Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা - ডেভিড ম্যাককাচিয়ন

ডেভিড ম্যাককাচিয়ন
বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা



ত্রয়োদশ শতকের সূচনায় মুসলিম আক্রমণকারীদের আগমন বাংলা দেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ এই বৈদেশিক বিজয় যাত্রা কেবলমাত্র লুণ্ঠন-উদ্দেশিক নয়, সাংস্কৃতিক বিজয় অভিযানও বটে, কারণ শস্ত্রের সাহায্যে শাস্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা এই সময়েই হয়েছিল। ওই সময়ের আতঙ্ক-বিজড়িত সমাজের পরিচয় এখনও পুষ্করিণীতে ও নদীতে মূর্তি-বিধ্বংসীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিক্ষিপ্ত ও বর্তমানে পুনরুদ্ধার-করা প্রাক-মুসলিম দেবপ্রতিমা থেকেই পাওয়া যায়। মুসলিম ও হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে প্রভূত পার্থক্যের কথা প্রায়শই উচ্চারিত হয়। সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও প্রচণ্ড কর্মোদ্যমকে মূলবস্তু করে একটি বহির্মুখী এবং অন্যটি পরিবারমুখী ও আত্মশুদ্ধিতে নিয়োজিত। একটি আচারনিষ্ঠ ও সুকঠিন ; অন্যটিতে পরিস্ফুট একটি গ্রহণক্ষমতাসম্পন্ন স্বচ্ছন্দ ঢিলেঢালা ভাব। অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে ধর্মে ও শিল্পে এই পার্থক্য বিশেষভাবে প্রকটিত। জীবনের আনন্দবোধ হিন্দু চিন্তাধারায় উদ্ভিদে-বনস্পতিতে, বহতা নদীতে, পক্ষী ও প্রাণীকুলে এবং প্রাণস্পন্দিত নিসর্গের বিভিন্ন রূপে হিন্দু পূজা-অর্চনায় ও দেবমন্দিরের অলংকরণে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। কিন্তু মরুদেশ-জাত ইসলাম দুর্ধর্ষ মরুজাতিদের সুশৃঙ্খল করার প্রাথমিক প্রয়োজনেই কর্কশ ধর্মান্ধতার সাহায্যে বিচারক-ঈশ্বরের 'সেমিতিক' ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করে তুলেছে। প্রাণীজগতের শিল্প-রূপায়ণ সম্পর্কে ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছাড়া ইসলাম-চেতনার মূলভাবধারাও মুসলিম শিল্পী ও স্থপতিকে বিমূর্ত জ্যামিতিক শিল্প-প্রকাশে প্ররোচিত করেছে। সমতল গৃহ প্রাচীর, আয়তাকার কক্ষ ও অঙ্গন এবং মসজিদের সাধারণ সুষমানুপাত ইসলামি চেতনায় যে-রকম তৃপ্তিদায়ক বিগ্রহের স্ফীতোন্নত রূপকল্পনা ও অলংকরণের প্রাচুর্য হিন্দু চেতনায় তেমনই সমাদৃত একটির মূল রেখাভঙ্গি সরল ও ঋজু, অন্যটি বঙ্কিম-রেখাশ্রয়ী। ইসলামি ধারা স্থাপত্য-পরিসরের সংস্থাপনে সাবধানী ও গাণিতিক। অন্যদিকে হিন্দু ভাবধারায় স্থাপত্য-সংস্থাপন প্রাণধর্মী ও উচ্ছ্বসিত। জ্যামিতিক প্রকাশভঙ্গি ও জৈবিক উপলেপের সংযম ও উচ্ছলতার এই পার্থক্য ইয়োরোপীয় 'গ্রিক' ও 'গোথিক' শিল্পকলা অথবা 'ক্ল্যাসিকাল' ও 'রোমান্টিক' ভাবধারার সঙ্গে তুলনীয়।
হিন্দু মন্দিরের পূজার্চনা 'গর্ভগৃহে' কেন্দ্রায়িত। গর্ভগৃহ মাতৃজঠরের মতোই অন্ধকারাবৃত ও জীবন-উন্মেষের মতোই রহস্যময় এবং প্রতিমাতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠার উদ্দেশেই পূজাচার অনুসৃত। ইসলামে অবশ্য প্রতিমার আরাধনা গভীরতম পাপ। তেত্রিশ কোটি হিন্দু দেবদেবীর প্রতিপক্ষে ইসলাম কেবলমাত্র হিন্দু ঐতিহ্যবাহী 'ঈর্ষাপরায়ণ' অদ্বৈত ঈশ্বরকে এনেছিল। ইসলামের আরাধনা সংকীর্ণ ও অন্ধকার কক্ষের কম্পিত দীপশিখায় ও ইতস্তত ভাসমান ধূম্রাচ্ছাদনের মধ্যে ব্যক্তিগত দেব 'দর্শনে' আবদ্ধ নয়, কিন্তু আকাশের তলায় মুক্তাঙ্গনে; মিলিত এক সামাজিক ও গোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত বা আত্মগত পবিত্রীকরণ এর মূল লক্ষ্য নয়, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে মানবিক একাত্মতা বা সহমর্মিতার প্রকাশ। স্বচ্ছতাই মসজিদের মৌল উপাদান সংকীর্ণ কক্ষের পরিবর্তে, দীর্ঘ প্রাচীরই মুসলিম আরাধনায় কেন্দ্রস্থিত লক্ষ্যবস্তু। কেবলমাত্র প্রার্থনার দিক নির্দেশই এই প্রাচীরের উপযোগিতা নয়, প্রাচীরের মধ্য দিয়ে মক্কার অভিমুখে উপাসনাই এর উদ্দেশ্য। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে এই প্রাচীর প্রায় পাঁচশো ফুট দীর্ঘ। উপাসনাকারী এর যে কোনও স্থানেই দাঁড়াতে পারেন। 'উপাসনা কুলুঙ্গি' বা 'মিহরাব'-সমূহ কেবলমাত্র মনঃসংযোগের জন্যই প্রয়োজনীয়।
তত্বগতরূপে দৃষ্ট হলে ইসলাম এতই অসহিষ্ণু ও হিন্দুধর্ম এতই স্বতন্ত্র ও মিশ্রণ বর্জনকারী যে এ-দুয়ের সহাবস্থান অসম্ভব। কিন্তু বাস্তব অবস্থা অবশ্যই যে কোনও তত্বের চেয়ে শক্তিশালী ও অমোঘ এবং এক শতকের মধ্যেই বাংলাদেশের মুসলিম শাসকেরা উপলব্ধি করেছিল যে দেশকে অধিকৃত রাখতে গেলে ও দেহলির প্রতাপ অস্বীকার করে স্বাধীনতা বজায় রাখতে গেলে স্থানীয়দের বিরোধীতে পরিণত করা চলে না এবং সকল স্থানীয় ভূস্বামীদের পরিবর্তন করাও তাদের আয়ত্তের মধ্যে নয়। এর পাঁচশো বছর পরেও বাংলাদেশ দখল করতে গিয়ে ব্রিটিশরাও দেখেছিল যে ভূস্বামীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তখনও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের অব্যবহিত পরে বর্বরযুগীয় ইয়োরোপে খ্রিস্টীয় ধর্মের প্রসারতার সময়ের মতোই এ সময়েও গণ ধর্মান্তরণের কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ যাই হোক না কেন হিন্দুধর্ম এ সময়ে প্রভূতরূপে উন্নত ও গভীর শিকড়ে প্রোথিত ছিল। প্রধানত হিন্দু সংস্কৃতি-জগতের বাইরে অবস্থানকারী নিম্নবর্ণের শ্রেণীসমূহ ও সমাজ-বহির্ভূত শ্রেণীরাই ধর্মান্তরণে আগ্রহী ও সমর্থ ছিল। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রাবল্য ও স্বাভাবিক পরিপার্শ্বের প্রভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে তারা বহু স্থানেই সত্যপীরের পূজা প্রভৃতি হিন্দু ভাবাদর্শ ও সর্বপ্রাণবাদী মনোভাবকে আত্মস্থ করেছিল - যার জন্য পরবর্তীকাল 'ফারাইদি' প্রভৃতি সংস্কারমূলক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়। যাই হোক কঠোরভাবে ব্যাখ্যাত নীতিতত্বের ভিত্তিতে স্থাপিত ক্রিশ্চান ধর্মের মতো ইসলামও বহু দিন হল এর উন্মেষ-কালাগত মতাদর্শ থেকে সরে এসেছে। এর নেতৃস্থানীয়রা যে কেবলমাত্র সত্যপ্রচারের পরিবর্তে বিলাসিতা ও শক্তিমত্তাকে গ্রহণ করেছে তাই নয়, সামাজিকভাবে 'শিয়া' ও 'সুননি' দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে ও রহস্যবাদী 'সুফি' মতবাদের জন্মদান করেছে-যে মতবাদ বাস্তববুদ্ধি-প্রণোদিত জগৎ-সচেতন ইসলামের থেকে এত স্বতন্ত্র - এবং 'ভক্তি'ধর্মের সঙ্গে নিকট-সম্পর্কস্থানীয় ও সাদৃশ্যময়। ঠিক একইভাবে ইসলামি শিল্পকলা তার সম্ভাবনাহীন ও নিরাভরণ উন্মেষের পর থেকে বিকশিত হয়ে পৃথিবীর মহান শিল্প-সাফল্যগুলির একটিতে পরিণত হয়েছে।
