Ticker

6/recent/ticker-posts

রবীন্দ্রকালীন কয়েকজন কবি - ড. তারকনাথ ঘোষ | বইয়ের খবর

রবীন্দ্রকালীন কয়েকজন কবি - ড. তারকনাথ ঘোষ

ঊনবিংশ শতাব্দী : রবীন্দ্রনাথ

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে যে সব কবি জন্মেছিলেন, তাঁরা যখন কাব্যচর্চা শুরু করেছেন তখন একটা গোটা শতাব্দীর সাধনার ফলকে তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাভূমিরূপে পেয়েছিলেন। ওই সাধনার রূপ অতি বিচিত্র সন্দেহ নেই। তবুও ওই সাধনার পরিচয় সম্পর্কে একটি কথা বলা যায় যে পাশ্চাত্য জগতের জ্ঞান সাধনরীতির আলোকে ভারতবর্ষের চিরন্তন ভাবসম্পদের পুনরাবিষ্কারের প্রয়াস বা বাসনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পুরুষদের অন্তরে যে আলোড়ন এনেছিল তার তরঙ্গই সারা ভারতবর্ষের নব্য ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনকে বেগবান করে তুলেছিল। বাংলাদেশে ওই তরঙ্গবেগ এত প্রবল হয়ে বাঙালির জীবনসাধনাকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছিল যে বাংলায় ওই নব্য ভাবপ্রবাহের প্রেরণায় রেনেসাঁস অর্থাৎ জাতীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলে সংস্কৃতির ইতিহাসবেত্তারা নির্দেশ করে থাকেন। ওই অভ্যুদয় অবশ্যই সর্বাঙ্গীন হয়নি, কারণ প্রধানত ইংরেজি- শিক্ষিত সমাজই এই ভাবময় উজ্জীবনের অঙ্গীভূত আর ফলভূক ছিল—সাধারণ মানুষের জীবনে প্রথমত ওই নব্য সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়নি। কালচক্রের আবর্তনে, বিশেষত ঐ ভাবপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত সাহিত্যে সৃষ্টির অভাবিত প্রাচুর্যে ওই জীবনসাধনা আর তার আদর্শ বা ফলপরিণাম ধীর স্থির গতিতে জাতির ভাবলোকে একটি সংস্কাররূপে সঞ্চারিত হয়েছে।

যে বিচিত্র উপাদানে ঊনবিংশ শতাব্দীর সাধনা বিভিন্ন মনীষীর জীবনকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে তার সংক্ষিপ্ত দিগ্‌দর্শন অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ওই সাধনা ভারতীয় সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে—ঊনবিংশ শতকের মনীষীরা সকলেই প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে ভারতপথিক ছিলেন, কিন্তু তাঁদের সাধনায় পাশ্চাত্যের যে ভাবনা বা সংস্কৃতির ধারা এসে মিশে এক অভিনব শক্তি সঞ্চার করেছে তার পরিচয় গ্রহণেরও প্রয়োজন আছে। বাস্তবিক পক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস ভাবসম্মেলনের বৃত্তান্ত।

এই মিলনযজ্ঞের প্রথম হোতা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। রামমোহন প্রথমে ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে গভীর সংযোগস্থাপন করেছিলেন, তারপর মধ্যযুগের আরব, পারস্য ও আধুনিকযুগের ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হতে অগ্রসর হয়েছিলেন। জাতীয় সংস্কৃতির যথার্থ মূল্য আর মর্যাদাবোধ থাকায় তিনি পশ্চিমের জ্ঞানচর্চার তীব্র রশ্মিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েননি। কিন্তু ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা এ দেশে প্রবর্তন করার প্রয়োজন যে আছে তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এ দেশে পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষাদানের উদ্যোগ যাঁরা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রামমোহনই অগ্রণী ছিলেন। পশ্চিমের যুক্তিশীলতা আর বিজ্ঞানপাঠ মার্জিত চেতনা দিয়ে তিনি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির যথার্থ মূল্য উদ্‌ঘাটনে ব্রতী হয়েছিলেন—বিশেষত ধর্মসাধনা আর সমাজবিধির আলোচনা আর অকল্যাণপ্রসূ লোকাচারের অপসারণ-প্রয়াসে তাঁর শেষ জীবন সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত হয়েছিল। জ্ঞাননিষ্ঠ প্রাণবান পুরুষের জীবনসাধনাই ঊনবিংশ শতাব্দীর অভ্যুদয়ের মূলগত প্রেরণারূপে কার্যকরী হয়েছে—যা বাঙলায় রেনেসাঁসের সূচনা করেছিল।

