Ticker

6/recent/ticker-posts

সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ: প্রথম খণ্ড, গান

সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ: প্রথম খণ্ড, গান
সংকলন ও সম্পাদনা: সবিতা চৌধুরী, অন্তরা চৌধুরী, রণবীর নিয়োগী


সলিল চৌধুরীর সাংগীতিক প্রতিভা বা বহুমুখিতা এ আলোচনার পরিসরের বাইরে, তা নিয়ে কথা বলার জন্যও অর্জন করতে হয় অধিকার। এক পাঠক ও রসিক শ্রোতার দৃষ্টিতে যদি দেখা যায়, সলিল চৌধুরীর এই রচনাসংগ্রহের সূচনা জরুরি এক পদক্ষেপ, কারণ ভারতীয় ও বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তাঁর স্থান যে অত্যন্ত উঁচুতে, সে নিয়ে সংশয় নেই কারও, তাই এহেন শিল্পীর যাবতীয় রচনা গ্রন্থ-আকারেও প্রকাশিত হওয়া উচিত, যেমন পাশ্চাত্য সংগীতের ক্ষেত্রে বেটোভেন বা মোজ়ার্ট-এর চিঠিপত্রও গ্রন্থিত হয় অতি যত্নে, নির্মিত হয় ‘দ্য বাখ রিডার’, আধুনিক শিল্পীদের মধ্যেও পাওয়া যায় সের্গেই প্রোকোফিয়েভ, এরিক সাতি, দারিউস মিলো, চার্লস আইভ্জ় প্রমুখর ডায়েরি, চিঠি, বিভিন্ন লেখাপত্র। এরকম উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে, পাশ্চাত্য সংগীতের মায়েস্ত্রো-দের নিয়ে লেখা হয় কত না বই!

বিশিষ্ট গীত-রচয়িতা, বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন সুর-রচয়িতা, স্বকীয়তা-প্রতিষ্ঠ সংগীত-পরিচালক সলিল চৌধুরীর রচনাসংগ্রহ এক জরুরি পদক্ষেপ।
বাংলায় এ ধারাটি ক্ষীণ, যেসব বই আছে, তা অধিকাংশই দুষ্প্রাপ্য। অন্য ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণ বা ভাবনার বাইরে সংগীত-ইতিহাসের তেমন কিছু পাওয়া যায় না, তাই সলিল চৌধুরীর এই সংগ্রহ বাংলা সংগীতের দলিল হিসেবেও প্রয়োজনীয় বই কী! শুধু একটিই কথা- ‘এখানে থেমো না’! প্রথম খণ্ডে যা সংকলিত হয়েছে, তার বাইরেও সলিল চৌধুরী লিখেছেন অনেক, রয়েছে কবিতা, গল্প, আত্মকথা, নানা সাক্ষাত্‌কার ইত্যাদি। অবশ্য ‘সংকলকের পূর্বভাষ’-এ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের উল্লেখ করেছেন রণবীর নিয়োগী। আপাতত প্রথম খণ্ডের অন্তরে প্রবেশ করা যাক।


গানই রয়েছে বইয়ের মুখ্য ভাগ জুড়ে, সেইসঙ্গে সলিল চৌধুরীর লেখা চারটি প্রবন্ধও এখানে সংকলিত হয়েছে, যা অবশ্যই তাঁর রাজনৈতিক পরিবেশ সচেতন জাগরূক মন ও গভীর ব্যাপ্ত সংগীতবোধের পরিচায়ক। ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ অংশে নামের তালিকা দীর্ঘ- ইংরেজি, বাংলা, এমনকী হিন্দিতে লেখার কয়েকটি নিশ্চয়ই রচিত হয়েছে এই ‘রচনাসংগ্রহ’কে কেন্দ্র করে, যেমন অনুপ ঘোষাল, অভিজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, মান্না দে প্রমুখর রচনা, কয়েকটি অন্যান্য গ্রন্থ বা পত্রপত্রিকা থেকে নেওয়া, কিছু লেখা ‘সিলভার জুবিলি সেলিব্রেশনস: মিউজিক অফ সলিল চৌধুরী’ (১৯৭৬) স্মরণিকা থেকে সংগৃহীত। সে-তালিকায় রয়েছে আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মুকেশ, নৌসাদ, রাইচাঁদ বড়াল এবং পঙ্কজকুমার মল্লিকের নাম, যদিও শেষোক্ত ব্যক্তির লেখাটি এখানে অনুপস্থিত। অবশ্য আলোকচিত্রে পঙ্কজ মল্লিকের হাতে লেখা একটি চিঠির প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে। ‘যশস্বী ও জনপ্রিয়’ সলিল চৌধুরীকে তিনি লিখেছিলেন, ‘সঙ্গীত-শিল্পকলাক্ষেত্রে আপনি ত্রিশক্তিসমৃদ্ধ এক প্রখ্যাত ও কীর্তিমান পুরুষ। আপনি কাব্যলেখকরূপে বিশিষ্ট গীত-রচয়িতা, আপনি বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন সুর-রচয়িতা, আপনি স্বকীয়তা-প্রতিষ্ঠ সঙ্গীত-পরিচালক।’

