Ticker

6/recent/ticker-posts

জীবনের বালুকাবেলায় - ফারুক চৌধুরী

Jiboner Balukabelay - Faruq Choudhury জীবনের বালুকাবেলায় - ফারুক চৌধুরী
ফারুক চৌধুরী তাঁর বই শুরু করেছেন খুবই সাবধানে। জীবনের বালুকাবেলায় বইটি তিনি শুরুই করেছেন উৎসাহী পাঠকের অত্যধিক প্রত্যাশার গায়ে পানি ঢেলে দিয়ে। পাঠককে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন :

প্রথাগত অর্থে এই বই কোনো আত্মজীবনী নয়। আমার মতো একজন সাধারণ জীবনযাপনকারীর পক্ষে তা লেখা ধৃষ্টতাই হবে। আকাশে আমার উড্ডয়নের কোনো ইতিহাস রচনার ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত রয়ে গেছি। এই বইয়ে আমার জীবনকে কেন্দ্র করে আমার অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার পরতে পরতে কতগুলো বৃত্ত রচনার প্রয়াস নিয়েছি। তা-ও সব সময় আমার জীবনের চলার পথের ক্রমান্বয়তায় যে করেছি, তা নয়। আমি তা করেছি জীবনের বালুকাবেলায়, ইতস্তত বিচরণ করে গল্প বলার অবাধ স্বাধীনতায়।

কোনো পরিসরে বিস্তৃত হলে যে স্মৃতিকথার আত্মজীবনীতে উত্তরণ ঘটে, সে বড় জটিল ও সূক্ষ্ম বিতর্ক। আত্মজীবনী বিচিত্র। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের আত্মজীবনী বিপুল, কমলা দাসের চটি। জাঁ জাক রুশোর আত্মজীবনী নিজের সম্পর্কে নেতির প্রচারে উন্মুখ, পাবলো নেরুদার অকপট, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরটি সতর্ক ও আংশিক উন্মোচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে নির্জলা ঘটনাবস্ত্তর পরিমাণ অতি-সামান্য, তা যেন অন্তর্লোকের দীপ্তিময় উন্মেষের এক বস্ত্তভারহীন বিবরণ।

আত্মজীবনীর এই বিচিত্র প্রকারের মধ্যে জীবনের বালুকাবেলায়ও নিজের মতো একটি পথ করে নিয়েছে। বরং লেখক যা দাবি করেছেন, তার সবটা আক্ষরিক অর্থে যথার্থও নয়। ইতিহাস-কাঁপানো যে বিপুল ঘটনাবর্ত ও ব্যক্তিত্বরাশির মধ্য দিয়ে ফারুক চৌধুরীর জীবন প্রবাহিত হয়েছে, সেটি তাঁকে আর নিছক ‘একজন সাধারণ জীবনযাপনকারী’ হয়ে থাকতে দেয়নি। তাঁর এ-রচনাও নিছক ‘ইতস্তত বিচরণে’র গল্পমাত্র নয়; সময়ের অনুক্রমে, পর্বে পর্বে, যথেষ্ট পরিমাণে ‘জীবনের চলার পথের ক্রমান্বয়তায়’ই এটি সাজানো।