রামমোহনের জীবনাদর্শ আত্মীয়সভা, ব্রহ্মসভা বা সংস্কারপ্রার্থী ব্রাহ্মসমাজের চিন্তাধারা আর কার্যসূচির মধ্য দিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারই থেকে কালক্রমে বিবর্তিত হয় একেশ্বরবাদী ও নিরাকারপন্থী ব্রাহ্মধর্ম। তাঁরই উদ্যোগে সতীদাহ নামে বিধবাবিনাশ বন্ধ হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে কোন প্রেরণায় একযোগে বিদ্যাসত্র আর করুণাসত্রের নিরন্তর আয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র-প্রমুখ যুগনায়কের বুদ্ধিমার্জিত জীবনচিন্তার মূলে রামমোহনের আদর্শের অলক্ষ্য ক্রিয়া অনুমান করা যায়; অবশ্য মত ও পথের দিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্র ভিন্নতর আদর্শের অনুগামী ছিলেন। রামমোহন জ্ঞাননিকষে সুপরীক্ষিত জীবনচর্যায় বিশ্বাসী ছিলেন—তাঁর সত্যসন্ধানী জ্ঞানদৃষ্টিতে স্বদেশ এবং বিদেশের বিভেদ ছিল না;ভারতবর্ষে জন্মেছিলেন বলেই তিনি ঔপনিষদিক ব্ৰহ্মবাদ বা বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অপরপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র-প্রমুখ মনীষীর ভাবনায় হিন্দুধর্মের হিন্দুত্বের মূল্য ছিল অপরিসীম। রামমোহনের আত্মমর্যাদাবোধ একটা সূক্ষ্ম আত্মাভিমানের রূপ নিয়েছে। কিন্তু এর ফল ক্ষতিকর হয়নি;বরং ওই অভিমানই প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সন্ধান আর নবকালের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যানে উৎসাহিত করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর নতুন ভাবজীবনের গড়নের পক্ষে ওই খাদটুকুর দরকার ছিল।

রামমোহন যেমন মননময় জীবনে যুগান্তর এনেছিলেন, সাহিত্যের জগতে তেমনই যুগান্তর আনলেন মধুসূদন। রামমোহনের অভ্যুদয়কে ঐতিহাসিক কার্যকারণসূত্রে গ্রথিত করা যায়; কিন্তু মধুসূদনের আবির্ভাব একেবারেই আকস্মিক অবশ্য ইংরেজি সাহিত্যের সাধনালভ্য যশঃপ্রয়াসী মধুসূদনের ব্যর্থতা আর বাংলা সাহিত্যের সাধনায় মনোনিবেশ ইতিহাসবিধাতার অদৃশ্য অঙ্গুলীসংকেত বলে নিদর্শন করা যায়। মধুসূদন যে পরিমাণ পাশ্চাত্য সাহিত্যের অনুশীলন করেছিলেন তা অভাবনীয়; সংস্কৃত কাব্য বা নাট্যসাহিত্যের যে পরিমাণ অধ্যয়ন তিনি করেছিলেন তা অধ্যাপকমণ্ডলীরও আদর্শস্থানীয়। তিনি যে সাহিত্য সৃষ্টি করলেন তার প্রথম পর্যায়ের রচনাগুলি বারো আনাই গ্রীক বা ইউরোপীয় ভাবাদর্শে জারিত;কিন্তু তাঁর রচনায় যে ধীরে ধীরে ভারতীয় মানসের পরিচয় স্ফুটতর হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যজীবন বিশ্লেষণ করলে তা অনুধাবন বা অনুভব করা কঠিন হয় না।

মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে যে যুগান্তর আনলেন তার মূল বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ এক কথায় বলতে গেলে বলা যায় যে তিনি বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের, বিশেষ করে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের আকুতি, রস আর রুচিগত আদর্শ সঞ্চার করলেন। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের প্রভাব গভীর নয়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিপ্রয়াসের দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যকে এক অভিনব প্রাণরসে সঞ্জীবিত করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে রমেশচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র এমনকি বিহারীলাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সাহিত্যিকই ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কাব্যের ক্ষেত্রে মধুসূদন ক্লাসিক সাহিত্যের বৈভবে মুগ্ধ হয়ে ওই পদ্ধতিরই প্রবর্তন করেছিলেন—দুটি কাব্যে মুখ্যত লিরিক সুর সংযোজন করেছেন মাত্র। ইংরেজিনবীশ অন্য সাহিত্যসেবীরা রোমান্স বা রোমান্টিক কাব্য আর লিরিক কবিতা প্রচুর পরিমাণে পড়েছেন আর সেই আদর্শে সাহিত্যসৃষ্টি করতে আগ্রহশীল হয়েছেন। মধুসূদন আর বঙ্কিমচন্দ্র এই দুই যুগপ্রবর্তকের রচনাদর্শই প্রথমত অনুসৃত হয়েছে—একে ইংরেজি সাহিত্যের সেকালের দুই দিকপাল মিলটন আর স্কটের ধারানুসরণ বলা অসংগত হবে না। কিন্তু পরে সাহিত্যানুরাগীরা ক্লাসিক রীতির চেয়ে রোমান্টিক রীতির কবিদের রচনায় আরও বেশি করে মুগ্ধ হয়েছেন। শেলী, কী, ওয়ার্ডওয়ার্থ, বায়রন প্রভৃতির রচনায় লিরিক সুরে যে রোমান্টিক ভাবব্যাকুলতা মূর্ত হয়ে উঠেছে পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে সেইটাই কাব্যরচনার আদর্শ হয়ে উঠেছে। কাব্যামোদী মহলে এই রচনাদর্শ এত প্রিয় ছিল যে রোমান্টিক গীতিকবিতা রচনায় দক্ষতার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে ‘বাংলার শেলী' আখ্যা পেয়েছিলেন। নবীনচন্দ্রের ‘বাংলার বায়রন' আখ্যাও উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের লেখকরা যদি কেবল ইউরোপের সাহিত্যের মুখ চেয়েই থাকতেন তাহলে বাংলার সাহিত্য বা সংস্কৃতি ওই স্বল্পকালের মধ্যে প্রাণময় বা পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত না। মধুসূদনের পরে যাঁরাই সাহিত্য বা সংস্কৃতির চর্চা করেছেন তাঁরা সকলেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি ভারতসংস্কৃতির অজস্র সম্পদ পুনরাবিষ্কারে উদ্যোগী হয়েছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যেমন যুগ প্রয়োজন সিদ্ধ করবার জন্য সর্বধর্ম-সমন্বয়ের আদর্শটি স্থাপনা করেছিলেন, তেমনই সেকালের মনীষীরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বিভিন্ন ভাব, ভাবনা আর রসরুচির সমন্বয়সাধনে ব্রতী হয়ে সাংস্কৃতিক সর্বোদয় ঘটিয়েছেন।

