Ticker

6/recent/ticker-posts

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস - তীর্থংকর রায়

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস - তীর্থংকর রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস
তীর্থংকর রায়

ব্যবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে অর্থনীতির পরিবর্তন- মূলত এই দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য হত মূলত স্থলপথে। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-ডা-গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজ়রা ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সোজা সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার পর জলপথেও বাণিজ্য শুরু হয়ে যায়। ভারত/এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে পর্তুগিজ়দের মুনাফার পরিমাণ (অনেকসময় শতকরা এক হাজারেরও বেশি) দেখে উত্তর ইউরোপের ব্যবসায়ীরা লোভ সামলাতে পারলেন না। ভারত/এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য তাঁরা জয়েন্ট স্টক কোম্পানি
প্রতিষ্ঠা করলেন। এভাবেই জন্ম হল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০) আর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০২)-র। তার অনেক পরে ফরাসি, ড্যানিশ প্রভৃতি কোম্পানির উদ্ভব। ষোড়শ শতকে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে পর্তুগিজ়দের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু সতেরো শতকে ডাচ আর ইংরেজরা এসে পর্তুগিজ়দের হটিয়ে দিয়ে নিজেরাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।
আলোচ্য গ্রন্থে তীর্থংকর দুটো ‘বড় প্রশ্ন’-র উত্তর খুঁজেছেন। প্রথম, ব্যবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ (মানদণ্ড থেকে রাজদণ্ড)- কোম্পানির এই বিবর্তনের কারণগুলি কী? দ্বিতীয়ত, ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে অর্থনীতির কী পরিবর্তন হয়েছিল? ‘ভূমিকা’ ও ‘মূল্যায়ন’ বাদ দিয়ে সাতটি সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত অধ্যায়ে লেখক তাঁর বক্তব্য ও মূল সিদ্ধান্ত পেশ করেছেন।
সে প্রসঙ্গ পরে। প্রথমে লেখকের কয়েকটি উক্তি নিয়ে একটু আলোচনা দরকার। কারণ, এগুলি ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়, ফলে তা পাঠকের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। তীর্থংকর লিখেছেন হলওয়েল বর্ণিত ‘অন্ধকূপ হত্যা’ ‘গণহত্যা’র সমান এবং ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড’র সমতুল্য! কোনও উগ্র জাতীয়তাবাদী ইংরেজও এমন কথা বলবেন কি না সন্দেহ। হলওয়েলের সমসাময়িক কর্মচারীরা ‘অন্ধকূপ হত্যা’র গল্পটাকে আজগুবি গল্প (‘specious fable’) বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ জে এইচ লিট্ল এটাকে ‘gigantic hoax’ বলে অভিহিত করেছেন। হলওয়েল তাঁর প্রথম বয়ানে বন্দির সংখ্যা ১৬৫ থেকে ১৭০ লিখে পরের বয়ানে (বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভেবে?) বন্দির সংখ্যা ১৪৬ জন করেন। তার মধ্যে নাকি ২৩ জন বেঁচে ছিল, বাকি ১২৩ জন মারা যায়। পঞ্চাশ বছরেরও আগে ব্রিজেশ গুপ্ত দেখিয়ে দেন, বন্দির সংখ্যা ছিল ৬৪ জন, তার মধ্যে ২১ জন জীবিত ছিল, মৃতের সংখ্যা ৪৩ জন।
তাছাড়াও বইটিতে বেশ কিছু তথ্যগত বিচ্যুতি চোখে পড়ে। স্থানাভাবে শুধু কয়েকটি উল্লেখ করছি। লেখক বলেছেন, ১৭০০ সাল পর্যন্ত কোম্পানির প্রধান দু’টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল ঢাকাই কাপড় ও সোরা। এ দু’টি ছাড়াও একটি প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল কাঁচা রেশম। রপ্তানি পণ্যের মোট মূল্য হিসেব করলে রেশমের স্থান কাপড়ের পরেই। আসলে ১৬৮০-র প্রথম দিক পর্যন্ত রেশমই ছিল প্রধান পণ্য, তারপর কাপড় ও সোরা। ওই দশকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপের মানুষের মধ্যে রুচির একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের (ভারতের/বাংলার কাপড় পরার একটা প্রচণ্ড হুজুগ) ফলে হঠাত্‌ ইউরোপে বাংলার/ভারতের কাপড়ের চাহিদা খুবই বেড়ে যায়, বেড়ে যায় কাপড় রপ্তানিও। তাছাড়া ঢাকাই কাপড় অন্যান্য কাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি দামি বলে রপ্তানির জন্য বেশির ভাগ কাপড়ই আসত কাশিমবাজার, হুগলি, মালদা, শান্তিপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। ঢাকা থেকে যে-পরিমাণ কাপড় রপ্তানি হত, তা মোট রপ্তানির শতকরা দশ শতাংশ মাত্র। আবার লেখক বলেছেন, ১৭৬৫-র পর থেকে মধ্যগ-বণিক, দালাল প্রভৃতির পরিবর্তে কোম্পানি নিযুক্ত কর্মচারীদের (গোমস্তা) মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। আসলে ১৭৫৩ সাল থেকেই কোম্পানি গোমস্তাপ্রথা চালু করে, ১৭৬৫-তে নয়।
