Ticker

6/recent/ticker-posts

আমরা আশাবাদী ছিলাম হুমায়ূন বেঁচে যাবে - আবু মোহাম্মদ ফজলুল করিম

আমরা আশাবাদী ছিলাম হুমায়ূন বেঁচে যাবে - আবু মোহাম্মদ ফজলুল করিমহুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা হয় দুইভাবে। এক. আমরা ঢাকা কলেজে পড়ি একসঙ্গে। ও ছিল প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র। আমি তাকে মাইকেল বলে ডাকতাম। আমরা ঢাকা কলেজে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হই এবং ১৯৬৭ সালে বের হই। এরপর বহুদিনের গ্যাপ। আমি সিঙ্গাপুর হয়ে আমেরিকায় থাকি অনেক দিন। এরপর দ্বিতীয়বার দেখা হয় তৎকালীন বিটিভির পরিচালক বরকতউল্ল্যার মাধ্যমে। সে হুমায়ূনকে নিয়ে আসে আমার বাসায় বাড়ির নকশা করার জন্য। বরকতউল্ল্যার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাঁর গুলশানের বাড়ি করার মধ্য দিয়ে। তত দিনে হুমায়ূন বিখ্যাত হয়ে যায় তার 'অয়োময়' এবং 'কোথাও কেউ নেই'-এর মাধ্যমে। তখন তাকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হলেও সে আমাকে চিনতে ভুল করেনি। হুমায়ূন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তো কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি তাঁর বাড়ির ডিজাইন করতে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, আমাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে। এরপর সে গুলতেকিনকে নিয়ে এলো। ওটা তো এখন গুলতেকিনের বাড়ি। তখন যে পরিচয়, এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এমন কোনো রাত ছিল না যে আমার সঙ্গে কথা হতো না, আড্ডা হতো না। বন্ধুত্বের যে কী পরিমাণ দাম দিত, তা বলে বোঝানো যাবে না। সে কোথাও দাওয়াত খেতে গেলে একা যেত না। আমি, আলমগীর, নূর, মাছুম- আমরা সব সময় একসঙ্গে চলতাম। বের হলেই একদল নিয়ে যেত। একবার আমেরিকায় আমরা একসঙ্গে ঘুরতে যাই। হঠাৎ একদিন বলল, দেশে চলো, নতুন আলু উঠেছে, কই মাছ দিয়ে রান্না করে খাব। চলো, দেশে চলো। ওর যত বই প্রকাশ হতো তা ছাপার আগে, প্রকাশ হওয়ার আগেই আমরা শুনে ফেলতাম। এখন মনে হয় ওর লেখা এবং ওকে কী যে মিস করি বলে বোঝাতে পারব না। একবার 'এসো' নামে একটি ঈদের নাটক তৈরি করছিল। সেটে হঠাৎ হুমায়ূন বলে বসল, এই তো আমাদের সাংবাদিক পাওয়া গেছে। এই, তুমি সাংবাদিক চরিত্রে অভিনয় করো। আবার কখনো বা ডাক্তার চরিত্রে। ওর সাত-আটটি নাটকে আমি অভিনয় করেছি। আবার কখনো আমাকে গানও গাইতে হতো। মানুষ হিসেবে ও কত উঁচু মানের, তার সঙ্গে না মিশলে বোঝা যাবে না। ও মারা যাওয়ার পর আমরা যেখানে আড্ডায় বসতাম, সেসবই এখন স্মৃতি। আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি, ও চলে যাবে এত তাড়াতাড়ি। গত জুলাইয়ে হুমায়ূন এসে নুহাশপল্লীতে চলে গেল। আমি ঠিক দুপুরে গিয়ে পৌঁছি। আর সে বলে উঠল, বন্ধু আসলে খাওয়ার সময়ই আসে। আমি ওকে দেখে বললাম, তুমি তো সুস্থই আছ। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রায় ২৩ ঘণ্টার জার্নি করে কেন আসছ? উত্তরে সে বলল, আমি আসছি দুইটা কারণে।
আমার বৃদ্ধ মাকে দেখতে আর তোমাদের শেষ দেখা দেখতে। আমরা আশাবাদী ছিলাম, হুমায়ূন বেঁচে যাবে। ও যখন আমেরিকায় হাসপাতালে ভর্তি হলো, ওর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হতো। আমি ওর সম্পর্কে যতখানি জানি আর কেউ হয়তো এতটা জানে না। ও তার নতুন কোনো লেখা পড়ার সময় ওই লেখার ভেতর ডুবে যেত। এবং পড়ে মাঝেমধ্যে কেঁদে ফেলত। ওর ভেতর যে এত প্রতিভা ছিল, তা সত্যি অবাক করার মতো। একদিন নুহাশপল্লীতে গিয়ে দেখি, হুমায়ূন তার পিএইচডি ডিগ্রির কাগজপত্র ফেলে দিয়েছে। কোঁচকানো কাগজ কুড়িয়ে দেখি পিএইচডির কাগজপত্র। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা ফেলে দিচ্ছ কেন? বলল, এটা দিয়ে কী হবে! আর আমি কি নামের আগে কখনো এই ডিগ্রি ব্যবহার করেছি। ও কুতুবপুর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নির্মাণ করেছে ওর নিজস্ব অর্থায়নে। ওকে যে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়া হলো, এটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল ওখানে সমাহিত হওয়ার। সে বলত, ওখানে আমার কবর, এরপর তোর কবর, এরপর আলমগীরের কবর হবে। আমরা তিন বন্ধু পাশাপাশি থাকব। আমি তো এসবের জীবন্ত সাক্ষী। ওখানে একটা গেস্ট হাউস আছে, ওটা আমারই করা। এখন আর যাওয়া হয় না নুহাশপল্লীতে। কারণ যার জন্য যাব সে তো নেই। যত দামি শুটিং হতো না কেন, আমরা গেলেই প্যাক-আপ। যেকোনো অনুষ্ঠানেই সে আমাকে তার পাশে বসাত। আর যেকোনো জায়গায় গেলে আমাদের সবার সঙ্গে সে পরিচয় করিয়ে দিত। এখনো সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজলে মনে হয়, তার ফোন আসছে। সে অনেক ছবি আঁকত। আমি গেলে বলত, দেখ কোনটা তোর পছন্দ। আর সে ভোজনবিলাসী ছিল। সে একদিন হালিম বানাল; কিন্তু মনে হলো সেই হালিম দেশের সেরা হালিম। সে দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। বাংলাদেশের কোনো খেলা হলে সে কখনো মিস করত না। সবাইকে একসঙ্গে করত খেলা দেখতে। দেশের বাইরে শুটিং, খেলা থাকলে সে শুটিং বাদ দিয়ে খেলা দেখত। ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে ছিল তার ভীষণ সখ্য। আমি তাকে প্রেমকুমার বলে ডাকতাম। হুমায়ূন প্রায়ই বলত, ডাকো তোমার প্রেমকুমারকে। মিলন যে হুমায়ূনকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করত, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার ছেলে রিশাদ। সে যখন কথা বলতে শিখল, আমি একদিন হুমায়ূনের বাসায় রিশাদকে নিয়ে যাই। হুমায়ূন বলল- তো রিশাদকে একটা কথা শিখাই। সে শেখাল হাদা বলতে। এরপর রিশাদ যত দিন ওকে দেখেছে হাদা চাচু বলেই ডাকত। হুমায়ূন বলত, কী এক বিপদে পড়লাম ওকে এই কথা শিখিয়ে! হুমায়ূন যে বয়সে মারা গেছে- তার লেখার সময় ছিল তখনই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তাকে অনেক ভালোবাসতেন। সুনীলদা এলেই বলতেন করিমকে ডাকো। আমাদের আড্ডা ও ছাড়া জমবে না। যেকোনো বিষয়ই হতো না কেন। সে গান অনেক ভালোবাসত। সে গান যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। তার আঁকা ছবিটা দেখলে মনে হয়, এই বুঝি মাইকেল এলো। সে সব সময় বলত- আমাদের সবারই মরতে হবে। জ্যোস্না উঠবে, সবাই ওয়াইন খাবে। কিন্তু আমরা কেউ থাকব না।
অনুলিখন : শ্যামল চন্দ্র নাথ

Post a Comment

0 Comments