ইসলামি শিল্পকলার সাফল্য স্থানীয় ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করার প্রতিভার সাহায্যেই সম্ভবপর হয়েছে। প্রথমে রোমক এবং খ্রিস্টীয় শিল্পধারার দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তীকালে অধিকৃত যে কোনও দেশের শিল্পধারাকেই ইসলামি শিল্পকলা গ্রহণ করেছে। পারস্যের ও ভারতের মতো সুপ্রাচীন শিল্প-ঐতিহ্যের দেশে গ্রহণের ও মিশ্রণের ফলাফল সর্বোত্তম হয়েছে। পারস্যের পুষ্পপ্রীতি ইসলামি জ্যামিতিক বিমূর্তির চেয়েও শক্তিশালী ছিল বলেই ইস্ফাহান ও শিরাজের মসজিদ উদ্ভিদের বঙ্কিম দেহরেখার ও গোলাপের অলংকার সজ্জিত, পারস্য ও ভারতের পুথিচিত্রে মানুষের ছবি ছড়াছড়ি, তুর্কি পুথিচিত্রে যা নেই এমনকি পারসিক শিল্পে পয়গম্বরের একটি চিত্র দেখা যায় এবং একটি মসজিদে মনুষ্যমূর্তির খোদাইও! ভারতের প্রাচুর্য-প্রবণতা ত্রয়োদশ শতকে আলতামাসের দেহলিতে নির্মিত কবরে ও তাঁর পুনঃপ্রসারিত মসজিদ-প্রাচীরের অলংকরণে প্রকাশিত। ভারতের বহু প্রাচীন মুসলিম সৌধই হিন্দু দেবগৃহ হতে আহরিত - মনুষ্যমূর্তি অপসারিত অথচ প্রাণীজ ও উদ্ভিদের অলংকারে সজ্জিত-স্থাপত্যাংশ দিয়ে নির্মিত। পলকাটা এবং অন্যান্যভাবে খোদিত অলংকারে ভূষিত গভীরভাবে অ-ইসলামি হিন্দু স্তম্ভাবলি প্রথমে মুসলিম স্থপতিদের দ্বারা ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীকালের উন্নত মুসলিম সৌধে মুসলিমদের খোদিত মসৃণ ও অলংকারবিহীন কিন্তু হিন্দু ধরনের পলকাটা ও বিভিন্নতলের খাঁজকাটা হিন্দুরীতির স্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছিল। মুসলিম বিজেতাদের হিন্দু ও জৈন শিল্পপ্রীতি এমনই ছিল যে উদাহরণস্বরূপ গুজরাটে তারা কড়িকাঠের উপর নির্ভরশীল শীর্ষভাগ সরাসরি অপসারণ করে নবনির্মিত মসজিদে ব্যবহার করতে থাকে তার উল্লেখ করা যায়। প্রায় এক পুরুষ কাল ধরে মুসলিম স্থাপত্যরীতি হিন্দু রীতির কড়ির সংস্থাপনকে অনুসরণ করে চলে সম্পূর্ণভাবে যথার্থ খিলান ও গম্বুজ প্রচলনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ন্যায় বাস্তব কার্যকারিতা ও শিল্পসৌকর্যগত সৌন্দর্য অনুভূত হওয়ার পূর্ব যুগে। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে মুসলিম সৌধ নির্মাণে হিন্দু কারুশিল্পী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দ্বারাই এই ব্যাপার সম্ভব হয়েছিল, কারণ স্থানীয় শিল্পীরা স্বাভাবিকভাবেই নবসৃষ্ট স্থাপত্য-পদ্ধতিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে অসমর্থ ছিল। কিন্তু ঢাকার ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দের 'বিবি পরী'র সমাধিসৌধে সামগ্রিকভাবেই কড়ির ছাদ গঠনের পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে-এটি এমনকি গম্বুজ-নির্ভর ছাদের সাধারণ ব্যবহারের চারশো বছর পরেও।
বাংলাদেশে মুসলিম-প্রবর্তিত স্থাপত্যরীতিতে রচিত মসজিদ, সমাধিসৌধ, নগর-তোরণ ও ভ্রমণকারীদের আবাসগৃহ সরাই প্রভৃতি এক সম্পূর্ণ অভিনব গঠনশৈলীর পরিচায়ক। মালদহ জিলার পাণ্ডুয়াতে অবস্থিত ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত সিকন্দর শাহ স্থাপিত আদিনা মসজিদের গঠন-পরিকল্পনা সরাসরিভাবে প্রাচ্যের। হয়তো দামাস্কাস শহরের সুবিশাল মসজিদ অথবা সামারা-র মসজিদসমূহের অনুপ্রেরণাতেই এটি গঠিত হয়। কিন্তু সমসাময়িক কালের বঙ্গীয় মসজিদের গঠন-প্রণালী অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার পরিধিতে সীমাবদ্ধ। চতুষ্কোণাকার সৌধশীর্ষে একটি গম্বুজ বা আয়তাকার কক্ষের ঊর্ধ্বে একাধিক গম্বুজের অবস্থিতিই এই রীতির উপাসনালয়ে আদিনার মতো বহু স্তম্ভ-বাহিত বৃহৎ আচ্ছাদিত বারান্দার প্রয়োজনকে নিঃশেষ করেছিল। একাধিক দিক থেকে সুলতানি আমলের মসজিদ ও সমাধিসৌধ পরবর্তীকালে বিবর্তিত প্রাদেশিক হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর উত্থানের সূচনাকাল। স্থাপত্যশিল্পের এই ধারা ষোড়শ শতকের বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল, দীনেশচন্দ্র সেন-বর্ণিত 'পৌরাণিক পুনরুজ্জীবনের'ই (রেনেসাঁস) অংশরূপে। চুন ও সৌধ-নির্মাণোপযোগী মিশ্রণ বা মশলার সহায়তায় গ্রথিত প্রকৃত খিলান ও গম্বুজের নির্মাণপদ্ধতি এনেছিল মুসলিমরাই। ইতিপূর্বে হিন্দুরা পরস্পরের উপর রক্ষিত প্রস্তর, বা কাদার উপর বৃহৎ ইষ্টক স্থাপন করত। মুসলিম যুগে ইষ্টকের আয়তন অনেকখানি ক্ষুদ্র হল, এবং মধ্যযুগের শেষপাদে অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরে ছাদও গম্বুজীয় পদ্ধতিতে রচিত। যদিও ভারতের অন্যান্য অংশের মতো বঙ্গীয় মন্দির বহির্ভাগের বিশেষত্বরূপে গম্বুজকে কখনই গ্রহণ করেনি। বৈদ্যপুরে সু-উচ্চ 'দেউল'-এর মতো কেবলমাত্র কয়েকটি মন্দিরেই বিগতকালের স্তরক্রমে ভার-বিতরণের ('করবেলিং') পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল। যদিও সাধারণভাবে চতুষ্কোণ গৃহ থেকে বৃত্তাকার গম্বুজের বিবর্তন চতুষ্কোণ স্তরক্রমিক ভার-বিতরণকারী স্থাপত্য-সংস্থাপনকে ভিত্তি করেই গঠিত হয়। প্রায় অবশ্যম্ভাবী রূপেই মুসলিম আগমনের উত্তরকালের হিন্দু মন্দিরসমূহে, এমনকি পূর্বতন প্রক্রিয়ানুসারী শিখরযুক্ত দেবগৃহেও কৌণিক-শীর্ষ-সমন্বিত খিলানের প্রবেশপথ একাধিক পত্রাকার