Ticker

6/recent/ticker-posts

চর্যাপদ : তাত্ত্বিক সমীক্ষা - ড. শামসুল আলম সাঈদ

Charyapad Tattwic Samiskha - Shamsul Alam Sayed in pdfচর্যাপদ : তাত্ত্বিক সমীক্ষা - ড. শামসুল আলম সাঈদ
বাঙালি জ্যোতিলন্ধ প্রথম চিত্ত-সম্পদ চর্যাপদ; এমন স্নিগ্ধ সংরক্ষণযোগ্য । চর্যাপদ বৌদ্ধ বজ্রযানি সিদ্ধাচার্যদের সাধন সংগীত, সম্পূর্ণ রূপক ভঙ্গিতে এবং তন্ত্রের মন্ত্র হিসেবে ধর্মশিক্ষার্থীদের জন্য রচিত । উদ্দেশ্য যা-ই থাক, চারদিকেও তার জ্যোতি ও আভা বাদ যায় না । ঠিক তেমনি তান্ত্রিক উদ্দেশ্য ব্যতিরেকেও চর্যাপদের সম্মোহনীয় পদ্মশ্রীর রূপস্পর্শে আকুলিত হয় না এমন কেউই নেই, সেখানেই চর্যাপদের কৃতিত্ব। কবিতা যে উদ্দেশ্যে লেখা হোক না কেন, যদি তা হয় হৃদয় নিঃসৃত শিল্পানুরাগে জারিত তবে কবিতা কবিতাই । বৌদ্ধ গান চর্যাপদ তাই আমাদের সেই উৎকৃষ্ট সুরভিত কবিতা এবং আস্বাদনের বিষয় ।
পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন । সেখানে রাজকীয় পরিবেশে সমাদরে তা গৃহীত হয়েছিল হয়তো-বা বাংলার বৌদ্ধ জীবন-মননে তার ঠাই ছিল না বলে । তাই মাজা-ঘষার দরুন বঙ্গীয় রূপ-লাবণ্য কিছুটা ছিন্ন বা ফিকে হয়ে গেলেও পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আপ্রাণ চেষ্টায় চর্যাপদে বাংলার প্রাচীনত্ব যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণিত এবং বাংলার আদি সাহিত্যভাষার নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বর্তমান সমীক্ষায় সেই উদ্দেশ্য সামঞ্জস্য রেখেও চর্যাপদের কবিতায় যে জগৎ এবং জীবনের অনুপম তাত্ত্বিক সৌকর্য সম্ভার লুকিয়ে তা উদ্ধার করার প্রয়াস রয়েছে।

ভূমিকা
চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রথম প্রাণস্পন্দন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একশত বছর আগে নেপালের রাজদরবার থেকে একে বের করে এনে বিশ্ব দরবারে হাজির করার পরপরই পূর্ব ভারতীয় অন্যান্য ভাষা দাবি করল যে এটাই আসলে তাদের সকলের পূর্বেকার সঠিক প্রাণ। কিন্তু ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেসব দাবি নাকচ করে বললেন, এটা বাংলার। সঠিক এবং তাই সত্য কথা ।
এত বলবীর্য সম্পন্ন ভাষা ও সাহিত্য কীর্তি বঙ্গ জননী হাজার বছর আগে প্রসব করেছিল, তবে জননীর কোল ছেড়ে কী অভিমানে তা অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তার কারণ এখনও নিণীত হয় নি এবং মাঝখানে বঙ্গ সাহিত্য ভাষার গ্রন্থিসূত্র এতটাই ছিন্ন হয়েছিল যে একমাত্র মাঠে ঘাটে অনাদরে থাকা বাউলরা কেবল একতারে যেটুকু পারে ধরে রেখেছিল, নইলে চর্যাপদকে বাংলা বলার কথা নয়। তাছাড়াও চর্য যে বাংলা পদ সাহিত্যের ঐতিহ্য পদাবলী তার চর্চাও তাই বলে দিচ্ছে। কিন্তু চর্য রচয়িতা সিদ্ধাচার্যরা কিন্তু একে পদ বলেন নি, এ পদগুলো কেবল চর্যা নামে অভিহিত, যা সিদ্ধাদের মন্ত্রধ্বনি বা