তারপরও লেখকের এই সতর্কতার কারণ কী? আত্মজীবনীর ভরকেন্দ্র একজন ব্যক্তির মন। সেখানে একটি কালখন্ড, সামাজিক পরিসর ও আরো অসংখ্য ব্যক্তির উপস্থিতি থাকে বটে - সেটি থাকতে বাধ্য, কারণ সমাজের বাইরে ব্যক্তি নেই এবং অন্যদের জীবনের সাপেক্ষেই একজন ব্যক্তির জীবন আকার পায়; কিন্তু আত্মজীবনীতে তাদের বিচ্ছুরণ ঘটে একজন ব্যক্তির মনের প্রিজমের মধ্য দিয়েই। এতে ব্যক্তিচৈতন্যের নিরিখই মুখ্য। ইতিহাসে আমরা পাই একটি সময়ের সামান্য বর্ণনা, অসংখ্য মানুষের বিচিত্র টানাপড়েনে রচিত সেই সময়ের নিরঞ্জন উদ্ভাস। আত্মজীবনীতে ব্যক্তির মন সে-সময়টিকে রাঙিয়ে দেয়। ঘটনার তলায় চাপাপড়া মানুষের অন্তরের মূল্য সেখানে প্রধান।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ-উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বিচিত্র উপায়ে তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা রূপ দিতে চেয়েছে। তার ফল হিসেবে এ-উপমহাদেশে কখনো রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে, কখনো অপরিসীম আশা সঞ্চারিত হয়েছে। তিন দশকেরও কম সময়ের মধ্যে এর মানচিত্র বদলেছে দুবার। ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসা আত্মস্বার্থে উন্মুখ নানা দেশও উপমহাদেশের এই রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে নানাভাবে। পেশার সূত্রে ফারুক চৌধুরী উত্থান-পতনময় এ-ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। সেসব ঘটনার ঘনঘটা, প্রভাব ও ভার এতই বেশি যে, সেগুলোই হয়ে উঠেছে তাঁর এ-বইয়ের কেন্দ্রভূমি। একটু এগিয়ে বরং এ-কথা বলা যায় যে, সেসব ঘটনার যে-অংশবিশেষ ফারুক চৌধুরীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে, তা এ-বইটির মূল আকর্ষণ। নিজের এ অনন্য অভিজ্ঞতার কথা লেখক নিজেও বিলক্ষণ জানেন। এ-বইটিতে তিনি তাই সেসব ঘটনাকে ছাপিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। বইয়ে নিজের জীবনটিকে তিনি সাজিয়েছেন সেসব ‘অভিজ্ঞতার পরতে পরতে কতগুলো বৃত্ত রচনার’ পরিকল্পনা নিয়েই।

জীবনের বালুকাবেলায় বইটির প্রথম কিছু অধ্যায়ে ফারুক চৌধুরী দ্রুত তাঁর শৈশব-কৈশোর-তরুণ বয়সের জীবনপর্বগুলো পার করে এসেছেন। আসাম, শিলং, সিলেট ও ঢাকায় ছড়ানো সে-জীবনের বর্ণনা অনুপম ও অসামান্য। এক নিস্তরঙ্গ সমাজপটে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু ও শিক্ষক-পরিবেষ্টিত এক জীবন। রাজনৈতিক বিভঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে সে-স্থিরতা। বাবার চাকরিসূত্রে বা নতুন দেশ বরণ করে নেওয়ার সূত্রে লেখক সপরিবারে ছুটছেন এক স্থান থেকে অন্যত্র। কিশোর লেখকের কাছে এর সবটাই আনন্দময় উত্তেজনার, নতুনের সঙ্গে পরিচয়ের। লেখকের দৃষ্টি এখানে ইতিহাসে নয়, একান্তে। ইতিহাসের খাত বেয়ে অবিভক্ত পূর্ব ভারত থেকে সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তানে এক পরিবারের যাত্রার অস্ফুট ছবি এখানে ফুটে উঠেছে ইশারাভরা কোমল ও স্নিগ্ধ ভাষায়। রাজনীতির মহাতরঙ্গ কীভাবে ব্যক্তিমানুষের তটে আছড়ে পড়ে প্রবল বা প্রচ্ছন্নভাবে তার জীবনধারার ছক পালটে দেয়, বাংলার পটে এ তার এক অনন্য চিত্র।

