Ticker

6/recent/ticker-posts

টিনের পুতুল - স্মরণজিত্‍ চক্রবর্তী

টিনের পুতুল - স্মরণজিত্‍ চক্রবর্তী
সকালে ঘুম ভাঙতে আজ দেরি হয়ে গেল রিজিয়ার৷ ভোর রাতে এমন একটা শ্বপ্ন দেখেছিলেন যে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আচমকা৷ তারপর সেই শ্বপ্নটাই ঘুরছিল মাথার মধ্যে৷ সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল নেই! তাই একটু বেলা হয়ে গেছে আজ৷ পাশের কাঠাল চাঁপা গাছ ছাড়িয়ে রোদটা ওই পেয়ারা গাছের ডালগুলো ছুঁয়ে দিয়েছে৷ এই ঘরটা বেশ বড়৷ উঁচু সিলিং৷ বড় বড় কাচের জানলা৷ সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় ঝরোকার কারুকাজ৷ দূরে গঙ্গা দেখা যায়৷ দেখা যায় তার সবুজ পাড় আর সেখানে পড়ে থাকা সকালো কামানটা৷ সেই সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করে বাংলাদেশ থেকে এসে ঢুকেছিলেন এই বাড়িতে৷ তারপর ছেষট্টি বছর হয়ে গেল! তবু আজও সব নতুন লাগে রিজিয়ার৷ ভিতরে ভিতরে সেই সতেরোর মনখারাপ আর ছটফটানি আজও টের পান খুব৷ ঘুম থেকে উঠেই শ্রীরামকৃষ্ঞের ছবিটাকে প্রণাম করেন রিজিয়া৷ একটুখানি তাকিয়ে থাকেন, তারপর শুরু করেন দিন! আজ একটা বিশেষ দিন৷ বাড়িতে ছোটাছুটি চলছে৷ দোতলার এই ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছেন সব৷ ইস, ওঁরও তো কাজে লেগে পড়ার কথা৷ কিন্ত্ত এমন একটা শ্বপ্ন দেখলেন যে দিনটাই ঘেঁটে গেল যেন! কিন্ত্ত কী শ্বপ্ন দেখলেন ভোরবেলা? নদী দেখলেন কি? আবছা জ্যোত্স্না? কেউ কি দাঁড়িয়েছিল দূরে? নাঃ, স্পষ্ট হচ্ছে না! ঘষা কাচের ওপারেই যেন রয়ে যাচ্ছে সব! মনের বয়সটা বুঝতে না পারলেও শরীরের বয়সটা বেশ বুঝতে পারেন রিজিয়া৷ হাঁটতে কষ্ট হয়৷ হাঁপ ধরে যায়৷ মাঝেমাঝেই কেমন যেন ঘুরে যায় মাথা! বোঝেন শরীর এবার ছুটি চাইছে৷ ঘরের লাগোয়াই বাথরুম৷ ষ্রেশ হয়ে নীচে নামতে আরও মিনিট কুড়ি লেগে গেল ওঁর৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই দেখলেন নিতাই উঠে আসছে ওপরে৷ ওঁকে দেখে বলল, “মা, বাবু খুব রাগ করছে! সাড়ে সাতটা বেজে গেছে কিন্ত্ত এখনও আপনি ওঠেননি শুনে চিত্কার করছেন খুব৷” রিজিয়া জিজ্ঞেস করলেন, “নমিতা আসেনি?” “হঁ্যা নার্সদি তো এসেছে৷ কিন্ত্ত তাও বাবু...” রিজিয়া জানেন লোকটা এমনই৷ নব্বই বছর বয়স হল৷ গোটা শরীরটা পড়ে গেল বিছানায় তবু মুখের জোর আর বদ মেজাজটা গেল না! “আমি যাচ্ছি, তুই যা৷” “মা, ওই এস্টোর রুমটা পরিষ্কার করছি৷ ভাঙ্গারওলা আসবে পরে৷ সব দিয়ে দেব কি?” “আমায় দেখিয়ে তারপর দিবি৷” রিজিয়া আর দাঁড়ালেন না৷ নমিতা মেয়েটা ভাল, সকাল সাতটার মধ্যে চলে আসে৷ যায় রাত ন’টা নাগাদ৷ তারপরের সময়টুকু নিতাই-ই সামলায় মুকুলকে৷ মুকুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ বিয়ের আগে নিজের বরের নামটাও শুনতে চাননি রিজিয়া৷ মাথা নিচু করে, ঠোঁট টিপে বসেছিলেন ঘরে৷ আর মা শাপশাপান্ত করে যাচ্ছিল ওঁকে! কত দিনের আগের কথা, কিন্ত্ত এখনও স্পষ্ট মনে আছে৷ মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা৷ মনে হয় আর একটু পরেই বাইরের উঠোনে বাবার খড়মের শব্দ শোনা যাবে৷ বিয়ের পিঁড়িতে বসে একবারও বরের দিকে তাকাননি রিজিয়া৷ মাথার ভিতর তখন আগুন পাক খাচ্ছিল৷ মালা বদলের সময় বাড়ির বড়রা জোর করে থুতনি তুলে ধরলেও চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলেন উনি৷ এমনকী ফুলশয্যার রাতে যখন শরীরের ওপর চেপে বসেছিল ভারী শরীরটা তখনও তাকাননি রিজিয়া, তখনও চোখ বন্ধ রেখেছিলেন৷ মনে মনে ভেবেছিলেন দেখবেনই না কিছু৷ আর কাউকে যে দেখার থাকতে পারেই না এ জীবনে! এক্ষুনি ওই ঘরে যাবেন না রিজিয়া৷ আগে বাগানে যেতে হবে৷ সকালের ফুলটা এখনও নিজেই তোলেন৷ বাড়িতে চার পাঁচজন কাজের লোক আছে৷ কিন্ত্ত তবু এটা কারও ওপর ছাড়েন না৷ ছোট থেকেই ফুল তোলাটা খুব প্রিয় কাজ ওঁর৷ পিতলের সাজি নিয়ে ধীরে ধীরে ফুল তুললেন রিজিয়া৷ তারপর দাঁড়ালেন একটু৷ শীতকাল৷ একটা আবছা কুয়াশা জড়িয়ে আছে গাছে গাছে৷ সামনের রাস্তাটাও কেমন যেন ভেজা৷ দূরে গঙ্গার থেকে হাওয়া আসছে একটা৷ শালটা ভাল করে কানে জড়িয়ে নিলেন এবার৷ জল দেখলে আজও কেমন যেন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ওঁর৷ সোঙ্গরের সেই কিশোরীবেলার কথা মনে পড়ে যায়৷ মনে পড়ে যায় ধলেশ্বরীকে৷ “মা, বাবু খুবই রাগারাগি করেছন!” এবার মালতী এল বলতে৷ রিজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালেন ওঁর দিকে৷ মেয়েটা রান্না করে৷ হাত বেশ ভাল৷ এ বাড়িতেই থাকে৷ বললেন, “দুধ মানকচুটা পেয়েছিস?” “হঁ্যা মা,” মালতী ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা, দেবুদা এখনও এসব খায়?” রিজিয়া আবার গঙ্গার দিকে ফিরলেন৷ নদীটা কেমন যেন রোগা হয়ে এসেছে৷ সত্যি, না এটা মনের ভুল? দেবু চলে গেছে বহু বহুদিন আগে৷ প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল! ওর বড় ছেলেটাকে দেখেছিলেন সে সময়৷ তারপর কত কী যে ঘটে গেল! রিজিয়া বললেন, “চল, ভিতরে চল৷” “মা, বাবু আপনাকে খুঁজছিলেন৷” ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াতেই নমিতা বলে উঠল৷ মুকুল নীচের ঘরে থাকেন৷ রাতে নিতাইও শোয় এই ঘরে৷ গত ন’বছর শয্যাশায়ী হয়ে আছেন মানুষটা৷ আর এখন তো একদম বিছানার সঙ্গে লেগে গেছেন৷ সব্বাই বলত মদ আর সিগারেটটা ছাড়তে৷ বলত এত বয়স হল এবার একটু সংযম দাবি করে শরীর৷ কিন্ত্ত কারও কথা শুনতেন না মুকুল৷ দু’বার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল৷ আর শেষে একটা সেরিব্রালে পুরো ফেলে দিয়েছে শরীরটা৷ রিজিয়া ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলেন মুকুল বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছেন৷ “খুঁজছিলে?” “কী করছিলে তুমি? এই বয়সে এত ঘুম আসে কোথা থেকে?” “কী দরকার বলবে?” রিজিয়া শান্ত গলায় বললেন৷ “আমার ওষুধ কই? কে দেবে সেসব?” মুকুল খিঁচিয়ে উঠলেন৷ “নমিতা দেয়নি?” “সব নমিতা করবে? তোমার কর্তব্য নেই! সারা জীবন তো ফাঁকি দিলে শুধু৷” “মনে নেই তোমার আজ দেবু আসবে?” রিজিয়ার কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না! মুকুল বললেন, “দেবু কোন লাটের বাট যে তার জন্য আমার ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে! জানি জানি, সব জানি৷ যদি সেই সাহেব থাকত তবে কি আর এমন অবহেলা করতে তুমি!” ক দূর থেকে জমিদার বাড়িটাকে কেল্লার মতো লাগে রিজিয়ার৷ দোতলার বড় বারান্দাটা দেখা যায়৷ জমিদারমশাই দুপুরবেলা ছড়ানো ডেক চেয়ারটায় লম্বা হয়ে শুয়ে তামাক খান৷ আর ধলেশ্বরী দিয়ে কোনও নৌকো গেলেই পাইক দিয়ে থামান সেটাকে৷ যারাই নদী দিয়ে যায় তারা দুপুরে জমিদার বাড়িতে না খেয়ে যেতে পারে না! রিজিয়ার হাসি পায়৷ সত্যি, টাকা থাকলে কত কী করে মানুষ! পুঁটির সঙ্গে মাঝে মাঝে নদীর পাড়ে ঘুরতে আসে রিজিয়া৷ তবে গত সাত দিন আসতে পারেনি! জ্বর হয়েছিল৷ আজ এসে ভাল লাগছে৷ আকাশে মেঘ করে আছে খুব৷ ঘোর বর্ষা চলছে৷ ধলেশ্বরী থেকে থেকেই হাওয়া-লাগা পালের মতো ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ রিজিয়া বলল, “হঁ্যারে পুঁটি, বাবাদের আসতে কি আজ দেরি হবে?” রিজিয়ার বাবা পুরোহিত৷ পুঁটির বাবার সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করেন৷ আজ একটা শ্রাদ্ধের কাজ আছে৷ তাই সকাল সকাল বেরিয়েছেন৷ পুঁটি বলল, “হবে হয়তো৷ কেন?” রিজিয়া জমিদার বাড়ির দিকে তাকাল, বলল, “যাবি ওখানে? সরমা এসেছে জানিস?” জমিদারের ছোট মেয়ে সরমা৷ গত বছর বিয়ে হয়েছিল৷ এখন বাপের বাড়ি এসেছে৷ বাচ্চা হবে৷ পুঁটি বলল, “না, যাব না৷ গেলেই খালি খোঁটা দেয়৷ বলে সতেরো বছর বয়স হল, বিয়ে হচ্ছে না কেন? পড়া-লেখা করে বিদ্যেধরী হব নাকি! ধুর, ভাল লাগে না আমার৷ যাওয়ার হলে তুই যা৷” রিজিয়া বলল, “সে তো আমাকেও বলে— ওমা তোর এমন নাম কেন! তাতে কি আমি রাগ করি! জেঠু রেখেছে তাই আমার নাম এমন৷ কে কী বলল তাতে কিচ্ছু এসে যায় না!” পুঁটি মুখ বেঁকাল, “ছাড় তো৷ তোকে কেন এখানে আনলাম জানিস?” “কেন?” রিজিয়া তাকাল পুঁটির দিকে৷ “ওই দেখ, সাহেব কুঠিতে নতুন লোক এসেছে৷” পুঁটি হাত দিয়ে দেখাল৷ দূরে বড় বড় গাছের মাঝে খুব সুন্দর একটা বাড়ি আছে৷ তার চারিদিকে সাদা বেড়া দেওয়া, সামনে বাগান৷ কাছের হিলজার্স চটকলের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার এই বাড়িতে এসে থাকে৷ রিজিয়া বলল, “তো? সব হুমদো হুমদো বুড়ো লাল-মুখোগুলো আসে৷ এ দেখার কী আছে?” পুঁটি হাসল, “আছে আছে, এবার যে এসেছে সে বুড়োও নয়, হুমদোও নয়৷ তাই তো দেখাতে আনলাম৷ কী সুন্দর দেখতে জানিস! বিকেলবেলা নদীর পাড়ের পাথরে বসে বেহালা বাজায়৷ গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বল খেলে৷ আর বাচ্চাদের কত রকমের লজেন দেয়!” “সাত দিনেই এত!” রিজিয়া ভুরু কোঁচকাল, “বউ বাচ্চা নেই?” “নারে, বাইশ-তেইশ বছর বয়স৷ চল না দেখবি৷” “আঃ, আমি কেন দেখতে যাব? খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমার?” রিজিয়া বিরক্ত হল, “চল, বাড়ি চল৷ মেঘ করে আছে৷ বিষ্টি শুরু হলে মুশকিল৷ ভিজলে মা যা বকবে না!” পুঁটি আর কথা বাড়াল না৷ রিজিয়ার মেজাজ জানে ও৷ একবার ক্ষেপে গেলে রক্ষে নেই! সবাই বলে ভগবান যেমন রূপ দিয়েছেন তেমন তেজেরও ঘাটতি নেই! পুঁটি বোঝে এর বশ্যতা শ্বীকার করে নেওয়াই ভাল৷ নদী পার থেকে বড় রাস্তা একটুখানি৷ সেখান থেকে রিজিয়াদের বাড়িটা হেঁটে মিনিট পাঁচেক লাগে৷ রাস্তায় উঠে শাড়ির কোঁচড় থেকে চালতা বের করল পুঁটি, “খাবি?” “নারে, ভাল লাগে না৷ মেয়ে বলেই কি টক খেতে হবে নাকি?” রিজিয়া কথাটা বলে সামনে তাকাল আর ঠিক তখনই দেখল তাকে৷ একটা সাইকেলকে হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে আসছে সে৷ কমে আসা আলোর মধ্যেও কী উজ্জ্বল লাগছে! রিজিয়া নিজের অজান্তেই তাকিয়ে রইল! পাশের থেকে পুঁটি খোঁচা দিল, “ওই দেখ আসছে৷ এর কথাই বলেছিলাম৷ কী সুন্দর দেখতে, না?” আচমকা লজ্জা লাগল রিজিয়ার৷ চিরদিন ওকে দেখেই লোকে চোখ ফেরাতে পারেনি৷ আর আজ ও এমন করে তাকাচ্ছে! দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল রিজিয়া৷ “কথা বলবি?” পুঁটি হাসল ঠোঁট টিপে৷ “মানে?” রিজিয়া ভুরু কুঁচকে তাকাল৷ “মানে আমি একদিন কথা বলেছি৷
ইংরিজিতে৷ বলবি?” “কী বলল?” জিজ্ঞেস করল রিজিয়া৷ “বললাম, এ বি সি ডি ই এফ জি এইচ৷” “ধ্যাত্,” রিজিয়া ধাক্কা দিল পুঁটিকে, “এই তোর ইংরিজি!” পুঁটি হাসতে গিয়েও সচকিত হয়ে গেল৷ সাহেব একদম সামনে এসে পড়েছে৷ রিজিয়া ভাল করে তাকাল এবার৷ পাথর কেটে তৈরি করা মুখ৷ দেখল সাহেবও ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সোজা৷ মাথা নামিয়ে নিল রিজিয়া৷ সারা গায়ে কদম ফুটল কেন! ও দেখল পুঁটিকে দেখে হাসল সাহেব৷ পুঁটিও হাসল, তারপর রিজিয়াকে দেখিয়ে বলল, “ষ্রেন্ড৷” “বোনধু!” ভেঙে ভেঙে বলল সাহেব৷ তারপর রিজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “মি রজার৷ ইউ?” রিজিয়া চোয়াল শক্ত করে মাটির দিকে মাথা নামিয়ে নিল৷ তারপর পুঁটির কবজিটা ধরে হনহন করে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে৷ পুঁটি বাধা দিচ্ছিল, কিন্ত্ত রিজিয়া শুনলই না৷ শুধু যেতে যেতে একবার আলতো করে পিছন দিকে তাকাল৷ আর দেখল মাঝপথে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে রজার৷ ২ মুকুলের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন রিজিয়া৷ মালতী রান্না শুরু করে দিয়েছে৷ খুদে বলে একটা ছেলে মালতীকে সাহায্য করে৷ ওঁকে দেখে মালতী বলল, “চাটনিটা আগে করে নিচ্ছি মা৷ তারপরে বাকিগুলো করব৷ আর নিতাইদা বলল মাছওলা আর একটু পরে মাছ দিয়ে যাবে৷ দু’রকম ছোট মাছই কি করব?” রিজিয়া মাথা নাড়লেন৷ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “ছোট বউমা কি চলে গেছে?” মালতী তাছাড়া ষাটের ওপর বয়স হয়েছে৷ দেখ কতটা কী খেতে পারে!” মালতী কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল৷ রিজিয়া পিছন থেকে ডাকলেন, “টিকুর খাবারটা করে দে তাড়াতাড়ি৷ নুডলস করে দিস৷ তেলটা কিন্ত্ত কম দিবি৷ কেমন?” চায়ের কাপ হাতে মুকুলের ঘরের দিকে এগোলেন রিজিয়া৷ ওঃ, আবার খারাপ কথা শুনতে হবে! কিন্ত্ত তার আগেই টিকু এসে দাঁড়াল সামনে৷ বলল, “আজ পড়তে বসব না ঠাম্মা৷ মা বকলে একটু ম্যানেজ করে নিও৷” রিজিয়া বললেন, “একটু বোসো৷ দেখো তো পিকু কত ভাল রেজাল্ট করে আই.আই.টি-তে গেছে পড়তে৷ তুমি না পড়লে কি মান থাকবে?” পিকু কুশলের বড় ছেলে৷ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে খড়গপুরে৷ ওরও আসার কথা আজ৷ তবে বলেছে সন্ধে হয়ে যাবে৷ দেবুর জন্য আবার কতদিন পর সবাই যে একসঙ্গে হবে! “প্লিজ প্লিজ ঠাম্মা,” টিকু বলল, “একদিন না পড়লে কি আর আই.আই.টি মিস হয়? আর আমার ইচ্ছেও নেই ওসব৷ আমি হিস্ট্রি নিয়ে পড়ব৷ এনশিয়েন্ট হিস্ট্রি অ্যান্ড রেলিক৷ তারপর ইন্ডিয়ানা জোনসের মতো অ্যাডভেঞ্চারে যাব৷” “ঠিক আছে,” রিজিয়া হাসলেন, “আমি দাদুকে চা-টা দিয়ে আসছি কেমন?” “আচ্ছা ঠাম্মা,” টিকু রিজিয়ার শাড়ির অাঁচলটা ধরে টানল, “সব তো বুঝলাম কিন্ত্ত একটা জিনিস তো বুঝতে পারছি না!” “কী পারছিস না বুঝতে?” “এতদিন পর হঠাত্‍ জেঠু আসছে কেন গো? মানে এতদিন তো এল না৷ হঠাত্‍ এখন আসছে কেন?” রিজিয়া তাকিয়ে রইলেন টিকুর দিকে৷ ফর্সা মুখটায় জ্বলজ্বল করছে কৌতূহল৷ কিন্ত্ত এর কী উত্তর দেবেন রিজিয়া! কারণ ও তো নিজেই জানেন না কেন হঠাত্‍ এত বছর পর ওর কাছে আসছে দেবু! খ রিজিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় কলকাতায় যদি যেতে পারত তবে পড়াশুনোটা আরও ভাল হত৷ এখানে পড়াশোনো করে ঠিক মন ভরে না৷ খুব কিছু বড় জায়গা তো নয় এই সোঙ্গর৷ ওদের ক্লাসে চারটে মাত্র মেয়ে পড়ে৷ তাতেই কত বাঁকা বাঁকা কথা শুনতে হয়! দাদা গত মাসে কলকাতায় গিয়েছিল৷ কাছের একটা ষ্লাওয়ার মিলে কাজ করে দাদা৷ সেখান থেকেই শহরে পাঠিয়েছিল দাদাকে৷ দাদার থেকেই অনেক গল্প শুনেছে কলকাতার৷ হাতে অাঁকা কয়েকটা ছবিও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে দাদা৷ শিয়ালদহ স্টেশন, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া, হাওড়ার লোহার সাঁকো, ময়দান আরও কত কী যে জিনিস ছড়িয়ে আছে শহরটায়৷ দাদার মুখে গল্প শুনে এত লোভ হয় রিজিয়ার! মনে হয় ও যদি ছেলে হত! মেয়ে হওয়াটা পৃথিবীতে একটা অসুবিধে৷ যেন জন্ম থেকেই একটা হাত আর পা বেঁধে পাঠানো হয়েছে! এটা করবে না৷ ওদিকে তাকাবে না৷ ওটা খাবে না৷ ওর সঙ্গে কথা