Ticker

6/recent/ticker-posts

জঞ্জাল (ছোটগল্প) - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

amarboi
জঞ্জাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমার বাসাটির নাম জনসন হাউজ। শুধু নামেই বাসা আসলে এটি একটি পুরাতন গুদাম ঘরের মতো। বাসার যিনি মালিক তিনি বাসার প্রতি বর্গইঞ্চি ব্যবহার করে অসংখ্য ছোট ছোট খুপড়িতে ভাগ করে নিয়েছেন। একেকটা খুপড়ি একেকজনের কাছে ভাড়া দেয়া হয়, ভাড়া নেয় আমার মতো দরিদ্র ছাত্রেরা। পুরাতন, অন্ধকার, মলিন ঘর, আমরা যারা থাকি পয়সা বাঁচানোর জন্যেই থাকি। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ঘরের ভাড়া ঊনষাট ডলার। এক ডলার বাড়িয়ে এটাকে ষাট ডলার কেন করে দেয়া হলো না সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। ঊনষাট ডলারের সেই খুপড়িতে আমার বেশ চলে যাচ্ছিল। অসুবিধে যে হয় না তা নয়, বাথরুম এবং রান্নাঘর বারোয়ারি, সময় মতো ব্যবহার করার জন্যে লাইন না দিলে হাতছাড়া হয়ে যায়। সস্তা ঘর বলে ছাত্র ছাড়াও আরো কিছু চালচুলোহীন মানুষ থাকে। তাদের কেউ কেউ পাকাপাকিভাবে রান্নাঘরে বসে সস্তা মদ খেতে থাকে। প্রথম দিকে বেশ হাসিখুশি থাকে কয়েক বোতল খাওয়ার পর তাদের মেজাজি মর্জি পাল্টে যায়। বাসার ম্যানেজার সাতফুট উঁচু তিনশ পাউন্ড ওজনের একজন দানববিশেষ, কেউ কোন গোলমাল করার সাহস পায় না। কিন্তু সব মিলিয়ে বাসাটিতে এক ধরনের দূষিত পরিবেশ। সামনের ক্রিসমাসের ছুটিতেই এখান থেকে সরে মোটামুটি একটা ভদ্র এলাকায় চলে যাব বলে ঠিক করেছি।

একদিন রাতে ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে এসেছি, ঘুমানোর আগে এক কাপ চা খাবার ইচ্ছে হলো। রান্নাঘরটি বাসার বেসমেন্টে অনেক ঘুরে যেতে হয়। রান্নাঘরের কাছাকাছি আসতেই একটা হল্লা শুনতে পেলাম, মনে হলো খুব আনন্দের কিছু ঘটছে। মধ্য রাতে মদ্যপ কিছু মানুষের আনন্দ সুখের ব্যাপার নাও হতে পারে। ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি ভারতীয় চেহারার বুড়ো একজন মানুষ পাংশু মুখে খাবার টেবিলে বসে আছে, সামনে একটা পাউরুটি। তাকে ঘিরে বসে আছে এই বাসার উচ্ছৃঙ্খল ছেলেগুলো। একজনের হাতে একটা বিয়ারের বোতল, চেষ্টা করছে বুড়ো মানুষটিকে এক ঢোক খাইয়ে দিতে। আমাকে দেখে তাদের উল্লাসে একটু ভাটা পড়ল, আমি নিজের ভয়টাকে ঢেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হচ্ছে ওখানে?

পার্টি। ওয়াইল্ড পার্টি।

তরুণগুলো আমাকে উপেক্ষা করে আবার সেই বৃদ্ধকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একজন তার ঘাড় ধরে মুখটা হাঁ করিয়ে রাখে, অন্যজন তার মুখে বিয়ার ঢালতে চেষ্টা করে। ব্যাপারটির অমানুষিকতা সহ্য করার মতো নয়। আমার কপালে বড় দুঃখ হতে পারে জেনেও আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, ছেড়ে দাও তোমরা ওকে। ছেড়ে দাও।