ছোট ছোট দুটো অধ্যায়ে দ্রুত অাঁচড়ে কিন্তু পরম মমতায় মা ও বাবার চেহারার একটি আভাস ফারুক চৌধুরী রচনা করেছেন। বেশ আন্দাজ করা যায়, চাকরিসূত্রে বাবার স্থানান্তরণ যেমন লেখকের শৈশব-কৈশোর জীবনকে আন্দোলিত করেছে, তেমনি তাঁর রসবোধ ও পাঠরুচি লেখককে প্রভাবিত করেছে ভেতর থেকে। বস্ত্তত প্রথাগত অর্থে লেখক না হলেও ফারুক চৌধুরীর ভাষাব্যবহার, বর্ণনার কুশলতা এবং কোনো ঘটনার বর্ণনায় পাঠকের কৌতূহল জাগিয়ে রাখার ক্ষমতা অতুলনীয়। এ সম্ভবত সেই পাঠরুচিরই গভীরতর প্রভাব। আর রসবোধে তো ফারুক চৌধুরীর জুড়ি মেলা ভার। বইটির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত স্নিগ্ধ কৌতুক। এই কৌতুকরসের তীরে তিনি নিজেকেও বিদ্ধ করেন বলে এর আবেদন আরো বেড়ে যায়।

দু-একটি উদাহরণ না দিলেই নয় :

মনে পড়ে রসায়নশাস্ত্রে আমার জ্ঞান আহরণের চরম ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। হলে, ঢাকার বর্তমান দুঃখজনক চিকিৎসাব্যবস্থার অবনতিতে আমার অবদান হতো সুনিশ্চিত। ডাক্তারি দূরের কথা, ইন্টারমিডিয়েটের রসায়নশাস্ত্রে সামান্যতম জ্ঞানলাভেও আমার ছিল অপারগতা ও অনীহা। আমার সহপাঠীরা গবেষণাগারে যখন ধাতব লবণের ধাতু (বেসিক র‌্যাডিক্যাল) এবং অম্লীয় যৌগমূলক (অ্যাসিড র‌্যাডিক্যাল) নির্ণয়ে সক্ষম হতো, তখন আমার মনে হতো নোবেল প্রাইজই তাদের প্রাপ্য।... রসায়নশাস্ত্রে আমার প্রধান ভরসা ছিলেন উর্দুভাষী, ঢাকা কলেজের বহু পুরোনো ল্যাবরেটরি সহায়ক, হানিফ মোহাম্মদ। ম্যাট্রিকে উর্দুতে ‘লেটার’ পাওয়া আমার ভাষাটির ওপর কিছুটা দখল ছিল, আর তার সঙ্গে দুই-পাঁচ টাকা হাতে তুলে দিলে আমার উর্দু হয়তো হানিফ মোহাম্মদের কানে বিশুদ্ধই শোনাত। প্রসন্নচিত্তে ধাতব লবণ হাতে নিয়ে তিনি কানে কানে বলে দিতেন আমার সে দিনের সমস্যাটি সোডিয়াম নাইট্রেট না পটাশিয়াম ক্লোরাইড।... আমাদের বহিরাগত পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোকাররম হোসেন।... ড. মোকাররম আমাকে ধাতব লবণ সম্বন্ধে একটিও প্রশ্ন করলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন :

বলো, ‘ইনফিনিটি’ কী?

‘ইনফিনিটি’র সঙ্গে রসায়নশাস্ত্র অথবা ধাতব লবণের কোনো সম্পর্ক আছে কি না আমার জানা ছিল না। আমার মনে হলো, প্রশ্নটি সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক। দ্রুত চিন্তা করেই নিবেদন করলাম :

স্যার, সংখ্যা ‘১’ লিখে অনন্তকাল ধরে যদি শূন্য লেখা যায়, সেটাই হবে ইনফিনিটি।

তার পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে বিস্ময়বিস্ফারিত নয়নে আমার দিকে তাকালেন ড. মোকাররম।

ফারুক চৌধুরী বর্ণনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর হলের জীবন :

