Ticker

6/recent/ticker-posts

বেদাত ওমর খৈয়ম দর্শন - শামসুল আলম সাঈদ

বেদাত ওমর খৈয়ম দর্শন শামসুল আলম সাঈদ বেদাত ওমর খৈয়ম দর্শন

শামসুল আলম সাঈদ

ইসলামের মূলনীতি এবং প্রচলিত তরিকা পরিপ্রেক্ষিত কিংবা পরিপন্থী যুক্তি তর্ক বুদ্ধি, চিন্তা, জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও শিল্পানুরাগ সময়ের বিবর্তনের কারণে কিছুটা বিচূতি প্রাপ্ত কিংবা নব সংযোজনের দাবিদার হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। সে প্রেক্ষিতে চেতনা সাপেক্ষ নব উদ্ভাবন সমৃদ্ধ হয়ে অগ্রসর সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়, বিশেষত যুব মানসে গ্রাহ্য সমন্বিত হয় এবং একটা নতুন মতবাদ সৃষ্টির প্রশ্ৰয়ও পেয়ে থাকে। রক্ষণশীল গোড়া পশ্চাৎমুখী ধর্মরক্ষী পণ্ডিতৰ্ম্মন্য বা বিনষ্টের আশংকায় নিজেরা পাহারাদার বিবেচনায় অসহিষ্ণু হয়ে কৃপাণ উদ্যত অবস্থায় এই নবচিন্তার উদ্ভিন্ন চারাগাছকে মুড়ে দেবার জন্য কিংবা ব্যতিক্রমী এ প্রথাকে উচ্ছেদ বা তার অনুপ্রবেশের দ্বার রুদ্ধ করে দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে হিংস হয়ে ওঠে। শিক্ষা ও সভ্যতা বিমুখ মুসলমান সমাজের কাচা বিচার বুদ্ধিকে কাজে লাগায়, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও অন্ধ বিশ্বাসের আচ্ছন্নতার সুযোগে রক্ষণশীল পন্থীরা তাদের সহজে দলভুক্ত করে নিয়ে শিক্ষিত ও সভ্য শ্রেণীর ওপর জবরদস্তি খাটায় এবং সহজে তা সম্ভবপর করে তোলে। ফলে নব উদ্ভাবন বা বেদাত যা প্রকৃত নাম থেকে সরে ধর্মে অপচিত নামে অজ্ঞদের হাতে সুকৌশলে তুলে দেওয়া অগ্রসর হলেও বেদাতপন্থীরা সংখ্যালঘু পর্যায়ে সীমাবদ্ধ পরিসরে তাদের সামান্যই প্রতিহত করতে পারল অথবা সাধনা ব্ৰত উদযাপন করে গেলেন কেবল ।

তাদের একজন ওমর খৈয়াম; তার চিন্তা যুক্তি দর্শন ও কাব্য অগ্রসর মুসলমান সমাজকে প্রতিবাদী প্রেরণা যুগিয়েছিল, যা সে যুগে অতি সাহসিকতার কর্ম এবং চিরন্তন নব চিন্তার উৎস ছিল আর সেটাও এখন বিবেচনা করা যায়। তার মতো আরও যারা প্রকাশ্যে এ ধরনের মতবাদ ও সত্য কথন উচ্চারণ করেছিলেন তাদের অনেকের শির স্কন্ধোপরি স্থির ছিল না, স্বদেশ ও সম্প্রদায় থেকে কেউ কেউ নিষ্কাষিত বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মরক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দিয়ে অজ্ঞাত পরিবেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং অন্য সম্প্রদায়ের আশ্রয় পেয়ে বিদেশের পরিবেশেও উন্নত চিন্তা দিয়ে বিশ্বের জন্য স্থায়ী কোনও সুকৃতি স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন, যা মধ্যযুগের ইয়োরোপের জন্য যথেষ্ঠ ফলপ্রসু হয়েছে। এই মনীষীদের ভেতর আভেসিন্না, আভেরুশ, আভেপকম্পা, আল কান্দি প্রমুখ খ্যাত। তারা সকলেই নাম এখনও উদ্ধার করা যায় নি। আভেসিন্না বা ইবনে সিনার বেদাত হল গ্রিক জ্ঞান ও গ্রিক বা যুনান চিকিৎসা পদ্ধতি মুসলমানদের জন্য প্রয়োগ করা। তার আগে মুসলমনাদের জন্য কোনও প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল না, কেবল পবিত্র গ্রন্থের কোনও সুরা পাঠ করে ফু দিয়ে যা চিকিৎসা হত তাই। কিন্তু ইবনে সিনা গ্রিক বা ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি মুসলমানদের ভেতর চালু করে অনেককে সুস্থ করে তোলেন। ফলে রক্ষণশীল সমাজের কোপদৃষ্টি তার ওপর পড়ল। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তার বেদাতি 'খোদার ওপরে খোদকারী নীতিকে আক্রমণ করলেন, তাকে কাফের আখ্যা দিয়ে বিতাড়িত করেন। অবশ্য তার রেখে যাওয়া গোপন পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবতী কালে সাধারণ মুসলমান সমাজ এর সুফল ভোগ করে। তবে তার সঙ্গে ফু দিয়েও চিকিৎসার মনোযোগ কমে যায় নি, এখনও পর্যন্ত ফু বেদাতি ও অন্য অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে রয়ে গেছে, যতদিন মুসলমান থাকবে ফুও থাকবে ।

দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে থাকবেন। কিন্তু তার প্রতিভাগুণে অল্প বয়সেই সম্রাট মালিক শাহের প্রিয়ভাজন হন। সম্রাট কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পৃথিবীর জন্য সর্বপ্রথম সৌর ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করেন, বিজ্ঞানাচার্যের পদ গ্রহণ করেন এবং মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। নানা কারণে সে সময়ে তিনি বুজুর্গ হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। ইবনে সিনার মতো প্রকাশ্যে কোনও বেদাত প্রচার করেন নি তার জীবিত কালে। কিন্তু গোপনে তার বেদাত দর্শন মতবাদ রেখে যান, যা তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়ে বিপুল আলোড়ন ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিল। অবশেষে তার মৃত্যুর ছয়শত বছর পরে ইংরেজ কবি এডওয়ার্ড ফিটসজেরাল্ড সুমার্জিত ও সুভাষিত ভাবে তার কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে এই অমূল্য সম্পদের আবিষ্কার করেন, যা বিশ্বে আজ সমাদৃত।

জীবিতকালেও তিনি মসৃণ জীবনযাপন করতে পারেন নি, মালিক শাহের অকাল মৃত্যুর পর তিনি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, রাজকীয় পদ হারান এবং গবেষণাগারও পরিত্যক্ত হয়। পরে নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকের যে চাকুরি নেন তাতে ছাত্রদের পাঠদান কালে তার মুখ নিভৃত 'বেদাতি লেকচার শুনে খোদাদ্রোহীতা প্রচার অপবাদের কারণে সে চাকুরি হারান এবং অভাবগ্রস্থ হয়ে দীনভাবে জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে শহরের প্রান্তে অজ্ঞাতবাস কালেও তার মতবাদের বহি চাপা থাকে নি। লোকেরা তার কাছে চিকিৎসার জন্য এলে তিনি দাওয়ার সঙ্গে ভূৰ্জপত্রে অনুপান’ হিসেবে চার লাইনের রুবাই রচনা করে সেটা ব্যবস্থাপত্র হিসেবে তাদের ধরিয়ে দিতেন। পরে সে পত্রগুলো সংকলিত করে তার রুবাইয়াত বা কাব্যগ্রস্থ সৃষ্টি হয়েছে।

