Ticker

6/recent/ticker-posts

সাক্ষাতকার - হরিশংকর জলদাস



সাক্ষাৎকারে হরিশংকর জলদাস

অন্ত্যজ সমাজে জন্মগ্রহণ করলেও জন্ম পরিচয় তাঁর কাছে গস্নানির কারণ হয়নি। বরং কথাসাহিত্যে ওই সমাজের ছবি
এঁকে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। পেশায় অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস এরই মধ্যে ব্যাপক নন্দিত হয়েছেন।
পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আরেক কথাশিল্পী মোহিত কামাল
মোহিত কামাল : প্রথমেই ২০১১ এর বইমেলায় প্রকাশিত আপনার নতুন উপন্যাসটি সম্পর্কে জানতে চাইব। এর পটভূমি, কাহিনী এবং অবশ্যই এটি লেখার প্রেরণা সম্পর্কে বলবেন। একই সাথে আপনি আমাদের বলবেন_'জলপুত্র' ও 'দহনকাল' উপন্যাস দুটো কীভাবে আলাদা?
হরিশংকর জলদাস : ২০১১-এর বইমেলায় আমার উপন্যাস বেরুচ্ছে একটি_'কসবি'। 
শুদ্ধস্বর বের করছে উপন্যাসটি। এছাড়া মাওলা ব্রাদার্স থেকে 'জলদাসীর গল্প' নামে একটি গল্পের বইও প্রকাশিত হচ্ছে। দশজন জেলেনারীকে নিয়ে লেখা দশটি গল্প নিয়েই 'জলদাসীর গল্প।' যাই হোক, আপনি 'কসবি' সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বলি_ তিনশ বছরের পুরনো একটি পতিতাপলস্নীকে নিয়ে 'কসবি' উপন্যাসটি। চট্টগ্রাম শহরে সদরঘাট বলে একটা জায়গা আছে, কর্ণফুলীর কোল ঘেঁষেই। ওই সদরঘাটের পাশেই সাহেবপাড়া মানে পতিতাপলস্নীটি। এই সাহেবপাড়া থেকে মাইল দেড়েক দূরে মাইজপাড়া। ওই মাইজপাড়ায় ছিল আমার বাবার মামার বাড়ি। খুব ছোটবেলা থেকেই মাইজপাড়ায় যাতায়াত ছিল আমার। আমার সিনেমা দেখার বড় লোভ ছিল। দাদীর বাপের বাড়িতে গেলেই সিনেমা দেখার নেশা পেয়ে বসতো আমাকে। খুব নিকটে ছিল লায়ন সিনেমা। বারো আনা যোগাড় করতে পারলেই সিনেমা দেখা যেত। তো ওই লায়ন সিনেমায় যেতে হতো সাহেবপাড়ার পাশ দিয়ে। আবার সাহেবপাড়ার ভেতর দিয়েও যাওয়া যেত। ওটা ছিল শর্টকাট রাস্তা। আমি শর্টকাট রাস্তাটাই বেছে নিতাম। আজ একথা অস্বীকার করব না যে, আমি বারবারই শর্টকাট রাস্তাটা বেছে নিতাম শুধু পথের দূরত্ব কমাবার জন্যে নয়, অসাধারণ রূপসীদের দেখার লোভেও। সেই বয়সে এই বোধটা কোনো কামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল না, তবে কামনার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট ছিল। কামনা_ রমণীয় রমণীদের অপলক চোখে দেখার কামনা।
তারপর বয়স বাড়ল, জীবনের অনেকটা পথ হাঁটা হল। জীবনের নানা সময়ে এই রূপকন্যারা আমার চিন্তায় বারবার স্থান করে নিয়েছে। তো সেই পুরনো সাহেবপাড়া, সেই পাড়ার প্রান্তিক মানুষজন যেমন বেশ্যা, মাসি, দালাল, কাস্টমার, সর্দার, গুণ্ডা-খুনীদের নিয়েই আমার 'কসবি' উপন্যাসটি।