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৪৭ নম্বর কামরায় আমরা প্রথমে থাকতাম তিনজন, যার একজন মুনাওয়ার (প্রয়াত) ছিল আমার মতোই টেনিসে উৎসাহী। আমার কামরায় নিয়মিত আড্ডা হতো, কিন্তু নিয়মিত লেখাপড়া করার ছিল না কোনো তাড়া। ক’মাস পর একজন নতুন রুমমেটের উদয় হলো। কিছুদিন থাকার পর সে যখন বুঝল যে তার বাড়ি থেকে পাঠানো টিনের মুড়ি অস্বাভাবিক দ্রুততায় নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে, তখন হাউস টিউটরের অনুমতি নিয়ে মুড়িবিহীন ক্ষুধার রাজ্যে আমাদের ফেলে রেখে সে কামরা বদল করল।

এসব তো আনন্দময় তারুণ্যদিনের ঘটনা। এমনকি ইতিহাসের নিষ্করুণ কোনো ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময়ও এই কৌতুকদৃষ্টি ফারুক চৌধুরী হারিয়ে ফেলেন না। এই রসবোধ জীবনের বালুকাবেলায় বইটির প্রাণ।
দুই


‘আমাদের ইতিহাসের একটি অসাধারণ এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়েই জীবন কাটিয়েছি - তিন পতাকার নিচে; অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান আর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে। পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায়।’ বলেছেন বটে ফারুক চৌধুরী। এ-বইয়ের মূল উপজীব্য কিন্তু লেখকের কূটনীতিক-জীবনের ইতিকথা, যে-জীবনে ‘শুধু কী করেছি নয়, কী দেখেছি তা-ও যথেষ্ট আগ্রহ-উদ্দীপক’। বটে। বিগত শতাব্দীর মধ্য পর্যায়ে, ১৯৫৬ সালে, তিনি যোগ দেন পররাষ্ট্র দফতরে। আশির দশকের উপান্ত পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ পেশাজীবনকালে এ-উপমহাদেশের ইতিহাসের ওপর দিয়ে কী ঝঞ্ঝামুখর ঝোড়ো হাওয়াই না বয়ে গেল। বিলয় ঘটল পাকিস্তান রাষ্ট্রের, অভ্যুদয় হলো নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। রাজনীতির বহু নায়ক পরিণত হলো খলনায়কে। নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হলেন বহু রাষ্ট্রনায়ক। এরকম বহু ঘটনা তিনি দেখেছেন বেশ কাছ থেকে। সংস্পর্শে এসেছেন দেশ-বিদেশের বহু রাজনীতিবিদের। আনুষ্ঠানিকতার নির্মোকের অন্তরালে ধরা পড়েছে অনেকের মানুষী সত্তা।

১৯৬৩ সালে মওলানা ভাসানী যখন গণচীনে বেড়াতে গেলেন, দূতাবাসে কর্মরত ফারুক চৌধুরীকে দেওয়া হলো তাঁর দোভাষীর দায়িত্বভার। সেই সফরের সূত্রে লেখকের কলমে ধরা পড়ে ভাসানীর সহজ-সরল কিন্তু কৌতূহলী এক অকপট সত্তা। নানা কিছু দেখার ফাঁকে চীনের জেলখানা-দর্শন ও শেষ সম্রাট পু ইর সাক্ষাৎ কামনা করেন ভাসানী। গণচীনের লৌহকঠিন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, নানা কান্ডের পরে, তাঁর দুই ব্যতিক্রমী অনুরোধই রক্ষা করে সরকার।

জেলখানায় গিয়ে সুদর্শনা এক তরুণীর সঙ্গে তাঁদের দেখা। কী অপরাধ সে মেয়ের? জানানো হয়, ‘এই মেয়েটি ছিল লোভী। লোভের বশে অর্থের প্রত্যাশায় একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির কাছে সে তার প্রেম নিবেদন করত। তাই তাকে মৃদু শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’ দোভাষী ফারুক চৌধুরী বাংলায় কথাটা বুঝিয়ে বলতে না বলতেই মওলানার মন্তব্য - ‘ও, বুঝেছি। মেয়েটি বেশ্যা।’ তাদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে বেশ্যাবৃত্তি আছে, এ-কথাটা চীনারা স্বীকার করে না বলে কথাটি তারা ঘুরিয়ে বলেছে।