অলংকরণের তরঙ্গে সজ্জিত। সূচালো বা তীক্ষ্ণ কোণের খিলান বাংলা সমেত সমগ্র ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্যেই ব্যবহৃত হয়েছে। পত্রালংকারে সজ্জিত খিলানও-মুক্ত রূপরেখে অথবা খোদিত রূপে-মুসলিম স্থাপত্যশৈলীরই একটি সাধারণ বিশেষত্ব। এ ধরনের খিলান পুরাতন দিল্লির সৌধাবলিতে-যেমন আলতামাসের সমাধিতে (১২৩৫) দৃষ্ট হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গৌড়-এর দারাসবাড়ি মসজিদের বহু তরঙ্গ-পত্রে ভূষিত ত্রিকোণ খিলান ইরাকের পশ্চিম সেলজুকীয় শিল্পের একটি বিশিষ্ট রীতিকে প্রতিফলিত করে। আবার পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদের মিহবাবের খোদিত তরঙ্গ-পত্রালংকার পারস্যের ইস্ফাহান শহরস্থিত দশম শতাব্দীর জোরজির মসজিদ অথবা ক্রেসওয়েল কর্তৃক তরঙ্গ-পত্রালংকারের সর্বপ্রাচীন নিদর্শনরূপে উল্লিখিত প্রথম শাপুর-এর রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত (২৪১-'৭২ খ্রিস্টাব্দে) সাসানীয় টেসিফোনের তাক-ই-কিসরা-র সঙ্গে তুলনীয়। মুসলিম-পূর্ব হিন্দু স্থাপত্যেও তুলনীয় নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের আজমিরের চওড়া ও অগভীর পত্র-তরঙ্গের খিলানপথে। নবম শতকের সামারার বিরাট মসজিদের গবাক্ষ অথবা হিন্দু শিল্পের সমধর্মী ত্রিপত্রী খিলানের উল্লেখও এ প্রসঙ্গে করা যেতে পারে। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে এ প্রকারের হিন্দু কুলুঙ্গির ব্যবহার করা হয়েছে কয়েকটি মিহরাবের জন্য এবং মসজিদের বহির্ভাগে ইষ্টক নির্মিত এ ধরনের অলংকরণও বর্তমান। একাদশ-দ্বাদশ শতকের গুজরাটি সোলাঙ্কি স্থাপত্যশৈলীর মধেরা-র সূর্যমন্দিরে ও সিদ্ধপুরের রুদ্রালয় মন্দিরের পত্র-তরঙ্গায়িত তোরণের ও কাষ্ঠ-নির্মাণের অনুকরণে রূপায়িত পশ্চিম ভারতীয় চৈত্যগুহাস্থি প্রবেশপথের শীর্ষস্থ অশ্বখুরাকার খিলানের দুইপার্শ্বের বক্রায়িত কড়ির গঠনভঙ্গির সাদৃশ্য ও সম্পর্ক উল্লিখিত হতে পারে।
মুসলিম শাসন যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের স্থাপত্যে ইসলামি রীতির খিলান বা গম্বুজ প্রচলনকারী তাই নয়, উপরন্তু স্থানীয় কয়েকটি স্থাপত্য-প্রবণতাকে এমন ভাবে আয়ত্ত করেছিল যে মুসলিম শাসনকালীন নবপ্রতিষ্ঠিত স্থাপত্যশৈলীটি একাধারে ইসলামি ও বঙ্গীয় রূপে বিবেচিত হবার যোগ্য। মালদহ জিলার পাণ্ডুয়াতে স্থিত পঞ্চদশ শতকের সূচনাকালের 'একলাখি সমাধিসৌধ'-র বক্রায়িত ছাদই এখনও দণ্ডায়মান ঐতিহাসিক কীর্তি-সৌধগুলির নিরিখে কুটিরে চালার স্থায়ী স্থাপত্য-রূপায়ণের সর্ব-পুরাতন উদাহরণরূপে, বঙ্গীয় স্থাপত্যে এক নবধারার আনয়নকারী; কারণ, উত্তরকালীন বহু স্থাপত্যরীতিই বক্রাকার চালের সঙ্গে যুক্ত। প্রাথমিকভাবে রেখ-দেউলে দৃষ্ট উর্ধ্বায়ত উচ্চতাভিলাষী হিন্দু বাস্তুরীতির পরিবর্তে বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলী একটি অপেক্ষাকৃত নিম্নাকার বিশালত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হয়তো স্থানীয় আবহাওয়া এবং ভূ-প্রকৃতির জন্য ও বর্ষণের জলধারাকে অল্পায়াসে অপসারিত করার প্রয়োজনে এই গঠনভঙ্গির উদ্ভব হয়েছিল। সাধারণ বঙ্গীয় মসজিদ পশ্চিম ভারতীয় ও অন্যান্য অঞ্চলের সৌধসমূহের চেয়ে কম উচ্চতাবিশিষ্ট এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার। বক্রাকার আলিশাই এর বিশিষ্টতা ও এ প্রকারের আলিশার রীতি মুঘল আমলে ক্রমে ক্রমে দেহলি, রাজস্থান, গুজরাট ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে। চতুষ্কোণ কক্ষায়তনের শীর্ষ-স্থায়ী এক-গম্বুজীয় রীতি একলাখি সমাধিসৌধকে পরবর্তী হিন্দু 'রত্ন' ও 'চালা' মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত করেছে আকারগত রূপে। 'চালা' মন্দিরের ক্ষেত্রে চারচালা গ্রাম্য কুটিরের মতো ছাদের উপর মধ্যস্থিত শীর্ষালংকারটি নির্মিত হয়েছে। পারসি ব্রাউন ও ড দানী দু-জনেই অনুমান করেন যে একলাখি-র দেওয়ালের সজ্জারীতি কুটিরের মতো বাঁশের কাঠামো ও তার মধ্যের মাটির দেওয়ালের দ্বারা অনুপ্রাণিত। একলাখি সৌধের চারিদিকে হিন্দুরীতির প্রস্তরের চৌকাঠের শীর্ষে সূচালো কোণের ইষ্টকের খিলানবিশিষ্ট একটি করে দরজা বা প্রবেশপথ বর্তমান। কিন্তু এর পরে মসজিদসমূহে সাধারণত একদিকে দেওয়াল বা পরবর্তী বঙ্গীয় হিন্দু মন্দিরের মতো স্তম্ভের দ্বারা পৃথকীকৃত তিনটি বা তার অধিক প্রবেশপথের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ধরনের স্তম্ভ ভারতের অন্য কোথাও দেখা যায় না এবং ব্রাউনের মতানুসারে আদিনার 'বাদশা-কা-তখৎ' ধারণকারী স্তম্ভই এ-শ্রেণীর স্তম্ভে প্রথম ব্যবহারের নিদর্শন। এই স্তম্ভের বামনাকার গড়ন, দর্শনীয় প্রস্থ ও পলকাটা অলংকারের বাহুল্য সাধারণভাবে পরিচিত বিশিষ্ট রীতির হিন্দুস্থাপত্যের নিদর্শন থেকে পৃথক একটি রূপ দান করেছে। মাঝে মাঝে এ ধরনের স্তম্ভ মুসলিমরা ব্যবহার করার পর (মুসলমানেরা একই হিন্দুরীতির দীর্ঘতর স্তম্ভ ব্যবহার করেছেন তাঁদের একাধিক গম্বুজকে ধরে রাখবার জন্য) একাধিক প্রবেশোপযুক্ত খিলানপথ-সমন্বিত ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতক কালের হিন্দু মন্দিরে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সহজেই জটিল অলংকারে ভূষিত হয়েছে। যখন এই সমস্ত স্থাপত্য ভঙ্গিমা-যথা স্থানীয় রীতির স্তম্ভ, কেন্দ্রস্থিত গম্বুজ বা শিখর, নিম্নায়ত আয়তাকার কক্ষ ও বক্রকার আলিশা পরস্পর যুক্ত হল তখন গৌড়ের 'কদম রসুল' (১৫৩১ খ্রি), যাতে পয়গম্বরের পদচিহ্ন রয়েছে (বিষ্ণুপদ বা বুদ্ধপদের মতো) তার অথবা বিষ্ণুপুরের হিন্দু মন্দির 'মদনমোহন'-এর সাদৃশ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠল। কোণে কোণে শিখর (রত্ন) যুক্ত করার হিন্দু স্থাপত্যরীতি (যেমন নবরত্ন, সপ্তদশরত্ন, পঞ্চবিংশতিরত্ন প্রভৃতি) সাক্ষাৎরূপে পূর্ববর্ণিত এই বিশিষ্ট শৈলীর থেকেই উৎপন্ন। এটিও আবার একদিক থেকে মুসলিম রীতি বলে গ্রাহ্য হতে পারে এবং সে অর্থে তাজমহল পঞ্চরত্ন এবং সাসারামের সমাধিসৌধের মতো বিভিন্ন স্তরে 'ছত্রী'-বিশিষ্ট বহু স্থাপত্যকীর্তিই যথেষ্ট অর্থবহ। এমনকি শিখরের সংস্থাপনে এ-ধরনের ব্যবহার মুসলিম উদ্ভাবনের ফলমাত্র নয়, কারণ এটি স্থাপত্য-সুসামঞ্জস্যের একটি মানবিক প্রবণতা - যেটি বুদ্ধগয়ার পঞ্চশিখরযুক্ত মন্দির-পরিকল্পনার চতুর্দশ শতকীয় ব্রহ্মদেশীয় উদ্ভাবনে অথবা চারিকোণে ও মধ্যে শিখর-বিশিষ্ট হিন্দু রীতির 'পঞ্চায়তন' মন্দিরে সহজলভ্য।
