Ticker

6/recent/ticker-posts

কবিতাসমগ্র - ত্রিদিব দস্তিদার

কবিতাসমগ্র - ত্রিদিব দস্তিদার
কবিতাসমগ্র
ত্রিদিব দস্তিদার

চির তরুণ, বর্ণিল, বােহেমিয়ান কবি ত্রিদিব দস্তিদার। সত্তর দশকের উত্তাল কালপর্বে এই রক্তিম তরুণ নিজেকে সমর্পিত করেন মাটি, মানুষ ও কবিতার অগ্নিমন্ত্রে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ১৯৭২-এ তাঁর কবিতার প্রথম প্রকাশ। যেন, এই কাল-পারম্পর্যই তাঁর সার্বভৌম জীবন ও শিল্পসত্তার অনিবার্য নিয়ামক। আমৃত্যু স্বাধীন, সংসারহীন ছিলেন তিনি– তাই গেরস্থালি পেতেছিলেন কবিতার সঙ্গে। গৃহহীন বলেই হয়তাে সমস্ত স্বদেশ ছিল তার ঘর। জীবনকে এ-ফোঁড় ওফোড় করে তিনি দেখেছেন ভেতরের শাস, নিঃশব্দ ক্ষরণ ও বিনাশের দাহ । আর মর্ম-ছেড়া সেই ক্রন্দনের ভেতর হামাগুড়ি দিতে দিতে গায়ে মেখে নিয়েছেন বহুবর্ণের দাগ-- প্রবঞ্চনার, প্রত্যাখ্যানের, প্রতিহিংসার । তবু, কবি বলেই, অমৃতপুত্র বলেই গরলের সব বিষন্নতা সরিয়ে তার অমল উদ্ভাসন— ভালাে বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবাে। আবার, কখনােবা রূঢ় বাস্তবতার তাপে অগ্নিবর্ণ কবিকে বলতে হয়েছে-~ উঃ উনুন, আঃ উনুন/তােমার বুকের রক্ত নিয়ে/নাম রেখেছি আগুন। এভাবেই, প্রেমে ও বিক্ষোভে, ব্যক্তি ও সমষ্টির তললগ্ন বহুরৈখিক অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতা। সদ্য প্রয়াত, জনপ্রিয় এই কবির গ্রন্থিত, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে এই কবিতাসমগ্র পাঠককে কবির অম্লান সান্নিধ্য দেবে।

কবি ত্রিদিব দস্তিদারের জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে। পিতা তিনকড়ি দস্তিদার ও মাতা ইভা দস্তিদার । ১৯৬৮ সালে পটিয়ার কেলিশহর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস। চট্টগ্রাম সিটি কলেজে পড়াকালীন ছাত্র-রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আন্দোলন পত্রিকায় তাঁর কবিতার প্রথম প্রকাশ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবেগ-বিহ্বল কবি রচনা করেন একগুচ্ছ প্রতিবাদী কবিতা। ১৯৭৬ সাল থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়। প্রকাশিত ১৬ খণ্ডের 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র' (১৯৮২-১৯৮৩) প্রকল্পে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পেশাজীবনের সূচনা। কয়েক বছর কাজ করেছেন বিজিআইসি-র জনসংযােগ কর্মকর্তা পদে। একসময় “দৈনিক জনতা’-র সাহিত্য। সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। শেষ জীবনে ব্যাপৃত ছিলেন মুদ্রণ-ব্যবসা ও অক্ষর' নামে সাহিত্যপত্র সম্পাদনায় । বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সাধারণ সম্পাদক, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের সক্রিয় কর্মী। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-- গৃহপালিত পদ্যেরা (১৯৯৬), অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ (১৯৯৮), ভালাে বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবাে (১৯৯৯), ভালােবাসার শাদা ছড়ি (২০০১), পােড়াবাে তাজমহল (২০০৩)। ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর প্রায় ৫৩ বছর বয়সে ঢাকায় চির তরুণ এই কবির জীবনাবসান ঘটে।