সম্রাট পু ইর সমস্যা আবার বিচিত্র। একসময় অর্থের কোনো মূল্য ছিল না তাঁর কাছে। এক কেজি সোনা আর এক কেজি আপেলে কী তফাৎ, রাজা হিসেবে তা বোঝার কখনো কোনো দরকার পড়েনি তাঁর। চীনে সমাজতন্ত্র আসার পরে কোন জিনিসের দাম কম আর কোনটির বেশি, সেটি বুঝে উঠতে বড্ড বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে।

আবার মওলানার সঙ্গে এ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার বিপরীতে আছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শঠতাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। নভেম্বর ১৯৭০-এ ইয়াহিয়া যাবেন পাঁচদিনের সফরে চীনে। প্রথা অনুযায়ী সফরের আগে চীনের রাষ্ট্রদূত চাং তুন দেখা করবেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। এরকম সাক্ষাৎকালে পররাষ্ট্র দফতরের সংশ্লিষ্ট পরিচালককে হাজির থাকতে হয় বলে ফারুক চৌধুরীও উপস্থিত। পুরো সাক্ষাৎপর্বটিই হলো খাপছাড়া ও অদ্ভুতুড়ে। লেখক সেদিন এর কারণ বুঝতে পারেননি। তিনি লিখছেন :

আজ আমি বিশ্বাস করি যে সেদিনকার সেই সাক্ষাৎকার ছিল লোকদেখানো অভিনয়, যাতে করে পররাষ্ট্র দপ্তর আর সরকারের অন্যান্য মহল বিশ্বাস করে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চীন সফর একটি সাধারণ দ্বিপক্ষীয় সফর।... চীনে ইয়াহিয়া খানের সেই সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকা আর চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে দূতিয়ালির ভূমিকা পালন। বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল সম্পূর্ণভাবে সেই গোপনীয়তা রক্ষা করার। সে কথা আজ আমরা হেনরি কিসিঞ্জার অথবা জি ডব্লিউ চৌধুরীর বই কিংবা অন্যান্য প্রকাশনা থেকে জানতে পেরেছি। সেই সময়ে তদানীন্তন ইয়াহিয়া খান মন্ত্রিসভার সদস্য জি ডব্লিউ চৌধুরী আর সম্ভবত পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খান ছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য কেউ জানতেন না। এঁরা দুজনই ছিলেন পিকিংয়ে ইয়াহিয়া খানের সফরসঙ্গী। আর বাকি আমাদের মতো সফরসঙ্গীরা ছিলাম আমাদের অজান্তে গোপনীয়তা রক্ষায় এই বিরাট প্রচেষ্টায়, প্রয়োজনীয় কিছু অতিরিক্ত।

সে-সফরে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল যখন পিকিংয়ে ছিল, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই তখন ঘনঘন অতিথিভবনে আসতেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে রোজই তাঁর একান্ত বৈঠক হতো। সে-বৈঠকে ইয়াহিয়ার সময় ব্যয়িত হতো চীন-আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দূতিয়ালিতে। এসব বৈঠকের গভীরতর প্রভাবে একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

এ-বইয়ের সবচেয়ে প্রাণবন্ত পর্ব সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে লেখকের অভিজ্ঞতার সংশ্লিষ্ট অংশটুকু। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন, স্বাধীন বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গড়ে তোলার প্রাথমিক দিন, একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও প্রায়োগিক পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ ও প্রজ্ঞা, লন্ডনে শেখ মুজিবের চিকিৎসাকালে তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য, শেখ মুজিবের পররাষ্ট্র-ভাবনা - এসব প্রসঙ্গ লেখক যত্ন ও মমতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ তখনো মুজিবশূন্য। শেখ মুজিব তখনো পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ। কবে মুক্তি পাবেন, তা অনিশ্চিত। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মত গড়ে তুলতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে ভারত-সফরে গিয়েছেন তাঁরা। ফারুক চৌধুরী লিখছেন :

