Ticker

6/recent/ticker-posts

শাহজাদা দারাশুকো - শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (অখন্ড)

Shahjada Darashuko - Shyamal Gangopadhyay in pdf
শাহজাদা দারাশুকো - শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (অখন্ড)
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শাহজাদা দারাশুকো' যেন উপন্যাস নয়, এ যেন এক স্বপ্নময় জীবনের বয়ান। কদাচিৎ একে ব্যক্তিপূজনের এক আয়োজনও বলা যায়। তবে কথা হচ্ছে, তাঁর এই উপন্যাসকে আমরা নানা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পারি_সেই রকম ব্যবস্থা ঔপন্যাসিক রেখেছেন। মোগল ইতিহাস যেমন এখানে বর্ণিত হয়েছে, একটা সময়কে যেমন আমরা পাই, তেমনি বিচিত্র শিল্পসম্ভারেও আমাদের প্রাণের অনেকগুলো দরজা-জানালা খুলে দেয় এটা। সেই দরজা-জানালা আবার আমাদের পরিচিত অতি সাধারণ দরজা-জানালা নয়। কারণ এর মেলা আয়োজন আছে, নানা প্রিজমের খেলা আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ঐতিহাসিক উপন্যাসে শুধু ইতিহাসই যে একমাত্র অনুষঙ্গ নয়, তাতে শিল্পীর মোহনীয়তাও একটা আরাধ্য বিষয় হতে পারে, তা-ই আমরা ক্ষণে ক্ষণে প্রত্যক্ষ করি।
কী আছে এই 'শাহজাদা দারাশুকো' নামের বিস্তৃত আয়োজনে? তাতে দারাশুকো নামের যে শাহজাদা আছেন, একজন অতি সাধারণ মানুষ আছেন, একজন ভাবুক আছেন, একটা ইতিহাস আছে, মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসের আবার লয়-ক্ষয় আছে, আমরা সেই ইতিহাস পাঠে স্তম্ভিত, রক্তাক্ত, বিমোহিত হই; আলোকিতও হই। এতে ইতিহাসের পাঠ আছে, মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারের কাহিনী আছে, আছে মোগলদের সোনালি দলের কথা_মোগলদের এই অংশটিই হিন্দুস্তান দখল করেছিল। আছে 'জিন্দানামা' ও 'দস্তুর-ই-তৈমুর'-এর পাঠমুখরতার কথা।
উপন্যাসটি মুখ্যত শুরু হয়েছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল থেকে। তবে তা শুধু সেই কালেই বিরাজ করেনি। মোগল সাম্রাজ্যের একেবারে অন্দর মহলের খবর অংশত তাতে যেমন আছে, এই সাম্রাজ্যের আদ্যন্ত কথনও আছে। সিংহাসন কিভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই সিংহাসনের বহির্দেশে মনোজগতের নানা লীলা যে চলে, তা-ই আমরা দেখি। সম্রাট জাহাঙ্গীর বরাবরই এক ভাবের মানুষ, ভালোবাসার কাঙাল_সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভালোবাসা দ্বারা তিনি তাঁর জীবনকে রাঙিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু সিংহাসন তো ভালোবাসা কর্তৃকই নির্মিত নয়। তাতে নিষ্ঠুরতা থাকে, থাকে ছলনা, রসনা, তিক্ততা। এমনকি সবচেয়ে বেশি থাকে ডিপ্লোম্যাসি। প্রেমাসক্ত-রসাসক্ত জাঁহাপনার সেসব দিক পূরণ করতেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। খসরু, খুররম, পারভেজ, শাহরিয়ার_সম্রাটের এই চার ছেলেকে নানাভাবে স্নেহ-ভালোবাসায়, শাসনে-পেষণে রাখতে হয়েছে। এই উপন্যাসের অনেকটুকু জায়গা দখল করেছেন একসময়কার শাহজাদা খুররম ওরফে সম্রাট শাহজাহান। একসময় তাঁর লোভ হয় সিংহাসনে আরোহণের প্রতি। তা দখলের বাসনা জাগে তাঁর। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর নন, সেই বাসনা বা লালসাকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। দীর্ঘদিন খুররম-আরজুমান্দ বা পরবর্তীকালের সম্রাট শাহজাহান-মমতাজমহল চার পুত্র দারাশুকো, সুজাঙ্গীর, আওরঙ্গজেব ও শিশুপুত্র মুরাদকে নিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবদ্দশায় আর তাঁরা তাঁদের প্রিয় স্থান রাজধানী আগ্রায় প্রবেশ করতে পারেননি। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুরও বেশ কিছুদিন পর। 'শাহজাদা দারাশুকো' নামের উপন্যাসটি শেষ হয় শাহজাহান কর্তৃক ক্ষমতা দখল করে বিচিত্র আয়োজনের মধ্য দিয়ে দারাশুকোর বিয়ের মাধ্যমে। এবং তারও পরে জাহানারা থ্রোতে মোগল সাম্রাজ্যের অন্দর মহলের এক হাহাকার মিশ্রিত রোদনময়তার ইঙ্গিত রেখে এর পাঠ সমাপন ঘটে। উপন্যাসটির আরো কিছু মজাদার দরকারি চরিত্র হলেন মিনাক্ষী, শফি, রানাদিল ও আসফ খাঁ। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির দরগাহকে এত চমৎকারভাবে এতে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এটাও আলাদা এক চরিত্রই। ইউরোপীয় বাণিজ্য বিস্তারের, বিশেষ করে বস্ত্রশিল্পের প্রতি তাদের লোভ বা নিয়ন্ত্রণ এতে প্রকাশ পেয়েছে।
রাজা-বাদশাহর উপন্যাস যখন লেখা হয়, তখন আমরা ধরেই নিই, তাদের দ্বারাই উপন্যাস বধিত, স্পর্ধিত ও কলুষিত হবে। কিন্তু অতি বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করতে থাকব, এখানে শেষতক এগুলো আর মোগলময় থাকে না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাতে তাঁর সৃজনশীলতা মারফত ভালোই ভাগ বসিয়েছেন। বলা যায়, একেবারে ইতিহাসের গা ঘেঁষে বিকল্প ইতিহাস তিনি সৃজন করতে পেরেছেন। সেই ইতিহাসের মূল বিষয় হচ্ছে সাংস্কৃতিক নান্দনিকতায় মোগল সাম্রাজ্য। আমরা হয়তো এটাকে এভাবে ধরে নিলেই এর মৌল রস অনুভব করতে পারব। আমরা একে ইতিহাসের ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা অনুভবের বিস্তৃত আয়োজন বলতে চাই। উপন্যাসটির শুরু আগ্রার ফজরের আজান দিয়ে। এর শুরুটির পাঠস্বাদুতা আছে, যেন সুবহে সাদিকের এক স্নিগ্ধ, নরম আবহ আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়_'আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাওম_শব্দ, সুর একই সঙ্গে ভোররাতের বাতাস কেটে কেটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এখন রাতের শেষদিকে আর সেই শীত নেই। ফাল্গুন মাস শুরু হয় হয়। আজানের সুরের ভেতর শেরগির হাতিদের কেউ কেউ দিন শুরুর আগেই প্রথম গরম নাদ ফেলতে শুরু করেছে। তারই মৃদু চেনা শব্দ কানে আসছিল কাছেরই পিলখানা থেকে।' আগ্রার সকাল-বিকাল-রাত এক নয়। এমনকি হিন্দুস্তানের সময়ও নাকি নানা স্থানে নানা ইমেজ নেয়। আমরা এতে এমনই নানা বর্ণনার সমাহার দেখি। শুধু মানুষজন নয়, পরিবেশ, নিসর্গ, হাতি-ঘোড়া, বাঁদি, নফর, সৈন্য-সামন্তের সাজসাজরব এর অনেক অংশই দখল করেছে। রাজপুত, পাঠান, সৈয়দ, ইরানি, তুর্কি, তাতার যেমন আছেন, স্বভাবতই আছেন মোগলও। তবে আলোচনার এ পর্যায়ে বলে রাখতে হয়, বর্ণনার এলায়িত ভাবও এতে আছে।