একজন চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কোথাকার লাট সাহেব আমাদের মজা নষ্ট করতে এসেছ? তারপর আমার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা সংক্রান্ত কিছু কুৎসিত গালিগালাজ করে দিল।

মাতাল মানুষের চরিত্র নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব কম, কিন্তু মধ্যরাতে একাধিক মদ্যপ তরুণের সাথে ঝগড়া বিবাদ শুরু করার ফল যে শুভ নাও হতে পারে সেটি বুঝতে আমার এতটুকু দেরি হলো না।

আমি আমার ভয় গোপন করে চিৎকার করে বললাম, এক্ষুনি ছেড়ে দাও ওকে, না হয় আমি পুলিশ ডাকব। তোমরা পেয়েছটা কী? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?

আমার চিৎকার আর চেঁচামেচির জন্যেই কি না জানি না তারা বৃদ্ধটিকে ছেড়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বলল, তোমার চোদ্দগুষ্টিকে আমি ইয়ে করি।

আমি বুক টান করে বললাম, দূর হও এক্ষুনি, না হয় আমি ম্যানেজারকে ডাকছি। পুলিশের ভয় দেখিয়ে যে কাজটি করা যায়নি, ম্যানেজারের ভয় দেখিয়ে সেটা করা গেল। সত্যি সত্যি পুলিশকে খবর দেওয়া হলে পুলিশ এসে বড় জোর খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে একটু শাসিয়ে যাবে। ম্যানেজারের বেলা ভিন্ন কথা, তাকে খবর দেয়া হলে সে কারো কোন কথা না শুনে এই উচ্ছৃঙ্খল মদ্যপ তরুণগুলোকে এমনভাবে রগড়ে দেবে যে দীর্ঘদিনের জন্যে তারা সিধে হয়ে থাকবে। ম্যানেজারের গায়ের রং কুচকুচে কাল হতে পারে, তার আকার আকৃতি দানবের মতো হতে পারে, কিন্তু তার মনটি শিশুর মতো কোমল। গান্ধী ছায়াছবি দেখার পর থেকে তার ধারণা পাক-ভারত উপমহাদেশের আমরা সবাই একটি ছোটখাটো গান্ধী এবং আমাদের রক্ষা করার জন্যে সে প্রয়োজনে নিজের জানও দিতে রাজি আছে!

ছেলেগুলো বিদায় নেয়ার পর আমি ভারতবর্ষীয় এই বৃদ্ধ লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? এখানে কী করছেন?

বৃদ্ধ লোকটি বাংলাদেশের স্কুল মাস্টারের ইংরেজি উচ্চারণে বললেন, আমার নাম শওকত আলী। আমি একটা ঘর ভাড়া করে থাকব। ভদ্রলোক তখনো ভয়ে একটু একটু কাঁপছেন।

আপনি কোন দেশের?

বাংলাদেশের। আপনি?

আমি উৎফুল্ল হবার ভান করে বললাম, আমিও বাংলাদেশের! কী যোগাযোগ!

এবারে আমরা বাংলায় কথা বলতে শুরু করলাম। সামনের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলাম, এত জায়গা থাকতে জনসন হাউজে এলেন কী মনে করে?

ইউনিভার্সিটিতে কাজ পেয়েছি একটা, এটা ইউনিভার্সিটির কাছে তাই এসেছি। এই অবস্থা কে জানত—

কী কাজ?

কাফেটেরিয়াতে বাসনপাতি ধোয়া।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এই বৃদ্ধটির দিকে তাকালাম। কমবয়সী তরুণেরা নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্যে আমেরিকা পাড়ি দিয়ে বাসনপত্র ধোয়াধুয়ি করছে, ট্যাক্সি চালাচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতে পারি, কিন্তু এই বয়সের একজন মানুষ জনসন হাউজের মতো একটি বাসায় একটা ছোট খুপড়ি ভাড়া করে কাফেটেরিয়াতে বাসন ধুচ্ছেন, ব্যাপারটা কেমন যেন গ্রহণ করা যায় না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে এসেছেন আপনি?

আমি?