ভিলহেলম এইলার-এর সংবর্ধনা-পুস্তকে ড. ক্লাউস ফিশার একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ের বাসুদেব (১৬৭৯ খ্রি) মন্দিরের কেন্দ্রস্থিত চতুষ্কোণী কক্ষও তার শীর্ষস্থ গম্বুজ ও তার চারিদিকের নলাকার ছাদের বারান্দা ও কোণস্থিত শিখরাবলি পূরবর্তী ইসলামি শতাব্দীগুলি অতিক্রম করে সাসানীয় যুগের অন্তিমকালের টেসিফোন শহরের স্থাপত্যকীর্তির সঙ্গে বাস্তুনির্মাণশৈলীগতভাবে সম্পর্কযুক্ত। তবে আমরা ওই রকম এক নিদর্শন অপেক্ষাকৃত নিকটের অর্থাৎ বাংলার গ্রামাঞ্চলের দুইপার্শ্বে ও সম্মুখে বারান্দা-দেওয়া কুটিরের মধ্যেই দেখতে পাই (যদিও এ ধরনের কুটিরে নলাকার খিলানের ছাদ ও গম্বুজ অনুপস্থিত)। আমরা জানি না যে মুসলিম-পূর্বকালে বাংলাদেশে কুটিরসদৃশ মন্দির নির্মিত হয়েছিল কিনা, কারণ এ ধরনের সৌধ স্থাপিত হয়ে থাকলেও বর্তমানে এরূপ কোনও স্থাপত্যকীর্তির চিহ্ন নাই। কিন্তু পাল-সেন আমলের প্রস্তর-প্রতিমার প্রাচুর্য ও তৎসহ তদুপযুক্ত সংখ্যক বিরাটাকার মন্দিরের অনুপস্থিতির ফলে অনুমান করা যেতে পারে যে এ সমস্ত প্রস্তর-প্রতিমা হয়তো আড়ম্বরহীন মাটির কুটিরেই রক্ষিত হত (এখনও এ-প্রথা প্রচলিত আছে) এবং ফলে পরবর্তীকালে মাটির কুটিরের আদর্শেই পাকা ইমারতির মন্দির নির্মিত হতে থাকে অপেক্ষাকৃত স্থায়ী প্রকৃতির উপাদানের সাহায্যে। গ্রিক-প্রভাবিত স্থাপত্যকীর্তি ব্যতীত ভারতীয় মন্দির-স্থাপত্যের মূল উদ্ভব এই প্রকারেরই এবং আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর মহাবলিপুরমস্থ দৌপদীরথ কুটির-উদ্ভুত শৈলীর নিরালংকার ও সরলতম প্রকাশ। কিন্তু বিশিষ্টাকারের হিন্দুমন্দির শিখরের সংযোগে স্থানীয় মূলাকারটি পরে হারিয়ে ফেলে এবং শিখরযুক্ত হিন্দুমন্দির থেকে এর মূলরূপটি ধরা শক্ত হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র মধ্যযুগের শেষদিকের বাংলাদেশে মূল কুটিরের আকারকে রক্ষা করা হয় এবং সে জন্যই বাংলার মন্দিরের এতখানি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একলাখি সমাধিসৌধ এই মূলরূপটিকে বিবর্তনের সুযোগ দান করে কিভাবে রত্ন ও চারচালা, আটচালা প্রভৃতি আকারের স্থাপত্য-নিদর্শনের প্রচলনে সাহায্য করেছে তা আমরা দেখেছি। কুটির-শৈলীর মধ্যে 'দো-চালা' বা 'বাংলা' রীতি সর্বাপেক্ষা বিশিষ্টকার। গৌড়ে-র ফত খানের সমাধি এ-রীতির এক উল্লেখনীয় উদাহরণ (ফত খান ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গত হয়েছিলেন)। সপ্তদশ শতকের শেষপাদের অন্যান্য মুসলিম সৌধে, যথা মৈমনসিংহের এগারাসিন্দুর গ্রামের শাহ মুহম্মদ-এর মসজিদ-এর প্রবেশপথে, বা ঢাকাস্থিত করতলব খানের মসজিদে এই ধারাই লক্ষিত হয়। এগুলি হয়তো হিন্দু পুনরুজ্জীবনের নিকট হতে মুসলিম স্থাপত্যাদর্শগত ঋণ বা গ্রহণের প্রমাণ, কারণ গুপ্তিপাড়ার জোড়-বাংলা মন্দির এখনও স্থায়ী মুসলিম সৌধগুলি অপেক্ষা প্রাচীন বা পূর্বতন। অবশ্য এর থেকে প্রমাণিত হয় না যে এ-ধরনের প্রাচীনতর মুসলিম সৌধ ছিল না। অতএব আমরা দেখতে পাই যে কোনও মসজিদই পাল যুগের 'রেখ' বা 'পীঢ়' দেউলকে অনুকরণ করেনি অথবা কোনও মন্দিরই ইসলামি রীতির গম্বুজের বহির্ভাগের আকার অনুসরণ করেনি, কিন্তু যথেষ্ট প্রয়োগগত-ব্যবহারগত ব্যবধান থাকলেও স্থানীয় স্থাপত্য-ঐতিহ্যের নিকট হতে নানাভাবে প্রেরণা পাওয়া বঙ্গীয় মুসলিম সৌধাবলী ও হিন্দু মন্দিরসূমহ পরিকল্পনায় ও গঠনে যথেষ্ট সাদৃশ্যময় হয়ে উঠেছে।



অলংকরণের ক্ষেত্রে মূলজ পার্থক্য থাকলেও এই সাযুজ্য সহজেই ধরা পড়ে। হিন্দু অলংকরণে জীবিতাকারের বাহুল্য ও মুসলিম অলংকরণে এর নিষিদ্ধতা বর্তমান থাকলেও বাংলার শিল্পীরা কখনওই মুসলিম সৌধের অলংকারের ক্ষেত্রেও রৈখিক কুটিলতার মধ্যপ্রাচ্যীয় জ্যামিতিক সজ্জা বা নক্সাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার উপযোগী মনোভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে পারেননি। মুসলিম অলংকরণ-পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত অগভীর, বিমূর্ত, নিয়মাবদ্ধ এবং হিন্দুরীতির মতো প্রাকৃতিক ভাবানুসারী না হলেও উপরোক্ত পার্থক্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সত্য। বাংলার মুসলিম অলংকার-পদ্ধতি এদিক দিয়ে পারসিকদের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত বঙ্কিম রেখাঙ্কনকেই সাগ্রহে বরণ করেছে।
নিকটতর পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম রীতি অনেকাংশই পূর্বতন হিন্দু শিল্পশৈলী হতে আহরিত। পাণ্ডুয়া ও গৌড়ের এবং অন্যান্য স্থানের নব প্রতিষ্ঠিত বহু মুসলিম সৌধেই সম্পূর্ণ চৌকাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই এটি আশ্চর্য নয় যে, এর অলংকারসমূহ অনুকরণ করা হবে। হিন্দু সৌধের দরজার উপরিস্থিত চৌকাঠের স্তম্ভের ও পাল দেবপ্রতিমার দেহে ব্যবহৃত দোলায়মান রত্নমালিকা এবং বস্ত্রখণ্ডে সজ্জিত ও শিকলে ঝোলানো ঘণ্টার অলংকার পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে ও একলাখি সৌধে ঈষৎ স্থূল রূপায়ণে দর্শিত হয়েছে। অগ্নিশিখার ন্যায় কুণ্ডলীতে; প্রসারণে প্রকাশমান বা জলধারার মতো উচ্ছলিত এবং অরণ্যের ন্যায় সতত বর্দ্ধিষ্ণু ও ঘনসন্নিবিষ্ট উদ্ভিদালংকারে ভূষিত পট্ট (তুলনীয় নক্সা চ) পাল শিল্পকলার এক প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এ প্রকারের অলংকারও আদিনার ন্যায় প্রাচীনতর সৌধসমূহে থাকলেও