প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
কবিতাসমগ্র
কবিতাসমগ্র ত্রিদিব দস্তিদার

ভূমিকা
বেলাল চৌধুরী

মাত্র বাহান্ন বছরের ঝােড়াে জীবনে বইয়ের সংখ্যা কুল্লে পাঁচ না বলে সাড়ে চারখানা বলাটাই শ্রেয়। সাড়ে অর্থাৎ সার্ধ বলার কারণ অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ বইটিতে আগে গ্রন্থিত অনেক কবিতারই পুনঃপ্রকাশ। এর কারণ সম্ভবত ত্রিদিব যে ভাসমান জীবন-যাপন করতেন তাতে সবকিছু গােছগাছ করে রাখাটা তার জন্য খুবই দুষ্কর ছিল। মাঝে মধ্যে দু'একটি খাতা বেশ মােটাসােটাই বলা যায় তাতে প্রাথমিক খসড়া এবং রীতিমতন বারবার কাটাছেড়া শেষে আবার পুনর্লিখন—এই ছিল ওর লেখালেখির ধরন। তাতেও ছিল তার একধরনের বিশেষত্ব অনেক সময় দেখা গেছে ওই খাতার পাতা ছিড়েই হয়তাে লেখাটি কাউকে দিয়ে দিয়েছে। এমনও আছে একই কবিতা একাধিকবার লিখে গেছে। তার জন্য যে কোনও অদল বদল করেছে তাও নয়। তবে বেশির ভাগ কবিতাই সে আলগা পাতায় লিখতে পছন্দ করত। কেন, তার কোনও সদুত্তর জানার আজ আর কোনও উপায় নেই। আরেকটা মজার ব্যাপার প্রতি বছরই সে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডায়রি সংগ্রহ করলেও লেখালেখি করা কোনও ডায়রি খুঁজে পাওয়া যায় নি।

কবিতায় ত্রিদিব শিল্পের জন্য শিল্পে বিশ্বাসী হলেও তার বেশির কবিতাতে সমাজ বাস্তবতা ও সচেতনতাও পরিলক্ষিত হয়। তবে নারী, প্রেম, সুরায় ছিল তার প্রবল আসক্তি। কাপড়চোপড়ও ছিল সমান শৌখিন। এক জামা ও দ্বিতীয়বার পরেছে কি-না। সন্দেহ। হালফ্যাশনের রঙচঙে পােশাক, ঘড়ি কলম আংটি বালা, বিচিত্র কর্ণাভরণ ছিল তার প্রচণ্ড শখের জিনিস। সস্তা দরের বিচিত্র টুকিটাকির প্রতি ছিল অসম্ভব ঝোঁক। চোখে লেগে গেলে ট্র্যাকের পয়সা খর্চা করে হলেও এসব বাড়তি পড়তি পুরনাে জিনিস সংগ্রহে তার আগ্রহকে কখনও কখনও ছেলেমানুষি পর্যায়ে ঠেকলেও কিছু করার ছিল।

ওর হস্তাক্ষরের টঙও ছিল একান্তভাবে ত্রিদিৰীয়। স্বাক্ষরটিও কারুকাজময়। আসলে ওর সব কিছুর ভেতরেই এক ধরনের নান্দনিক বােধের স্বাক্ষর বােধ হয় সর্বত্রই ছিল। যেমন ও কবি ও প্রেমিক পরিচয়ের সঙ্গে নিজেকে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে ভাবতে ঢের বেশি আনন্দ পেত। দুর্মরভাবে প্রেমিকই হােক কিংবা সন্তই হােক ত্রিদিবের মধ্যে যে একটা তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠ গর্জমান ছিল তাকেও বা কি করে অস্বীকার করা যায়। যেমন একুশের খুনী লুটেরাদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম যিনি সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন সেই মাহবুব আলম চৌধুরীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ত্রিদিবের কবিতা—এই যে রঙ/মুহূর্তে পেশী বলে উঠলাে, এটা আমার/ফসল বলে উঠলাে, এটা আমার/হাতুড়ি বলে উঠলাে, এটা আমার বর্ণমালাদের চোখে তখন একটি সেতু/আর ভাষার চোখে সূর্যোদয়।'