বলবে না৷ যাচ্ছেতাই কাণ্ড৷ তার ওপর আবার একটু বড় হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা-মা! ভাগ্যিস জেঠামশাই বেঁচে ছিলেন তাই বাবা এখনও দুম করে ওর বিয়েটা দিতে পারেনি৷ নাহলে কি বাবা এতদিন অপেক্ষা করত নাকি? কত সম্বন্ধ যে ফি হপ্তায় আসে তার ঠিক নেই৷ লোকে বলে রিজিয়ার মতো সুন্দরী হয় না! সুন্দরী আর সুন্দরী! মেয়েদের এটা ছাড়া কি আর কিছু দেখতে নেই৷ শুধু চামড়ার দিকে লোভ! মাঝেমাঝে রিজিয়ার মনে হয় এই রূপটাই ওর শত্রু৷ মনে হয় নিজের মুখেই ক্ষুর চালিয়ে শত্রুটাকে শেষ করে দেয়! মা বলে, “এমন রূপ অবহেলা করিস না৷” বলে, “দেখবি তোকে তোর বর কত ভালভাসবে!” দরকার নেই ভালবাসার! জেঠামশাইয়ের কথাই আসলে ঠিক৷ যে দেশে মেয়েরা সামনে এগিয়ে আসে না সে দেশের কিছু হয় না! জেঠামশাইকে বাবা ভয় পেত খুব৷ তাই রিজিয়ার বিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি৷ জেঠামশাইয়ের কথার ওপর কথা বলতে তো পারত না বাবা৷ কিন্ত্ত এখন রিজিয়া বুঝতে পারে ওর সুখের দিন ফুরিয়ে আসছে৷ জেঠামশাই মারা গিয়েছেন গত বছর৷ এক বছর পার হয়ে গেছে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে মা-ও ঠেলতে শুরু করেছে বাবাকে৷ বলছে, “সরমাটার বাচ্চা হয়ে যাবে আর তোমার মেয়ে ছাদনাতলায় পর্যন্ত গেল না এখনও!” এই অবস্হায় কলকাতায় গিয়ে পড়া যে রূপকথা সেটা বোঝে রিজিয়া৷ কিন্ত্ত ব্যাপারটা ভাবলে যে ভাল লাগাটা তৈরি হয় সেটা হারাতে চায় না ও৷ আজ রবিবার, ষ্কুল ছুটি৷ ভরা বর্ষা চলছে এখন৷ চারিদিক জলে থৈ থৈ৷ ধলেশ্বরী ফুলে উঠে পাড় গিলে নিয়েছে অনেকটা৷ এ জলের তেজ খুব বেশি৷ সব ভাঙতে ভাঙতে যায়৷ সারা দিনের বৃষ্টির পরে এই বিকেলে রোদ উঠেছে একটু৷ আজ সরমার কাছে যাওয়ার কথা ওর৷ জমিদার গিন্নি খুব ভালবাসেন রিজিয়াকে৷ মায়ের কাছে প্রায়ই রিজিয়ার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেন লোক দিয়ে৷ কিন্ত্ত রিজিয়া কেন কে জানে একটু আড় হয়ে থাকে৷ অত বড়লোকদের সঙ্গে গা ঘেঁষতে ভাল লাগে না৷ সরমা নেহাত ওদের সঙ্গে পড়ত তাই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ মা এইজন্য খুব বকে রিজিয়াকে৷ বলে জমিদার গিন্নি এত ভালবাসেন তাও কেন ওঁর কাছে যায় না রিজিয়া? বলে, “গিন্নিমা আমার কাছে দুঃখ করেন খুব৷ তুই যেদিন কাউকে ভালবাসবি সেদিন যন্ত্রণাটা বুঝবি, বুঝেছিস?” মা আজ নাড়ু করেছে৷ রিজিয়ার হাত দিয়ে পোর্সেলিনের এক বয়াম ভর্তি নাড়ু দিয়ে দিয়েছে সরমার জন্য৷ আর পুঁটি নিয়েছে মোরব্বা৷ দাদা কলকাতা থেকে একটা সুন্দর স্যান্ডেল কিনে এনেছে৷ আজ সেটাই পায়ে দিয়েছে রিজিয়া৷ পুঁটি বেশ কয়েকবার আড় চোখে চটিটা দেখেছে৷ আসলে এখানে রাবারের চটি ছাড়া ভাল কিছু পাওয়া যায় না৷ রিজিয়ার কষ্ট হয় পুঁটির জন্য৷ ওদের অবস্হা রিজিয়াদের চেয়েও খারাপ৷ দাদা আর বাবার মিলিত রোজগার ওদের তাও দিন চলে যায়৷ কিন্ত্ত পুঁটির বাবার চার মেয়ে আর একটা ছোট ছেলে৷ একার রোজগারে ভদ্রলোকের নাভিশ্বাস ওঠে প্রায়! “কী চিন্তা করছিস তখন থেকে?” পুঁটি খোঁচাল রিজিয়াকে৷ “না, কিছু না৷” রিজিয়া মাথা নাড়ল৷ সামনে রাস্তাটা গিয়ে নদীর পাড়ের বড় রাস্তায় মিশেছে৷ ওই অবধি পুরো রাস্তাটাই একদম মাখা সন্দেশের মতো হয়ে আছে৷ পুঁটি বলল, “আজ এই জুতোটা না পরলেই পারতিস৷ নষ্ট হয়ে যাবে৷” রিজিয়া পাত্তা দিল না৷ ও নদীর দিকে তাকাল৷ বর্ষার জল-ভরা মেঘের তলা থেকে সূর্য ছিটকে বেরচ্ছে যেন৷ মনে হচ্ছে নদীর জলে সোনার পাতা ভাসিয়ে দিয়েছে কেউ৷ ও জিজ্ঞেস করল, “সরমার কত মাস রে?” মাটির দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছিল রিজিয়া৷ আবছা জলের ছাঁট এসে লাগছিল ওর মুখে৷
“জানি না,” বলেই পুঁটি চোখ বড় বড় করল, “জানিস আমার ছোট বোন কাল গিয়েছিল ওই রজার সাহেবের কাছে৷” “একা? কেন?” চট করে তাকাল রিজিয়া৷ “একা নয়, ওরা কয়েকজন৷ কৌতূহল ছিল লোকটাকে নিয়ে৷ তাই লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল৷” “কৌতূহল কেন?” রিজিয়া ভুরু কোঁচকাল, “এর আগে লাল-মুখো দেখেনি?” “নারে বাবা, এ লোকটা, আর লোকই বা বলছি কেন, ছেলেটা তেমন নয়৷ ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে৷ পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বল খেলে৷ ঘুড়ি ওড়ায়৷ তাই বোনরা গিয়েছিল৷” রিজিয়া কিছু না বলে তাকাল পুঁটির দিকে৷ পুঁটি উত্সাহিত হয়ে বলল, “সাহেব ওদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কেক-রুটি খাইয়েছে৷ নিজে বানিয়েছে সাহেব৷ বোন আমার জন্য নিয়ে এসেছিল একটু৷ কী ভাল খেতে, জানিস! অবশ্য বাড়িতে কাউকে বলিনি৷” রিজিয়ার বুকের ভিতরে কেমন যেন করে উঠল একটা৷ কেন করল কে জানে! কিন্ত্ত বুকের ভিতরটায় কী যেন মুচড়ে উঠল, কামড়ে উঠল! ও বলল, “ইস, এত হ্যাংলা তুই? দিল আর খেলি! ছিঃ৷” পুঁটি আহত হল, বলল, “এমন করে বলছিস!” রিজিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্ত্ত তার আগেই শব্দ শুনল একটা৷ ও দ্রুত বাঁদিকে ফিরে তাকাল৷ দেখল পাশের বড় কদম গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রজার৷ হাতে ছোট্ট একটা বাক্স মতো জিনিস৷ “কী হল এটা?” রিজিয়ার মাথা তো গরম ছিলই এবার আরও হয়ে উঠল৷ রজার হাসল, তারপর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, “আমার ক্যামেরা৷ ছবি তুললাম একটা তোমার৷” “ক্যামেরা?” রিজিয়া ভুরু খোঁচকাল৷ ও দেখেছে ক্যামেরা বলে জিনিসটা৷ জমিদার বাড়িতেই আছে৷ কিন্ত্ত সে তো অনেক বড়! রজার হাসল, “হঁ্যা৷ আমার৷ এমন ওয়েদারে ছবি তুলতে বেরিয়েছি৷” রিজিয়া চোয়াল শক্ত করে বলল, “এসব যন্ত্র দিয়ে আমার ছবি তুললেন কেন? কে বলেছে তুলতে?” রজার একটু থমকে গেল৷ আমতা আমতা করে বলল, “সরি৷ বুঝতে পারিনি৷” রিজিয়া বলল, “জমিদার মশাইকে বললে না পিটিয়ে ছাতু করে দেবে৷ কেন তুললেন আমার ছবি? কেন?” রজার থমকাল একটু, তারপর অশ্ফুটে বলল, “তুমি এত সুন্দর দেখতে তো... তাই কুডনট রেজিস্ট মাইসেলফ৷” রিজিয়া তাকিয়ে রইল ওর দিকে৷ দেখল রজার মাথা নিচু করে চলে গেল৷ কিন্ত্ত কী বলে গেল ও? এমন সরাসরিভাবে বলা যায়! বুকের ভিতর ধলেশ্বরী ফুলে উঠল যেন রিজিয়ার৷ শ্বাস কেমন যেন বন্ধ হয়ে এল! বুঝল নদী আবার পাড় ভাঙতে শুরু করেছে! পুঁটি বলল, “এ বাবা তোর ছবি তুলে নিল! এখন কী হবে? তোর বাবা জেনে গেলে?” রিজিয়া ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “আর তুই যে বাড়ির লোকদের লুকিয়ে কেক খেয়েছিস! সেটা কিছু নয়? সেটা জানলে? এখন চুপ করে চল তো!” ৩ “তুমি বারবার চলে যাচ্ছ কেন বলো তো? কী এমন রাজকার্য আছে তোমার? কে এমন আসছে?” মুকুলের দিকে তাকালেন রিজিয়া৷ সারা শরীর পড়ে গেছে৷ কথাও কিছুটা জড়ানো, তবু এখনও ভিতরের পশুটা মরল না! বাবা মা যে ঈশ্বর নয়, তা ছোট বয়সেই বুঝেছিলেন রিজিয়া৷ আর যত বড় হয়েছেন সেই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে ওঁর৷ এমন একটা মানুষের সঙ্গে কেউ বিয়ে দেয় নিজের মেয়ের? টাকা ছাড়া আর কী ছিল লোকটার? সবাই তো জানত কেমন ছেলে! গ্রামের মানুষদের ওপর অত্যাচারের নানা গল্প তো লোকের মুখে মুখে ঘুরত৷ তাই কলকাতায় পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই৷ তাও এই লোকটার সঙ্গে বাবা মা কী