হ্যাঁ।

অনেকদিন হলো। শওকত সাহেব আঙুলে গুনে বললেন, নয় বছর।

নয় বছর?

হ্যাঁ।

এর আগে কোথায় ছিলেন?

শওকত সাহেব একটু ইতস্তত করে বললেন, ছেলের কাছে।

ছেলের কাছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার ছেলে এখানে আছে?

হ্যাঁ। আমার চার ছেলে তিন মেয়ে। একটা মেয়ের দেশে বিয়ে হয়েছে, সে দেশে আছে। আর সবাই এখানে।

কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কৌতূহল দেখানো ঠিক নয়, কিন্তু আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, এই বয়সে আপনি এখানে পড়ে আছেন কেন? ছেলেদের সাথে থাকেন না কেন?

ভদ্রলোক কেমন জানি আহত একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা, এই দেশের তো এটাই নিয়ম। সবাই নিজের পায়ে দাঁড়ায়। শুধু শুধু ঘরে বসে না থেকে একটু কাজকর্ম করে নিজেকে ব্যস্ত রাখি আর কী! একটু থেমে যোগ করলেন, যদি ভাল না লাগে ছেলের কাছে চলে যাব।

ভাল লাগা না লাগার কী আছে, চলে যান ছেলের কাছে! এটা একটা থাকা হলো! আমরা কমবয়সী বলে পারি, আপনি কেমন করে পারবেন?

তা ঠিক। ভদ্রলোক দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, তা ঠিক।

এরপর শওকত সাহেবের সাথে প্রায়ই দেখা হতে লাগল। খুব ভোরে উঠে রান্নাঘরে কেউ আসার আগে নাশতা করে নিতেন। রুটি, টোস্ট, মাখন এবং ডিম। এই বয়সে প্রতিদিন সকালে দুটো করে ডিম খাওয়া যে তার জন্য ভাল নয় ব্যাপারটা তাকে ঠিক বোঝাতে পারলাম না। সম্ভবত মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ে হয়েছেন, ধরে নিয়েছেন দুধ মাখন ডিম হচ্ছে বড়লোকের ভাল খাবার। যৌবনে যেটা খেতে পাননি এখন সেটা পুষিয়ে নিচ্ছেন। নাস্তা করে নীল রঙের একটা পার্কা পরে তিনি কাজে যেতেন, এক হাতে সব সময় একটা ছাতা অন্য হাতে দুপুরের খাবার। সারাদিন কাজ করে বিকালে ফিরে আসতেন। রাতের খাবার রান্না করে নিজের রুমে নিয়ে যেতেন, সম্ভবত অন্য সবার সামনে হাত দিয়ে খেতে তার লজ্জা লাগত।

শনি রবিবার ছুটির দিন, আমি বেলা করে ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে নাশতা করতে বাইরে যাচ্ছিলাম, দেখি শওকত সাহেব জনসন হাউজের সামনে হাঁটাহাঁটি করছেন। পরনে পরিষ্কার জামা-কাপড় এবং গলায় একটা টাই। এক হাতে চকলেটের একটা বাক্স। আমাকে দেখে একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, উইক এন্ডে ছেলের বাসায় যাবার কথা। এসে নিয়ে যাবে। নাতিটার জন্যে একটা চকলেটের বাক্স কিনলাম। এক টুকরা চকলেট খেতে পেলে আর কিছু চায় না।

আমি বললাম, বেশ, ভাল। উইক এন্ডে যদি সবাইকে নিয়ে একটু হৈ চৈ না করেন কেমন করে হবে! কখন ফিরে আসবেন?

দেখি। কাল রাতের মাঝে আসতে হবে। ভোর বেলা তো আবার কাজ!

নাশতা করে আড্ডা মেরে ফিরে আসতে আসতে বেলা একটা বেজে গেছে, দেখি তখনো বাইরে শওকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে দুর্বলভাবে একটু হাসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো গেলেন না?

