Ticker

6/recent/ticker-posts

মহাভারতের মহারণ্যে - প্রতিভা বসু [১৬]

amarboi
মহাভারতের মহারণ্যে
প্রতিভা বসু

১৬

অগত্যা যেতেই হলো বিদুরকে। ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্র পাশাক্রীড়াচারীদের সম্মেলন ডেকেছেন। তুমি সেই ধূর্ত পাশাক্রীড়াচারীদের দেখবে। আমি ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাবাহী হয়েই এসেছি। নিবৃত্ত করতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তত্রাচ আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। এখন তুমি যা শ্রেয়স্কর মনে করো, তাই করো।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘দুর্যোধন ব্যতীত আর কোন কোন অক্ষবিদ সেখানে আছেন বলুন, আমি তাদের শতবার পরাজিত করবো।’

বিদুর বললেন, ‘অক্ষনিপুণ পাকাহাত শকুনি, বিবিংশতি, চিত্রসেন, রাজা সত্যব্রত, জয়, এঁরা সব সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।’

বিদুরের অনিচ্ছা বুঝেও যুধিষ্ঠির যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দ্রৌপদী প্রভৃতি স্ত্রীগণসহ, ভ্রাতাগণসহ, অনুচরসহচরবর্গভিব্যাহারে বেশ জাঁকজমক করেই হস্তিনাপুরে এলেন। সেই রাত্রি সুখে যাপন করে পরের দিন সভামণ্ডপে প্রবেশ করলে শকুনি বললেন, ‘এই সভামধ্যে সকলেই তোমার প্রতীক্ষা করছেন। দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ করা যাক।’

যুধিষ্ঠির আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, ‘দ্যাখো, কপট দ্যূতক্রীড়া অতি পাপজনক। এতে অণুমাত্র ক্ষাত্রপরাক্রম নেই। তুমি কী কারণে পাশাক্রীড়ার প্রশংসা করছো?’ একথা শুনে শকুনি অবশ্যই অবাক হয়েছিলেন। কেননা তিনি তো পাশাক্রীড়ার প্রশংসা করেননি। কিন্তু কিছু জবাব দেবার পূর্বেই যুধিষ্ঠির পুনরায় বললেন, ‘ধূর্ত কপটাচারীকে কেউ বিশ্বাস করে না।’ শকুনি কবে তাঁর সঙ্গে পাশা খেলেছেন যে ধূর্তকপটাচার করবেন? তারপরেই বললেন, ‘তুমি যেন নৃশংসের মতো অসৎপথ অবলম্বন করে আমাদের পরাজিত করো না।’

সভাগৃহে প্রবেশ করেই যুধিষ্ঠির অকারণে অভদ্রের মতো কেন এই কর্কশ উক্তিগুলো প্রায় মুখস্থের মতো বলে যাচ্ছিলেন কারোই সেটা বোধগম্য হচ্ছিলো না। দুর্যোধন কেবলমাত্র শ্রুতিগোচরে বিদুরের কথাই শুনছিলেন। যেমন জতুগৃহ তৈরি হলে তা কী কারণে বহ্নিযোগ্য গৃহে প্রবিষ্ট হয়েই ভীমকে বলেছিলেন, এই বক্তৃতাও অনেকটা সেই রকম। আবার বললেন, ‘আর্যলোকেরা মুখে ম্লেচ্ছভাষা ব্যবহার ও কপটাচার প্রদর্শন করেন না।’ যদিও সেই সভায় এ পর্যন্ত কোনো রাজাই কোনো কথা বলেননি। তদ্ব্যতীত, ম্লেচ্ছভাষা যুধিষ্ঠির ব্যতীত আর কোনো ক্ষত্রিয় অবগতও নন। রাজসূয় যজ্ঞ করে সম্রাট হয়ে তিনি কি ভারসাম্য হারিয়েছেন? যুধিষ্ঠির বলেই যাচ্ছিলেন, কোনো জবাবের সময়ও দিচ্ছিলেন না, ‘শোনো, অপকট যুদ্ধই সৎপুরুষের লক্ষণ। আমি শঠতা করে সুখ ও ধনপ্রাপ্তির ইচ্ছা করি না।’ অর্থাৎ যা করে তিনি রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন।

আশ্চর্য! এই তো কদিন পূর্বে তিনিই তাঁর ভ্রাতাদের এবং কৃষ্ণকে জরাসন্ধের অন্তঃপুরে পাঠিয়ে কোনো পূজানিবন্ধনে উপবাসী, অসতর্ক জরাসন্ধকে অসহায় পেয়ে কপটযুদ্ধে খুন করালেন! এসব বলতে তাঁর কি একটু লজ্জাও হলো না? তিনি তাঁর স্বীয় লোভ চরিতার্থ করতে ভ্রাতাদের দিয়ে একটি ঘটনাও কি সৎভাবে সম্পন্ন করেছেন? জরাসন্ধকে গভীর রাত্রে একা পেয়ে এভাবে হত্যা করার প্রস্তাবটা অবশ্য কৃষ্ণই দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি সম্মতি দিলেন কেন? ব্রাহ্মণ সেজে যাওয়াতে জরাসন্ধর নিকট তাঁরা অতি সাদর সম্ভাষণ ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি কল্পনাও করেননি নিতান্ত অধঃপতিত ইতর ব্যক্তি ব্যতীত কোনো ক্ষত্রিয় সন্তান এরকম কাপুরুষসুলভ কপটাচার করতে পারে। আর কীভাবে শিশুপালকে খুন করা হলো! সেটা ভাবতেও দেহ কণ্টকিত হয়।

শকুনি দুর্যোধনের মাতুল, গান্ধারীর ভ্রাতা। সেকালের নিয়ম অনুযায়ী তিনি কুটুম্বিতা সূত্রে যুধিষ্ঠিরের মাতুল। যদি কোনো বক্তব্য তাঁর থেকেই থাকে, মাতুলজ্ঞানে তাঁকে প্রথমে সম্ভাষণ জানিয়ে, অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যথোপযুক্ত সম্ভাষণ জানিয়ে, বলতে পারতেন। মনে হচ্ছিলো, কারোকে যেন তিনি তাঁর উচ্চাসন থেকে দেখতেই পাচ্ছিলেন না। তাঁর ব্যবহারে স্পর্ধিত গর্ব যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ছিলো।