এই সমন্বয় আর সর্বোদয়ের কিছুটা পরিচয় নেওয়া যেতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের আদর্শ আদিতে স্কটের রোমান্স হলেও ক্রমে তাঁর উপন্যাস যখন তত্ত্ববাহী হয়ে উঠেছে তখন তিনি তার মধ্য দিয়ে গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শ বা বিষয়ভোগের পরিণামের তত্ত্ব সন্নিবেশ করেছেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ফলশ্রুতি নব্য মানবতাবাদ, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আদর্শ, হিতবাদ বা অপর কোনো আদর্শ তাঁর বা তাঁর সমকালের অন্য মনীষীদের চিত্তে অবশ্যই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু তাঁরা নির্বিচারে ওই সব মতবাদ গ্রহণ করেননি। বঙ্কিমচন্দ্র বা অনেকেই ভারতীয় সাহিত্যে অনুরূপ আদর্শের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন; বিশেষত গীতায় তত্ত্বচিন্তার যে সুবিপুল আয়োজন আছে তা তাঁদের বিচিত্র ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। মধুসূদনের পর হেমচন্দ্র-প্রমুখ দু-একজন কবি মহাকাব্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন বটে কিন্তু বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের আদর্শ চলেনি। তবে ইউরোপের মহাকাব্য বা ইতিহাস অধ্যয়নের ফলে স্বাদেশিকতা অর্থাৎ দেশপ্রেম আর বীরত্বের আদর্শ এই তৎকালে পরাধীন দেশের ভাবুকদের চিত্তবিস্কার ঘটিয়েছিল; বিশেষত টডের রাজস্থানবৃত্তান্তে রাজপুতদের শৌর্যবীর্যের যে ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি পরিবেশিত হয়েছিল তার সঙ্গে পরিচয় ওই দেশপ্রেমকে আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রবল করে তুলেছিল। নবীনচন্দ্রের কাব্যে সেকালের ইংরেজিশিক্ষিত সমাজের ভাবনার আবেগময় প্রকাশ অনুভব করা যায়।