করে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল ওঁর! বাবা মায়ের কথা ভাবলে মনটা তেতো হয়ে যায় রিজিয়ার৷ নিজেদের ঠুনকো সামাজিকতা আর সম্মানের জন্য মেয়েকে যারা বলি দিতে পারে তাদের সম্মান করবে কী করে! রিজিয়া বললেন, “বাড়িতে হাজারটা কাজ৷ কে দেখবে? তুমি এমন করছ কেন?” মুকুল দাঁত পিষে বললেন, “কেন, তোমার আদরের বউমাটি কোথায়? সে ষ্কুলে না গিয়ে একদিন বাড়ির কাজ দেখতে পারত না? আর তোমারই বা অত কী? কে এমন লাট সাহেব আসছে?” “দেবুর সঙ্গে তোমার কীসের এত শত্রুতা বলতে পার?” “শত্রুতা? বেজন্মা একটা৷ আমার সঙ্গে শত্রুতা কী করবে ও!” মুকুলের গলাটা খরখর করে উঠল৷ “তুমি... এখনও...” রিজিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন৷ “নয়তো কী?” মুকুলের চোখে বিষ ঘনিয়ে এল যেন, “বিয়ের আগে আমি জানতাম না তোমার সঙ্গে ওই সাহেবটার আশনাই-এর কথা৷ কিন্ত্ত বিয়ের পরে তো জেনেছি! তোমরা বড় ছেলের চোখ অমন কটা কেন? নোংরা একটা লোক৷ তোমায় ভোগ করে পালিয়ে গিয়েছিল৷ আর তুমি? আমায় ঠকাওনি?” রিজিয়া চুপ করে তাকিয়ে রইলেন৷ এতগুলো বছর এই কথাটা এতবার শুনেছেন যে এখন আর কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না! মুকুল আবার বললেন, “জানোয়ার সাহেব একটা৷ আমার জীবন শেষ করে দিল! তার সেই বেজন্মা সন্তান আসবে বলে কি আমায় নেত্য করতে হবে?” রিজিয়া কথা না বলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে৷ কিন্ত্ত আজ একটু চিন্তা হচ্ছে৷ দেবুর সামনে এসব শুরু করলে আবার একটা ঝামেলা না হয়! কারণ দেবুর এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণও তো এই কথাগুলোই! “মা, ভাঙ্গারওলা এসেছে৷” নিতাই এসে দাঁড়াল সামনে৷ রিজিয়া বলেন, “তাড়াতাড়ি কর তোরা৷ দেবু আসবে যে কোনও সময়৷” “আপনি একটু দেখবেন না মা? বললেন যে দেখবেন!” “ওজন-টোজন করুক৷ আমি আসছি৷” আশি ছাড়িয়ে গেছে রিজিয়ার বয়স, কিন্ত্ত এখনও যথেষ্ট কর্মক্ষম আছেন৷ শুধু আগে, যেমন বহুবার ওপর নীচে করতে পারতেন এখন আর তেমন পারেন না৷ সব কাজ সেরে একেবারে রাতে ওপরে যান৷ মাছ দিয়ে গেছে একটু আগে৷ মালতীকে দু’- একটা টুকটাক কথা বলে রিজিয়া আর দাঁড়ালেন না৷ কুশলকে এবার তুলতে হবে৷ গতকাল নিজেই বলল ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রসাদটা নিয়ে আসবে৷ কিন্ত্ত এখনও ঘুমোচ্ছে! রাতে ওইসব ছাই-পাশগুলো গিললে কি আর সকালে উঠতে পারে! কুশলের ঘরে গিয়ে একটু অবাক হলেন রিজিয়া৷ দেখলেন বিছানায় বসে খবর কাগজ দেখছে কুশল৷ মুখ দেখে বুঝলেন ব্রাশ-টাশ হয়ে গেছে৷ “উঠে পড়েছিস?” কুশল বলল, “না উঠে উপায় আছে? বাড়িতে যা হুড়ুম-দুরুম হচ্ছে!” “ঠাকুর বাড়ি যাবি না?” কুশল উত্তর দিল না! উটে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মা, দাদার তো বড় ছেলে মারা গেছে না? ছোট ছেলেটার কী যেন নাম?” “পূরব৷ কেন রেয়” “না মনে হল৷ দেখিনি তো কোনওদিন৷ যা ছবি পাঠিয়েছিল তাও বোধহয় বছর পনেরো আগে৷ এখন তো অনেক বড় হয়ে গেছে না?” রিজিয়া চুপ করেই রইলেন৷ দেবুর বড় ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে৷ তাকে ছোটবেলায় একবার দেখেছিলেন রিজিয়া৷ কিন্ত্ত পূরবকে দেখেননি৷ ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হবে এখন৷ কেমন ছেলে কে জানে! কুশল বলল, “মা, বাবা বা তুমি কি কোনও উইল-ফুইল করছ নাকি?” “কেন? হঠাত্‍ এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন তুই?” “না, দাদা হঠাত্‍ এত বছর পরে আসছে! আমাদের সঙ্গে তো যোগাযোগই রাখে না! কে জানে হয়তো টাকা পয়সার দরকার৷ এসে হয়তো এবার সম্পত্তি ভাগ করতে বলবে৷ ইউ নেভার নো৷” “দেবু অমন ছেলে না, তুই ভাল করেই জানিস৷” “সরি মা আমি জানি না,” কুশল উঠে পড়ল বিছানা থেকে, “যখন এ বাড়ি থেকে চলে গেছে তখন আই ওয়াজ সিক্সটিন৷ আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড় দাদা৷ দাদা না বলে কাকু বলা যায়৷ বাড়িতে যখন থাকত একাই থাকত৷ হয় বই পড়ত না হয় ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করত৷ কথা বলত কতটুকু? আমি জানব কেমন করে বলো তো! তবে যাই উইল-টুইল করো, একটা কথা মাথায় রেখো, দাদা কিন্ত্ত তোমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷ আমি কিন্ত্ত যাইনি৷ বুঝলে?” “তুই কী বলতে চাইছিস?” রিজিয়া সোজা তাকালেন কুশলের দিকে৷ কুশল হাসল, “এটা বুঝতে পারছ না? বাদ দাও৷ আমি ঠাকুর বাড়িটা ঘুরে আসি৷” রিজিয়ার মনটাই তেতো হয়ে গেল৷ কোথায় একটা ছেলে এতদিন পরে বাড়ি আসছে, কিন্ত্ত না ভাই, না বাবা, কেউ খুশি নয়৷ সবার এক প্রশ্ন, কেন আসছে দেবু? আরে, কেন আসবে না? রাগ কি সারা জীবন থাকে? মানুষ কি চিরকাল নিজের লোকদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে? শাখা নদী কি এসে মূল শ্রোতে মিশতে চায় না? রিজিয়া ধীরে ধীরে উঠোন পেরিয়ে পিছনের দরজার কাছে গেলেন এবার৷ নিতাই বসে আছে৷ ভাঙ্গারওলাটি জিনিসপত্র গুছিয়ে এনেছে প্রায়৷ এই লোকটাই আসে ভাঙা পুরনো জিনিস কিনতে৷ নাম মুনির৷ একটা চোখ নষ্ট লোকটার৷ খুবই ভদ্র মানুষ৷ আজও মুনির রিজিয়াকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে প্রণাম করল৷ বলল, “মা, সব গুছিয়ে নিয়েছি৷ শুধু এইটা...” কথা শেষ না করেই বস্তার আড়াল থেকে একটা কাপড় ঢাকা জিনিস বের করল মুনির৷ “কী এটা?” রিজিয়া জিজ্ঞেস করলেন৷ “জানি না মা৷ একটা বাক্স৷ দেখুন৷” এবার নিতাই বলল, “স্টোর রুমের জিনিসের মধ্যে ছিল৷ পুরনো টিনের বাক্স৷” কাপড়টা সরিয়ে মুনির এগিয়ে দিল বাক্সটা৷ আর সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে গেলেন রিজিয়া৷ এই বাক্সটা! এখনও আছে! টিনের চৌকো বাক্স৷ ঢাকনার ওপরে জঙে আবছা হয়ে আসা রং৷ রিজিয়া হাত বাড়িয়ে নিলেন বাক্সটা৷ তারপর চেপে ধরলেন বুকে৷ চোখ দু’টো জ্বালা করে উঠল হঠাত্৷ বুকের ভিতরে এতদিন পরে আবার যেন ফুলে উঠল বর্ষার ধলেশ্বরী! গ কাল শেষ রাত থেকে শুরু হয়ে এই বিকেল পর্যন্ত অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে৷ গোটা গ্রামটাই কেমন যেন গোলা পায়রার পালকের মতো হয়ে আছে৷ দাদা আজ মিল-এ যেতে পারেনি৷ বাবাও জমিদার বাড়িতে পুজো করে এসে আর বেরোয়নি ঘর থেকে৷ চারিদিকে জল থৈ থৈ করছে শুধু! ওদের বাড়িটা মাটি আর ইট মিশিয়ে তৈরি৷ মাথায় চালা৷ এমন বৃষ্টির দিনে সারা বাড়িটা সঁ্যাতসঁ্যাত করে৷ একবার কাঠের চৌকো ঘড়িটার দিকে তাকাল রিজিয়া৷ বুকের ভিতরটায় কেমন যেন করছে! দম আটকে আসছে৷ কষ্ট হচ্ছে৷ আর সত্যি বলতে কী ভয়ও করছে খুব৷ ও জানে একটু পরে যা হতে যাচ্ছে তাতে একদম পালটে যাবে ওর জীবন৷ সারাদিন আজ ঠিক মতো খেতেও পারেনি রিজিয়া৷ মা জিজ্ঞেস করেছে অনেকবার কিন্ত্ত কী বলবে মাকে? কী করে বলবে? আয়নায় নিজেকে একবার দেখল ও৷ মনে মনে তৈরি করেছে নিজেকে৷ বাড়ির সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য বুকে পাথর রেখে আজ তৈরি করেছে নিজেকে৷ “রজার ওল্ডম্যান? ওল্ডম্যান? বুড়ো মানুষ?” নামটা শুনে খিকখিক করে হেসেছিল পুঁটি, বলেছিল, “রজার আর রিজিয়া৷ বেশ ভাল মিলেছে কিন্ত্ত৷” রিজিয়া হেসে নামিয়ে নিয়েছিল মুখ৷ ক’দিন দেখেছে ও রজারকে? কিন্ত্ত তাতেই এত মায়া কী করে জন্মাল ছেলেটার ওপর? ষ্কুল থেকে ফেরার পথে এখন রজার