পরবর্তীকালে অতিরিক্ত সজ্জিতভাবের অথবা অতিরিক্ত বন্ধনহীনতার কারণে মুসলিম সৌধ থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আদিনার মিহরাব-শীর্ষের পালযুগীয় রীতির দীর্ঘ ত্রিভুজাকার উদ্ভিদীয় সজ্জা ড দানির মতানুসারে বৌদ্ধ স্তূপের সঙ্গে এক সুদূরপ্রসারী যোগসূত্রে গ্রথিত। দিনাজপুর ও গৌড়ে প্রাপ্ত হিন্দু রীতির স্তম্ভাবলিতে উপস্থিত পার্শ্বাগত রূপায়ণের প্রস্ফুটিত পদ্মালংকার মুসলিম সৌধের বিশেষাকার 'ঢাল'-অলংকার 'গ্রন্থিসারী' অলংকারেও গৃহীত হয়েছে। কখনও কখনও হিন্দুরীতির নবগ্রহ বা দশাবতার ফলকে ব্যবহৃত ক্ষুদ্রাকার স্তম্ভার্ধ ('পিলাস্টার') দ্বারা এই গ্রন্থিসারীকে বিভক্ত করা হয়েছে। (তরঙ্গায়িত বৃক্ষকাণ্ড, পদ্ম ও হীরকখণ্ড, পদ্মপত্রের ধারা, ত্রিপত্র, ক্ষুদ্রাকার পুষ্পালংকার, শীর্ষালংকার, উড়ন্ত পতাকা, পাক-দেওয়া রশি বা দড়ি এ ধরনের পূর্বতন হিন্দুরীতির নিদর্শনের অনুকৃতির উদাহরণ অনেক বাড়ানো যেতে পারে। অন্যদিকে পূর্বতন হিন্দু স্থাপত্যালংকারেও জ্যামিতিক বিমূর্তির অভাব ছিল না পরস্পর-সন্নিবিষ্ট চতুষ্কোণ এবং হীরকীয় বহু-কৌণিক পরস্পর অতিক্রমকারী রেখাঙ্কন আমরা পাহাড়পুরের পাকজ মৃৎশিল্পে ('টেরাকোটা'), বাণগড়ে ও মহাস্থানে দেখেছি। এ ধরনের অনেক শৈলীই কেবলমাত্র হিন্দু বা মুসলিম শিল্পকলা নিজস্ব রূপে দাবি করতে পারে না, কারণ গুপ্তযুগীয় উদ্ভিদ পট্টালংকার একই ভাবেই বা সমপরিমাণেই 'গ্রেকো রোমান' বা 'সীদিয়' বলে অভিহিত হতে পারে। হয়তো বিশিষ্ট 'পামেট'-পুষ্পালংকারটি মুসলিমরা 'ক্ল্যাসিকাল' অথবা 'সাসানীয়' উৎস থেকে আহরণ করেছিল, কিংবা পাল ভাস্কর্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রহণ করেছিল। পাল পুষ্পালংকারের মতো সজ্জা জেরুসালেমের নবম শতাব্দীর 'ডোম অব দি রক' নামক মুসলিম সৌধে ব্যবহৃত হবার ব্যবহৃত হবার পর বহু স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ ভাবে অলংকরণে ব্যবহৃত হতে থাকে। আবার পরস্পরে জড়িত স্বস্তিকা চিহ্ন সারনাথের ষষ্ঠ শতাব্দীর বৌদ্ধ ধামেক স্তূপে ও বাংলাদেশের পরবর্তীকালীন হিন্দু মন্দিরে এবং মসজিদে দেখা যায় - আবার এটি গ্রিক স্থাপত্যেও বহুলব্যবহৃত। সুষ্ঠু বিচারে দেখা যাবে যে বিমূর্ত অলংকরণ এতই বিশ্বজনীন যে আদিনার কেন্দ্রস্থিত মিহরাবের ভূষণে ও হিন্দু অলংকাররীতির মধ্যে বিশেষ সাযুজ্য বর্তমান। এইভাবেই মকর-পুচ্ছের প্রকৃতি খাঁজ-খাওয়ানো বৃত্তরেখায় পর্যবসিত করা সম্ভবপর হয়েছে।
যদিও আমরা মুসলিম-পূর্ব স্থাপত্যকলা সম্পর্কে অল্পমাত্রই জানি এবং যদিও আমাদের ওই সময়ের স্থাপত্যশৈলীসমূহের সম্পর্কে ধারণাটি আংশিকমাত্র তাহলেও আমরা নিরাপদেই বলতে পারি যে প্রাচীন হিন্দু ও মুসলিম রীতির স্থাপত্য অপেক্ষা পরবর্তী হিন্দু ও মুসলিম রীতির স্থাপত্যের অধিকতর ধারাবাহিকতা আছে। সূচনায় বঙ্গীয় মুসলিম শিল্পধারা পূর্বতন ধারা বিরোধী ছিল। আবার পরবর্তী হিন্দু রীতি অপেক্ষাকৃত কম অসহিষ্ণুতার আবহাওয়াতেই বর্ধিত হয়েছিল। এছাড়াও গুরুসদয় দত্ত প্রমুখ লেখকরা মনে করেন যে পাল-সেন শিল্পকলা অভিজাতধর্মী এবং বহিরাগত আরোপণের ফল এবং পাহাড়পুরের নবম শতাব্দীর দেশজ লোকমানসের অ-বিদগ্ধ শিল্পরীতি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল ইসলামের দ্বারা ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রানুশাসন-বিজড়িত আধিপত্য ভগ্ন হওয়ার সময়ে এবং হিন্দু পুনরুজ্জীবনে, বৈষ্ণব অনুপ্রেরণায় পরবর্তীকালে আপনাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। ড. দানি আদিনার 'টেরাকোটা' অলংকরণের 'প্রাণোচ্ছলতা ও মূল দৃষ্টিভঙ্গি'কে পাহাড়পুর ও ময়নামতীর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
নিশ্চিতভাবেই মুসলিমরাই পাকজ মৃত্তিকার (টেরাকোটা-র) অলংকারকে স্থাপত্যে ব্যবহারের রীতি হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। কারণ দশম শতকের পরে পাহাড়পুরে এ রীতি অনুসৃত হয়নি এবং পরবর্তী পাল-সেন যুগের মন্দিরেও দেখা যায় না। এবং এর মধ্যে এখনও দণ্ডায়মান কিছু মন্দিরের জমানো চুনের ('স্টুকো') অলংকারই মাত্র রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালের মুসলিম ও হিন্দু সৌধাবলিতে পাকজ মৃত্তিকার ব্যবহারের পদ্ধতি সংস্থাপন ও শিল্পপ্রকৃতির দিক থেকে পৃথক। পূর্বতন বৌদ্ধ স্থাপত্যে পাকজ মৃত্তিকার ফলক দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় দুই 'ফুট' ও প্রদক্ষিণ পথপার্শ্বের প্রাচীরের গাত্রে সারিবদ্ধভাবে উপরে নীচে অলংকৃত পাড় দিয়ে সজ্জিত। কিন্তু পরবর্তীকালের ফলক আকারে কয়েক 'ইঞ্চি' মাত্র ও নানানভাবে সজ্জিত খিলানের চারপাশে অথবা সমগ্র সৌধের সম্মুখস্থ দেওয়ালে। মুসলিমরাই পঞ্চদশ শতাব্দীর মসজিদে ও সপ্তদশ শতকের মন্দিরে দৃষ্ট সূক্ষ্মভাবে খোদিত ফলকের প্রচলন করে ও বহু প্রকারের অলংকৃত পাড়ের ব্যবহার করে, যে সমস্ত পাড় পরবর্তী হিন্দুমন্দিরে দেহরূপায়ণ-সমন্বিত ফলকের মধ্যবর্তী স্থানের প্রসারতাকে আচ্ছাদিত করার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সৌধ-সম্মুখের মূল রূপরেখকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