সাধন সংগীত। বৌদ্ধ বজ্রযানি তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্যরা আপন আপন গুহ্য আচারের নিমিত্ত এ চর্যা ব্যবহার করতেন আগম নিগম রূপে, সাধারণের জন্য নয়। টীকাকার মুনিদত্ত তাই চর্যার ভাষাকে প্রাকৃত-সান্ধ্য ভাষা বলেছেন অর্থাৎ একটা আশ্চর্য মরমি ভাষা, যা সাধারণের বোধগম্য নয়। তাই বোধগ্রহীদের জন্য টীকা নির্মাণ করেন। এ রকম চর্যা বাংলা বৌদ্ধ বিহারগুলোতে কিংবা অন্যত্র ‘লোকজ্ঞানলোকভাসের নিমিত্ত নৃত্য গীত রাগ তাল লয় সহকারে গীত হত। বাংলার বুক থেকে বৌদ্ধ প্রভাব বিলুপ্ত হবার পর এ অমর সম্পদও অন্যত্র অপসারিত হয়েছে, অবশেষে হিমালয়ের ভেতরে গিয়ে যতটা সম্ভব অস্তিত্ব রক্ষা করেছে।
চর্যার ভেতরে বঙ্গ নামের উল্লেখ থাকলেও ভাষার নাম তখনও বঙ্গ হয়ে ওঠে নি, অথবা অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-মগধ সবকে মিলে তৎকালে বঙ্গই বলা হত, এ সমগ্র অঞ্চলের ভাষাটাই ছিল পূবী প্রাকৃত বা চর্যার ভাষা, বর্তমান বাংলাভাষায় মূলরোম অন্য ভাষাগুলো তা থেকে গেড় পেয়েছে। এ ভাষাতে দেড় হাজার কি তারও আগে এ রকম চর্য রচিত হত বলে অনুমান করা যায়। হাজার হাজার আগাছা চর্য সৃষ্টির পর এ চর্যার মত মহীরুহ উৎপন্ন হয়েছে, যা হঠাৎ করে এ অঞ্চলে জেগে ওঠে নি। টীকাকারের মন্তব্যে ধরা পড়ে যে এ সব হাজার হাজার চর্য সংগ্রহের পর তার থেকে নির্বাচিত একশতটি চর্যার একটি সংকলন হয়েছিল, তার ভেতর থেকে মুনিদত্ত মাত্র একান্নটি, পরে একটি ব্যাখ্যা নাস্তি’ বলে বাদ দিয়ে পঞ্চাশটির নির্মল টীকা প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীদের জন্য, সেই টীকাযুক্ত চর্যগ্রন্থের নাম হল চর্যাগীতিকোষবৃত্তি যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করেন এবং এ চর্য্যাচৰ্য্যাচয়' কে তিনি নামকরণ করেন চর্য্যাচৰ্য্যবিনিশ্চয়', প্রকৃতপক্ষে এর নাম আশ্চৰ্য্য-চৰ্য্যাচয়'। 'আশ্চর্য-মরমি ভাষা ও কথার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ শাস্ত্রী চর্যার ভাষাকে সান্ধ্য বা আলো আঁধারি ভাষা বলেছেন, যা ঠিক নয়। মুনিদত্তের টীকা অনুসরণে চর্যার ভাষাকে দুর্বোধ্য বলার অবকাশ নেই।
চর্যাপদ বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ, একে এখন আর মন্ত্র বা সাধন সংগীত বলে একপেশে আচরণ দিয়ে বিচার করার প্রয়োজন নেই, এখন নিশ্চয়ই আমাদের জ্ঞান প্রসারিত হয়েছে, চর্যার শব্দ ও ভাষার অর্থভেদ করার মত চিন্তা চেতনা যুক্তি ও মুক্ত মননের উদয় হয়েছে যা নিয়ে অনুধাবন করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে চর্যাপদ বাংলা কবিতার এক অপূর্ব সৃষ্টি এবং এর ভাব ব্যঞ্জনা শব্দ অনুষঙ্গ আধুনিক কবিতাকেও অতিক্রম করার শক্তি রাখে। সেই সময়ের চর্য রচয়িতা এ সকল সিদ্ধাচার্য বা রাজপুত্র কী অমোঘ ভঙ্গিতে এ বাণী সমিধ উচ্চারণ করে গেছেন ভাবতে অবাক লাগে, যার গোপন গন্ধের চারিদিকে বাঙালি চিরদিন অবশ্য ঘুরে বেড়াবে।