দাঁড়িয়ে থাকে৷ চারটের সময় ষ্কুল ছুটি হয়৷ চটকল তো তখনও খোলাই থাকে, কিন্ত্ত কী উপায়ে কে জানে রজার ঠিক চলে আসে৷ পথের পাশে ওর ওই বড় সাইকেলটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ পথ দিয়ে হেঁটে আসা রিজিয়াকে একবার মাত্র দেখে৷ তাকায়৷ তাকিয়েই থাকে৷ তারপর ধীরে ধীরে চলে যায়৷ রিজিয়ার কেমন যেন গা শিরশির করে৷ ও তাকাতে পারে না ভাল করে৷ বুকের ভিতর একটা বেয়াড়া হরিণ লাফায় কেবল৷ পেটটা কেমন খালি খালি লাগে! মনে হয় সারাদিন এমন করে যদি ওর দিকে তাকিয়ে থাকত রজার! এমন চলতে চলতেই রথের দিন ঘটেছিল ঘটনাটা৷ ষ্কুল ছুটি ছিল সেদিন৷ পাশের গ্রামে বড় মেলা হয়৷ দাদা বলেছিল নিয়ে যাবে বিকেলে৷ কিন্ত্ত দাদার এক বন্ধু এসে খবর দিয়েছিল যে ওভার টাইম পড়ে গেছে, দাদা আসতে পারবে না৷ খুব রাগ হয়েছিল রিজিয়ার৷ ও জেদ ধরেছিল একাই যাবে তবে৷ বাবা মা অনেক করে বোঝাবার পর একটু শান্ত হয়েছিল রিজিয়া৷ বলেছিল, “ঠিক আছে, তবে পুঁটি আর আমি যাব৷” বাবা বলেছিল, দু’টো মেয়ে একা যাবি না৷ পুঁটির ভাইও যাবে তোদের সঙ্গে৷ নিধুকে আমি বলছি৷” নিধু কাকা, মানে পুঁটির বাবা, আপত্তি করেনি৷ বাবার কথা খুব মেনে চলে নিধু কাকা৷ সেদিন রথের মেলায় খুব ঘুরেছিল ওরা৷ তবে কিনতে পারেনি বেশি কিছু৷ বাবা তো আর বেশি টাকা দিতে পারেনি! আপশোস হচ্ছিল রিজিয়ার৷ এত সুন্দর নীল কাচের চুড়ি দেখেছিল ওখানে! ঢাকার তৈরি জিনিস৷ কিন্ত্ত দাম যা চাইল কিনতে পারল না! অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিল চুড়িগুলো৷ কিনতে না পারায় মনটা খারাপ লাগছিল৷ ফেরার পথে আকাশ কালো করে এসেছিল একদম৷ ওরা পা চালিয়ে আসছিল সোঙ্গরের দিকে৷ কিন্ত্ত বাড়ি থেকে আধ মাইলখানেক দূরে এত জোরে বৃষ্টি নামল যে আর এগোতে পারেনি! কাছেই রাধাবিনোদের একটা পরিত্যক্ত মন্দির আছে৷ মানে কাঠামোটা আছে, কিন্ত্ত বিগ্রহ নেই৷ সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল ওরা৷ পুঁটি তো ভয়ই পাচ্ছিল৷ কিন্ত্ত কী করবে? এত বৃষ্টি পড়ছিল যে মনে হচ্ছিল সামনে কেউ দেওয়াল তুলে দিয়েছে৷ আর ঠিক সে সময়ই সাইকেলের ঘণ্টির শব্দটা শুনেছিল ওরা৷ প্রবল বৃষ্টির শব্দের ফাঁক দিয়ে নরম শব্দটা ঠিক চিনতে পেরেছিল রিজিয়া৷ সঙ্গে সঙ্গে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর৷ শ্বাস ভারী হয়ে এসেছিল৷ রিজিয়ার মনে হয়েছিল, ও যে আসবে সে তো জানতই! সাইকেলটা দাঁড়া করিয়ে মোটা ওয়াটার প্রুফে ঢাকা মানুষটা এগিয়ে এসেছিল ওদের দিকে৷ তারপর মাথার টুপিটা খুলে হেসেছিল৷ পুঁটি দ্রুত বুঝে নিয়েছিল ব্যাপারটা৷ ও ভাইকে নিয়ে সরে গিয়েছিল দূরের কোনায়৷ রিজিয়া ওদের বারণ করতে পারেনি! মাটির দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছিল রিজিয়া৷ আবছা জলের ছাঁট এসে লাগছিল ওর মুখে৷ আর না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল লম্বা মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছে ওর কাছে৷ ওই সুন্দর গন্ধটা যে ও চোখ বন্ধ করে চিনতে পারে! রজার নরম গলায় বলেছিল, “তোমায় আজ দেখতে না পেয়ে মন খারাপ করছিল৷ মেলায় আচমকা দেখে ফেললাম৷ তাই...” ভাল লাগায় অবশ হয়ে গিয়েছিল রিজিয়া৷ ও কথা বলতে পারছিল না৷ মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না৷ কিন্ত্ত তবু যেন সমস্তটা দিয়েই ও তাকিয়েছিল রজারের দিকে৷ “এটা তোমার জন্য৷” রজার সামনে বাড়িয়ে দিয়েছিল একটা কাগজে মোড়া জিনিস৷ রিজিয়া হাত বাড়ায়নি৷ একইভাবে দাঁড়িয়েছিল৷ রজার অপেক্ষা করেছিল সামান্য৷ তারপর একই রকম নরম গলায় বলেছিল, “আয়াম সরি৷ তুমি বোধহয় আমার আসাটা পছন্দ করছ না! আর ডিস্টার্ব করব না৷” রজার পিছন ঘুরেছিল চলে যাবে বলে৷ আর পারেনি রিজিয়া৷ দ্রুত হাত বাড়িয়ে রজারের হাতের একটা পাতা চেপে ধরেছিল৷ থেমে গিয়েছিল রজার৷ তারপর ঘুরে তাকিয়েছিল৷ রিজিয়ার বড় বড় চোখের পাতায় যেন আটকে গিয়েছিল ওর চোখ৷ রিজিয়াও চোখ সরাতে পারছিল না৷ সেই গন্ধটা ক্রমশ ঘিরে ধরছিল ওকে৷ রজারও এগিয়ে আসছিল আস্তে আস্তে৷ পায়ে জোর পাচ্ছিল না রিজিয়া৷ শরীর ওর কথা শুনছিল না৷ রজার এসে দু’হাতে কোমরে জড়িয়ে ধরেছিল ওর৷ তারপর ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসেছিল ঠোঁট৷ বৃষ্টিটা কি বেড়েছিল আরও? দূরে রাঘব দিঘির পাশের জাম গাছে কি কড়কড় করে আছড়ে পড়েছিল বাজ? ছোট ছোট মাটির ঘরগুলো কি ঝুপ ঝুপ করে ভেঙে পড়ছিল সুদেশ মাঝির খালে? জানে না, রিজিয়া কিচ্ছু জানে না৷ ও শুধু রেনকোটের ভিতর দিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে চেপে ধরেছিল রজারকে৷ আর নিজের সমস্ত ভালবাসা স্হাপন করছিল রজারের দুই ঠোঁটের মধ্যে৷ এক সময় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল রজার৷ এক ঝাঁক পায়রার মতো করে লজ্জা এসে ঢেকে ফেলেছিল রিজিয়াকে৷ রজার হাতের জিনিসটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, “এটা তোমার৷ দেখো৷” ধীরে ধীরে কাগজ খুলেছিল রিজিয়া৷ দেখেছিল এক গোছা নীল কাচের চুরি! তারপর বেশ কয়েকবার লুকিয়ে দেখা করেছে ও রজারের সঙ্গে৷ পুঁটিই ওকে সময় আর সুযোগ করে দিয়েছে৷ কিন্ত্ত রিজিয়া জানে এমন করে তো চলতে পারে না৷ তাই গত দু’দিন আগে ও বলেছিল, “আমি এভাবে আর আসতে পারব না৷ লোকে যে কোনও দিন জেনে যাবে৷ আমায় মেরেই ফেলবে মা৷” রজার তাকিয়েছিল ওর দিকে৷ কী বলবে বুঝতে পারছিল না৷ রিজিয়া বলেছিল, “দু’টো কাজ করা যেতে পারে৷ এক আমায় ভুলে যাও৷ আর দুই আমায় নিয়ে পালিয়ে যাও৷” “পালাব” রজার অবাক হয়েছিল, “ইলোপ? কেন? কেন এমনটা করব আমি? না, পালাব না৷” “তবে ঠিক আছে, ভুলে যাও৷” অভিমানে চোখে জল এসে গিয়েছিল রিজিয়ার, “আমি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করব৷” রজার নিশ্চিত গলায় বলেছিল৷ “মানে?” রিজিয়া অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রজারের দিকে৷ “মানে, আমি তোমায় বিয়ে করার কথা বলব তোমার বাবাকে৷” “পাগল নাকি? বাবা মানবে ভেবেছ? আমরা কুলিন ব্রাহ্মণ৷ বাবা তিনবার জপ না করে জল স্পর্শ করে না৷ আর তুমি তাকে বলবে? মেরেই ফেলে দেবে তোমায়৷” রিজিয়া তাকিয়েছিল ওর দিকে৷ “কেন এমন ভাবছ? তুমি দেখো, আমি যাব তোমার বাড়ি৷ জানি ওঁরা রাগ করবেন প্রথমে৷ কিন্ত্ত আমি ঠিক রাজি করাব৷ লাভ ইজ ডিভাইন৷ তোমার বাবাও তো তোমার মাকে ভালবাসেন৷ উনি ঠিক বুঝবেন! লজিক দিয়ে বোঝাতে পারলে ঠিক বোঝে মানুষ৷” “আর যদি না হয়, তবে? তবে আমায় নিয়ে চলে যাবে তো?” রিজিয়া রজারের হাত দু’টো ধরে তাকিয়েছিল ওর চোখের দিকে৷ রজার বলেছিল, “তুমি তো আমার রিজিয়া৷ অ্যান্ড নো বডি ক্যান চেঞ্জ দ্যাট৷” আজও বৃষ্টির শব্দের ভিতর দিয়ে সাইকেলের ঘণ্টিটা শুনতে পেল রিজিয়া৷ ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষে৷ ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে ও হাত জোড় করে বলল, “বাবাকে রাজি করিয়ে দাও ঠাকুর৷ আর কোনওদিন উত্তর না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসেছিলেন রিজিয়া৷ মুকুল এসে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়েছিলেন রিজিয়াকে৷
