Ticker

6/recent/ticker-posts

মুসলমানের বর্ণপরিচয় - মিলন দত্ত

মুসলমানের বর্ণপরিচয়

মিলন দত্ত

‘এক মত/ এক পথ/ ইসলামী/ শরীয়ত । /কিছু চাও/ তোল হাত, ক'রে নাও/ মোনাজাত।’ ‘ইসলামী সহজ পাঠ' প্রথম ভাগ। এমনই কয়েকটি ছড়া পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় মুসলমান শিশুদের পড়ানো হয়।

মুসলমানের জন্য কি পৃথক ছড়া-কবিতা প্রয়োজন? এ প্রশ্নের অনিবার্য উত্তর নিঃসন্দেহে ‘না'। কিন্তু চালু প্রাইমারগুলো নিয়ে মুসলমানের যদি সাম্প্রদায়িক একদেশদর্শিতার অভিযোগ থাকে? তাহলেও অবশ্যই মুসলমানের জন্য পৃথক কোনো প্রাইমারের সুপারিশ করা যায় না।

পড়াশোনা শুরু করার জন্য শিশুর হাতে প্রথমেই যে বইটি তুলে দেওয়া হয়, সেটাই প্রাইমার। প্রাইমারের মধ্য দিয়ে শিশু তার ভাষার ধ্বনি আর বর্ণের সম্পর্ক বুঝতে শেখে। বর্ণযোজনার দ্বারা শব্দ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়া আয়ত্ত করে। প্রাইমার এমন একটি সোপান, যা ধাপে ধাপে শিশুকে লিখিত ভাষার বিশাল জগতের দিকে নিয়ে যায়। সেই প্রাইমার নিয়ে অন্তত কোনো সাম্প্রদায়িক একদেশদর্শিতার অভিযোগ থাকা সংগত নয়।

‘সহজ পাঠ'-এর প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ মিলিয়ে দুটি মুসলমান নাম পাওয়া যায় । ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের প্রথম পাঠের দ্বিতীয় কবিতায় রয়েছে ‘জয়নাল/ ধরে হাল'। আর দ্বিতীয় ভাগের সপ্তম পাঠে কবিতাংশে রয়েছে, ‘আমি-যে রোজ সকাল হ’লে/ যাই শহরের দিকে চ’লে/ তমিজ মিঞার গরুর গাড়ি চড়ে।' ব্যস এইটুকুই।

অথচ প্রাইমার এবং অন্যান্য ছাত্রপাঠ্য বই নিয়ে মুসলমানের অভিযোগ বহুদিনের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলমানের জন্য পৃথক বাংলা পাঠ ও পাঠ্যপুস্তকের কথা ভেবেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। সেই ভাবনা থেকেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা' (ছাত্রপাঠ্য প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৩১০ বঙ্গাব্দে এবং প্রথম ভাগের প্রথম অংশ ১৩১৩ বঙ্গাব্দে)। পরে ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছিলেন, কি পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয় । সে পড়ে গোপাল বড় ভালো ছেলে । কাশেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তাহা পড়িতে পায় না । এখান হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণাৰ্জ্জুনের কথা, সীতা-সাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে । সম্ভবত তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের বড় লোক নাই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ববিহীন করা হয় । হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয় । মুসলমানরা নিতান্তই ছোট জাত । তাহাদের মধ্যে ভালো লোক জন্মিতে পারে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদ করা হয়।'

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আরও লিখেছিলেন, ‘মক্তবে ও মুসলমান বালিকা বিদ্যালয়েও আমাদিগের শিশুগণকে হিন্দুর লিখিত পুস্তক পড়িতে হয়, তদপেক্ষা আর কি কলঙ্কের কথা আছে? আমরা কি এতই মূর্খ যে তাহাদের জন্য পুস্তক রচনা করিতে পারি না? ...মূল পাঠ্য ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের সম্বন্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়ে ফেলা হয়। আর মুসলমানদিগের বেলা ঢাকঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়। গুণের কথা বড় একটা উল্লিখিত হয় না। ফল দাঁড়ায় এই, ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়িয়া ছাত্ররা বুঝিল, মুসলমান নিতান্তই অপদার্থ, অবিশ্বাসী, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর জাতি। পৃথিবী হইতে তাহাদের লোপ হওয়াই মঙ্গল।' [আমাদের (সাহিত্যিক) দরিদ্রতা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (এম এ, বি এল), আল-এসলাম ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩।]

তারও আগে মোহম্মদ ফকির উদ্দিন সরকার বাসনা পত্রিকার ২য় ভাগ, ২য় সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬) লিখছেন, 'প্রথম বর্ণ পরিচয় কাল হইতেই আমাদের বালকগণ রামের গল্প, শ্যামের কথা, হরির কাহিনী, কৃষ্ণের চরিত্র ইত্যাদি পড়িতে থাকে। যদু-মধু, শিব-ব্রহ্মা, রাম-হরি ইত্যাদি নামের পাঠ আরম্ভ করিতে হয়। কাজেই আমাদের সরলমতি কোমল প্রকৃতি শিশুগণ বিদ্যালয় পঠিত হিন্দুগণের উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং আমাদের জাতীয় পবিত্র শাস্ত্র ও ইতিহাস উপাখ্যান ধর্মকর্মাদির বিষয় অপরিজ্ঞাত হইয়া থাকে।' মোহাম্মদী পত্রিকায় (১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৩৩৪) আনোয়ার হোসেন তাঁর 'বাংলার মোছলমান ও প্রাথমিক শিক্ষা' প্রবন্ধে একই সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। তাঁর মোদ্দা বক্তব্য, মুসলমান ছাত্রদের অনেকে হিন্দু শিক্ষা গ্রহণ করত। হিন্দু সংস্পর্শে মুসলমান ছাত্ররা পরবর্তীকালে তাঁদেরই আদর্শ অনুসরণ করত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিন্দু রূপকথায় পরিপূর্ণ। মুসলমানদের প্রাচীন গৌরবের কথা, বীরপুরুষদের কাহিনি, পীর-দরবেশদের কথা ইত্যাদি পাঠ্যসূচিতে কম ছিল। এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমান অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের সেসব বিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে উৎসাহ বোধ করতেন না।

ফলে বিশ শতকের গোড়া থেকেই কিছু কিছু প্রাথমিকের বই লেখা শুরু হয়, যা একান্তই মুসলমান শিশুদের জন্য। এখনো বাজারে এ রকম বইয়ের অভাব নেই। তা বহু স্কুলে পড়ানো হয়। কিন্তু কোনো দিনই তা মুসলমান সমাজে শিশুশিক্ষার মূলধারায় ঢুকতে পারেনি। মুসলমানি বর্ণপরিচয়ের বইগুলো চিরকালই প্রান্তিক পাঠ হয়ে থেকে গিয়েছে। তবে বর্ণমালা শিক্ষা থেকে শুরু করে যাবতীয় শিশুপাঠ্য বইয়ে হিন্দুদের আধিপত্য কিংবা বলা ভালো মুসলমানের অনুপস্থিতি বাঙালি মুসলমানকে চিরকাল ব্যথিত করেছে, আরও অভিমানী করে তুলেছে। কিন্তু শিক্ষায় এবং সংস্কৃতিতে অনেকটা এগিয়ে থাকা হিন্দুরা মুসলমানের সেই ব্যথা বা অভিমান বোঝার চেষ্টা করেনি কোনো দিন। এমনকি দেশভাগের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। আমাদের প্রাইমারে আজও রাম, শ্যাম, গোপাল, পার্থ, অর্ক বা ষষ্ঠীদেরই আনাগোনা। সেখানে নাসিম, নিয়াজ, তৌফিক, আঞ্জুমান বা আবদুল্লারা আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু এবং নিতান্ত প্রান্তিক হয়েই থেকে গেল । এখনো কোনো প্রাইমারে পড়ছি, ‘হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি দিদিমা দীপ হাতে পুজোর আরতি করছেন।' তারই পাশাপাশি ‘হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল । দেখি নানি দাওয়ায় জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছেন'—এই রকম একটা পাঠ থাকলে কি বাঙালি শিশুকে খুব অসুবিধায় ফেলা হতো? কিংবা ‘রাতের শেষভাগে মা উঠে পড়েন। সেহেরির জোগাড় করেন। কাল যে রোজা । খোকন বায়না ধরে। সে রোজা রাখবে। খোরমা খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। মামা বলেন, শুধু না খেয়ে থাকার নাম রোজা নয়। খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার নাম রোজা। ভোগ-বিলাস আর লোভ থাকলে রোজা হয় না।' এই রকম পাঠ কি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পড়তে পারে না? তাতে তো হিন্দু সমাজের শিশুদের জানার পরিধি ব্যাপ্ত হবে। সে ওই এক একটি পাঠ থেকে শিখে নিতে পারবে জায়নামাজ, ফজর, নামাজ বা রোজা, সারি, ইফতার রা খোরমার মতো শব্দগুলো । একটা শব্দ তো কেবল একটা শব্দমাত্র নয়, হিন্দু শিশু ওই শব্দগুলোর অনুষঙ্গে শৈশব থেকে চিনতে শিখবে মুসলমান সমাজের নানা আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধিসন্ধি । তাহলে এত বড় লাভের সুযোগ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুদের বঞ্চিত করা কেন?

আমরা এই বিষয়গুলোকে বিবেচনার মধ্যে আনিনি। এখনো আনছি না । মুসলমানদের সামাজিক বিষয়গুলো (ইসলামে সমাজ ও ধর্ম একাকার) প্রাইমারের অন্তর্ভুক্ত করার কোনো উত্তরাধিকারও আমাদের নেই। এমনকি ‘বর্ণপরিচয়' বা 'সহজ পাঠ'-এও মুসলমানকে পাওয়া যায় না। অথচ বিদ্যাসাগর যখন ‘বর্ণপরিচয়' লিখছেন, তখন মুসলমান শাসনের পতনের পরে ইংরেজের কর্তৃত্ব এ দেশে কায়েম হয়ে গিয়েছে। তত দিনে বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তখন মুসলমানকে ভুলে থাকার কোনো কারণ ছিল না। তবে ওই সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘চাষা মুসলমানের মধ্যে লেখাপড়া না করার এবং সামান্যসংখ্যক সম্পন্ন মুসলমানের বাংলা পড়া থেকে বিরত থাকার কারণে মুসলমান হয়তো তার ‘বর্ণপরিচয়'-এ ঠাঁই পায়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? ১৯৩০ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’ প্রকাশিত হচ্ছে, তখন বাংলায় আদমশুমারির হিসাবেই মুসলমান হিন্দুর থেকে সংখ্যায় অনেক বেশি। তা ছাড়া বিশ শতকের গোড়া থেকেই বাঙালি মুসলমান বিদ্বৎসমাজ গড়ে উঠেছে। তাঁদের ভাবনাচিন্তা এবং লেখালেখি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯২৬ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলমান বিদ্বজ্জনদের উদ্যোগে। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল “চিন্তার মুক্তি'। রবীন্দ্রনাথ সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ' নিয়ে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ কাজী আবদুল ওদুদকে দিয়ে ১৯৩৫ সালে বিশ্বভারতীতে ‘নিজাম বক্তৃতা’ করাচ্ছেন । আবদুল ওদুদ ছিলেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ'-এর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা । এমন একটা সময়ে তৈরি ‘সহজ পাঠ'-এর প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ মিলিয়ে দুটি মুসলমান নাম পাওয়া যায় । ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের প্রথম পাঠের দ্বিতীয় কবিতায় রয়েছে ‘জয়নাল/ ধরে হাল'। আর দ্বিতীয় ভাগের সপ্তম পাঠে কবিতাংশে রয়েছে, ‘আমি-যে রোজ সকাল হ’লে/ যাই শহরের দিকে চ’লে/ তমিজ মিঞার গরুর গাড়ি চড়ে।' ব্যস এইটুকুই।

অথচ ১৩৩৮ সালে প্রবাসীর শ্রাবণ সংখ্যায় ‘হিন্দু-মুসলমান' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ধর্মমত ও সমাজরীতি সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমানে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতাও আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্ত্বেও ভালো রকম করে মেলা চাই। এ সাধনায় সিদ্ধিলাভ আমাদের না হলে নয়।' তাঁর সেই 'ভালো করে মেলা' এবং মেলানোর সাধনায় কবি কেন 'সহজ পাঠ'কে শামিল করতে পারলেন না?

তারপরও যেসব জনপ্রিয় প্রাইমার আমাদের হাতে এসেছে, সেখানেও মুসলমানের গরহাজিরা চোখে পড়ার মতো। এতে কেবল মুসলমানের অভিমানকেই বাড়িয়ে তোলা হয়নি, ক্ষতি হয়েছে হিন্দু সমাজেরও। কখনো সচেতনভাবে, কখনো অবচেতনেই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে (অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ) সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একধরনের উচ্চম্মন্যতায় ভুগতে ভুগতে হিন্দুরাও নিজেদের চারপাশে গড়ে তোলা বেষ্টনীর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি হিন্দু আজও সেখান থেকে বেরোতে পারেনি। প্রাইমারগুলোই হয়তো হতে পারত বাঙালি হিন্দুর স্বেচ্ছাবৃত গণ্ডি ভেঙে দিয়ে, মুসলমানের অভিমান ঘুচিয়ে একটা সুস্থ সম্পূর্ণ বাঙালি সমাজ গড়তে । কিন্তু বাংলায় তা হয়নি ।

এ অভিযোগ সত্ত্বেও, চাইলেই একটা ভারসাম্যের প্রাইমার বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা আশা করতে পারি না। তাঁরা যে সময়ে, যে সমাজ-পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বসে তাঁদের প্রাইমারগুলো রচনা করেছেন, সেখানে ‘নবীন তুমি বাড়ী যাইবার সময় পথে ভুবনকে গালি দিয়াছিলে, কিংবা ‘ঐ-যে আসে শচী সেন, মণি সেন, বংশী সেন, আর ঐ-যে আসে মধু শেঠ আর খেতু শেঠ'-ই ছিল স্বাভাবিক। কেবল শিশুপাঠ্য প্রাইমার নয়, তাঁদের কাছ থেকে আমরা যে কালজয়ী সৃষ্টি পেয়েছি তা শিশুপাঠের আঙিনা ছাড়িয়ে বাঙালির আধুনিক মন ও মননের দিশা হয়ে ওঠে। তাঁরা তা না করে কেবল যদি কোনো ভারসাম্যের পাঠ রচনা করতেন, তাহলে হয়তো আমরা ‘বর্ণপরিচয়' বা ‘সহজ পাঠ'-এর মতো অমর সৃষ্টি পেতাম না।

বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে একেবারে হালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তৈরি ‘আমার বই' পর্যন্ত মূলধারার প্রাইমারগুলোকে বলা যেতে পারে সেক্যুলার পাঠ্যবই। সেখানে শিশুসাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অন্তত নয়টি প্রাইমার পাচ্ছি, যার মধ্যে রয়েছে যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রণীত ‘হাসিখুশি’ এবং সুখলতা রাও প্রণীত ‘নিজে পড়’ এবং ‘নিজে শেখ’। ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে' বা ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা'-র মতো সেক্যুলার পাঠ কী-ই বা হতে পারে। সেখানে ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ নিতান্তই অবান্তর। তবে গত ১০-১৫ বছরে যেসব প্রাইমার তৈরি হয়েছে, সেখানে ভারসাম্য রক্ষার একটা চেষ্টা কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। ‘আমার বই'-এ কেবল ধর্মীয় ভারসাম্য নয়, খেয়াল রাখা হয়েছে লিঙ্গ ভারসাম্যের দিকেও। তা সহজভাবে আসেনি, ভারসাম্য গড়তে হয়েছে।

এতৎসত্ত্বেও মুসলমান শিশুর জন্য পৃথক প্রাইমার তৈরি করে বেসরকারি মাদ্রাসা ও নার্সারি স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। তবে সেই সংখ্যাটি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের আয়তনের তুলনায় নগণ্য । কারণ, মুসলমান সমাজের অধিকাংশ শিশুই পড়াশোনা করে মূলধারার সরকারি ও বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে। এর পাশাপাশি মুসলমানি শিশুশিক্ষার একটা ধারা কিন্তু ক্রমেই শক্তপোক্ত হয়েছে। শিশুদের মাদ্রাসামুখী করার প্রয়াস এবং আরও বেশি করে ইসলামি পাঠের দিকে নিয়ে যাওয়ার সক্রিয় প্রয়াসও রয়েছে। সেখানে শিশুকে মাতৃভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ দেওয়ার জন্য মুসলমান নিজের মতো করে নিজের জন্য প্রাইমার তৈরি করে নিয়েছে।

সেখানে কেবল ভিন্ন মতে ভিন্ন পথে ভাষাশিক্ষাই নয়, তার পরিচিত প্রতিবেশের মধ্যে তাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা ও পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠার শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে। আজ থেকে নয়, প্রথম মুসলমানি প্রাইমার মীর মশাররফ হোসেনের 'মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা'র (প্রথম ভাগের প্রথম অংশ) চতুর্থ পাঠে রয়েছে, 'তুমি মুসলমান।/ টুপি নাই কেন?/খালি মাথা ছি ছি/ চাদর আর ধুতি ।/ হরি বাবুর নাতি ।/ পায়জামা চাপ্‌ কান/ হয় সেখ্ নয় পাঠান।' ওই প্রাইমার তাকে আরও বেশি করে মুসলমান পরিচয়ের বাঁধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে । সেটা জেনেও শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে অনেকটা এগিয়ে থাকা হিন্দুর ওপর অভিমান মুসলমানকে ঠেলে দিয়েছে ধর্মপরিচয়ের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে ।

কেবলই অভিমান! তা বোধ হয় নয়। ধর্মীয় বিধি মেনে মুসলমান সমাজে ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার রীতি চালু আছে। ছোটবেলাতেই সম্পূর্ণ কোরানশরিফ পাঠ করার মতো আরবি শেখা এবং খানিকটা ইসলামি পাঠ দেওয়াটা মুসলমানের অবশ্যকরণীয় কাজের মধ্যেই পড়ে। তাঁদের বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে সে ভালো মুসলমান হয়ে উঠতে পারবে। অনেক মুসলমান বাড়িতেই মৌলভি রেখে বাড়ির ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক আরবি ভাষার পাঠ দেওয়া হয়, যাতে তারা কোরানশরিফ পড়তে পারে। অবশ্য সে চেষ্টা কতটা সফল হয়, তা নিয়ে সন্দেহের বিস্তর অবকাশ রয়েছে। একটু আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, এমন পরিবারই সাধারণত বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোরানশরিফ পড়ানোর মতো সময় ও অর্থ ব্যয় করার সংগতি রাখে। বেশির ভাগ পরিবারেই তা সম্ভব হয় না। তারা তাই ছেলেমেয়েদের এমন একটা প্রাইমারি বা নার্সারি স্কুলে পড়াতে চায়, যেখানে অন্তত কিছুটা ইসলামি পাঠ এবং শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই স্কুলগুলোতে ধর্মীয় নেতা এবং অভিভাবকদের চাপেই বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হয়। এমনকি বাংলা বর্ণমালাও শেখানো হয় সম্পূর্ণ ইসলামি অনুষঙ্গে। দ্বীনি শিক্ষার চাপাচাপিতে শিশুর প্রকৃত পাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না, সে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।

পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে-গঞ্জে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রাইমারি স্কুলে কিংবা আরও হালের নার্সারিগুলোতে একধরনের ইসলামি বর্ণপরিচয় পড়ানো হচ্ছে শিশুদের। কোনো কোনো খারিজি মাদ্রাসাতেও শিশুরা ওই প্রাইমার পড়ছে। তারা শিখছে, 'অ-এ অহি আসে আকাশ থেকে । আ-এ আল্লা ডাকে দ্বীনের দিকে । ই-তে ইমান মান নবির পর। ঈ-তে ঈমান বলে জিহাদ কর।' এই পাঠ রয়েছে মালদহ থেকে প্রকাশিত ‘আল ইকরা’ নামে একটি প্রাইমারে। মালদহ জেলায় মুসলমান মহল্লাগুলোতে কিছু কিছু প্রাইমারি ও নার্সারি স্কুলে ওই বইটি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।

আর একটি বইয়ে ‘অ-এ অজু করে পড় নামাজ। আ-এ আদম হতে মানব সমাজ। ই-তে ইসলাম হল সঠিক পথ। ঈ-তে ঈদের দিনে মিলাও হাত।' (ফুলকুঁড়ি প্রবেশিকা-২, মহম্মদ নুরুদ্দিন ও শেখ নাসিরুদ্দিন আহমেদ। ছাত্রবন্ধু পুস্তকালয়। ঢোলাহাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা) কলকাতার বাংলা ইসলামি প্রকাশনী ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত 'এসো পড়তে শিখি' বইটিতে রয়েছে, ‘অ-এ অজু করে নামাজ পড়। আ-এ আজান শুনে জামাত ধর । ই-তে ইমাম থাকেন সবার আগে। ঈ-তে ঈদের সিমাই দারুণ লাগে।' রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ প্রথম ভাগের অনুকরণে তৈরি ‘ইসলামী সহজপাঠ প্রথম ভাগ' নামে একটি প্রাইমারও বাজারে রয়েছে। বইটির বিন্যাস, প্রচ্ছদ, অলংকরণ এবং অঙ্গসজ্জাও আসল সহজ পাঠকে অনুকরণ করার চেষ্টা স্পষ্ট। বইটির লেখক হায়দার আলী (প্রকাশক ছাত্রবন্ধু পুস্তকালয়)। সেখানে বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে এভাবে, 'বসে অজু করে অ আ / মনে মনে পড়ো দোয়া । হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ জুটে/ মসজিদে যায় ছুটে। হ্রস্ব উ দীর্ঘ উ দেখে/ সালাম দিয়েছে হেঁকে । ঋ আর এ ঐ/ পড়ে হাদিসের বই ।'

কেন এই ‘ইসলামী সহজ পাঠ'? প্রকাশক মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন জানাচ্ছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ প্রকাশিত হয়েছিল বহুদিন আগে। তাঁর বইটির মধ্যে সত্যিই এক হৃদয়গ্রাহী ভাবনা আছে।... কিন্তু ইসলামি সাহিত্যে এই ধরনের কোনো বই ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। সেই চিন্তা এবং পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে ইসলামী সহজপাঠ রচনায় হাত দেন কবি হায়দার আলী।' সহজ পাঠ প্রথম ভাগে প্রথম পাঠের দ্বিতীয় সেই অসামান্য কবিতাটির (আলো হয়,/ গেল ভয়।) রূপান্তর ঘটিয়ে করা হয়েছে, নূর নবী/ হযরত,/ দুনিয়ার/ রহমত।/ খোদাভীরু/ ওসমান,/ গরীবের করে দান ।/ এক মত/ এক পথ,/ ইসলামী / শরীয়ত ।/ কিছু চাও/ তোল হাত,/ ক'রে নাও/ মোনাজাত ।’

বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয়ের ‘ঈ-কারযোগে' শেখানো হচ্ছে 'জীবন, ধীবর, নীরব, শীতল, অলীক, গভীর, নবীন, শরীর' ইত্যাদি শব্দ দিয়ে। আর বাংলা ইসলামি ট্রাস্টের ‘এসো পড়তে শিখি'-তে ঈ কার শেখার জন্য শিশুরা পড়ছে ‘আরবী, সাহাবী, তারাবী, তবলীগ, কাশমীর, ইসলামী, তরবারী, সরকারী, হীকত, গনীমত, ফজীলত’ এবং ‘হাদীস পড়ি/ জীবন গড়ি। ‘গরীব শহীদ হয়/ আমীর সব সরীফ নয়। ‘পীর ফকীর আজমীর/ বীর সহীদ কাশমীর।’ ‘তবলীগ করা দরকারী/ মসজীদ নয় সরকারী। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ওই বইটিতে ঈ-কারযোগে যতগুলো শব্দ শেখানো হয়েছে তার সব কটিই বিদেশি শব্দ । শব্দগুলো সবই ভুল বানানে শেখানো হয়েছে। দেশি ও বিদেশি শব্দ সব সময়েই ই কার দিয়ে লেখা হয়। সেটাই নিয়ম। তা না হলে ভুল হয়। ‘ফুলকুঁড়ি’-তেও ঈ কার শেখানো হয়েছে ভুল বানানে তফসীর, তবলীগ, তসবীহ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে। আরও আছে, ‘নবীর কথা হল হাদীস । শরীয়ত ছাড়া পথ নেই । তকদীর মানা ফরজ । নবীর ভাষা হল আরবী।' দীর্ঘ ঈ-কারের ছড়াছড়ি।

