Ticker

6/recent/ticker-posts

সমালােচনা - গৌরী আইয়ুব

amarboi
সমালােচনা
গৌরী আইয়ুব

বাঙলা সমালােচনা (‘আজকাল পত্রিকার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে)

গ্রন্থ-সমালােচনা বিষয়ে আমি নিজেকে কোনাে মত দেবার যােগ্য মনে করছি না। প্রধানত দুটো কাগজের সমালােচনা নিয়মিত দেখি, ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার রিভিউ নিবন্ধগুলাে আর দেশ পত্রিকার পুস্তকসমালােচনা। তার মধ্যেও আমার নিজের উৎসাহের ক্ষেত্র অনুযায়ী খানিকটা বােধ নিয়ে পড়ি।
সম্প্রতি অন্যান্য কয়েকটি পত্র-পত্রিকার সমালােচনা অংশটি নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম, কিন্তু সেগুলাে এত সংক্ষিপ্ত যে সমালােচনার বদলে নােটিস বা পরিচয় বললেই হয়। তাতে পাঠকের কোনাে লাভ হয় না। আমি আশা করেছিলাম ‘কলেজ স্ট্রিট' পত্রিকাটিতে সমালােচনার একটা বড়াে অংশ থাকবে, কিন্তু থাকেনি।
সমালােচনার মান নীচু বললেই যে কথা প্রথমেই তাই মনে আসে, তা হল সমালােচকরা যথেষ্ট যত্ন নিয়ে সমালােচনা করেন না। তাছাড়া আর একটি কারণ মনে হয় যােগ্য লােকের হাতে সমালােচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় না। আবার যােগ্য লোকের অভাবও রয়েছে; বিশেষত যদি কোনাে বৃত্তিমূলক বিষয় হয়, অনেক সময়েই যােগ্য সমালােচক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এমনিতেই আমাদের সত্য কথা বলার খুব যে একটা অভ্যাস আছে তা নয়, আসলে অপ্রিয় সত্য কথা বলার জন্য যে নৈর্ব্যক্তিক মান থাকা প্রয়ােজন সেটা আমরা অনেক সময়েই রাখতে পারি না। আমাদের ভালাে লাগা, মন্দ লাগা অনেক সময়েই ব্যক্তিগত হয়ে যায়। তাই নৈর্ব্যক্তিক মান সামনে রেখে সমালােচনা করার অভ্যাস তৈরি হয়নি। এবং কারও বইয়ের আলােচনা করলে লেখকের মনে হয় যে তার ব্যক্তিগত সমালােচনা করা হল। কিংবা বইয়ের মতামতের সমালােচনা করলে সেটাও নৈর্ব্যক্তিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতাও অনেকের থাকে না। অন্যদিকে আবার খুব রুষ্ট হয়ে অপ্রিয়ভাষণ করার অভ্যাসও অনেকেরই রয়েছে।
আমি নিজে সমালােচনা খুব বেশি করেছি তা নয়। তবে যত সমালােচনা এযাবৎ করেছি সেসব ক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয় যে কোনােরকমের বহিরাঙ্গীন চাপ আমি কখনও অনুভব করিনি। বরং আমি নিজের মধ্যে একটা চাপ প্রায় সবসময়েই অনুভব করেছি, সেটা হল, যে কেউ খেটেখুটে বই লিখেছেন অথচ সেটা বিশেষ কিছু হয়নি, তা বললে তার ক্ষতি হতে পারে। তাই সেই কাজটা আমি করব কিনা, এটা আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে।
পাশ্চাত্যের হুবহু অনুকরণ বলতে কী বুঝব? আমি যা দেখি, আমার অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতায়, পাশ্চাত্যের পুস্তক সমালােচনা প্রায়ই বেশ একটা পাঠযােগ্য প্রবন্ধ হয়ে ওঠে। সমালােচনার ক্ষেত্রটিকে মনােগ্রাহী করে তােলার দিকে সকলেরই ঝোঁক রয়েছে। তুলনায় বাংলা সমালােচনায় প্রায়শই পাণ্ডিত্যের কচকচি। বইয়ের মূল বক্তব্য এড়িয়ে গিয়ে, অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ প্রসঙ্গগুলাে বড়াে হয়ে ওঠে বাংলা সমালােচনায়। পাশ্চাত্যের হুবহু অনুসরণ হয়ত স্বাস্থ্যসম্মত হবে না, কিন্তু সমালােচনাও যে একটা বিশেষ ধরনের শিল্প প্রকরণ, সত্যবাদী হয়েও তার যে চিত্তাকর্ষক হবার দায় আছে। এ কথা বাঙালি সমালােচকদের মনে রাখা ভাল।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে শুধু বাংলা সমালােচনার ক্ষেত্রেই নয় সব দেশের সব ভাষার সমালােচনাতেই সমালােচ্য কোনাে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইকে অন্ততপক্ষে তিনজন সমালােচকের কাছ থেকে সমালােচনা সংগ্রহ করে পাশাপাশি প্রকাশ করা বােধহয় ভালাে, তাতে পাঠক অনেক বেশি নিরপেক্ষ ধারণা পাবে। সব বইয়ের ক্ষেত্রে এ কাজ সম্ভব না হলেও, কখনও কখনও এরকম করে দেখা যেতে পারে পাঠাকেরা পছন্দ করছেন কিনা। আর একটা কাজও করা যায়, কোনাে কোনাে বইয়ের জন্য পাঠকের মতামত আহ্বান করে বেছে নিয়ে তার থেকে ৮/১০ জনের মতামত যদি প্রকাশ করা যায় তাহলে সেরকম মতামতের জন্য যেহেতু টাকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, তাই ওরকম মতামত আন্তরিকভাবেই পাঠাবেন সাধারণ পাঠকজনেরা। সেক্ষেত্রে আমারও মনে হয়, লেখকের কাছে পাঠকসমাজের প্রত্যক্ষ সমালােচনা বােধহয় অনেক বেশি সহায়ক হবে, সমালােচনা সাহিত্যেরও যথার্থই উন্নতি হবে, লেখকরাও উপকৃত হবেন, যত্ন করে বই পড়ার অভ্যাসও খানিকটা তৈরি হতে থাকবে, ক্রমাগত মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে মুক্ত থাকার ফলে পাঠকেরাও ক্রমশ দায়িত্বশীল ও মনােযােগী পাঠক হয়ে উঠবেন।

আজকাল, ০৩/০৫/৮৩