Ticker

6/recent/ticker-posts

কী বই পড়েছেন - গৌরী আইয়ুব

amarboi
কী বই পড়েছেন
গৌরী আইয়ুব

অত্যন্ত অস্বস্তি আর অনিচ্ছার সঙ্গে যুগান্তরের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছি। আমার এমন নির্বোধ অহঙ্কার নেই যে ভাববাে আমার নিতান্ত অপরিচিত ব্যক্তিরাও জানতে উৎসুক হবেন যে আমি এখন কি পড়ছি বা কি লিখবার পরিকল্পনা করছি। জানি বটে, আজকের সংবাদপত্র সর্বশক্তিমান, চাইলে আমার মতন ছােটো মাপের মানুষকেও বড়াে করতে পারে, আবার বড়ােকেও ছােটো করতে পারে। সংবাদপত্র কাউকে তােলে, কাউকে ফেলে, কাউকে ভাঙে, কাউকে বা গড়ে-কিন্তু আমার মতাে অনতিখ্যাত মানুষ এই সব ভাঙাগড়ার আবর্তের বাইরে থাকতে পারলে আরাম পায় এই কথাটা প্রতিবেদক মশাইকে বােঝাতে পারলাম না।

আগামী বছরেই আমার ঘাট পূর্ণ হবে। এখন পর্যন্তও এমন কিছু লিখতে পারিনি যার দৌলতে আমি এর পরে কি লিখতে চাই তা জানবার জন্য বঙ্গীয় পাঠককূল আকুল হবেন। তবু প্রশ্নের জবাব তাে দিতেই হবে। একটি নিভৃত উচ্চাশার কথাই বলি যা হয়ত কোনাে কালেই পূর্ণ হবে না। বেশ কিছুকাল যাবৎ মনে মনে ভাবছি, পশ্চিম বাংলার মুসলমান সমাজকে নিয়ে, দেশ ভাঙার পর থেকে এই সমাজের ভাঙাগড়া নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব। আজও যে এই লেখায় হাত দিতে সাহস পাইনি তার আসল কারণ একটা সংশয়। চল্লিশ বৎসর ঘনিষ্ঠ থেকেও ঠিক মতন ঠাহর করতে পারি না এই সমাজের ‘অন্তঃমহলে’ কতখানি প্রবেশ করতে পেরেছি। মুখের এবং ভাবনার ভাষা যতটুকু রপ্ত করতে পেরেছি তাতেও যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয় অর্জিত হয়নি।

এখন কি পড়ছি তাও নাকি কবুল করতে হবে। গত এক মাস ধরে--অর্থাৎ যখন থেকে কলেজে পড়ানাের বার্ষিক চাপ একটু কমেছে তখন থেকে দুটি বই পড়েছি। একটি হল, শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জিন্না পাকিস্তান-নতুন ভাবনা। আর Wall Stanley Walpert-এর Jinnah of Pakistan।

সম্ভবত বছর দুয়েক আগে ‘আনন্দবাজারে একটি মূল্যবান সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল দেশভাগ বিষয়ে পশ্চিম বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত। বিস্মিত হয়েছিলাম দেখে যে বেশ কয়েকজন প্রিয় লেখক দেশভাগের সবটুকু দায় মুসলমানদের কাঁধেই চাপিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতাকামী মানসিকতারও সন্ধান করেছিলেন তাদেরই মধ্যে। এই বদ্ধ আবহাওয়ায় শৈলেশবাবুর বইটা যেন একটু তাজা হাওয়া এনে দেয়। সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসের ওই বিতর্কিত অধ্যায়টিকে পুণর্মূল্যায়ন করার সত্যনিষ্ঠ প্রয়াস দেখে উৎসাহিত বােধ করলাম। আরও অনেকের মতাে তারও চোখে ভারতীয় রাজনীতি মঞ্চের খলনায়ক ছিলেন জিন্নাহ। কিন্তু কিভাবে তার মনের বদ্ধ অর্গলে প্রথম আঘাত পড়ল পঞ্চাশের দশকে এবং ক্রমে জিন্নাহকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন তারই কাহিনি তার এই বইখানি। এই বইয়ে শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে। তার একটি মন্তব্য বর্তমান পরিস্থিতিতে উল্লেখ করার মতাে “এদেশে অগ্রাধিকার যদি কারও থাকে তবে তা আদিবাসীদের। তারাই এদেশের রেড ইন্ডিয়ান। তারাই আদি ভারতীয়। হিন্দু নয় । সবাইকে হিন্দু বানাবার উদগ্র বাসনা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয়। জিন্না প্রমুখ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের আত্মীয় না করে পর করে দেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের হিন্দু পুনরুজ্জীবনকামী শাখা। প্যান-ইসলামিজমের মতাে প্যান হিন্দুইজম্।”

সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসও একটি মহাকাব্যের মতাে সাহিত্য কর্মের জন্ম দিতে পারে যদি তেমন সক্ষম ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের হাতে পড়ে। এই বিয়ােগান্তক নাটকের দুই করুণ চরিত্র গান্ধী এবং জিন্নাহ! হায় এ কি সমাপন।

এমন লেখা কে লিখতে পারবেন ? Stanley Walpert নয় অবশ্য। উনি বলেছেন, Few individuals significantly alter the course of history. Fewer still modify the map of the world. Hardly anyone can be credited with creating a nation-State. Mohammad Ali Jinnah did all three! চমৎকার বাচনভঙ্গি। কিন্তু যে সমদৃষ্টি থাকলে ইতিহাসের নিরাসক্ত বােধ নিয়ে সাহিত্যরচনা সম্ভব তা তাঁর নেই। গান্ধী সম্বন্ধে এক বিদ্বেষজাত অন্ধতা যেন তার আছে। এমন কি কেউ আসবেন যিনি এই দুই ব্যক্তিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তাদের ট্রাজিক ব্যর্থতার কাহিনি লিখতে পারবেন? যদি পারেন তাহলে সে হবে আর একটি মহাভারত।

যুগান্তর, ১৫/০৫/৯০
আমাদের দুজনের কথা এবং অন্যান্য - গৌরী আইয়ুব (রচনাসংগ্রহ)