
আমার বৃদ্ধ মাকে দেখতে আর তোমাদের শেষ দেখা দেখতে। আমরা আশাবাদী ছিলাম, হুমায়ূন বেঁচে যাবে। ও যখন আমেরিকায় হাসপাতালে ভর্তি হলো, ওর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হতো। আমি ওর সম্পর্কে যতখানি জানি আর কেউ হয়তো এতটা জানে না। ও তার নতুন কোনো লেখা পড়ার সময় ওই লেখার ভেতর ডুবে যেত। এবং পড়ে মাঝেমধ্যে কেঁদে ফেলত। ওর ভেতর যে এত প্রতিভা ছিল, তা সত্যি অবাক করার মতো। একদিন নুহাশপল্লীতে গিয়ে দেখি, হুমায়ূন তার পিএইচডি ডিগ্রির কাগজপত্র ফেলে দিয়েছে। কোঁচকানো কাগজ কুড়িয়ে দেখি পিএইচডির কাগজপত্র। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা ফেলে দিচ্ছ কেন? বলল, এটা দিয়ে কী হবে! আর আমি কি নামের আগে কখনো এই ডিগ্রি ব্যবহার করেছি। ও কুতুবপুর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নির্মাণ করেছে ওর নিজস্ব অর্থায়নে। ওকে যে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়া হলো, এটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল ওখানে সমাহিত হওয়ার। সে বলত, ওখানে আমার কবর, এরপর তোর কবর, এরপর আলমগীরের কবর হবে। আমরা তিন বন্ধু পাশাপাশি থাকব। আমি তো এসবের জীবন্ত সাক্ষী। ওখানে একটা গেস্ট হাউস আছে, ওটা আমারই করা। এখন আর যাওয়া হয় না নুহাশপল্লীতে। কারণ যার জন্য যাব সে তো নেই। যত দামি শুটিং হতো না কেন, আমরা গেলেই প্যাক-আপ। যেকোনো অনুষ্ঠানেই সে আমাকে তার পাশে বসাত। আর যেকোনো জায়গায় গেলে আমাদের সবার সঙ্গে সে পরিচয় করিয়ে দিত। এখনো সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজলে মনে হয়, তার ফোন আসছে। সে অনেক ছবি আঁকত। আমি গেলে বলত, দেখ কোনটা তোর পছন্দ। আর সে ভোজনবিলাসী ছিল। সে একদিন হালিম বানাল; কিন্তু মনে হলো সেই হালিম দেশের সেরা হালিম। সে দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। বাংলাদেশের কোনো খেলা হলে সে কখনো মিস করত না। সবাইকে একসঙ্গে করত খেলা দেখতে। দেশের বাইরে শুটিং, খেলা থাকলে সে শুটিং বাদ দিয়ে খেলা দেখত। ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে ছিল তার ভীষণ সখ্য। আমি তাকে প্রেমকুমার বলে ডাকতাম। হুমায়ূন প্রায়ই বলত, ডাকো তোমার প্রেমকুমারকে। মিলন যে হুমায়ূনকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করত, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার ছেলে রিশাদ। সে যখন কথা বলতে শিখল, আমি একদিন হুমায়ূনের বাসায় রিশাদকে নিয়ে যাই। হুমায়ূন বলল- তো রিশাদকে একটা কথা শিখাই। সে শেখাল হাদা বলতে। এরপর রিশাদ যত দিন ওকে দেখেছে হাদা চাচু বলেই ডাকত। হুমায়ূন বলত, কী এক বিপদে পড়লাম ওকে এই কথা শিখিয়ে! হুমায়ূন যে বয়সে মারা গেছে- তার লেখার সময় ছিল তখনই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তাকে অনেক ভালোবাসতেন। সুনীলদা এলেই বলতেন করিমকে ডাকো। আমাদের আড্ডা ও ছাড়া জমবে না। যেকোনো বিষয়ই হতো না কেন। সে গান অনেক ভালোবাসত। সে গান যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। তার আঁকা ছবিটা দেখলে মনে হয়, এই বুঝি মাইকেল এলো। সে সব সময় বলত- আমাদের সবারই মরতে হবে। জ্যোস্না উঠবে, সবাই ওয়াইন খাবে। কিন্তু আমরা কেউ থাকব না।
অনুলিখন : শ্যামল চন্দ্র নাথ