সব শুনে শকুনি বললেন, ‘তুমি যদি আমাকে ধূর্ত বলেই স্থির করে থাকো, যদি দ্যূতক্রীড়ায় ভীত হয়ে থাকো, তা হলে দ্যূতক্রীড়া থেকে বিরত হওয়াই ভালো।’

যুধিষ্ঠির বিরত হলেন না। শুরু হলো খেলা এবং একটু বাদেই বোঝা গেলো শকুনি প্রকৃতই দক্ষ খেলোয়াড়। কিন্তু যেহেতু যুধিষ্ঠির সমানেই হারতে লাগলেন, মহাভারতের ভাষ্যে শকুনি সর্বদাই ‘‘শঠতা’’ করে তাঁকে হারালেন। যুধিষ্ঠিরের মতো অক্ষবিদ্যায় অনিপুণ ব্যক্তিকে সৌবলের মতো সর্বজনস্বীকৃত দক্ষ এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড় শঠতা বা ধূর্ততা করে কেন হারাবেন? এখানেও সেই প্রচারের মহিমা। রচয়িতা বলেই খালাস, ‘শকুনি শঠতা অবলম্বন করে পাশা খেলে বললেন, ‘‘এই জিতলাম’’।’ আর তার সঙ্গে শুরু হলো বিদুরের অকথ্য ভাষায় দুর্যোধনকে আক্রমণ। তিনি পুনরায় বললেন, ‘পূর্বে যে পাপাত্মা জাতমাত্রই গোমায়ুর মতো বিকৃতস্বরে রোদন করেছিলো, সেই কুলান্তক দুর্যোধন সকলের বিনাশের কারণ তাতে সন্দেহ নেই।’

এখানে একটা কথা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য, দুর্যোধনের জন্য হস্তিনাপুরীর কোনো বিনাশই হয়নি। হবেও না। দুর্যোধন না বাঁচলে ধৃতরাষ্ট্রকে হত্যা করতে এদের সময় লাগতো না। যার জন্য এই বিনাশের আশঙ্কা, তিনি যুধিষ্ঠির। দুর্যোধন সাগরাম্বরা পৃথিবীর একজন অদ্বিতীয় শাসক বলে স্বীকৃত। রাজা হয়ে তো তিনি পিতৃরাজ্য আলোকিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, বিনাশের কারণ যুধিষ্ঠিরও নয়, বিদুর নিজে, এবং তাকে প্রলম্বিত করে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছেন তাঁর পিতা দ্বৈপায়ন। সবই অবশ্য ওই একমাত্র যুধিষ্ঠিরের জন্যই। এখন সত্যবতীর কৃপায় সবাই দ্বৈপায়নের পুত্র পৌত্র। কিন্তু ক্ষেত্রজ পুত্র পৌত্র নয়, যারা অবৈধ তারাই প্রধান ভূমিকায়। এখন আর আর্য অনার্যের প্রশ্ন নেই, সবার জন্মই অনার্য, মিশ্রিত রক্তে। এখন শুধু বৈধ-অবৈধের বিবাদ। বিদুর বললেন, ‘দুরাত্মা দুর্যোধন দ্যূতমদে মত্ত হয়েছে (যদিও দুর্যোধন খেলছিলেন না)। মহারাজা, পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করে অচিরাৎ আপনার পুত্রের পতন হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মহারাজ! আপনি আদেশ দিন, সব্যসাচী অর্জুন দুর্যোধনকে বধ করবেন। এই পাপী নিহত হলে কৌরবগণ সুখী হবে। কাকশৃগালতুল্য দুর্যোধনের পরিবর্তে ময়ূরশার্দুল সদৃশ পাণ্ডবদের ক্রয় করুন।’

সমস্ত জীবন ধরে এই একই বাক্য দুর্যোধন শুনে এসেছেন বিদুরের মুখে। জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখে আসছেন তাঁর জন্মদাতা পিতা এর বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। আজ হঠাৎ দুর্যোধনের সমস্ত দুঃখবেদনা ক্রোধ অপমান অসম্মান আগুনের মতো জ্বলে উঠলো রক্তের মধ্যে। অত্যন্ত কষ্টে সংযত হয়ে বললেন, ‘হে ক্ষত্ত! সব সময়ে আমাকে অবমাননা করো কেন? তার কারণ, যারা আমাদের শত্রু তুমি তাদের প্রতি অনুরক্ত। তুমি কি ভাবো যে আমি কিছুই বুঝি না? তোমার বাক্যই কৌরবদের প্রতি তোমার মনের প্রতিফলন। তুমি আমাদের আশ্রিত হয়েও কী কারণে উক্ত বিষয়ের বিরুদ্ধ আচরণে প্রবৃত্ত হয়েছো? তুমি আমাদের তিরস্কার করতে চাও করো, কিন্তু আর তুমি এভাবে আমাকে অপমান কোরো না। আমি তোমার মন বুঝেছি, শত্রুকার্যে ব্যাপৃত থেকো না। আমি তো তোমার কাছে আমার হিত জিজ্ঞাসা করি না। তুমি আমার শাস্তা নও। শাস্তা শুধু একজনই। আমি তাঁর শাসনানুসারেই কার্য করে থাকি। তিনি মস্তক দ্বারা শৈলও ভেদ করতে পারেন, গর্ভস্থ শিশুকেও শাসন করতে পারেন। তুমি কেন বলপূর্বক আমাকে অনুশাসন করো?’

বিদুর যে তাঁদের কতো বড়ো শত্রু সেকথা ধৃতরাষ্ট্রের জ্ঞানের মধ্যে কেন যে প্রবিষ্ট হয় না ভেবে পাওয়া যায় না। স্বীয় সন্তান সম্পর্কে অবিশ্রান্ত এসব শুনতে শুনতে কখনো এক পলকের জন্যও কি তাঁর পুত্রের জন্য বিন্দুমাত্র বেদনার সঞ্চার হয় না? পাণ্ডবরা যে গোপনে গোপনে গিয়ে দ্রুপদের সঙ্গে এই সম্পর্ক পাতালো, পাঁচজনে মিলে একটি মেয়েকে বিবাহ করে ভরতকুলকে কলঙ্কিত করলো, কৌরবদের কারোকে কিছু জানালো না, মাত্রই কয়েক দিনের জন্য বারণাবতে গিয়ে এক বছরের মধ্যেও ফিরে এলো না, এ সব নিয়ে তিনি কি কিছুই চিন্তা করেন না? রাজত্বের চাকা ভীষ্মর জন্যই ঘুরছে, আর তাঁর মনের চাকা ঘোরাচ্ছেন বিদুর। তিনি বিদুরের কথারই প্রতিধ্বনি করে যখন বলেন, তিনি পাণ্ডবদের কিঞ্চিৎমাত্র কোনো দোষ দেখতে পান না, যতো দোষ ঐ দুর্যোধনের—তখন মনে হয় এইরকম একজন মূঢ়মতি মানুষ কী করে রাজার সিংহাসনে বসে আছেন। মানুষটির তো কাণ্ডজ্ঞান বলে সত্যিই কিছু নেই। পাণ্ডবরা যে তাঁকে বিচ্যুত করে ঐ সিংহাসনটিতে বসবার জন্যই এতো কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, এবং দুর্যোধন জীবিত আছেন বলেই যে আজও তিনি টিকে আছেন, সে কথা তাঁকে কে বোঝাবে? দুর্যোধনের যোগ্যতাতেই যেমন রাজত্বের পরিধি বেড়েছে, তেমন প্রজারাও দুর্যোধনের জন্যই সুখে আছে, শান্তিতে আছে, বিদ্রোহ নেই, এসবও কি তিনি দেখছেন না? বুঝতে পারছেন না? কোথা থেকে কোন পাঁচটি মানুষ পর্বত থেকে নেমে এসে পাণ্ডুর পুত্র সেজে তৎক্ষণাৎই ধৃতরাষ্ট্রকে উচ্ছিন্ন করতে চাইলে বিদুরের কাছে অবশ্যই দুর্যোধন প্রতিবন্ধক। অবশ্যই দুর্যোধনের মৃত্যু চান তিনি, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রেরও তো স্বীয় বুদ্ধিতে কিছু বোঝা উচিত ছিলো।

খেলার প্রারম্ভ থেকেই বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে এমন সব অসম্মানজনক উক্তিতে জর্জরিত করছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র যে অতবড়ো সাম্রাজ্যের একজন অধিকমান্য মহারাজা, বিদুরের জ্যেষ্ঠ, এবং বিদুর তাঁর অর্থবহ, সে কথা মনে হচ্ছিলো না। ধৃতরাষ্ট্র তথাপি বিদুরের এই ব্যবহারে কিঞ্চিৎমাত্রও অসম্মান বোধ করছিলেন না।

খেলতে খেলতে যুধিষ্ঠির যখন সর্বস্বই হারালেন, শকুনি বললেন, ‘দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের সবই তুমি নষ্ট করলে। আর তোমার অপরাজিত ধন কী আছে বলো।’

যুধিষ্ঠির দাম্ভিক কণ্ঠে বললেন, ‘আমার অসংখ্য ধন আছে। ধনের কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেন? আমি অযুত পদ্ম খর্ব অর্বুদ শঙ্খ মহাপদ্ম নিখর্ব কোটি মধ্য ও পরার্ধসংখ্যক ধনদ্বারা এ সমস্ত জনসমক্ষে তোমার সঙ্গে ক্রীড়া করবো।’

আবার শুরু হলো খেলা। হিতৈষীরা বারণ করেছিলেন, যুধিষ্ঠির শোনেননি। অনুপার্জিত ধনদৌলতের গরম যুধিষ্ঠিরকে তখনো গরম করে রেখেছে। খেললে তিনি আরো যাঁরা খেলতে এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গেও খেলতে পারতেন, কিন্তু সেখানে তাঁর দম্ভে আঘাত লাগছিলো। তাঁর জেদ তিনি শকুনির সঙ্গেই খেলবেন। সুতরাং তাঁর সঙ্গেই খেললেন এবং অবধারিতভাবে পুনরায় হেরে গেলেন। হারতে হারতে যখন নিষ্কপর্দক হলেন, তখন একজন একজন করে প্রত্যেকটি ভাইকেও বাজি রেখে হারলেন। শেষে নিজেকেও পণ রাখলেন। তাতেও যখন হারলেন, তখন দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন। সকলে হায় হায় করে উঠলো। সমস্ত সভা তাঁর এই অধঃপতিত কর্মে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হলো। বৃদ্ধগণ ধিক্কার দিতে লাগলেন। তিনি কিছুই গ্রাহ্য করলেন না। এতোক্ষণ পঞ্চভ্রাতা দুর্যোধনাদিদের দাস ছিলেন এখন তাঁদের পত্নীও তাঁদের দাসী হলেন। বিদুর জন্মাবধি দুর্যোধনকে যতো অপমান করেছেন, তাঁর পুত্র হয়তো সেই ঋণ এইভাবে শোধ করলেন।

কেবলমাত্র পুত্র যুধিষ্ঠিরই তো নন, সেই সঙ্গে অন্য চারটি পাণ্ডবভ্রাতার সাহায্যে বিদুর সমস্ত রাজ্য সর্বতোভাবে গ্রাস করবার লোভে এতোদিন যাবৎ যতো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, একমাত্র বাধাস্বরূপ দুর্যোধনকে আর তার বন্ধু কর্ণকে যতো ভাবে আঘাত করেছেন, এইভাবেই সেই অন্যায়ের প্রতিবিধানের কাছে মাথা নত করতে হলো।

ঠিক সেই নিয়মেই, সেদিন ধনসম্পদে মত্ত হয়ে দুর্যোধনকে দ্রৌপদী এবং কৃষ্ণসহ সর্বজন যেভাবে উপহাস করে যতো আমোদিত বোধ করেছিলেন, দ্রৌপদীকে সভার মধ্যে আনয়ন করে ‘দাসী’ ‘দাসী’ বলে তার শোধ নিলেন দুর্যোধন। কর্ণ উপভোগ করলেন। কিন্তু এই ব্যবহার অবশ্যই দুর্যোধনের পক্ষে অতিশয় অশালীন। এই প্রতিশোধের মধ্যে কোনো সভ্যতা ছিলো না। দ্রৌপদীকে দুঃশাসন চুলের বেণী ধরে সভার মধ্যে আনয়ন করে অতি অভদ্রভাবে অতো সব মাননীয় ব্যক্তিদের সম্মুখে শাড়ি ধরে টানাটানি করলো, এটা অবশ্যই অমার্জনীয় অপরাধ। পাণ্ডবরা সবাই যার যার উত্তরীয় ছুঁড়ে দিলেন তাঁর দিকে। কর্ণকে তাঁর যোগ্যতার মূল্য না দিয়ে, পিতাভ্রাতার প্রতিজ্ঞা না মেনে জাত তুলে প্রত্যাখ্যান করে, স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদী যতো অপমান করেছিলেন, অথবা যজ্ঞের দিন ময়দানবের তৈরি অপূর্ব সভাটিতে পুনঃপুন দুর্যোধনকে বিভ্রান্ত করে সদলবলে যেভাবে উপহাস করেছিলেন, সেটাও মার্জনাযোগ্য নয়। কিন্তু এখানে একজন মহিলাকে নিয়ে এই ব্যবহার, বলা যায় সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে ভীম বললেন, ‘হে যুধিষ্ঠির! দ্যূতপ্রিয় ব্যক্তিরা স্বগৃহস্থিত বেশ্যাগণকেও পণ রেখে খেলে না। তাঁরা তাদের প্রতিও কিঞ্চিৎ দয়া প্রকাশ করে থাকেন।’ বলতে বলতে তাঁর সারা দেহ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকোতে লাগলো। দ্রৌপদী একটা তর্ক তুললেন, যুধিষ্ঠির কার অধীশ্বর হয়ে তাকে দ্যূতে সমর্পণ করেছেন? অগ্রে নিজেকে অথবা পূর্বে দৌপ্রদীকে দুরোদর মুখে বিসর্জন করেছেন?

দুঃশাসনও ‘দাসী’ ‘দাসী’ বলে উচ্চৈঃস্বরে হাসছিলেন। এমনই হাসির রোল যেদিন দুর্যোধনকে ব্যথিত করেছিলো, নিজেকে সেদিন নিশ্চয়ই অতি অসহায় এবং দীন বলে মনে হয়েছিলো তাঁর। আজ দ্রৌপদীকে এই হাসির রোল নিশ্চয়ই তেমনি ব্যথিত ও দীনভাবাপন্ন করে তুলছিলো। কৌরবদের আজকের নির্দয় অভদ্র ব্যবহারের পেছনে মূল কথাটা প্রতিশোধস্পৃহা।

তবু দ্রৌপদী স্ত্রীলোক, তারা পুরুষ। তদ্ব্যতীত, দুঃশাসন যেভাবে তাঁকে সভার মধ্যে নিয়ে এসেছে বা যেভাবে তাঁর বস্ত্র ধরে টানাটানি করছিলো, সেটা অতীব অভব্য ব্যবহার। খুব আশ্চর্য, কেউ তা নিয়ে একটা কথাও বলছিলেন না। দ্রৌপদী ক্রন্দন করতে করতে বললেন, ‘হায়, ভরতবংশীয়গণের ধর্মে ধিক্। ক্ষাত্রধর্মজ্ঞগণের চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সভাস্থ সমস্ত কুরুগণ স্বচক্ষে কুরুকর্মের ব্যতিক্রম নিরীক্ষণ করছেন, কিন্তু কেউ এদের নিন্দা করছেন না। বোধহয় এদেরও এই কর্মে অনুমোদন আছে। দ্রোণ ভীষ্ম বিদুর, এঁদের কিছুমাত্র সত্ত্ব নাই। প্রধান প্রধান কুরুবংশীয় বৃদ্ধগণও দুর্যোধনের এই অধর্মানুষ্ঠান অনায়াসে উপেক্ষা করছেন।’

ভীষ্ম বললেন, ‘হে সুভগে! একদিকে পরবশ ব্যক্তি পরের ধন পণ রাখতে পারেন না, অন্যদিকে স্ত্রী স্বামীর অধীন, এই উভয়পক্ষই তুল্যবল বোধ হওয়াতে তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর বিবেচনায় আমরা অসমর্থ। বিশেষত যুধিষ্ঠির আপনার মুখে স্বীকার করেছেন, ‘‘আমি পরাজিত হয়েছি’’। শকুনি দ্যূতক্রিয়ায় অদ্বিতীয়। যুধিষ্ঠির স্বয়ং তার সঙ্গে ক্রীড়া করতে অভিলাষী। তিনি স্বয়ং তোমার এই অবমাননা উপেক্ষা করছেন। আমরা কী করে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি?’