সেখানে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক চলছে। অকস্মাৎ সম্মেলনকক্ষের দরজাটি সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত। চোখেমুখে তাঁর উত্তেজনার ছাপ।

এইমাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। খবর এসেছে তিনি ইতিমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।

ভেঙে গেল বৈঠক, সম্মেলনকক্ষটি ভেঙে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে। নিমেষে একটি সাধারণ দিন স্মৃতির মণিকোঠায় প্রবিষ্ট হলো অসাধারণের বেশে। উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোর স্মৃতিধারণ সুকঠিন। সেই মুহূর্তগুলোর ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত। তাদের বর্ণনা দুরূহ।

অবশেষে ব্রিটিশ বিমানে করে সে-সময়ের ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এসে নামলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। লেখক দিয়েছেন তার অভূতপূর্ব বর্ণনা :

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি গিরি, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দুপাশের জনতা।... স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি।...

বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তাঁর পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তাঁর ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ...।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সংগীত।

যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু কীভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করলেন লেখক শুধু তার বর্ণনা দেননি, বিশদ বিশ্লেষণও তুলে ধরেছেন। এসব বিশ্লেষণ বহু ঘটনাকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে।

বইটিতে নানা প্রসঙ্গের আলোচনায় ফারুক চৌধুরীর আরেকটি যে-মৌল ভাবনা লক্ষ করা যায় তা হলো, বিস্তৃত এই উপমহাদেশ ও এর সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যে একটি কার্যকর সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা। সার্কের ভাবনা, প্রতিষ্ঠা ও কয়েকটি সার্ক সম্মেলন আয়োজনের যে বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে এ-ভাবনার বিচ্ছুরণ লক্ষ করা যাবে। সার্কের ভাবনার পেছনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা তিনি যেমন উল্লেখ করেছেন; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে এ-বাসনাটি প্রথম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন, সেটিও তুলে ধরেছেন সযত্নে।

লেখক তখন আবুধাবিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শেখ জায়েদের দেওয়া নৈশভোজ শেষে প্রেসিডেন্টের কাছে বিদায় নিতে গেছেন লেখক।

যখন বিদায় নিতে যাব, বললেন, ‘বসুন, আরও একটু। আরও একটি কথা আছে। ঢাকায় একটি ব্যাপারে আমরা ভাবছি। আমাদের অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আমরা কেন বাড়াতে পারি না? এই সংযুক্ত আমিরাতে এসেও দেখছি বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা পারস্পরিক সহযোগিতায় এই দেশ আর এই অঞ্চলকে গড়ে তুলছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। সুদূরে এসে আমাদের অঞ্চলের অধিবাসীদের এই সৌহার্দ্য, সম্পৃক্তি ও সহযোগিতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু আমাদের নিজেদের অঞ্চলে কেন আমরা এই সহমর্মিতা স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছি? আমাদের এ ব্যাপারে কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে।’ জিয়া থামলেন।

সহজ চিন্তা। সরল যুক্তি। অ-জটিল ভাবনা। কিন্তু ইতিহাসের সব মহান সাফল্যের গোড়াতেই রয়েছে অতিসাধারণ চিন্তাধারা। অসাধারণ জন্ম নেয় সাধারণকেই কেন্দ্র করে। অসাধারণের সৃষ্টি সাধারণের সম্পৃক্তিতে। তার পরের বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা আজ ইতিহাসেরই অঙ্গ।