ইয়ে, মানে—ছেলে এখনো আসেনি তো, তাই অপেক্ষা করছি। খুব ব্যস্ত মানুষ। উইক এন্ডে তো কথাই নেই! নাতিটা কারাটে স্কুলে যায়, নাতিটা ব্যালে ক্লাসে! সবাইকে নামিয়ে আসতে আসতে মনে হয় দেরি হয়ে যায়।

আমি বিকেল চারটার সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শওকত সাহেব তখনো সেজেগুজে বাইরে অপেক্ষা করছেন। তখনো তার ছেলের বৃদ্ধ বাবাকে তুলে নিয়ে যাবার সময় হয়নি।

ছুটির দিনে প্রায়ই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। শওকত সাহেব সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন তার ছেলে এসে তাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু তার ছেলের দেখা নাই। কেমন ধরনের ছেলে আমি ভেবে পেতাম না। আমি কখনো সোজাসুজি জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এই বৃদ্ধ মানুষটিকে দেশ থেকে জোর করে ধরে নিয়ে এসে আমেরিকার নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়া হয়েছে তার অন্য ছেলেদের আনার জন্যে। ছেলেরা পাকাপাকিভাবে আসন গেড়ে নেবার পর হঠাৎ করে আবিষ্কার বাবা একটি বাড়তি যন্ত্রণার মতো। এক ছেলে অন্য ছেলের ঘাড়ে গছিয়ে দেবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তার গতি হয়েছে জনসন হাউজের এই দূষিত খুপড়িতে।

আমার ভদ্রলোকের জন্য একটু মায়া হতো সত্যি, কিন্তু তার জন্যে কিছু করতে পারতাম না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি, অন্যদের সাথে কথা বলার সময় নেই। সময় থাকলেও বন্ধুদের সাথে হৈ চৈ করে আড্ডা মারি। এই বৃদ্ধ মানুষের সাথে কথা বলার সময় কোথায়? নিজের ছেলে যদি তার বাবার দায়িত্ব নিতে না পারে আমি কেমন করে নেব?

একদিন শওকত সাহেব খুব উৎসাহ নিয়ে আমার ঘরে এসে হাজির হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, এই শনিবারে কী করছ?

এখনো ঠিক করিনি। কেন?

আমার নাতির জন্মদিন, আমার ছেলে তোমাকে যেতে বলেছে।

সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষের ছেলের জন্মদিনে যাবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, কিন্তু কথাটা সোজাসুজি শওকত সাহেবকে বলতে পারলাম না। বললাম, দেখি কী রকম প্রোগ্রাম হয়।

শওকত সাহেব বললেন, না না কোন প্রোগ্রাম রাখবে না। আমার সাথে যাবে তুমি।

শওকত সাহেবের প্রবল উৎসাহে সত্যি সত্যি পরের শনিবার আমি চকলেটের একটা বাক্স নিয়ে তার ছেলের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। শহরের সম্ভ্রান্ত এলাকায় বিরাট এলাকা নিয়ে চমৎকার দোতলা বাসা। ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে স্থানীয় বাঙালিরা এসেছে, খাবারের বিশাল আয়োজন। আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, এখানে যারা এসেছে তাদের সবাই মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত। কারো সাথে আমার পরিচয় নেই। ভেবেছিলাম সন্ধেটা পুরোপুরি মাটি হবে, কিন্তু লোকজনের সাথে পরিচয় হওয়ার পর সময়টা বেশ ভালই কাটল। শওকত সাহেবের দুই ছেলে এবং তাদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় হলো। তৃতীয় ছেলেটি আমেরিকান বিয়ে করেছে বলে এরকম জায়গায় আসে না। আমি ভেবেছিলাম এই বৃদ্ধ মানুষটিকে এভাবে জনসন হাউজে ফেলে না রেখে নিজেদের বাসায় নিয়ে রাখার কথা বলব, কিন্তু তার সুযোগ হলো না। চারদিকে এত হৈ চৈ আনন্দ, তার মাঝে এ ধরনের কথাবার্তা মনে হয় একেবারে খাপ খায় না। আমি শওকত সাহেবের দুই ছেলের টেলিফোন নাম্বার নিয়ে এলাম, ফোনে কথা বলব কোন একদিন।