'কসবি'র গোটা কাহিনীটি বলে দিলে তো পাঠকের আগ্রহ মিটে যাবে। তবে এইটুকু বলা যায়_ আমি এই উপন্যাসে বেশ্যাদের নিয়ে কোনো রগরগে কাহিনী শোনাইনি। পতিতারাও যে মানুুষ, তাদেরও যে দাবি-চেতনা আছে, তারাও যে রক্ত-পুঁজময় জীবন পেরিয়ে আলোর পথে হাঁটতে চায়, তার কাহিনীই লিখেছি আমি 'কসবি'তে। দেবযানী নামক বেশ্যাটির মাধ্যমে আমি বেশ্যাদের মূক প্রতিশোধস্পৃহাকে মুখর করেছি, কালু সর্দারদের রাজত্বও যে এক সময় শেষ হয়, তার কথাও শুনিয়েছি। তাছাড়া, সেই 'মহাভারতী'য় যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বেশ্যাজীবনের চালচিত্র তৈরি করবার চেষ্টা করেছি এই উপন্যাসে। সাহেবপাড়া নামক বেশ্যাপলস্নীটিকে ঘিরে চট্টগ্রাম শহরের তিন শ বছরের ইতিহাসের সুলুকসন্ধান করেছি 'কসবি'তে। এখানে আছে শ্রেণীচেতনার কথা। মোহিনীবেশ্যার ছেলে কৈলাস বেশ্যাসন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবার চাইছে, চাইছে বেশ্যাদের মধ্যে অধিকারচেতনার বীজটিকে প্রতিষ্ঠা দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালু সর্দারদের কারণে এই তরুণীটিকে প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু কৈলাস নিজের প্রাণের বিনিময়ে সাহেব পাড়ার বেশ্যাদের জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।
'কসবি' লেখার প্রেরণা আমি কসবিদের কাছ থেকেই পেয়েছি। এর সঙ্গে মিশে আছে প্রান্তিক মানুষদের জন্যে আমার দরদ।
'জলপুত্রে' আমি জলের কথা শুনিয়েছি। জলনির্ভর জেলেদের নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক উপন্যাস আছে। নদীনির্ভর জেলেদের নিয়েও লেখা হয়েছে বেশ ক'টি উপন্যাস_'পদ্মানদীর মাঝি', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'গঙ্গা', 'গহিন গাঙ', 'অবগাহন' ইত্যাদি। বাংলাসাহিত্যে সমুদ্রনির্ভর জেলেদের নিয়ে ইতিহাস আছে, আছে সামান্য প্রাপ্তির উলস্নাস। সবচাইতে বেশি আছে তাদের বঞ্চনার চালচিত্র। প্রতিবাদ আছে এই উপন্যাসে; কিন্তু তার স্বর খুবই ক্ষীণ। গঙ্গাপদ নামক একজন জেলেযুবক জেলেদের অধিকার আদায়ের আওয়াজ তুলেছে 'জলপুত্রে'। 
কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার মধ্য দিয়ে জলপুত্রদের অধিকার চেতনার বিষয়টি মরে যায়নি। বরং তাদের বাসনা বনমালীর মাধ্যমে অবয়ব পাওয়ার ইঙ্গিত আছে 'জলপুত্রে'।
আর 'জলপুত্র' যদি জলের আখ্যান হয়, তাহলে 'দহনকাল' জল ও স্থলের কাহিনী। এখানে শ্রেণীচেতনা প্রবল। মুক্তিযুদ্ধ এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জেলেরাও যে মুক্তিপাগল ছিল, স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাও যে তাদের মধ্যে জোরদার ছিল তার ইতিহাস 'দহনকাল' উপন্যাসটি।
মূলত 'জলপুত্র' ও 'দহনকাল' কোনো আলাদা উপন্যাস নয়। বরং বলা চলে এই দুটি উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমি বঙ্গোপসাগর-নির্ভর জেলেদের দীর্ঘ একশ বছরের ইতিহাসকে নির্মিতি দেয়ার চেষ্টা করেছি।
মোহিত কামাল: আপনার আগামী লেখালেখি নিয়ে কিছু বলুন। নতুন লেখায় হাত দেয়ার জন্যে কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন? এজন্যে কি অধ্যয়ন এবং স্পট পর্যবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন?
হরিশংকর জলদাস: লেখালেখির জন্যে অধ্যয়ন ছাড়া গতি নেই। আর দেখার ব্যাপারটি তো লেখকের জন্যে অপরিহার্য। জীবন-নিষ্ঠ লেখার ক্ষেত্রে স্পট পর্যবেক্ষণ না করে যাঁরা শুধু পুস্তকী-জ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেন, তাঁদের লেখা চটকদার হয় বটে, কাল-অতিক্রমী হয় না। অধ্যয়ন আর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লেখকের বোধ পোক্ত হয়। আমি পড়ি এবং দেখি। দেখি_ যাদের নিয়ে লিখি তাদের জীবনচর্চা-প্রণালী, তাদের আবাসস্থল, তাদের কথা বলার ধরন-ভঙ্গি, তাদের রাগ-অনুরাগ এসব। মেথর, যাদের আমরা হরিজন বলে থাকি, তারা আমাকে খুব টানে। তাদের জীবন-ইতিহাস বড়ই করুণ; তাদের আমরা ব্যবহার করি, তারপর ছুঁড়ে ফেলি। তাদের ঘৃণা করি, তাদের প্রতি অবহেলা দেখাই। অথচ আমাদের ভদ্র ও সুন্দর রাখার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ভদ্রলোকের মুখোসপরা আমরা মেথরপলস্নী সযত্নে এড়িয়ে চলি। আমি বর্তমানে যেখানে থাকি তার অদূরে ফিরিঙ্গিবাজার মেথরপলস্নী। চট্টগ্রাম শহরে চারটি মেথরপলস্নী আছে; সেগুলোতে আমার যাতায়াত আছে। আমি কার্তিককে চিনি, গুরুচরণের বেদনা আমাকে ছুঁয়ে থাকে। তাদের নারীদের লাঞ্ছনার সংবাদ আমাকে মথিত করে। অনেকদিন আগে থেকে তাদের নিয়ে লেখার এক গহীন বাসনা আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন তাদের নিয়ে একটা উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছি। ভেবেছি উপন্যাসটির নাম রাখব_রামগোলাম। জানি না, রামগোলামের জীবনকাহিনীর ভেতর দিয়ে মানবেতর জীবনযাপনকারী শত শত বছরের এই সেবকশ্রেণীর মানুষদের কথা আমি যথাযথভাবে লিখে উঠতে পারব কিনা। এই উপন্যাস লেখার জন্যে মনুসংহিতা, সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, ইংরেজযুগ, সেনযুগ ইত্যাদিকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছি।
আর 'মহাভারতে' একটা বিশেষ চরিত্রকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আমার আছে। এজন্যে আমি গভীর অনুধ্যান নিয়ে মহাভারত পড়ছি, পড়ছি নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরীকে।
মোহিত কামাল:পেছনে ফিরে যাই। আপনার কথাসাহিত্যচর্চার শুরু একটু বেশি বয়সে_ কেন? কীভাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন? প্রথম উপন্যাস প্রকাশের অভিজ্ঞতা বলুন।
হরিশংকর জলদাস: লিখব বা পিএইচ.ডি করব_ এটা কখনো ভাবিনি। যার গহীন-গভীর বাসনা ছিল শুধুমাত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হবার, সে হয়ে গেল সরকারি কলেজের অধ্যাপক। ভেবে দেখুন_ বাসনার চেয়ে প্রাপ্তির অংশ ক-ত বেশি! এই তৃপ্তিতে বিভোর ছিলাম আমি। পরিবার-পরিজনকে বাঁচাবার জন্যে রাতে নির্মম বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মাছ ধরছি আর সকালে দৌড়াচ্ছি কলেজে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবার জন্যে। সে সময় কলেজের বেতন ছিল ৭৫০ টাকা। ওই টাকায় বারোজনের সংসার চলত না। তাই বাপের সঙ্গে জলযুদ্ধে অংশ নেয়া। তখন আমার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এক মহিলা। স্বামী ছাড়া, স্বামীহারা। পিএইচ.ডি ডিগ্রি হোল্ডার তিনি। আমরা যে ৫/৭ জন তাঁর তত্ত্বাবধানে চাকরি করতাম_তাদের জন্যে এক নিবিড় তাচ্ছিল্য তাঁর মধ্যে কাজ করতো। আর তিনি পেতে চাইতেন বিভাগের পড়-য়াদের যত শ্রদ্ধা-ভালবাসা। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। তিনি ছিলেন অহংকারী এবং দুমর্ুখ। জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেক পিছিয়ে ছিলেন তিনি। এজন্যে অথবা অন্য কোনো অজানা কারণেই আমার প্রতি তাঁর অবহেলা তাচ্ছিল্যের পরিমাণ ছিল সিংহভাগ। একদিন আমার এক কলিগ, তাহমিনা যাঁর নাম, আমাকে ডেকে বললেন, 'দাদা, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন নাতো?' আমি অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকালাম।
ভাবলাম_আমার মনে কষ্ট পাওয়ার মতো কী এমন কথা তিনি আমাকে শোনাতে চান? মুখে বললাম_'বলুন। মনে করার কী আছে?' তিনি বললেন, 'আপনার আড়ালে বিভাগীয় প্রধান আপনাকে জাইল্যার পোলা বলে সম্বোধন করেন। আমাদের জিজ্ঞেস করেন_জাইল্যার পোলা আসছে কিনা_ ক্লাসে গেছে কি না? দাদা, মুখে কোনো প্রতিবাদ করতে পারি না। বড় কষ্ট লাগে দাদা। বলব না বলব না করে বিবেককে দীর্ঘদিন গলা টিপে চুপ রেখেছি। আর পারছিলাম না। আজকে বলে ফেললাম। বিবেকের বড় যন্ত্রণা পাচ্ছিলাম দাদা।'