বেদাত মতবাদ বা দর্শন নিয়ে ইতিপূর্বে কোনওগ্রন্থ বা চিন্তাকর্ম সৃষ্টির অবকাশ আমার জানামতে নেই অথবা দৃষ্টিগোচর হয় নি। ইসলামের দর্শনে 'বেদাত' এর উল্লেখ অপরিহার্য নয় অথবা বেদাত এ দর্শনে স্থান সংকুলান করতে পারে না অথবা তা ইসলামের চিন্তাবিদদের বিবেচ্য বিষয় নয়, অথবা ঠাই ধরতে পারে কিনা সেটা তাদেরই বিবেচ্য বিষয়। তা ছাড়া দর্শন চর্চার জন্য আমি কোনও মতেও কৃপান্ত অধিকার সম্পন্নও নই। কিন্তু মানব চিন্তার সকল অধিকারের একটু করে হলেও নাসিকা উচ্চাসন করে শ্বাস গ্রহণের অধিকার সবারই রয়েছে, সেখানে কারও আপত্তি উত্থাপন চলে না। সে কারণে আমার এ দুঃসাহস। বেদাত ইসলামের সৌন্দর্য সৌধের ভেতর খচিত গোলাপকুঞ্জ, সে শিল্পী কারিগরেরই কাজ। তবে আল গাজেল অর্থাৎ আল গাজ্জালি প্রথমে অনেক তথ্য বেদাতের জন্য সংযোজন করলেও পরে সস্তা নেতৃত্বের মোহে রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের নেতা হয়ে বেদাতের শক্র হয়ে যান। নেতৃত্বের মোহে রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের নেতা হয়ে বেদাতের শক্র হয়ে যান। বেদাতি ফালসোফদের বিরুদ্ধে প্রখর আন্দোলন গড়ে তোলেন, ফালসোফের বিরুদ্ধে তার শর্ত হল, "সাপুড়ে যেমন আপন সন্তানকে সর্প খেলা শেখায় না, তার থেকে বিরত রাখে, তেমনি মুসলমান সমাজকে ফালসোফদের ক্রীড়া রপ্ত করা থেকে বিরত রাখতে হবে, নইলে ছোবলে ধর্ম বিনষ্ট হবার ভয় রয়েছে। এই তত্ত্বজ্ঞান ইসলামের দর্শনের মূল মন্ত্র হয়েছে। অনেকের মতে তার ইয়াহিয়া উলুমুদিন সে দর্শনের পথ প্রদর্শক।

সত্যিকার ফালসোফ বা দর্শন তা হতে পারে না। ফালসোফে ধর্মের প্রতি ছোবল থাকবে তবে মানব চিন্তা অর্থই হল ধর্মের প্রতি ছোবল, কেবল যে চিন্তা একটা গ্রন্থে আবদ্ধ তার বাইরে নয় এটা মুসলিম দর্শন। প্রকৃত দর্শন হচ্ছে মানব সুন্দর জীবন বোধি। মধ্যযুগীয় কট্টর খ্রিস্টীয় সংস্কার নামে আবর্জনা পৃথিবীর জন্য অভিশাপ ছিল, উমাইয়া যুগের স্বেচ্ছাচারিতা প্রায় অনুরূপ যা এখনও জঙ্গিবাদের রূপে রয়েছে। খৈয়ামের প্রতিবাদী মতবাদ তো ওখানেই। বিশ্বগুরু সক্রেটিস মানবচিন্তাকে অন্ধকার থেকে বের করে আনলেন, সেই আলোই তো ফালসোফি বা ফিলোসোফি। একজন ফালসোফ কখনও বিশ্বাসের ধর্মে আকৃষ্ট হতে পারেন না, মানবধর্ম হচ্ছে একজন দার্শনিকের আসল ধর্ম। সে জন্য খৈয়ামও বলেন,

‘তা নিয়েও মনে করি হতে পারি মুসলমান’

এটা একটা আধুনিক মতবাদ। কারণ আপন ধর্মের প্রতি উদাসীন হলেও কোনও শিক্ষিত লোক অন্য কোনও ধর্মে এখন দীক্ষিত হতে পারেন না। তাই আপন ধর্মের সুন্দর আচারগুলো নিজের কাছে রেখে জীবনাচার রচনা করেন এবং অন্যকেও চাইলে ব্যবহার করতে দেন। তবু যদি কেউ ধর্মান্তরিত হন বুঝতে হবে ভবিষ্যতের কাছে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ অভিলাষী বটেন।

এমন একটি অপেয় বিষয়োচ্ছাসজনিত হবার জন্য সাধ্যস্থিত হয়েছি তার গোপন কথা হল প্রকাশক রিয়াজ খান স্নেহাম্পদের সোৎসাহ এবং পাঠকও এর জন্য দায়ী হতে পারেন।