এই জবাবটা ভীষ্মের উপযুক্ত হলো না। এটা কোনো জবাবই নয়। গৃহবধূকে এভাবে টেনে সভার মধ্যে অপমান করা যে অন্যায়, সে কথাটাই তাঁর বলা উচিত ছিলো। যুধিষ্ঠির তাঁকে পণ্য করে যতো অসম্মানই করে থাকুন, সেটা আলাদা। কিন্তু বিনিময়ে যেভাবে এঁরা আক্রোশ মেটাচ্ছেন, তার প্রতিবাদ করা গুরুজনদের কেবলমাত্র উচিতই নয়, কর্তব্য। কিন্তু তা কেউ করেননি। কেন করেননি? তার মানে কি এটাই ধরে নেবো যে দ্রৌপদী স্ত্রী কিংবা পুরুষ এটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলো না। স্ত্রীলোকের প্রতি আলাদা কোনো সম্মানের প্রশ্ন নেই। যদি তা থাকতো তাহলে দ্রৌপদীকে সভায় এনে সকলের সম্মুখে, বিশেষত যেখানে ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি গুরুজনেরা সকলেই উপস্থিত, সেখানে এই অশালীন আচরণ করার সাহস তাদের কখনোই হতো না। সেকালের সমাজে মাননীয় অতিথি এলে অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোককেও উপঢৌকন দেওয়া হতো। সেই মনোভাব থেকেই কি দ্রৌপদীকে এভাবে সভার মধ্যে টেনে অানায় তাঁরা কোনো অন্যায় দেখতে পাননি?

আরো একটা কথা ভীষ্ম বললেন, ‘পরবশ ব্যক্তি পরের ধন পণ রাখতে পারেন না, অন্যদিকে স্ত্রী স্বামীর অধীন। এই উভয় পক্ষই তুল্যবল বোধ হওয়াতে তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর বিবেচনায় আমরা অসমর্থ।’ তাই যদি হয়, তা হলে যুধিষ্ঠিরই তো দ্রৌপদীর একমাত্র স্বামী নন, আরো তো চারজন স্বামী আছেন, তাঁরা কেন কোনো প্রতিবাদ করলেন না? অন্যের স্ত্রীকে পণ রাখার অধিকার যুধিষ্ঠির কোথায় পেলেন? পুরাকালের নিয়ম অনুসারে কনিষ্ঠ ভ্রাতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অধীন, কিন্তু তাদের স্ত্রীরা নিশ্চয় তাদের স্বামীর অধীন। তাহলে সেই স্বামীরা নিঃশব্দ রইলেন কেন? তাঁরা তো দ্রৌপদীকে পণ রাখেননি। তাঁরা কেন কোনো প্রতিবাদ করলেন না? শেষ পর্যন্ত এটাই মনে হয়, প্রতিবাদ যখন কেউ করলেন না, গুরুজনেরাও নন, সভাস্থ অন্যান্য জনেরাও নন, স্বামীরাও নন, তবে হয়তো দ্রৌপদীর কারো কাছেই মহিলা বলে আলাদা সম্মান পাবার কোনো প্রশ্ন ছিলো না। অথবা জুয়াখেলার নিয়ম অনুসারে, অনুক্ষণ অপমানিত দুর্যোধন আর কর্ণ যা করছিলেন, সেটা কিছু অন্যায় নয়। দুর্যোধনের কোনো এক ভ্রাতাই একমাত্র ব্যক্তি যার মুখে একটি প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো। বিকর্ণ বললেন, ‘যুধিষ্ঠির ব্যসনাসক্ত হয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন, অধিকন্তু পণ রাখবার পূর্বে তিনি স্বয়ং পরাজিত হয়েছেন, তাতে তিনি স্বত্ববর্জিত হয়েছেন। এসব বিবেচনা করে আমি দ্রৌপদীকে জয়লব্ধ বলে স্বীকার করতে পারি না।’

বিকর্ণর একথা শুনে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘দেবতারা স্ত্রীলোকদের এক ভর্তাই বিধান করেছেন। দ্রৌপদী সেই বিধি লঙ্ঘন করে যখন অনেক ভর্তার বশবর্তিনী হয়েছেন, তখন ইনি বারস্ত্রী। সুতরাং সভামধ্যে আনয়ন, বা বিবসনা করা, মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়।’

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘হে নৃপতে। ভীম অর্জুন নকুল সহদেব তোমার বশীভূত, দ্রৌপদী পরাজিত কিনা তুমিই বলো না।’ হাসতে হাসতে বসন সরিয়ে ঊরুতে চাপড় দিলেন। বলাই বাহুল্য, ব্যবহারটা অশালীন।

কিন্তু আশৈশব তিনি বিদুরের বাক্যদংশনে যে জ্বালায় জ্বলেছেন, বিদুরের পরামর্শে পাণ্ডব নামধারী পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে যে বৈরীভাব সৃষ্টি হয়েছে, নিঃশব্দে যে গ্লানি, অপমান, অসম্মান, সতত সহ্য করেছেন, এতোদিনে সেই সব অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরে দুর্যোধনের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলা আশ্চর্য নয়। বিশেষত, মহিলারা যে সমাজে ভোগের সামগ্রী ব্যতীত আর কিছু নয়। বিশেষত, যে স্ত্রী পঞ্চপতিগামিনী।

তদ্ব্যতীত, দ্রৌপদী এখন কুরুকুলবধূ বলে নিজেকে জাহির করলেও, যজ্ঞের দিন যে চাপল্য প্রকাশ করেছিলেন সেই ব্যবহারটা বিন্দুমাত্র সুষ্ঠু ছিলো না। অন্যকে অসম্মান অপমান করলে, পরিবর্তে অসম্মানিত অপমানিত হবার ঝঁুকি থাকে বৈকি। স্বয়ংবর সভায় জাত তুলে অতি অন্যায়ভাবে কর্ণকে অপমান করেছিলেন দ্রৌপদী, তার মধ্যে কোনো শালীনতা ছিলো না। অতঃপর একজনের গলায় বরমাল্য দিয়ে বিবাহের পরেও তিনি তাঁর বরণীয় পতির জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সকল ভ্রাতার সঙ্গেই বা কী করে বিবাহিত হলেন? কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করবার সময়ে তাঁর কণ্ঠে যে জোর ছিলো, বিবাহের সময়ে কেন তেজস্বিনী দ্রৌপদীর কণ্ঠ নিঃশব্দ রইলো?