কথা ও সুর সলিল চৌধুরী, এমন গান তো সংকলিত হয়েছেই, যেখানে শুধু সুর সলিল চৌধুরীর, সেগুলিও রেখেছেন সংকলক ‘পরিশিষ্ট’ অংশে। গানগুলির উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়, তাঁর ভক্ত শ্রোতামাত্রেই জানেন ‘রেখো মা দাসেরে মনে’, ‘পালকির গান’, ‘রানার’ বা ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’-র কথা। অন্য বিভাগগুলি হল ‘গণ সংগীত ও গণ-চেতনার গান’, ‘আধুনিক গান’, ‘ছায়াছবির গান’ এবং ‘ছোটদের গান’।
গানের পরিচিতির পক্ষে এই ধরনের বিভাজনের হয়তো প্রয়োজন আছে, কিন্তু স্রষ্টা সলিল চৌধুরীর সামগ্রিক এক সত্তা ধরা পড়ে সব ধরনের গানেই। ঠিক এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বজনীন শিল্পী, এক লহমায় উডি গাথরি, পিট সিগার-এর মতো মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায় আমাদের সলিল চৌধুরী বা হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে। এই বাঁধনটি অবশ্যই ধরা রয়েছে গানের কথায় বা লিরিকে। দু’-একটি উদাহরণ বক্তব্য স্পষ্ট করতে সহায়ক হবে।

সলিল চৌধুরীর লেজেন্ডারি গণসংগীতগুলি ‘ঘুম ভাঙার গান’ নামে সংকলিত হয়েছিল আশির দশকে। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’, ‘মানব না এ বন্ধনে’, ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার’ বা ‘ও আলোর পথযাত্রী’র মতো গানগুলি চার-পাঁচের দশকে যেমন, এখনও ততখানিই জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক। সেই ‘ঘুম ভাঙার গান’-এর রেকর্ড কভারে সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত হলেও এই গানগুলির মূল উত্‌স এবং প্রেরণা হোল সব রকম দাসত্ব বন্ধন পীড়ন এবং শোষণ থেকে মুক্তির জন্য মানুষের সেই চিরন্তন প্রয়াস যা যুগ-যুগান্ত ধরে তাকে বুলেট ও ফাঁসির মুখোমুখি হতে সাহস জুগিয়েছে - সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের জন্ম দিয়েছে এবং পৃথিবীর এক বৃহদাংশে তার প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠা সম্ভব করে তুলেছে।’ ‘প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠা’ আজ ব্যর্থ, মানবিকতার অংশটুকু নয়। এই মানবিকতাই সলিল চৌধুরী (১৯২৫-১৯৯৫) ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর যাবতীয় শিল্পকর্মে। তাই ‘এই সারাটা দেশ জুড়ে আমার ঘরবাড়ি’ মূলত ছোটদের জন্য লেখা গান হয়েও বৃহত্‌ এক পরিসর পেয়ে যায়, কিংবা কিশোরী-কণ্ঠেই শোনা যায়, ‘মন্ত্রীর কান, আনতে গেলে দিল্লি যেতে হবে!/... বলল কেঁদে নিন ফিরিয়ে আপনার টাকাটা-/ দিল্লি গিয়ে দেখি, ওদের সবার দু’কান কাটা!’