ত্রিদিবের কবিতার বাগরীতিই ছিল ভিন্ন রকমের। ও বইগুলির নামের মধ্যে পরােক্ষে প্রেমেরই যে প্রধান ভূমিকা তাতে সন্দেহ কী? যেমন ওর অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ বইটির ভেতরের ডানায় ও নিজেই অতি সংক্ষিপ্তভাবে ওর নিজের পরিচিতিতে শখের উল্লেখে লিখেছে--রঙ-বেরঙের পােশাক পরা ও সুন্দরীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া। আর পুরস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে-~~প্রেমের জন্য একবার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন কলেজ জীবনে। তারপর পুরস্কার প্রত্যাখ্যান । প্রেমিক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। প্রথম প্রেমের জায়গায় বলছেন—মেরী এ্যান রড্রিগস। বর্তমানে কানাডা প্রবাসিনী। এ বইয়েরই ‘কিছুতে নেই, কিছুতে নেই’ কবিতায় ত্রিদিবের কণ্ঠে বেজে উঠছে একটা অন্তলীন করুণ সুর। চতুর্দিকে শূন্যতাবােধ গিলে খাচ্ছে। সব কিছুতে কিচ্ছুটি নেই, সনের ভেতর সনটিও নেইরূপের ভেতর রূপটি... আমি এখন কিছুতে নেই, কিছুতেই নেই/হায়রে আমার মন ময়ূরী তুমিও বললা/আমি এখন কিছুতে নেই, কিছুতেই নেই।

এই হাহাকার থেকেই কি-না বলা মুশকিল ত্রিদিব তার চতুর্থ বইয়ের নামকরণ করেছিল পােড়াবাে তাজমহল। ভেতরে উৎসর্গপত্রে ছিল—“দিমা নেফারতিতি যে আমার কবিতার তৃতীয় নয়ন। নিচে আগুনের শিখার ভেতর কবিকে ভালােবাসা/দুর্ঘটনাকে ভালােবাসা/প্রতিনিয়তই একটি দুর্ঘটনার দিকে/এগিয়ে যাওয়া। তৃতীয় বইতে কবি এতই বেপরােয়া যে এবার নামকরণ করেছেন ভালাে বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবাে। উৎসর্গে এবার কিন্তু কোনও রক্তমাংসের মানবী নয়, তার বদলে কবির হৃদয়াভ্যন্তরে যে তুমি আমার কবিতার রক্তক্ষরণ' ত্রিদিব শুরু করেছিল কিন্তু কবিতার প্রতি তিছরি নজর হেনে ‘গৃহপালিত পদ্যেরা' দিয়ে। এর একেবারে
অন্ধ আত্মসমর্পণ—-ভালােবাসার শাদা ছড়ি।

একজন কবি পেছনে রেখে যায় কি? কিছু খসড়া পাণ্ডুলিপি, ইতি-উতি ছড়ানাে ছিটানাে কবিতার ছিন্ন পাতা, এর মধ্যে কোনটা প্রকাশিত, কোনটা অগ্রন্থিত সেটা আবিষ্কারের ভার ত্রিদিবের কবিতানুরাগীদের। আর কবির জীবন্ত স্মৃতির বা উপস্থিতির কথা নাইবা বলা হল।

কবির অনুপস্থিতিতে কবি সাহিত্যিকদের একান্ত বান্ধব মাওলা ব্রাদার্স স্বেচ্ছায়, ভালােবাসায়, মমতায় কবির কবিতাসমগ্র' প্রকাশনা-ভার নিয়ে, আমরা যারা ত্রিদিবের অনুরাগী তাদের খানিকটা হলেও দায়মুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে। তাদের কল্যাণ হােক। বাংলা সাহিত্যে ত্রিদিব দস্তিদার পুনরাবিষ্কৃত হােক এই আমাদের কামনা।

ঢাকা
বেলাল চৌধুরী
ফেব্রুয়ারি ২০০৫

বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!