একটি বা তিনটি প্রবেশপথ এবং সূচালো খিলানের উপরের স্থানই এই অলংকারসজ্জার মূল প্রস্ফূটন-স্থান। প্রস্ফুটিত পদ্মের বৃত্তালংকার খিলানের মধ্যবর্তী স্থানে দিয়ে খিলানশীর্ষের আয়তাকার ক্ষেত্রের সৌন্দর্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এই ধরনের পদ্মালংকার মধ্য-প্রাচ্যের মুসলিম স্থাপত্যের একটি প্রাচীন রীতি ও ভারতে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভেই কুতব-এ ও আজমিরে ব্যবহৃত হয়েছিল। খিলান-মধ্যবর্তী স্থানের ধারগুলিতে জ্যামিতিক রেখাঙ্কনের অলংকারের অবতরণ-যেটি প্রধানত ইসলামি রীতির এবং সূচালো ত্রিপত্র (নক্সা ক ও খ) হতে বিবর্তিত। তবে এ প্রকারের অলংকার মধ্যযুগীয় হিন্দুমন্দিরের চৈত্য-গবাক্ষ প্রতীকেও বর্তমান। এই ধরনের রেখাঙ্কন হিন্দুরীতির শীর্ষালংকারে ভূষিত হত এবং মধ্যভাগ হতে পৃথকীকৃত ছিল। এবং অনেক সময়েই যুগ্ম পদ্মালংকারসহ (যা কখনও বা 'রাসমণ্ডলে' পরিণত) পরবর্তী হিন্দুমন্দিরের প্রবেশপথের উপরে অলংকার রূপে দেখা যায়। পূর্বতন হিন্দুমন্দিরের 'করবেল'-করা প্রবেশপথে প্রায় প্রচুর খোদিত অলংকারে সজ্জিত প্রস্তরের কাঠামো ব্যবহার করা হত-এ পদ্ধতি পরবর্তীকালে ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালের হিন্দুমন্দিরের প্রবেশপথের একটি পূর্বানুসৃত নিদর্শন হয়তো প্রতিমা-রক্ষণের কুলুঙ্গিতে দেখা যেতে পারে, যেটি মুসলিমরা মিহরাব-এর জন্য ও বহির্ভাগের প্রাচীর-সজ্জার জন্য ব্যবহার করেছে। যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে যে পত্র-তরঙ্গের খিলান আংশিকভাবে বিগ্রহের কুলুঙ্গির সূঁচালো অথবা বৃত্তায়িত ত্রিপত্র অলংকরণের দ্বারা প্রভাবিত, যেমন আশুতোষ সংগ্রহশালার বহুল পরিচিত সুন্দরবনের খাড়ি হতে একাদশ শতাব্দীর নিদর্শনটি, - যাতে স্তম্ভার্ধের ব্যবহারও দেখা যায়। একলাখি সমাধিসৌধের বাহির হয়ে স্তম্ভার্ধগুলি খাড়িতে প্রাপ্ত নিদর্শনের স্তম্ভার্ধের এক দূরাগত প্রতিধ্বনিস্বরূপ। আদিনা মসজিদের (চিত্র সংখ্যা ১) বহিঃপ্রাচীর রূপায়ণে স্তম্ভার্ধের ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি, কিন্তু একদিক থেকে এই সমস্তটিই রামপাল (ঢাকা জিলা) ও সাজাদপুর (পাবনা জিলা) এই দুই স্থানে পরবর্তীকালের মসজিদসমূহের সম্মুখভাগের মতো হিন্দু অলংকরণরীতির আশ্রয়ী। আরও পরের যুগে এ ধরনের অলংকৃত কুলুঙ্গির বিশিষ্ট মুসলিম রীতির অলংকারে ভূষিত হয়ে সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত বর্ধমান জিলার ইছাই ঘোষের দেউলে (চিত্র সংখ্যা ৩ দ্রষ্টব্য) আবির্ভূত হয়েছে। এই শ্রেণীর কুলুঙ্গির আরও ব্যাপক ও সাধারণ ব্যবহার সমগ্র মুঘল-পুর্ব যুগীয় মিহরাবেই প্রকাশিত। হুগলি জিলার পাণ্ডুয়াস্থ বড়ি মসজিদের ঊনবিংশ মিহরাবে হিন্দুরীতির স্তম্ভার্ধ ইষ্টকে অনুকরণ করা হয়েছে। এই স্থাপত্যটি জরাজীর্ণ হলেও হয়তো বাংলাদেশের এখনও দাঁড়িয়ে-থাকা অপরিবর্তিত ও সর্ব-প্রাচীন মসজিদরূপে গণ্য হতে পারে। এর স্তম্ভার্ধগুলিতে হিন্দু শৈলীর রত্নমালা, ঝোলানো ঘণ্টা প্রভৃতি আছে, যেমন এই মসজিদেরই মধ্যে (চিত্র সংখ্যা ২) ইতস্তত ছড়ানো প্রাচীনতর প্রস্তর স্তম্ভসমূহে উৎকীর্ণ। এখানে পত্র-তরঙ্গের সংখ্যা পাঁচটির অধিক নয় এবং অন্তত একটি হিন্দুশৈলীর বৃত্তায়ত ত্রিপত্রের ব্যবহার রয়েছে। খিলানের উত্থান-প্রান্তে হিন্দুরীতির অনুগামীরা মকর, হংস, অলংকৃত পেখমের ময়ূর (হংস তোরণ, মরক-তোরণ তুলনীয়) প্রভৃতি স্থাপন করত। মুসলিমরা এ-প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়ে, আমরা আগেই যেমন লক্ষ করেছি তেমনি, এক ত্রিপত্রের অর্ধাংশের রেখাঙ্কনের প্রচলন করে ও মৃণালশীর্ষের থেকে উত্থিত পদ্মের ( সূর্যদেবের হস্তধৃত পুষ্পদ্বয়ের মতো) ব্যবহার করে। উত্তরকালে এ প্রকারে, অলংকারে সজ্জিত অনেক স্তম্ভার্ধযুক্ত কুলুঙ্গি একক প্রবেশপথের হিন্দুমন্দিরে আদর্শ রূপে অনুসৃত হয়েছে।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মসজিদ ও মন্দিরের স্থাপত্য-সজ্জা পূর্ববর্তী কালাপেক্ষা অধিকতরভাবে একে অন্যের উপর আরোপিত হয়। অনেক প্রকৃতির স্থাপত্যরীতিই মুঘল-পূর্ব যুগের অন্তিমকালের মসজিদ হতে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের প্রাচীনতম মন্দিরসমূহে গৃহীত হয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে মসজিদগুলিই হয়তো ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে অধিক সংখ্যায় নির্মিত হিন্দু মন্দিরের নিকট হতেই স্থাপত্য-অলংকরণের বেশ কয়েকটি আয়ত্ত করে নেয়। রাজশাহী জিলার কুসুম্বা-র মসজিদের মিহরাবের মতো ষোড়শ শতকের মধ্যভাগের মসজিদের মিহরাবসমূহের বহির্ভাগে একটি অথবা দুটি সমান্তরাল অলংকৃত বন্ধনীর ব্যবহার দেখা যায়। তলা হতে উপরে এবং শীর্ষের প্রস্থ বা প্রসারে শায়িত এই বন্ধনীর সজ্জা হিন্দু প্রবেশপথের সঙ্গে মিহরাব-সজ্জার সাদৃশ্যকে আরও বর্ধিত করে তুলেছে। প্রায় সমসাময়িক যুগেই পূর্বতন হিন্দুমন্দিরের কয়েকটি অলংকার-সজ্জা পুনরায় প্রকাশিত হয়। প্রবেশদ্বারের উপরিস্থিত এক ধরনের আলংকারিক ধনুকাকার (নক্সা গ) পুরাতন দরজার পাথরের কাঠামোতে ব্যবহৃত হত। এটি
এখন পদ্মদলে, ঝোলানো আলংকারিক পট্টবস্ত্রে, তরঙ্গায়িত খাঁজে (নক্সা ঘ ও ঙ) আরও সুসজ্জিত ও অলংকৃত হয়ে ওঠে, কিন্তু মিহরাব-এর চতুস্পার্শ্বস্থ পাড়ের নিকটে এর অবস্থিতিতে মনে হয় যে অলংকৃত সংযোজনের এই নবলব্ধ অনুপ্রেরণা হিন্দু রীতির দ্বারের কাঠামো হতেই এসেছিল। তরঙ্গায়িত খাঁজের মধ্যবর্তী স্থানের বাহিরের দিকে এক শ্রেণী পাকানো শিখার মতো অলংকার ও আরও একটি পুনরাবির্ভুত স্থাপত্যসজ্জা। এটি সেন দেবপ্রতিমা প্রভাবলী-স্থিত শূন্যস্থান পূরণোপযোগী অলংকৃত উদ্ভিদ-সজ্জাকে স্মরণ করিয়ে দেয় (নক্সা চ দ্রষ্টব্য)। এটি কালনার (বর্ধমান জিলা) ষোড়শ শতকের মসজিদে, হাড়োয়ার (চব্বিশ পরগণা জিলা) ও রাজনগরের (বীরভূম) অনিশ্চিত তারিখের পরবর্তীকালের মসজিদে এবং বৈদ্যপুর (বর্ধমান জিলা ১৫৭৮ খ্রি), রায়নগর (যশোহর ১৫৮৮ খ্রী - নক্সা জ), উজানী (ফরিদপুর) প্রভৃতি স্থানের মন্দিরে সপ্তদশ শতকে নির্মিতরূপে কথিত গুপ্তিপাড়ার (হুগলি জিলা) জোড়াবাংলা মন্দিরে দৃষ্ট হয়। এটি খেরুর-এর (মুর্শিদাবাদ জিলা ১৪৯৪ খ্রি) মসজিদে উন্মেষের ভ্রূণাবস্থায় অথবা ঝোলানো অলংকারের অংশরূপে নতুনহাট (নক্সা ছ) ও কুলুটে লক্ষণীয় এবং পরবর্তী স্থাপত্যরীতিতে লম্ভদানরত সিংহের দ্বারা অপসারিত। পরস্পর জড়ানো বা পাক-খাওয়া উদ্ভিদ ও পুষ্পালংকারের বিমূর্ততর রূপায়ণ ও পত্র হতে বিবর্তিত 'কমা' চিহ্নে সমন্বিত আলংকারিক পট্টালংকার মন্দির ও মসজিদের স্থাপত্য-সজ্জায় সর্বাধিক পার্থক্যের পরিচয় দান করে। অলংকারের এই উন্নয়নও আমরা কুসুম্বার মিহরাবে দেখি।