যুধিষ্ঠিরের মান সম্মান ঐশ্বর্য কিছুই তাঁর স্বোপার্জিত নয়। পত্নীটিও নয়। অনুপার্জিত সমস্ত কিছুই তিনি তাঁর জুয়ার নেশায় সমর্পণ করে ভ্রাতাগণসহ দ্রৌপদীকে নিয়ে কুরুদের দাস হলেন।

দুরোদর রাজাদের বিবিধ ব্যসনের মধ্যে একটা। খেলার জন্য সকল রাজাই সকলকে ডাকতে পারেন—সেটাই নিয়ম। সেটা একটা সম্মানের ব্যাপার। এই খেলার আয়োজন যে কোনো রাজা যে কোনোদিন করতে পারেন, খেলতেও পারেন। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডাকলেও একা তাঁকেই ডাকা হয়নি; অন্যান্য কীর্তিমান রাজারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যুধিষ্ঠির নিজেই শকুনির সঙ্গে খেলতে অভিলাষী হলেন। কেন অভিলাষী হলেন তার মধ্যে যে একটা গূঢ় অভিসন্ধি ছিলো সেটা কেউ ধরতে পারেননি। তিনি নিজেই প্রকাশ করেছিলেন সে কথা। সরবে সদরে নয়, দ্রৌপদীর বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর মনে হয়েছিলো খেলতে খেলতে একবার না একবার তিনি জিতবেনই, এবং তখন দুর্যোধনের সমস্ত ঐশ্বর্য তাঁর ক্ষমতার অধীন হবে। একথা যে তিনি শুধু স্ত্রীকেই বলেছিলেন তা-ই নয়, ক্রুদ্ধ ভ্রাতা ভীমকেও বলেছিলেন। নচেৎ, এ খেলাটা যদি তিনি অন্য কারো সঙ্গে খেলতেন, হয়তো জিতেও যেতে পারতেন। কিন্তু দুর্যোধনকে না হারাতে পারলে সুখ কোথায়? এই খেলা যে সবাই পণ নিয়ে খেলেন তা নয়। দুর্যোধনও পণের কথা বলেননি, বলেছিলেন যুধিষ্ঠির নিজেই। তিনি জানতেন তাঁর যতো ঐশ্বর্য আছে, তার সঙ্গে এঁরা কোনোরকমেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারবে না, অতএব এক সময় ধরা দিতেই হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাসনা তাঁর মিটলো না। বিদুরের মতো তাঁরও শান্তনুর সিংহাসনটি শেষ লক্ষ্য।

হিতৈষীরা তাঁকে শকুনির সঙ্গে খেলতে বারণ করেছিলেন, তিনি শোনেননি। কুরুরা একটা অভিসন্ধি নিয়ে খেলার আয়োজন করলেও, ফলাফল বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন না। কেননা যুধিষ্ঠির যে সৌবলের সঙ্গেই খেলবেন এমন তো কোনো কথা নেই। যুধিষ্ঠিরের মনে অথচ সেই নিশ্চয়তা ছিলো। ধনদৌলতের আধিক্যে তিনি যে এঁদের অপেক্ষা অনেক বেশি ঐশ্বর্যবান, সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন। সেজন্যই গৌরব করে বলেছিলেন, ‘পণ-পূর্বক খেলো, দেখি তোমাদের কী আছে।’ কিন্তু মজাটা এই যে সারা রাজ্যেই রটে গেলো দুর্যোধনের ঈর্ষাতেই যুধিষ্ঠিরের এতো বড় একটা ক্ষতি হলো। যুধিষ্ঠির খেললেন, যুধিষ্ঠির হারলেন, অতি নিন্দিত জুয়াড়িদের চাইতেও অধিক নিন্দিত জুয়াড়ি হয়ে স্বীয় পত্নীকেও পণ রাখলেন; তথাপি যুধিষ্ঠির সৎ, যুধিষ্ঠির নির্দোষ, যুধিষ্ঠির সরল, আর তাঁর সব মন্দকর্মের দায় নিতে হলো দুর্যোধনকে। অবশ্য কর্ণ সৌবল্য বাদ গেলেন না।

এরমধ্যে যেটা উল্লেখযোগ্য তা ভীষ্ম এবং দ্রোণের চুপ করে থাকা। তার অর্থ সম্ভবত এটাই যে তাঁরা সেখানে দুর্যোধনের দোষ দেখতে পাননি। সহসা বিদুর তাঁর পক্ষে যতোটা সম্ভব ভদ্রভাষায় বললেন, ‘হে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ, তোমরা অন্যায় দ্যূতক্রীড়া করেছো। যেহেতু সভামধ্যে স্ত্রী নিয়ে বিবাদ করছো, তোমাদের রাজ্যের কল্যাণ বলে আর কিছুই রইলো না। তোমরা সকলেই কুমন্ত্রণা-পরতন্ত্র হয়েছো। সভামধ্যে অধর্মানুষ্ঠান হলে সমুদয় দূষিত হয়। এখন আমার ধর্মবাক্য শ্রবণ করো। দ্যাখো, যদ্যপি যুধিষ্ঠির আত্মপরাজয়ের পূর্বে দ্রৌপদীকে পণ রেখে ক্রীড়া করতেন, তা হলে উনি যথার্থ ঈশ্বর হতেন। কিন্তু অনীশ্বরের নিকট বিজিত ধন, আমার মতে স্বপ্নার্জিত ধনের ন্যায়। অতএব হে কৌরবগণ! তোমরা গান্ধাররাজের বাক্য শ্রবণে বিমূঢ় হয়ে ধর্মচ্যুত হয়ো না।’

দুর্যোধন দ্রৌপদীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে যাজ্ঞসেনী! ভীম অর্জুন নকুল সহদেবের মতই আমার মত। যদি তাঁরা যুধিষ্ঠিরকে অধীশ্বর বলেন, তাহলে তোমার দাসীত্ব মোচন হবে।’

