Ticker

6/recent/ticker-posts

মহাভারতের মহারণ্যে - প্রতিভা বসু [১৫]

amarboi
মহাভারতের মহারণ্যে
প্রতিভা বসু

১৫

ফিরে এসে ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধন জানালেন সেকথা। ধৃতরাষ্ট্রের তাতে কোনো চৈতন্য উদয় হয়েছে বলে মনে হলো না। তাঁর ধারণায় উৎকৃষ্ট অন্নভোজন আর উৎকৃষ্ট বস্ত্রপরিধানই সব। তিনি জানেন না, কাপুরুষেরাই অশনে বসনে পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে, অধর্মপুরুষেরাই অমর্ষশূন্য হয়। দুর্যোধন যাঁদের এতো বড় শত্রু, তাঁরাই বা দুর্যোধনের কাছে মিত্র হবেন কেমন করে? তাঁদের তিনি বিনষ্ট করতে কেন বদ্ধপরিকর হবেন না? যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী, যার গর্বে গর্বিত হয়ে সবাই মিলে তাঁকে এতোখানি যন্ত্রণায়, লজ্জায়, অপমানে দগ্ধ করেছে, সেই রাজলক্ষ্মীকেই বা কেন তিনি কেড়ে নেবেন না? ওরা তাঁর বীরত্ব দেখুক একবার। দুর্যোধন লুকিয়ে হত্যা করতে অক্ষম, সেটা তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্মের বিপরীত পন্থা। কিন্তু যোদ্ধা হিশেবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে জানেন তিনি। সভাচত্বরে জলভ্রমে পরিচ্ছদ উৎক্ষিপ্ত করলে, ওরা তাঁকে শত্রুসম্পত্তি দর্শনে বিভ্রান্ত ও রত্নানভিজ্ঞ মনে করে উপহাস করেছিলো। সেই উপহাসের শাস্তি তাদের দিতেই হবে। এজন্যই, অভ্যুদয় কালেই শত্রুদের উপেক্ষা না করে, পরিবর্ধিত ব্যাধির ন্যায় মূলোচ্ছেদ করা উচিত। সামান্য কণ্টকও কালক্রমে ব্রণকারণ হয়ে ওঠে।

মাতুল পূর্বেই বলেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধে কিছুতেই রাজি হবেন না, বিদুরই দেবেন না সেটা, কেননা এখনো ওরা প্রস্তুত হতে পারেনি।

ঠিকই বলেছিলেন। সব শুনে পিতা বললেন, ‘হে পুত্র! যুদ্ধ করা আমার অভিপ্রেত নয়।’

এরপরে ধৃতরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে আরো নানা বিষয় পর্যালোচনার পরে সৌবল নির্জনে বললেন, ‘একটা উপায় আছে যা তোমাকে তোমার মনোমতো স্থানে হয়তো পৌঁছে দিতে পারে। সেটা কোনো গোপন ষড়যন্ত্র নয়, ছদ্মবেশে কারো অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হয়ে কারোকে নিধন করাও নয়, কোনো কাপুরুষের নীতিও নয়। রাজাদের একটা ব্যসন মাত্র। আমি অক্ষবিদ্যায় অভিজ্ঞ, মর্মজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ। যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয়, কিন্তু তদ্বিষয়ে তাঁর নিপুণতা নেই। ক্ষত্রিয় রীতি অনুসারে দ্যূতের নিমিত্ত আহ্বান করলে তিনি আসবেন, এবং আমি অতি সহজেই তাঁকে পরাস্ত করবো।’

কথাটা দুর্যোধন খুব পছন্দ না করলেও মন্দের ভালো এটাই ভেবে নিলেন। তাঁর ইচ্ছা করছিলো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই অসম্মানের ভালো জবাব দেন। শিশুপাল কৃষ্ণের শত্রু আর দুর্যোধন পাণ্ডবদের শত্রু। শিশুপালকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে যেভাবে যথেষ্ট পরিমাণে অপমান করা হয়েছিলো এবং বধ করা হয়েছিলো, সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। আর নিধন না করলেও চূড়ান্ত অপমান তাঁকেও করা হয়েছে। দুর্যোধন এবং পাণ্ডবগণ একই কুরুবংশের সন্তান হিশাবে গণ্য, পরন্তু যার যার পিতার অংশ তারা তারাই সঠিকভাবে ভোগ করছে। উপরন্তু, এই মুহূর্তে রাজসূয় যজ্ঞ করে পাণ্ডবরা যেখানে পৌঁছেছেন, তাঁদের ব্যবহার সেই মর্যাদার উপযুক্ত শালীনতার গণ্ডিতে পড়ে না, সদ্বংশের গণ্ডিতে পড়ে না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে কে বোঝাবে সে কথা?