এবার যদি তাকানো যায় অন্য এক দেশে, আমরা দেখতে পাব ‘দিস ল্যান্ড ইজ় ইয়োর ল্যান্ড’-এর মতো অসাধারণ গানের স্রষ্টা উডি গাথরি (১৯১২-১৯৬৭) সেই তথাকথিত ছোটদের গান-এ ‘Why can’t a bird eat an elephant?/ Why, oh why, oh why?/ ’Cause an elephant’s got a pretty hard skin./ Goodby goodbye goodbye’-এর মতো নিপাট মজার লাইনের সঙ্গেই দিব্যি জুড়ে দিচ্ছেন, ‘What make the landlord take money?/ Why, oh why, oh why?/ I don’t know that one myself./ Good-bye goodbye goodbye’। সলিল চৌধুরী বহন করেছেন এই লিগ্যাসি, পাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল, ফোক, জ্যাজ় প্রভৃতি ধারার সংগীতের উপর তাঁর যে যথেষ্ট দখল এবং জ্ঞান ছিল, সেটি স্পষ্ট হয় প্রবন্ধগুলি থেকে। তাই আলোচ্য গ্রন্থে সংযোজিত ‘সুর সৃষ্টি সম্পর্কে’, ‘আধুনিক ভারতীয় সংগীতে বিবর্তন’, ‘বিষয় : গণসংগীত’, ‘সমকালীন বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতে পাশ্চাত্য সংগীত পদ্ধতির প্রভাব’ লেখাগুলি যেন হয়ে ওঠে সলিল চৌধুরীর গানেরই অবিচ্ছেদ্য করোলারি।


তাঁর গানে অর্কেস্ট্রেশন, মেলডি ও হারমনির প্রয়োগ, নানা বাদ্যযন্ত্রের বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহার থেকে সলিল চৌধুরীর উপর সমগ্র বিশ্বের সংগীতের প্রভাব লক্ষ করা যায়, একইসঙ্গে তা থেকে যায় ‘বিশিষ্ট’। এই শব্দটির উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, ভাষার মতো শব্দ এবং স্বরসমষ্টিও নির্ভর করে ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রতিবেশের উপর। সে কারণেই ভারতীয় সংগীত ইউরোপীয় সংগীতের চেয়ে বিশিষ্ট, এমনকী আরও সীমায়িত করা যায় এই সংজ্ঞা। অঞ্চল ভেদেও বদলে যায় সুরের আঙ্গিক।


সংগীত সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা নিশ্চয়ই প্রয়োজন, কিন্তু শেষমেশ শ্রাব্য সংগীতই শেষকথা বলে, যেমন ভাবতেন সলিল চৌধুরী নিজেই- ‘সুরসৃষ্টি করা সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার চেয়ে সুরসৃষ্টি করা ঢের বেশি আনন্দদায়ক’।


লতা মঙ্গেশকর-এর ভূমিকায় সমৃদ্ধ এই গ্রন্থ। এর এক অন্যরকম আকর্ষণ থাকবে পাঠকের কাছে। গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে অনেক আলোকচিত্র। কত গুণী মানুষ যে জড়িয়ে ছিলেন সলিল চৌধুরীর জীবনে, এই ছবিগুলি তার প্রমাণ। আরও একটি বাড়তি পাওনা, সলিল চৌধুরীর নিজের আঁকা তিনটি চমত্‌কার পেন্টিং। এক পূর্ণ শিল্পীসত্তার সন্ধান দেয় এই গ্রন্থ।



সলিল চৌধুরী রচনাসংগ্রহ: প্রথম খণ্ড, গান
সংকলন ও সম্পাদনা: সবিতা চৌধুরী, অন্তরা চৌধুরী, রণবীর নিয়োগী
দে’জ পাবলিশিং
কল-৭৩ ।
আলোচ্য লেখাটি দেশ পত্রিকা থেকে সংকলিত
ছবিঃ আলোচ্য বইটি থেকে সংগ্রহিত।
বইটির কিছু পাতা পড়া যাচ্ছে না, এই জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।