এবার তীর্থংকরের মূল বক্তব্যে আসা যাক। কোম্পানি কী করে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ শুরু করে, তার জন্য তিনি অন্ধকূপ হত্যা ও সিরাজদ্দৌল্লাকে দায়ী করেছেন। আধুনিক গবেষণায় তা অসার বলে প্রমাণিত। পলাশি প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একাংশের বিশ্বাসঘাতকতাই পলাশির যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা, ইংরেজরাই পলাশি চক্রান্তের অন্যতম নায়ক। তাদের সক্রিয় সমর্থন ও উত্‌সাহ ছাড়া এ চক্রান্ত সফল হত না। খোদ ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকে বর্তমান প্রতিবেদক এটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আসলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা, যা ১৭৩০-এর দশক এবং চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত রমরমিয়ে চলছিল, ১৭৪০-এর শেষদিকে তা ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বিনাশুল্কে কোম্পানির কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করে দিতে সিরাজদ্দৌল্লার দৃঢ় সংকল্পের সম্মুখীন হয়ে প্রচণ্ড মার খাচ্ছিল। অথচ এই ব্যক্তিগত ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে দেশে ফিরবে বলেই ইংরেজ কর্মচারীরা সাত সমুদ্র পেরিয়ে এদেশে আসত। তাই তারা এই ব্যক্তিগত ব্যবসা পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আর তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল- তাই পলাশির যুদ্ধ এবং সিরাজদ্দৌল্লার বিতাড়ন।
তীর্থংকরের আরও বক্তব্য, কোম্পানির বাণিজ্যের ফলে ভারতের বাণিজ্যে ‘বিশ্বায়নের জানালা’ খুলে যায়, আর ইউরোপীয়রা পণ্য সংগ্রহের জন্য বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করে বাণিজ্য সংগঠনে নতুনত্ব আনে। এসব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। ইউরোপীয়রা ভারতে আসার বহুদিন আগে থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আর, পণ্য সংগ্রহের জন্য অগ্রিম চুক্তি নতুন কিছু নয়, বাংলার বাণিজ্যে এটি একটি সনাতন পদ্ধতি ছিল। ইউরোপীয়রা আসার অনেকদিন আগে থেকেই এশীয় বণিকরা এদেশে তাদের রপ্তানি পণ্যের সিংহভাগই সংগ্রহ করত দাদন বা অগ্রিমের মাধ্যমে। তবে লিখিত চুক্তি হত কি না, তা ঠিক জানা যায় না। অবশ্য তার কোনও প্রয়োজনও ছিল না, কারণ, পরস্পরের ওপর বিশ্বাসই ছিল এশীয় বণিকদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এটাও এখন প্রতিষ্ঠিত যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও এশীয় বণিকদের রপ্তানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়েও অনেক বেশি ছিল। তাই ইউরোপীয়দের রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি বলে পণ্য সংগ্রহের জন্য অগ্রিম চুক্তি এবং দাদন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, এমন যুক্তি সঠিক নয়।
লেখকের আরও একটি উপপাদ্য- পলাশির পর যে-বিখ্যাত ‘পলাশি লুঠ’ শুরু হয়েছিল এবং বাংলা থেকে ধননিষ্ক্রমণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যার উপর এতকাল ইতিহাসবিদরা জোর দিয়ে এসেছেন, সেটি আসলে ভ্রান্ত। তীর্থংকরের মতে, এই ধননিষ্ক্রমণ তত্ত্ব জাতীয়তাবাদী ও মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের মনগড়া জিনিস, তাই সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন, এই যে ধনরত্ন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তা দিয়ে ভারতের জন্য পরিষেবা কেনা হত। কিন্তু কী পরিমাণ ধননিষ্ক্রমণ হয়েছিল, আর পরিষেবা কিনতে কত খরচ পড়েছিল, তার কোনও হিসেব লেখক দেননি। ফলে তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাছাড়া অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার তাঁতিদের উপর কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের অমানুষিক অত্যাচারের ফলে, বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় হয়, ফলে ৬০ লক্ষ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে- এ নিয়ে বইতে কিছুটা আলোচনা থাকলে ভাল হত।
অর্থনীতিবিদ হিসেবে তীর্থংকরের নাম সুবিদিত। তাই আমাদের আর-একটু বেশি প্রত্যাশা ছিল। সে যাই হোক, বইটি সুখপাঠ্য।
আলোচনা করেছেনঃ সুশীল চৌধুরী।
Download and Join our Facebook Group