এই উপন্যাসের মূল অনুষঙ্গ দারাশুকো হলেও সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তাঁর বেগম এর অনেক অংশে আধিপত্য বজায় রেখেছেন। সেই হিসাবে 'শাহজাদা দারাশুকো'র প্রথম খণ্ডকে সম্রাট জাহাঙ্গীরজনিত উপাদানে ঠাসা এক আয়োজনও বলতে পারি। যাহোক, ইতিহাসনির্ভর এমন মহাকাব্যিক আয়োজনের দরুন তা হয়তো পুষিয়েও যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর যে খেয়ালি মানুষ, ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক, তা ইতিমধ্যে বলাও হয়েছে। তিনি সম্রাট আকবরের মতো মানুষের সামগ্রিক ইতিবাচকতাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেননি। আকবরের শাসন-প্রক্রিয়ায় সব ধর্মের সমন্বিত একটা নবধারার যে সম্ভাবনা তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তা কিন্তু সেভাবে চালুও থাকেনি। বরং হাস্য-কোলাহলে, নৃত্যে-গানে তিনি জীবন ভাসাতে চাইলেন। ভালোবাসার ফল্গুধারায় জীবনের সব প্রান্ত উজাড় করে দিতেও কসুর করেননি তিনি। অথচ সম্রাট আকবর তাঁর সৃজনকৃত দ্বীন-ই-এলাহির মাধ্যমে সবার মাঝে মানবিক এক আর্তি রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সুলহে কুল বা সর্ব-অঙ্গের ভাবব্যাকুল সমন্বয়ের মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বহু জাতি-বহু ধর্মের এই ভারতবর্ষকে এক রাখতে হলে এমন এক রীতি চালু করতে হবে, যাতে সব ধর্মের, সব মতের মানুষ শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে। ষোড়শ শতকে কিংবা বলা যায়, তাঁর সময়ে ধর্মভিত্তিক নানা রকম ভাব আন্দোলনও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শিখদের প্রধান গুরু পৌত্তলিকতাবিবর্জিত একেশ্বরবাদী নানক, নিরক্ষর সাধক কবীর শুধু নন, চৈতন্য মহাপ্রভুর বৈষ্ণবীয় এক প্রবল ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ধারাকে আমরা কার্যকর স্রোত হিসেবে বিকশিত হতে দেখি। বরং বলা যায়, এ সময় ছিল মানব ধর্মের মানবিক উত্থানের কাল। কিংবা বলা যায়, ধর্মকে আশ্রয় করে ধর্মের প্রাবল্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে আসার একটা চমৎকার সময়।
শাহজাহান গড়ছেন হামাম শাহি, মোতি মসজিদ, দিলি্লর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো আছে নয়া রাজধানী শাহজাহানবাদ। আমরা উপন্যাসটির এ পর্যায়ে শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন, এমনকি তাজমহলের দেখাও পাইনি। মসনদকে তিনি রাঙিয়েছেন নানা রঙে। কারণ, আমরা জানতে থাকি, মসনদ আসলে কোনো ব্যক্তির নয়, এই মসনদ তাগদের, নসিবের। সবচেয়ে বড় কথা, তা মগজের। এমনই একটি ইঙ্গিত আমরা দারাশুকোর ভাবনায় পাই। আমরা যে দারাশুকোকে দেখি, বিয়ের পরও তাঁর চলাচলের নানা মাত্রিকতা প্রত্যক্ষ করতে থাকি। তাতে আমরা এমন সিদ্ধান্তও নিতে পারি যে তিনি আসলে সম্রাট আকবরের ছায়া-প্রতিচ্ছায়া হয়ে নিজেকে আরেক আকাশ করে তুলছেন ক্রমেই। তাঁর স্ত্রী, একসময়কার শাহজাদা পারভেজের কন্যা নাদিরা স্পষ্টতই প্রত্যক্ষ করেন, তাঁর স্বামী দিলখোলা গা-ভাসানো সরল এক মানুষ; প্রাসাদের তীক্ষ্ন হিসাবের বাইরের এক পার্সোনালিটি তিনি বহন করছেন। দারাশুকোকে বুঝতে চাইলে এই দুজনের মাঝে সংঘটিত কিছু সংলাপ আমরা পুনরায় পাঠ করতে পারি_
আপনার দরবেশ-সন্ন্যাসীরা না বলে-কয়ে ঢুকে পড়েন। শায়ের-গাইয়ে-আঁকিয়েরা দিব্যি চলে যান আপনার কাছে। কিন্তু সেদিন উজিরে আজম সাদুল্লা খাঁকে অমন বসিয়ে রাখলেন কেন?