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘বিদুর আমাদের মন্ত্রী, বিদুর আমাকে যে মন্ত্রণা দেবেন, আমি তাই শুনবো। বিদুর দূরদর্শিতা প্রভাবে উভয় পক্ষের মঙ্গল ও ধর্মানুসারে মন্ত্রণা দেবেন।’ বলাই বাহুল্য, বিদুর সব শুনে দুর্যোধনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করলেন।

মহাভারত নামের পুস্তকটিতে যেমন ধর্ম বলতে বিদুরকে বোঝায়, সত্যবাদী বলতে যুধিষ্ঠিরকে বোঝায়, পুত্রস্নেহে অন্ধ বলতে বোঝায় ধৃতরাষ্ট্রকে। এই সব ক’টি প্রবাদই নিতান্ত অসত্য। বিদুরের মতো অধার্মিক যেমন সচরাচর দেখা যায় না, দু’একটা অনৃতভাষণ এই পুস্তকে যাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে তাঁর নামই যেমন যুধিষ্ঠির, স্বীয় পুত্রকে মরার বাড়া গাল দিয়েও যাঁর হৃদয়ে বিন্দুমাত্র কষ্টের সঞ্চার হয় না, তিনিই হচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্র।

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের পরামর্শ নিয়ে বললেন, ‘বিদুর যখন অক্ষবেদনে অনুমোদন করছেন না, তা হলে এসবে প্রয়োজন নেই। তোমার কী অভাব? তুমি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত, পৈতৃক রাজ্য বর্ধিত করেছো, প্রতিনিয়ত আজ্ঞাপ্রচার করে দেবেশ্বরের ন্যায় দীপ্তি পাচ্ছো, তবে তোমার দুঃখের বিষয় কী বলো?’

দুঃখের বিষয়টা যে কী সেটা কি দুর্যোধন বলেননি? পুত্রের সেই অসম্মানে পিতা হয়ে তাঁর হৃদয়ে কি কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে? বেদনার সঞ্চার? অপমানবোধ? কী ভাবে সবাই মিলে তাঁকে উপহাস করলো! দ্রৌপদী পর্যন্ত! তার প্রতিও দুর্যোধনের কি কিছু কম প্রতিশোধস্পৃহা জন্মেছে? প্রতিশোধস্পৃহা কর্ণেরও কিছু আছে বৈকি! কী ভাবে স্বয়ংবর সভায় জাত তুলে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দ্রৌপদী, তা কি ভোলা সম্ভব? আর তারপরে কী হলো? যে কন্যা উদ্ধত প্রতিবাদে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করে অজুর্নকে বরমাল্য দিলেন, তাঁকে বিয়ে করতে হলো পাঁচজনকে। পাঁচজনকে বিয়ে করা মেয়ের পক্ষেই বুঝি নববধূ হয়েও ওরকম নির্লজ্জ হাসি শোভা পায়। যে নারী পাঁচজনের সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দেয়, তোকে সমাজ এবং অন্যান্য পুরুষ সম্ভ্রমের চোখে দেখে না। সুযোগ পেলে দুর্যোধন তাঁকে ছেড়ে দেবেন না। পিতাকে বোঝানো অসম্ভব, কে শত্রু কে মিত্র এটা কারো শরীরে লেখা থাকে না। সেরকম কোনো সাংকেতিক শব্দও নেই। যে যাকে সন্তাপিত করে শুধু সে-ই জানে কে কার শত্রু।