'সহজ পাঠ' প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠের পদ্যাংশে রয়েছে সেই বিখ্যাত ছড়া, ‘কালো রাতি গেল ঘুচে/ আলো তারে দিল মুছে ।/ পুব দিকে ঘুম ভাঙা/ হাসে ঊষা চোখ-রাঙা।’...ইত্যাদি। ‘ইসলামি সহজপাঠ' প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠে পদ্যাংশে পড়ছি, ‘মা বলেছেন সোনামানিক/ আল্লা তোমার রব,/ বাতাস আলো পাহাড় নদী/ সৃষ্টি তাঁহার সব।/ রোজ সকালে সূর্য ওঠে/ সেই আল্লার ডাকে,/ আমরা সকল মুমিন শিশু/ সিজদা করি তাঁকে।/ সারা জীবন সঙ্গী হবো/ নামাযীদের সাথে,/ খোদার কাছে এমন দোয়া/ করব মোনাজাতে।/ মিলেমিশে থাকলে তবে/ খোদার রহম হয়,/ তওবা করি আর কখনো/ ঝগড়াঝাটি নয়।' তুলনা নয়, কেবল স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে সহজপাঠ প্রথম ভাগের গোটা বইয়ে কোনো যুক্তাক্ষর নেই সহজবোধ্য কারণেই । রবীন্দ্রনাথ যুক্তাক্ষর শিখিয়েছেন দ্বিতীয় ভাগে। কিন্তু ‘ইসলামি সহজপাঠ'-এর রচয়িতা প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠে পৌঁছেই ধরে নিয়েছেন ছেলেমেয়েরা যুক্তাক্ষর শিখে গিয়েছে। এ বইয়ের তৃতীয় পাঠের পদ্যাংশটা এই রকম, ‘রইল পড়ে কেতাব কলম,/ যাই ছুটে সব ফেলে/ মন বসে না পাঠে আমার/ আযান কানে এলে!/ মুখ হাত ধুয়ে করবো অজু/ পাক হবো এক্ষুনি,/ দাঁড়িয়ে যাবো লাইন- সোজা/ যেই তকবির শুনি।/ আল্লাহ্ মোদের সহজ সরল/ দেখিয়ে দেবেন পথ,/ সারা জীবন আমরা যেন/ চরিত্রে হই সৎ।/ দু'হাত তুলে করবো দোআ/ মোদের মুমিন করো,/ দুনিয়ায় আর আখিরাতে/ শান্তি দিয়ে ভরো।'

এই সব প্রাইমারের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগের বইগুলো কোথাও তৃতীয় শ্রেণি, কোথাও চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। প্রাইমারে সাধারণভাবে শিশুর চারপাশের চেনা জগতের শব্দগুলো বেশি করে ব্যবহার করা হয় । লক্ষ্য থাকে, অচেনা শব্দ যেন তার বর্ণশিক্ষায় বাড়তি বোঝা না হয়ে ওঠে । শব্দগুলো যেন তার চেনা পরিসরের মধ্যেই থাকে। তাতে পাঠ আরও আনন্দের হয়। ইসলামি প্রাইমারগুলো ধর্মীয় শব্দ দিয়ে এমন করে গড়ে তোলা হয়েছে যে শিশু সেই শব্দ ঘিরে স্বপ্ন দেখার বা ভাবার সুযোগই পাবে সামান্য। বরং বাড়তি কিছু অচেনা শব্দের বোঝা তাকে ঘাড়ে তুলে নিতে হচ্ছে। অবশ্য উদ্দেশ্য যদি হয় ধর্মশিক্ষা, সেখানে প্রাইমার তৈরির স্বাভাবিক নিয়ম বা শর্ত গৌণ হয়ে যায়। 