এই মধ্যবর্তী সময়কালীন সৌধাবলিতে অলংকার-সজ্জার সাদৃশ্যটি দেখবার মতো। স্বাভাবিকভাবেই মসজিদে কখনওই মানুষ বা মনুষ্যেতর জীবের রূপায়ণ হয়নি। তেমনি এই সময়ের হিন্দু মন্দিরেও দেহ-রূপায়ণের নিদর্শন নেই এবং সমস্ত অলংকারই ওই সময়ের মসজিদের অলংকারেরই অনুরূপ। বৈদ্যপুরের মন্দিরে একটি সংকীর্ণ পাড়ের মধ্যে রামায়ণের রূপায়ণ আছে, কিন্তু অন্যভাবে দেখলে খুলনা জিলার কোদলা মঠের মতো এতে মুসলিম রীতির পাড়ের অলংকারই বেশি। রাজনগরের মসজিদে মৈমনসিংহ জিলার আতিয়া-স্থিত মসজিদে (১৬০৯ খ্রি) অথবা ভূষণা-গোপালপুর বা ননীক্ষীর (ফরিদপুর জিলা) মন্দিরসমূহে একই শ্রেণীর ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদে ব্যবহৃত পুষ্পসজ্জিত ফলকালংকারের অবস্থান হয়েছে। হুগলি জিলার আরামবাগ সাব-ডিভিশনের কৃষ্ণনগরস্থিত রাধাবল্লভ মন্দির এ ধরনের স্থাপত্য-প্রবণতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এতে মন্দিরের সম্মুখভাগ দীর্ঘাকার আয়তক্ষেত্রের মধ্যবর্তী পদ্মচক্রাকার অলংকরণে এবং ঊর্ধ্বের ও নিম্নের তরঙ্গায়িত রূপায়ণ এবং সম্মুখভাগের আচ্ছাদিত অংশের দুই পার্শ্বের ভিতরের দিকে পান পাতার ('হার্ট শেপড') মতো মধ্যবর্তী অলংকার ও উপরে বঙ্কিম চন্দ্রকলার ভিন্নধর্মী স্থাপত্য সজ্জার ব্যবহার দর্শনযোগ্য। এ-সমস্ত রূপায়ণ বিশেষভাবেই ইসলামি রীতির খেরুর, বাজুয়া, নতুনহাট, রাজনগর, এগারাসিন্দুরের পঞ্চদশ শতকের শেষ পাদ হতে সপ্তদশ শতকের মধ্যাহ্ন কালের মসজিদসমূহে বর্তমান। আবার বাঘনাপাড়া (বর্ধমান জিলা ১৬১৬ খ্রি), বৈচিগ্রাম (হুগলি জিলা ১৬৮২ খ্রি) ননীক্ষীর (ফরিদপুর জিলা) প্রভৃতি স্থানের মন্দিরের স্থাপত্যালংকারও অনুরূপ। কৃষ্ণনগরের রাধাবল্লভ মন্দিরের সম্মুখের আচ্ছাদিত অংশের অভ্যন্তরে অগভীর কুলুঙ্গিতে তরঙ্গায়িত অলংকার দুই খিলানের মধ্যবর্তী অংশে পদ্ম ও কেন্দ্রস্থ ঝোলানো অলংকার এবং পুষ্প ও উদ্ভিদের কুণ্ডলাকার আকর্ষ প্রভৃতি মুসলিম রীতির অলংকার সজ্জিত। আদিনা মসজিদের বহির্ভাগের প্রাচীরগাত্রে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর এই অলংকারটি কদম রসুল সৌধের সম্মুখভাগে ষোড়শ শতকের বহুবার ব্যবহৃত হয়ে একটা স্থায়ী ও প্রচলিত রূপ পেয়েছিল। কৃষ্ণনগরের মন্দিরের ভিতরে দরজার অলংকৃত কাঠামো কুসুম্বা মিহরাবের অলংকরণের অনুগামী ও সপ্তদশ শতকের বহু মন্দিরেই উপস্থিত (যেমন বাঘনাপাড়া, বৈচিগ্রাম, বিষ্ণুপুর, বাঁশবেড়িয়া প্রভৃতি)। সমগ্রভাবে বলতে কৃষ্ণনগরের মন্দিরটিতে দেহজ রূপায়ণ প্রায় নেই বললেই চলে এবং উপরে বর্ণিত ফলকালংকার ও অন্যান্য সজ্জা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের মসজিদেরই মতো। গোকর্ণ (মুর্শিদাবাদ জিলা ১৫৮০ খ্রি), রায়নগর (যশোহর জিলা ১৫৮৮ খ্রি), তরাস (পাবনা জিলা ১৬৩৫ খ্রি) এ-সমস্ত অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত প্রাচীনকালের হিন্দুমন্দিরসমূহে পৌরাণিক কাহিনির দেহজ রূপায়ণ ও মসজিদে সহজলভ্য অলংকারের বেড় ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও ষোড়শ শতাব্দীতেই মসজিদের অলংকরণ ব্যতীত শুধুমাত্র হিন্দুরীতির পৌরাণিক চিত্র কৃষ্ণলীলার দৃশ্য ও অন্যান্য সামাজিক দৃশ্যাবলির সাহায্যেও মন্দির অলংকৃত হয়েছে। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হরিপুরগড়ের (ময়ূরভঞ্জ) রসিক রায় মন্দিরে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রবেশপথের ফলকসমূহ বিনিষ্ট হয়েছে। কিন্তু এর পরবর্তীকালের ঘুরিসা-র (বীরভূম ১৬৩৩ খ্রি) 'লঙ্কাযুদ্ধে'র পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এর থেকে অনুমিত হতে পারে যে অন্তত ষোড়শ শতাব্দী হতে মন্দিরে কর্মরত একদল কারুশিল্পী আপেক্ষিকভাবে মসজিদের স্থাপত্য-সজ্জার প্রভাবমুক্ত ছিল।
মুঘলযুগে একপ্রকারের গভীরতর ফলকালংকার গৃহনির্মাণের মশলার আস্তরণ দিয়ে মসজিদের প্রাচীর আবৃত করা হতে থাকে পাকজ মৃত্তিকার (টেরাকোটার) অলংকার অপসারিত করে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে মৈমনসিংহ জিলার কয়েকটি নিদর্শন ব্যতিরেক 'টেরাকোটা'র অলংকার কেবলমাত্র মন্দিরেই ব্যবহৃত হতে থাকে ও মসজিদের অনুরূপ রূপসজ্জা অপসারিত হয়। পরবর্তীকালীন 'টেরাকোটা' বা পাকজ মৃত্তিকার অলংকারে ভূষিত মৈমনসিংহের এগারাসিন্দুরস্থ সাদি মসজিদ (১৬৫২ খ্রি) অথবা আতিয়াস্থ মসজিদে (১৬০৯ খ্রি) আমরা দেখি যে মিহরাবের সজ্জা (কুসুম্বা (১৫৫৮ খ্রি) মসজিদ হতে হিন্দু মন্দিরের প্রবেশপথের সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্যযুক্ত। এ ক্ষেত্রে মন্দির থেকে মসজিদ অলংকরণের অভিমুখে যাত্রার চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বীরভূম জিলার রাজনগরস্থ মতিচূড়া মসজিদে ঐতিহ্যমণ্ডিত ইসলামি অলংকার ও হিন্দুরীতির রূপসজ্জার মিশ্রণ দেখা যায় অনুরূপভাবেই। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনি-আশ্রয়ী হিন্দুরীতির দেহজ রূপায়ণের রূপসজ্জায় মণ্ডিত মন্দিরে ইসলামি রীতির বেড়ে অলংকার যেমন একদিকে ব্যবহৃত হয়েছিল তেমনই বাংলাদেশের মসজিদে প্রাচীনতর হিন্দুরীতির অলংকার উপস্থিত ছিল। অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতাব্দীর চেয়ে এই প্রবণতার সাক্ষাৎ সপ্তদশ শতকের সৌধসমূহে অধিকতর পরিমাণে দৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে নলডাঙায় আতিয়া মসজিদের মতো ইসলামি রীতির জ্যামিতিকধর্ম-বিজড়িত অলংকার আছে। সরলতর পুষ্পীয় বিজড়িতালংকারের সাধারণ ব্যবহার অষ্টাদশকে অতিক্রম করে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। স্থাপত্যস্থান পুর্ণকরণ বা পৃথকীকরণের জন্য নিয়োজিত মসজিদের অলংকারে (প্রায়ই পূর্বতন হিন্দুযুগ হতে প্রবাহিত) হীরক ও বৃত্ত, পাকানো রজ্জু, পদ্ম দলের সারি (পরস্পর জড়িত), ঝোলানো অলংকার অথবা শীর্ষালংকার, ঝুলন্ত পুষ্প অথবা কোরকের শ্রেণী, পরস্পরকে