কিচ্ছু চাইব না তোমার থেকে৷ তিন সত্যি করে বলছি, কিচ্ছু চাইব না!” ৪ ঠাকুরের থেকে নিজের জন্য আর কিছু চাওয়ার নেই রিজিয়ার৷ ও জানে ঠাকুর হয়তো ব্যক্তিগত শ্বার্থ-পূরণ পছন্দ করেন না! টিনের বাক্সটা নিয়ে রিজিয়া খুদেকে ডাকলেন৷ বললেন ওপরে ওঁর ঘরে রেখে দিতে৷ ঘড়িটা দেখলেন একবার৷ কুশল কি গেল প্রসাদ আনতে? এ সময়টা একটু খবরের কাগজ দেখেন রিজিয়া৷ কিন্ত্ত আজ ভাল লাগছে না৷ মন বড় অশান্ত হয়ে আছে৷ দেবু আসছে এতদিন পরে কিন্ত্ত কারওই যেন তাতে আনন্দ নেই! কেন সবাই এমন করছে! অন্যান্য দিনের চেয়ে মুকুল আজ বেশি অশান্তি লাগিয়েছে৷ নব্বই বছর বয়সেও মানুষ এমন করতে পারে! আজকাল অনেক কিছুই ভুল হয়ে যায় মুকুলের৷ তার মধ্যেও কী করে অত বছর আগের অশান্তিটা মনে রেখেছে! শ্মৃতি নাকি নিখুঁত সত্য নয়৷ বরং সত্য আর আমাদের বিশ্বাসের মিশেল৷ মুকুলের মনের মধ্যে কেমন ছবি তৈরি করে রেখেছে শ্মৃতি? রিজিয়া তো এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন সবটা৷ রবিবার ছিল সেদিন৷ দেবু তার কয়েকদিন আগেই এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে৷ দুপুরে খাওয়ার পরে বসার ঘরেই কথা হচ্ছিল সবার৷ দেবুর বড় ছেলে বিক্রম তখন বছর পাঁচেকের৷ সে খেলা করছিল উঠোনে৷ দেবু রিজিয়াকে বলেছিল, “মা, আমার সঙ্গে এবার একবার চলো৷ কয়েক মাস থাকবে৷ তারপর আমি নিজে এসে দিয়ে যাব তোমায়!” রিজিয়া বলেছিলেন, “নারে দেবু, ওখানে আমার ভাল লাগবে না৷ পারব না ওখানে থাকতে৷” “চলো না মা,” দেবু বাচ্চাদের মতো করে আবদার করেছিল৷ আর ঠিক সেই সময়েই ঘরে ঢুকেছিলেন মুকুল৷ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কোথায় নিয়ে যাবি তোর মাকে?” দেবু বলেছিল, “লন্ডনে৷ আমি আবার দিয়েও যাব৷” “কেন? কী করবে ও ওই দেশে গিয়ে?” ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন মুকুল৷ “না মানে... এমনি...” “ও-ও ওই দেশে যাবে?” মুকুল গলায় বিষ নিয়ে তাকিয়েছিলেন রিজিয়ার দিকে, “কেন যাবে ওই দেশে? তোমার ভাতারকে খুঁজতে৷ এত বয়স হল তাও রস যায়নি?” রিজিয়ার কান নিমেষে লাল হয়ে গিয়েছিল৷ দেবুর বউ নীপা বসে রয়েছে যে সামনে! রিজিয়া বলেছিলেন, “কী বলছ কী তুমি?” “কেন তোমার সেই ভাতার তো ওই দেশেই থাকে৷ এখন কি ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বাপের সঙ্গে আলাপ করাবে?” “বাবা কী বলছ তুমি?” দেবু আর নিতে পারেনি৷ উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ “ঠিক বলছি৷ মাকে নিয়ে যাবে! তেল বের করে দেব তোর৷” “কেন এসব বলছ তুমি৷” দেবু এগিয়ে গিয়েছিল মুকুলের দিকে৷ “তুই মারবি আমায়?” মুকুল আচমকা এগিয়ে এসে থাপ্পড় মেরেছিলেন দেবুকে৷ বলেছিলেন, “বেজন্মা একটা৷ লাথি মেরে বের করে দেব বাড়ি থেকে৷ বের হ, বের হয়ে যা তুই৷ আমার সংসার ভাঙতে এসেছিস?” তিরিশ বছর হয়ে গেছে৷ তবু আজও কথাগুলোর ভিতরের বিষ নষ্ট হয়নি৷ বিয়ের দশ মাসের মাথায় দেবু এসেছিল পৃথিবীতে৷ তার কটা চোখ দেখে তখনই ক্ষেপে গিয়েছিলন মুকুল৷ সেই সন্দেহের লাভা সারা জীবন শিরার মধ্যে বহন করেছেন মুকুল৷ আজও কি কোনও অনিষ্ট হবে? “মা, শিগগিরি আসুন৷ দেবুদাদা এসে গেছে৷” নিতাইয়ের গলার শ্বরে ঘোর কাটল রিজিয়ার৷ সামান্য ঝুঁকে পড়েছে দেবু৷ মাথার চুলও পেকে গেছে বেশিরভাগ৷ কিন্ত্ত গোলাপি গায়ের রং আর চোখের আলোটা এখনও কমেনি একটুও৷ দেবু এসে সোজা জড়িয়ে ধরল রিজিয়াকে৷ কী সুন্দর গায়ের গন্ধ! চোখ বুজে এল রিজিয়ার৷ যেন দেখতে পেলেন হাসপাতালের ছোট্ট বেবি কট থেকে নিয়ে দেবুকে নার্স তুলে দিচ্ছে ওঁর হাতে৷ অদ্ভুত গোলাপ জল আর মাখন মেশানো একটা গন্ধ যেন টের পেলেন এত বছর পরেও৷ রিজিয়া মাথায় হাত রাখলেন দেবুর৷ অভিমানী ছেলের তবে অভিমান ভাঙল! দেবু কাঁপছে! কাঁদছে কি? কেন? সেই ঝগড়ার দিনে মার খেয়ে পড়ে গিয়েছিল দেবু৷ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল রিজিয়ার দিকে৷ বলেছিল, “মা তুমি চলো আমার সঙ্গে৷ এই জঙ্গলে থাকতে হবে না তোমায়৷ চলো৷” রিজিয়া যাননি৷ ছোট্ট কথায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যেতে পারবেন না একেবারেই৷ দেবু শুধু তাকিয়েছিল ওঁর দিকে৷ তারপর বউ আর ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে৷ একবারও ফিরে তাকায়নি! সে আজ কাঁদছে! দেবু সোজা হয়ে দাঁড়াল এবার৷ নাকটা লাল হয়ে আছে৷ রিজিয়া হেসে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন ছেলের৷ বললেন, “এই শিখেছিস ওই দেশে? এতদিন পরে এসে কান্নাকাটি!” দেবু হাসল৷ মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা বহু বছরের পুরনো মূর্তির মতো লাগল সেই হাসি৷ বলল, “পূরবের বিয়ে ঠিক করেছি৷ তাই তোমায় বলতে এলাম মা৷” রিজিয়া বলেন, “তাই? নীপা কই? আর পূরব?” “ওরা আসছে৷ নীপার বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠিয়েছিল৷ ওদের বাড়ি ঘুরে এই এসে পড়ল বলে৷” দেবু নিজেকে শ্বাভাবিক করার চেষ্টা করল৷ “চল, ভিতরে চল৷” রিজিয়া হাসলেন৷ কিন্ত্ত দেবু এগোবার আগেই ‘জেঠু’ বলে টিকু এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর৷ রিজিয়া অবাক হলেন৷ দেবুকে তো কোনওদিন দেখেইনি টিকু৷ তবে? দেবু টিকুকে জড়িয়ে ধরে অসহায়ের মতো তাকাল টিকুর দিকে৷ তারপর বলল, “তুমি টিকু? আমায় চিনলে কী করে?” টিকু দেবুর কোমরের কাছটা জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা বলেছে তো৷ বলেছে, ‘দেখবি কী সুন্দর দেখতে আমার দাদাকে৷ দেখবি কত ভাল আমার দাদা৷ আমার মতো খারাপ লোক নয়৷ জানিস দাদা ছোটবেলায় আমায় অঙ্ক করাত মাঝে মাঝে৷ অত ভাল অঙ্ক আর কেউ করতে পারে না৷’ আমি তো তোমায় চিনি জেঠু৷ বাবার কাছে গল্প শুনে শুনে আমি তো তোমায় খুব ভাল জানি৷ জানি তোমার মতো লেগব্রেক শেন ওয়ার্নও করতে পারে না!” দেবু কথা বলতে পারল না৷ রিজিয়া দেখলেন চোখটা আবার জলজল করে উঠল ওর৷ রিজিয়া বললেন, “আর দাঁড়িয়ে থাকিস না৷ চল এবার৷ বাবার সঙ্গে দেখা করবি৷” দেবুকে দেখে নমিতা বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে৷ রিজিয়া গিয়ে দাঁড়ালেন মুকুলের বিছানার পাশে৷ বললেন, “ দেখো কে এসেছে?” মুকুল কোনওমতে ঘাড় ফেরালেন, তারপর বিকৃত মুখ করে বললেন, “জানোয়ার৷” “কী বলছ কি তুমি?” রিজিয়া বললেন, “এখনও এসব করছ? এখনও?” মুকুল বললেন, “কেন? সত্যি বলা অন্যায়? বিয়ের দশ মাসে দেবু হয়নি? আমি না বললেই সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ওর চোখ অমন কটা কেন? সাহেবের চোখ অমন ছিল বলেই তো, নাকি? কী? কথা বলছ না কেন? আমার বয়স হয়েছে তো কী হয়েছে? আমি ভুলে গেছি নাকি সব? কেমন দেখতে ছিল, বলো কেমন দেখতে ছিল সেই সাহেবকে? কলকাতায় থাকতাম আমি৷ তাই দেখতে পাইনি৷ কিন্ত্ত সরমা বলেছে আমায়৷ তোমার প্রেমিক ছিল ওই সাহেব৷ কেমন দেখতে ছিল তাকে? ওর মতো কটা চোখ ছিল? কী হল বলো, আজ ছেলের সামনে বলো তুমি৷ নাহলে...” অসুস্হ মানুষটা আচমকা কেমন যেন থমকে গেলেন৷ যেন শেষ কথাটা আটকে গেল গলার কাছে৷ ওঁর দৃষ্টি ধরে দরজার দিকে তাকালেন রিজিয়া৷ দেখলেন নীপা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আর তার পিছনে পূরব! মুকুল বড় বড় চোখ করে পুরবকে দেখলেন৷ পূরবও নীপা আর দেবুকে সরিয়ে এসে দাঁড়াল রিজিয়ার পাশে৷ “এ কে? কে এটা?” মুকুল বালি-কাগজের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যি করে সবার সামনে আজ বলো