পরে - ১৯৮০ সালে - ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের সরকারপ্রধানদের কাছে এক বার্তায় জিয়া লেখেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে, যাতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়... দক্ষিণ এশিয়াই পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল, যেখানে কোনো আশাবাদ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা চলছে না।’ এ-ভাবনায় লেখক উদ্দীপিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু এর পর বাংলাদেশে পানি গড়িয়ে যায় অনেক দূর। লেখক যখন বেলজিয়ামে কর্মরত, সে-সময় নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন জিয়াউর রহমান। অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থানে অস্থির দেশে নানা নিয়ম-অনিয়ম পেরিয়ে লেখক অবশেষে পান পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব। অদ্ভুত নিয়তিচক্রে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের ভার তাঁর ওপরই বর্তায়। লেখক সে-আয়োজনের বিবরণ দিয়েছেন কাব্যমাখা আবেগপূর্ণ ভাষায়।



তিন

ফারুক চৌধুরীর অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণে দেশের ও উপমহাদেশের বহু ইতিহাস-রচনা করা মুহূর্ত ধরা পড়েছে বটে। তাই বলে অম্লমধুর ছোটখাটো ঘটনা তিনি এড়িয়ে যাননি। আর তার মধ্যে ধরা পড়েছে বড় বড় মানুষের ছক-কাটা চেহারার অন্তরালে তাঁদের চকিত মানবিক মুহূর্ত। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের ধর্মান্তরিত স্ত্রী রানা লিয়াকতের উদারতা ও শেষ জীবনের নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি বুমেদিয়ানের দক্ষতা, বেলজিয়ামের রাজা বঁদোয়াকে রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ করার সময়কার হাস্যপরিহাসময় ঘটনা, প্রিন্স চার্লসের হাস্যরস, মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলির প্রত্যুৎপন্নমতি ও ঢাকার সার্ক সম্মেলনে কাশ্মিরের বিতর্কিত সীমান্তচিহ্নিত ডাকটিকিট নিয়ে রাজীব গান্ধী-জিয়াউল হককে নিয়ে উত্তেজনাময় প্রহর - এমন অসংখ্য প্রসঙ্গ বইটিকে মুক্তাখচিত অলংকারের সৌন্দর্য দিয়েছে।

ফারুক চৌধুরীর বড় গুণ তাঁর ইতিবাচক মানসিকতা। রাজনীতির নায়ক বা খলনায়ক যাঁর প্রসঙ্গেই তিনি উত্থাপন করুন না কেন, প্রথমেই তাঁকে ভালো বা মন্দের সাদায়-কালোয় বিভাজিত প্রকোষ্ঠের দিকে ঠেলে দেন না। তাঁদের ভেতরকার নানা রঙে মেশানো মানুষী সত্তাটিই যেন তাঁর অন্বিষ্ট। যখন তিনি তাঁদের ইতিহাসের পটে রেখে বিচার করছেন, তখন নিজের বিবেচনা ও মূল্য তিনি আরোপ করছেন। কিন্তু যখন তাঁদের সাহচর্যে আসছেন, ইতিহাসপট থেকে নামিয়ে আনছেন তাঁদের। তাঁদের নিজস্ব চরিত্রগুণ ও মানবিক মাত্রাটিই ফারুক চৌধুরীর কাছে মুখ্য। তাঁর বইয়ের কোথাও তাই কোনো তিক্ততার রেশ নেই। তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে যে অন্তর্বাণীটি ঘোষিত হচ্ছে, তা হলো ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’

এ-বইয়ের নানা প্রসঙ্গের ফাঁকে ফাঁকে গোপন অন্তঃস্রোতের মতো আর যে-বিষয়টি বয়ে চলেছে, তা হলো, নানা দেশের বিচিত্র ও উৎকৃষ্ট খাদ্যের প্রতি ফারুক চৌধুরীর অপরিমেয় আগ্রহ। যেন যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, সেখানকার খাবার চেখে না দেখলে পূর্ণ উপলব্ধি সম্পূর্ণ হচ্ছে না। ফলে ভুটানের কাঁচামরিচের সঙ্গে রাঁধা ঝাল পনির; কাশ্মিরের গুজতাবা, ইয়াখনি, রোগন জোশ; বাগদাদের মাসগুফ; চীনের মাওতাই; রোমে গালিয়াজ্জি রেস্তোরাঁর মুরগির কাচ্চাতোরে ইত্যাদি খাদ্য ও পানীয়ের মৌতাতে যে বইটি ভরে উঠবে, তা আর বিচিত্র কি!