এর পরে আর পিতার সঙ্গে কোনো বিতর্কে গেলেন না দুর্যোধন, কিন্তু নিজের সংকল্প থেকেও চ্যুত হলেন না। জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলেন দুষ্টু লোকের মিথ্যা প্রচারে স্বীয় সম্মানকে পদাহত হতে দেওয়াও একধরনের কাপুরুষতা। ক্ষতি যা করবার বিদুর সেটা ষোলো আনার স্থলে আঠারো আনাতেই পৌঁছে দিয়েছেন। এইবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এমন কোন দুর্নাম আর তাঁর বাকি আছে যা মুখে মুখে বিদুর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রটিয়ে বেড়াননি? ধৃতরাষ্ট্র না জানুন, দুর্যোধন জানেন বিদুর যতোটাই পাণ্ডবগণের হিতৈষী, ততোটাই ধার্তরাষ্ট্রদের অহিতাকাঙ্ক্ষী। স্থির করলেন, হয় অক্ষবেদনে যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ জানাবেন, নচেৎ যুদ্ধে নিহত হবেন। তিনি জানেন, পৌরুষশালী ব্যক্তি পরমার্থের সাপেক্ষ হয়ে স্বকার্য সাধনে প্রবৃত্ত হয় না। কর্তব্যানুষ্ঠান বিষয়ে দুইজনের মত সমান হওয়া নিতান্ত দুর্ঘট। কী ব্যাধি কী মৃত্যু কেউ শ্রেয় প্রাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করে না। অতএব ভবিষ্যৎ কালের অপেক্ষা না করে শ্রেয়স্কর কর্মের অনুষ্ঠান করাই কর্তব্য। দুর্যোধন দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘হয় পাণ্ডবলক্ষ্মী লাভ করবো, নতুবা আমার প্রাণধারণের আবশ্যকতা নেই।’ পুত্রের এই দৃঢ় কণ্ঠ শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্র ভৃত্যগণকে আদেশ করলেন, ‘তোমরা সহস্রস্তম্ভশোভিত হেমবৈদুর্যখচিত শতদ্বারবিশিষ্ট ক্রোশায়ত তোরণস্ফটিক নামে এক মহতী সভা শীঘ্র নির্মাণ করো।’

তাই হলো। সুনিপুণ শিল্পীগণ শীঘ্র সভা নির্মাণ করে সমুচিত দ্রব্যসামগ্রীতে সুশোভিত করে স্বল্পকাল মধ্যেই বহুরত্নে খচিত ও বিচিত্র হেমাসনে শোভিত করলেন। সভা সুসম্পন্ন হলো। তারপরেই ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, ‘তুমি ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে এসো।’

সঙ্গে সঙ্গে বিদুর বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার এই ইচ্ছে আমি কোনোরকমেই সমর্থন করতে পারছি না। আপনি আমাকে এই অনুমতি দেবেন না। এতে সুহৃদভেদ হয়।’

কথাটা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সুহৃদভেদ হয়েছে বলেই যে এই আয়োজন তা-ও বিদুর জানেন। রাজত্ব পেয়েও তাঁদের মন থেকে যে দুর্যোধনের প্রতি এক কণা বিদ্বেষও প্রতিহত হয়নি, সেটা অকাট্য সত্য। অতি প্রতাপশালী একজন রাজা, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী, সৈন্যস্থাপনে সুযোগ্য, তাঁর পক্ষে ভীষ্ম আছেন, দ্রোণাচার্য আছেন, অশ্বত্থামা আছেন, আছেন কর্ণ। সুস্থির হয়ে বসে তবে তো পাণ্ডবরা এদিকে মন দেবেন? সুতরাং দুর্যোধনকে তো তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিতেই দেখবেন। এ অবস্থায় যুধিষ্ঠির যদি জুয়াখেলায় মত্ত হয়ে উঠে হেরে যান, তবে তো সব গেলো। এই ভীতিতেই বিদুর কিছুতেই মত দিতে পারেন না।

কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘দৈব প্রতিকূল না হলে কলহ আমাদের পরিতাপিত করতে পারবে না। তুমি কুন্তীপুত্রকে গিয়ে নিয়ে এসো।’

চলবে...
বাকি পর্বগুলো পড়ুন এই লিঙ্কেঃ https://www.amarboi.com/search/label/mahabharatera-maharanye