Ticker

6/recent/ticker-posts

ত্রয়ী - সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
ত্রয়ী


কত পথ চলে এসেছি, আঁকাবাঁকা পথ, চড়াইয়ের পথ, মাঠের পথ, সহরের পথ। আলোয় ঝল্ করছিলো তখন জীবনের বিস্তৃত প্রান্তর যখন সুরু করেছিলুম চলা। আজ জীবনের প্রান্তরের উপর সন্ধ্যার দীর্ঘ ছায়া ঘনিয়ে এসেছে, শুধু তার এক প্রান্তে একটুখানি আলো চিক্‌চিক্ করছে। আজও চলছি, আলোটুকু নিঃশেষ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলতে হবে। চলবার সময় তাকাতে নেই পিছনে, তাতে চলার কবিতার ছন্দ-পতন হয়, চলার সুরের তাল কেটে যায়।

তাই তাকাইনি ফিরে পিছন পানে, শুধু চলেছি প্রাণের মধ্যে বৈশাখী ঝড় তুলে,তারি মত্ত আবেগে। চলতে চলতে অকস্মাৎ এক একবার বিরাট অস্তিত্বের সামনে এসে পড়ছি। অনির্বাণ আলোর শিখা বহন করে চলেছেন যে সব মানুষ তাঁদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছি। তাঁদের জীবনের শিখা অযাচিত ভাবে আমার মনের অন্ধকার দূর করেছে। সেই আলোর স্পর্শ দগ্ধ করেছে আমার দুর্বলতাকে, অসহ্য দাহ জাগিয়েছে প্রাণের মধ্যে, আবার চলতে সুরু করেছি পাগলের মতো।

যতো সমের দিকেও এগোচ্ছি ততো মনে হচ্ছে, যে-সব বিরাট অস্তিত্বের স্পর্শ পেয়েছে জীবন চলতে চলতে, তার একটা ছবি এঁকে রেখে গেলে মন্দ হবে না।

যেমন কথা ভুলে গেলেও গানের সুর লেগে থাকে মনে, তেমনি স্মৃতির রেখা মনকে জড়িয়ে থাকে, তার বর্ণ-বৈচিত্র্য ফিকে হয়ে এলেও। তাই কালের ধুলোয় সব রঙ একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে স্মৃতির মঞ্জুষা থেকে কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূৰ্ত্ত সযতনে বের করে এনেছি। তাদের আসল রঙটি ফুটিয়ে তুলতে পারি, কলমের এমন মুন্সিয়ানা আমার নেই, দুঃখ সেখানেই।

দার্জিলিং জেল

৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭

সে দিন সন্ধ্যেবেলা আকাশ থেকে হঠাৎ নেমে এলো রাশি রাশি বরফের জুঁই ফুল। হাওয়ায় ঘূর্ণি খেতে খেতে তারা ঝরে পড়তে লাগলো আকাশ থেকে। মস্কোর রাস্তা, বাড়ীর ছাদ, বুলভার, সব ঢেকে গেলো হালকা শাদা বরফের ফুলে। ১৯২৭ সালের ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যের কথা বলছি। সারাদিন সহরের অলিতেগলিতে, রাস্তায়, রেস্তোঁরাঁয়, রেডস্কোয়ারে বয়েছিলো আগুনের স্রোত। দশ বৎসর আগে এই দিন উপরতলার বাবুদের মুঠো ফুটো করে রাশিয়ার মজুরচাষীরা চোরাই মাল বোঝাই করা সিন্দুকের চাবিটা ছিনিয়ে নিয়েছিলো বাবুদের কাছ থেকে। এই দিন তারা বাবুদের রাজ শেষ করে মজুরচাষীর পঞ্চায়েত্রাজ কায়েম করেছিল রাশিয়ায়। এইদিন পৃথিবীর ইতিহাসের সুরু হলো এক নতুন অধ্যায়, মোড় ঘুরে মানুষের সমাজ সুরু করলো এক নতুন যাত্রা। সেই নতুন যাত্রা সুরু করার দিনটি নীচের তলার লোকদের আদরের দিন, পরম উৎসবের দিন। তারি দশম বার্ষিক উৎসবের দিন ছিলো ১৯২৭ সালের ৭ই নভেম্বর।

সকাল থেকে মস্কোর রাস্তায় লাভার মতো বয়ে চলেছিলো জন-স্রোত। বাড়ীতে বাড়ীতে লাল নিশান আগুনের শিখার মতো উঠলো জ্বলে, নীল আকাশটাতেই আগুন ধরিয়ে দেয় আর কি! রাস্তায় চলেছে কারখানার মজুরের দল, লাল পল্টন, ছাত্রেরা, ছেলে মেয়ে বুড়ো। তাদের শরীর, মুখ, সব যেন আগুন-জ্বালা। দলে দলে মেয়ে পুরুষ চলেছে বিপ্লবের গান গেয়ে, নাচছে তারা বুল্ভারে বুল্ভারে, রাস্তায় রাস্তায়। সবাই চলেছে রেড স্কোয়ারের দিকে। রেড স্কোয়ারে লেনিনের কবরের সামনে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মজুর, ছাত্র আর লাল পল্টনেরা মার্চ করে চল্লো। ককেসাসের ঘোড়সোয়ারেরা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলো রেড স্কোয়ারের মধ্যে দিয়ে, হাজার হাজার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাথর বাঁধানো রেড স্কোয়ারের বুকে বেজে উঠলো। এমন সচ্ছন্দ সুষমার সঙ্গে কোনো নটীও নিজের দেহকে বহন করতে পারে না যেমন সচ্ছন্দে কঙ্কাশের ঘোড়সোয়াররা ঘোড়ার উপর হাল্কা ভাবে নিজেদের বহন করছিলো। ক্রেমলিনের চূড়োয় উড়ছে বিরাট লাল নিশান। ক্রেমলিনের ঘড়ি থেকে বেজে উঠলো ইন্টারন্যাশানাল।

সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় বয়ে চললো আগুনের জোয়ার। আকাশ বুঝি আর সহ্য করতে পারলো না। আগুন নিবোবার জন্যে নীল আকাশের বুক ফেটে ঝরে পড়লো তাই বরফের স্রোত। দেখতে দেখতে রাস্তা ঘাট, বাড়ীর ছাদ, কার্ণিশ, সব ঢাকা পড়ে গেলো বরফে। আমরা চলুম ক্রেমলিনের সন্ধ্যের উৎসবে যোগ দিতে। ক্রেমলিনের যে অংশে সম্রাটের মেয়েরা থাকতেন সেই মহলে উৎসবের আয়োজন হয়েছিলো। লুনাচারস্কি এসে ঘুরে গেলেন সেখানে, কতো বলশেভিকনেতারা যে এলেন গেলেন তার ইয়ত্তা নেই। কঙ্কাসের নাচ দেখতে দেখতে বৃদ্ধ শক্‌লওয়ালা আর বসে থাকতে পারলেন না, তিনিও উঠে নাচতে সুরু করলেন। এমন সময়ে সেখানে এসে ঢুকলেন একজন দীর্ঘকায় পুরুষ, রোগা, একটু নুয়েও পড়েছেন। মুখটি শীর্ণ, চোখদুটো যেন জ্বলন্ত কয়লা, নাক খড়গের মতো, প্রশস্ত ললাটের কোনে লম্বা চুলের গুচ্ছ এসে পড়েছে। অদ্ভুত চেহারা, প্রাণের দীপ্তিতে মুখ আলো হয়ে রয়েছে। শক্‌লওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলুম, কে ইনি? শক্‌লওয়ালা বল্লেন ইনি হচ্ছেন আঁরি বারবুস্। আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে। ইনি আঁরি বারবুস্? 'আগুন' আর 'শৃঙ্খল' বই দুইটির রচয়িতা ইনি?

যখন প্রথম এই দুটি বই পড়ি সেই তরুণ বয়েসের কথা মনে পড়ে গেলো। কি আশ্চর্য ভালো লেগেছিলো বইদুটি। মনের বাতায়ন খুলে হঠাৎ এক নতুন আলো ঝলকে ঝলকে এসে পড়েছিলো আমার তরুণ জীবনে। সে জগৎকে চিনতুম না সে দিন, আমার সে দিনকার জীবনের সঙ্গে তার কোনো যোগ ছিল না। বারবুস্ যখন হাজির করে দিলেন আমাকে সেই অজানা জগতের সামনে তখন কেঁপে উঠেছিলো বুক ভয়ে ও বিস্ময়ে সে জগত টানছিলো আমাকে তার দিকে অথচ তাকে স্বীকার করে নিতে পারছিলুম না। মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সুরু করিয়ে দিলেন বারবুস্, তারি পরিণতি হলো একদিন যখন পুরণো ঘাট থেকে নোঙর ছিঁড়ে ভেসে পড়লো জীবন অজানা সমুদ্রে।

ইনি সেই বারবুস্! চেহারাটা 'আগুন' আর 'শৃঙ্খল' রচয়িতার উপযুক্ত চেহারা বটে। আমার সঙ্গে দুচারিটি কথা বিনিময় করে বারবুস্ চলে গেলেন। পরদিন সন্ধ্যেবেলা মস্কোর ট্রেডইউনিয়ন হলে সভা হলো। নানা দেশ থেকে আগত মনীষীরা নভেম্বর-বিপ্লব ও সোভিয়েট রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন সেই সভায়। ফরাসী দেশের মনীষীদের তরফ থেকে বারস্ নভেম্বর বিপ্লবকে অভিনন্দন জানালেন। মুগ্ধ হলুম তাঁর বলবার ধরণে। সভা শেষ হলে চায়ের আসরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর লেখা যে আমার জীবনে এক অজানা জগতের প্রথম আলো এনে দিয়েছিলো, তাঁকে সেই কথা না জানিয়ে থাকতে পারলুম না। ভারতবর্ষ সম্বন্ধেনানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। স্বাধীনতা-আন্দোলনের ভিতরের কমিউনিষ্ট আন্দোলন গড়ে উঠছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। জানতে চাইলেন ভারতবর্ষের সাহিত্যেকেরা কতোটা অংশ গ্রহণ করছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। জানালুম তাঁকে আমাদের সেই প্রথম প্রচেষ্টা 'বঙ্গীয় শ্রমিক-কৃষক দল' আর তার মুখপত্র 'লাঙল' আর ‘গণবানীর’ কথা, ১৯২৫ সালে গান্ধী-আন্দোলনের আওতা থেকে বেরিয়ে আসা আমদের সেই ছোট্ট দলটির কথা। গান্ধীবাদের সংকীর্ণ জাতীয়তার দিক রবীন্দ্রনাথ যে স্বীকার করেননি সেকথাও তাঁকে জানালুম। বন্ধু নজরুল ইসলাম সে সময়ে 'লাঙল' আর ‘গণবাণীতে' তাঁর গান আর কবিতা বের করে যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন বাঙলা সাহিত্যে, তার খবর তাঁকে পৌঁছে দিলুম। ঘন্টা খানেকের আলাপ হলো সেদিন চায়ের আসরে। তারপরে তাঁর সঙ্গে দেখা হোলো বার্লিনে ১৯৩০ সালে। তিনি এসেছিলেন মানুষের অধিকার সংরক্ষণ লীগ' নামক সঙ্ঘের আহ্বানে বার্লিনে বক্তৃতা দিতে। মজুর- আন্দোলন তখন ক্রমশই পিছে হটে আসছিলো ফ্যাসিজমের আক্রমণে। ক্যাথলিক ব্রুনিং ডেমোক্রাসির অজুহাতে নাৎসীদের সব সুবিধে জুটিয়ে দিচ্ছিলেন মজুর-আন্দোলনকে বিধ্বস্ত করবার জন্যে। হিটলারের কালো ছায়া ক্রমশই দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়ে পড়ছিলো জাম্মানীর বুকে। সোশালিষ্ট বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখাবার জন্যে বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি লেলিয়ে দিচ্ছিলো ফ্যাসিজমকে শ্রমিক-আন্দোলনের বিরুদ্ধে। জার্মানীর শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরা সমাজের স্রোতে কচুরি পানার মতো ভেসে যাচ্ছিল নাৎসিজমের বেনো জলের টানে। গোয়েটে আর হায়নের জার্মানী, কান্ট, হেগেলের জার্মানী সেঁধিয়ে যাচ্ছিলো অবৈজ্ঞানিক বর্বরতার চোরাবালিতে। জার্মানীতে ফ্যাসিজম জয়ী হলে সমস্ত ইয়োরোপে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। খাঁটি রক্তের ঔৎকর্ষের মতবাদ, জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মতবাদ, বিচার বর্জন করে হৃদয়াবেগকে প্রাধান্য দেওয়ার মতবাদ, এই সব উদ্ভট মতবাদের দ্বারা ফ্যাসিজম্ ইয়োরোপীয় সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, কলা ও দর্শনকে ধর্ষন করবার জন্যে তখন উঠে পড়ে লেগেছে। এই ঘনায়মান বিপদ সম্বন্ধে সকলকে সজাগ করবার জন্যে বারবুস্ এসেছিলেন বার্লিনে। তাঁর প্রাণের সমস্ত ব্যথা আর জ্বালা দিয়ে সে দিন সন্ধ্যেবেলা তিনি বল্লেন। একে বক্তৃতা বলা চলে না, এ প্রাণ-নিঙড়নো আন্তরিকতা। মানুষের সভ্যতার বিরুদ্ধে বর্বরতার অভিযান সুরু করেছে ফ্যাসিজম্। মানুষের বন্ধু বারবুস্, তিনি কি চুপ করে থাকতে পারেন ? আলসেমিতে ভরা মানুষের মন, মন নড়ে বসতে চায় না, জুগিয়ে দেওয়া জিনিস রোমন্থন করে দিন কাটাতে ভালোবাসে। সাধারণ মানুষের এই আসে মনটিকে জাগিয়ে তোলবার ভার তাঁদেরই যাঁরা চির-জাগ্রত, যারা মানুষের সভ্যতার অনিদ্র প্রহরী। বারবুস্ তাঁদেরই একজন। পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করবার কথা ঠিক করে নিলুম। সে দিন সকালে ইয়োরোপের ইনটেলেক্‌ট্রয়েলদের অবনতির সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে আলাপ করি। বল্লুম—ইয়োরোপের প্রত্যেক দেশে গর্ভমেন্টের মন যুগিয়ে চলার যে প্রয়াস ইয়োরোপের সাহিত্যিকমহলে দেখা যাচ্ছে সেটা যেমন দুঃখের তেমনি বিপদের লক্ষণ।

তিনি বল্লেন—আমি তোমার সঙ্গে একমত। মানবতার যে অটল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সমস্ত অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো দরকার, ইয়োরোপের ইনটেলেকট্রয়েলদের মধ্যে সেই সুগভীর মানবতা বোধের দৈন্য আমাকে গভীর ব্যথা দিচ্ছে।

বুঝলুম জোলা, রোম্যাঁ রোলাঁর আদর্শ থেকে ইয়োরোপের শিক্ষিত সমাজ ভ্রষ্ট হচ্ছিল এই ছিলো তাঁর মর্মবেদনার কারণ।

বল্লুম,—ফ্যাসিজমকে নিছক একটা অর্থনৈতিক আন্দোলন, ক্যাপিটালিষ্ট সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোটি বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা মাত্র, শুধু এই হিসেবে দেখলে ভুল করা হবে নাকি? আমার মনে হচ্ছে নানা দিক থেকে এর বিচার আমরা করছি না, শুধু এক দিকেই ঝোক দিচ্ছি। আপনি এর পূর্ণ চেহারাটা সকলের সামনে ধরে দিন। সব দিক থেকে এই সর্বগ্রাসী বীভৎসতাকে প্রতিহত করুন। আমার মতে ফ্যাসিজম্ হচ্ছে হাজার হাজার বৎসরের কণা কণা অভিজ্ঞতা নিয়ে গঠিত মানুষের যে সংস্কৃতি তাকে ধ্বংস করে নির্জলা পশুত্বের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

বারবুস্ বল্লেন—তাতে কি আর সন্দেহ আছে? বিচার-বুদ্ধিকে লাঞ্ছিত করে অন্ধ আবেগের জয়গান, নরডিক জাতির রক্তের ভুয়ো শ্রেষ্ঠতা নিয়ে অবৈজ্ঞানিক উন্মত্ততা, যুদ্ধকে মানুষের সর্বোত্তম কর্তব্য বলে ঘোষণা, জাতীয় অভিমান মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর বিশ্বমানবের আত্মিক কুটুম্বতা পাপ এই অপপ্রচার,—এইগুলোই হলো মানুষের সভ্যতার বিরুদ্ধে ফ্যাসিজমের অভিযানের নমুনা। এই সর্বনাশী প্রতিক্রিয়া সভ্যতার তীর ভাঙ্গ বার আগেই আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। বাঁধ রক্ষা করতেই হবে বর্বরতার বন্যার আঘাত থেকে। বিপদ সামনে, সময় খুবই কম। সেদিন সকালে ঘন্টা দুয়েক আলাপের পর তাঁর কাছে থেকে বিদায় নিলুম।

তারপর বারবুসের সঙ্গে আমার দেখা ১৯৩৩ সালের মে মাসে। ম্যুনিকের নাৎসি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আমি চলে আসি প্যারিসে। জার্মানীতখন সদ্যসদ্য নাৎসিজমের কবলে পড়েছে। জেল আর বন্দীনিবাসগুলো ভর্তি সোশালিষ্ট, কমুউনিষ্ট, ডেমোক্রাট প্রভৃতি সব দলের লোকে। লক্ষ লক্ষ লোক জেলে আর হাজার হাজার লোক নিহত। বই পোড়ানোর ধুম লেগে গেছে, হায়নের বইগুলোও পুড়োতে ব্যস্ত নাৎসী বর্বরেরা। শ্রমিক আন্দোলন টুকরো টুকরো হয়ে গেলো নাৎসিজমের প্রচন্ড আঘাতে। বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার লোক জার্মানী থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। প্যারিস হলো তখন ঘর-ছাড়া জার্মান সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিপ্লবীদের প্রধান আশ্রয় ও আড্ডা। প্যারিসে এসে আমি নানা রাজনৈতিক বৈঠকে যোগ দিই। হিটলারী বর্বরতার প্রতিবাদে আহুত প্যারিসে একটি বিরাট জনসভায় নানা দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমিও বক্তৃতা দিই। প্যারিসে থাকবার সময় বাসের সঙ্গে বার কয়েক দেখা হয়। দুএকবার দেখা হলো বৈঠকেতে! আর কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। ফ্যাসিজম্ ও যুদ্ধ-বিরোধী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তিগুলিকে কেন্দ্রস্থ করবার কাজে তিনি লেগে গেছেন তখন। ভারতবর্ষও যাতে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগদান করে তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে সে সম্বন্ধে সজাগ ও সক্রিয় হতে অনুরোধ করলেন।। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-আন্দোলনের প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়ে বল্লেন যে এই ফ্যাসিজম্ ও যুদ্ধ-বিরোধী সঙ্ঘের মারফৎ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের কথা সমস্ত পৃথিবীকে শোনাতে পারবে। বিশেষ করে অনুরোধ করলেন যে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে ভারতের প্রতিবাদ যেন ধ্বনিত হয়। তাঁরই কথা মত ভারতবর্ষে ফ্যাসিজম্ ও যুদ্ধ-বিরোধী সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার ভার নিয়ে আমি দেশে ফিরে আসি। বারবুসের সঙ্গে শেষ দেখা আমার ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিন। তার দুদিন পরে আমি ভারতবর্ষ মুখে রওনা দিই, তাই তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলুম। ভগ্ন শরীর নিয়ে অক্লান্ত খেটে চলেছেন। শুধু এক চিন্তা কি করে ফ্যাসিজমের দানবতা থেকে মানুষের সভ্যতাকে বাঁচানো যায়, দেশে দেশে কি করে এই বিপদ সম্বন্ধে মানুষকে সজাগ করে তোলা যায়, কি করে তাঁদের সমস্ত শক্তি এক করে সভ্যতার শত্রু ফ্যাসিজমকে প্রতিহত করা যায়। বিদায়ের মুহূর্তে দুই হাত দিয়ে আমার হাত ধরে বল্লেন, ভারতবর্ষকে আমরা চাই বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বমানবের এই অভিযানে। মনে রেখো এস কথা আর ভারতবর্ষের মুক্তি-সংগ্রামের সৈনিকদের আমার অভিনন্দন জানিও। সেই কথার সুর আজও আমার কানে বাজছে। ভারতবর্ষে ফিরে আসবার পর দুবার তাঁর কাছ থেকে চিঠি পাই। তার কিছু দিন বাদেই তাঁর মৃত্যুখবর পেলুম।