তো রিজিয়া৷ সবাই জানুক, আসল সত্যিটা কী!” রিজিয়া তাকালেন পূরবের দিকে৷ বাদামি চুল, কটা চোখ৷ হালকা গোলাপি গায়ের রং৷ কে বলবে বাঙালির ছেলে! “কী হল, বলো,” মুকুলের মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল, “সবার সামনে আজ শ্বীকার করো তোমার চরিত্র দোষ৷ কীভাবে এমন চেহারা হয় এদের? বলো সেই জানোয়ারটা কেমন দেখতে ছিল৷ বলো৷” রিজিয়া চোয়াল শক্ত করলেন৷ তারপর পূরবকে টেনে কাছে আনলেন নিজের৷ মুকুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, “এই তো, এমনই ছিল দেখতে৷ এমন কটা চোখ, বাদামি চুল, গায়ের রং—সব এক৷ হুবহু এক৷ নাতির মধ্যে দিয়ে তিনিই তো আবার ফিরে এলেন আজ আমার কাছে৷ সারা জীবন আমায় যতই যন্ত্রণা দাও না কেন, মনে রেখো তুমি তাকে আমার মন থেকে সরাতে পারোনি৷ মনে রেখো, তুমি যেমন আমার যন্ত্রণায় থাকো, তেমনই সে থাকে আমার ভালবাসায়৷ সমস্ত কিছুর মধ্যে আজও সে আমার৷ অ্যান্ড নো বডি ক্যান চেঞ্জ দ্যাট৷” ঘ মেঘ ফাটা জ্যোত্স্নায় আজ ভেসে যাচ্ছে চরাচর৷ ধলেশ্বরীর জলে কে যেন ছিটিয়ে দিয়ে গেছে হিরের গুঁড়ো৷ প্রকাণ্ড গাছেরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছে শুধু৷ আজ পাগল হাওয়ার দিন৷ পাগল হওয়ার দিনও হয়তো আজই! রাতের এই পথ ধরে যেতে যেতে এটাই মনে হল রিজিয়ার৷ দূরে ছোট্ট বাগান-ঘেরা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে৷ আরও দূরে দেখা যাচ্ছে গাঢ় সিংহের মতো জমিদার বাড়ি৷ রিজিয়া এগিয়ে চলেছে৷ পিছনের সমস্ত বাধা কাটিয়ে এসেছে ও৷ ঘুমন্ত বাবা, মা আর দাদার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে এদের চেনে না৷ মনে হয়েছে এদের জন্য চোখের জল ফেলার অর্থ নেই কোনও৷ রজারের মুখটা মনে পড়ছে ওর৷ বাবার ছুঁড়ে মারা খড়মে কেটে যাওয়া কপালটা মনে পড়ছে৷ মনে পড়ছে শাবল নিয়ে তেড়ে যাওয়া দাদার মুখটা৷ ওরা তো মেরেই ফেলত রজারকে৷ দাদা তো মাথা লক্ষ্য করে চালিয়েছিল শাবলটা৷ রজার কোনওমতে মাথা সরিয়ে নিয়ে বেঁচেছিল! মা গিয়ে না থামালে যে কী হত! বাবা বলছিল, “এত বড় সাহস? কুলীনের মেয়েকে বিয়ে করবে তুমি৷ জানোয়ার পেয়েছ আমাদের? তোমাদের রাজত্ব বলে যা খুশি তাই করবে!” দাদা গালি দিয়েছিল খুব৷ মুখে আনা যায় না এমন ভাষায় রজারের বাপ মা তুলে কথা বলেছিল৷ সাইকেলটা তুলে আছড়ে, লাথি মেরে ভেঙে দিয়েছিল স্পোক৷ রজারকে কেউ কোনও কথা বলার সুযোগ দেয়নি! আশেপাশে লোক জমে গিয়েছিল৷ কেউ হাসছিল৷ কেউ এই সুযোগে ঢিল ছুঁড়ে মারছিল রজারকে৷ কেউ আবার বলছিল কীভাবে রজার রোজ ষ্কুল থেকে ফেরার পথে বিরক্ত করত রিজিয়াকে! বারান্দায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল রিজিয়া৷ কথা বলতে পারছিল না৷ মনে হচ্ছিল শরীরের সব রক্ত বোধহয় বেরিয়েই যাবে এবার৷ লোক বাড়ছিল ক্রমশ৷ কেউ বলছিল রাম দা দিয়ে কেটে কাছের শিয়াল মাটির চোরাবালিতে পুঁতে দিলেই তো হয়৷ কেউ আবার পুড়িয়ে মারার কথাও বলছিল৷ সবার মাঝে রক্তাক্ত রজার দাঁড়িয়েছিল একা৷ আর বলছিল, “আষ্ক রিজিয়া৷ প্লিজ, ফর ওয়ান্স৷ ও বললেই আমি চলে যাব৷” দাদা আর নিতে পারেনি শেষটায়৷ হাতের শাবলটা বর্ষার মতো করে ছুঁড়ে মেরেছিল রজারের দিকে৷ রজার সরতে কি দেরি করেছিল সামান্য? ঠিক মনে নেই ওর৷ কারণ ততক্ষণে মাটির বারান্দায় মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল রিজিয়া! কথা ছড়িয়েছিল দ্রুত৷ ছিছিক্কারও৷ পুঁটি আসা বন্ধ করে দিয়েছিল ওর কাছে৷ ষ্কুল যাওয়ার কথা মুখেও আনতে পারেনি আর৷ এর দু’দিনের মাথায় একটা পাল্কি এসে থেমেছিল ওদের বাড়ির সামনে৷ বার্নিশ করা, রুপোর ফলক লাগানো পাল্কি৷ ওদের সোঙ্গারের সবাই এই পাল্কি চিনত৷ জমিদার গিন্নি এটাই করেই ঘোরেন যে! “প্রভা, কী শুনছি আমি?” গিন্নিমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন বারান্দায়৷ মা হতবাকের মতো তাকিয়েছিল প্রথমটায়৷ তারপর উপুড় হয়ে গিন্নিমার পা জড়িয়ে কেঁদেছিল খুব৷ গিন্নিমা বলেছিলেন, “এটা হল কী করে? মেয়েকে ধরে রাখতে পারিসনি? অমন রূপ দেখে তো যে কোনও মানুষের মাথা ঘুরবে৷ আর ওই লালমুখোগুলো তো তক্কে তক্কে থাকেই৷ কত করে বলেছিলাম ইষ্কুল থেকে ছাড়িয়ে দে, শুনিসনি কেন?” মা কান্না মিশিয়ে বলেছিল, “বুঝতে পারিনি মা৷ আমার মেয়ে সাত চড়ে রা করে না৷ মাথা নিচু করে যেত আসত৷ আর শয়তানটা... একেবারে বাড়িতে এসে.... ওদের জাতের ঠিক আছে? আচার বিচারের ঠিক আছে? কত বড় সর্বনাশ যে হল আমার!” গিন্নিমা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “সর্বনাশ মানে? আর কী হয়েছে?” “না মা আর তো কিছু হয়নি৷ আমার ছেলে এমন শাবল পেটা করেছে যে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পালিয়েছে শয়তানটা৷ আর ওই রাক্ষসটাকে দেখে ভয়ে আমার মেয়ে তো মুচ্ছো গিয়েছিল একদম৷” “ঠিক আছে, শোন, আর দেরি করা ঠিক হবে না বুঝলি?” গিন্নিমা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিলেন৷ মা বুঝতে পারেনি৷ অবাক হয়ে দেখেছিল গিন্নিমাকে৷ গিন্নিমা বলেছিলেন, “আমার ছেলে মুকুল৷ কলকাতায় ডাক্তারি পড়ছে৷ ওর সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেব সাত দিনের মধ্যে৷ রিজিয়াকে তো আমি মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলাম ওর জন্য৷ বিয়ের পর ব্যান্ডেলে আমাদের নতুন বাড়িতে পাঠিয়ে দেব৷ ওখানেই থাকবে ওরা৷ জানিস তো আমরা ব্রাহ্মণ৷ তোদের আপত্তি নেই তো?” মা কিছু বলতে পারছিল না৷ বোবায় ধরা মানুষের মতো তাকিয়েছিল শুধু৷ বুঝতে পারছিল না এতে খুশি হবে না ভয়ে, কৃতজ্ঞতায় আরও নত হয়ে থাকবে! ঘরের ভিতরে বসে মাথা নিচু করে সব শুনছিল রিজিয়া৷ আর বুঝতে পারছিল একটা একটা করে ওর সব বন্ধন কেটে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে! তাই আজ, এই মধ্য রাতে পিছনে বেড়ার দরজা দিয়ে রিজিয়া বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে৷ পরশু ওর বিয়ে৷ কিন্ত্ত ও তো সেখানে থাকতে পারবে না৷ কোনও জমিদারের ছেলের জন্য তো ঈশ্বর ওকে পাঠাননি! ও তো সম্পূর্ণ রজারের! কাঠের বারান্দায় বেহালা নিয়ে বসেছিল রজার৷ রিজিয়া গিয়ে দাঁড়াল ওর সামনে৷ “তুমি?” রজার সোজা হয়ে বসল৷ রিজিয়া দেখল বাঁ পায়ে ব্যান্ডেজ করা৷ বুঝল দাদার তৈরি করা ক্ষত! ও বলল, “আমি চলে এসেছি তোমার কাছে৷ পালিয়ে যাই চলো৷” রজার তাকাল ওর দিকে৷ জ্যোত্স্না এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিজিয়ার মুখে৷ রজার তাকিয়ে দেখছে ঈশ্বরীর রূপ৷ “কী হল, চলো৷” রজার হাসল, বিষণ্ণ গলায় বলল, “না রিজিয়া৷ আমি চোর নই৷ তোমার ভালবাসা পেয়েছি৷ কিন্ত্ত তার জন্য এটা করতে পারব না৷ আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাদের সমাজ৷ তুমি চলে গেলে তোমার বাবা মায়ের কী হবে ভাবতে পারো?” রিজিয়ার জল আসছিল চোখে৷ এ কী বলছে রজার? এমন করে বলছে? ও বলেছিল, “আমায় ভালবাস না তুমি?” “তোমায় ছাড়া কি আর কাউকে ভালবাসা যায় কোনওদিন? আমি কি কোনওদিন তা পারব ভেবেছ? কিন্ত্ত তাই বলে আমি তো আর অন্যায় করতে পারি না৷ তুমি ফিরে যাও৷ আমিও চলে যাব এখান থেকে৷” “ফিরে যাব?” “রাত গভীর, কেউ জানবে না৷ তোমার মা বাবার কথা ভাব৷ তুমি এমন করলে ওদের গ্রামের লোকেরা ছিঁড়ে খাবে৷” রজার মাথায় হাত দিয়েছিল রিজিয়ার৷ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি ও৷ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রজারের বুকে৷ দু’হাত দিয়ে পিষে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছিল রজারের সঙ্গে৷ মনে হচ্ছিল এই তো শেষ সুযোগ৷ যতটা পারা যায় নিজের শ্বাসের মধ্যে ভরে নিতে হবে এই মানুষটাকে! ও বলেছিল, “ঠিক আছে৷ কিন্ত্ত তার আগে আমায় তুমি নাও৷ তোমার সবটুকু একবারের জন্য হলেও আমায় দিয়ে যাও৷ আমার মধ্যে তোমায় রেখে দেব সারা জীবন৷” রজার তাকিয়েছিল রিজিয়ার দিকে৷ তারপর অশ্ফুটে বলেছিল, “দেব তো৷ তোমাকেই তো সব দিয়ে যাব আমার৷” এই নিঝুম রাত, এই ধলেশ্বরীর ঢেউ আর চরাচর জুড়ে ফুটে থাকা প্রকাণ্ড চাঁদ, শুধু দূরে থেকে দেখেছিল কৃত্রিম বিধি নিষেধের মাথা ছাড়িয়ে একে অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওঁরা৷ কীভাবে পূর্ণতা পাচ্ছে এই প্রেম! ৫ এখন অনেক রাত৷ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ দোতলার জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় আজ ভেসে যাচ্ছে এই ঘর৷ এক কোণে টেবল ল্যাম্পের নরম আলোর বৃত্তে বসে টিনের বাক্সটা কাছে টানলেন রিজিয়া৷ কতদিন কেটে গেছে৷ বাক্সের ওপরে নানা রঙে অাঁকা উজ্জ্বল ছবি ছিল একটা৷ ব্রিটিশ কোম্পানির বাক্স৷ রজার দিয়েছিল! রিজিয়া হাত বোলালেন বাক্সটার ওপর৷ জঙে হারিয়ে গেছে ছবি৷ তবু কি সত্যি হারিয়ে যায়! সেই রাত, সেই ধলেশ্বরীর পাড় আর সোনার গোলকের মতো চাঁদের তলায় দাঁড়িয়ে রিজিয়া সবটা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন রজারকে৷ ওঁর চওড়া বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে অাঁকড়ে ধরেছিলেন শরীরটা৷ মুখ উঁচু করে ঠোঁট খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের ঠোঁটে৷ তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলেন, “ঘরে চলো৷” ঘরে গিয়েছিলেন রজার৷ রিজিয়া নিজেই উদ্যোগী হয়ে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন নিজেকে৷ কিন্ত্ত রজার বাধা দিয়েছিলেন এবার৷ বলেছিলেন, “আমি পেয়ে গেছি তোমায় রিজিয়া৷ সবটাই তো আমায় দিয়ে দিলে তুমি৷ এটা না হলেও আর ক্ষতি নেই৷” বিহ্বল হয়ে রজারকে দেখেছিলেন রিজিয়া৷ বলেছিলেন, “আমায় তুমি চাও না!” “একমাত্র তোমাকেই তো চেয়েছি৷ তাই তো সব ভুলে তোমার বাবার কাছে গিয়েছিলাম৷ কোনও কিছুকেই ভয় পাইনি৷ পাত্তা দিইনি৷ তারপর আজ এই তুমি এলে৷ আমি পূর্ণ হলাম৷ কে আর এত পায়, বলো?” রিজিয়ার চোখে জল এসে গিয়েছিল৷ বলেছিলেন, “তুমি যে বললে দেবে, সেটা মিথ্যে?” “না তো,” বলে রজার এগিয়ে গিয়েছিলেন ঘরের এক কোণে৷ একটা বাক্স নিয়ে এসে বলেছিলেন, “এটা দেব তো তোমায়৷ জানি তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷ জানি তোমার নতুন জীবন শুরু হবে৷ তার মধ্যে কোথাও যদি আমার এটাকে একটু রাখো... না কেঁদে, হাসি মুখে যদি একটু রাখো...” “কী আছে এতে?” রিজিয়া বাক্সটা নিয়ে তাকিয়েছিল রজারের দিকে৷ “আমি আছি রিজিয়া৷ আমার ছোটবেলার রং-পেন্সিল৷ কাচের গুলি৷ মায়ের দেওয়া সোনার আংটি, তোমার ছবি আর একটা টিনের পুতুল৷” “টিনের পুতুল!” আজ বহু বছর পরে আবার বাক্সটা খুললেন রিজিয়া৷ বাক্সের ভিতর থেকে হলদেটে হয়ে যাওয়া নিজের ছবিটা এবার তুলে নিলেন হাতে৷ রজারের তোলা সেই ছবি... সামান্য বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন রিজিয়া! দিন কত পালটে যায়! মানুষ হারিয়ে যায় সময়ের ভাঁজে৷ আজও মনে আছে সেই রাতে বাড়ি ফিরে রিজিয়া দেখেছিলেন মা বসে আছেন ঘরে৷ দেখেছিলেন পাশে রাখা কাটারি৷ ওকে দেখেই মা কাটারি তুলে বলেছিল, “আজ তোর শেষ দিন৷ সাহেবের থেকে নোংরা হয়ে এসেছিস!” রিজিয়া কিছুই বলেননি৷ শুধু বাক্সটা বুকে চেপে তাকিয়েছিলেন মায়ের দিকে৷ তেড়ে আসা মাকে বাবা আটকেছিল৷ তারপর রিজিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমায় সত্যি করে বল, আমার শালগ্রাম ছুঁয়ে বল মা, তুই কি এখনও নতুন আছিস? সাহেব তোকে...” রিজিয়া বাবার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলেছিলেন, “সে আমায় কিছুই করেনি বাবা৷ সে কিছু করার মতো মানুষ নয় যে!” ফুলশয্যার রাতে মুকুলকে প্রথম ভাল করে দেখেছিলেন রিজিয়া৷ কেমন অদ্ভুত মানুষ৷ রাগের গলায় মুকুল বলেছিলেন, “সরমা বলছিল তোমায় নাকি কোন একটা সাহেব বিয়ে করতে চেয়েছিল? সে আর কিছু করেছে নাকি?” উত্তর না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসেছিলেন রিজিয়া৷ মুকুল এসে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়েছিলেন রিজিয়াকে৷ গায়ের কাপড় টেনে ছাড়াতে ছাড়াতে বলেছিলেন, “ও, উত্তর দিবি না? দিবি না উত্তর! ঠিক আছে, আমি নিজেই দেখছি তবে৷ দেখছি তুই এঁটো কি না!” মুকুলের শক্ত শরীরের তলায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন রিজিয়া৷ মুকুল পাগলের মতো অাঁচড়াচ্ছিল ওঁকে৷ আর জিজ্ঞেস করছিল, “বল কেমন দেখতে ছিল সেই সাহেব? বল হারামজাদি, বল!” মুকুলের মুখ থেকে আসা সিগারেটের গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠছিল রিজিয়ার৷ যন্ত্রণা হচ্ছিল৷ আর ঠিক তখনই রিজিয়া দেখেছিলেন তাঁকে৷ দেখেছিলেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন রজার৷ হাসছেন৷ রিজিয়ার শরীর নরম হয়ে এসেছিল৷ দু’হাত বাড়িয়ে রজারকে ধরেছিলেন তিনি৷ মুকুলকে মুছে ফেলে রজারের সঙ্গেই সেই রাতে এক হয়ে গিয়েছিলেন রিজিয়া! সাদা কালো ছবিটা রেখে বাক্সটা আবার দেখলেন রিজিয়া৷ জং-ধরা টিনের পুতুলটা শুয়ে আছে এক পাশে৷ ছোট্ট ছেলে পুতুল৷ রজার বলেছিলেন, “আমার মা পুতুল বানাত৷ আমার মতো দেখতে এই পুতুলটা বানিয়ে দিয়েছিল মা৷ মারা যাওয়ার আগে বলেছিল চিরদিন এটা সঙ্গে রাখতে৷ এটা তুমি রাখো রিজিয়া৷ আমায় তুমি রাখো তোমার সঙ্গে৷” সারা জীবন মুকুল অত্যাচার করে গেছেন ওঁর ওপর৷ শুধু জানতে চেয়েছেন কেমন দেখতে ছিল সেই সাহেব, কেন দেবুর চোখের রং কটা! কেন পূরবকে অমন দেখতে? কার থেকে পেয়েছে ওরা এমন চেহারা? আজ সব অত্যাচার ফিরিয়ে দিয়েছেন রিজিয়া৷ পূরবকে দেখিয়ে বলেছেন ঠিক এরকম দেখতে ছিল রজার৷ বলেছেন পূরবের মধ্যেই আবার ফিরে এসেছেন সেই সাহেব! মুকুল চুপ করে গেছেন একদম৷ কেমন যেন গুটিয়ে গেছেন তারপর থেকে৷ খারাপ কথা, গালিগালাজ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে৷ জীবনের শেষে এসে এভাবে নিজের আশঙ্কা সত্যি হয়ে উঠবে ভাবেননি৷ ভাবেননি এভাবেও পরাজয় ঘটতে পারে! টিনের পুতুলটা হাতে তুললেন রিজিয়া৷ জঙের ভিতর দিয়ে আবছা কালো চুল আর চোখের মণির কালো রং দেখা যাচ্ছে৷ রজারের চুল আর চোখের মণি এমনই কুচকুচে কালো ছিল৷ না, দেবুর সঙ্গে বা পূরবের সঙ্গে তাঁর মিল নেই৷ রিজিয়া জানেন থাকতেও পারে না মিল৷ রজারের মতো কেউ হতেই পারে না! পুতুলটা বুকের কাছে চেপে ধরলেন রিজিয়া৷ তারপর আলতো হাতে নিভিয়ে দিলেন টেবল ল্যাম্প৷ জ্যোত্স্নার রাত্রি সময় বেয়ে ফিরে চলল উজানে৷ যেখানে ধলেশ্বরীর জলে আজও ভেসে বেড়াচ্ছে হিরের গুঁড়ো৷ আর দশকের পর দশক পার করে সবার মাথার ওপর থেকে প্রকাণ্ড এক চাঁদ শুধু তাকিয়ে দেখছে সেই নবীন কিশোরীটিকে৷ দেখছে তার হাতে ধরা টিনের পুতুল!

Post a Comment

0 Comments