বিশুদ্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও শেক্সপিয়র প্রমুখ পাশ্চাত্য কবির রচনার সঙ্গে সঙ্গে কালিদাস প্রমুখ সংস্কৃত কবিদের রচনার অধ্যয়ন চলেছে। তবে ক্লাসিক রীতির চেয়ে রোমান্টিক রীতির কাব্যের অনুশীলন যেমন ব্যাপক হয়েছে, তেমনই প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যপাঠের চেয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের ফলে অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলী এর আগে দেবলীলার অঙ্গরূপেই কল্পিত হত। অষ্টাদশ শতকের অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজের রুচিবিকারের ফলে বৈষ্ণব কাব্য এমন একটি স্তরে এসে পৌঁছেছিল যে ঊনবিংশ শতকের ইংরেজি শিক্ষিত সমাজ প্রথমে এটির দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিই নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যের অনুরাগী রসিকরা বৈষ্ণব পদাবলীর রসবৈভব নতুন করে আবিষ্কার করলেন। যা লোকায়ত দৃষ্টিতে দেবলীলার বর্ণনা বা সাধকের কাছে আধ্যাত্মিক আকুতির প্রতীক ছিল কাব্যরসিকের কাছে তা চিরন্তন মানবীয় প্রেমের রূপময় রসগর্ভ কাব্যের স্বাদ নিয়ে এসেছে। ইংরেজি রোমান্টিক কাব্য আর বৈষ্ণব পদাবলীর মিলিত রসাবেদন বাংলা লিরিক কবিতার ঘুম ভাঙিয়েছে। এর ফলে বাংলা কবিতা তিরিশ চল্লিশ বছরে দু-তিন শতাব্দীর সৃষ্টির অজস্রতায় ভরে গেছে। ওই নবজাগ্রত রসদৃষ্টি ক্লাসিক সাহিত্যের মধ্যে রোমান্টিক ভাবনার অবকাশ খুঁজে পাওয়ায় ভাবের দিক থেকেও যেমন উপাদানের দিক দিয়েও তেমনই অফুরন্ত সম্পদের সন্ধান পাওয়া সৃজনোৎসুক কবিকুলের পক্ষে কঠিন হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর এই সংস্কৃতির সাধনা রবীন্দ্রনাথে এসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন ভাবোচ্ছ্বাসময় গীতিকবিতা রচনার পন্থা অবলম্বন করে—বিহারীলালই ছিলেন তাঁর কৈশোরের আদর্শ। এই লিরিক কাব্যপ্রয়াস ইংরেজি রোমান্টিক কাব্য আর বৈষ্ণব পদাবলীর চর্চার ফলে পরিশীলিত রূপ নিয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীর রসগভীরতা তাঁর রোমান্টিক রূপপিপাসাকে নিবিড় সৌন্দর্য চেতনায় পরিণত করেছে; আবার ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যের মর্মগত আকুতি তাঁর অধ্যাত্মপিপাসাকে অনুপম কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছে। 'সোনার তরী’, চিত্রা, চৈতালি, গীতাঞ্জলি এই দ্বিধারার মিলনের আশ্চর্য ফল। সংস্কৃত ক্লাসিক সাহিত্যের অধ্যয়ন প্রভূত উপাদানযোগে তাঁর ভাবব্যাকুল কবিচিত্তকে সংহত করে বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাব্য রচনায় প্রোৎসাহিত করেছে। পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্যের ফলে অপিচ আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে গভীর সংযোগ থাকায় ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ বিশেষত ব্রহ্মের আনন্দস্বরূপের অনুধ্যান রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মপিপাসাকে যেমন একটা জীবননির্ভর অথচ বাস্তবাতিশায়ী চেতনায় প্লাবিত করেছে, তেমনই তাঁর সমগ্র সাহিত্য সাধনাকে একটা সুদৃঢ় প্রত্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্বিষ্ট এবং অভিনিবিষ্ট পাঠকের কাছে রবীন্দ্রসাহিত্য সংস্কৃতিসাধনায় এইসব বিচিত্র উপাদান আর প্রৈতির সমন্বিত ভাবরূপ অগোচর থাকে না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে যাঁরা জন্ম নিয়েছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়েই বঙ্গসংস্কৃতি বা ভারতসংস্কৃতির রসগ্রহণ করেছেন। এ পর্যন্ত যেসব সাহিত্য বা সংস্কৃতিমূলক ভাবধারার উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি ছাড়া আর একটি ভাবাদর্শ বাংলা দেশকে বা সমগ্র ভারতবর্ষকেও অনুপ্রাণিত করেছিল; সেটির মূলে ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অধ্যাত্মশক্তিময় পরমাশ্চর্য জীবনসাধনা। কিন্তু সাহিত্যের সাধনার ক্ষেত্রে ‘গীতাঞ্জলি’-‘গোরা’-‘গল্পগুচ্ছ' পর্যন্ত রবীন্দ্রসাহিত্যে যে ভাবমণ্ডল বা রচনাদর্শ প্রকাশিত হয়েছে সেই সাহিত্যসংস্কারই এই শতাব্দীর প্রথম সাহিত্যশিল্পীরা বিশেষত কাব্যসাধকরা পেয়েছিলেন। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য বা সংস্কৃতির সাধনার যে ফলপরিমাণ অমিত প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁরা সেটিকে পূর্বসূরিলব্ধ রিক্থরূপে অর্থাৎ সহজাগত ঐতিহ্যের দানরূপে পেয়েছিলেন। সুতরাং যেসব কবি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অংশে জন্ম নিয়ে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে কাব্যরচনায় ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কারটুকু নিয়েই অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের রচনায় ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাবনা ওতপ্রোত হয়ে আছে। অবশ্য তাঁদের কবিপ্রাণ ওই আদর্শে চিরবদ্ধ হয়ে থাকেনি; নতুন নতুন ফসলে ডালা ভরিয়ে দেওয়াতেই কবিপুরুষের আনন্দ।

রবীন্দ্রকালীন কয়েকজন কবি

ড. তারকনাথ ঘোষ

৪৭৫.০০

ঋত প্রকাশন


Post a Comment

0 Comments