সেদিন তাহমিনাকে আমি কিছুই বলিনি। বিস্মিত স্তম্ভিত চোখে শুধু তাকিয়েছিলাম তাঁর দিকে। ওই সময়ে, ওই মুহূর্তে ঠিক করলাম_ জেলেদের উৎস অনুসন্ধান করব। তারা আদৌ ঘৃণার কিনা, তাচ্ছিল্যের কিনা_এটা আমি খুঁজে দেখব। ঠিক করলাম_ধীবরগোষ্ঠীর উৎস-বিকাশ-পরিণতি বিষয়ে পিএইচডি করব।
গেলাম ময়ুখ চৌধুরীর কাছে। বয়সী পড়ুয়াকে দেখে তিনি প্রথম প্রথম একটু দ্বিধায় ছিলেন। পরে আমার বাসনার দুর্মরতা দেখে তিনি কাছে টেনে নিলেন। তো, এই পিএইচ.ডি-র কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে এক গহীন রাতে মাথাটা একেবারে খালি হয়ে গেল। যে বাসায় থাকতাম তখন, তার জানালার পাশে বাড়িওয়ালার সার্ভেন্টদের খোলা পায়খানা। জানালা খুললেই বদবু নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, না খুললে গরমে আলুসিদ্ধ হতে হয়। এই রকম পরিবেশ, সময় এবং পরিস্থিতিতে পাশের তাকে অলসভাবে পড়ে থাকা আধ-পুরনো একটা খাতা টেনে নিলাম। লিখলাম_'উথালপাথাল বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে আছে উনিশ বছরের ভুবনেশ্বরী।' 'জলপুত্রে'র প্রথম লাইন। তারপর থেকে পিএইচ.ডি-র তথ্য সংগ্রহ এবং তত্ত্ব-বিশেস্নষণের ব্যাপারটি যখন আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলত, তখন 'জলপুত্রে'র খাতাটি টেনে নিতাম। একটা সময়ে দেখা গেল 'নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্তজনজীবন'_এর পাশাপাশি 'জলপুত্র'ও লেখা হয়ে গেছে।
'জলপুত্র' লিখে বাক্সবন্দি করে ফেলে রাখলাম। উপন্যাস লিখেছি একটা, কাউকে বলতে দ্বিধা হল। এই ভয়ে যে, যদি কেউ বলে ফেলে_যে লোক গোটা জীবনে একটা গল্প পর্যন্ত লেখেনি, তার আবার উপন্যাস!? টিপু সুলতান-মহিউদ্দীনের মতো আমার গুটিকতক ছাত্র-অধ্যাপকই শুধু জানল উপন্যাসের বিষয়টি।
সে বছর, ২০০৭ই হবে বোধহয় বছরটি। ঈদসংখ্যার আগে 'যুগান্তরে' একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল_ নবীন লেখকদের লেখা উপন্যাসের পান্ডুলিপি চাই। যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক তখন কবি মারুফ রায়হান। তিনি বিজ্ঞাপনে এ-ও বললেন যে, শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি এই বছরের 'যুগান্তরে'র ঈদ সংখ্যায় ছাপানো হবে। মহি-টিপু বলল_স্যার, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি পাঠান। ৫২ বছর বয়স আমার । আমি কি নবীন লেখক? লেখায় এবং ভাবনায় নবীনরা ক-ত এগিয়ে!
শেষ পর্যন্ত তাদের জোরাজুরিতে জলপুত্রের পাণ্ডুলিপিটি আমাকে 'যুগান্তরে'র বরাবরে পাঠাতে হল। কাজের চাপে 'জলপুত্রে'র কথা এক সময় আমি ভুলে গেলাম। কিন্তু কবি মারুফ রায়হান শেষ পর্যন্ত ভুলতে দিলেন না। এক সকালে যুগান্তরের পাতায় দেখলাম_ অনেক পাণ্ডুলিপির মধ্যে বিচারকদের রায়ে 'জলপুত্র' শ্রেষ্ঠত্বের তকমা পেয়েছে। এবং সেটা ২০০৭-এর যুগান্তরের ঈদ সংখ্যায় ছাপানো হল। পরবর্তীকালে, সে প্রায় ৫ বছর পর, মারুফ রায়হানের সঙ্গে যখন আমার ঘনিষ্ঠভাবে মেশবার সুযোগ এল, জিজ্ঞেস করেছিলাম_'অনেক' বলতে সে সময় তিনি কতটি পাণ্ডুলিপি বুঝিয়েছিলেন? তিনি বলেছিলেন_এই প্রতিযোগিতায় প্রায় ৬০ টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়েছিল।
যা-ই হোক আজকে আমি বলতে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছি যে, কবি মারুফ রায়হানই আমাকে কথাসাহিত্যের জগতে ঢোকার পথটি করে দিয়েছিলেন। যুগান্তরে 'জলপুত্রে'র সেন্সরড অংশটি ছাপিয়ে তিনি থেমে থাকেননি। পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে আমি ঢাকার রাস্তায় যখন দ্বিধান্বিতভাবে ঘুরে ফিরছি, তখন মারুফ রায়হান মাওলা ব্রাদার্সের আহমেদ মাহমুদুল হককে ফোন করলেন 'জলপুত্রে'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। এখানে আরেকজনের কথা না বললে অপরাধ হবে, তিনি সাইমন জাকারিয়া। আমার প্রিয় মানুষ ড. আহমেদ মাওলা তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি মাওলা ব্রাদার্সের দিকে আমাকে আরও এক কদম এগিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে মাওলা ব্রাদার্স থেকে 'জলপুত্র' বই হয়ে বেরুল।
মোহিত কামাল: বাংলার শিক্ষক আপনি, এমনকি বিভাগীয় প্রধান। তাই কর্মক্ষেত্রে আপনার সময় চলে যায় অনেকখানি। সাহিত্যচর্চার সঙ্গে এটি কোনো বিরোধ তৈরি করে না?