কেটে-যাওয়া বৃত্ত, পুষ্পসজ্জিত তরঙ্গায়িত রেখা, পরস্পর অতিক্রমকারী সরলরেখা, চতুষ্কোণী অলংকার, মুক্তামালা ও কম্পিত বা খাঁজকাটা রূপরেখের অলংকার প্রভৃতি দেখা যায়। এই সমস্ত অলংকার সাধারণত গৌড়ে বিবর্তিত প্রবেশ পথের উপরের সংকীর্ণ বেড় সমূহেই উৎকীর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় সূচালো ত্রিপত্র, বর্শাফলক বা টিকলি মসজিদের খিলান-মধ্যস্থিত রেখাঙ্কনে ও মন্দিরে উপরে প্রসারিত ও নিম্নে ক্ষুদ্রায়িত রূপে আপন অধিকারেই উপস্থিত। পদ্মের মতো একটি বিশিষ্ট হিন্দু স্থাপত্যরীতি অনুসারী অলংকার মুসলিম যুগের সময়ে ও তার পরবর্তী যুগেই আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এর উৎপন্ন উন্মুক্তদল পুষ্পালংকার ও চক্রাকার পদ্মদলের সজ্জা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় ছিল। আবার মুসলিম স্থাপত্যরীতির সৌধ-প্রান্তের উচ্চ-নীচ স্থাপত্য অলংকার বা 'ব্যাটলমেন্ট' কান্তনগরের রত্নমন্দিরের মতো স্থাপত্যকর্মে ব্যবহার করা হয়েছে।
অষ্টাদশ শতক এগিয়ে আসার সাথে সাথে মন্দিরের স্থাপত্যালংকার স্থূলতর হয়ে পড়ে। গৌড়ের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত রূপ ও সূক্ষ্মতার পরিবর্তে বাস্তবানুগ উদ্ভিদালংকারের প্রচলন হয় এবং এই স্থূল ও অপেক্ষাকৃত অপটু হাতের অলংকরণ হিন্দু পুনরুজ্জীবনের যুগের প্রারম্ভকালীন পট্টালংকারকে সরিয়ে দেয়। পুষ্পালংকার মুঘল কায়দায় সুসমঞ্জস গুচ্ছে রূপায়িত হতে থাকে। সৌধ-সম্মুখের প্রান্তে বা পাদদেশে, প্রবেশপথের খিলান-শীর্ষে, স্তম্ভে যথেষ্ট জটিল এবং পশু পাখির রূপায়ণ-যুক্ত। হিন্দু সৌধের এই নবসজ্জা বা অলংকার মসজিদের অলংকার অপেক্ষা পুথিচিত্রের মতো অন্য কোনও মাধ্যম হতে আহরিত বলে মনে হয়। কখনও কখনও মন্দালয় (হুগলি জিলা ১৭৫৮ খ্রি) বা গোবরহাটি (মুর্শিদাবাদ জিলা ১৭৭২ খ্রি) এ দুটি স্থানের মন্দিরের মতো সমগ্র স্থাপত্যটিতে এ ধরনের মানবদেহ রূপায়ণহীন অলংকারে সজ্জিত করা হয়েছে মসজিদ হতে মন্দির অলংকারে বিবর্তনের ধারায়। প্রায়ই এই শ্রেণির অলংকারের সম্পর্কযুক্ত রূপায়ণ জামানো চুন বা 'স্টুকো'র সাহায্যে করা হয়েছে। এটি এমন কিছু নতুন প্রথা নয়, কারণ 'ল্যাটেরাইট' বা মাকড়া পাথরের এই পর্যায়ের অলংকার বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জিলার অনেক মন্দিরেই আছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের সূচনাকাল থেকে। এ ছাড়া বেড়াচাঁপার (চব্বিশ পরগণা জিলা) প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে আবিষ্কৃত মন্দিরেও 'স্টুকো'র ব্যবহার আছে। সুন্দরবনের সুউচ্চ জটার দেউলে এ শ্রেণীর সুন্দর অলংকারের ব্যবহার যথেষ্ট পুরাতন। আবার বর্ধমানের সাতদেউলিয়ায়, বাঁকুড়ার বহুলাড়া ও সন্তোপাল এবং পুরুলিয়ার বোড়ামস্থিত (দেউলঘাট) মন্দিরসমূহেও দেখা যায় জমানো চুনের অলংকারের ব্যবহার। শেষোক্ত মন্দিরসমূহ পাল-সেন যুগের বলে নির্দিষ্ট হলেও এর অলংকার অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী সংযোজনের ফলমাত্র। এই সমস্ত স্থাপত্য সৌধের সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে 'স্টুকো' অলংকরণের উন্নতিশীল ব্যবহার মুসলিমদের বাংলাদেশে আগমনকাল থেকে সুপ্রচলিত ছিল। এই ঘটনা থেকে সিরিয়ায় ও পারস্যদেশে চলিত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত 'স্টুকো'-অলংকার মুসলিম আগমনকারীরা বাংলাদেশে গ্রহণ না ক'রে 'টেরাকোটা'-র পুনরুত্থানে অধিক উৎসাহী হয়ে উঠল কেন এই প্রশ্ন ওঠে। পাকজ মৃত্তিকার অলংকার বা 'টেরাকোটা' নিশ্চিতভাবেই সুন্দরতর ও আরও আকর্ষণীয় এবং পরবর্তীকালের হিন্দু মন্দিরে 'টেরাকোটা'র অপসারণ হয়েছিল ইষ্টকের উপর জামাটচুনের অলংকারের দ্বারা এবং এই পদ্ধতি ক্রমশই অবশ্যম্ভাবী নিম্নাভিমুখী মানের দিকে এগিয়ে চলে। ইতিমধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে 'টেরাকোটা'য় ইয়োরোপীয় প্রভাবের এক নব্যরীতি দেখা দেয়। এই ধারা পূর্ব হতে চলিত মুসলিম অলংকরণের অবশিষ্টাংশকে আরও কমিয়ে দেয়। কিন্তু এইভাবেই মূল ইয়োরোপীয় উদ্ভিদালংকারের প্রভাবে উদ্বুদ্ধ মুঘল প্রতীকসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলা ও সর্বমতগ্রাহিতার যুগ। বীরভূম জিলার দুবরাজপুরস্থ একটি মন্দিরের সম্মুখে একটি বিশিষ্ট নিদর্শন আছে যাতে জ্যামিতিক অথবা জ্যামিতিকভাবাপন্ন পুষ্পালংকার থাকলেও তাকে আমরা বিশেষরূপে ও নির্দিষ্টভাবে মুসলিম রীতির বলে অভিহিত করতে অসমর্থ। আধুনিক যুগের আগমনকালে শিল্পী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকবৃন্দ তাদের মনোমতো যথেচ্ছ রূপায়ণের পথ নিয়েছিল। বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জিলায় এই সময়ে হিন্দু রীতির 'রেখ'-রূপটি মন্দিরে পুনরায় অনুসৃত হতে থাকে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে মসজিদ ও মন্দির ইয়োরোপীয় প্রভাবের আয়ত্তে এসে পড়ে। সুতরাং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তাদের বিশিষ্ট রূপটি কার্যত নিশ্চিহ্ন ও হতপ্রাণ হয়ে পড়ে। ক্রমশ অলংকারের পরিমাণ কমে আসতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মন্দির ও মসজিদ উভয়ই পলেস্তারার মসৃণ ও রঙে-ধোওয়া রূপ পরিগ্রহণ করে। কেবলমাত্র গম্বুজ ও শিখর তাদের প্রকৃতির পরিচয় দিতে শুরু করে।
মতামতের জন্য দ্রষ্টব্য
১. K.A.C Creswell Early Muslim Architecture
২. Percy Brown Indian Architecture (Islamic Period), ch VIII
৩. H. N. Dani Muslim Architecture in Bengal
Professor David McCutchion এক্ষণ-এর জন্য বিশেষভাবে লিখেছেন এই প্রবন্ধটি-Hindu-Muslim Artistic Continuities in Bengal।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ সান্ত্বনা বসুমল্লিক।
৬ষ্ঠ বর্ষ ৫ম সংখ্যা
(কার্তিক-মাঘ ১৩৭৫)



Download and Comments/Join our Facebook Group