সঙ্গে সহযোগী পাঠ হিসেবে ‘ইসলাম শিক্ষা’, ‘আমার প্রিয় নবী’, ‘আমাদের ছড়া” বা ‘ছোটদের দো'আ', 'Islaamee English Reader'-এর মতো বই পড়ানো হয়ে থাকে। শেখ ফজলুল রহমানের ‘আমার ছড়া' বইয়ের প্রথম ছড়াটি হলো, ‘রাত পোহালো ফজর হলো/ ডাকছে মুয়াজজিন ।/ ঘুমের চেয়ে নামাজ ভালো,/ কায়েম করো দ্বীন।/ অযু করে কাপড় প’রে/ মসজিদেতে যাই ।/ আল্লাহ হলেন সবার বড়ো,/ তাঁর বড়ো কেউ নাই।' ওই বইয়ের আর একটি ছড়া, ‘ভোরের বেলা পাখপাখালি/ কিচির মিচির করে।/ সবাই মিলে শোকর করে/ আল্লাহর নাম ধরে।/ মগরিবেতে বাসায় ফিরে/ কূজন করে পাখি ।/ তারাও যেন নামাজ পড়ে/ সবাই মিলে ডাকি।' এই রকম বই কেবল কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয় না, বিভিন্ন জেলা থেকে প্রকাশিত হয়। এবং তা বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের জন্য গড়ে তোলা স্কুলে পড়ানোও হয় ।

আগেই বলেছি, শিশুশিক্ষার এই ইসলামি বইগুলো পড়ানোর মতো স্কুলের সংখ্যা মূলধারার স্কুলের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। তবে ইদানীং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে-গঞ্জে কিছু কিছু স্কুল তৈরি হচ্ছে। খুব ধীরে হলেও এই সব স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। প্রকাশকদের কাছে খবর নিয়ে জানা গেছে, এই বইগুলো বেশি চলে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই দিনাজপুর এবং উত্তর চব্বিশ পরগনায়। অন্যান্য জেলায় চললেও তার সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ।

কলকাতা এবং জেলা মিলিয়ে অন্তত ছয়টি প্রকাশন সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানি প্রাইমার প্রকাশ করে থাকে। তার কয়েকটি আমরা দেখেছি। সেখানে শিশুর বর্ণশিক্ষা বা ভাষাশিক্ষা একেবারেই গুরুত্ব পায়নি। শিশুর মনস্তত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের শর্তগুলো মেনে চলার কোনো চেষ্টা নেই সেখানে। মুশকিল হলো, এই ধরনের ইসলামি প্রাইমারে পাঠ নেওয়ার পরে শেষ পর্যন্ত সেই শিশুকে চতুর্থ শ্রেণি থেকে সাধারণ স্কুলের সেক্যুলার পাঠেই ফিরতে হয়। কারণ, পঞ্চম শ্রেণিতে তাকে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় পর্ষদের স্কুলেই ভর্তি হতে হবে। সেখানে পর্ষদের পাঠ্যসূচি মেনেই পড়াশোনা করতে হবে। তাহলে একজন মুসলমান শিশুকে কেন বর্ণমালা শেখাতে গিয়ে ইসলামি পাঠ দেওয়া হবে?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে কথা বলেছিলাম মালদহের দুটি নার্সারি স্কুলের দুই শিক্ষকের সঙ্গে। একজন হরিশচন্দ্রপুর থানার বিদ্যানন্দপুর গ্রামের ‘আর রহমান অ্যাকাডেমি'র শিক্ষক মুসাররফ হোসেন, অন্যজন মালদহ শহরের কাছেই বিধিয়া গ্রামে ‘শহিদ তিতুমির অ্যাকাডেমি'র শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। মুসাররফ হোসেনের বক্তব্য, “শিশুদের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগিয়ে তুলতেই নীতিশিক্ষার পাঠ দেওয়া হচ্ছে শিশুকাল থেকে। তা ছাড়া অভিভাবকেরাও চাইছেন লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েরা শিশুকাল থেকে কিছুটা ইসলামি শিক্ষার তালিম পাক।' অভিভাবকেরা চাইছেন বলেই বিভিন্ন জেলায় মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে গ্রামে এই ধরনের নার্সারি স্কুল গড়ে উঠছে। ভুল বানানে ভরা ওই সব বই যেখানে পড়ানো হয়, সেখানে শিক্ষার মান কেমন তার মূল্যায়নে না যাওয়াই ভালো। সেখানে অবশ্য বর্ণমালা বা ভাষাশিক্ষার চেয়ে ধর্মশিক্ষাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে ভরা বই দিয়ে কি ধর্মশিক্ষাটাও নির্ভুল হবে?

সিরাজুল ইসলাম অবশ্য মুসলমান শিশুদের জন্য ধর্ম ও নীতি শিক্ষার বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন। তাঁর বক্তব্য, “ইসলামি সংস্কৃতি মুসলমান ভুলে গিয়েছে। ইসলামি সংস্কৃতি শেখাতে গেলে ছোটবেলা থেকেই ইসলামি শিক্ষা দিতে হবে। তাই আমাদের স্কুলে ছোটবেলা থেকেই ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা।' সিরাজুল জামাত-এ ইসলামি হিন্দ নামে একটি সর্বভারতীয় সংগঠনের সদস্য। সিরাজুল ‘সাংগঠনিকভাবেই’ মনে করেন, কোনো শিশুকে যদি এক থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে ইসলামি শিক্ষার ভেতর দিয়ে বড় করে তোলা যায়, তাহলে ইসলামি ইমান তার মধ্যে দৃঢ় হয়ে যাবে । তিনি মনে করেন, ইসলামি বিশ্বাসের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে বলে ওই নার্সারি স্কুলগুলোর সংখ্যা বাড়ছে।