শরৎকাল পর্যন্ত শওকত সাহেব ভালই ছিলেন, শীতের শুরুতে তার শরীর খারাপ হয়ে গেল। এদেশে শীতকালটি বড় বাজে সময়। ভোর আটটা বেজে গেলেও সূর্য ওঠে না আবার বিকেল চারটার মাঝে অন্ধকার নেমে আসে। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, বৃষ্টিভেজা প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা সব মিলিয়ে মন খারাপ করা একরকমের আবহাওয়া। জনসন হাউজে ঘর গরম রাখার ভাল ব্যবস্থা নেই, শওকত সাহেবের বুকে কাশি বসে গেল। কাজ কামাই করে তিনি কয়দিন ঘরে বসে থাকলেন। আমি একদিন শওকত সাহেবের ছেলের বাসায় ফোন করলাম, ছেলে ছিলেন না তার স্ত্রী ফোন ধরলেন। নিজের পরিচয় দিতেই ভদ্রমহিলা একটু শঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

শওকত সাহেবের শরীর খারাপ।

কী হয়েছে?

ঠাণ্ডা লেগেছে, জ্বর কাশি। আমার মনে হয় তাকে আপনারা এখন আপনাদের বাসায় নিয়ে যান। এখানে থাকলে খুব কষ্ট হবে।

ভদ্রমহিলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনাকে আমার ভাশুরের টেলিফোন নাম্বার দিই, আপনি তাকে ফোন করে বলেন।

কী বলব?

শ্বশুরকে তার বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে।

আমি উষ্ণ হয়ে বললাম, আমি কেন বলব? বুড়ো একজন মানুষ কষ্ট পাচ্ছে শীতের মাঝে, ছেলেরা এত ভাল বাসায় থাকে আর বুড়ো বাবাকে নিয়ে নিজের বাসায় রাখতে পারবে না? এটা কোন ধরনের কথা?

অন্য পাশ থেকে ভদ্রমহিলাও উষ্ণ হয়ে উঠে বললেন, দোষ শুধু আমাদের? কতদিন নিজের ঘাড়ে টেনেছি আপনি জানেন? আমার সাহেবই শুধু ছেলে? অন্যেরা তার ছেলে না? দরকারে অদরকারে শুধু আমাদের খোঁজ পড়ে? অন্যেরা আছে কী জন্যে?

আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনারা বোঝেন, একজন বুড়ো মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন নিজের ছেলেরা দেখছে না জিনিসটা ভাল দেখায় না, তাই বললাম। যা ইচ্ছে হয় করেন।

আমি রেগে মেগে টেলিফোন রেখে দিলাম।

সন্ধেবেলা শওকত সাহেবকে দেখতে গেলাম। কম্বল মুড়ি দেয়ে বিছানায় পা তুলে বসে আছেন। ঘরের মাঝামাঝি ছোট একটা ইলেকট্রিক হিটার ঘরটাকে গরম করার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, এই ঠাণ্ডাটা বড় কাহিল করে দিয়েছে।

হ্যাঁ। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে এবার। আপনার শরীর কেমন?

এই বয়সে আর শরীর। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে কাটিয়ে দিই আর কয়টা দিন।

ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?

না যাইনি।

আপনার হেলথ ইন্স্যুরেন্স আছে?

ইন্স্যুরেন্স? মনে হয় আছে। মেজো ছেলেটা সেদিন নিয়ে গিয়ে করিয়ে দিল।

সেদিন করিয়ে দিল মানে? আগে অসুখ বিসুখ হলে কী করতেন?