হরিশংকর জলদাস: দেখুন কলেজ পর্যায়ে পড়িয়েও অনেকে বাঘা সাহিত্যিক হয়েছেন, হচ্ছেন। আমরা যারা কলেজ পর্যায়ে পড়াই তাদের অনেক সমস্যা, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের নেই। আমরা এই পিরিয়ডে একাদশ শ্রেণীতে পড়াতে গেলাম তো, পরের ঘন্টায় এম. এ শ্রেণীতে। মননের বিশ্রাম বা প্রস্তুতি ছাড়াই প্রতিনিয়ত আমাদের এই কাজ করতে হয়। ফলে বেশ অস্বস্তির মধ্যে আমাদের কলেজকালীন সময়টা কাটে। ওই সময় সাহিত্য চিন্তার কোনো অবকাশ থাকে না। আর সাধারণ শিক্ষকদের তুলনায় বিভাগীয় প্রধানের এক বোঝা সমস্যা বেশি। বিভাগের নীতিনির্ধারণের ব্যাপারে, ক্লাস-বিন্যাসের ব্যাপারে, পড়-য়াদের পাঠদানের অগ্রগতির ব্যাপারে এরকম আরও অনেক ব্যাপারে বিভাগীয় প্রধানকে প্রচুর সময় দিতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে অধ্যক্ষের কাছে বিভাগীয় অগ্রগতি বিষয়ে দায়বদ্ধতার ব্যাপারটিও। এসব কিছু কাটিয়ে সরিয়ে চুকিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমার হাতে সময় থাকে খুবই অল্প। তারপরও লিখতে বসি, নিয়ম করে নয়, যখন মন চায়। সেটা সন্ধে হতে পারে, গভীর রাত হতে পারে, এমনকি অতি ভোরও হতে পারে। এমনও হয়_রাতে ঘুমাচ্ছি, রাত তখন অনেকটা পেরিয়ে গেছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, অসমাপ্ত লেখাটির অগ্রগমনের ব্যাপারটি মাথায় এল, তখন উঠে গিয়ে লেখার টেবিলে বসি। এভাবে লিখতে থাকি। লেখা শেষও হয় এক সময়। খুব বেশি লেখার আগ্রহ আমার মধ্যে নেই। আমি প্রয়োজনে লিখি না, মনের আনন্দে লিখি। ফলে লেখা শেষ করতে একটু দেরি হয়, তাতে আমার তেমন খারাপ লাগে না। তবে হঁ্যা, কোনো কোনো লেখা লেখার জন্যে ভেতর থেকে প্রবল একটা তাগিদ আসে। কিন্তু শিক্ষকীয় সময় সমস্যার কারণে লেখার টেবিলে বসতে পারি না। তখন বেশ কষ্ট হয় বৈকি! মনে হয়, আহা! সকল কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিবিড় মনে লিখে যেতে পারতাম যদি! এইভাবে কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে লিখন-ক্ষেত্রে কিছুটা বিরোধ সৃষ্টি হয় বৈকি!