ইসলামি স্কুলগুলো গড়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি সংগঠিত ইসলামি আন্দোলনের ভূমিকা রয়েছে। এই কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে জামাত-এ-ইসলামি হিন্দ। পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের স্কুলের সংখ্যা ঠিক কত, তা জানা যায় না। তবে জামাত সূত্রে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। জামাত-এ-ইসলামি হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার আমির এ হালকা (সম্পাদক) মুহাম্মদ নূরুদ্দীন জানালেন, তাঁদের সংগঠনের অধীনে এখন পর্যন্ত ৪৭টি প্রাক্-প্রাথমিক স্কুল (ছাত্রসংখ্যা ২ হাজার ৮৮) এবং ৩৯টি প্রাথমিক স্কুল (ছাত্রসংখ্যা ৮ হাজার ৪৪৪) রয়েছে। সেখানে ইসলামি প্রাইমারগুলো পড়ানো হয়। নূরুদ্দীন নিজে কয়েকটি ইসলামি প্রাইমারের লেখক এবং প্রকাশকও । ফলে এই ব্যাপারে সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিসংখ্যান তাঁর কাছেই পাওয়া সম্ভব। নূরুদ্দীন বললেন, ‘আমাদের সংগঠনের যত স্কুল আছে, তার অন্তত চার গুণ স্কুল তৈরি হয়েছে সংগঠনের বাইরে। বেশির ভাগই বেসরকারি বাণিজ্যিক উদ্যোগ। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর, দুই চব্বিশ পরগনা জেলার গ্রামে গ্রামে আরও নতুন স্কুল তৈরি হচ্ছে।'

জামাত-এ ইসলামি হিন্দ মনে করে, শিশু বয়স থেকে ইসলামি নীতিরীতি এবং ইসলামি মূল্যবোধ শিশুর মনে গেঁথে দিতে পারলে সে সারা জীবনে আর নীতিচ্যুত হবে না। বিচ্যুতিহীন একটা আদর্শ মুসলমান সমাজ গড়ার লক্ষ্যেই যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব মুসলমান শিশুকে ইসলামি প্রাইমার পাঠের আওতায় আনতে চাইছেন তাঁরা। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, জামাত ইতিমধ্যে পাঁচটি জুনিয়র হাইস্কুলও তৈরি করেছে। সেখানে ছাত্রসংখ্যা ১ হাজার ৫৪০ জন।

জামাত-এ-ইসলামি হিন্দ কেরালা ও কর্ণাটকেও বেশ কিছু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ইসলামি স্কুল গড়ে তুলেছে। সেখানে আধুনিক পাঠক্রমের পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয় । জামাত পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের স্কুল গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু কেরালা বা কর্ণাটকের মতো পশ্চিমবঙ্গে ধনবান মুসলমানের অভাব থাকায় আপাতত ইসলামি শিক্ষা ও নীতিশিক্ষার জন্য গ্রামে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল তৈরিতেই উৎসাহ দিচ্ছে। পরে সংগঠন আরও জোরদার হলে মানুষ আরও বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুঁকলে জামাত আরও বেশি ছেলেমেয়ের জন্য প্রকৃত ইসলামি শিক্ষার আরও বড় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে প্রয়াসী হবে।

এখানে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলমানের একটা অংশ, তা সে যত ছোটই হোক, শিশুশিক্ষার জন্য কেন ইসলামি প্রাইমারের দিকে ঝুঁকছে। ওই শিশুরা কেন ইসলামি প্রাইমার পড়ছে তার দুটি কারণের দিকে আমরা আলোকপাত করেছি। এক. মুসলমানের অস্তিত্ব প্রায় বিবেচনার মধ্যে না এনেই বাংলা প্রাইমারগুলো তৈরি করা হয়েছে। তার জন্য মুসলমানের দীর্ঘ লালিত অভিমান খুব সংগত কারণেই থেকে গিয়েছে। সেই অভিমান থেকেই সে শিশুর হাতে ভুলে ভরা ইসলামি প্রাইমার তুলে দিয়েছে। এ যেন তার অস্তিত্বের সংকট মোচনের চেষ্টা। দুই. মুসলমান ইসলামের ফরজ মেনে ছেলেমেয়ের জন্য এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নিচ্ছে, যেখানে সে বর্ণপরিচয়ের পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মশিক্ষাও পেয়ে যাবে।

দুটি ক্ষেত্রেই মুসলমানের সংখ্যালঘু মনমানসিকতা গুরুত্ব পেয়েছে কি না, কিংবা তার কাছে বাংলা ও বাঙালি পরিচিতির চেয়ে মুসলমান পরিচয় বড় হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।




বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।

Post a Comment

0 Comments