হঠাৎ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বলতে লাগলেন, ‘আরে দুর্বিনীত দুর্যোধন। তুই একেবারে উৎসন্ন হলি। যেহেতু কুরুকুলকামিনী, বিশেষত পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে সম্বোধন করলি।’

বিদুর বলেছেন, অতএব ধৃতরাষ্ট্রকে ছেলের বিরুদ্ধে কিছু তো বলতেই হবে। এই প্রৌঢ় রাজাটির অবিবেচনা যতো গভীর, দুর্যোধনের দুর্ভাগ্য ততোধিক। দুর্যোধন তাঁর বয়স্ক পুত্র; স্বাবলম্বী, প্রজাবৎসল বলে খ্যাত একজন রাজা। সভার মধ্যে সকলের সম্মুখে পিতাই যদি তাঁর নিন্দায় মুখর হন, এভাবে অসম্মান করেন, তাহলে অন্যেরা বলবে না কেন? পরিজনদের মধ্যে এমনিতেই বিদুর তাঁকে যে চিত্রে চিত্রিত করে রেখেছেন, সেই চিত্র তবে আর কেমন করে মুছে যাবে? প্রচারের সাহায্যে বিদুর তাঁকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তাতে উত্ত্যক্ত হয়ে দুর্যোধন আজ যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মাত্রাজ্ঞান হারান, খুব কি দোষের সেটা?

বিদুর ধর্ম! বিদুর মিথ্যা বলতে জানেন না। বিদুর সততার প্রতীক। বিদুর বিবেকের প্রতীক। আর স্বীয় পিতা ধৃতরাষ্ট্র তার ছায়া। দুর্যোধনের জীবনের গভীরতম কষ্টের জায়গা সেটাই।

তারপরেই ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে তার স্বামীদের সহ সমুদয় ধনসম্পত্তিও ফেরৎ দিলেন। কর্ণ বললেন, ‘অসামান্য রূপবতী স্ত্রী দ্রৌপদীর মতো কোনো স্ত্রীলোকের এতাদৃশ কর্ম কর্ণগোচর হয়নি। পাণ্ডবগণ দুস্তর জলপ্লাবনে নিমগ্ন হয়েছিলেন, পাঞ্চালী তরণী হয়ে পার করে দিলেন।’

কর্ণের কথা শুনে অসিহষ্ণু ভীম দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে বললেন, ‘হা! স্ত্রী পাণ্ডবগণের গতি হলো?’

অতঃপর ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞাত হয়ে ধনসম্পত্তি সহকারে পাণ্ডবগণ যখন চলে গেলেন, তার অনতিবিলম্বেই নিজ সহোদর সমন্ত্রী দুর্যোধনের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমরা অতীব ক্লেশে যে সমুদয় দ্রব্য সঞ্চয় করেছি, বৃদ্ধ রাজা সমুদয় নষ্ট করছেন। অধিকাংশই পুনরায় শত্রুদিগের হস্তগত হয়েছে। এখন ভালোমন্দ যা হয় তোমরা বিবেচনা করো।’

এ কথা কর্ণগোচর হওয়ায় দুর্যোধন বিস্মিতও হলেন, শঙ্কিতও হলেন। এখন পাণ্ডবরা যে রকম ক্ষিপ্ত অবস্থায় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেছেন, সেই ক্রোধ থেকে নিস্তার পাবার কী উপায় সেটাই চিন্তার বিষয়। ওদের সহায় সম্বল প্রবল, আর তিনি নিজে এ মুহূর্তে একান্তই অপ্রস্তুত। প্রাণ সংহারোদ্যত এই ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গদিগকে কণ্ঠলগ্ন করে কে থাকবে? সমস্ত উপায় দ্বারাই এখন তাঁদের দমন করা কর্তব্য। আজ হোক কাল হোক, যুদ্ধ এঁরা করবেনই। অস্থিরমতি ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনচ্যুত করে অবিভক্ত রাজত্ব না পাওয়া পর্যন্ত এঁরা শান্ত হবেন না। বিদুরও হবেন না। আর এখন তো একটা বড়ো কারণই পেয়ে গেলেন। প্রকৃতপক্ষে, দ্রৌপদীকে সভায় এনে অসম্মান করাটা তাদের পক্ষেও যেমন একটা অতি অশোভন কার্য হয়ে গিয়েছিলো, সেই অসম্মান পঞ্চপাণ্ডবকে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্ত করেছে। ভীম প্রতিজ্ঞা করেছেন দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন, আর দুঃশাসনের রক্তপান করবেন।

অবিলম্বেই সকলে মিলে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বললেন এসব কথা। তারপর বললেন, ‘হে মহারাজ! আমরা বনবাস পণ করে পুনরায় পাণ্ডবদের সঙ্গে পাশাক্রীড়া করবো। তারা বা আমরাই হই, দ্যূতনির্জিত হলে বল্কলাজিন পরিধান করে দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনপ্রবেশ করবো। এক বৎসর তারাই হোক বা আমরাই হই, পরিবারসহ অরণ্যে বাস করবো। আপনি অনুমতি করুন, আমরা পুনরায় পাশাক্রীড়া করি।’

ধৃতরাষ্ট্র তৎক্ষণাৎ অস্তির হয়ে পাণ্ডবদের ডেকে পাঠালেন। পরিজনসহ সকলেই পুনরায় ফিরে এলেন। দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘হে যুধিষ্ঠির! এই সভায় বহুবিধ লোকের সমাগম হয়েছে। এসো আমরা পুনরায় অক্ষ নিক্ষেপ পূর্বক দ্যূতারম্ভ করি।’

সৌবল বললেন, ‘বৃদ্ধ রাজা আপনাদের যে অর্থ প্রত্যর্পণ করেছেন, সেটা ভালোই করেছেন। কিন্তু এবার আমরা যারাই হারবো, তারাই মহারণ্যে প্রবেশ করে একবৎসর অজ্ঞাত ও দ্বাদশ বৎসর জ্ঞাত, এই ত্রয়োদশ বৎসর অরণ্যে বাস করবো।’