মোহিত কামাল : আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
হরিশংকর জলদাস: হরিশংকর জলদাসের জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯৫৫। 
তবে এ তারিখে ফাঁকি আছে। ওটা স্কুল-সার্টিফিকেটের জন্ম তারিখ। মৃতু্য তারিখ জানা নেই। সামনের দিকের যেকোনো একটা দিন হয়তো ক্ষেত থেকে পটল তুলতে বেরিয়ে পড়ব। বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস, মা শুকতারা জলদাস। মেছো-মেছোনি। বাবা মাছ ধরতেন। মা কখনো মাছের খাড়াং মাথায় নিয়ে 'মাছ লইবা না মাছ, তাজা লইট্যা মাছ' বলে পতেংগার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াননি। তবে ঠাকুরদি পরানেশ্বরী তা করেছেন। আড়াই বছর বয়সে পিতৃহারা যুধিষ্ঠিরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, পরবর্তীকালে পুত্রের স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্যে এই সর্বংসহা নারীটি পতেংগার অলিতে-গলিতে, হাটেবাজারে মাথায় মাছ নিয়ে নিয়ে ঘুরেছেন। পুত্রের আয়ের সঙ্গে নিজের শ্রম-ঘাম যুক্ত করে পরিবারটিকে থিকথিকে অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মূলত, আমার নির্মাতৃ হলেন ঠাকুরদি পরানেশ্বরী। তিনি আমার জীবনের সঞ্জীবনী সুধা।
বাবার দৃঢ় মনোবল, মায়ের স্নেহ, ঠাকুরদির প্রেরণা আর ভাইদের অপার সহযোগিতায় আমার আলোর পথে হাঁটা। আমার সৌভাগ্য যে, হাইস্কুল জীবনে আমি কিছু অসাধারণ শিক্ষকের সংস্পর্শ পেয়েছিলাম, যাঁরা আমার কানের কাছে অবিরাম বলে গেছেন, 'শংকর, তোমাকে এগুতে হবে। জেলেপাড়ার কালোমাটির কুঁড়েঘরের অন্ধকার থেকে তেজোময় সূর্যের নিচে এসে দাঁড়াতে হবে।'
দু' শো টাকা বেতনে ইস্টার্ন রিফাইনারী হাইস্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছি। চারশ টাকা বেতনে দক্ষিণ হালিশহর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের কঠিন দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করেছি। বছর তিনেক কঠোর পরিশ্রমের পর স্কুলটাকে দাঁড় করানো শেষে কতর্ৃপক্ষ 'জাইল্যার পোয়া'র দোহাই দিয়ে আমাকে বরখাস্ত করার পাঁয়তারা করেছে। ইজ্জত বাঁচানোর জন্যে ইস্তফা দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরেছি। বেকার জীবন যে কত দুঃসহ সেই ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালে আমি বুঝেছি। ঘরে নতুন স্ত্রী, অসহায় মা-বাবা, ক্ষুধার্ত ভাইবোনেরা। মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছে জেগেছে। গহীন রাতে সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে ভেবেছি_ মৃতু্যই ভাল, আত্মহত্যা মন্দ নয়। কিন্তু ভীরু আমি। শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকাকেই শ্রেয় মেনেছি। বেঁচে থাকবার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এম.এ পাস হরিশংকর দিনে-রাতে বাবার সঙ্গে, কখনোবা ভাইদের সঙ্গে, কখনো গাউরদের সঙ্গে সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছি। স্ত্রী শহুরে। বেঁচে থাকার জন্যে এত কায়দা-কানুন তার জানার কথা নয়। সমুদ্রফেরা ক্লান্ত বিপন্ন হরিশংকরের দিকে প্রথম প্রথম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত সে। সয়ে যাওয়ার পর কানের কাছে চুপে চুপে বলেছে_'থামবে না। সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেখে নিও_সুদিন তোমার একদিন আসবেই।' স্ত্রীর প্রেরণায় বা ভেতরের আগুনের দাহে আমি থেমে যাইনি। ১৯৮২-তে বি.সি.এস. পরীক্ষা দিয়েছি। পাসও করেছি। ১৯৮৪-র শেষের দিকে সরকারি কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হয়েছি। তারপর জীবনে কত উথাল-মাতাল অবস্থা! কখনো সোজা হয়ে পথ চলেছি, কখনো মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে মাটি ধরেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। পৃথিবীর কাছে অসহায় হরিশংকরকে জমা রেখে যুধিষ্ঠির এবং শুকতারা মৃতু্যকে আলিঙ্গন করেছেন। তার আগেই চলে গেছেন পরানেশ্বরী। তারপর। তারপর ভাইদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ভারে, অভাবে যৌথপরিবার ভেঙেছে। সৌহার্দ্যের খামতিতে ভ্রাতৃবোধ বিদায় নিতে বসেছে।
অসহিষ্ণু সহকর্মীর অপমানে জর্জরিত হয়ে জেলেদের উৎস সন্ধানে মগ্ন হয়েছি। লিখেছি 'কবিতা ও ধীবরজীবন কথা', 'কবি অদ্বৈত মলস্নবর্মণ' এবং 'ছোটগল্পে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ'। 'লোকবাদক বিনয়বাঁশী' গ্রন্থটি মানুষকে আলোড়িত করেছে। 'জীবনানন্দ ও তাঁর কলে' গ্রন্থটিকে পণ্ডিতরা ভাল বাসছেন। 'জলপুত্র' ও 'দহনকাল' উপন্যাস দুটো পাঠকের সঙ্গে আমার পরিচিতি ঘটিয়েছে। 'কসবি' লেখা হয়েছে অন্য ডাইমেনশন থেকে। দশজন জলদাসীকে নিয়ে লিখেছি 'জলদাসীর গল্প'। 'কৈবর্তকথা' বইটি আমার জীবনের খণ্ডিত ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। 'দহনকাল' ২০১১-এর 'প্রথম আলো বর্ষসেরা বই'-এর সম্মান পেয়েছে।
আমার একটা ছেলে, একটা মেয়ে এবং একজন স্ত্রী।
এখন চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে বাংলা বিভাগে পড়াচ্ছি এবং অপেক্ষা করছি যমদূতের। যমদূত আমার কাছে একদিন আসবে, এসে পড়বেই। কারণ, আমার পিতামহকে ২৪ বছর বয়সে নিয়ে গেছেন যমরাজ মশাই, বাবা গেছেন ৬০ বছর বয়সে। খুব বেশিদিন বাঁচার অভ্যেস আমাদের পরিবারের পুরুষদের মধ্যে নেই। আমিও তার ব্যতিক্রম ঘটাব কোন্ সাহসে?