শওকত সাহেবকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল। আমি কথা বলে বুঝতে পারলাম তার আলাদা করে কোন রকম হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেই। এ দেশের বুড়ো মানুষদের জন্যে সরকার থেকে দায়সারা যে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে সেটাই একমাত্র অবলম্বন। মেজো ছেলেটি তাকে নিয়ে যে ইন্স্যুরেন্স কিনে দিয়েছে সেটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। শওকত সাহেব মারা গেলে মেজো ছেলে মোটা অংকের টাকা পাবেন। বুড়ো মানুষ মারা তো যাবেনই তাকে বিক্রি করে কিছু বাড়তি টাকা পেলে মন্দ কী? ব্যাপারটা ভেবে আমার কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

শওকত সাহেবের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। ভদ্রলোকের মনটা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়েছিল। ঘুরে ফিরে শুধু তার মৃত স্ত্রীর কথা বললেন। হৃদয়হীন এই পৃথিবীতে স্ত্রীর স্মৃতি ছাড়া ভালবাসার আর কিছু তার জন্যে অবশিষ্ট নেই।

শওকত সাহেব এক সপ্তাহ পরে মারা গেলেন। রাতে কাজ থেকে ফিরে এসে ম্যানেজারের কাছে শুনলাম দুপুরে তার ঘর থেকে গোঁ গোঁ ধরনের একটা শব্দ হচ্ছিল। দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হলো। ভেতরে তিনি বিছানায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সাথে সাথে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ম্যানেজারের কাছে তার ছেলের টেলিফোন নাম্বার ছিল তাদেরকে খবর দেয়া হয়েছে। তার ঠিক কী হয়েছিল এখনো জানা যায়নি, সন্দেহ করা হচ্ছে স্টোক বা হার্ট অ্যাটাক জাতীয় কিছু হয়েছে।

হাসপাতালে যেতে আমার একেবারেই ভাল লাগে না। আমি তবু শওকত সাহেবকে দেখতে গিয়েছিলাম। ভিজিটরদের সময় পার হয়ে গিয়েছিল তবু আমাকে যেতে দিল। হাসপাতালের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। নাকে একটি নল লাগানো।

নিশ্চয়ই অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। হাতে পায়ে নানা ধরনের ওষুধপত্র যাচ্ছে। শওকত সাহেবের জ্ঞান নেই। তাকে ঘিরে তার তিন ছেলে এবং ছেলেদের স্ত্রী। আমার সাথে কিছু কথাবার্তা হলো। শওকত সাহেবকে দেখে শুনে রাখার জন্যে তারা আমাকে নানাভাবে ধন্যবাদ দিলেন। আমি কিছুক্ষণ থেকে ফিরে এসেছিলাম, সকালে খবর পেয়েছি রাতেই মারা গেছেন।

শওকত সাহেবের চেহলামে আমাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না, শেষ পর্যন্ত কি মনে করে গিয়ে হাজির হলাম। বাসা ভরা লোকজন, শোকের চিহ্নটি খুব স্পষ্ট নয়। একজন মৌলভী গোছের মানুষ ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, তিনি এক কোনায় বসে কোরান শরীফ পড়ছেন। খাওয়া-দাওয়ার আগে মিলাদ পড়ানো হলো। মৌলভী গোছের মানুষটি উর্দু আরবি মিশিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা বললেন। একটি কথা এরকম; শওকত সাহেবের মতো সৌভাগ্যবান মানুষ খুব বেশি নেই, তার মৃত্যুর পর তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য যে পরিমাণ দোয়া খায়েরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আমেরিকা দূরে থাকুক, বাংলাদেশেও আজকাল কোন মানুষ তাদের বাবা-মায়ের জন্য সেই পরিমাণ দোয়া খায়ের করতে চায় না। শুধু যে ছেলেরা তার আত্মার জন্যে দোয়া খায়ের করছে তাই নয়, তাদের স্ত্রীরাও করছে। চেহলাম উপলক্ষে খতমে ইউনুস শেষ করা হয়েছে এবং শওকত সাহেবের দুই পুত্রবধূ একলক্ষ বার দোয়া ইউনুস পড়ে ফেলেছেন। মৌলভী সাহেবের মতে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।

মিলাদ চলাকালীন ঘরের এক কোনায় একটি ভিডিও ক্যামেরায় পুরো ব্যাপারটি ধরে রাখা হচ্ছিল। কোথায় জানি শুনেছিলাম লাইফ ইন্স্যুরেন্সের টাকা তোলার সময় মৃত মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটা প্রমাণ দেখাতে হয়।

বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!