Ticker

6/recent/ticker-posts

ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়ানডার্থাল থেকে নাস্তিক) - ভবানীপ্রসাদ সাহু

ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়ানডার্থাল থেকে নাস্তিক) - ভবানীপ্রসাদ সাহু ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়ানডার্থাল থেকে নাস্তিক) - ভবানীপ্রসাদ সাহু

‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। হ্যাঁ,ধর্মেরও উপরে; তার একমাত্র কারণ, ধর্মকে মানুষই তার জ্ঞান ও বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টি করেছে, তার নিজেরই প্রয়োজনে। ধর্ম চিরন্তন বা সনাতন কোন কিছু যেমন নয়,তেমন ঐশ্বরিক কোন ব্যাপারও নয়, কারণ এই ঈশ্বরও মানুষেরই কল্পনার সন্তান।
তবু কিছু মানুষ আছে, যারা ধর্মকে মানুষেরও উপরে স্থান দেয়। ধর্মের নাম করে অন্য মানুষকে ঘৃণা করা, এমন কি হত্যা করার ঘটনাও ঘটে। ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভেদ এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে যেন মনে হয় ধর্ম রক্ষাই মানুষের প্রধান কাজ—যা মিথ্যা।
ধর্ম তথা ঈশ্বর বিশ্বাসকে ব্যবহার করে ও অটুট রেখে, বিভিন্ন সময়ে কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মানুষে মানুষে ঐক্য স্থাপন করা ও বিভেদ দূর করার বাণী প্রচার করেছেন। কখনো তা নিতান্ত সাময়িক কিছু কাজ করলেও, বিভেদ আদৌ দূর করেনি; তার কারণ, কোনক্ষেত্রেই আন্তরিকভাবে মানুষকে ধর্ম ও ঈশ্বরের উপরে স্থান দেওয়া হয়নি এবং সব ক্ষেত্রেই ধর্মীয় গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে তার নিজস্ব বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান।
যাঁরা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসকে উৎসাহিত করে চলেন। ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ বা ‘প্রকৃত ধর্মাচরণ করা’র মত কথাবার্তায় তো সরাসরি ভাবেই তা করা হয়।
জোর করে কাউকে ধর্মবিশ্বাসী বা ধর্মপ্রাণ যেমন করা যায় না, তেমনি নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদীও বানানো যায় না। কিন্তু কি অতীতে, কি সম্প্রতি,এমন কাজ করা হয়েছে। একদা অতীতে, মানুষ নিজের অজ্ঞতা ও অসহায়তার কারণে এবং নিজের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রয়োজন মেটাতে (অন্তত যাকে সে মনে করেছে প্রয়োজন মেটানো), ঈশ্বর,আত্মা, ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান, গোষ্ঠীগত ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র ইত্যাদির জন্ম দিয়েছে। পরে এক সময় সমাজে শ্রেণীবিভাজনের ফলে শাসকগোষ্ঠী ধর্ম-কে ব্যবহার করেছে ব্যাপক মানুষকে শাসন করার কাজে (বর্তমানের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও যেমন এভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে)। ধর্মবিশ্বাসকে বিপুল সংখ্যক মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও মানসিকতার অঙ্গ করে তোলা হয়েছে। শাসক গোষ্ঠী নিজ স্বার্থের অনুকূল ধর্ম-কে প্রচারের উদ্যোগ যেমন নিয়েছে, তেমনি মানুষের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিক্ষোভকে দমনও করেছে। অন্যদিকে, মানুষকে জোর করে ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত করার, সরল ধর্মবিশ্বাসীদের অপমান ও হতমান করার মানসিকতাও লক্ষ্য করা গেছে।
মানুষ কেমনভাবে ধর্মের জন্ম দিয়েছে, কেমনভাবে শাসকগোষ্ঠী তাকে ব্যবহার করেছে, কেনই বা বিপুল সংখ্যক মানুষ ধর্মে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করতে বাধ্য হন—এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যকে ব্যাপকভাবে মানুষের সামনে নানা মাধ্যমে তুলে ধরা দরকার। এ কাজ না করে,শুধু ধর্মের দিকটি তুলে ধরা যেমন মানব জাতির স্বার্থবিরোধী, তেমনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও সভ্যতার ইতিহাসকে অস্বীকার করার সামিল।
অন্ধভাবে তথাকথিত ঐতিহ্যের অনুসরণ নয়, মুক্তমনে সত্যের সন্ধানই কাম্য। আর এই প্রচেষ্টারই একটি সীমিত বহিঃপ্রকাশ এই বইটি। এটি গবেষণা গ্রন্থ নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণও নয়, আমার যোগ্যতাও সন্দেহাতীত নয়। তবু এই প্রাথমিক সংক্ষিপ্ত প্রয়াসটি যদি সত্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকাও পালন করতে পারে, তবে এর সার্থকতা। অবশ্যই এর সীমাবদ্ধতা পূরণ হবে আরো অনেকের অংশগ্রহণে। তাই যুক্তিহীন, আবেগচালিত অন্ধ বিরোধিতা নয়, গঠনমূলক সমালোচনা শ্রদ্ধেয় পাঠকদের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে।
‘ধর্ম নয় সনাতন, ঐশ্বরিক কিছু’ শিরোনামায় “উৎস মানুষ” (বিডি ৪৯৪, সল্টলেক, কলিকাতা-৬৪) পত্রিকায় ১৯৯০-৯১ সালে ধারাবাহিকভাবে যে লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, তারই পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ এই বইটি। তা সত্ত্বেও কিছু ক্রটি থেকেই গেছে। পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার সময় পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলী যে মূল্যবান পরিমার্জনা করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন তার জন্য আমি এঁদের কাছে কৃতজ্ঞ, বিশেষ করে ডঃ অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীতরুণ বসুর কাছে। এছাড়া লেখাগুলি পড়ে পত্রিকার বেশ কিছু পাঠকও পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছেন। এঁদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। এঁদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় ডাঃ সুজিত কুমার দাস, শ্রীসত্য মিত্র ও সুকী আব্দুল আন্নায-এর পরিবেশিত কিছু তথ্যও এই বইটিতে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য ডাঃ আরতি সাহু(চট্টোপাধ্যায়), ডঃ ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, শ্রীসুধাংশু শেখর চট্টোপাধ্যায়, আকবর আলি, তানিয়া দে, অধ্যাপক কমলেশ লাহিড়ি ও শ্রীমতী সুনন্দা লাহিড়ি প্রমুখের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। এবং কৃতজ্ঞ ‘প্রবাহ'-এর তরুণ প্রকাশক শ্রীরাখাল বেরা-র কাছে, যিনি এ ধরনের বই প্রকাশ করার দিকে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
ধর্ম প্রসঙ্গে অন্ধ ও যুক্তিহীন আবেগ নয়,--বিজ্ঞানমনস্ক, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন ও আসছেন। তাঁদের হাতে হাত মিলিয়ে এই বইটি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকশিত করার কাজে কিছুটা সাহায্য করলেও পরিশ্রমের সার্থকতা।

১লা জানুয়ারী, ১৯৯২
ডাঃ ভবানীপ্রসাদ সাহু

Download and Comments/Join our Facebook Group