Ticker

6/recent/ticker-posts

ফিরে দেখা জীবন - এটিএম শামসুল হুদা

amarboi ফিরে দেখা জীবন
এটিএম শামসুল হুদা
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আমাদের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থা কী এবং কেন তারা এই দশায় পৌছেছে, লেখকের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে খণ্ড খণ্ড চিত্রের মাধ্যমে এ বইয়ে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্ণিত সব ঘটনা লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত। গল্পের মতো করে লেখা এসব ঘটনা পাঠককে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরের অনেক অজানা বিষয় সম্পর্কে যেমন অবহিত করবে, তেমনি এসব অনাচার থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়, সে সম্পর্কেও তারা কিছু ধারনা লাভ করতে পারবেন।
একটা দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে তার আনুষ্ঠানিক বিধিবিধান আছে। কিন্তু অন্তরালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ অনুরাগ-বিরাগও এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিশাল ভূমিকা রাখে। সাধারণ নাগরিকেরা এসবের কিছুই জানতে পারেন না। এটিএম শামসুল হুদা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বইয়ে তিনি তার স্কুলজীবন থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে অতিবাহিত সময়কাল পর্যন্ত কিছু প্রতিষ্ঠানে পর্দার অন্তরালে সংঘটিত কিছু সত্য ঘটনা গল্পছলে উপস্থাপন করেছেন। বিধৃত কাহিনিগুলো পাঠ করে পাঠকের মনে কিছুটা হতাশা জন্মাতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় কথা পাঠক এর মধ্যে আশার আলো দেখতে পাবেন। সহজ ভাষায় লেখা সুখপাঠ্য একটি বই।
ভূমিকা
কালের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই—কাল অনন্ত, অসীম। তবু কালপ্রবাহের নিরন্তর স্রোতে সিক্ত মানুষ যুগে যুগে, দেশে দেশে এমন কিছু অসাধারণ ঘটনার সৃষ্টি করে কিংবা মুখোমুখি হয়, যা অসীমকে সীমায় আবদ্ধ করে ওই সময়কালকে একধরনের বিশিষ্টতা ও স্বকীয় রূপ দেয়। এই স্বকীয়তা এতই সুস্পষ্ট ও উচ্চকিত যে, সহজেই এই সময়কালকে আগের ও পরের সময়কাল থেকে পৃথক করে দেখা যায়।
আমাদের প্রজন্মের অনেকেই তিনটি কালের মুখোমুখি হয়েছে। কালের ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় এসব ছিল একধরনের সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তন। ২০০ বছর পর ইংরেজ শাসকদের বিদায় একটি কালের অবসান এবং ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভু্যদয় আরেকটি কালের সূচনার ইঙ্গিত দেয়। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর পাকিস্তান থেকে অবমুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তৃতীয়কালের যাত্রা শুরু হয়।
অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে জনগণের উন্নত জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ব্রিটিশরাজের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ছয় দশকের অধিককাল পরও সেই অঙ্গীকার বহুলাংশে অপূর্ণই থেকে গেছে।
অথচ এমনটি না-ও হতে পারত। ব্রিটিশরাজের বিদায়কালে পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্টই তাদের হাতে সযত্নে লালিত বিচারব্যবস্থা, আইসিএসসহ বিভিন্ন সিভিল সার্ভিস ক্যাডার, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক রাষ্ট্ৰীয় প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ সচল অবস্থায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়। মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও কর্মজীবন পরিচালনা করার ফলে তারা নিজেদের কাজকর্মে ঈর্ষণীয় নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন ।
আইসিএস সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো মৌলিক পরিবর্তন না এনে আতীকরণ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা সুসংহত করার লক্ষ্যে মেধাভিত্তিক নিয়োগ এবং কর্মজীবনের পরিকল্পনাও অব্যাহত থাকে। ভারতীয় এবং কিছু কম মাত্রায় পাকিস্তানি মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্নিহিত শক্তি এই সূত্র থেকে উৎসারিত ভাবলে তা অমূলক হবে না।
বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্নেও এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ চালু অবস্থায় প্রয়োজনীয় লোকবলসহ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সংগঠনে বিভিন্ন সময়ে তথাকথিত সংস্কারের অজুহাতে নেওয়া বিভিন্ন হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং বিগত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ব্যাপক রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে তাদের নিরপেক্ষ কৃষ্টিকে যেমন নির্বাসিত করা হয়েছে, তেমনি সংগত কারণেই, এদের দক্ষতার ক্রমাবনতিও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দেশে সুষ্ঠ গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে গণতন্ত্রচর্চার পাশাপাশি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, নিষ্ঠাবান বিরোধী দলের পরিপোষণ ও রাজনৈতিক সমঝোতার গুরুত্ব অনুধাবন করেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা হীন দলীয় স্বার্থে তা অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। বরং তারা গণতন্ত্রকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন, যেখানে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এই অভিলাষ পূরণে সবচেয়ে বড় বাধা। এরকম ধারণা থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানকে নানা কৌশলে দুর্বল করে নিজ দলের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে রাজনীতিকীকরণ করা হয়। দলীয় আনুগত্য অবলীলাক্রমে মেধার স্থান দখল করে নেয়। দলীয়করণের এই বিষবাষ্প সর্বত্র ব্যাপৃত হয়ে দেশের আপামর জনসাধারণকেও প্রভাবিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আইনের শাসন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রশাসন, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের ধারা, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র-এককথায় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সুদূরপরাহত হয়েছে। উন্নত-শির সব রাষ্ট্রীয় মৌলিক প্রতিষ্ঠান কালান্তরের আবর্তে এখন বিপন্ন।
পক্ষান্তরে পাকিস্তান, যাকে অনেক বাংলাদেশি বোদ্ধা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান, সেখানে আজও ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সে দেশের রাজনীতি নানা পরস্পরবিরোধিতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অনেকটা বিভ্রান্ত হলেও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা সেখানকার রাজনীতিকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও ধারণতত্ত্ব বহুল আলোচিত এবং নতুন কোনো আবিষ্কার নয়। এই গ্রন্থে যা অভিনব, তা হলো এই প্রতিপাদ্য অবলম্বন করে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের কালান্তরিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব অবস্থা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে খণ্ড খণ্ড চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন।
প্রথমে পাকিস্তানের উভয় অংশে এবং পরে বাংলাদেশে সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের সরকারি চাকরি ও পরে পাচ বছর বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনকালে আমি অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। এসব ঘটনা সামগ্রিকভাবে কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কখনো ছিল আনন্দের, কখনো বিষাদের; কখনো কাঙিক্ষত, কখনো সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত—ঈর্ষা, বিদ্বেষ আর অপচিকীর্ষার ঘটনাও কম ছিল না। বর্ণিত ঘটনাগুলোর বিশেষত্ব এই যে, এসব আমার চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছে কিংবা আমি সরাসরিই এসব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম। এই প্রক্রিয়ায় যাদের সম্পর্কে দুটি ভালো কথা বলা সম্ভব হয়েছে, সেটি করতে আমি কোনো কাপণ্য করিনি এবং সশ্রদ্ধচিত্তে আমি তাদের নামও উল্লেখ করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্ণিত বিষয় সংবেদনশীল হওয়ায় এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আজ আর জীবিত নেই, তবে যারা আছেন, তারা গ্রন্থটি পাঠ করে আহত হলেও দেখবেন যে বর্ণনায় কোনো অতিশয়োক্তি নেই।
এ ধরনের একটি গ্রন্থ রচনার জন্য আমার পরিবারের সবাই, শুভাকাঙক্ষী, বন্ধুবান্ধব ও আমার অনুরক্ত অনেক সহকর্মী আমাকে বহুদিন ধরে তাগিদ দিয়ে আসছেন। সত্য ঘটনাসংবলিত এ ধরনের গ্রন্থ রচনার বিড়ম্বনা অনেক। অনেকেই সত্যকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে চান না। সে জন্য প্রথমে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও পরে লেখার সিদ্ধান্ত নিই।
গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিতে সম্মত হওয়ায় আমি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং এটি দ্রুত ও সর্বাঙ্গসুন্দর আকারে প্রকাশনার সার্বিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
এটিএম শামসুল হুদা
২০ জানুয়ারি ২০১৪
গুলশান, ঢাকা

Download and Comments/Join our Facebook Group