মোহিত কামাল: আপনি কি কবিতা পড়েন? আপনার প্রিয় কবি?
হরিশংকর জলদাস : আপনার এ প্রশ্ন শুনে বড় ব্যথা পেলাম মোহিত দা। কারণ আমাকে আপনার কাছ থেকে আলাদা করে দিলেন। এমন কে আছে যে, যে কবিতা ভালবাসে না। আপনি একজন কথাসাহিত্যিক। মানুষের মন আপনার কথা সাাহিত্যের মূল উপাদান। নিরেট গদ্যশিল্পী মোহিত কামালও কিন্তু কবিতা ভালবাসেন। পড়েনও। আমি যদ্দূর জানি, স্বরচিত একটি মাত্র কবিতা দিয়ে আপনি পৃথিবী জয় করেছিলেন। মনে পড়ে কি সেই কবিতা ও সেই বিজিত পৃথিবীকে? যাই হোক, আমিও আপনার মতো কবিতা প্রেমিক। যদিও জয় করবার মতো তেমন পৃথিবী আমার সামনে উপস্থিত হয়নি কখনো। কবিতা আমি পড়ি_ দিনে রাতে, সকালে বিকালে, সন্ধেয় প্রদোষে, সংকটে আনন্দে। কবিতা আমার প্রাণরস, চলার শক্তি।
প্রিয় কবি তো অনেক। কোনো কোনো কবি একটি কাব্যগ্রন্থের জন্যে প্রিয় কোনো কবি আবার একটি কবিতার জন্যে প্রিয়, কোনো কবি একটি পঙ্ক্তির জন্যে। শোক এবং সুখ_ এই দুই বিপরীত সময়ে কবিরা আমার পাশে থাকেন। সেই পুরনো কাল থেকে আজ পর্যন্ত বেশ ক'জন কবি আমার প্রিয়। নবীনদের কবিতা আমি খুঁটিয়ে পড়ি। নবীনদের লেখা আমি একপাশে সরিয়ে রাখি না। তাঁদের লেখায় আমি একটি কবিতাকে খুঁজি, একটি পঙ্ক্তিকে খুঁজি, খুঁজি একটি শব্দকেও। প্রিয় কবিদের নামের উলেস্নখ এখানে নাইবা করলাম। যদিও ভুলক্রমে আমার কোনো প্রিয় কবির নাম বাদ যায়। আপনার এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হবার পর যদি তাঁর নাম মনে পড়ে যায়, তাহলে বড় অপরাধ বোধ কাজ করবে আমার মধ্যে। চুপে চুপে বলি, 'পরানের গহীন ভেতর'কে সর্বদা সাথে রাখবার চেষ্টা করি আমি।
মোহিত কামাল: নতুন যাঁরা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন, তাঁদের জন্যে আপনার কোনো সাজেশন আছে কি?
হরিশংকর জলদাস: এমন নয় যে আমি অনেক উপন্যাস লিখে ফেলেছি। আমার মাত্র তিনটি উপন্যাস 'জলপুত্র', 'দহনকাল' আর 'কসবি'। 
সংখ্যার নিরিখে আমিও কিন্তু নতুন। তাছাড়া, আমি উপন্যাস লিখছি এই ২০০৭ সাল থেকে। সময়ের বিচারে একেবারে কালকের লিখিয়ে আমি। তারপরও প্রশ্নটা যখন আমার সামনে রাখলেন আপনি, তখন তো কিছু বলতেই হয়। বলি_ উপন্যাস লেখার জন্যে অভিজ্ঞতাটা ভীষণ জরুরি। বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া উপন্যাস এমনকি ছোটগল্পও লিখতে যাওয়া উচিত নয়। বই তো পড়তেই হবে প্রচুর। নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি নবীন লেখকদের নজর দেয়া উচিত। এমন বিষয় যেখানে দুঃসাহসের পরিচয় দেয়ার সুযোগ থাকে। প্রাচীন লেখক যাঁরা, তাঁরা বিতর্কিত বিষয়কে নিয়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারে আগ্রহ নাও দেখাতে পারেন। কিন্তু নবীনরা তো নতুন কথা শোনবার জন্যে কলম ধরেন। ড্রয়িংরুম-নির্ভর ফ্যাসফেসে প্রেমের কাহিনী অনেক লেখা হয়েছে। অলীক, অতিমাত্রায় কল্পনা-নির্ভর, অতিলৌকিক গল্প উপন্যাসের জন্যে অনেক বৃক্ষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে, হচ্ছে। যে বই একবার পড়ে তাকে তুলে রাখার তাগিদ অনুভব অনুভূত হয় না, সে বই লেখার দরকার কী? কেনারও প্রয়োজন কেন? যেখানে জীবন তপ্ত তাবায় ভাজা ভাজা হচ্ছে সেদিকে নজর দেয়া উচিত নবীন লেখকদের। কত বিষয় পড়ে আছে_বেশ্যা, পথের ধারের ক্লান্ত বিপন্ন মুচি, রমনা পার্কের পিম্প, রেলস্টেশনের এককোনায় শুয়ে থাকা নারীটি_যে দিনে ভিক্ষা করে রাতে স্বামীর হাতে ছোট্ট সন্তানটিকে জমা রেখে আড়ালে অন্য পুরুষকে দেহ দিতে যায়, শ্মশানের ডোম। অথবা বড় অফিসের বড় কর্মকর্তা যার দুটো মোবাইল, এ দুটোর একটি তিনি অফিসে রেখে যান, লক্ষ্মীমন্ত স্বামীটি সেই মোবাইলের মাধ্যমে দ্বিচারিতা, ত্রিচারিতা করেন। এমন কত কত বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়! অথবা লেখা যায় গেট টুগেদার নিয়ে, লেখা যায় সমকামিতা নিয়ে।
নবীন লিখিয়েদের কাছে আমার এইটুকু বলার আছে_লিখেই প্রকাশের জন্যে হা-পিত্যেশ না করা ভাল। লেখার পর ওই লেখা ফেলে রাখুন বেশ ক'মাস। তারপর নিজের লেখা আবার পড়-ন_ আবেগমুক্ত হয়ে, পরম শত্রুর লেখা পড়ছেন এই মনোভাব নিয়ে। ওই সময় যদি আপনার মনে হয়_নাহ! লেখাটা খারাপ হয়নি। তাহলে প্রকাশের উদ্যোগ নিন। নিজের মনের চেয়ে বড় বিচারক আর নেই। দীর্ঘ বিরতির পর পড়লে আপনার মনই বলে দেবে আপনার উপন্যাসটি উৎরে যাবে কি না_ এছাড়া, পাণ্ডুলিপিটি খ্যাতিমান কাউকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে পারলে ভাল। এই পরামর্শ আজকাল খুব টেকসই নয়। খ্যাতিমানদের সময় বা ভালবাসা নেই নবীনদের পাণ্ডুলিপি দেখে দেবার। কথাটা একেবারে গড়ে বলা ঠিক নয়। আমি দু'চারজনকে জানি, তাঁরা নিজের জরুরি লেখা থেকে কলম গুটিয়ে নবীনদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে। তবে একথা সত্য যে, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ প্রবীণ মুখ ফিরিয়ে নেন নবীনদের লেখা থেকে। যে কজন খ্যাতিমানদের সহযোগিতা পান তাঁদের সংখ্যাওবা কত?
তাহলে কথা এই_ নবীন লিখিয়েদের পড়তে হবে, পড়তে হবে এবং পড়তে হবে। আর যে বিষয়ে লিখবেন তাঁরা, যে মানুষজনদের নিয়ে লিখবেন_ তাদের কাছে যেতে হবে, একবার নয়, বারবার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তিন মাস জেলেপাড়ায় থেকে উপন্যাস লিখতে বসলে ভুল হবে। মানিক বলে পেরেছেন। আমরা যারা নতুন উপন্যাস লিখিয়ে তাদের আরও বেশি সময় ধরে লিখিতব্য উপন্যাসের কুশীলবদের জীবনচর্চা অতি নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
মোহিত কামাল: অনেক কথা হল। অনেক অসাধারণ কথা বলেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
হরিশংকর জলদাস: আপনার প্রতি রইল আমার নিবিড় ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। আর যদি এ সাক্ষাৎকারটি কখনো ছাপা হয়, তাহলে সেই পাঠকদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যাঁরা আমার জন্যে তাঁদের মূল্যবান সময়ের বেশ কিছুটা ব্যয় করলেন।

Post a Comment

0 Comments