Ticker

6/recent/ticker-posts

দ্য লাস্ট ডাইনিং আউট - মাজহারুল ইসলাম

দ্য লাস্ট ডাইনিং আউট - মাজহারুল ইসলাম

হোয়াইটস্টোন ব্রিজ পার হয়ে 195 হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি দুটি। গন্তব্য ব্রোঞ্জ আইল্যান্ড। আমার বন্ধু রুবেল আর আতাহার উদ্দীনের দুই গাড়িতে ভাগাভাগি করে বসেছি আমরা। হুমায়ূন আহমেদ, শাওন, নিষাদ, নিনিত আর আমি। শাওন ভাবির মা তহুরা আলীও আমাদের সঙ্গে আছেন। ১২ জুন সার্জারির কারণে তিনি নিউ ইয়র্কে এসেছেন। রুবেল ও আতাহার আছেন সপরিবারে। রুবেলের দুই শিশুকন্যাও সঙ্গে আছে। এ পথে এক্সিট 8-B দিয়ে বেরিয়ে গেলে সোজা অর্চার্ড বিচ সিটি আইল্যান্ড। আরেকটু সামনে এগোলে Sammys-এর সাইন দেখা যায়। বিচের ধারে পর পর তিনটা রেস্টুরেন্ট।
Sammys Fish Box যাত্রা শুরু করে ১৯৬৬ সালে। গোড়াতে এটি ছিল ২৬ আসনের স্ন্যাকস বার। এখন পরিণত হয়েছে ৫০০ আসনের ফুল সার্ভিস রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্লায়ারে লিখেছে, গুণগত মান অক্ষুণ্ন রাখা আর সব সময় সতেজ খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। সি-ফুড যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের খুব প্রিয় এ রেস্টুরেন্ট।
আজ ৯ জুন ২০১২, শনিবার। আমরা দলেবলে চলেছি এই রেস্টুরেন্টে সি-ফুড খাব বলে।
এর আগে রুবেল একবার হুমায়ূন-পরিবারকে এই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছিল। সেবার আমি নিউ ইয়র্কে ছিলাম না। হুমায়ূন আহমেদ খুব উপভোগ করেছিলেন এখানকার খাবার। বিশেষ করে তাদের চমৎকার খাবার পরিবেশনা আর পুরো পরিবেশটা। আমি জানি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে স্বল্পাহারী হলেও ভালো খাবারের বেশ সমঝদার। রেস্টুরেন্টটি তাঁর ভীষণ পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারি, যখন তিনি অপারেশনের আগে তাঁর যে তিনটি ইচ্ছে পূরণ করতে চান, তার মধ্যে উল্লেখ করেন এ রেস্টুরেন্টে আরেকবার খাওয়ার বিষয়টি। তবে তাঁর এ ইচ্ছেপূরণ শুধু নিজের জন্য নয়, আমার জন্যও। তিনি বলেন, মাজহার আগেরবার ছিল না। এবার আমি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ওখানে যেতে চাই। ওদের খাবারের পরিবেশনা দেখার মতো। রুবেলকে বলো ব্যবস্থা করতে।
হুমায়ূন আহমেদের তিন ইচ্ছের একটি পূরণে আজ আমরা এখানে এসেছি। শনিবার হওয়ায় পর্যটক আর ভোজনরসিকদের বেশ ভিড়। একই মালিকানায় আরো তিনটা সি-ফুড রেস্টুরেন্ট এখানে- Sea Shore Restaurant and Marina, Seaside Johnnies ‰es Pier Restaurant & Tiki Bar.
এককোণে ভিড় খানিকটা কম- এ রকম জায়গা খুঁজে সবাই একটা টেবিলে বসলাম। হুমায়ূন আহমেদ বসলেন দুই পাশে দুই পুত্র নিষাদ আর নিনিতকে নিয়ে। আতাহারের স্ত্রী ফিলিপিনো। এই প্রথম ভাবির সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। প্রথম পরিচয়েই তাঁকে হাসিখুশি ও মিশুক বলে মনে হলো। অল্প সময়ে সবার সঙ্গে মিশে গেলেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন তিনি। শুনতে খুব ভালো লাগে। হুমায়ূন আহমেদকে বললেন, শুনেছি আপনি অনেক বড় রাইটার। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল। হুমায়ূন আহমেদও তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো, বিশেষ করে যে খাবারটি দেখে এর আগে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ- The Crab & Lobstar Feast. আমি জানি স্যার Crab খান না। Lobstar তাঁর খুব পছন্দ। তবে কি এ জন্যই খাবারটি এত ভালো লেগেছিল তাঁর? খাবারের স্বাদের চেয়ে অপূর্ব পরিবেশনাটি ছিল তাঁর কাছে প্রধান আকর্ষণ। খানিক বাদে ওয়েটার যখন খাবারটি এনে পরিবেশন করলেন টেবিলে, আমি সত্যি চমকালাম। অদ্ভুত সুন্দর খাবারের পরিবেশনা, স্যার তো মুগ্ধ হবেনই। একটা বড় সার্ভিং ডিশে সাজানো আছে King Crab legs আর Lobstar. নিচে ইয়েলো রাইস। সঙ্গে বয়েলড ভেজিটেবল ও স্পেশাল ব্রেড বাটার। আরো অন্য কিছু খাবার অর্ডার করা হয়েছিল। মূলত হুমায়ূন আহমেদের জন্য ছিল তাঁর পছন্দের বিফ স্টেক। বিশাল লবস্টারের একটা অংশ তিনি কেটে নিলেন। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। আমি লক্ষ করলাম, নিজের খাওয়ার চেয়ে অন্যদের খাওয়া আর এই পুরো আয়োজনটা বেশ উপভোগ করছিলেন তিনি।