_উজিরে আজম বলেই!
_তার মানে?
_সাধু-সন্ন্যাসীরা সহজ করেই আল্লাহ তায়ালার কাছে এগিয়ে চলেছেন। ওরা সিধে বলেই সিধে আমার কাছে চলে আসেন। উজিরে আজম কি তাই? শাহি জটের কাছে উনিও যে জট পাকিয়ে আছেন, নাদিরা।
_জুমা নামাজ আপনি খেলাপ করেন না। ওই দিন দুই হাতে দান-খয়রাত করেন।
_সুফিরা বলেন, দান-খয়রাতই হলো খোদা তায়ালার আসল ইবাদত। ওই পথেই আমার প্রার্থনা, আমার উপাসনা। এখানে স্পষ্টতই সম্রাট আকবর থেকে তিনি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। ক্রমেই এমনই এক বিমূর্ত নান্দনিকতায় নিজ সত্তাযোগে যেন বিলিয়ে দিচ্ছেন। কায়া নয় ছায়া, মূর্ত নয় বিমূর্ত, বাস্তব নয় বাস্তবের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা খোয়াব দিয়ে তিনি তাঁর মনোজগৎ বিনির্মাণ করতে চান। এখানে আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিত্ব আমরা দেখতে পারি_তিনি ভাবুকতার ভেতর নেই, নেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরের কোনো ধারণায়ও। তিনি তাঁর কৈশোর বয়সেই রাজনীতির একটা মজবুত-শৃঙ্খলিত ধারাকে লালন করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর শাসনকালের বড় একটা বিষয় ছিল ইসলাম ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ঊধর্ে্ব তুলে ধরা। ফিকাহশাস্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী আইন-কানুন তিনি চর্চা করেন। এমনকি 'ফতোয়ায়ে আলমগীরি' রচনা করতে এই ধারাকে তিনি একটা উচ্চতর পর্যায়ে নিতে চান। জিজিয়া কর আরোপসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে নানা রকম সংকটে ফেলেন। এমনকি বেশ্যাদের বলপূর্বক বিয়ে দেওয়ার কথাও বলছিলেন। তাঁর সময়ই মারাঠারা হয় নির্যাতিত, শিবাজির নেতৃত্বে তারা দ্রোহ করে; তাদের নিপুণ যুদ্ধকৌশলে আওরঙ্গজেবের রাজ্য শাসনকে নাকানি-চুবানি খাওয়ায়।
বিশাল এই উপন্যাসে আমরা মোগল সাম্রাজ্যের অন্দর মহলের যন্ত্রণার কথা তেমন পাই না। বরং তাঁর উপন্যাসে এরা বরাবরই নিয়ন্ত্রণকারী_তা নূরজাহানে তো আছেই, তা থাকারই কথা; মমতাজমহলে কিছুটা আছে, নাদিরার অন্তর্জগতে কিছুটা হলেও আমরা এগুলো প্রত্যক্ষ করতে থাকি। তবে উপন্যাসটির একেবারে শেষদিকে শাহজাহান-দুহিতা জাহানারার রোদনময় মনোজগতের সন্ধান আমরা পাই, যেখানে নারীর একাকিত্বের আহাজারি নিদারুণভাবে প্রত্যক্ষ করি।
