Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

নির্বাচিত রবিবারের গল্প ২ - সম্পাদনায় আবুল বাশার

নির্বাচিত রবিবারের গল্প ২ - সম্পাদনায় আবুল বাশার
নির্বাচিত রবিবারের গল্প ২ - সম্পাদনায় আবুল বাশার
নির্বাচিত রবিবারের গল্প ২ - সম্পাদনায় আবুল বাশার বইটির ভূমিকা

অল্প গল্প কথা

সুচিত্রা ভট্টাচার্য

গল্পপাঠের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়, গল্পের পূর্বাভাস বা গল্পের আলোচনা তো নয়ই, কারণ সেরকম করলে একদিকে যেমন গল্পকারের প্রতি অবিচার করা হয়, অন্যদিকে গল্পপাঠকের প্রতিও। গল্পকার গল্পে যেটুকু বলার বলেই দেন, আগে-পরে কিছু সংযোজন করে তার গল্প বুঝতে হবে, এরকম উদ্দেশ্য কোনো গল্পকারের থাকে বলে আমি অন্তত জানি না। আর গল্প পাঠকের কথা যদি ধরি, আজ ছোটগল্পের উদ্ভবের অন্তত সওয়াশো বছর পরেও যদি তাকে বুঝিয়ে দিতে হয় কোন গল্প কেমন, তাহলে বলতে হবে ছোটগল্পের পরিণত পাঠক আমরা কোনো দিনই পাব না।

আসলে, এই প্রকাশন সংস্থা নির্বাচিত রবিবারের গল্প নিয়ে একটি সংকলন পাঁচ বছর আগেই করেছিলেন। উদ্দেশ্য অত্যন্ত সাধু, ছোটগল্পের প্রচার এবং প্রসারের জন্য বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবারের সাহিত্য-ক্রোড়পত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রতি সপ্তাহে এতগুলি সংবাদপত্রের সারস্বত ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত রাখতে গেলে প্রচুর গল্পের প্রয়োজন, সুতরাং গল্পকারেরও। উপরন্তু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় যেসব গল্প প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক সমস্যা এবং তথ্যাদি থাকার ব্যাপারটাও থেকে যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, বাংলা ছোটগল্প কীভাবে বিবর্তিত হয়ে চলেছে, গল্পের এখন গতি কোনদিকে, ইত্যাকার ধারণাও পাঠকদের মনে তৈরি হয়ে যায় এইসব গল্প একসঙ্গে পড়তে পারলে। এই কারণেই পূর্বের সেই গ্রন্থটি এতটা জননন্দিত হতে পেরেছিল। যেহেতু একটি গ্রন্থে এত বড়ো একটা উদ্যোগ সম্পূর্ণ করা যায় না, এতদিন পরে সেই একই সম্পাদকের বলিষ্ঠ সম্পাদনায় এই গ্রন্থের পরিপূরক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হতে চলেছে, এটি খুবই আনন্দের কথা।

উল্লেখযোগ্য আরো একটি প্রসঙ্গ এখানে বলা যেতে পারে, সেটি হল, পূর্বের গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পরও বেশ কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের উদ্ভব ঘটেছে, তারাও যথারীতি রবিবারে সাহিত্যের পাতা সাজিয়ে চলেছেন। সেইসব পত্র-পত্রিকার কয়েকটি সকালবেলা, নিউজ বাংলা, খবর ৩৬৫ দিন, প্রাত্যহিক খবর, ভোরের বার্তা প্রভৃতি থেকেও রবিবারের গল্প সংগৃহীত হয়েছে, অবশ্য সেই সঙ্গে আনন্দবাজার, বর্তমান, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন প্রভৃতি সংবাপত্র তো আছেই। সব মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছি মোট এগারোটি সংবাদপত্র থেকে গল্পগুলি নির্বাচিত ও সংকলিত হয়েছে।

এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের কিছু ধ্রুপদী গল্পকার যথা, পরশুরাম, বনফুল, মনোজ বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, লীলা মজুমদার, নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখের গল্প আগের গ্রন্থে আছে, সুতরাং তাঁদের মৃত্যুর কারণেই গল্প পাওয়া যায়নি, সম্ভবত তার জন্য বর্তমান সংকলনে গ্রহণ করা হয়নি। প্রকৃত পক্ষে প্রয়াত সাহিত্যিকদের বাদ দিয়ে জীবিত সাহিত্যিকদের গ্রহণ করাই বোধহয় বর্তমান সংকলনের উদ্দেশ্য ছিল। ব্যতিক্রম তারাপদ রায়, হিমানীশ গোস্বামী এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তারাপদ রায় এই প্রকাশনীর অত্যন্ত প্রিয় লেখক, সেটা তার অন্তর্ভুক্তির কারণ হতে পারে। হিমানীশ গোস্বামী আসতে পারেন সদ্যপ্রয়াত সাহিত্যিক হিসাবে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটেছে অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে, এই গ্রন্থ সম্ভবত তার আগেই প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় এইজন্যই তরুণতর কিছু সাহিত্যিকের গল্প এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা গিয়েছে, সেটা এক পক্ষে ভালোই হয়েছে, পাঠক-পাঠিকা এখন কী রকম গল্প লেখা হচ্ছে তার একটা ধারণা পেয়ে যাবেন।

বললাম বটে এগারোটি সংবাদপত্র থেকে গল্প সংগ্রহ করা হয়েছে, কিন্তু এর সিংহভাগ আগের মতো এবারও দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার, মোট গল্পের সংখ্যা আঠাশ। প্রয়াত সাহিত্যিকদের মধ্যে দুজনের গল্প এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল, তারাপদ রায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তারাপদ রায়ের গল্পটি একটি বিদেশিনী চরিত্রকে কেন্দ্র করে এবং অবশ্যই রসরচনা, তার যে ধরনের গল্পের সঙ্গে পাঠকের সম্যক পরিচয় আছে, সেরকমই একটি গল্প। সদ্যপ্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মাথা উঁচু করে যাওয়া’ গল্পটি যখন প্রকাশিত হয় তখনই চমকে দিয়েছিল আমাদের। একটি কিংবদন্তী মানুষ রাজা রামমোহন রায়ের শেষ দিন নিয়ে লেখা গল্পটি মনে করিয়ে দেয় তার বিখ্যাত উপন্যাসে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুদৃশ্য এবং রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার বর্ণনা, সেই সঙ্গে আর একবার প্রমাণ করে কত উঁচু মাপের লেখক তিনি ছিলেন।

নামী লেখকদের অনেকের গল্পই আনন্দবাজার থেকে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘নয়নিকা আর চয়নিকা’ গল্পের জন্য টান টান তো বটেই, একটা নতুন ভঙ্গির জন্যও আকর্ষণীয়। গোটা গল্পটা লেখা হয়েছে নাটকের ভঙ্গিতে, কোনো বর্ণনা নেই, সবটাই সংলাপ, সেটা অবশ্য আমাদের মনে পড়ে গল্পটা শেষ করবার পর। সুচিত্রা ভট্টাচার্য ভালো লাগার মতো গল্প অনেক লিখেছেন, ‘অস্তরাগ’ও সেইরকমই একটি গল্প, তবে চমকে দিয়েছেন, বাণীবসু তার রাম! রাম!' গল্পে। আমাদের যৌবনকালে বাণী রায় লিখতেন এরকম পুরুষালি গল্প, এই গল্প পড়েও বুঝবার উপায় নেই কোনো মহিলার হাত দিয়ে এরকম গল্পের লাইন বার হয় ‘আরে বেটা লালবাত্তি কি রাণ্ডিকে পাস অ্যায়সি বডি থােড়ি মিলেগি।’ খুব সাধারণ একটা সেন্টিমেন্ট নিয়ে খুব ভালো গল্প লিখেছেন অমর মিত্র। আফসার আমেদের ‘আত্মজীবনীর কাল’, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জট’, হর্ষ দত্তের ‘মেরি ক্রিসমাস', মানব চক্রবর্তীর ‘মুড়িঘণ্ড’ ভালো লাগবে। কিন্তু চমকে দিয়েছে স্বপ্নময় চক্রবর্তী তার ‘ক্ষমা চাইছি’ গল্পে, তার এই কালো ভাতের গল্প আনন্দবাজার পত্রিকায় যেদিন প্রথম প্রকাশিত হয় সেদিনও অনেকেই চমকে উঠেছিলেন।