১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাস। কয়েক মাস থেকে আমি কাপ্রিতে রয়েছি। আগে কতোবার পড়েছি যে লেনিন, গর্কি, লুনাচারস্কি কাপ্রিতে অনেক দিন কাটিয়েছেন, এখানে তাঁরা স্কুল চালাতেন শ্রমিকদের জন্যে। কাপ্রির সঙ্গে তাই মনের পরিচয় অনেক দিন থেকেই ছিলো, এবার চোখের মিলন ঘটলো। ফুলেফলে ভরা এই দ্বীপটি যেন পারিজাত ফুল, অলকার কানন থেকে উড়ে এসে পড়েছে ভূমধ্য সাগরের বুকে। পাহাড়ের গায়ে জিনেষ্ট্রোর হলদে ফুল আগুন জ্বেলে রেখেছে। আঁকাবাঁকা পথের ধার দিয়ে আঙ্গুরের ক্ষেত থাকে থাকে নেমে গেছে। কালো মুক্তোর মতো নিটোল কালো অঙ্গুর, একটু ঘা দিলেই লাল, রস ফিনকি দিয়ে পড়ে। জেলেরা নৌকা নিয়ে বের হয়ে যায় রাতে, দূর সমুদ্রে মাছ ধরবার জন্যে। অন্ধকার রাত্তিরে জেলেডিঙ্গির আলো দেখা যায়, কালো সমুদ্রের পলতেতে কে যেন সারি সারি দীপ জ্বেলে দিয়েছে। সহর বলতে শুধু পিয়াৎসাটুকু, সেখানে দোকান, হোটেল, রেস্তোঁরা, কাফেগুলো গা ঘেঁসাঘেসি করে রয়েছে। বিলাসী বাবুদের আর বিলাসিনীদের ভিড় লেগেই থাকে পিয়াৎসায়। যেখানে জাহাজীদের, জেলেদের আর চাষীদের ভিড়, পিয়াসার পেছনে সেই সব রেস্তোরাঁয় আমাদের আড্ডা। অল্গা, হ্যারল্ড, মারিয়ানা, মিখাইলঙ্, মারিও আর আমি সন্ধ্যেবেলা জুটি একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর মালিক কর্শিকান, ছোট্ট মানুষটি, ধারালো মুখে ধারালো গোঁফ, আঙ্গুর দিয়ে অমলেট করে খাওয়ায়, কালামাইয়ো মাছ ভেজে দেয় অলিভের তেলে, গাছ-পাকা ফিগ ধরে দেয় থালায় করে। অলগা রাশিয়ান গান গায়, হ্যারল্ড গল্পলেখক, তার ছোটো গল্প পড়ে শোনায়, মারিও ইটালীয়ান গান শোনায়, আমি বাঁশী বাজাই। মাঝে মাঝে এক একদিন এক একজন জেলেকে ধরে নিয়ে আসি আমাদের আসরে, শুনি তার কাছ থেকে জেলেদের গান। দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ বাজে তার গানে, ঝড় গর্জে ওঠে, নৌক ডুবুডুবু হয় আবার শেষ রাতে তীরে এসে পৌঁছয়। আমার অসুস্থ শরীরটাকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে এসেছিলুম কাপ্রিতে, এসেই খোঁজ নিয়েছিলুম মাসিম গর্কির। মস্কোতে থাকবার সময় শুনেছিলুম তিনি কাপ্রিতে থাকেন। যক্ষ্মা রোগী তিনি, রাশিয়ার দারুণ শীত তাঁর সহ্য হয় না, তাই দক্ষিণ ইটালীর তপ্ত আবহাওয়ায় তিনি বাস করেন। কাপ্রিতে এসে শুনলুম অনেক দিন হলো তিনি কাপ্রি ছেড়ে সোরেন্টোতে বাস করছেন। কাপ্রির কাছেই সোরেন্টা। কাপ্রি ছাড়বার সময়ও ঘনিয়ে এলো। বার্লিনে ফিরে যাওয়ার আগে গর্কির সঙ্গে দেখা করে যেতেই হবে এটা মনে মনে সংকল্প করে নিয়েছিলুম।

একদিন ভোরে আমি আর আমার ইংরেজ বন্ধু হ্যারল্ড টুবী সোরেন্টো রওনা দিলুম। কাপ্রি থেকে সোরেন্টো ঘন্টা খানেকের পথ ষ্টীমারে। শীতের ভোর, তখনও অন্ধকার কাপ্রির মুখে, আঙ্গুরক্ষেতে আর সমুদ্রের বুকে জড়িয়ে, আছে যখন আমরা দুই বন্ধু ষ্টীমার ঘাটে গিয়ে ষ্টীমার ধরলুম। সোরেন্টোর পথে ষ্টীমার থামলো গিয়ে মাৎসালুব্রেসা নামে ছোট্ট একটি জেলেদের গাঁয়ে। অসংখ্য জেলে নৌক বন্দরে, কোনো নৌক সারারাত সমুদ্রে কাটিয়ে এস ফিরলো বন্দরে, কোনো নৌক তুললো নোঙর। বন্দরে নৌকর ভিড় যতো তার অর্দ্ধেকও ভিড় নয় লোকের। সোরেন্টোতে পৌঁছে খোঁজ নিতে নিতে পৌঁছলুম গিয়ে গর্কির বাড়ীতে। প্রকান্ড কাঠের ফটক বন্ধ ছিলো। ঘন্টা বাজালুম, একটু পরে মোটাসোটা একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফটক খুলে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। আমাকে দেখেই রুশীয় ভাষায় বল্লেন, আপনি টাগোর, না? মস্কোয় আপনাকে দেখেছি!' গর্কির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি জানালুম তাঁকে! বল্লেন, সকালে তো গর্কি কারো সঙ্গে দেখা করেন না, লেখার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আপনারা একটার সময় আসবেন। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিয়ে একটু চড়াই উঠে বসলুম গিয়ে একটা রেস্তোরাঁয়। কফি নিয়ে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিয়ে ফিরে চল্লুম আবার পিয়াসার দিকে। সময় আর কাটতে চায় না। এ দোকানে ও দোকানে উঁকি মেরে আবার কাফেতে গিয়ে বসলুম দুজনে। একটার সময় হাজির হলুম গিয়ে গর্কির বাড়ীতে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবারেও ফটকের কাছে এসে আমাদের উপরে নিয়ে গেলেন। পরে জানলুম ইনি গর্কির ডাক্তার। দোতলায় গর্কির ছেলে আর পুত্রবধূ আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলুম এমন সময় পাশের একটা দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন গর্কি। দীর্ঘকায় পুরুষ, কৃশ শরীর, ছবিতে দেখা বহুদিনের সেই চির-পরিচিত মুখ। ডাক্তার দিলেন আলাপ করিয়ে, বসলুম আমরা খেতে। গর্কির স্ত্রীও এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। খেতে খেতে আলাপ সুরু হলো, জিজ্ঞেস করলুম কিছু লিখছেন কিনা। গর্কি বল্লেন হাঁ, একটা উপন্যাস লিখছি। পুত্রবধূ বল্লেন, সকাল থেকে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় পর্যন্ত গর্কি একটানা লিখে চলেন। তারপরে বিকেলের দিক থেকে আবার লেখা সুরু করেন, লিখে চলেন রাত্তিরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত। বিরাট একটা নভেল লিখছেন এইবার। গর্কি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, – ডাক্তারের কাছে শুনলুম তুমি অনেক দিন সোভিয়েট রাশিয়ায় ছিলে, কি রকম লাগলো তোমার ?

প্রায় দুবছর রাশিয়ায় থাকবার সময় যা দেখেছি ও জেনেছি সে সব আমার মনকে যে কি গভীর ভাবে আলোড়িত করেছে তা তাঁকে জানালুম। তবুও কতকগুলো জিনিস যে আমি স্বীকার করে নিতে পারি নি তাও তাঁকে জানালুম। গর্কি আমার দিকে তাকালেন, বুঝলুম যে তিনি জানতে চান ঠিক কোন জায়গাটায় আমার বেধেছে, ঠিক কোন জিনিসগুলো আমি মন থেকে গ্রহণ করতে পারি নি।

তাই বল্লুম,— লেনিনের শব-পূজা আমি আদবেই বরদাস্ত করতে পারি নি। জনসাধারণের মনকে কুসংস্কারে ডুবিয়ে রাখাবার জন্যে প্রত্যেক ধর্মের পান্ডারা যে প্রণালীতে মানুষের মনকে ভূতগ্রস্থ করে রাখে, লেনিনের শব-পূজা সেই একই জাতের জিনিস। আমার মতে লেনিনের শব-পূজা কমিউনিজমের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ এক বস্তু। লেনিনের মৃতদেহটিকে মমি করে রাখা আমার মনকে তাই পীড়া দিয়েছে।

গর্কি বল্লেন—তুমি যা বলছো সেটা ঠিক, তবে এটা সাময়িক আর বর্তমানে সোভিয়েট রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্যে ওর প্রয়োজন আছে বোধ হয়।

আমি বল্লুম—আপনি যে যুক্তি দেখালেন, মস্কোতে আমার অনেক কমুউনিষ্ট বন্ধুরা ঠিক এই একই যুক্তি দেখিয়েছেন। আমি কিন্তু এই যুক্তি মানতে পারি নি। সব কুসংস্কার আমরা একদিনে নির্মূল নিশ্চয়ই করতে পারবো না, কিন্তু তাই বলে জনসাধারণের মনে কুসংস্কারকে জিইয়ে রাখবার চেষ্টা তো কমুউনিষ্টরা করতে পারে না। কোনো সাময়িক প্রয়োজনীয়তার খাতিরে আমরা এটা করতে পারিনে, কেন না এটা কমিউনিজমের মূল ভিত্তিকে ধ্বসিয়ে দেয়। জনসাধারণের মনে যেখানে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার জমে আছে সেখানে বিচারের আলো জ্বেলে দিতে হবে। এ ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই।

গর্কি চুপ করে রইলেন। পরে আস্তে আস্তে বল্লেন—আর কি তোমার ভালো লাগে নি?