চর্যাগীতি আমাদের অহংকার, বাংলা গানের প্রথম ঘরানা তো এখানেই। এ মন্ত্রধ্বনি উচ্চারণ করতেন ঈশ্বরের মত শক্তিসম্পন্ন সিদ্ধাচার্যরা। তারা তাকে মার্গ সংগীত বা সাধন সংগীত হিসেবে চর্চা করতেন। বাংলা গানের এই নামের ঈশ্বরদের গুণ এমনই যে তারা একাধারে বাণী রচনা করতেন, সুর সংযোজন করতেন, রাগ তাল নির্ণয় করতেন এবং অবশেষে নিজের কণ্ঠ নিঃসৃত সুরে প্রকাশ করতেন, সেই একই ধারায় বৈষ্ণব মহাজন পদকর্তাদের বৈভব থেকে শুরু করে এই সেদিন পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত বাংলা সংগীত সম্ভারে জমা পড়েছে। এ রকম সৃষ্টিকে কেউ গানবাধা সাধনা বলেছেন, তাতে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিজস্ব ঘরানা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর পর থেকে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আলাদা-আলাদা ভাবে তাদের প্রতিভার বিস্তার করে থাকে, তাই আধুনিক গানকে আর মার্গ সংগীত বলা যাচ্ছে না। লোকসংগীতের মত ব্যাপারটা এর জন্য অচেনা রূপকারদের কাজ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে, আগের মার্গ গৌরব অর্জন এরা করতে পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় চর্যাগীতি হল বাংলা গানের বা বাণীর মাতৃস্তন্য, যা পান করে বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও বাঙালির জীবনবোধ বর্ধিত হয়েছে।
চর্যাপদ নিয়ে দীর্ঘদিন দানাপানি ছেড়ে মাঠে প্রান্তরে মগ্ন থেকে কবিতা হিসেবে এগুলোকে আস্বাদন করতে গিয়ে অতি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল যে যারা এ শব্দ ভাষানুষঙ্গ ও বাণীর রূপকার ছিলেন, মনে হয়েছে তারা নিশ্চয়ই ঈশ্বরই ছিলেন, তা না হলে আধুনিক কাব্যগুণের ব্যাপারগুলো কী করে তারা জানতে পারলেন? তবে মাঝখানে দ্বাদশ শতাব্দীতে মুনিদত্ত যে এর জন্য আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চেপে কাব্যরস পিপাসাকে আলগা করে দিয়েছেন একথা ভুলে যেতে হবে। অথচ তিনিই চর্যাপদকে নবজীবন দান করেছেন। বর্তমান গ্রন্থচর্চায় আধুনিক পাঠক হয়তো এ দায়িত্বটা উদ্ধার করতে পারেন, তবু তা সন্দেহ নিশ্ছিদ্র নয়। মনে করছি এ জন্য যে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ জঙ্গিবাদের জন্য ধর্মদায় মোচন করছে, গির্জায় মঠে মন্দিরে তাদের গগন বিস্ফারিত সত্য নয় কে বলতে পারে? এ মহাশক্তিবলেই তো চর্যাশক্তি উৎসারিত হয়েছে। অবশ্য আমাদের বিস্ময় যে নেওয়ারি দুর্বোধ্য লিপি থেকে জননীর প্রথম জাতককে কেমন করে উদ্ধার করলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী? এ সব কিছু ঈশ্বরের কাজ-এমনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। আর এ বিশ্বাসাপ্লুত হয়ে এ গ্রন্থ রচনা আর পাঠকই তার দায় মোচন করতে পারেন।
ঢাকা
শামসুল আলম সাঈদ