Ticker

6/recent/ticker-posts

দেবতার ধনুর্বাণ - চিনুয়া আচেবে

দেবতার ধনুর্বাণ: চিনুয়া আচেবে
দেবতার ধনুর্বাণ: চিনুয়া আচেবে
ভূমিকা ও অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
প্রকাশকাল: জুন ২০১২
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সব্যসাচী হাজরা
Chinua Achebe (pronounced CHIN-you-ah Ah-CHAY-bay). আধুনিক আফ্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচেবে আর নেই। আমেরিকার বোস্টনের এক হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন নাইজেরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিশ্বসাহিত্যেরই এক শ্রদ্ধেয় মানুষ। আমারবই এ পূর্বে প্রকাশিত দেবতার ধনুর্বাণ বইটি আবারো feature করলো, যারা এখনো পড়েননি, এই সুযোগে পড়ে ফেলুন। Updated on March 24th, 2013
চিনুয়া আচেবেকে বলা হয় আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক। আফ্রিকার জীবিত শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে তিনি একজন। নাইজেরিয়ার অ্যানামব্রা প্রদেশে জন্ম নেওয়া এই লেখক ১৯৫৯ সালে থিংস ফল এপার্ট উপন্যাস লিখে সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দেন। ঔপনিবেশিক যুগের পূর্ব এবং পরের নাইজেরিয়ার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হলো আচেবের বেশির ভাগ লেখার উপজীব্য। চিনুয়া আচেবে নিজে ইগবো সম্প্রদায়ের লোক। ফলে ইগবোদের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, রাজনৈতিক সচেতনতা ইত্যাদি তিনি দেখেন একদম ভেতর থেকে। দেবতার ধনুর্বাণ বা অ্যারো অব গড আচেবের তৃতীয় উপন্যাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা আফ্রিকার অধিবাসীকে যেভাবে শোষণ করেছে, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে যেভাবে পদদলিত করে নিজেদের শাসন ও নিয়মকানুন চালু করতে বাধ্য করেছে, তাতে আফ্রিকান কোনো লেখকই এসব অনুষঙ্গকে বাদ দিয়ে তাঁদের লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তাঁদের লেখায় অনিবার্যভাবেই ঔপনিবেশিক অনুষঙ্গ বিদ্যমান। পঞ্চাশের দশকে চিনুয়া আচেবে নাইজেরিয়ায় ট্র্যাডিশনাল ওরাল লিটারেচার নামক একটি নতুন ধারার সাহিত্য রচনার প্রবর্তন করেন। এ ধারাটি নাইজেরিয়ান সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। দেবতার ধনুর্বাণ উপন্যাসটি মূলত পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে ইগবো সমাজের ক্ষমতাবান ও দাম্ভিক এক পুরোহিত ইজুলু চরিত্রটিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। কাহিনির প্রথম দিকে আমরা দেখব, ব্রিটিশরা তাদের প্রসারিত বাহু বিস্তার করে ঢুকে পড়ছে প্রত্যন্ত নাইজেরিয়ার আনাচকানাচে। ছয়টি গ্রামের প্রধান পুরোহিত ইজুলুকে এ সময় ব্রিটিশদের সাহায্যকারী হিসেবে মনে হয়, যে কিনা তার এক ছেলেকেও খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য পাঠায়। জমি নিয়ে বিরোধে ব্রিটিশদের উপস্থিতিতে তাদের শত্রুগ্রামের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয় এই প্রধান পুরোহিত। ফলে নিজের গ্রামের মানুষের রোষানলে পড়ে সে। উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে বোঝা যায়, এসবই ইজুলুর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঔপনিবেশিক শাসকের চরিত্র বোঝার জন্যই সে পদ্ধতি হিসেবে এগুলোকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু নিজের গ্রামের এমনকি পরিবারের লোকেরাও তাকে বুঝতে পারে না। ইজুলুর চরিত্রের জটিলতা এবং প্রচণ্ড একরোখা দাম্ভিকতা তাকে মহাকাব্যিক নায়কের সমান্তরাল করে তোলে। শেষ পর্যন্ত সে তার প্রিয় সন্তান এবং ছয়টি গ্রামের লোকের সমর্থন হারায়। তার দেবতাও ঔপনিবেশিক দেবতার কাছে হার মানে। এ সবই পাঠকের মনে হয়, কেবল ইজুলুর আত্মম্ভরিতার জন্য ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সনাতন অস্ত্রশস্ত্র আর প্রাচীন মাটিবর্তী সরলতা হার মানে অধিকতর কৌশলী ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার আছে। তবুও পাঠকহূদয়ে ইজুলুর জন্য বিয়োগান্তক মহাকাব্যের নায়কের মতোই সমবেদনা জেগে ওঠে। উপনিবেশ-পূর্ববর্তী ইগবো সমাজের ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার, কৃষি, লোকজ বিশ্বাস, সমাজকাঠামো এসবের একটি বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা রয়েছে এ উপন্যাসে। চিনুয়া আচেবে প্রথাগত ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আফ্রিকান সাহিত্য নির্মাণে ব্রতী হন। ঔপনিবেশিক সাহিত্যের বিপরীতে অর্থাৎ জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস কিংবা জয়েস কেরির মিস্টার জনসন যে রকম খণ্ডিত ও বর্ণবাদী আফ্রিকাকে উপস্থাপন করে, তার বিপরীতে গিয়ে নতুন এক সাহিত্যিক দর্শন নির্মাণ করেন তিনি। ফলে আফ্রিকান সাহিত্যে তাঁর আসনটি চিরকালের জন্য পাকা হয়ে যায়। ইংরেজিতে লিখলেও ইগবো সমাজের মিথ, ইগবো শব্দ, লোকজ অলংকার, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির প্রচুর ব্যবহার করে ভাষাগত একটি সমন্বয়ে পৌঁছান আচেবে। এমনকি তিনি কোনো টীকাভাষ্যও দেন না এসবের জন্য। চিনুয়া আচেবে তাঁর উপন্যাসে প্লট নির্মাণের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ভঙ্গি বর্জন করে ইগবো সমাজে গল্প বলার প্রচলিত রীতিকে বেছে নেন। অনেক সমালোচক এ ব্যাপারটিকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এটি তাঁর সচেতন নিজস্ব নির্মাণ। বস্তুত ঔপনিবেশিক শিক্ষার (উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ববর্তী সবকিছুই খারাপ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বর্বর, অসভ্য ইত্যাদি) বিপরীতে চিনুয়া আচেবের দেবতার ধনুর্বাণ মূর্তিমান এক দ্রোহেরই প্রকাশ। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য উপন্যাসটির একটি সাবলীল অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদে উপন্যাসের ইগবো সমাজের আঞ্চলিক অনুষঙ্গগুলো বেশ ভালোভাবে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া উপন্যাসটি নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা লিখেছেন তিনি। বেশ কিছু অপরিচিত বিষয় ভূমিকায় বর্ণনা করার ফলে পাঠকের জন্য এটি বাড়তি পাওনা হিসেবে ধরা যেতে পারে।