খাবার শেষে বিল দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল রুবেল ও আতাহার। সব সময় তা-ই হয়, রুবেল-আতাহার সঙ্গে থাকলে তারা অন্য কাউকে বিল দিতে দেয় না। এবারও হুমায়ূন আহমেদ ও আমি কোনোভাবেই তাদের নিবৃত্ত করতে পারলাম না। রুবেল বলে সে বিল দেবে, আতাহার বলেন তিনি দেবেন। প্রায় ৮০০ ডলার বিল হয়েছে। শেষে রুবেল-আতাহার দুজনে মিলে বিলটা দিলেন।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। খানিকটা হেঁটে আটলান্টিকের পাড়ে বড় আকারের উন্মুক্ত ফুড কোর্ট। সেখানে শত শত মানুষ খাচ্ছে। কেউ কেউ বসে সময় কাটাচ্ছে। আমরা দুটি টেবিল নিয়ে কিছুটা সময় বসলাম। হুমায়ূন আহমেদ ভাবি ও বাচ্চাদের সঙ্গে ছবি তুললেন। সামনে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। আটলান্টিকের জলরাশি আছড়ে পড়ছে সেখানে। বয়ে আসা বাতাস শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে দেহ ও মনে। আমরা এক ঘণ্টার মতো সময় কাটালাম এখানে। হুমায়ূন আহমেদ সারাক্ষণ দুই শিশুপুত্রের কাছে কাছে থাকছেন, তাদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করছেন। নিনিত তো বাবাকে ছাড়তেই চায় না। আমার মনে হলো, শিশু দুটি তাঁর খেলনা, তিনি নিজেই শিশু। খেলছেন তাঁর খেলনা-শিশুদের নিয়ে। কী যে আনন্দ তাঁর চোখে-মুখে!
ওখান থেকে আমরা গেলাম পাশেই আরেকটা বিচে। সেখানে শিশুদের সুন্দর খেলার জায়গা আছে। ফিলিপিনো ভাবি নিষাদ-নিনিতকে নিয়ে অনেকক্ষণ খেললেন। তিনি ও আতাহার দুজনেই মনে হয় শিশুদের খুবই পছন্দ করেন। প্রথম থেকেই লক্ষ করছি, তাঁরা বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছেন শিশুদের সঙ্গে। রুবেলের দুই শিশুকন্যাও আতাহারের খুবই ভক্ত। নিষাদ-নিনিতসহ ওদের সঙ্গে নানা ধরনের মজা করছেন আতাহার। হুমায়ূন আহমেদ ভাবিকে নিয়ে একটু দূরে বসে শিশুদের খেলা উপভোগ করছেন।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরা ঘরে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে রওনা হলাম। হুমায়ূন আহমেদ ও ভাবি আতাহারের গাড়িতে। হোয়াইটস্টোন ব্রিজ পার হয়ে আমরা কুইন্সের দিকে চলেছি। এর মধ্যে রুবেলের মোবাইলে সংকেত এলো, ওজন পার্কের বাসায় ফেরার আগে আতাহারের বাসায় সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি হবে। হুমায়ূন আহমেদ ভাবির অনুরোধে তাঁদের বাড়িতে চা খেতে রাজি হয়েছেন। তিনি থাকেন জ্যামাইকা এস্টেটে। ইনডিপেন্ডেন্ট সিঙ্গল হাউস। বাড়ির সামনে বাগান করেছেন। সেখানে নানা ধরনের ফলমূলের গাছও রয়েছে। প্রাসাদসম বাড়ির ভেতরে ঢুকে চোখ আটকে গেল ভাবির শাড়ি পরা বাঙালি রমণীর মতো ছবিটির দিকে। একমাত্র কন্যা নিউ ইয়র্ক সিটির বাইরে পড়ালেখা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আতাহার পাঁচ-ছয় ধরনের ফলমূল কেটে সামনে হাজির করলেন। এর মধ্যে হলুদ রঙের কিউই দেখে সবাই মুগ্ধ। আমরা সব সময় সবুজ কিউই দেখে অভ্যস্ত। বেশ কিছুটা সময় কাটালাম আতাহারের বাসায়।
এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ফেরার আগে হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, বাসাটা তাঁর পছন্দ হয়েছে। অপারেশনের পর একদিন বেশি সময় নিয়ে আসবেন। ১২ জুন অপারেশনের আগে স্যারের তিন ইচ্ছের আরো একটি পূরণ হলো। আনন্দে কেটেছে আমাদের আরো একটি বেলা। কিন্তু কে তখন ভেবেছে, আমাদের আনন্দের বেলাগুলো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে? এই আনন্দগুলো স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হবে আর কদিন পরই। আনন্দগুলো দুঃসহ যন্ত্রণা হয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে সারাটি জীবন। তবে কি বিধাতা তাঁকে কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে সময় খুবই অল্প? তা না হলে সবাইকে নিয়ে ঘরের বাইরে একসঙ্গে খেতে চেয়েছিলেন কেন তিনি? কেন এটিই হলো রেস্টুরেন্টে পরিবার-বন্ধুবেষ্টিত তাঁর শেষ খাওয়া?

Post a Comment

0 Comments