উন্মত্ত জুয়াড়ি যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মৌনভাব অবলম্বন করে এতো কাণ্ডের পরেও তৎক্ষণাৎ পুনরায় ফিরে গেলেন খেলতে। কারো কোনো বাধাই মানলেন না। কারো দিকে তাকালেনও না। যথারীতি পুনরায় হেরে গিয়ে পুনরায় নিঃস্ব হলেন। অতঃপর শুরু হয়ে গেলো বনবাসপর্ব।

পাণ্ডবগণ প্রব্রজ্যাশ্রম অবলম্বন করেছেন শুনে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য মহাবনে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণও এলেন। তাঁকে দেখে দ্রৌপদী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন ‘হে কৃষ্ণ! আমার বোধ হচ্ছে আমি পতিপুত্রবিহীনা, আমার বন্ধু নাই, ভ্রাতা নাই, পিতা নাই, তুমিও আমার নাই।’ করতলে মুখ ঢাকলেন তিনি। মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত করে রোদন করতে লাগলেন। অজস্র অশ্রুবিন্দুতে তাঁর বক্ষস্থল অভিষিক্ত হতে লাগলো। অসামান্য সুন্দরী সখীর এই বিগলিত বাক্যে কৃষ্ণও যে বিগলিত হবেন তাতে আর সন্দেহ কী? তিনিও বিগলিত কণ্ঠে ‘হে ভাবিনী’ সম্বোধন করে অনেক সান্ত্বনা দিলেন। এই বনবাস পর্বেই যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে যা বলেছিলেন, পরে সে কথা তিনি ভীমকেও বলেন, ‘ভ্রাতঃ! আমার অন্যায়াচরণেই তোমরা বিষাদসাগরে পতিত হয়েছো, তাতে সন্দেহ নাই। আমি দুর্যোধনের রাজ্যহরণে ইচ্ছুক হয়ে অক্ষ গ্রহণ করেছিলাম।’

এইখানে কি আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি না, কেন তিনি দুর্যোধনের রাজ্যে লোভ করতে গিয়েছিলেন? তিনি কি তখন অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারী হননি? পাণ্ডুর অর্ধাংশ পাননি? কীসের অভাব ছিলো তাঁর? আসলে যতোক্ষণ না শান্তনুর সিংহাসনটি সর্বতোভাবে গ্রাস করতে পারেন, ততোক্ষণ বিদুরেরও যেমন শান্তি ছিলো না, তাঁরও ছিলো না। দুর্যোধন এঁদের বিষয়ে এই সব কথাই তাঁর রাজোচিত বুদ্ধিতে অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং এঁরা পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ কিনা সে বিষয়েও তাঁর মনে সন্দেহ ছিলো। এছাড়া, যে কারণেই হোক, এর সঙ্গে যে বিদুর সম্পৃক্ত, সে বিষয়েও তাঁর সন্দেহ ছিল না। অন্য কোনো বলবান রাজার সহযোগ পাবার জন্যই যে তাঁরা হস্তিনাপুরীতে আর প্রত্যাবৃত্ত হননি, নিজেদের পরিচয় গোপন করতে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন, এসব কথা অন্তত দুর্যোধনের কাছে গোপন নেই। যদিও বিদুর সকলকে এ কথাই বুঝিয়েছেন যে দুর্যোধনের অসূয়া থেকে মুক্তি পেতে প্রাণভয়েই পাণ্ডবরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।

পাণ্ডবদের উদ্দেশ্য সফলও হয়েছিলো। বিশেষভাবে কৃষ্ণের সহায়তা পেয়ে, বলা যায় সবই প্রায় হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছেছিলো। রাজসূয় যজ্ঞের দিন তাঁরা যদি অকারণে দুর্যোধনকে এভাবে অপমান না করতেন, ভৃত্যভৃত্যাদের সম্মুখে স্ত্রীপুরুষ সবাই ওরকম অশালীন অভব্য আচরণ না করতেন, তা হলে তথাকথিত জ্ঞাতিদের বৈভব দেখে দুর্যোধনের মন যতোই কলুষিত হোক না কেন, এই প্রতিশোধের ঘটনা কখনোই ঘটতো না। পাণ্ডবরা নিজেদের যদি কুরুকুলের সন্তান ভাবতেন, আর কিছু না হোক, কুরুকুলের মানসম্মানের দায়েও এটা করতে পারতেন না। এর পরে যে কোনো আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই যেভাবে পারে সেভাবেই এর প্রতিশোধ না নিয়ে পারে না। সেখানে দুর্যোধনের তো বহু বছরের জমা রাগ এদের ওপরে। ছেড়ে দেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কুলে, মানে ধনে জনে দুর্যোধন নিশ্চয়ই একজন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি, সমকক্ষ ক্ষত্রিয় রাজা, তিনি কেন সহ্য করবেন অপমান? সহ্য করলে আমরা পাঠকরাই তাঁকে কাপুরুষ বলে অশ্রদ্ধা করতাম। আত্মসম্মানের প্রতি যাঁদের দৃষ্টি নেই, তাঁরা মানুষ হলেও মানুষ নয়। আত্মসম্মান প্রাণীকুলে একমাত্র মনুষ্য জাতির মধ্যেই বর্তমান।

যখন পাণ্ডবরা দ্রৌপদীসহ বনবাসে যাচ্ছিলেন দুঃশাসন বলেছিলেন, ‘যে পাণ্ডবরা ধনমদে মত্ত হয়ে ধার্তরাষ্ট্রদের উপহাস করছিলো, এক্ষণে তারাই নির্জিত ও হৃতসর্বস্ব হয়ে বনপ্রবেশে যাচ্ছে।’

যাবার সময়, তাঁরা ফিরে এসে যে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন তা জোর গলায় বলে গিয়েছিলেন পাণ্ডবরা।

চলবে...
বাকি পর্বগুলো পড়ুন এই লিঙ্কেঃ https://www.amarboi.com/search/label/mahabharatera-maharanye