বল্লুম,—মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে মেরেধরে সঙ্কুচিত করে সরকারী মতবাদের ফ্রেমের মধ্যে বাঁধবার জন্যে সোভিয়েট রাষ্ট্রের বর্তমান নেতারা লেনিনের নামের যে মর্মান্তিক অপব্যবহার করছেন, সেটা আমার মনকে খুবই পীড়া দিয়েছে। প্রত্যেকটি চিন্তার, প্রত্যেকটি মতবাদের বিচার হওয়া উচিত তার নিজস্ব মূল্যে। সোভিয়েট রাষ্ট্রে সেই বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যখনই কেউ কিছু বলে কিম্বা লেখে অমনি সে বিষয়ে লেনিন কি বলেছেন সেইটে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে লেগে পড়ে বড়ো ক্ষুদে মাঝারি টীকাকারের দল। যদি লেখক বা বা ভাগ্যক্রমে সমর্থন পায় লেনিনের লেখা থেকে তবেই সে বাঁচে, নইলে তার দুর্দশার সীমা থাকে না। এই রকম করেই স্বাধীন চিন্তার ভ্রুণহত্যা বহুযুগ থেকে করে এসেছে ধর্মের পদ্ধতি-পন্ডিতেরা শাস্ত্রের ও শাস্ত্রকারের দোহাই দিয়ে। সেই একই হত্যাকান্ড চলেছে সোভিয়েট রাশিয়ায় লেনিনকে শাস্ত্রকার আর লেনিনের লেখাকে শাস্ত্র বানিয়ে।

গর্কি বল্লেন—তুবও বিচার করতে গেলে একটা কিছুতো প্রামাণ্য বলে ধরে নিতে হবে, নইলে মূল্য নির্দ্ধারণ করা সম্ভব হবে কি করে ?

আমি বল্লুম—প্রামাণ্য আমি স্বীকার করি, তবে সে প্রামাণ্য আমার চিন্তাকে, আমার মনন-শক্তিকে খর্ব করে দেওয়ার জন্যে নয়, আমার সৃজনীশক্তিকে সন্দীপিত করবার জন্যে। প্রামাণ্য মুগুর নয় মানুষকে ভয় দেখিয়ে হতবৃদ্ধি করবার জন্যে, প্রামাণ্য হচ্ছে আলো পথ দেখাবার জন্যে। আপনাকে আর আপনার সৃষ্টিকে যাচিয়ে নেবে মানুষ সেই আলোতে। 'তা'ছাড়া এটা ভুললে চলবে না যে অতীতের কতো অটল সিদ্ধান্ত টলে গেছে। যা একদা অনড় বলে মনে হয়েছে তা নড়েছে, ধুলোয় মিশেছে, মানুষ নতুন সিদ্ধান্তে এসে পৌঁচেছে। মানুষের বিচার-বুদ্ধিকে, তার সৃজনীশক্তিকে আমি কোনো প্রামাণ্যের পায়ে বলি দিতে রাজী নই। প্রত্যেক চিন্তাকে বিচার করতে হবে তার নিজস্ব মূল্যে, নইলে সংস্কারবদ্ধ মানুষের মন স্বাধীন চিন্তাকে জাতিচ্যুত করে রাখবে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে।

গর্কি বল্লেন—অতীতে কোনো বাধাই মানুষের মননশক্তিকে আটকাতে পারে নি, এখনো পারবে না, কখনো পারবে না। তবে এটা ঠিক যে প্রামাণ্য স্বীকার করেও কেমন করে মানুষের সৃজনী শক্তিকে অবাধ-গতি করা যায় এই সমস্যার সমাধান আমাদের করতেই হবে।

আমি বল্লুম——মানুষের মনন-শক্তিকে আটকানো যায়নি শেষ পর্যন্ত আপনার একথা ঠিক, আর ভরিষ্যতেও যে আটকানো যাবে না সে কথা মানি। তবে সেটা হচ্ছে শেষ পর্যন্তের কথা অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত তকে আটকিয়ে রাখা যাবে না, সে সব বাধা ঠেলে এগোবেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই যে সোভিয়েট রাষ্ট্রেও কি তাকে প্রামাণ্যের বাঁধ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগোতে হবে, লড়তে হবে তাকে পদে পদে প্রামাণ্যের নিষেধের সঙ্গে? এখানেও কি মানুষের সৃজনী শক্তিকে স্তূপাকার নিষেধ ঠেলতে ঠেলতে এগোতে হবে শেষ পর্যন্ত? সোভিয়েট রাষ্ট্রেও কি এই নিষেধের আবর্জনা সরিয়ে দেওয়া হবে না, মানুষ বহু অপ্রয়োজনীয় শক্তিক্ষয়ের দুঃখ থেকে বাঁচবে না? এই সমস্যার সমাধান যে খুব তাড়াতাড়ি হবে না সেটা আমি স্বীকার করি। আমি শুধু এর আরম্ভের সন্ধান করেছিলুম সোভিয়েট রাশিয়ায়, সেইটেতো দেখতো পাইই নি, বরঞ্চ চারদিকে নিষেধের ভ্রুকুটি দেখে আতঙ্কিত ও ব্যথিত হয়েছি।

টেবিলে সবাই চুপ করে ছিলেন, গর্কিও নিস্তব্ধ। আমি কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বল্লুম- সোভিয়েট রাশিয়ায় এক নতুন ধরনের পেট্রিয়টিজম্ গজিয়ে উঠেছে, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন ?

গর্কি বল্লেন—কি রকম পেট্রিয়টিজম্?

বল্লুম—কবিতা, শিল্প থেকে খাবার পর্যন্ত সোভিয়েট রাশিয়ার যা কিছু তৈরি হচ্ছে, তার মতো আর দুনিয়ায় কোথাও কিছু নেই, এই উৎকট পেট্রিয়টিজমের গুটিতে সোভিয়েট নাগরিকদের দেহ ভরে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বল্লুম, মস্কোয় এর রুশীয় বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রুশীয় রান্না কেমন লাগছে? বল্লুম, মন্দ নয়, তবে আহামরি কিছু নয়। বন্ধু খাপ্‌পা হয়ে উঠলেন— সেকি? রুশীয় রান্নার মতো এমন রান্না দুনিয়ায় আছে? সাহিত্য আলোচনা হচ্ছিলো একদিন। বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন আমাকে সোভিয়েট যুগের রুশীয় সাহিত্য কিছু পড়েছি কিনা! বল্লুম, হাঁ পড়েছি কিছু কিছু, যেমন গ্লাডকফ্, ত্রিচিকফ্, ডিমিয়ান্ বিয়েদনি প্রভৃতি। ডিমিয়ান্ বিয়েনির কবিতা পড়েছি শুনে বন্ধু খুসি হলেন, বল্লেন— চমৎকার কবিতা লেখেন বিয়েনি, নিশ্চয়ই তোমার খুব ভালো লেগেছে তাঁর কবিতা? কতো আর মিথ্যে বলা যায়, তাই মরিয়া হয়ে বল্লুম, আদবেই ভালো লাগে নি বিয়েদনির কবিতা, ওগুলো কবিতাই নয়, ওগুলো ইস্তাহার, ওতে না আছে ভাব, না আছে রস। আর যায় কোথা! সে দিন তপ্ত বাক্যের যে লাভা স্রোত বন্ধুর ওষ্ঠ থেকে নির্গত হলো তাতে একেবারে দগ্ধ হয়ে বাড়ী ফিরলুম।

গর্কি হাসতে লাগলেন। বড়ো মিষ্টি লাগলো তাঁর হাসি, মানুষের প্রতি গভীর দরদ সেই হাসিতে মাখানো ছিলো। জীবনে তিনি কি অপরিসীম দুঃখই না পেয়েছেন! নিজের জীবনের সঙ্গে নামকে একসুরে বেঁধে নেবার জন্যে আসল নাম বদল করে নিজের নাম রাখলেন গর্কি (গর্কি মানে তিতো)। এতোটুকুও তিক্ততা কিন্তু তাঁর জীবনকে স্পর্শ করে নি, এমনি আশ্চর্য তাঁর প্রাণ-শক্তি, তাঁর মানবতা।

গর্কি বল্লেন—এসব ছেলেমানুষি কেটে যাবে বৃহৎ পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হলে। একেবারে অন্ধকার থেকে হঠাৎ আলোতে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। প্রথম পরিচয়ের আলো তাই অসীম বিস্ময় জাগাচ্ছে, অপূর্ব বলে বোধ হচ্ছে এদের কাছে। যখন অন্য আলোর সন্ধান পাবে তখন কাছের আলোকে যাচিয়ে নিতে পারবে। তখন এসব ছেলেমানুষি কথা আর বলবে না।

বল্লুম--আমার একটি প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। সোভিয়েট রাশিয়ায় সাহিত্যকে মজুর- সাহিত্য ও বুর্জোয়া সাহিত্য এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমি এই বিভাগটা ঠিক মেনে নিতে পারছিনে। তাই আপনার কি মত এ বিষয়ে সেটা জানতে চাই।

গর্কি বল্লেন—ঠিক কোথায় তোমার বাধছে সেটা যদি জানাও তো আমার পক্ষে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হয়।

