একটি চড়ুই পাখি ও কালো মেয়ে
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
আনন্দ চোখ খুলে দেখছিল, আর দেখতেই হঠাৎ ঝপ করে কিছু একটা এসে পড়ল তার মুখে—ঠিক নাক আর ডান চোখের সংযোগস্থলে। বেশ বড়সড়, ধারালো কাঁটাযুক্ত কিছু একটা। মুহূর্তের মধ্যে কাঁটাগুলো চোখে বিঁধে গেল, যেন একটা পিন-কুশন, যার সূঁচগুলো বেরিয়ে আছে। আকস্মিক আঘাতে আনন্দ চমকে উঠল, সঙ্গে সঙ্গেই ক্রুদ্ধ, ব্যথাতুর চিৎকার বেরিয়ে এল—"ওঃ!"
বিকেলের শেষ ভাগ, প্রায় পৌনে চারটে। চৈত্রমাসের মাঝামাঝি, শীত বিদায় নিয়েছে, গরমের আমেজ শুরু হয়েছে, দুপুরে ঘুম পেতে ভালো লাগছে, কিন্তু কাঠফাটা রোদ এখনো জেঁকে বসেনি। তবু দুপুরের সেই থমথমে নীরবতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাখিরা একে একে নীরবতা ভেঙে ডাকতে শুরু করেছে—কয়েকটা কাক বৈদ্যুতিক তারে বসে কর্কশ কা কা করছে, শালিকগুলো কিচিরমিচির তুলেছে, আর চড়ুইয়ের দল অনবরত ছোটাছুটি করে উড়ছে।
কলকাতার বাইরে একসময় শহরতলী বলা হলেও, এখন তা শহরেরই অংশ হয়ে গেছে। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নতুন প্রকল্পে আধুনিক পরিকল্পনার শহর গড়ে উঠেছে—মাঝখানে একখানা পার্ক ঘিরে মসৃণ রাস্তা, পাশে নতুন নতুন বাড়ি। বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউয়ের মতো সবগুলো বড়ো নয়—ছোট, মাঝারি, চারতলা বাড়ির পাশাপাশি দু-একটা পাঁচতলাও দেখা যায়। এর মধ্যেই একতলা ছোট্ট একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে আনন্দ।
বাড়িটা একতলা হলেও আড়ম্বর কম নেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এর জানালা—দক্ষিণ দেয়ালে আট ফুট চওড়া, চার ফুট উঁচু, যার ওপাশেই পঁচিশ ফুট প্রশস্ত রাস্তা, তারপর পার্ক। পার্ক ঘিরে দেবদারু, দু-একটা শিমূল, সব মিলিয়ে শহর ও প্রকৃতির মিশ্র অনুভূতি। গাছপালার মধ্যে নানা পাখি—শকুন থেকে চড়ুই পর্যন্ত। কীটপতঙ্গও কম নয়, মশার তো কথাই নেই। রাতে মাঝে মাঝে পোকামাকড় ঘরে ঢুকে উড়ে এসে মাথায় আঘাত করে, আর ঠিক তখনই আনন্দ চমকে ওঠে।
এ পর্যন্ত দু’খানা ছবি নষ্ট হয়েছে—একবার চমকে গিয়ে তুলি এমনভাবে টেনেছিল যে ভুলটা আর শুধরানো যায়নি। শোনা যায়, আশেপাশে সাপও আছে। কোণাঘেঁষে ব্যাঙ লুকিয়ে থাকে, আকাশে মেঘ জমলেই ডাকতে শুরু করে। রাতে পাশের ফ্যাক্টরির কোনো অজানা কোণ থেকে নিয়মিত শেয়ালের ডাক ভেসে আসে।
বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল আনন্দের। গতকাল শনিবার কাজ করেছিল, আজ ভেবেছিল বেশি ঘুমাবে, সন্ধ্যায় বেরোনোরও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ঘুম ভাঙল—একটা স্বপ্ন দেখে।
কাল বিকেলে মিশন রোডের একটা অফিসে গিয়েছিল আনন্দ। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর মিশন রোডের মোড়ে তখন প্রবল যানজট, ট্যাক্সিতে বসে সে প্রায় নড়তেই পারছিল না। ঠিক তখনই কাপালীটোলার দিক থেকে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে—ফিরিঙ্গি। হাঁটুর ওপরে ফ্রক, মুখে ব্রণ, যেগুলো মেকআপেও ঢাকা পড়েনি। বগলে ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতে সিগারেট—অশ্লীলতা যেন ইচ্ছে করেই ফুটিয়ে তুলেছে। অথচ, বড় বড় চোখ আর এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে ওর এই রূপটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।
আনন্দ আর্টিস্ট, জানে যে অন্য কোনো সাজ ওকে মানাতো না—দামী পোশাকে বা সুশীল সাজেও শুধু করুণ দেখাত। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব ধরন থাকে, আর এইটেই ওর স্টাইল। সে কপাল কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে উঠেছিল, "হুঁ!" হয়তো মেয়েটা শোনেনি, কিন্তু ড্রাইভার—একজন বয়স্ক শিখ—শুনে বলল, "চৌরঙ্গি যাতি হ্যায়!"
ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটা এক টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করল, তারপর এঁকেবেঁকে গাড়িগুলোর ফাঁক গলে রাস্তা পার হয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার ধোঁয়া ছেড়ে যেন ব্যঙ্গ করল যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে। ট্যাক্সি, বাস, লরি একসঙ্গে হর্ন দিচ্ছিল, আর সে যেন সেই কোলাহলের মাঝেই নিখোঁজ হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments