Ticker

6/recent/ticker-posts

হুমায়ূন ফরীদি



মিতা
হুমায়ূন আহমেদ


লেখাটি কিছুদিন আগের, হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন হুমায়ূন ফরীদিকে নিয়ে। আমারবই.কম শোকাহত এই মহান শিল্পীর মৃত্যুতে। কিং লিয়রের মহানুভবতা নিয়েই চলে গেলেন এ যুগের শক্তিমান অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি। যিনি নিজেই বলতেন, ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই আমি শিখিনি।’

দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরীর মাথায় (কাজকর্ম তেমন ছিল না বলেই মনে হয়) অদ্ভুত অদ্ভুত আইডিয়া ভর করত। একদিন এ রকম আইডিয়া ভর করল। তিনি আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় উপস্থিত হয়ে বললেন, বাংলাদেশে পাঁচজন হুমায়ূন আছে। দৈনিক বাংলায় এদের ছবি একসঙ্গে ছাপা হবে। আমি একটা ফিচার লিখব, নাম 'পঞ্চ হুমায়ূন'।
আমি বললাম, পাঁচজন কারা?
সালেহ চৌধুরী বললেন, রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন, অধ্যাপক এবং কবি হুমায়ুন আজাদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি এবং তুমি।
আমি বললাম, উত্তম প্রস্তাব। তবে এখনও না। আরও কিছুদিন যাক। সময় যেতে লাগল, হুমায়ূনরা ঝরে পড়তে শুরু করলেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী গেলেন, আহমেদ হুমায়ুন গেলেন, হুমায়ুন আজাদ গেলেন। হারাধনের পাঁচটি ছেলের মধ্যে রইল বাকি দুই। এই দুজনের মধ্যে কে আগে ঝরবেন কে জানে। সময় শেষ হওয়ার আগেই হুমায়ুন ফরীদি বিষয়ে কিছু গল্প বলে ফেলতে চাচ্ছি।
শুরু করি প্রথম পরিচয়ের গল্প দিয়ে। ফরীদির তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। বিটিভির অভিনয়রাজ্য দখল করে আছেন। একদিনের কথা, বেইলি রোডে কী কারণে যেন গিয়েছি, হঠাৎ দেখি ফুটপাতে বসে কে যেন আয়েশ করে চা খাচ্ছে। তাকে ঘিরে রাজ্যের ভিড়। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখানোর সময় তাদের ঘিরে এ রকম ভিড় হয়। কৌতূহলী হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ভিড় ঠেলে উঁকি দিলাম, দেখি হুমায়ুন ফরীদি। চা খাচ্ছেন, সিগারেট টানছেন। রাজ্যের মানুষ চোখ বড় বড় করে এই দৃশ্য দেখছে, যেন তাদের জীবন ধন্য। হঠাৎ ফরিদীর আমার ওপর চোখ পড়ল। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, আপনি এখানে কী করেন। আমি বললাম, আপনার চা খাওয়া দেখি।
ফরীদি উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। মিতা! আসুন তো আমার সঙ্গে। [নামের মিলের কারণে আমরা একজনকে অন্যজন মিতা সম্বোধন করি]। 
তিনি একটি মনোহারী দোকানে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেলসম্যানকে বললেন, আপনাদের দোকানের সবচেয়ে ভালো কলমটি আমাকে দিন। আমি মিতাকে গিফট করব।
ফরীদিকে আমি একটি বই উৎসর্গ করেছি। উৎসর্গ পাতায় এই ঘটনাটি উল্লেখ করা আছে।
এখন দ্বিতীয় গল্প। শুরুতেই স্থান-কাল-পাত্র উল্লেখ করি। স্থান সুইডেন, কাল ২০০৮, পাত্র মানিক। এই ভদ্রলোকের সুইডেনে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। তিনি একদিন নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাড়িতে। দেশের বাইরে গেলে আমি কোথাও কোনো নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি না। কারও বাড়িতে তো কখনও না।
মানিক সাহেবের বাড়িতে গেলাম, কারণ তাঁর চেহারা অবিকল হুমায়ুন ফরীদির মতো। আপন ভাইদের চেহারায়ও এত মিল থাকে না। ভদ্রলোককে এই কথা জানাতেই তিনি বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, অনেকেই এমন কথা বলে।
আমি বললাম, ফরীদির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো পরিচয় কি আছে?
মনিক বললেন, সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৭১ সালে আমি এবং ফরীদি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি।
আমি চমকালাম। ফরীদি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তা আমার জানা ছিল না।
মানিকের বাড়িতে আমার জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল। সেখানে দেখি তাঁর বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘরটির নাম ফরীদি। এ ঘরটি তিনি সারা বছর তাঁর বন্ধু হুমায়ুন ফরীদির জন্য সাজিয়ে রাখেন, যদি ফরীদি বেড়াতে আসেন। অন্য কারোর সেই ঘরে প্রবেশাধিকার নেই।
তৃতীয় গল্প। সন্ধ্যাবেলায় ফরীদি টেলিফোন করেছেন। আমি ফোন ধরতেই বললেন, মিতা, আপনি কি আচার খান, আমের আচার, তেঁতুলের আচার এসব?
আমি বললাম, খাই।
ফরীদি বললেন, সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে গল্প করতে আসব। ভাবছি তখন আচার নিয়ে আসব।
তিনি গল্প করতে এলেন, সঙ্গে কোনো আচারের বোতল দেখলাম না। আমি ভাবলাম বলি, মিতা! আমার আচারের বোতল কোথায়? শেষ পর্যন্ত বলা হলো না। আমরা দু'জন দু'জনকে মিতা ডাকি, কিন্তু আমাদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। গল্প শেষ করে ফরীদি বিদায় নিলেন।
রাত ১২টার মতো বাজে। ঘুমানোর আয়োজন করছি, তখন দরজায় কলিং বেল। দরজা খুলে দেখি হুমায়ুন ফরীদি ড্রাইভার। তার সঙ্গে ২৩টা আচারের বোতল। তার দায়িত্ব ছিল দোকানে দোকানে ঘুরে যত রকমের আচারের বোতল ছিল সংগ্রহ করে নিয়ে আসা। সংগ্রহ করতে দেরি হয়েছে বলেই সে এত রাতে এসেছে।
চতুর্থ এবং শেষ গল্প। এই গল্পটি শুনেছি আমার প্রিয় প্রতিভাময়ী এক জনপ্রিয় শিল্পীর কাছে। গল্পটি আমার এতই পছন্দ হয়েছিল যে, এই লেখায় উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। গল্পের পটভূমির পরিবর্তন হয়েছে। নতুন পটভূমিতে গল্পটি বলা শোভন হচ্ছে কি-না বুঝতে পারছি না।
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে। ফরীদি স্ত্রীর রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। রাগ ভাঙাতে পারেননি। সুবর্ণা কঠিন মুখ করে ঘুমাতে গেছেন। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই সুবর্ণা হতভম্ব। ঘরের দেয়াল এবং ছাদে ফরীদি লিখে ভর্তি করে ফেলেছে। লেখার বিষয়বস্তু, সুবর্ণা! আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সুবর্ণা আমার সঙ্গে হাসতে হাসতেই গল্পটা শুরু করেছিলেন, একসময় দেখি তার চোখে ভালোবাসা ও মমতার অশ্রু চিকচিক করছে।
পাদটীকা
আচ্ছা, এই মানুষটি কি অভিনয়কলায় একটি একুশে পদক পেতে পারেন না? এই সম্মান কি তাঁর প্রাপ্য নয়? [যে পাঁচ হুমায়ূনের নাম করা হলো তাদের মধ্যে ফরীদি ছাড়া বাকি সবাই একুশে পদক পাওয়া]। 
মিতার ৬০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমার শুভেচ্ছা। হে পরম করুণাময়, এই নিঃসঙ্গ গুণী মানুষটিকে তুমি তোমার করুণাধারায় সিক্ত করে রাখো। আমিন।

Post a Comment

3 Comments

Md Sultan Mahmud said…
yes. but all humayun are no more !