বল্লুম—মজুর-সাহিত্য যে কি জিনিস তা আমি বুঝে উঠতে পারি নি। মজুর-সাহিত্য বলতে ঠিক কি বোঝায়-মজুরের লেখা সাহিত্য অথবা মজুরদের জীবন নিয়ে লেখা সাহিত্য ? যদি মজুরের লেখা মজুর-সাহিত্য হয় তাহলে সেখানে বিচারের বিষয় হচ্ছে এই যে যেটা লেখা হয়েছে সেটা সাহিত্য হয়েছে কিনা। আর যদি মজুরের জীবনকে বিষয়-বস্তু করে লেখা সাহিত্য মজুর-সাহিত্য হয়, তাহলে বহুকাল থেকে এরকম সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, যথা এমিল জোলার জার্মিনাল। এই সাহিত্যকে হঠাৎ মজুর-সাহিত্য নাম দেওয়ায় কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই।

গর্কি বল্লেন—মজুর-সাহিত্য বলতে বোঝায় জনসাধারণের জীবনকে কেন্দ্র করে নতুন সামাজিক জীবন গঠন করবার ইঙ্গিত যে সাহিত্য দেয় সেই সাহিত্য।

আমি বল্লুম—জনসাধারণের জীবনের হাহাকার ও লাঞ্ছনার ছবি এঁকে, নতুন সামাজিক জীবন সৃষ্টি করবার ইঙ্গিত যে সাহিত্যে আছে তাকে আমি বিপ্লবী সাহিত্য বলি। সেটা মজুর-সাহিত্য নয়। মজুরের লেখা সাহিত্য বিপ্লবমুখী সাহিত্য নাও হতে পারে, এমন কি সে সাহিত্য বুর্জোয়া-সাহিত্য অর্থাৎ বুর্জোয়া সমাজের সমর্থনকারী সাহিত্যও হতে পারে। তাই আমার মতে বর্তমান কালের সাহিত্যকে বুর্জোয়া-সাহিত্য অর্থাৎ বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার সাহিত্য আর বিপ্লবী-সাহিত্য অর্থাৎ এই সমাজ-ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ- ব্যবস্থা রচনা করবার জন্যে মানুষের মনকে জ্বালিয়ে তোলার সাহিত্য—এই দুইভাগে বিভক্ত করা সমীচীন। একটা হলো পিছনে-তাকানো সাহিত্য, স্থানুর সাফাই গাওয়ার সাহিত্য আর অন্যটা হলো সামনে-চলার সাহিত্য, নুতনের জয়গান। মজুর-সাহিত্য কথাটা আমার কাছে অর্থহীন, কেন না আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে মজুরের লেখা সাহিত্য যে সব সময় নবজীবনের দিকে চলার সাহিত্য হবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, মজুরের লেখা সাহিত্য সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যও হতে পারে। তাছাড়া সাহিত্যকার কোন্ শ্রেণী- উদ্ভুত তার বিচারের দ্বারা সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্দ্ধারণ না করে, সাহিত্যকার কোন আদর্শের কথা বলছে তার বিচারের দ্বারা সাহিত্য বিচার করা যুক্তিসঙ্গত।

গর্কি বল্লেন—বুঝেছি তুমি কি বলতে চাও। তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত। তবে সোভিয়েট রাশিয়ার মজুর শ্রেণী বিপ্লব করেছে, তারা সোভিয়েট রাষ্ট্র পত্তনও করেছে। তাই সেখানে মজুর-সাহিত্য বলতে বিপ্লবমুখী সাহিত্যই বোঝায়। তাছাড়া মজুর সাহিত্য এই সংজ্ঞার প্রচারের দ্বারা মজুরদের সাহিত্য সৃষ্টি করতে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিক থেকে এই সংজ্ঞার একটি সামাজিক প্রয়োজনীয়তা আছে, সাহিত্য-বিচারের দিক থেকে তার প্রয়োজনীয়তা থাকুক, না থাকুক।

বল্লুম—আপনার কথা বুঝলুম। তবে সোভিয়েট রাষ্ট্রে মজুর-সাহিত্য নামে যা সব সৃষ্টি হয়েছে তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সাহিত্য হচ্ছে না আর খুব কম ক্ষেত্রেই বিপ্লবমুখী সাহিত্য হচ্ছে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে মজুরদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা খুবই প্রশংসনীয়। নীচের তলার অন্ধকারে যারা গুমরে মরছিলো তাদের প্রাণের সলতেকে উস্কে দিয়ে সৃষ্টিশক্তির আলো জ্বেলে দিতে সোভিয়েট রাশিয়ায় যা করা হয়েছে তার তুলনা নেই। আমার প্রাণের অকুণ্ঠিত শ্রদ্ধা তাঁদের নিবেদন করি যাঁরা তাঁদের এই কর্মের দ্বারা সমস্ত মানুষের লজ্জা ঘুচিয়েছেন। তবু বলতেই হবে যে সৃষ্টিশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা আর সাহিত্য-বিচার এ দুটো এক জিনিষ নয়। তা ছাড়া সাহিত্য সম্বন্ধে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে মানুষের সৃষ্টি-শক্তিকে আমরা কখনই জাগিয়ে তুলতে পারবো না। মজুর-সাহিত্যের হুজুগ তুলে মজুর-সাহিত্যিকদের আমরা কি রকম বিভ্রান্ত করেছি তা তো আমার চেয়ে আপনি ঢের বেশী জানেন। আপনাকেই তো কলম ধরতে হয়েছিলো সেই সমালোচকের বিরুদ্ধে যে এক মজুর-কবির কবিতার সমালোচনা করে লিখেছিলো-তুমি তোমার প্রিয়ার নরম হাতের কথা লিখেছো, তোমার প্রিয়া নিশ্চয়ই বুর্জোয়া, তোমার প্রিয়া যদি মেয়ে হতো তাহলে তার হাত কি নরম হতো? তুমি যখন বুর্জোয়া মেয়ের প্রেমে পড়েছো তখন তুমিও বুর্জোয়া।

বুঝতেই পারলো না সেই হতভাগ্য সমালোচক যে প্রেমের চোখে কড়া হাতও ফুলের চেয়ে কোমল ঠেকতে পারে। ভাগ্যিস আপনি সেই কবিকে বাঁচাতে কলম ধরেছিলেন নইলে তার প্রাণ বাঁচানো দায় হতো।

গর্কি খুব হাসতে লাগলেন। বল্লেন, তুমি তো অনেক খবর রাখো দেখছি। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। স্বাধীনতা-আন্দোলন ও গান্ধীজি সম্বন্ধে অনেক কিছু খরব নিলেন। বল্লেন—তোমাদের দেশের জনসাধারণ অশিক্ষিত, লিখতে পড়তে জানে না, তাই তাদের মধ্যে বিপ্লবের মতবাদ ছড়িয়ে দেওয়া বড় শক্ত হবে।

বল্লুম—রাশিয়ায় সেই একই অবস্থা ছিলো। সেখানকার লোকেরাও ভারতবর্ষের লোকের মতোই অশিক্ষিত ছিলো। তবু সেখানে বিপ্লব ঘটলো আর ঘ্টলো না জার্মানীতে যেখানে শিক্ষিতের সংখ্যা এতো বেশী। লিখতে পড়তে জানে না এমন জনসাধারণকে বিপ্লবের শিক্ষা দিতে খুব বেশী কষ্ট পেতে হয় না। তবে তার জন্যে চাই বলশেভিক পার্টির মতো দল আর লেনিনের মতো নেতা।

গর্কি আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে। প্রকান্ড ঘর, আসবাবের মধ্যে তাঁর বিছানা, লেখবার টেবিল, দুটো চৌকি আর একটা বইয়ের শেলফ্। ঘরটির পাশেই বারান্দা। ঘর আর বারান্দা দুই থেকেই সোরেন্টোর তলা দিয়ে বেঁকে যাওয়া সমুদ্র দেখা যায়। মন- ভোলানো সেই ছবি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলুম। বিদায় নেবার সময় তাঁর নিজের হাতে আমাদের নাম ও তাঁর নাম লিখে দুটি বই আমাদের উপহার দিলেন।

১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষাশেষি ম্যুনিক জেল থেকে বের হয়ে আমি প্যারিসে আসি। মে মাস থেকে আমি রোম্যা রোঁলার সঙ্গে পত্রালাপে আলোচনা সুরু করি গান্ধীজির উপর লেখা তাঁর প্রসিদ্ধ বইটি সম্বন্ধে। তাঁকে জানাই যে লেখার দিক থেকে অপূর্ব হলেও তাঁর বইটি মূলত একটা রোম্যানটিক্ বই, কেন না ভারতবর্ষের সমস্যাগুলিকে তিনি যে ভাবে দেখিয়েছেন তাঁর বইতে ততে সমস্যাগুলিকে তিনি রঙীন করে তুলেছেন। সমস্যাগুলির প্রকৃত চেহারা ফুটে ওঠে নি। গান্ধীবাদ সম্বন্ধে তিনি যা লিখেছেন, এমন কি গান্ধীজির বর্ণাশ্রমপ্রথার সমর্থনকে পর্যন্ত তিনি যে ভাবে সমর্থন করেছেন তাতে আধুনিক ভারতের বহু মনীষীর প্রচেষ্টাকে লঘু করা হয়েছে। তা ছাড়া ‘ইয়োরোপ' মাসিক পত্রিকায় সোভিয়েট রাশিয়ার উপর তাঁর যে সব প্রবন্ধ বের হয় সে সম্বন্ধেও তাঁর সঙ্গে পত্ৰ বিনিময় করি। ছ’সাত মাস চিঠি লেখালেখির পর একদিন স্থির করলুম রোম্যাঁ রোলাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবো। ভারতবর্ষে ফিরে যাবার সময়ও ঘনিয়ে আসছিলো, তাঁর সঙ্গে দেখা না করে ইয়োরোপ ছাড়তে মন সরছিলো না।