বইটির শেষ অংশে যুক্ত হয়েছে ব্র্যাকের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতার পর্বটি। ব্র্যাক কীভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এখানে আছে। তবে এ-কথা বলতেই হয়, লেখক তাঁর পরিব্যাপ্ত কূটনৈতিক জীবনের মধ্য দিয়ে দুই ভিন্ন রাষ্ট্রকাঠামোয় উপমহাদেশের বিস্তৃত ইতিহাসপটের যে-অন্তরঙ্গ চেহারাটি মেলে ধরেছেন, সমাপ্তি পর্ব হিসেবে শেষ এ-অংশটি তার ছন্দপতন ঘটায়। এটি আলাদা বই হলে পৃথক পরিপ্রেক্ষিতে দুটো মূল্যবান স্বতন্ত্র বই হতে পারত।

লেখক নিজে বলেছেন এবং আমরাও দেখেছি, আত্মজীবনীতে লেখকের যে-ব্যক্তিস্বরূপকে খুঁড়ে তুলে ধরা হয়, এ-বইটি তা নয়। কিন্তু তাতে এ-বইয়ের গুরুত্ব মোটেই কমে না। এ-বই আমাদের ইতিহাসের বহু মোড়-ফেরানো ঘটনার অন্দরমহলে নিয়ে যায়। এ-বই বরং আমাদের প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে দিলো। আমরা এবার তাঁর একটি যথার্থ আত্মজীবনী প্রত্যাশা করতে পারি।

ফারুক চৌধুরী বইটিতে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি তাঁকে প্রতি বছর অন্তত একটি করে চিঠি লিখছেন। আর তাতে ধরে রাখছেন তাঁদের সুবিশাল পরিবারের নানামুখী বিবর্তন। সেগুলো গাঁথতে পারলে ‘তা হবে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক আর সমকালীন নানা টানাপোড়েনে, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অপকেন্দ্রিক টানে ছড়িয়ে পড়া একটি পরিবারের নানা মনের আর নানা পেশার মানুষগুলোর ক্রমে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিয়োগান্ত একটি কাহিনি।’ আমরা যারা জীবনের বালুকাবেলায় পড়েছি তারা সে-বইটি লেখার জন্য ফারুক চৌধুরীর কাছে দাবি জানাব।

ফারুক চৌধুরীর বাবার মৃত্যু হয়েছিল নিদারুণ এক সড়ক দুর্ঘটনায়। দুই ভাই ফারুক চৌধুরী ও ইনাম আহমেদ চৌধুরীও সে-গাড়িতে বাবার সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তাঁদের তখন বরাভয় দিয়েছিল বাবার এই বাণী যে, ‘জীবনে যদি বিপদের মুখোমুখি হও, এটা মনে রেখো যে যা ঘটেছে তার চেয়েও ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারত।’ বাবার এই আর্ষোক্তি স্মরণ করে লেখক বলছেন, ‘হ্যাঁ, তা-ই ঘটত, যদি একটি সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত উঠন্ত পরিবার থেকে আমরা তিনজন একযোগে অন্তর্হিত হতাম।’

আমরা অকিঞ্চিৎকর পাঠকেরা বলব, হ্যাঁ, তা-ই, জীবনের বালুকাবেলায় বইটি আমরা পেতাম কোথায়?
Jiboner Balukabelay - Faruq Choudhury
Download