উপন্যাসটির ভাষায় মাদকতা আছে। এটা রবীন্দ্রোত্তর চলমান মানভাষায় লেখা হয়েছে। তবে শ্যামল তাঁর স্বভাবজাত কাব্যিকতা গদ্যে প্রয়োগ করেছেন। হয়তো বাদশাহিকালকে বোঝানোর জন্য, তখনকার কালচারকে একেবারে চাক্ষুষ করানোর নিমিত্তে তিনি আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগে আস্থা রেখেছেন। তবে তা কখনো কখনো তাঁর গদ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেমন হয়েছে, তেমনি এর ভুল প্রয়োগও করেছেন (ইনশাআল্লাহ্র ইচ্ছায়, ভোরের নামাজ, কচি উমর, দাখিলার ব্যবহার; জানাজার সময়কে মুমূর্ষুকালের সঙ্গে একাকার করে ফেলেছেন); দিদি, দাদা, মেসো, তসলিম, তসবির ইত্যাদির প্রয়োগ খাপছাড়া লেগেছে। আবার কিছু শব্দের চমৎকার ব্যবহারও আমরা দেখি। যেমন_জিন্দাফুল, রঙিন উমর, শাহী সন্ধ্যা, হামাম, দুনিয়াদারি করা মানুষ ইত্যাদি। এর ভেতর ভাষার আলাদা এক প্রাণময়তা যে আছে, তা স্বীকার করতেই হয়।
আবার কখনো কখনো সংস্কারকে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণও করা হয়েছে। যেমন_শাহজাদা খুররম স্বপ্ন দেখলেন, বর্ষার রাতে একটি কালো সাপ মোতিবাগের সেঁউতিকুঞ্জ দিয়ে বেয়ে বেয়ে যমুনার দিকে চলে যাচ্ছে। অথচ তার মাথায় আছে আরেকটি সাদা সাপের কুণ্ডলী। তাতেই নাকি ধারণা করা যায়, তিনি একসময় সম্রাট হবেন। তিনি কেঁপে ওঠেন! উপন্যাসটিতে প্রচুর কাঁপাকাঁপির ব্যাপার আছে (কমপক্ষে ২০ জায়গায় আবেগে কাঁপাকাঁপির প্রয়োগ আর কি)।
ইতিহাস তো নায়কবিহীন হয় না। আর যেকালের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা তো নায়কেরই কাল। ইতিহাস নায়ক দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। এখানে মোগল সাম্রাজ্যই নায়ক হতে পারত। আবার এই নায়কত্ব নির্মাণে হিন্দু-মুসলিম আছে, আছে মারাঠা-রাজপুত। ইউরোপীয়ও আছে। হিন্দু সম্প্রদায় আকবর-দারাশিকো, শিবাজি, চৈতন্য মহাপ্রভুকে নায়ক করতে চান, মুসলমানরা আওরঙ্গজেবকে খাঁটি নায়কের চিরকালীন মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে জিহাদি হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ আবার গুরু নানককে স্মরণ করেন হিন্দু পৌত্তলিকতাকে ঘায়েল করার কৌশল হিসেবে। কিন্তু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় দারাশুকোকে অবলম্বন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ভাব আন্দোলনমুখী মানবতাকেই নায়ক করেছেন। এখানেই উপন্যাসটির বিশেষত্ব।
শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা বিকল্প জীবনায়োজনের একটা দরকারি দিক এতে ফুটে উঠেছে বলেও নির্ধারণ করা যায়। মূলত ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তিনি তাঁর মতো করে একটা স্বপ্নময় রাজ্য নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন_এটুকু বলা যেতেই পারে। এই সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে পাঠকের মনোজগতে ইতিবাচক কার্যকর প্রভাব পড়বে বলেও ধারণা রাখা যায়।





Shahjada Darashuko - Shyamal Gangopadhyay in pdf