নভেম্বর মাস শেষ হয়ে আসছে। বোয়াদ' বলোনিয়ার সবুজ সোনালী হয়ে শেষে একেবারে দেউলে হয়ে গেলো সব পাতা খুইয়ে। লেকের জল জমে এসেছে, রাজহাঁসগুলো সরে পড়েছে। স্যান্ নদীর জলে শীতের ছোঁয়াচ লেগেছে। এমনি একদিন শীতের সন্ধ্যেবেলা (২৪শে নভেম্বর, ১৯৩৩) রওনা দিলুম প্যরিস থেকে ভিন্যত্। সকালেবেলা গিয়ে পৌঁছলুম ভিন্যভে। ছোট গ্রাম ভিন্যভ বরফে ঢাকা। জমাট লেকের উপর স্কেটিং চলেছে, ছিপছিপে পানসী নৌকর মতো স্কি করে দলে দলে লোক যাচ্ছে এদিকে ওদিকে। লেকের ধারেই হোটেল, হোটেলের মালিকের কাছ থেকে সন্ধান নিয়ে একটি বাঁকা সরু পথ দিয়ে পৌঁছলুম গিয়ে ভিলা অল্গায়। বাগানের ছোট দরজাটি খুলে ঢুকতেই, বাগানে একটি লোক দাঁড়িয়েছিলো, এগিয়ে এলো। বল্লুম, রোম্যাঁ রোলাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। সামনের বাড়ীতে না নিয়ে গিয়ে নিয়ে গেল পিছনের বাড়ীতে। এক বৃদ্ধা বের হয়ে এলেন, বিকেলে যখন পরিচয় পেলুম তখন জানলুম ইনি রোম্যাঁ রোলাঁর বোন। আমার আসার উদ্দেশ্য তাঁকে জানালে, জিজ্ঞেস করলেন—আগে থেকে কি কোন কথা আছে, রোম্যা কি আপনাকে আসতে বলেছেন? বল্লুম—না, সে রকম কোনো কথা নেই। তবে তাঁর সঙ্গে কয়েক মাস থেকে পত্র বিনিময় করেছি। ভারতবর্ষে ফিরে যাবো শীঘ্রি, তাই ফিরে যাবার আগে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছি। বৃদ্ধা বল্লেন—আপনি বুঝি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারিস থেকে যিনি রোম্যাকে চিঠি লেখেন? বল্লেন—একটু অপেক্ষা করুন আমি রোম্যার সঙ্গে কথা বলে আসছি। কয়েক মিনিট বাদে ফিরে এসে বল্লেন— আপনি বিকেলে চারটের সময় আসবেন। রোম্যাঁ তখন আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে এলুম হোটেলে। হোটেলে আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখছি সামনের জমাট-বাঁধা লেক রোদে ঝল্‌মল্ করছে যেন সোনালি বরফের মরুভূমি। লেকের ওধারে পাহাড় উঠে গেছে, তার গায়ে ছোট ছোট বাড়ী। আবার সেই বাঁকা পথ ধরে গেলুম ভিলা অল্গায়। শ্রীমতী ম্যাড়লেন রোঁল্যা আমাকে নিয়ে গেলেন সেই পেছনের বাড়ীতে। ঘরে ঢুকেই দেখলুম রোম্যা রোলাঁ বসে আছেন খোলা আগুনের চিমনীর পাশে। শীর্ণ মুখ, চোখ দুটি যেন কোথায় তলিয়ে আছে মনের মধ্যে। প্রখর চিন্তা নিপুন শিল্পীর মতো তাঁর মুখটিকে ভেঙ্গে চুরে গড়েছে। অসীম বেদনা, গভীর চিন্তা আর নিবিড় মানব-প্রেমের জোয়ার বয়ে গেছে মুখের উপর দিয়ে। মুখের মাটি ধুয়ে গেছে, মুখ হয়ে গেছে মন এমন মুখশ্রী আমি আর কখনো দেখি নি।

আলাপ সুরু হোলো।

বল্লুম—আপনার শেষ চিঠি পেয়ে আমার মনে হোলো যে আপনার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করলে ভালো হবে, বিশেষ করে যখন শীঘ্রিই ভারতবর্ষে ফিরে যাচ্ছি। তাছাড়া আঁদ্রে জিদ প্রভৃতি ইয়োরোপীয় বন্ধুরা আপনার সঙ্গে দেখা করে আলোচনা করবার জন্যে আমাকে অনুরোধ করেছেন। ডেমোক্রেসির নাম করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে অকথ্য অত্যাচার ভারতবর্ষে চালাচ্ছে, ডেমোক্রেসির অবগুন্ঠন ছিন্ন করে সেই অত্যাচারের নগ্ন রূপ ইয়োরোপের লোকদের কাছে প্রকাশ করে দেবার একান্ত প্রয়োজন আছে।

রোম্যাঁ রোলাঁ—ভারতবর্ষের উত্তর-পাচিম সীমান্তে এই অত্যাচার খুব প্রবল ভাবে চলছে, তাই না?

বল্লুম— সেটা ঠিক, তবে বাঙলা দেশও এই অকল্পনীয় অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। গাঁয়ে গাঁয়ে সৈন্য মোতায়ন রেখে গাঁয়ের লোকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হচ্ছে। আমি কিন্তু শুধু এই অত্যাচারের খবর ইয়োরেপে ছড়িয়ে দেবার কাজে আপনার সাহায্য লাভের আশায় আপনার কাছে আসি নি। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সমর্থক হচ্ছে গান্ধীবাদ। সেই গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইতে আপনার সহযোগিতা কামনা করি।

রোম্যাঁ রোলাঁ—গান্ধীবাদ সম্বন্ধে তোমার মত আমি একেবারেই সমর্থন করি না। গান্ধীর সঙ্গে আমি দীর্ঘ আলোচনা করেছি আর সেই আলোচনার ফলে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে যে গান্ধী মানব-প্রেমের বশবর্তী হোয়ে মূলধনের মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনতে চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু শ্রমিকেরা যখনই নির্যাতিত হয় তখনই তিনি তাদের পক্ষ গ্রহণ করবার জন্যে প্রস্তুত।

বল্লুম—আপনার কথা মানতে পারছিনে। কলওয়ালাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের লড়াইকে সব সময় যতদূর সম্ভব কমজোর করে দেবার চেষ্টাকে মানব-প্রেম বলা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। অবিশ্যি গান্ধীজি যে কখনো মজুরদের স্বপক্ষে দুটো কথাও বলেন নি এ কথা আমি বলছিনে। আমার বলবার কথা হচ্ছে এই যে-মানব- প্রেমের দোহাই দিয়ে কলওয়ালা আর শ্রমিকদের পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্বন্ধে তিনি যা বলে থাকেন তা এই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখবার নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। গান্ধীজির অগুনতি লেখা থেকে উদ্ধৃত করে আমি আপনাকে দেখাতে পারি যে তাঁর মতবাদ আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গোল-টেবিলের বৈঠকে গান্ধীজি এমন পর্যন্ত বল্লেন যে সেই বৈঠকে চাষীদের নিজেদের কোনো লোককে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানোর প্রয়োজন নেই, কেন না বৈঠকে যে সব জমিদারেরা গেছেন তাঁরাই চাষীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন! এটাকে কি ঠিক মানব-প্রেম বলা যায় ?

রোম্যাঁ রোলাঁ—তাঁর যে সব ভারতবর্ষীয় ক্যাপিটালিষ্ট বন্ধুরা আছেন তাদেরই মানদন্ডে গান্ধী ক্যাপিটালিষ্টদের বিচার করেন। গান্ধী মনে করেন যে এই ভারতবর্ষীয় ক্যাপিটালিষ্টরা মানবতার উপাসক ও মজুরদের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপন করতে ইচ্ছুক। গান্ধী আরো মনে করেন যে শ্রেণী-সংঘাত এড়িয়ে গিয়ে, ঐ সংঘাতের পথে না গিয়েও মূলধনের মালিকদের স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থের একটা সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব। এটা তাঁর অন্তরের স্বপ্ন। বাস্তব যদি প্রমাণ করে যে সেটা সম্ভব নয় তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মজুরদের পক্ষ সমর্থন করবেন।

বহুম—বাস্তব কি প্রমাণ করেনি যে সেটা সম্ভব নয়? ভারতবর্ষীয় ক্যাপিটালিষ্টদের মনের চেহারাটা আর মজুরদের উপর তাদের ব্যবহার গান্ধীজির অজানা আছে কি? ক'জন লোক আছে সারা ভারতবর্ষের যারা এবিষয়ে গান্ধীজির চেয়ে বেশী খবর রাখে? তাই বাস্তবতা-বর্জিত এই স্বপ্ন দেখার অধিকার গান্ধীজির আছে কি? আসল কথা হচ্ছে এই যে গান্ধীজি ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা বদল করতে চান না, স্বপ্নটা সেই ইচ্ছারই রূপান্তর। রোম্যাঁ রোলাঁ—আমি এটা একেবারেই বিশ্বাস করি না। গান্ধী সর্বপ্রথমে সব শ্রেণীদের নিয়ে একটা জাতীয় ব্লক (National Bloc) সৃষ্টি করতে চান ইংরেজদের অত্যাচার থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করবার জন্যে। আমার মতে এটা খুবই সঙ্গত ও সমীচীন নীতি। স্বাধীনতা লাভের পর সামাজিক সমস্যা, শ্রেণী-সংঘাতের সমস্যা সমাধান করবার সময় আসবে। আমি গান্ধীর সঙ্গে একমত যে সর্বপ্রথমে সমস্ত শ্রেণীদের নিয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা ব্লক তৈরী করা দরকার।

