয়স উনিশ। মন আবেগে পূর্ণর্। ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। ছুটি কাটাতে বরিশালের পিরোজপুরে গিয়েছি। একগাদা Chemistry বই নিয়ে গেছি। আগামীকাল থেকে পড়তে শুরু করব, এই ভেবে ভেবে সময় কাটাচ্ছি। বইয়ের পাতা খোলা হচ্ছে না। বিকালে কেমন যেন অস্থির লাগে। আমি হাঁটতে বের হই। হুলারহাটের দিকে এগুতে থাকি। প্রথমেই একটা কবরখানা পড়ে। গাছপালায় ঢাকা এমন সুন্দর একটা জায়গা। একদিন কবরখানার ভেতরে ঢুকলাম। অবাক কাণ্ড, কবরখানার ভেতর টলটলে পানির ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের পাশে শ্যাওলা ধরা এক কামরার মসজিদ। ভাঙা ঘাট। ভাঙা ঘাটে অতি বৃদ্ধ একজন [সম্ভবত মসজিদের ইমাম, কবরখানার কেয়ারটেকার] আমাকে দেখে বললেন, কী চান বাবা?
আমি বললাম, কিছু চাই না।
কবরখানায় ঘুরতেছেন কেন?
বেড়াচ্ছি।
বাবা, এইটা কি কোনো বেড়ানোর জায়গা? আসরের ওয়াক্ত হয়েছে, আসেন নামাজ পড়ি।
আমি বললাম, আমার অজু নাই।
পুকুরে পানি আছে। অজু করেন।
বৃদ্ধ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একবার ইচ্ছা করল দৌড়ে পালিয়ে যাই। কেন জানি সাহসে কুলাল না। বৃদ্ধ অজু করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।
অজু কীভাবে করতে হয় জানেন?
জানি।
অজুর দোয়া জানেন?
জি-না।
থাক, দোয়া লাগবে না। অজু করে আসেন। একত্রে নামাজ পড়ি।
আমি অজু করলাম এবং বৃদ্ধকে নিয়ে অন্ধকার মসজিদে ঢুকলাম। আসরের নামাজের দোয়া মনে মনে পড়তে হয়। বৃদ্ধ কিন্তু শব্দ করে পড়ছেন। সূরা ফাতিহার পর তিনি অতি দীর্ঘ একটা সূরা পাঠ করতে শুরু করলেন। ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। দ্রুত অন্ধকার নামছে। চারদিকে কবর। পুকুরের পানিতে কেউ সাঁতরাচ্ছে এমন শব্দ হচ্ছে। নামাজের শেষে তিনি দীর্ঘ দোয়ায় বসলেন। এই দোয়া কোনোদিন শেষ হবে_ আমার এ রকম মনে হলো না। নামাজে সালাম ফেরানোর একটা ব্যাপার আছে। একবার ডানে একবার বামে সালাম দিতে হয়। এই অতি বৃদ্ধ মাওলানা দোয়ার মধ্যেও কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে সালাম ফেরাচ্ছেন। পাগল না তো!
ঠিক মাগরেবের আগে আগে বৃদ্ধ দোয়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যান বাড়িত যান।
আমি বললাম, আপনি একা একা এখানে থাকেন?
হুঁ।
একাই নামাজ পড়েন?
বৃদ্ধ বললেন, একাই নামাজ পড়ি। তবে মাগরেব এবং এশার ওয়াক্তে অনেক জিন আমার সঙ্গে নামাজ পড়ে। সূরা পাঠে ভুল করলে তারা লোকমা দেয়।
আমি দ্রুত বের হয়ে এলাম। মাগরেবের ওয়াক্তের বাকি নাই। জিনরা সম্ভবত আসতে শুরু করেছে।
আমার বৈকালিক ভ্রমণে পিরোজপুর গোরস্তানে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে ফেলল। প্রায়ই সেখানে যাই, কবরের গায়ে লেখা নামগুলি পড়ি। বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকে দেখি কবর পরিষ্কার করছেন। ঝোপঝাড় কাটছেন। তিনি আর কখনো আমাকে নামাজ পড়তে ডাকেননি। তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা তেমন হতো না। একদিন শুধু বললেন, আপনার কোনো আত্মীয়স্বজন কি এখানে আছেন?
আমি বললাম, না।
তাহলে রোজ আসেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাপাকের কোনো ইশারা আছে বইল্যাই আপনে আসেন।
জানি না কাকতালীয় ব্যাপার কি-না, মিলিটারির হাতে নিহত আমার বাবার কবর হয় এই পিরোজপুরের গোরস্তানেই।
কবরস্থান বিষয়ক অংশটি বিস্তারিত লেখার একটা কারণ আছে। আমি একদিন কবরস্থান থেকে ফিরেই প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দিই। সন্ধ্যাবেলা আয়োজন করে Chemistry -র বই বের করে পড়তে বসি। খাতায় লেখি_ The term ‘macromolecule’ was first suggested by Staudinger .
এইটুকু লিখেই পরের লাইনে লিখলাম_ বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম।
Macromolecule-এর সঙ্গে বাসের কোনোই সম্পর্ক নেই। তারপরও কেন লিখলাম! বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসার সামনে বিশাল পুকুর। পুকুর থেকে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির শব্দ আসছে। পিরোজপুর শহরে বৃষ্টি হওয়া মানেই কারেন্ট চলে যাওয়া। আমি সিরিয়াসলি পড়ছি ভেবেই আমার সামনে হারিকেন দেওয়া হয়েছে। আমার মাথার ভেতর একের পর এক লাইন আসছে। এক ধরনের অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি লিখতে শুরু করেছি আমার প্রথম উপন্যাস_ 'শঙ্খনীল কারাগার'।
বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারা স্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিভে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকনা খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, ঝুপ ঝুপ করে একটা ছোট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম করে।
'শঙ্খনীল কারাগার' আমার প্রথম লেখা উপন্যাস, যদিও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'নন্দিত নরকে'। আমার পরম সৌভাগ্য, আমার বাবা 'শঙ্খনীল কারাগার' উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে যেতে পেরেছেন। সেই গল্প আরেকদিন করব।

Post a Comment

1 Comments

শিহাব said…
প্রিয় লেখক, আপনাকে সবসময়েই মিস করি