চমকে দেবার মতো গল্প আরো অনেকেই লিখেছেন, বিভিন্ন কারণে। যেমন অসীম চট্টরাজের ‘অগ্নিপুরাণ’, শৈলেন সরকারের ‘হাওয়া নল’ বা পৌরাণিক গল্পের আমেজ লেখা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মালব কৌশিক’। এছাড়াও উপভোগ্য গল্প পাই শুভমানস ঘোষের ‘লাইন ওয়ান ওয়ান’, সিদ্ধার্থ সিংহের ‘জবান’, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালবাতির নিষেধ’, বাণীব্রত চক্রবর্তীর ‘উর্বী, প্রচেত গুপ্তের ‘বৃষ্টি’। তরুণদের মধ্যে আছেন উল্লাস মল্লিক ‘ফোনটা বাজছে’, বিপুল দাস ‘টাইটেল মিউজিক’ অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় ‘অন্তর্ভেদ’। আনন্দবাজার পত্রিকা ভিন্ন পেশার নামী মানুষদের দিয়ে গল্প লিখিয়েছিলেন রবিবারের পাতায়। মানুষগুলি চেনা, তারা কেমন লেখেন, অন্তত গল্প, আমাদের জানা ছিল না। সেটা জানার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেইরকম লেখকদের কয়েকটি লেখা আমরা এই সংকলনে পাচ্ছি সংগীতশিল্পী স্বাগতলক্ষ্মী দাসগুপ্তের ‘কখন বসন্ত’,নচিকেতার লেখা ‘অদ্বৈত’, নাট্যকার ব্রাত্য বসুর লেখা ‘গোয়েন্দা চটক’ এবং অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের লেখা গল্প ‘তোমার নাম’।

সম্ভবত আনন্দবাজার পত্রিকার এই উদ্যোগের কথা স্মরণ রেখেই দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা কিছু বিখ্যাত মানুষকে দিয়ে গল্প লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এখানে সেরকম একটি গল্প আমরা পাচ্ছি, ধ্রুপদ গানের নামী শিল্পী পণ্ডিত অরুণ ভাড়ীর লেখা ‘পুনর্জন্ম’। দৈনিক স্টেটসম্যান রবিবারের পাতা থেকে আরো পাঁচটি গল্প অবশ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। লেখকদের মধ্যে যেমন আছেন প্রবীণ লেখক দীপঙ্কর দাস ‘আমি ঘরে ফিরবনা’, তেমনি আছেন নতুন পুরনো কিছু লেখক অনুপ ঘোষাল ‘আত্মজা’ সুব্রত রাহা ‘আত্মজিজ্ঞাসার রক্তের ঘ্রাণ’ উৎপলকুমার গুপ্ত ‘পায়রার আকাশ’ মণি শঙ্কর দেবনাথ ‘আকাঙক্ষার শরীর’।