বল্লুম—জাতীয় ব্লকের ধারণা যেমন ভ্রান্ত তেমনি বিপদজনক। এই ব্লকের নমুনা আমরা আধা-উপনিবেশ চীন দেশে ইতিমধ্যেই পেয়েছি। সেখানকার বুর্জোয়াদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান কুমিংটাঙ্গ যতোদিন চীনের বুর্জোয়াদের স্বার্থের কোনো ক্ষতি হবার আশঙ্কা ছিলো না ততোদিন বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে মজুরকিষাণদের প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিলো, কিন্তু যেই চাষীমজুরেরা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করবার দাবী করলো অমনি জঘন্যতম ত্রাসের দ্বারা তাদের সমস্ত দাবী চূর্ণবিচূর্ণ করতে এতোটুকুও সঙ্কোচ করেনি চীনের বুর্জোয়ারা আর তাদের প্রতিষ্ঠান কুমিংটাঙ্গ। চীনদেশের হাজার হাজার তরুণ এই ত্রাসের যূপকাষ্ঠে বলি হোলো। পুরো-উপনিবেশ ভারতবর্ষে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে যদি বিপ্লবের দ্বারা আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকল আর ভারতবর্ষের ক্যাপিটালিষ্ট সমাজ-ব্যবস্থাকে একই সঙ্গে ভেঙ্গে দিতে না পারি। ভারতবর্ষের বুর্জোয়াদের একেবারে ঘুমন্ত মনে করলে ভুল করা হবে। তারা বেশ বুঝতে পারছে যে, যে-বিপ্লব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করবে সে বিপ্লব তাদেরও ধ্বংস করবে, তাই বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীর মতো তারা বুঝেছে যে একেবারে সব মুনাফা খোওয়ানোর চেয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষ করে মুনাফার বখরা নেওয়া অনেক ভালো। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই কলওয়ালা-জমিদারের দল সব সময়ে বাধা দিয়ে এসেছে, সব সময়ে তারা ব্রিটিশের পক্ষ নিয়েছে। কংগ্রেস কিম্বা গান্ধীজি এদের বিরুদ্ধে কিন্তু কখনো কোনো অভিযান করেন নি। সব শ্রেণী মিলিয়ে জাতীয় ব্লক তৈরী করার অর্থ হচ্ছে জাতীয় সংহতির নাম করে জনগণকে কলওয়ালা আর জমিদারদের পায়ে বলি দেওয়া।

রোম্যাঁ রোলাঁ—এই লড়াইতে একটি জিনিস আছে যা গান্ধী কখনো ত্যাগ করবেন না,সেটি হচ্ছে অহিংসা। তিনি বলেন—“যদি তোমরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অহিংসা ছাড়া অন্য অস্ত্র ব্যবহার করতে চাও তো করো, আমি সরে যাচ্ছি। আমি কিছুতেই তাতে সাহায্য করতে পরবো না।” আমি এই 'অহিংসা' শব্দ পছন্দ করি না। এর বদলে অস্বীকৃতি শব্দটি ব্যবহার করলে ভালো হয়। শক্তির প্রয়োগ জীবনে সর্বত্র। আমরা এই বর্বর শক্তিকে আত্মার সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেবো। গান্ধীর তথাকথিত অহিংস' হচ্ছে বীরত্বপূর্ণ এই অস্বীকৃতির চরম নিদর্শন। এই অস্বীকৃতির মহান প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা আজ যেমন, এমন আর কখনো ছিলো কিনা সন্দেহ। এই পশুশক্তির জয়গান করছেন স্পেঙ্গলার। যা কিছু মানবতার পরিচায়ক বলে আমরা মনে করি সে সব তিনি বিদ্রূপ করছেন, তিনি নিষ্ঠুরতার স্তবগান করছেন। গান্ধী হচ্ছেন মানবতার শেষ রক্ষক। যদি এই আশা ধূলিসাৎ হয় তাহলে হিংস্র সংঘাত জীবনকে কলুষিত করবে।

বল্লুম—গান্ধীজি যাকে অহিংসা বলেন সে অহিংসা আমি স্বীকার করি না। গান্ধীজি শ্রেণী-বিভাগ ও বর্ণ-বিভাগ সমর্থন করেন। এই সমর্থনকে কি অহিংসা বলা চলে? হিংসার প্রকৃত মূল সামাজিক জীবনে কোথায় সেটা গান্ধীজি আমাদের দেখাতে পারেন নি। এমন কি ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থাকেও তিনি হিংসাত্মক বলে মনে করেন না। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩০ সালে ইয়োরোপে আসেন তখন হিংসা অহিংসার সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করি। এ বিষয়ে তিনি লিখবেন বলেছিলেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছু লেখেননি। অহিংসা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মতামত গান্ধীজির ধারণার মতই অসম্পূর্ণ, কেননা দুজনেই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। রবীন্দ্রনাথ অন্তত সমস্যাটি সম্বন্ধে সচেতন, গান্ধীজি সমস্যাটিকে দেখেনই না।

রোম্যাঁ রোলাঁ—রবীন্দ্রনাথ যেটা ধী-শক্তির আলোকে প্রত্যক্ষ করেন, জনসাধারণের অন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম গান্ধীর সহজ-বুদ্ধি (Instinct ) তাঁর কাছে সেটা প্রকাশ করে। লেনিনকে আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমার মতে গান্ধী হচ্ছেন তাঁর নিজের দেশের ও পৃথিবীর জনগণের হৃদয়বান সেবক। লালা লজপৎ রায় আমাকে বলেছিলেন যে অহিংস অসহযোগ হচ্ছে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সর্বোত্তম অস্ত্র। ভারতবর্ষের লোকেরা যদি অস্ত্র ব্যবহার করতো (যেটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা মনে প্রাণে চায়) তাহলে সেই অছিলায় সাম্রাজ্যবাদীরা যে অত্যাচার চালাতো তার তুলনায় যে নিপীড়ন ভারতবর্ষ আজ ভোগ করছে তা কিছুই নয়। তাছাড়া একটা সমগ্র জাতির অহিংসা অসহযোগ যে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই ইংলন্ডকে কাবু করবে তা নয়, ব্রিটিশ শাসকদের চিত্তবৃত্তির উপর প্রভাব বিস্তার করার এটা হলো একমাত্র পন্থা। ভারতবর্ষ যে স্বাধীনতা দাবী করছে সে সম্বন্ধে ব্রিটিশ শাসকদের অনুকূল মনোভাব তৈরী একমাত্র এই অহিংস অসহযোগই করতে পারে।

বল্লুম—অহিংসাকে দুদিক থেকে বিচার করা যায়---রাজনৈতিক লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে আর তার নিজস্ব মূল্যের দিক থেকে। কৌশলের দিক থেকে বলা যেতে পারে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবার শক্তি বর্তমানে আমাদের নেই। এই জন্যে বর্তমানে অহিংসাকে লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তাই বলে অহিংসার দ্বারা আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হৃদয় পরিবর্তন করে দিতে পারবো, তাদের হৃদয় গলিয়ে দিতে পারবো, এ অর্থহীন খেয়াল আমি পোষণ করি না। সমস্ত পৃথিবীর ঘটনার চাপে, পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক শক্তিগুলির ঘাতপ্রতিঘাতের ফলে সাম্রাজ্যবাদীরা মুঠো শিথিল করতে বাধ্য হবে। অহিংসার আবেদনে সাম্রাজ্যবাদের হৃদয় কখনো বদল হবে না, সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করতে হবে।

রোম্যাঁ রোলাঁ—দুটি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অন্তবর্তী এতো অল্প সময়ের মধ্যে শাসকদের ও দেশের লোকদের হৃদয় পরিবর্তন হোয়ে যাবে এটা আশা করা কি যুক্তিসঙ্গত? তবে হৃদয় পরিবর্তনের সম্ভবনার আশা করা যেতে পারে, বিশেষ করে গ্রেট বৃটেনের দিক থেকে সমস্যাটির বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে তাকে একটি বিরাট জাতির সাধারণ ধর্মঘটের সম্মুখীন হোতে হবে। তোমার দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি না, কিন্তু ইয়োরোপের সামনে আজ যে সব গুরুতর সমস্যা উপস্থিত সেগুলোর বিচার করে দেখতে পারি। এখানে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার পক্ষে হিংসার ও অহিংসার সম্মিলিত শক্তিও আমি যথেষ্ট বলে মনে করি না। ১৯৩২ সালের আগষ্ট মাসে আষ্টারডামে আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে বারবুস্ আর আমি সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিজম্ বিরোধী সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করতে চেষ্টা করেছিলুম। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধে যুদ্ধ-বিরোধকারীদের ও অহিংস অসহযোগীদের সহযোগিতার উপর আমি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করি। এরা তাদের নিজ নিজ দেশের ফ্যাসিষ্ট গভর্মেন্টকে বলবে—“তোমরা যা খুসি তাই করতে পারো, আমরা তোমাদের হুকুম মানবো না।” ইয়োরোপের বেশীর ভাগ দেশে মজুরদের শক্তির চেয়ে ফ্যাসিষ্টদের শক্তি অনেক বেশী। ফ্যাসিজম্ বিরোধী শক্তিকে আমরা যেন ভাগ করে না ফেলি। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা অংশ হচ্ছে অহিংসা, আর ইয়োরোপের মজুরদের জন্যে এতে যথেষ্ট আশার কথা আছে।

বল্লুম—ঠিক সময়ে তাদের সমস্ত শক্তি বিপ্লবের কাজে না লাগিয়ে ইয়োরোপের মজুর শ্রেণী খুব ভুল করেছে।

রোম্যাঁ রোলাঁ—১৯১৪-১৯১৮ সালের বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ফলে যে অপরিসীম ক্লান্তি ও অবসাদ এসেছে সেটা ভুলে যেও না। ইয়োরোপের সমস্ত দেশের লোকেরা দৈহিক ও নৈতিক রক্তপাত করে নিবীর্য হোয়ে পড়েছে। তারা যে শক্তি প্রয়োগ করেনি তার কারণ এই নয় যে আদর্শের উপর তাদের নিষ্ঠা ছিলো না, নিছক ক্লান্তি বশত তারা লড়াই করতে পারেনি।

বল্লুম—হিংসাকে এড়িয়ে যাবার জন্যে যে শ্রমিকেরা ঠিক সময়ে শক্তি ব্যবহার করেনি তাতো আদবেই নয়, কারণটি বরং ঠিক তার বিপরীত। সোশালিষ্ট নেতাদের মধ্যে আদর্শগত নিষ্ঠার অভাবের জন্যেই এটা ঘটেছে। এরই অভাবের দরুণ ইয়োরোপে ফ্যাসিজম্ প্রসার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। তা ছাড়া যা সমষ্টির ন্যায্য অধিকার তা ফিরে নেবার জন্যে সমষ্টি যখন শক্তি প্রয়োগ করে তখন সে শক্তিপ্রয়োগকে হিংসা বলতে আমি রাজী নই, শক্তির সেটা নৈতিক প্রয়োগ। যে ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমষ্টিকে বঞ্চিত করে তার অধিকার থেকে সেই ক্ষেত্রেই শক্তি হিংসার রূপ গ্রহণ করে।

শ্রীমতি রোলাঁ—অস্পৃশ্যতা-সমস্যার সমাধানে গান্ধীজির মহান প্রচেষ্টা সম্বন্ধে আপনার মত কি?

বল্লুম—অস্পৃশ্যদের অবস্থার উন্নতীকরণে গান্ধীজির প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই, তবু বলতেই হবে যে বর্ণাশ্রম প্রথাকে স্বীকার করে নিয়ে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করার খুব বেশী সার্থকতা নেই। বর্ণাশ্রম প্রথাই অস্পৃশ্যতার নামান্তর। গান্ধীজি হিন্দুসমাজের এই চতুবর্ণ বিভাগকে চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে করেন।

শ্রীমতী রোলাঁ—অস্পৃশ্যতার অবস্থা অন্য সব বর্ণের অবস্থার থেকে খারাপ নয় কি? বল্লুম—সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কিন্তু সে অবস্থার যথার্থ পরিবর্তন বিপ্লবের পরেই করা সম্ভব। হাজার হাজার মন্দিরের মধ্যে মাত্র কয়েকটি মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে হরিজনদের প্রবেশের জন্যে। এই মতো ঢিমে তেতালা ভাবে চললে শতাব্দী কেটে যাবে এই সমস্যার সমাধান করতে। তা ছাড়া মন্দিরে প্রবেশ করতে পারলেই যে অস্পৃশ্যরা সামাজিক অধিকার লাভ করবে তা' আদবেই নয়। তাই বলেছিলুম যে এ সমস্যার সমাধান বিপ্লবের পরেই হওয়া সম্ভব, আগে নয়। রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখছি যে এমন কি বিপ্লবের পরেও জনসাধারণের মন থেকে কুসংস্কার দূর করা কতো শক্ত। শ্রীমতী রোলাঁ—আপনার কথা থেকে তো বুঝলুম যে ভারতবর্ষে বিপ্লব আসতে এখনো অনেক দেরী।

বল্লুন—আমার ধারণা তাই। শুধু ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উপর নয়, পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভারতবর্ষের বিপ্লব নির্ভর করে। তার জন্যে বহুদিনের প্রস্তুতিও প্রয়োজন। কিন্তু যত শীঘ্রি সম্ভব এই প্রস্তুতির আরম্ভ করা দরকার।

সে দিন বিকেলে আমাদের আলোচনা এই পর্যন্ত হলো। রোম্যাঁ রোলাঁ পেছনের বাড়ী থেকে আমাকে নিয়ে এলেন সামনের বাড়ীতে। এই সামনের বাড়ীতেই তিনি থাকেন। আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। ছোট্ট বসবার ঘরটি, পিয়ানো আর দুচারটি আসবাবে ঘরটি খুবই সাধাসিধে ভাবে সাজানো। গান্ধীজি যখন ভিন্যভে গিয়েছিলেন তখন এই ঘরে বসেই তাঁদের আলোচনা হয়। সেই সময়কার তোলা একটি ছবি টেবিলে রাখা রয়েছে। পিয়ানোর ধারে একটি চৌকিতে রোম্যাঁ রোলাঁ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসেছিলেন। রোলাঁর স্ত্রী রুশীয় মহিলা তাঁর সঙ্গে আলাপ করছিলুম রাশিয়া সম্বন্ধে। রোম্যাঁ রোলাঁও মধ্যে মধ্যে আমাদের আলাপে যোগদান করছিলেন। সন্ধ্যে হোয়ে এলো, আমি বিদায় নিলুম।

পরদিন প্যারিসে ফিরে যাবো তাই সকালে রোম্যাঁ রোলাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। সামনের বাড়ীতে রোলাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো, তিনি আমাকে দোতালায় রোম্যাঁ রোলাঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। কাঁচের সার্সি দেওয়া বড়ো বড়ো জানালা দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঘরে তিনটি ছবি টাঙ্গানো রয়েছে—গান্ধীজির রবীন্দ্রনাথের আর গর্কির। বিছানার ধারে হেলান-চৌকিতে রোম্যাঁ রোলাঁ বসে ছিলেন। রোলাঁ-পত্নী বল্লেন, সকাল থেকে রোম্যা বসে আছেন আপনার অপেক্ষায় চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে, এতো দেরী যে আপনার ?

লজ্জিত হলুম, তিনি যে আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন এটা মনে করিনি। চা পানের পর রোল্যা-পত্নী চলে গেলেন। আমাদের কথাবার্তা সুরু হোলো।

বল্লুম—আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি। আমি আপনাকে বলে যেতে চাই যে আমাদের লড়াই কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নয়। দুটি ভিন্নমুখীন আদর্শের মধ্যে লড়াই বেধেছে—শ্রেণী-বিভক্ত সমাজ ও সেই সমাজের ভিত্তিতে রচিত সভ্যতা থাকবে না, শ্রেণীভেদলুপ্ত মানবসমাজের প্রতিষ্ঠা হবে, নতুন সভ্যতা বিকশিত হবে, এই হোলো প্রশ্ন, এই হোলো এই যুগের সমস্যা। এই সমস্যার দিক থেকে বিচার করে দেখলে আমরা দেখতে পাবো যে গান্ধীবাদ আর কমিউনিজম পরস্পর-বিরোধী। কমিউনিজমের পথ ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের আর অন্য কোনো পথ নেই। আমাদের এই কাজে আপনার সহযোগিতা কামনা করি।

রোম্যাঁ রোলাঁ—আমি মনে করি না যে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থায় গান্ধীবাদ আর কমিউনিজম্ স্বভাবতই পরস্পর-বিরোধী। আমার মতে এই দুই মতবাদ মিলতে পারে ও তাদের মেলা উচিত। অবিশ্যি সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন শ্রম ও মূলধনের সম্বন্ধের পারস্পরিক সমস্যার সমাধানে গান্ধীকে বাধ্য হোতে হবে পরিষ্কার করে জানাতে যে তিনি কলওয়ালাদের পক্ষে না শ্রমিকদের পক্ষে। তখন আমাদের সময় আসবে গান্ধীবাদ অথবা কমিউনিজম্ এই দুয়ের মধ্যে কোনটাকে গ্রহণ করবো, কোনটাকে বর্জন করবো সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করবার।

বল্লুম—আমরা সে বাছাই অনেকদিন আগেই করে নিয়েছি। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে নতুন সম্বন্ধ রচনা করবার স্বপ্ন আমরা দেখি, যে স্বপ্ন বাস্তব করে তোলবার জন্যে আমরা কাজ করি, সেটা কমিউনিজমের পথ ছাড়া অন্য পথে পাওয়া অসম্ভব বলে মনে করি।

রোম্যাঁ রোলাঁ—গান্ধী সংস্কারের আধ্যাত্মিক শক্তিতে বিশ্বাসবান কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি অতীত আঁকড়িয়ে বসে নেই। তিনি সর্বদাই চলেছেন আর তাঁর চিন্তা কথা ও কাজের মধ্যে বিন্দুমাত্র অসামঞ্জস্য নেই।

বল্লুম—সে তো ইয়োরোপের অনেক রাজনৈতিক নেতা সম্বন্ধে বলা যেতে পারে, এমন কি মুসোলিনী সম্বন্ধেও।

রোম্যাঁ রোলাঁ—(আবেগের সঙ্গে) মুসোলিনীর আর গান্ধীর নাম একসঙ্গে উচ্চারণ কোরো না। মুসোলিনী নিজেকে ছাড়া আর কিছু জানে না। তার প্রত্যেকটি কাজ শুধু তার উচ্চাকাঙ্খা ও দম্ভের পরিচয় দেয়। এমন কি হিটলার যে মুসোলিনীর চেয়ে বুদ্ধিতে অনেক খাটো, সেও মুসোলিনীর চেয়ে এ বিষয়ে অনেক বেশী খাঁটি।

বল্লুম—আপনি বোধ হয় জানেন না যে বর্তমানে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র গুলি বিশেষ করে বাঙ্গলাদেশের কাগজগুলি হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই কাগজগুলি হিটলারকে জার্মানীর ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দন জানিয়েছে।

রোম্যাঁ রোলাঁ—হাঁ, আমি জানি যে তরুণ ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে, বিশেষ করে বাঙ্গলা দেশের তরুণদের মধ্যে মুসোলিনীর খুব খাতির। আমি অনেকবার এই অনুরাগের প্রতিবাদ করেছি।

বল্লুম—ভারতবর্ষীয় জাতীয়তাবাদও একদিন এই ফ্যসিজমের রূপ গ্রহণ করবে যদি না যথাসময়ে সফল বিপ্লব তাকে বাধা দেয়।

রোমা রোলাঁ—গান্ধীবাদ আর কমিউনিজম্ দুয়েরই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের তরুণদের আবেদন জানিয়ে একটা লেখা তোমার হাতে দেবো, সেটা তুমি মোর দেশের তরুণদের হাতে পৌঁছে দিও। গান্ধী সম্বন্ধে আমি তোমাকে বলতে পারি যে আমি তাঁর অনুরক্ত। এই যুগের কোন মানুষকে আমি এতো শ্রদ্ধা করি না যেমন করি তাঁকে। কিন্তু তবুও যদি তিনি ভবিষ্যতে মূলধনের মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের লড়াইয়ে খোলাখুলি ভাবে শ্রমিকদের পক্ষ না নেন, আর আমার বিশ্বাস যে তিনি সেটা করবেন, তাহোলে তখন আমার সময় আসবে তাঁর কাছ থেকে সরে যাবার। কেন না যাই ঘটুক না কেন, শ্রমিকদের পক্ষে আমি এখনও আছি আর ভবিষ্যতেও থাকবো।

বল্লুম—আপনার এই কথা আমার মনে আশা জাগাচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতেই আমরা আপনার পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করবো আমাদের কাজে।

বিদায়ের সময় হোলো। সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। এখনো চোখে ভাসছে হলদে রঙের দীর্ঘ ড্রেসিং গাউনে পা পর্যন্ত ঢাকা, দীর্ঘ ঋজু শরীর, হাত তুলে আমাকে বিদায় দিচ্ছেন, মুখ প্রশান্ত হাসিতে উজ্জ্বল।

Post a Comment

0 Comments