আনন্দবাজারের পরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যার গল্প নেওয়া হয়েছে আজকাল পত্রিকা থেকে, গল্পের সংখ্যা মোট আট। প্রত্যেক লেখাই কম-বেশি পরিচিত এবং প্রত্যেকটি গল্পই লেখকের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। প্রয়াত যে তৃতীয় লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল, হিমানীশ গোস্বামী, তার ‘আজকের রূপকথা' গল্পটি এই পত্রিকা থেকেই নেওয়া হয়েছে। শেখর বসু ‘আরামদায়ক মৃত্যুর কথায়’ গল্পে দেখিয়েছেন শেষ বয়সে আরামদায়ক মৃত্যুর ইচ্ছা ব্যক্ত করা হলেও মৃত্যুর চেয়ে জীবন এখনও মানুষের অনেক বেশি কাম্য। আবার মৃতদেহ কবরস্থ করা নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প লিখেছেন আবুল বাশার ‘চমৎকার আলি বৈদ্য’ লাশবাহক একটি মানুষকে নিয়ে, যার দুই মেয়েও এই একই পেশা গ্রহণ করে এবং বাবার লাশ নিয়ে বিচিত্র পরিস্থিতিতে পড়ে। আকর্ষণীয় গল্প লেখার জন্য কয়েকটি পরিচিত নাম এই পত্রিকার রবিবারের গল্পসংগ্রহে আছে, এঁরা হলেন ভগীরথ মিশ্র ‘জন্মভূমি’ কিন্নর রায় ‘বৃক্ষলতা’ শচীন দাশ ‘সে ও তার সেই কলম’, শৈবাল চক্রবত্তী ‘ছাতাবাহার’ এবং হীরেন চট্টোপাধ্যায় ‘যাওয়া আসা’।

আজকাল এবং দৈনিক বর্তমানের গল্প সংখ্যা প্রায় সমান। প্রবীণ লেখক শক্তিপদ রাজগুরুর গল্প ‘তৃষ্ণা’ যেমন এখানে আছে, তরুণ লেখক জয়ন্ত দের গল্পও ‘ভাইবোন’ রয়েছে এখানে। সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে একেবারে ডকুমেন্টেশনের ভঙ্গিতে গল্প লিখেছেন এই সময়ের অন্যতম সমর্থ অনিতা অগ্নিহোত্রী ‘বহিরাগত’ লিখেছেন কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় ‘দিনান্তের বিহঙ্গ’। মহিলা লেখক আরো আছেন। পুরনো দিনের কণা বসুমিশ্র ‘বিদেশের গ্র্যানি আশোকা’ এবং নতুন দিনের অনিন্দিতা গোস্বামী ‘মোচ্ছব'। আরো আছেন মৃত্যুঞ্জয় মাইতি ‘লকার' এবং শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় ‘একাকী’।

অন্যান্য পত্রিকার উল্লেখ করেছি গল্পকারের নাম বলিনি। সংবাদ প্রতিদিন থেকে সংগ্রহীত হয়েছে চারটি গল্প- ‘মহাযাত্রার রথ’ রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী একদিন সুভদ্রা প্রদীপ ঘোষ ‘মরে গেল চেরী’ মনোজ দে নিয়োগী এবং একেবারে নিজস্ব মেজাজও স্বতন্ত্রতায় আলাদা করে নেওয়ার মতো গল্প ‘মেঘদীপের গার্লফ্রেন্ডরা’, লেখক নবনীতা দেবসেন। খবর ৩৬৫ দিনে থেকে তিনটি গল্প আছে ‘সাবালকের পত্র’ নবকুমার বসু ‘সােনালি বুদবুদ’ তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় এবং ‘টারোর চোখ’ হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত। Newz বাংলা থেকে আছে ‘প্রতিশোধ’ চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়, প্রাত্যহিক খবর থেকে ‘খিড়কি’ বিপ্লব রায়, ভোরের বার্তা থেকে ‘রাজকন্যা’ মনন মুখোপাধ্যায় আবার যুগান্তর থেকে ‘মাকড়সা’ বিনোদ ঘোষাল এবং সকালবেলা থেকে ‘সুগার কিউব’ অর্ণব দত্ত।

কথাসাহিত্যিক আবুল বাশারের বিচক্ষণতায় একটি মনে রাখবার মতো সংকলন পাওয়া গেল, এ কথাই সকলে মনে করবেন, অন্তত আমার তো তাই মনে হয়েছে।

ধন্যবাদন্তে

২৫.১২.২০১২

কলকাতা